কিস্সা বলেন শেহ্রজাদে

রবিশংকর বল

\ ১১ \

 

শেহ্রজাদে একটা গল্প বলেছিল। সিমন ম্যাগাসের গল্প। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে তার পরিচয় জাদুকর সিমন হিসেবে। খ্রিষ্টান অর্থোডক্স ধর্মগ্রন্থেও তাকে জাদুকর বলা হয়েছে। আইন ভাঙার দায়ে সে অভিযুক্ত; ঈশ্বর ও ঈশ্বরপুত্রের বিরোধিতাই তার লক্ষ্য। সে না কি নিজের ইচ্ছামতো উড়তে পারত।

নাজারেথের যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের সতেরো বছর পর সামারিয়াতে এসে পৌঁছেছিল সিমন। অনুগামীরা তাকে বলত ম্যাগাস – ধর্মগুরু :  বিরোধীদের কাছে সে জাদুকর। কারোর মতে, সে এসেছিল সামারিয়ার হতদরিদ্র গ্রাম গিত্তা থেকে; অন্যরা বলত, অ্যান্টোনিয়াস ও র‌্যাচেলের পুত্র সিমন এসেছিল আনাতোলিয়া তথা সিরিয়া থেকে। তার বাড়ি কোথায়, জিজ্ঞেস করলে সিমন হেসে, হাত নেড়ে প্রশ্নটাকে উড়িয়ে দিত। বেশি জোরাজোরি করলে বলত, ‘কেন, রাস্তাটা ঘর হতে পারে না?’ সিমন তার অনুগামীদের বলেছিল, ‘মানুষ এই দুনিয়ায় এসেছে পথে-পথে হাঁটার জন্যই। তার সঞ্চয় বলতে একমুঠো ধুলো।’

সিমনের একটা চোখ অন্য চোখের চেয়ে বড় ছিল; ফলে তার মুখ দেখে সবসময়ই মনে হতো, সে মজা করছে। বিদ্রূপের বিদ্যুৎঝলক লুকিয়ে রেখেছে দৃষ্টিতে। কোঁকড়ানো, কালো চুল, কিন্তু দাড়ি-গোঁফ প্রায় সাদা হয়ে গিয়েছিল। বাঁ কানে সোনার দুল, একটা সাপ লেজ থেকে নিজেকেই খাচ্ছে।

রঘুপতি শেহ্রজাদেকে বলেছিল, ‘মহাভারতেও এমন একটা সাপ আছে, লেজ থেকে নিজেকেই খাচ্ছে।’

শেহ্রজাদে হেসে বলে, ‘সময় তো সব জায়গাতেই একইরকম।’

সিমনের কোমরে পেঁচানো থাকত দড়ি, যা দিয়ে সে জাদুর খেলা দেখাত। সে আদেশ করলেই দড়ি আকাশের দিকে মাথা করে সোজা হয়ে দাঁড়াত আর সবাইকে বিস্মিত করে সিমন। দড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যেত। আশ্চর্য সব জাদুর খেলা দেখাত সে। ভেড়ার মুণ্ডু তলোয়ারের এক কোপে কেটে, মন্ত্র পড়তে-পড়তে আবার জুড়ে দিত।

একই সঙ্গে গ্রিক, আরামাইক, হিব্রম্ন ভাষায় কথা বলতে পারত সে। মজা করা আর কথার পিঠে কথা সাজানোয় সিমনের ওস্তাদির তারিফ করত তার শত্রম্নরাও। কথা বলার সময় চোখদুটো জ্বলজ্বল করত তার; মনে হতো, কোনো শক্তি তার ওপর ভর করেছে, উন্মাদের মত মাথা ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে কথা বলত সে।

তখন জন ও পল এবং তাদের অনুগামীরা যিশুর বাণী প্রচার করে বেড়াচ্ছে। সিমন লুকিয়ে থেকে তাদের কথা শুনত। ঈশ্বরের পৃথিবী কত নিখুঁত, ঈশ্বরপুত্র এসেছিলেন সব মানুষের ত্রাণের জন্য – গ্রামের পর গ্রামে খ্রিষ্টের প্রচারকরা এমন বার্তাই পৌঁছে দিচ্ছে। তারা চলে যেতেই সিমন জনসমক্ষে বেরিয়ে আসত। তখন গ্রামের মানুষদের সিমনের কথা শোনার আর ধৈর্য নেই। তবু সে বলতে শুরু করত, ‘আমি ধর্মগুরু নই। তোমাদেরই তো হেটোমেঠো মানুষ। ধর্মগুরুরা মানুষের মাথায় হাত রেখে ঈশ্বর আর ঈশ্বরপুত্রের কথা শোনায়। ধুলো-কাদা থেকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য আমি তোমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। ধর্মগুরুরা তোমাদের মুক্তির কথা বলেছে। আমি দিতে পারি জ্ঞান ও মরুযাত্রার তৃষ্ণা। যার ইচ্ছা আমার সঙ্গে আসতে পারো।’

গ্রামের মানুষেরা দেখেছে, নাজারেথের যিশুর মৃত্যুর পর গত পনেরো বছর ধরে যারা আসছে, তারা সবাই নিজেদের ঈশ্বরপুত্র হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা সবাই একই কথা বলে যায়। যিশু খ্রিষ্টের একই অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করে। কীভাবে তিনি জলকে সুরায় পরিণত করেছিলেন, কয়েকটি মাছ দিয়ে অগণিত মানুষের খিদে মিটিয়েছিলেন। অনেকে না কি দেখেছে, তিনি চোখ ধাঁধানো আলোর মত আকাশে উঠে গেলেন, তারপর স্বর্গে পৌঁছলেন। অন্ধকে ফিরিয়ে দিয়েছেন দৃষ্টি। প্রচারকদের একই কথা শুনতে-শুনতে গ্রামের মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এক টুকরো রুটি আর এক পাত্র সুরার বিনিময়ে তারা গ্রামবাসীদের স্বর্গীয় জীবন দেওয়ার কথা বলে। আর যখন তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়, লেলিয়ে দেওয়া হয় কুকুর, তখন ঈশ্বরপুত্ররা অভিশাপ দিতে থাকে। নরকে জায়গা হবে তোমাদের। সেখানে আগুনে পুড়বে তোমাদের মাংস।

প্রথমে স্বর্গের বাগানে সুখী জীবনের কথা বিশ্বাস করত না গ্রামের মানুষরা। এমন জায়গা কোথায়, যেখানে সবসময় সূর্যের আলো দেখা যায়, যেখানে কোনো যন্ত্রণা বা মৃত্যু নেই? কিন্তু ঈশ্বরপুত্ররা এমন জোরের সঙ্গে কথাগুলো বলে, গ্রামবাসী একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করে। একটা মিথ্যা বারবার বলা হলে মানুষ তা বিশ্বাস করে। কোনো না কোনো বিশ্বাস ছাড়া তো মানুষ বাঁচতে পারে না। সন্দেহবাদীদের কী করে জয় করতে হয়, তা জানত ধর্মগুরুরা। কখনো মিষ্টি কথা বলে, কখনো হুমকি দিয়ে, কখনো-বা ঘুষ দিয়ে। তারা সংখ্যায় যত বাড়তে লাগল, ততই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠল। তাদের নিজস্ব বিচারসভায় অবিশ্বাসীদের শান্তি দিতে শুরু করল, বিরোধী মতাবলম্বীদের লেখাপত্র পোড়াতে লাগল।

এই সময়ে সিমন এসে পৌঁছেছিল সামারিয়াতে। সে প্রচার করতে শুরু করল, ধর্মগুরুদের ঈশ্বর-অত্যাচারী, তাই সে কখনো মানুষের ঈশ্বর হতে পারে না। তাদের ঈশ্বর – জিহোভা মানুষকে ঘৃণা করে, হত্যা করে, মারক বীজ ছড়িয়ে দেয় গ্রামে-গ্রামে, খরা ও বন্যা নিয়ে আসে, দুঃস্বপ্ন ও নিদ্রাহীনতায় জাগিয়ে রাখে মানুষকে। আমাদের পূর্বপুরুষদের স্বর্গের বাগানে জায়গা দিলেও সবচেয়ে মিষ্টি ফল খেতে দেয়নি। তাই মানুষ ভাল আর মন্দের পার্থক্য শেখেনি। আমাদের দুর্ভাগা পূর্বপুরুষরা সেই ফল নিতে গেলে ঈশ্বর তাদের কুষ্ঠরোগীদের মত তাড়িয়ে দিলো, তার হাতে তখন আগ্নেয় তরবারি। কেন? এই ঈশ্বর জানে শুধু ঘৃণা ও হিংসা। স্বাধীনতার বদলে সে দিতে চায় দাসত্ব, জ্ঞানের পরিবর্তে ধরাবাঁধা বুলি…

সিমন উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করতে থাকে, ‘সামারিয়ার মানুষরা, বলো, ঈশ্বর কি তোমাদের ঘর ভেঙে দেয়নি? খরা নিয়ে আসেনি? ভয়ংকর পেস্নগ কি তোমাদের জীবন উজাড় করে দেয়নি? তাহলে কেমন সে ঈশ্বর, কী তার বিচার, যে কখনো প্রতিহিংসা ভুলতে পারে না? পিটার, জন, পল – এরা ঈশ্বরের যে রাজত্বের কথা বলে তা সর্বৈব মিথ্যা। তাদের ঈশ্বরও মিথ্যা। যেখানে সবাই মিথ্যা বলে, সেখানে আলাদা করে আর মিথ্যা থাকে না। তাদের ধর্মগ্রন্থ মিথ্যা। যে-স্বর্গের কথা ঈশ্বরপুত্ররা বলে, তা মিথ্যা, কেননা সেই স্বর্গ তাদেরই হাতে, স্বর্গের দরজায় তারাই দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা বলে, হত্যা করো না। কিন্তু ওদের ঈশ্বরই তো হত্যাকারী।’

সিমন দেখে, একে-একে সবাই চলে যাচ্ছে, শুধু তার অনুগামীরা কয়েকজন রয়ে গেছে। আর সোফিয়া। বছরতিরিশের এই ছোটখাটো মহিলার চোখদুটি বড় গভীর। সেই দৃষ্টি থেকে চোখ ফেরাতে পারে না সিমন। সিমনের অনুগামীদের কাছে সোফিয়া সৌন্দর্য ও জ্ঞানের প্রতীক। খ্রিষ্টানরা তার নামে অনেক কুৎসা রটনা করেছে। সে ভ-  এবং বেশ্যা। সিমন সে-কথা শুনে হেসে বলেছে, ‘ঠিকই তো। সোফিয়া ছিল দাসরমণী, রক্ষিতা। এতেই তো জিহোভার নিষ্ঠুরতা, তার সৃষ্টির হিংস্রতা প্রমাণিত হয়।’ সোফিয়াকে পতিত দেবদূত মনে করত সিমন, বহু শতাব্দী ধরে নানা রূপে সে জন্মগ্রহণে করেছে আর বর্তমান জন্মে সিরিয়ার বেশ্যালয়ের পতিতা।

এমন সময় পিটার ও তার শিষ্যদের দেখতে পেল সিমন। তারা সিমনের সামনে এসে দাঁড়াল। পিটার বলল, ‘ঈশ্বরপুত্র অনেক যন্ত্রণা সয়েছেন। তাঁর অলৌকিকতা তাঁর ন্যায়পরায়ণতারই প্রমাণ।’

সিমন হেসে উঠল, ‘অলৌকিকতা ন্যায়পরায়ণতার প্রমাণ হতে পারে না। এসব তোমাদের যিশুখ্রিষ্টের পাগলামি।’

– তুমি কী জানো অলৌকিকের?

– দেখবে? আমি এখনই আকাশে উড়ে যেতে পারি।

– আমি দেখতে চাই। পিটার কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলল।

সিমন বলল, ‘আমি সপ্তম স্বর্গ পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না। তার আগে পর্যন্ত পারব। একমাত্র চিন্তাই সপ্তম স্বর্গে পৌঁছতে পারে, কেননা সেখানে সব আলোকিত, সুখময়। মানষ কখনো চূড়ান্ত সুখ পেতে পারে না।’

পিটারের এক শিষ্য বলে উঠল, ‘তুমি ওই মেঘ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই ঈশ্বরপুত্রের মত শ্রদ্ধা করব তোমাকে।’

সিমনের কা- দেখার জন্য আবার লোক জড়ো হয়ে গেল। বাকতেল্লাবাজটা কী করে, দেখা যাক। দরবেশদের মতো না কি খেলা দেখাবে! সিমন তার কোমরে পেঁচানো দড়ি খুলে ফেলে পায়ের কাছে রাখল।

সোফিয়া এগিয়ে এসে বলল, ‘এই ছোট্ট চাদরটা নিয়ে যাও। মেঘের দেশে খুব ঠান্ডা হবে।’ বলতে-বলতে সে চাদরটা সিমনের গলায় জড়িয়ে দিলো। সোফিয়ার কপালে চুমু দিয়ে সিমন বলল, ‘বিদায়’।

একজন শিষ্য হেসে বলল, ‘দেখো, ঠান্ডা লাগিও না।’

এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে সিমন দু-পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠল, তার দুই হাত ডানার মতো প্রসারিত। কে একজন ডেকে উঠল, ‘ককর-কঁ, ককর-কঁ।’ সিমন বেঁটে লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাজটা সহজ নয়, ভাই। পৃথিবীর একটা টান আছে, পালককেও তা টানে। আর মানুষের মত ওজনদারকে তো টানবেই নিজের দিকে।’

সবাই দেখল, সিমন ম্যাগাস মাটি ছেড়ে উঠছে – উঁচু থেকে উঁচুতে – দুই হাত ডানার মতো ঝাপটাচ্ছে, তার চুল, দাড়ি-গোঁফ হাওয়ায় উড়ছে। মানুষের ভিড় নীরব হয়ে গেল। তাদের চোখ আকাশের দিকে স্থির।

পিটারকে পাথরের মূর্তির মত মনে হচ্ছে। বিস্ময়ে তার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। অলৌকিক ক্ষমতা তো শুধু খ্রিষ্টানদেরই দেওয়া হয় আর খ্রিষ্টানদের মধ্যে তারাই সেই ক্ষমতা পায়, যাঁর বিশ্বাস পাহাড়ের মত স্থির। যেমন ঈশ্বরপুত্র। দুই চোখ ঘষে আবার তাকাল পিটার, যেখানে সিমন দাঁড়িয়ে আছে। সাদা মেঘের প্রেক্ষাপটে সিমনকে ছায়ামূর্তির মতো দেখাচ্ছে। মনে হল, এক দৈতাকৃতির ঈগল। কিন্তু সিমনকে এখন আর চেনা যাচ্ছে না, যেহেতু এত নিচু থেকে তার মুখ বোঝা যায় না। যদি সে সত্যিই সিমন হয়, তাহলে খ্রিষ্টানদের অলৌকিকতা ও বিশ্বাসের সত্য তো চূড়ান্ত নয়। এ-পৃথিবীর অন্যান্য সত্যের মতোই আরেকটি সত্য। গোটা পৃথিবীই তাহলে রহস্যময়, বিশ্বাস এক মায়া, জীবনের কোনো ভিত্তি নেই, মানুষও এক রহস্য, পৃথিবী ও সৃষ্টির ঐক্য আমাদের অজানা।

নীরবতা ভেঙে জনতার কণ্ঠে এবার বিস্ময়ের স্বর। তারা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, আভূমি প্রণত হয়। পিটারের কয়েকজন শিষ্যও শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। পৌত্তলিক সিমন এমন অলৌকিক ক্ষমতা কোথা থেকে পেল? পিটার চোখ বন্ধ করে হিব্রম্নতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে লাগল। এই মায়া ভেদ করার দৃষ্টি ও জ্ঞানদান করুন আমাকে। আপনার প্রতি বিশ্বাসে, আপনার পুত্রের প্রতি ভালবাসায় যাতে স্থিত থাকতে পারি।

ঈশ্বর পিটারকে বললেন, ‘মানুষকে বলো, এইসব মায়ার চেয়ে বিশ্বাস অনেক বড়। বলো, ঈশ্বর একজন, ঈশ্বরপুত্রও একজন, তার নাম যিশু আর পৃথিবীতে একটিই বিশ্বাস আছে, খ্রিষ্টান বিশ্বাস। আর সিমন, যে নিজেকে ধার্মিক বলে, সে ঈশ্বরের শিক্ষাকে অপবিত্র করেছে। সে এখন উড়ছে। সবাইকে বলো, আমিই এ-ক্ষমতা তাকে দিয়েছি। সব অলৌকিকতা আর ক্ষমতা একমাত্র আমারই আছে।’

ঈশ্বরের কথা শুনে পিটার সমবেত মানুষের উদ্দেশে বলতে লাগল, ‘শোনো সামারিয়ার জনগণ, তোমরা যে দেখেছো, তা শুধুই মায়া। এই জাদুকর এসব খেলা শিখে এসেছে ইজিপ্ট থেকে।’

– কিন্তু সে তার কথা রেখেছে। সোফিয়া বলে।

পিটার বলে যায়, ‘আমি দশ গোনার মধ্যেই সিমনের শরীর মাটিতে এসে আছড়ে পড়বে। আর সে কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবে না। একমেবাদ্বিতীয়ম ঈশ্বর তা-ই চান।’

– কিন্তু সিমন তো উড়েছে। সোফিয়া আবার বলে।

– এক… দুই…। পিটার গুনতে থাকে।

একসময় দেখা যায়, মেঘ থেকে সিমনের শরীর মাটির দিকে নেমে আসছে। একটু পরেই সিমনের দেহ, যেখান থেকে উড়ে গিয়েছিল, সেখানে এসে আছড়ে পড়ে। সোফিয়া তার দিকে দৌড়ে যায়, কিন্তু সিমনের রক্তাক্ত শরীরের দিকে তাকাতে পারে না। মাথার খুলি ভেঙে গেছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে গেছে, মুখ চেনা যায় না, বেরিয়ে এসেছে নাড়িভুঁড়ি, রক্তে ভেসে যাচ্ছে সিমন। শুধু কয়েকটা হাড় আর ম- হয়ে যাওয়া মাংস।

পিটার ও তার শিষ্যরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসছিল। সোফিয়া উঠে দাঁড়াল, গ্রামবাসীদের উদ্দেশে বলতে লাগল, ‘সিমন আমাদের যা শিখিয়েছে, এ তারই প্রমাণ। মানুষের জীবন আসলে পতন – আমরা নরকের ভিতরে আছি, – এই পৃথিবী অত্যাচারীদের হাতে। ঈশ্বর সবচেয়ে বড় অত্যাচারী।’

– এসব কথা কোথায় লেখা আছে শেহ্রজাদে? রঘুপতি জিজ্ঞেস করে।

– অনেক বইতে। খ্রিষ্টানরা সেসব বই প্রামাণ্য মনে করে না।

– প্রমাণ কী? প্রামাণ্য কী?

– পাথরের মত বিশ্বাস ছাড়া এই দুনিয়ায় প্রামাণ্য কিছুই নেই। কিছু প্রমাণ করাও যায় না। একমাত্র মৃত্যুই নিশ্চিত।

অনেকে সিমন ম্যাগাসের গল্প অন্যভাবেও জানে। সে নাকি সপ্তম স্বর্গকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি, বরং ফিরতে চেয়েছিল মাটি পৃথিবীর গর্ভে।

একদিন অলিভ গাছের নিচে দুই হাতের ওপর মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিল সিমন। সোফিয়া তার পাশেই বসেছিল, দুই পা ছড়িয়ে, খ্রিষ্টানদের মতে গর্ভবতী গাভির মত। তখন পিটার ও তার শিষ্যরা সেখানে এসে পৌঁছল। সোফিয়াকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে পিটারের এক শিষ্য সিমনকে এক দার্শনিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। পৃথিবীতে বীজ বুনে স্বর্গে তার ফসল তোলা, না বাতাসে নিজের বীজ ভাসিয়ে দেওয়া – কোনটা সবচেয়ে ভালো?

সিমনের উত্তর ছিল, ‘পৃথিবী তো পৃথিবীই। যেখানে বীজ বোনা হোক, সব একই। সত্যিকারের আত্মিক যোগাযোগ হয় নারী ও পুরুষের মিলনে।’

– যে-কোনো নারী আর পুরুষের মিলন? পিটার জিজ্ঞেস করে।

– নারী তো স্বর্গসুখের পাত্র। তোমরা কোনো কিছুর উত্তর না পেলেই তা থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকো।

এরপর সিমনের সঙ্গে ঈশ্বর, শান্তি, অনুতাপ, শরীর ও আত্মা, জীবনের অর্থ নিয়ে তর্ক চলতে থাকে। পিটার শেষে বলে, আত্মাই আদি ও অমত্ম্য। ঈশ্বর যাতে খুশি হন, তা-ই ভালো।’

সিমন হেসে বলে, ‘কোনো কাজই নিজে ভালো বা খারাপ নয়। ঈশ্বর নয়। নৈতিকতার সংজ্ঞা তৈরি করে মানুষ।’

– যাদের মনে এখনো ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দেহ আছে, তাদের কাছে তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণ করে অলৌকিক কাজ। পিটার বলে।

– কোনো কুমারীর ওপর আক্রমণের ক্ষতিপূরণ করতে পারবে তোমাদের ঈশ্বর?

– তিনি আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী।

– শারীরিক ক্ষমতা আছে?

-আছে তো বটেই। পিটার বলে। -তিনি কুষ্ঠরোগীদের আরোগ্য দান করেছেন –

সিমন হাসতে-হাসতে বলে,  ‘তিনি জলকে সুরায় পরিণত করেছন – ’

– হ্যাঁ। অলৌকিকই তাঁর ধর্ম ও পেশা।

– আমি জানতাম, চুতোরগিরি। শোনো নাজারেখের যিশুর মতো আমিও অলৌকিকতা দেখাতে পারি।

পিটারের এক শিষ্য বলে, ‘ইজিপ্টের বাজার থেকে শিখেছো তো জাদুর কেরামতি?’

– তোমাদের যিশুও নিশ্চয়ই সেখান থেকেই শিখেছে। আমাকে মাটির নিচে কবর দিয়ে দেখো। তিনদিনে যিশুর মতই পুনরুত্থান হবে আমার।

পিটারের এক শিষ্য কাছের গ্রামে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে নিয়ে এলো। তাদের পেছন-পেছন গ্রামবাসীরাও এলো। খবর পৌঁছেছিল, ইজিপ্টের এক জাদুকর এসেছে খেলা দেখাতে।

মাটি খুঁড়ে গভীর গর্ত তৈরি করা হল। কফিনও বানানো হলো। সোফিয়া তার ছোট্ট চাদর সিমনের গলায় জড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘মাটির নিচে খুব ঠান্ডা হবে।’

সিমন কফিনটা পরীক্ষা করে তার ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। পিটারের নির্দেশে শ্রমিকরা কফিনটি মাটির গর্ভে নামিয়ে দিলো। তারপর মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে শুরু করল। অলিভ গাছের কাছে এভাবেই কবর দেওয়া হল সিমনকে। পিটার সেই কবরের ওপর দাঁড়িয়ে স্বর্গের উদ্দেশে হাত তুলে প্রার্থনামন্ত্র বলতে লাগল।

তিনদিন পরের দিনটি ছিলো শুক্রবার। করব খুঁড়ে তুলে আনা হল কফিন। সেদিন আরো অনেক মানুষের ভিড় জমে গেছে। এই কদিনে, জাদুকর কফিনের কথা একের পর এক গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল।

কফিন তুলে আনতেই চারদিক পচা গন্ধে ভরে গেল। ঢাকনা খুলে দেখা গেল, সিমনের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে, দুচোখের গহবরে কিলবিল করছে পোকা। সিমন কি হাসছে? মনে হলো সোফিয়ার। দুহাতে চোখ ঢেকে সে আর্তনাদ করে উঠল। কিছুক্ষণ পর পিটারের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘এও সিমনের শিক্ষারই প্রমাণ। মানুষের জীবন পচনশীল, নরকেই তার বসবাস আর এই পৃথিবী অত্যাচারীদের হাতে। ঈশ্বর সবচেয়ে বড় অত্যাচারী।’

সিমনের মৃত্যুর পর সোফিয়া তার বেশ্যালয়ের জীবনেই ফিরে গেল।

 

শেহ্রজাদের গল্পের পথ ধরে রঘুপতি সেই কবিতার দিকে চলে যেতে পারে :

মরণ তাহার দেহ কোঁচকায়ে ফেলে গেলো নদীটির পারে।

সফেন আলোক তাকে চেটে গেলো দুপুর বেলায়।

সবুজ বাতাস এসে পৃথিবীতে যাহা কোঁচকায়

তাহাকে নিটোল ক’রে নিতে গেলো নিজের সঞ্চারে।

উৎসাহে আলাপী জল তাহাকে মসৃণ

ক’রে নিতে গেলো- তবু- সময়ের ঋণ

ধীরে-ধীরে ডেকে নিয়ে গেলো তাকে কুৎসিত, কাঠ নগ্নতায়।

তখন নরক তার অকৃত্রিম প্রাচীন দুয়ার

খুলে দিতে গেলো দেখে কানসোনা ঘাসের ভিতরে

সহসা লুকায়ে গেলো ঘাসের মতন তার হাড়।

সেই থেকে হাসায় এ-পৃথিবীকে ঘাস

ছ-মাস গাধাকে, আর মনীষীকে মিহি ছয়মাস।

কে যেন বলেছিল, বিজয়ীরা ইতিহাস লেখে, সাধারণ মানুষ ঐতিহ্য রচনা করে, লেখকরা কল্পনার জাল বোনে। একমাত্র মৃত্যুই নিশ্চিত।   r (চলবে)

কৃতজ্ঞতা : ড্যানিলো কিস্