কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি

‘তোমার কোথায় দেশ? কিবা পরমাত্মা-পরিচয়?

তুমি ছোট ঘরে বসে আজীবন পড়াশুনা করো

তোমার সামান্য আয়, তুমি স্ফীতোদর।’

(‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

 

 

বুকসেলফ …

একবার খুব টানাটানির মধ্যে পড়ে গেলাম। ২০০৯ সালের কথা। সুজলার বয়স তিন আর স্বননের সাত-আট মাস হবে। চট্টগ্রামের যে-দৈনিকটাতে কাজ করতাম সেখানে নিয়মিত বেতন হতো না। বকেয়া পড়ত প্রায়ই। তো সেরকম একটা রাতে পত্রিকার একটা বিজ্ঞাপন দেখিয়ে, দীপ্তির প্রশ্ন,

বই পাঠিয়েছ?

আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। তখন আমার প্রথম কবিতার বইখানা সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। কোনো একটি পুরস্কারের জন্য বই পাঠাতে বলছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনে দেখা গেল বই পাঠানোর শেষ তারিখ ছিল সেদিনই।

যে-রুমটায় থাকতাম আমরা সেখানে মেঝেতে আমার বইগুলো একটা বিছানার চাদরের ওপর সত্মূপ করে রাখা। তখন কোনো বুকসেলফ ছিল না। বই পাঠানোর সময়সীমা পার হয়েছে শুনে দীপ্তির দীর্ঘ নিশ্বাস। ছড়ানো-ছিটানো বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা বুকসেলফ তো কিনতে পারতে পুরস্কারের টাকাটা হাতে পেলে।

আশ্চর্য হলাম ওর কথা শুনে। প্রথমত আমি পুরস্কার পেতে পারি এই বিশ্বাস কি করে এলো ওর মধ্যে। দ্বিতীয়ত, বাচ্চার দুধ কেনার টাকা থাকে না প্রায় সময়, এমন প্রয়োজনের বিষয় না ভেবে বুকসেলফের কথাই তার মাথায় এলো?

পরদিন এক বন্ধুর পরামর্শে যোগাযোগ করলাম পুরস্কারদাতা সংস্থার অফিসে। ওরা বলল, সময় পার হয়ে গেলেও ঈদের ছুটির কারণে অনেকের বই সময়মতো আসেনি। একদিনের মধ্যে পাঠাতে পারলে সেটা গ্রহণ করা হবে।

বই পাঠিয়ে বিষয়টা মাথা থেকে একরকম ফেলে দিয়েছি। অপেক্ষার প্রশ্নই আসে না। কারণ জানতাম, আমি কী লিখি। আর আমার সামনে কেউ বই হাতে নিলে কুঁকড়ে যেতাম সংকোচে। মনে হতো পোশাক পরিনি। ওই পাঠক নেড়েচেড়ে দেখছে আমাকে।

মাসচারেক পর হঠাৎ ফোনে জানানো হলো পুরস্কার পেয়েছি আমি। যার মূল্যমান এক লাখ টাকা।

আলমগীর মিস্ত্রি দেখতে ছোটখাটো হলেও বেশ চটপটে। সাত ফুট বাই আট ফুটের ভিনিয়ার বোর্ড কেটে বানানো বুকসেলফের নকশা দীপ্তি নিজে করেছিল। গত দশ বছরে সেলফটার নিচের অংশের গস্নাসডোরের একটাও অক্ষত নেই। দুবার বাড়ি বদলানোর ধাক্কায় কোথাও কোথাও ওপরের পস্নাস্টিক সরে গিয়ে কাঠের গুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছে। পেছনের পায়ার দিকে সামান্য পচনও ধরেছে। বছর কয়েক আগে এক লেখকবন্ধু অটবির শক্তপোক্ত একটা বুকসেলফ উপহার দিয়েছেন। সেটা আসার পর পুরনোটা বহাল হয়েছে বাড়ির নিভৃত কোণে, স্টাডি রুমে আর নতুনটা ড্রয়িংরুমে।

জীর্ণ বুকসেলফটা তবু অনেক আপন মনে হয়। তার কাছে গেলেই একটা অন্যরকম গন্ধ পাই আমি। এই গন্ধটা অনেকটা নতুন কচি বাঁশ, সুগন্ধি তেল আর ন্যাপথালিনের মিশেল বলে মনে হয়। নিউমার্কেটের মোড়ে শুকতারা নামে একটা বইয়ের দোকান ছিল। এখন নেই। সেখানে স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, শিশু, নবারু এসব ওলটাতাম। সেখানেই পেয়েছিলাম আলেক্সান্দার বেলায়েভের উভচর মানুষ। সেই বইয়ের ভেতরেও ছিল এমন অদ্ভুত ঘ্রাণ।

এজন্য বুকসেলফটাকে জীবন্ত মনে হয় আমার। জীবন্ত আর স্মৃতিভারাতুর। কত কাহিনি ওর পেটের ভেতর, শরীর জুড়ে। অথচ নতুন বুকসেলফটাকে মনে হয় নিশ্চল আর মৃত। কোনো গন্ধও নেই তার।

 

 

পাশে এসে বসো

চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়ঘেরা একটা বাড়িতে থাকি তখন। বাড়িটাও গাছে ঘেরা একটা টিলার ওপরে। সেখানে আমার সকাল হতো বেলা দশটায়। তার আগে ঘুম ভাঙতো কদাচিৎ। লেখাপড়া, ক্লাস করার কোনো বালাই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম মাঝে কালেভদ্রে। বন্ধু রোজাউল করিম সুমন নিয়মিতই আসত তখন। মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভাঙার আগে। খবর পেয়ে এসে দেখতাম বারান্দায় বসে একমনে স্কেচ খাতা খুলে উবু হয়ে বসা কুকুরটার ছবি আঁকছে।

দুপুরের কিছু আগে আমরা বেরিয়ে পড়তাম। গন্তব্য জলসা মার্কেটের পুরনো বইয়ের দোকানগুলো, বিশেষত অমর বইঘর। সেখান থেকে কবি জ্যোতির্ময় নন্দীর রহমতগঞ্জের বাসায় কিংবা লালখান বাজারের বাগঘোনার আরেক বন্ধুর বাড়িতে। মাঝে মাঝে প্রয়াত লেখক অধ্যাপক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের বাসায়ও যাওয়া হতো। জ্যোতিদার বাড়িতে আমরা অনাহূতই ছিলাম। খুব বিরক্ত হতেন। বলতেন, আপনাদের আর কোনো কাজ নাই? কবিতা একটা লিখেই শোনানোর জন্য এখানে ছুটে আসতে হবে? তবু আমরা ছিলাম নাছোড়বান্দা। আসলে ভীষণ রকমের স্নেহই করতেন আমাদের। কয়েকদিন না গেলে জানতে চাইতেন কেন আসিনি।

নিপাট ভালোমানুষ বউদি আমাদের সাহিত্য আলোচনার কাছে ঘেঁষতেন না। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে তাঁর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আবার। একবার জ্যোতিদার বাসায় গিয়ে শুনলাম, তিনি নেই। বউদি বললেন, আপনাদের দাদা শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। আপনারাও তাড়াতাড়ি যান। নন্দনকাননের ফুলকিতে ওরা বসেছেন।

বুঝলাম সাহিত্যের আলোচনায় যোগ না দিলেও শঙ্খ ঘোষ যে আমাদের প্রিয় কবি এ-কথাটা বউদির কানে ঠিকই পৌঁছেছে। না হয় এমন উত্তেজিত হয়ে কেন খবরটা দেবেন তিনি।

তখনো জ্যোতিদা আর ওমর কায়সার ছাড়া চট্টগ্রামের কবিদের তেমন কারো সঙ্গে আলাপ-পরিচয় নেই। আবুল মোমেন, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, শাহিদ আনোয়ার, শেলিনা শেলী এদের দূর থেকে চিনি। ততোদিনে তাঁদের অনেকের কবিতাই পড়া হয়েছে। একটা মুগ্ধতাও ছিল। তবে সাহস করে কথা বলা হয়নি। এদের আসরেই শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে চলছিল সাহিত্য-আড্ডা। সেখানে কোন পরিচয়ে হাজির হই? কেমন কুণ্ঠিত ছিলাম মনে মনে। সালটা ১৯৯৮ হবে। তারিখ মনে নেই। শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে এক বন্ধুর কাছ থেকে একটা ছোট অডিও রেকর্ডার জোগাড় করে নিয়েছিল সুমন। আসরের মাঝামাঝি তখন, সবাই গোল হয়ে বসেছেন। তাঁদের মাঝে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি আর মোজা পরা শঙ্খ ঘোষ। ভূত দেখার মতো সবার দৃষ্টি আমাদের দিকে নিবদ্ধ। এমনকি শঙ্খ ঘোষেরও। তবে সেখানে উপস্থিত জ্যোতিদা আর আসর পরিচালনা করছিলেন যিনি, কবি ওমর কায়সার তাঁদের দেখেই সাহস পেলাম। ভেতরে ঢুকে বসে পড়লাম এক কোণে। সস্নেহে কায়সারভাই বললেন, এখানে সবাই কবিতা পড়েছে। এরপর শঙ্খ ঘোষ পড়বেন। তোমরা কি কবিতা নিয়ে এসেছো? আমি দুপাশে মাথা নেড়ে জানালাম, না, পড়ব না। কিন্তু সুমন আসরের সবার সামনে জানিয়ে দিলো সদ্য লেখা একটা কবিতা পকেটে আছে আমার। আসলে সেটা পকেটে করে নিয়ে বের হয়েছিলাম জ্যোতিদাকে শোনানোর জন্য। ওমর কায়সার সে-কথা শুনে ঘোষণা দিলেন, এখন আহমেদ মুনির কবিতা পড়বে।

আমার সারাশরীর কাঁপছে ভয়ে, লজ্জায়। ভাঁজ করা কাগজটা বের করতে করতে বলেছিলাম, দুর্ভাগ্য যে, একটা কবিতা পকেটে ছিল। সেই কবিতাখানা তুলে দিলাম এখানে –

‘ধূসর সন্ধ্যায় বাইরে আসি

বাতাসে ফুলের গন্ধ;

বাতাসে ফুলের গন্ধ;

আর কিসের হাহাকার।’

 

এই সমস্ত কিছুকেই আমি বলেছি ভাবালুতা

এবং অসময়ের বর্ষণও আমার আবেগকে

এখন আর জাগাতে পারছে না।

এখন আমি সকালকে বলছি সকাল

বিকেলকে বিকেল

আর সন্ধ্যাকে বলেছি কেবলমাত্র সন্ধ্যা।

বস্ত্তত এখন আমি এক প্রকার বর্ণান্ধ।

তবু এই বিকেলে আমাকে বেরোতে হলো

সমুদ্রের নোনা বাতাসের ঝাপটের মধ্যে,

জল আর জলের সবরকম তরলতার ভিতরে

ডুবে যেতে যেতে একটি উজ্জ্বল মাছ

কেবল প্রাণ পেল

অথবা বেরিয়ে এল কঠিন আড়াল থেকে;

তবু সেই বাড়িটার সামনে

আমার পদক্ষেপ কেমন টলোমলো হলো;

আর বাতাসে কিসের যেন হাহাকার

সবরকম ফুলের গন্ধকে ছাপিয়ে !

(‘ক্রমাগত ধূসর সন্ধ্যা’, আমি ও বাঘারু)

পাঠ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আমার কাঁপুনি থামছিল না। হঠাৎ শুনতে পেলাম শঙ্খ ঘোষ বলছেন, আমারও দুর্ভাগ্য যে তোমার পকেটে একটা কবিতাই ছিল, আর শোনা হলো না। তুমি আমার পাশে এসে বসো।

নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। আসরভর্তি মানুষের চোখ আমার দিকে। চোখের পানি লুকাতে চেষ্টা করছি প্রাণপণ। কিন্তু সহজ করে দিলেন শঙ্খ ঘোষ। তাঁর পাশে বসতেই বললেন, তুমি বাছাই করে দাও আমি পড়ি। আমি তাঁর বই থেকে এক-এক করে নিজের পছন্দের কবিতা উলটে সামনে এগিয়ে দিতে থাকলাম, আর তিনি পড়তে লাগলেন। পাশে এই সব যন্ত্রে ধারণ করছিল বন্ধু সুমন। বারোটি কবিতার সেই রেকর্ডটি পরে কবিকন্যা সেবমত্মী ঘোষ অর্থাৎ টিয়াদিকেও পাঠানো হয়েছিল। সেই আসরে উপস্থিত টিয়াদি পরে বলেছিলেন, তাঁকে তখন পিএইচ.ডি করতে যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে হচ্ছিল। প্রবাসে বাবার কণ্ঠ শুনবেন বলে কিছু কবিতা রেকর্ড করে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ তাতে রাজি ছিলেন না। বলেছিলেন, যন্ত্রে স্বস্তি পান না তিনি (অবশ্য পরে সংখ্যায় নগণ্য হলেও তাঁর ধারণ করা কবিতা খুঁজে পেয়েছি নানা জায়গায়)। অথচ এখানে কি অবলীলায় যন্ত্রে কবিতা ধারণের সম্মতি দিলেন!

আজ এতোকাল পর সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। অচেনা এক বালকের প্রায় না হয়ে ওঠা, কাঁচা কবিতার এমন প্রশংসা করা আর তাকে পাশে ডেকে নিয়ে বসানোর মধ্যে কেবল একটা প্রশ্রয়ই ছিল বলে মনে হয়। তরুণটি কবিতা লিখছে, আর সেই লেখার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে, কুণ্ঠা আছে, এটা বুঝতে পেরেছিলেন হয়তো। আর সেটা দূর করতেই তাঁর এই প্রচেষ্টা? ভাবতে গেলে আজো শঙ্খ ঘোষের প্রতি ভালোবাসায় মন আচ্ছন্ন হয়ে আসে।

 

শব্দ করে হাসো, যত পারো আজ বাঁচো

শোকের আপেল থেকে মুক্ত হও নরম খোসার মতো

মমতা-মাখানো ধান রুয়েছি মাটিতে

যাও তার ঘ্রাণ নিয়ে এসো।

 

এই নাও শেষ মদ, শস্যের সোনালি স্বেদ

জীবনের সাদা ফেনা, আশা ও শান্তির গাঢ় জল

প্রশান্ত স্নেহের জলে ডুবে আছে কালো এই পাড়া

যদি দুঃখ পেয়ে থাকো অচেনা পথের বাঁকে

দ্যাখো ধুলোলীন ঘাস, সহজ করুণ আমাদের ঘর।

(‘চাকমা বুড়োটা যা বলেছিল’, আমি ও বাঘারু)

২০০১ সালের দিকে একটা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে বছরখানেক রাঙামাটিতে কেটেছিল। শহরের রাজবাড়ি এলাকার কে কে রায় রোডের একটা বাড়িতে আরো চার চাকমা তরুণের সঙ্গে আমার নতুন সংসার। সে-বাড়ির বাসিন্দাদের একজন নন্দ চাকমার বাড়ি শুভলংয়ের কাছের একটা গ্রাম হাজাছড়ায়। নন্দর নিমন্ত্রণে একবার যাওয়া হয়েছিল ছবির মতো সুন্দর গ্রামটিতে।

শহরের রিজার্ভ বাজার ঘাট থেকে লঞ্চে শুভলং, সেখান থেকে ভাড়া নৌকায় হাজাছড়া। গ্রাম বলতে যে সহজ-সরল ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, হাজাছড়া সেরকম নয় মোটেও। কাপ্তাই হ্রদের মাঝে জলমগ্ন শান্ত এক গ্রাম। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি একেকটা টিলার ওপর। সেই টিলা আবার ডুবে আছে হ্রদের জলে। যেন অসংখ্য দ্বীপের একটা মালা। সেরকমই একটা টিলার সামনে এসে থামল আমাদের নৌকা। মূল বাড়ির আগে নৌকা ভেড়ার ঘাট, সেই ঘাট সংলগ্ন সেগুনবাগানের একটা অংশ হ্রদের জলে নিচু হয়ে মিশে গেছে। নৌকা থেকে নেমে, নন্দদা পথটা দেখিয়ে দিলেন,

সেগুনবাগানের ভেতর দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ, এই পথে সোজা গেলেই বাড়ি। আপনি দেখতে দেখতে আসেন, আমি বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে আসি।

টিলায় উঠতেই অপূর্ব দৃশ্য। সামনের নীল হ্রদের জলে ঝুঁকে পড়া সেগুনবাগানের টলটলে প্রতিবিম্ব। জলের ওপর ওঠা ঘূর্ণি বাতাস ক্ষণে ক্ষণে তাকে ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে। ঢেউ শান্ত হয়ে এলে সেটা আবার ভরে উঠছে আগের চেয়ে স্পষ্ট চেহারা নিয়ে। কোথাও কোনো গাছের ডাল থেকে ডেকে উঠছে একটা কোকিল। একবার ডাকতেই তার প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতে সময় নিচ্ছে বেশ কয়েক মিনিট। বাতাসে ঘাস আর পাহাড়ি লতার অতিপরিচিত মিষ্টি ঘ্রাণ।

এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখে পড়ল বাগানের প্রান্তে হ্রদের তীর ঘেঁষে একটা ছোট্ট মাচান ঘর। কাছে যেতেই দেখলাম, মাচানের দাওয়ায় দা-হাতে বাঁশের কঞ্চি কাটছে এক চাকমাবুড়ো। চোখাচোখি হতেই তিনি ইশারায় ডাকলেন। হাত ধরে মাচাঙে উঠে বসতে সাহায্য করলেন।

বুড়োর চোখে-মুখে হাসির ছটা। কথা বলে জানলাম, নন্দদার সেগুনবাগানের পাহারাদার তিনি। বাগানের পরিচর্যা করেন। জুমে আবাদ করে আর মাছ ধরে বেশ ভালোই কেটে যায় একার জীবন।

কথা বলতে বলতে ঘোলাটে এক গস্নাস পানীয় এগিয়ে দিলেন।

বললেন, ডাবের জল। বলেই আকর্ণবিসত্মৃত হাসি। তবে আমি যে বুঝতে পেরেছি এটা ডাবের জল নয়, তা বুঝতে দিইনি তাঁকে। বেশ ভালো এক চোয়ানি ছিল সেটা। একে তো নীরব, নিস্তব্ধ উদার
প্রকৃতি তার ওপর এমন উৎকৃষ্ট পানীয় – আমাকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। চাকমা বুড়ো তখনো পর্যন্ত আমার নাম জানতে চায়নি। নন্দর সঙ্গে এসেছি এটুকু জেনেই আলাপ জমায়।

আমাদের কথোপকথন পুরোটা মনে নেই। তবে যা মনে আছে তুলে দিচ্ছি –

আপনার ডাবের পানি তো বেশ ভালো!

হা হা, হ্যাঁ নিজে বানাইসি। আমার শ্বশুর এসে বেশির ভাগ

খেয়ে ফেলসে।

বউ কই আপনার?

সে মারা গেসে দশ বছর।

তারপরও শ্বশুর আসে এখানে?

হা হা, আসে, ডাবের পানি খাইতে আসে।

আপনি চট্টগ্রাম গেছেন কখনো?

আমি রাঙ্গামাটিও যাই নাই কখনো।

বলেন কি কেন যান নাই?

হুই দূরে, কি কামে যাব? কোনো কাম নাই সেখানে।

আপনার একা থাকতে ভয় লাগে না?

ভয়? ভয় কেন লাগবে, কোনো ভয় লাগে না।

আপনার জীবনে কোনো সমস্যা নাই?

কি নাই?

সমস্যা, সমস্যা।

মাচানের ওপর দাবা (হুঁকো) টানতে টানতে কয়েকজন বাগানি আমাদের কথা শুনছিল। তাদেরই একজন সমস্যার অর্থটা বুড়োকে বুঝিয়ে বললো।

বুড়ো উত্তর দিলো,

আছে আছে, একটা অসুবিধা আসে। এখানে রাতের বেলা দেওতারা দিস্টাব (বিরক্ত) করে।

দেওতা মানে ভূত?

আমাদের মধ্যে যারা মারা যায় তারা আর কী, আশপাশেই থাকে। রাতের বেলায় মাছ ধরতে গেলে মশাল তেনে (টেনে) ধরে পানিতে দুবিয়ে (ডুবিয়ে) নিভিয়ে দেয়। ক্ষতি করে না। খেলে আর কি আমার সঙ্গে।

এটা ছাড়া অন্য কোনো অসুবিধা নাই জীবনে?

বুড়ো হাসে, হা হা হা। কেন থাকবে?

হাসি সংক্রামক। আমি আর মাচাঙে বসা পাঁচ-ছয়জন বাগানিও তাতে যোগ দিই। একজন লম্বা বাঁশের দাবা এগিয়ে দেয় টানার জন্য। তার আগে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কীভাবে টানতে হবে। আমি সেই মতো টানার চেষ্টা করি। প্রথম বারে ধোঁয়া বের হয় না। এবার ফুসফুসে দম নিয়ে আবার চেষ্টা। জোরে টান। ধোঁয়ায় মুখ ভরে যায়। কড়া তামাকে প্রচ- কাশির দমক ওঠে। আমি কাশতে থাকি আর দাওয়ায় বুড়ো আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে পড়ে। আমার কাশির দমক যত বাড়ে তাদের আছাড়ি-পিছাড়ি হাসিও তত বাঁধভাঙা হয়ে ওঠে।