নিমতার মানুষ একটা ভয়কে চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে ঘুমায়। ভয়টা হারিয়ে যাওয়ার। পদ্মা এখনো তিন মাঠ দূরে, হয়তো পাড় ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত, কিছুকাল জিরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু তারা জানে, যে-কোনো রাতে পদ্মা ছোবল মারতে পারে, যখন মানুষজন ঘুমায়, পশুপাখিও। পদ্মা, কেন জানি, রাতটাকেই বেশি পছন্দ করে, কিছু মানুষের মতোই। মুরুব্বিরা বলেন, পদ্মার দশটা ভাঙনের গল্পের সাতটাই লেখা হয় রাতে। নিমতার কয়েক মানুষ সেই ভয়ে গ্রাম ছেড়েছে, কেউ কেউ দেশান্তরি হয়েছে। দেওয়ান জুননু যেমন, তাঁর দুই ভাই এক ভাগ্নেকে নিয়ে এমন দেশান্তরি হয়েছিলেন যে, তাঁদের খোঁজ পেতে পরিবারকে চার মাস নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। পরিবার একসময় জানল তাঁরা ব্রাজিলে আছেন। নিমতার লোকজন ব্রাজিলের নাম জানে, তারা টিভিতে ওয়ার্ল্ড কাপ মৌসুম ঘনালে ঘরের মাথায় ব্রাজিলের পতাকা ওড়ায়, আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সঙ্গে বিবাদে জড়ায়। অনেকে ‘ছেলেছাও’ ফুটবলারদের নাম মুখস্থ বলতে পারে, ব্রাজিলের জার্সি পেলে হাতে চাঁদ পায়।

দেওয়ান জুননু বছর দুয়েক পর দেশে এলে কয়েক বাড়িতে ব্রাজিলের ধূলিময়লা পতাকা উড়ল। গ্রামের লোক তার বাড়িতে ভিড় জমালো। তার কাছে ছেলে-ছোকড়ারা

কাকা-নেইমার-রোনালদিনহোর গল্প শুনতে চাইল। দেওয়ান জুননু অল্প কথায় তাঁর গল্প সারলেন। তিনি থেকে যেতে আসেননি, এসেছেন ব্রাজিলের কুরিতিবাতে তাঁর কর্মীদল ভারী করতে। মাস তিনেক বাড়িতে থেকে তিনি নিমতার চার যুবককে সঙ্গে নিয়ে ব্রাজিল ফিরে গেলেন। সেই যুবকদের একজন অবশ্য ততটা যুবক নয়। তার বয়স পঁয়ত্রিশ। নাম মকিম শেখ। তিনি নিমতারও নয়, মতিগঞ্জের। এক রাতে মতিগঞ্জের আধখানা পদ্মার উদরে গেলে তিনি এসে ঠাঁই নেন নিমতায়, সঙ্গে স্ত্রী আর দুই মেয়ে। দেওয়ান জুননুর বাবা হাজী মজনু দয়া না দেখালে তাঁকে অনেক আগেই বড় শহরের বস্তিতে বা ফুটপাতে ঠিকানা খুঁজতে হতো। মকিমকে দেওয়ান জুননু পছন্দ করতেন তার হাতের কাজের জন্য। জাত হ্যান্ডিম্যান। কুরিতিবাতে ফুলতে থাকা তার ফুলের ব্যবসায় মকিম ভালোই দমের জোগান দিতে পারবেন।

ঢাকায় এসে যখন লঞ্চে নিমতা ফিরছিলেন দেওয়ান জুননু, তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হরিপদ মণ্ডলের। জুননুর ফুলের ব্যবসার কথা শুনে হরিপদ যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘ইহজীবনে এটা আমার কল্পনাতে আসত না’, হরিপদ বললেন, ‘ফুলের ব্যবসা করে এক্কেবারে কোটিপতি হওয়ার পথে! তাও আবার সুদূর ব্রাজিলে!’ হরিপদের কণ্ঠে ব্যাপক বিস্ময়। ‘দেওয়ান সাহেব’, তিনি বললেন, ‘দেশেও এখন ফুলের ব্যবসার বাড়-বাড়ন্ত। যাকে বলে পাকাপাকি পার্বণিক ব্যবসা। বারো মাসে এখন একশ তেরো পার্বণ। এই যেমন, সামনে নির্বাচন আসছে। ফল ঘোষণার রাতেই তো কয়েক কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়ে যাবে।’

দেওয়ান জুননু ব্যাপারটা জানেন। তাঁর ভাই দেওয়ান চুন্নু অনলাইনে দেশের পত্রিকা পড়েন। তেলমারা বাঙালি ফুলের তোড়া-মালাকেও যে এখন তেলে চোবায়, এ-বিষয়টা চুন্নু তাঁকে বলেছেন। চুন্নুর সঙ্গে ফোনে আলাপ করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ব্রাজিলের কিছু ফুলের আবাদ নিমতায় করবেন। কপালে থাকলে একটা চমক দেখিয়ে পার্বণিক বাজারে ঢুকে যাওয়া যাবে। সে-রকমটা হলে কুরিতিবার ব্যবসাটা চুন্নু এবং আরেক ভাই ঝুনুকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি দেশে ফিরতে পারবেন। নিমতা এখনো হারিয়ে যায়নি। তিনিও নিমতা ছেড়ে আর কোথাও হারিয়ে যেতে চান না। আর পদ্মা যদি আড়মোড়া ভেঙে জাগতে শুরু করে, তাতেও সমস্যা নেই। তাঁর যে টাকা আছে তা দিয়ে অন্য কোথাও জমি কিনে নতুন করে শুরু করতে পারবেন। পদ্মাপারের মানুষের মতো দেওয়ান জুননুরও পদ্মার ওপর রাগ আছে, আবার ভক্তিও আছে। ফুলের ব্যবসার জন্য তিনি বরং একটু লম্বা সময় পদ্মা থেকে চেয়ে নেবেন।

গল্পটা দেওয়ান জুননু বা চুন্নুকে নিয়ে নয়, মকিম শেখ কিংবা পদ্মাকে নিয়েও নয়, যদিও তারা না থাকলে গল্পটা শুরুই করা যেত না। সেজন্য তাদেরকে সালাম। গল্পটা মকিম শেখের তিন কাচ্চাবাচ্চার, যদিও বড়টা আছে মার্জিনে, হালকা পেনসিলের দাগে। তার থাকাটা না থাকার মতো। তাদের কাছেই তাহলে যাওয়া যাক। তবে তার আগে দেওয়ান জুননু আর মকিম শেখকে যতটুকু প্রয়োজন, ব্যবহার করে ফেলা যায়।

প্রধান ব্যবহারটা দেওয়ান জুননু নিমতায় ব্রাজিলের ফুল ফোটানোর যে সংকল্পটা নিয়েছিলেন, তার ফলাফল ঘিরে।

কৃষিবিদ হরিপদ মণ্ডল দেওয়ান জুননুর সাফল্যকে তুলনা করেছেন রূপকথার সঙ্গে। তাকে তিনি বলেছেন, ‘আপনি নিমতার নতুন রূপকথা রচনা করলেন। এক
কুসুম-বিপ্লবের সূচনা করলেন। আপনার কল্যাণে আমিও এখন টিভিতে সেলিব্রেটি মুখ। এটি বিস্ময়েরও অধিক!’

২.

দেওয়ান জুননু পাকাপাকি নিমতাবাসী হলেন। তাঁর অসুস্থ স্ত্রী তাতে সুস্থ হলেন। তাঁদের গৃহসুখ বাড়লো এবং চতুর্থ সন্তান আগমনের পথ সুগম হলো। এই আলাদা আনন্দে তিনি পদ্মার পার ঘেঁষা কয়েক বিঘা জমি কিনে নিলেন। তিনি যে দাম দিলেন, তাতে যারা জমি বিক্রি করতে পারল না, তারা কপাল চাপড়ালো। পদ্মা যেভাবে আড়মোড়া ভাঙছে, যত কুড়ের বাদশার মতোই হোক, তাতে আর তিন-চার বর্ষা হয়তো জমিগুলি টিকে থাকবে। তখন তো একটা ফুটো পয়সারও দাম থাকবে না জমিগুলির।

ব্রাজিলেও অল্প-দরে জমি কিনে দেওয়ান জুননু ফুলচাষ শুরু করেছিলেন। সেই চাষবিদ্যা তিনি নিমতার নতুন কেনা মাটিতে ফলালেন। হরেক রকমের বীজ,
চারা-কলম তিনি আর তাঁর ভাগ্নে নিয়ে এসেছেন, প্লাস্টিকে-রাংতায় মুড়ে, স্যুটকেসে, টিনের তোরঙ্গে ফেলে। দুই-তিন বিমানবন্দর ঘুরে, উদ্ভিদ-গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে, ঢাকার প্রবাসী-অবান্ধব হযরত শাহজালাল পার হয়ে, কীভাবে যে এই চালান তিনি নিমতা পর্যন্ত নিয়ে এলেন, সে এক বিস্ময়। অল্পতেই বিস্মিত হওয়া কৃষিবিদ মণ্ডলের জন্য এটি ছিল পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। তিনি ভেবে পেলেন না, পদ্মাপারের মাটিতে ব্রাজিলের বীজ-চারা-কলমগুলি কীভাবে এত সহজে আপন নিবাস গড়ে তুলল।

নিমতাতে এসে মকিম শেখ শেষ সন্তানের বাবা হয়েছিলেন। সেই সন্তান, যার নাম মমিন শেখ, সাত বছর বয়স থেকে পাঁচ বিঘার বাগানটাকে গড়ে উঠতে দেখেছে। তিন বছর ধরে বাগানটা একটা কাস্তে-চাঁদ থেকে বাড়তে বাড়তে ভরা-চাঁদের আদল নিয়েছে। কত রঙের, কত ঢংয়ের যে ফুল। দেওয়ান জুননুর ভাগ্নে মকসুমুল হাকিম বেশ আয়েস করে ছেলে-ছোকড়াদের ফুলের নামগুলি শোনাত : আলগারোবা ব্লাঙ্কো, জাকারান্ডা, ব্রুগমানসিয়া, মিমোসা পুদিকা, নিকোতিনা, পেতুনিয়া। কারো রং লাল তো কারো রং কড়া লাল, কারো বেগুনি তো কারো আকাশ নীল। গোলাপি, সাদা, কনে দেখা আলোর কমলা-হলুদ, নানা রঙের ডোরাকাটা – যেন এক চমকের উৎসব। ছেলে-ছোকরারা অবশ্য হাকিমকে রাগিয়ে দিয়ে নিজেদের মতো নামগুলি বলত – গরিবী বঙ্কু, জাকির আন্ডা, মিরাবু’র জিলাপি, পুতু মিয়া। দেওয়ান জুননুর কুসুম বাগান কোনো বিপ্লবের সূচনা করুক বা না করুক, বড়সড় একটা ঢেউ অবশ্যই তুলল। মিডিয়ার লোকজন ভিড় জমালো, ঈদে-পার্বণে নিমতায় মানুষের ঢল নামলো। হরিপদ মণ্ডল সত্যি সত্যি বিস্মিত হয়েছিলেন বিজ্ঞান পাল্টে যেতে দেখে। বঙ্গদেশের পদ্মাপারে ব্রাজিলের ন্যাটিভ ফুল আর লাল মরিচ কি করে থানা গেড়ে বসল, তার প্রশ্ন – যদিও এ দুই ভূগোলের দূরত্ব এই জেট বিমানের যুগেও অন্তত দুদিনের। পদোন্নতি পেয়ে উপজেলা থেকে – এবং আমাদের গল্প থেকেও – বিদায় নেওয়ার আগে কৃষিবিদ মণ্ডল মন্তব্য করেছিলেন, ‘এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে দক্ষিণ বাংলার অবিসংবাদিত
কুসুম-সম্রাট দেওয়ান জুননুর কারণে। সরকারের উচিত তাঁকে জাতীয় কুসুম পদকে ভূষিত করা।’

কুসুম বাগানের দায়িত্ব নিতে একসময় মকিম শেখকে তলব করলেন দেওয়ান জুননু। তলব পেয়ে খুশিতে আটখানা – নাকি ষোলোখানা – হয়েছিলেন মকিম। পরিবার থেকে

আধা-পৃথিবী দূরে থেকে মকিমের আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল। ব্রাজিলে গতর খেটে তার যা আয় হয়েছে, তা দিয়ে নিমতায় একটা টিন ছাওয়া পাকা ঘর তোলা আর একটা টিউবওয়েল বসানোর স্বপ্ন চোখে লেপে তিনি বাড়ির পথ ধরেছিলেন। তাঁর উপার্জিত রেয়ালগুলিকে ডলারে ভাঙিয়ে, দুই-তিন নতুন বীজ-কলম স্যুটকেসে ভরে তাঁকে বিমানে তুলে দিয়েছিলেন দেওয়ান চুন্নু। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বিমানটা ঠিকঠাক দুবাইয়ে পৌঁছেছিল, কিন্তু মকিম শেখ সেই বিমান থেকে নামেননি।

অথবা নেমেছিলেন, কিন্তু দেশের বিমানে ওঠেননি, নাকি উঠতে পারেননি, অথবা উঠতে দেওয়া হয়নি। যা হোক, দুবাইয়ে ঠিক কী হয়েছিল, তার কোনো হদিস কেউ করতে পারেনি। বিমানটা মাঝখানে কোথাও থামেনি, কাজেই যা ঘটার তা ঘটেছিল দুবাইয়েই। কিন্তু কী এবং কেন ঘটেছিল, সেসবের জবাব কারো জানা হলো না। না হওয়ার একটা কারণ : মকিম শেখের মতো মানুষেরা হচ্ছেন কানাকড়ি। তাদের দামে বড়জোর একটা আলপিন কেনা যায়। আলপিন তবুও তো খোঁচা দিতে পারে, কানাকড়ির সেই সাধ্য নাই। ফলে মকিম শেখকে নিয়ে কারো কৌতূহলী হওয়ার কথাও না। দেওয়ান জুননু অবশ্য ধরে নিয়েছেন, মকিমের সঙ্গে থাকা ডলারই হয়েছিল তার কাল। বীজ-কলম নিয়ে যদি তার সমস্যা হতো, এতদিনে তিনিও তার আঁচ পেতেন।

৩.

মমিনের বয়স যখন বারো, তার বাবার নিরুদ্দেশ হওয়ার বয়স তখন এক। এই এক বছর মমিনের মা কেঁদেছেন, কিন্তু তিন ছেলেমেয়েকে যেভাবে হোক মানুষ করেছেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে, ডালের বড়ি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে সংসারের অন্ন জুটিয়েছেন। তাঁর শরীর ক্ষয় হচ্ছিল, যেমন ক্ষয় হচ্ছিল তাঁর মন, মকিম শেখ নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণে। এই দুই ক্ষয় তাঁকে একসময় শূন্য করে দিলো। তিনি দেহ রাখলেন।

মমিন আর তার দুই বোনকে কেউ যেন হাত-পা বেঁধে পদ্মায় ফেলে দিলো। বড় বোনটাকে, যার নাম ছিল মাহবুবা, বয়স ১৫, উদ্ধার করলেন দেওয়ান জুননু। তাকে তাঁর এক ফুলচাষির ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। ছেলেটা ভালো, অন্তত জুননুর চোখে সেরকমই মনে হলো। চট্টগ্রামের ইপিজেডে চাকরি জুটিয়ে সে মাহবুবাকে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু মমিনের এক বছরের বড় বোনটাকে, যার নাম দিলরুবা, তিনি উদ্ধার করার সময় পেলেন না। এক চাঁদ-নেভা রাতে কেউ বা কারা ঘর থেকে তাকে নিয়ে গেল। ঘরটায় দরজা ছিল, কিন্তু তা ভাঙার প্রয়োজন ছিল না, টান দিলেই খুলে যায়। মমিন কিছুই জানল না। সে ঘুমিয়ে ছিল।

দিলরুবাকে আর দেখা গেল না। দেওয়ান জুননু চেষ্টা করলেন বিষয়টার গভীরে যেতে। তাঁর চেষ্টায় দুদিন পর পুলিশ নিমতায় এলো। ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে কিছু না পেয়ে তারা কুসুম বাগানের কিছু ফুল তোড়া বেঁধে থানায় ফিরে গেল। ফুলচাষিরা তারপরও চেষ্টা করল। গ্রামের মানুষও। এমনকি দেওয়ান চুন্নুর বন্ধু রাজুর ভাই বখাটে আনজুটাও, যে তোয়াজে আর তেলে দেওয়ান জুননু থেকে ‘ভালো ছেলে’ তকমা বাগিয়ে নিয়েছে। গ্রামের মানুষকে বলা হলো, যারা দিলরুবাকে নিয়ে গেছে তারা দুনিয়ার কেউ না, অন্যলোকের। তারা সূক্ষ্ম শরীরের। তা না হলে কি তাদের পায়ের ছাপ থাকত না আশেপাশের নরম মাটিতে? মেয়েটিকে তুলে নিয়ে তারা কুসুম বাগান দিয়েই গেছে। একটা জাকির আন্ডা গাছে মেয়েটার চুলের ফিতা আটকে আছে – যতটা উঁচুতে, ততটা মেয়েটির মাথা উঠতে পারে না। ফিতাটা পুলিশ দেখেনি, অথবা দেখলেও গা লাগায়নি।

নিমতার মানুষ একসময় এই ধারণায় থিতু হলো যে, দিলরুবার উপর অন্যলোকের কারো কুনজর ছিল। তার যে বয়স, তাতে এটা অস্বাভাবিক না। কেউ কেউ অবশ্য একথাও বলল, মেয়েটা মায়ের শোক সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছে। কিন্তু কেউ বলল না, অথবা বলার হিম্মত পেল না, আনজুকে সেদিন সন্ধ্যায় মকিম শেখের বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। দুদিন আগে সে নিমতায় এসেছে, কলেজে নাকি ছুটি চলছে। পুলিশের খাতায় আনজুর নাম আছে অথচ রাজুর কাঁচা পয়সায় পুলিশের অনুগ্রহ কিনে সে তিন গ্রামে ত্রাস ছড়ায়। মনু মাঝি নামে এক দুর্বল মানুষ একসময় বলতেন, আনজুর সঙ্গে মেয়ে ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ আছে। একথা শুনে রাজু তাকে ডাকিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘মাঝির পোলা মাঝি, নাও-নৌকায় ফিরা যাও, ডাঙ্গায় চরতে আইসো না। কথা কানে গেছে?’

মনু মাঝি নৌকাতেই ফিরে গিয়েছিলেন।

দিলরুবা নামের মেয়েটা তার মায়ের মতোই শূন্য হয়ে গেল। মমিনের কাছে দুইটা শূন্য একটা হাহাকারকে দ্বিগুণ জোরে বাজালো। এতে তার ঘরের ভেতরের শূন্যতাটা জমাট বাঁধতে লাগল। একটা মাসও গেল না, ঘরটাকে মমিনের কাছে মনে হতে লাগল কবর। এই কবরে সে কীভাবে থাকে? এক রাতে সেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তবে ঘর থেকে পথে নামতে আরো দুটো দিন সে হয়তো সময় নিত, কিন্তু এর মধ্যে তাকে তাড়াতে লাগলো একটা ত্রাস। ত্রাসটা পুলিশের।

কুসুম বাগানে এক ভোরে আনজুর লাশ পাওয়া গেছে। লাশের মুখটা নীল, যেন বাজারের ইন্দ্রনাথ কারিগর টিনের তোরঙ্গে রং দিতে গিয়ে আনজুর গালে-মুখে রঙের একটা পোঁচ দিয়ে দিয়েছেন। লোকেরা প্রথমে ধরে নিল কোনো বিষধর সাপের কামড় খেয়ে আনজু মরেছে। কিন্তু শরীর উল্টেপাল্টে সাপ কাটার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। নিমতার হোমিও ডাক্তার রজব আলি বললেন, সাপে না কাটুক আনজু মরেছে বিষ থেকেই। সেটা কিভাবে তার শরীরে ঢুকে মুখে চলে গেল তা উপজেলার ডাক্তার বলতে পারবেন। পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করল। তাদের সন্দেহটা প্রথমেই গেল মমিনের দিকে। তার বয়সটাও পুলিশ বিবেচনায় নিল না। সে থানা পুলিশ করল। তার ভাগ্য, দেওয়ান জুননুও আস্তিন গুটিয়ে নেমেছিলেন। এজন্য মমিনকে একসময় পুলিশ ছেড়ে দিলো।

ঘরে ফিরে মমিনের মনে হলো, যে-বিষে আনজু মরেছে, সেই বিষটা যেন নিমতাকেও নীল করে ফেলেছে। বেঁচে থাকতে হলে নিমতা থেকে পালাতে হবে। মমিন শেখ একবার ব্রাজিল থেকে ক্যাম্বিসের ব্যাগে করে তাঁর স্ত্রীর কাছে এটা-সেটা পাঠিয়েছিলেন। ব্যাগটা মমিনের মা একটা চটের বস্তায় ভরে চৌকির নিচে রেখে দিয়েছিলেন। মমিনের মনে আছে, ক্যাম্বিসের ব্যাগটা খালি করে দিলরুবাকে দিয়েছিলেন মা। দিলরুবা ব্যাগটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে ছিল, আর মাঝে মাঝে এর ভেতরটায় উঁকি দিচ্ছিল, যেন এর কোনো গোপন পকেটে বাবার আদর লুকিয়ে আছে।

মমিন ঘর ছেড়ে পালানোর আগে চৌকির নিচ থেকে ক্যাম্বিসের ব্যাগটা টেনে বের করল। ব্যাগটার মুখ খোলা। মমিন অবাক হলো, দিলরুবার মতো গোছানো মেয়ের ব্যাগের মুখ খোলা রাখার কথা না। তার দু-এক গেঞ্জি, একটা লম্বা প্যান্ট, দুটা শার্ট, একটা লুঙ্গি – তার ইহজাগতিকতার সর্বসাকল্য সম্বল – তাতে সে ঢোকালো। তবে ব্যাগের ছোট এক ভেতর-পকেটে সে আর হাত দিলো না। সেই পকেটে রাংতায় মুড়ে কাগজে পেঁচিয়ে মমিন শেখ কিছু বীজ পাঠিয়েছিলেন। তাছাড়া, একটা গাছের কিছু বীজও আলাদা করে একটা ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাখা ছিল। দিলরুবাকে তার মা বলেছিলেন, এই বীজ থেকে বিষের গাছ হয়। এই গাছের ফুল পাতা মশা-মাছি ব্যাঙ সব মেরে ফেলে। এটা যেন সে না ধরে। বীজ-টিজ নিয়ে অবশ্য মমিনের কোনো উৎসাহ ছিল না, তার উৎসাহ ছিল চকলেটে, মমিন শেখ ছেলেমেয়ের জন্য যত্ন করে যা পাঠিয়েছিলেন। চকলেটগুলি এক বিকেলেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে বাবার স্মৃতিও।

ব্যাগটা কাঁধে ফেলে কুসুম বাগান দিয়ে হাঁটা দিলো মমিন। রাতের ফুলগুলি অদ্ভুত কড়া-মিঠা সুবাস ছড়াচ্ছে। নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। মনে মনে সে ফুলগুলির নাম নিতে থাকল – গরিব মানুষ, জিলাপি, নিকুতিন্যা, পুতুমিয়া। নামগুলি সে নামতা পড়ার মতো বলে যাচ্ছিল আর ফুলগুলি তাদের সুবাস তার কলিজা পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছিল। রাতের বেলা যে কুসুম বাগানে কেউ তাকে মেরে-কেটেও পাঠাতে পারত না, সেই বাগান দিয়ে মমিন হেঁটে গেল। যেন কোনো রোদ-বিকালে সে খোলা মাঠে ফুটবল খেলতে নেমেছে।

৪.

দিলরুবার ভাগ্যটা ছিল কাচের মতো। একটা টোকা দিয়ে তাকে ভেঙে দিয়েছিল আনজু। কিন্তু মমিনের ভাগ্যটা দেখা গেল যেন লোহার তৈরি। ভাঙেনি, মাঝে মধ্যে যদিও মচকেছে।

কুসুম বাগান পার হতে হতে সে একটা সিদ্ধান্ত নিল, সে লড়বে। যতটা লড়তে হয়। ছাড় দেবে না। পিছু হটবে না। একটা যে ছোট্ট ছুরি সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে, বাবা যা ব্রাজিল থেকে মাকে পাঠিয়েছিলেন এটা-সেটা কাটতে, সেটাকেও ছাড়বে না। কুসুম বাগানে সে ঢুকল বালকের পা ফেলে, বের হলো এক জোয়ান মানুষের পদক্ষেপে। সিনেমায় যেমন দেখায়। সিনেমার লোক সময় আর পয়সা বাঁচাতে একটা দৃশ্যেই নায়ককে বালক থেকে যুবক করে ফেলেন। সেরকমটা এই গল্পে করা গেলে ভালো হতো, কিন্তু মমিনকে আরো কিছুকাল বালক থাকতে হবে। বালক থেকে তার যুবক হওয়ার ইতিহাস পুরোটা লিখতে গেলে গল্পটা একটা পেটমোটা উপন্যাস হয়ে যাবে। সে-পথে না গিয়ে বরং এটুকু বলে নেওয়া যাক : মমিন নানা পথ বেয়ে এসে ঢাকায় পৌঁছালো। পথে তার অনেক ভালোমন্দ মানুষ দেখা হলো। মন্দ মানুষেরা নানা কারণে তার অনিষ্ট চাইল, তার একটা আদিম : যার শিকার এই বঙ্গদেশের মুটে-মজুর-বাপে খেদানো-অপড়ুয়া-তালেব ইলিম হাজার শিশু। মমিনের ছুরির সামনে অবশ্য আদিম শিকারিরা সুবিধা করতে পারল না।

কৃষিবিদ মন্ডল আমাদের গল্পে এখনো থাকলে অবাক হতেন, একটা ছুরি ছেলেটাকে এতটা সাহস কী করে দিলো, যা তাকে কিশোর গ্যাংয়ের নেতার মতো দুর্ধর্ষ করে তুলল। তবে তার লোহাভাগ্য একসময় এক ভালো মানুষের সামনে তাকে নিয়ে ফেলল। তার নাম আফজাল মিয়া। মিয়া সাহেব বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন – এখনো থাকেন – তবে ডেঙ্গু রোগ বাকিদের নিয়ে নিলে শূন্যঘরে একাই থাকেন। নূরের চালা, থানা ভাটারায়। অনেকদিন মনোকষ্টে মরে থেকে একদিন তিনি জেগে উঠেছেন, ব্যবসাপাতি আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছেন। মমিনকে দেখে তাঁর মনে হয়েছে আঁকড়ে ধরার মতো কেউ একজন এই ছেলেটা। মিয়া সাহেবের একটাই ছেলে ছিল, মমিন থেকে অনেক ছোট, কিন্তু মমিনের মধ্যে তিনি তার একটা ছায়া দেখলেন।

মমিনের ছুরিটা, ফুলের বীজগুলির মতো, ক্যাম্বিসের ব্যাগেই থাকল। মিয়া সাহেবের সঙ্গে তার গল্প বিনিময় হলো। এতে দুজনের শূন্যতা কমল।

৫.

মমিনের বয়স পঁচিশে পৌঁছালে তার লোহাভাগ্যে একটা হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। মিয়া সাহেব ইন্তেকাল করলেন। সেই কাজটি করার আগে তিনি চেয়েছিলেন, পড়িয়ে-শুনিয়ে মানুষ করা মমিনকে একটা ভালো বিয়ে দেবেন। একটা ভালো চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা ছেলেটার আছে। ব্যবসাপাতি যে তাকে দিয়ে হবে না, তিনি সেটা বুঝেছিলেন। বিয়ের ব্যাপারে অবশ্য তাঁর একটা সন্দেহ ছিল। একটা সাজগুজু মেয়ের সঙ্গে কয়েকদিন তিনি মমিনকে দেখেছেন। মেয়েটা বাসে চড়ে রোজ মতিঝিল যায়, চেহারাটা ভালোই, আদব-কায়দাও। যেটুকু তাঁর অপছন্দ তা ওই অত্যধিক সাজ-পোশাকে। নূরের চালাতে এটা বেমানান। এরকম মেয়ে বেমানান অনেক কিছু করতে গিয়ে সংসারে অশান্তি আনে, তিনি দেখেছেন। তারপরও মমিন চাইলে বিয়ের আয়োজনটা তিনি করবেন। বিষয়টা অবশ্য মমিনের একান্ত, এতে তাঁর নাক গলানোটা অনুচিত। কিন্তু মমিনই একদিন তাঁকে জানালো, মেয়েটার নাম ফিরোজা। সে আর নূরের চালায় থাকে না। তার অফিসের পাশে আরামবাগে চলে গেছে। নূরের চালা তার ভালো লাগতো না। এখানে থেকে বড় কিছু হওয়া যাবে না, এরকম সে ভাবত। মমিন অবশ্য জানে, আরামবাগের ভূগোলটাও আঁকাবাঁকা। সেখানে ফিরোজাকে খুঁজে পেতে তার কষ্ট হবে।

মিয়া সাহেব যা বোঝার বুঝেছিলেন। তিনিও অবশ্য নূরের চালার জমি-বাড়ি-ব্যবসাপাতি বিক্রি করে দিয়েছেন আলেকজান্ডার বেকারির মালিক ভালো মানুষ আলম সাহেবের কাছে। আলম সাহেব একটা শর্ত মেনেই সব কিনেছেন – তাঁকে দখল নিতে অপেক্ষা করতে হবে মিয়া সাহেবের ওফাৎ পর্যন্ত, যা দুই বড় ডাক্তারের অনুমান মতো আর ছয় মাস। তারপরও ছেলেটাকে সব গুছিয়ে উঠতে সময় দিতে হবে। মমিনকে তিনি জানাননি, তার নামে সব টাকা রাখা আছে। কথাটা তিনি একটা চিঠিতে লিখে  যাবেন। তিনি জানেন, নূরের চালা ছাড়া আর কোথাও সুখ থাকতে পারে, ছেলেটা তা ভাবে না, কিন্তু তিনি চলে গেলে তার ভুল ভাঙবে। তখন অন্য কোথাও সুখ খুঁজে নেবে। আরামবাগে হলে উত্তম। না হলেও সমস্যা নেই।

মিয়া সাহেবকে কবরে শুইয়ে ফেরার পথে আলম সাহেব মমিনকে বাড়ি-ব্যবসা কেনার কথাটা বললেন। মিয়া সাহেব যেসব কাগজপত্র রেখে গেছেন, সব পড়তে ও বুঝতে বললেন, তাঁর লিখে যাওয়া চিঠিটা যেন সে পড়ে, তার অনুরোধ জানালেন। দরকার হলে আলম সাহেব আছেন। মিয়া সাহেবের কাছে তার যত ঋণ, তার কিছু শোধ করতে পারলে তিনি খুশি হবেন।

মমিন কিছুদিন সময় চাইল। তার শূন্যতাটা ফিরে এসেছে। এই শূন্যতা থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে সে জানে না।

টাকা-পয়সার চিন্তা কোনোকালে তার মাথায় ছিল না। এখনো নেই। এখন পায়ের নিচে একটা শক্ত জমিন পেলেই সে বেঁচে যায়। সে বুঝল, জমিনটা তাকেই পেতে হবে, পা জোড়া যেহেতু তার।

৬.

ঢাকার কোনো ভদ্রপাড়ায় দুই কামরার একটা ঘর খুঁজে পাওয়া যতটা কঠিন, তার থেকে অনেকগুণ কঠিন চাকরি খুঁজে পাওয়া। মমিন জানে, তিতুমীর কলেজের একটা এম.কম দিয়ে সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে না। সরকারি চাকরি পেতে অনেক হ্যাপা। সে বরং ভিন্ন চাকরি খুঁজবে – কোনো ব্যাংকে হলে মন্দ হয় না। মাসখানেক দৈনিক চাকরিপত্র দেখে নানা ব্যাংকে সে অ্যাপ্লাই করল। কিন্তু কোনো ব্যাংক থেকে আরামবাগে তার দুই কামরার ফ্ল্যাটে অথবা তার ইমেইলে কোনো চিঠি এলো না। একদিন সে কাগজে দেখল, এক ব্যাংকের বড় কর্তা এক ইয়ুথ কনফারেন্সে বলছেন, তাঁর দরজা সকলের জন্য খোলা, এমনকি যাদের অভিজ্ঞতার থলিতে আছে একটা বড় শূন্য, তাদের জন্যও। এক সকালে সে মিয়া সাহেব থেকে ঈদ উপহার হিসেবে পাওয়া নতুন প্যান্ট-শার্ট পরে ওই ব্যাংকের দরজায় হাজির হলো। দরজাটা খোলা বটে কিন্তু সেটি দিয়ে কাস্টমার ঢোকে, বড়কর্তার দরজায় উর্দিপরা পাহারা। কিন্তু মমিনের রাগ আছে, লেগে থাকার জেদ আছে। ব্যাংকের লোকজন বুঝল, এই ছেলেকে আটকে রাখা যাবে না। ঘণ্টা দুই পর বড় কর্তা তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। এবং তিনি বুঝলেন, ছেলেটা ‘না’ শুনতে আসেনি। তিনি মানুষ চেনেন। মমিনকে তিনি চিনলেন। তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। শেষমেশ একটা কাগজ তার হাতে ধরিয়ে বললেন, ১ তারিখ থেকে সে কাজ শুরু করতে পারে, তবে এক বছর তাকে প্রবেশনে থাকতে হবে। ইত্যাদি।

মমিন নিজেকে বলল, প্রবেশন শেষে চাকরিটা তার থাকবে কি না বলা যায় না, কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই। আপাতত সে একটা পরীক্ষায় পাশ করেছে। পরে কী ঘটবে তা পরে দেখা যাবে।

৭.

আরামবাগের তার ফ্ল্যাটটা একটা ছয়তলা বাড়ির তিন তলায়। বাসাটা খারাপ না। একটা ছোট রান্নাঘর আছে, শোবার ঘরের সঙ্গে লাগানো একটা ব্যালকনিও আছে। সেখানে একটা চেয়ার ফেলে, ছ’টা টবে মাটি ফেলে মাটিতে জৈব সার মিশিয়ে ব্রাজিলের বীজের জন্য তৈরি করে রেখেছে। বীজগুলি সে ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতড়ে পেয়েছে। প্রতিটি প্যাকেটের গায়ে ফুলের নাম লেখা আছে। এখন শুধু বীজ ফেলার অপেক্ষা। মমিনের ভয়, বীজগুলি এতদিনে নিশ্চয় নষ্ট হয়ে গেছে। মাটি না পেয়ে মরে গেছে। ক্যাম্বিসের ব্যাগে তারা কি কবরে শোয়ানো, নাকি নতুন জীবনের অপেক্ষাটা তারা এখনো ধরে রেখেছে?

৮.

আরামবাগে কেন বাসা ভাড়া নিল মমিন, এ-প্রশ্নটাকে ছাপিয়ে আরেকটা প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়ায়, ফিরোজাকে কেন তার প্রয়োজন হলো? প্রয়োজন হলো, কারণ যৌবনের আবেগ। জীবনের ধর্ম। শরীরের কামনা। ছুটির দিনে সারা আরামবাগ সে চষে বেড়ায়। কিন্তু ফিরোজা নেই। একদিন তার মনে হলো, আরামবাগ একটা ছাঁকনির মতো। কিছুদিন মানুষ এইখানে আটকে থাকে। তারপর কোনো ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। তারা আরো বড় জায়গায় যায়। ফিরোজা যে আরামবাগেই আছে, সে-কথাটা তাকে কে বলেছে? সে তো নয়াপল্টন যেতে পারে, ইস্কাটনও, অথবা ধানমন্ডি। কেন নয়?

অথবা, সে হয়তো আরামবাগেই আছে। তাকে চিরুনিখোঁজা পুলিশ-র‌্যাব করতে পারে। তার সেই ক্ষমতা নাই।

মমিনের মন খারাপ হলো। মাকে সে আঁকড়ে ছিল সারা শিশুকাল। তাকে ধরে রাখতে পারল না। মায়ের পর দিলরুবাই ছিল তার সবচেয়ে বড় বন্ধু। সেও তার হাত গলিয়ে বেরিয়ে গেল। ফিরোজাকে তেমন করে সে পায়নি – পেতে চেয়েছিল শুধু। সেই চাওয়াটা ডানা মেলার আগেই গুটিয়ে গেল।

যাক। মমিন সিদ্ধান্ত নিল, ফিরোজাকে ভুলতে হবে। না ভুলতে পারলে বিপদ। এমনিতেই সারাদিন তার কথাহীন কাটে। তার জীবনে হাহাকারের অভাব নেই। এর সঙ্গে ফিরোজাকে নিয়ে যদি হাহাকার জমে, একটুখানি হলেও, তাহলে ঘর ছেড়ে পালাতে হবে। ঘরটা সে ছাড়তে পারে না, তার চাকরিটা তাকে একটা ঠিকানা দিয়েছে – নড়বড়ে হলেও। বাসাটাও। তার বাবার মতো ঠিকানা হারানো মানুষ সে হতে চায় না।

তাকে বাঁচিয়ে দিলো ব্রাজিলের বীজ। ঠিক যেমন পদ্মাপারের কুসুম বাগানকে তারা আপন ভুবন করে নিয়েছিল, শিকড় গজিয়েছিল, ডালপালা মেলেছিল, আরামবাগের ছোট্ট এই বাড়ির ব্যালকনিতে রাখা ছ’টি টবে তারা তাই করল। বীজগুলি শুধু যে বেঁচে আছে, তা না, এই ক’বছরে যেন এক অদ্ভুত জীবনশক্তিতে তারা নিজেদের তাজা রেখেছে। যে-গতিতে চারাগুলি মাথা তুলল, তাজা হলো, শক্তপোক্ত ডালপালা আর চকচকে পাতার ছাতা খুলে ধরল – কৃষিবিদ হরিপদ মণ্ডল দেখলে বিস্ময়ে হয়তো কথাই হারাতেন। মাত্র সপ্তাহ দুয়েকে ব্যালকনি ছাপিয়ে রেলিংয়ের উপর-নিচের জায়গাগুলি কড়া-মিঠা সবুজে ছেয়ে গেল। সবুজের উপর দেখা দিলো লাল-নীল-বেগুনি-হলুদ-কমলার খেলা। রংধনুর সবগুলি রং ধরে ফুলগুলি যেন অসংখ্য আশ্চর্য চিহ্নের মতো দ্রষ্টব্য হয়ে থাকল। মমিনের ব্যালকনিটা হয়ে দাঁড়ালো ছোটখাটো এক মায়াকানন। যেন, এখানে শুধু ফুল ফুটবে না, ফুলগুলি, লতা-গাছগুলি মায়া ছড়াবে।

মায়া না, মায়ার থেকে বেশি কিছু তারা ছড়ালো। নেশা ধরানো ঘ্রাণ! সন্ধ্যারাত থেকে তারা ঘ্রাণ ছড়াতে শুরু করে। যেসব মানুষ আশেপাশে থাকে অথবা রাস্তায় চলতে চলতে মমিনের দালানের নিচে চলে আসে, তাদের সকল ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে ঘ্রাণটা তাদের একেবারে ভেতরে পৌঁছে যায়। মানুষগুলির স্নায়ু অবশ করে তাদের অলীক কোনো লোকে যেন পাঠিয়ে দেয়। এই চেতনায় তোলপাড় তোলা, স্নায়ু অবশ করা, স্বপ্নগ্রস্তের মতো মানুষকে কব্জা করার ক্ষমতা রাখে যে ঘ্রাণ, তার কোনো বর্ণনা সম্ভব না, তার শক্তির কোনো ব্যাখ্যাও।

প্রথম ফুলটা যেদিন ঘ্রাণ বিলাতে শুরু করল – হয়তো ব্রুগমানসিয়া – মমিনের শরীরের এমাথা-ওমাথা চিড়ে একটা বিদ্যুতের ফলা যেন বয়ে গেল। তার স্মৃতির ঘরে যে কুসুম বাগান ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, সেটি আবার স্পষ্ট জেগে উঠল। একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে সে কুসুম বাগানের দিনগুলিতে যেন ফিরে গেল। মাকে পেল, দিলরুবাকেও। এমন কি মাহবুবাকেও। তার দুঃখগুলি তরল হলো। নিশ্বাসটাও সহজ হলো।

দশদিন ধরে গাছগুলির নিজেদের মেলে ধরা চলল। মিরাবু’র জিলাপি, নিকুতিন্যা, পুতুমিয়া, গরিবী বঙ্কু – সবাই যেন পণ করেছে বারান্দার ভূগোল মেপে তারা ডালপালা ছড়াবে, লতা মেলবে, বারান্দার রেলিং গলিয়ে তিন-চার ফুটের বেশি নামা যাবে না, যেন এই মাপগুলি মমিন একটা কাগজে লিখে তাদের দিয়েছে। কিন্তু ফুল কতগুলি ফুটবে, গাছগুলি যেন নিজেরাই ঠিক করে নিল। কত ফুল? না, সংখ্যায় মাপা যাবে না।

সন্ধ্যা থেকে ফুলগাছগুলি যত নেশা ধরানো ঘ্রাণ আরামবাগের বাতাসে ঢেলে দিতে থাকল, তত মানুষের মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরি হতে থাকল। এরকম উত্তেজনা কেউ কখনো দেখেছে কি না, নিজের ভেতর টের পেয়েছে কি না, কে জানে। এই উত্তেজনার কোনো কারণ নেই, কোনো প্রশ্ন অথবা অভিযোগ অথবা রাগ থেকে এই উত্তেজনা তৈরি হয় না, এর প্রকাশেও কোনো আওয়াজ থাকে না। এর কোনো নিশানাও নেই। এই উত্তেজনা মানুষের ভেতরেই থাকে, শুধু একটা তাড়না তারা অনুভব করে। মানুষ যখন বুঝতেই পারে না কেন উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে তাদের ভেতরে, কোনো কারণও তারা তেমন খুঁজে পায় না, তখন তো উত্তেজনাটা ভেতরেই থেকে যাওয়ার কথা। মানুষ শুধু বুঝতে পারে উত্তেজনা বলুন আর তাড়না বলুন, তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে ওই ছয়তলা বাড়ির তিনতলার একটা ব্যালকনি থেকে ছড়ানো ঘ্রাণের, যে-ঘ্রাণটা চেনা পৃথিবীর কোনো ঘ্রাণের সঙ্গে মেলানো যায় না। ঘ্রাণটা পাহাড়ি কোনো নদীর মতো উৎসে যত প্রবল, নিচে, আশেপাশে ছড়াতে শুরু করলে তার থেকে অনেক বেশি প্রবল। অবাক! ওই ছয়তলা বাড়ির কোনো মালিক-ভাড়াটিয়া একবারও মমিনের দরজায় কড়া নাড়েনি, কোনো নালিশ বা তারিফ জানাতে আসেনি, ভেতরে ঢুকে গাছগুলিকে, ফুলগুলিকে দেখতে চায়নি। ফুল তারা বাইরে থেকে দেখেছে বটে, কিন্তু এত বাহারি ফুল হাতে নিয়ে দেখতে এবং শুঁকতেও তো তাদের মন চাইতে পারত। পারত না? রাতে যদি অচেনা কোনো পথচারী, আরামবাগে বেড়াতে আসা অথবা ঘ্রাণের খবর পেয়ে চেতনা অবশ করতে আসা কোনো মানুষ তার বারান্দার নিচ দিয়ে যায়, একটা বড় নিশ্বাস সে নেয়, তাকে যেন বলতেই হয়, আজকের রাতটা এত অন্যরকম কেন? এমন মন কেমন করা?

সন্ধ্যা থেকে অনেকক্ষণ মমিন বারান্দায় বসে থাকে। একসময় উঠে রান্নাঘরে যায়, রাতের খাবারের জোগাড়যন্ত্র করতে। খাবার খেয়ে, বাসন-কোসন ধুয়ে, রান্নাঘরের ঝাঁপি ফেলে আবার এসে বারান্দায় বসে। সিগারেট খায়। কিন্তু সিগারেটের ধোঁয়া – অবাক! – ফুলগুলি যেন শুঁষে নেয়, অথবা তাদের ঘ্রাণের অধিকারে নিয়ে নেয়। মমিনের মনে হয়, সে তো না, যেন ব্রুগমানসিয়া সিগারেট খাচ্ছে, ধোঁয়া ছাড়ছে, অথবা গরিবী বঙ্কু। বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে থাকলে মমিনের আর একা লাগে না। ঘরটাও শব্দহীন শবের মতো পড়ে থাকে না। তার মনে হয় ঘর জুড়ে যেন কথা হয়। যেন সবাই কথা বলে, মা, দিলরুবা, এমনকি মাহবুবা! এমনকি বাবা! যেন সে শিশুকাল থেকে বলা আর শোনা কথাগুলির মধ্যেই আছে। যেন স্মৃতিতে এক কণা ধূলিও জমেনি। যেন বারান্দাটা কুসুম বাগান। এবং সে এর একমাত্র চাষা। অথবা সম্রাট।

৯.

একদিন সন্ধ্যারাতে মমিনের দরজায় টোকা পড়ল। টোকাটা অনির্দিষ্ট, কুণ্ঠিত, যেন যে টোকা দিচ্ছে, ধরেই নিচ্ছে, ঠিকানাটা ভুল। মানুষটা ভুল। যেরকম টোকায় দরজা খোলার কথা না।

মমিন শুনল। টোকাটা কুসুম বাগানের গন্ধে সুরেলা। টোকার সঙ্গে তার নামটা কি কেউ ডাকল, যেমন কেউ ডাকত তার ঘুমের ভেতরে এবং বলত উঠতে হবে, লাকড়ি জোগাড় করে আনতে হবে, তারপর রান্না চড়বে।

কতটা শিশু সে ছিল ওই লাকড়ি কুড়ানোর বেলা? কতটা শিশুকাল সে বয়স্ক পৃথিবীর পথে পথে হারিয়েছে? সেই হারানো সময়ের ওপার থেকে কেউ কি তাকে ডাকল?

বারান্দা থেকে দৌড়ে এসে সে দরজা খুলল। দিলরুবা!

অবাক! দিলরুবাকে সে কি করে চিনল, কে জানে। কতকাল সে তাকে দেখে না। তাছাড়া দিলরুবা তো এখন আর দিলরুবা নাই। না শরীরে, না মনে, না চেহারায়। শরীরটাকে পৃথিবী যাচ্ছেতাই আঘাত দিয়েছে; মনটাকে, চেহারাটাকে ক্লান্ত করেছে। তার ওপর একট প্রলেপ লাগিয়েছে অস্পৃশ্যতার। মমিন তার দিকে দু-হাত বাড়িয়ে দিলো।

মমিনের হাত টেনে নিল দিলরুবা, এবং একটুখানি হাসল। কতকাল পরে কে জানে।

‘কেমনে আমারে পাইলি বুবু?’

‘কেমনে আবার!’ ঘ্রাণের উৎসের দিকে আঙুল তুলে সে বলল, ‘ওই, ওরাই তো নিয়া আইল।’

‘ওরা’ মানে ব্রাজিলের সেই ফুলবাহিনী।

মমিন হাসল। ‘তর কাছে কোনো বীজ আছেরে, বুবু?’ সে  জিজ্ঞেস করল। ‘থাকলে দুই-একটা আমার বাগানে লাগাইতে পারি।’

‘না, ফুল না। একটা পুরিয়া আছে। তিনটা আছিল, এখন একটা। তয় ওইটা তরে লাগাইতে দিমু না।’ চোখে আলো জ্বেলে দিলরুবা বলল।

মমিন হাসল। দিলরুবাও। শব্দ করে। শব্দটা তাদের ভেতরের শূন্যতাগুলিকে ভাঙল।

‘আয় বুবু, ভিতরে আয়’, মমিন ডাকল। দিলরুবার হাতে ধরা একটা মলিন প্লাস্টিকের ব্যাগ সে নিজের হাতে নিয়ে নিল। একটু অবাক হলো। ‘আর কিছু নাইরে বুবু? এই একটা পাতলা ব্যাগ?’

দিলরুবা কিছু বলল না। সে মমিনের ঘরে পা রাখল।

ঘরের দরজা লাগাতে লাগাতে মমিন বলল, ‘তুই যখন আইতে পারছস বুবু, আব্বাও পারব। কী কস?’

দিলরুবা হাসল। অনির্দিষ্ট হাসি। তবে মমিন জানে, এটি নির্দিষ্ট হতে বেশি সময় লাগবে না। কুসুম বাগানের ঘ্রাণটা সেই সম্ভাবনার কথাটা জানান দিচ্ছে।