ক্যামিই ক্লদেল : নিঃসঙ্গ যন্ত্রণার মুখ

অমিতাভ মৈত্র

‘Paul claudel is a simpleton. When one has a sister who is a genius one doesn’t abandon her. But he always thought that he was the sole one who had the genius.’ – Morhardt

‘ঈ শ্বর, আবার যেন ফিরে যেতে পারি শৈশবের সেই গ্রাম ভিলেনোভে। সুখ স্মৃতিমাখা চিমনিটির পাশে বসে শরীরে জড়িয়ে নিতে পারি কোমল উত্তাপ।’ – অ্যাভিন্যঁর পাগলাগারদের অন্ধকার হিম কুঠুরি থেকে ভাই এবং বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার পল ক্লদেলকে (১৮৬৮-১৯৫৫) ক্যামিই ক্লদেল (১৮৬৪-১৯৪৩) লিখেছিলেন, বলা ভালো আর্ত-অসহায়তায় ভিক্ষা চেয়েছিলেন, ত্রিশ বছর ধরে কোনো মহৎ অভিপ্রায়ের কাছে বলিপ্রদত্ত এক অন্ধকার, শীতার্ত বন্দিজীবন থেকে তাঁর ছোটবেলার সেই গ্রামে ফিরতে, যেখানে বাতাসে
ধুয়ে-যাওয়া বাড়িতে একসময় ছোটভাই পলকে নিয়ে থাকতেন ক্যামিই। ‘উদারিং হাইটস’ নামের সেই বাড়িটিতে আর কখনো ফেরা হয়নি ক্যামিইর। ভিলেনোভের বনেজঙ্গলে লালচে পাথুরে মাটিতে বৃষ্টির মধ্যে ভাই পলের সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে, জীবনের আনন্দে ভেসে গড়াগড়ি খেতে খেতে ভাইকে বলেছিলেন, এই দুর্বল পাথরদের অমরত্ব দেবেন তিনি। ‘One day I shall animate the stone… marble gets its own weakness and I want to give it the force of love.’ দু-বছরের ছোট পলকে ভৎর্সনা করে ক্যামিই বলেছিলেন, শুধু বিখ্যাত নাট্যকার হতে চাইলে পল ভুল করছে। তাকে লিখতে হবে ইসকাইলাস আর শেক্সপিয়রের মতো সুমহান ট্র্যাজেডি। দিদির কথাকে কাজে অনুবাদ করেননি পল ক্লদেল। সময় বদলে গেছিল। ধ্রম্নপদী নাটকের দিন তখন আর নেই। এছাড়া যে অন্তর্দৃষ্টি, জীবনবোধ আর মানবচরিত্রের গভীর জ্ঞান ট্র্যাজেডি দাবি করে তা তাঁর ছিল না। তাঁর নাটক সুররিয়ালিস্টিক – যেখানে স্বপ্নের অনিয়ন্ত্রিত নিয়মে রূপক গল্পগুলো আসে, আর ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে চেতনায়। ক্যামিইর ছায়া তাঁর অনেক নাটকের চরিত্রেই এসেছে। The Satin Slipper-এর নায়িকা যখন উপাসনাকক্ষি কুমারী মেরির কোলে জুতো ছুড়ে দেন যাতে নরকের রাস্তায় যাওয়ার সময় তাঁকে খুঁড়িয়ে চলতে না হয় – আমাদের মনে পড়বে ক্যামিইর একটা পা সামান্য ছোট ছিল, তাঁর নিখুঁত শারীরিক গঠনে একমাত্র হালকা ছায়ার মতো।

ক্যামিইর মা ছিলেন অশিক্ষিত-অমার্জিত এক মহিলা। তিনি ঘৃণা করতেন ক্যামিকে। শারীরিক নিগ্রহও বাদ যেত না। কেননা তিনি ভেবেছিলেন, ক্যামিই নয়, এবার একটি ছেলে জন্মাবে তাঁর, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর শৈশবেই মৃত ছেলেকে ফিরে পাবেন আবার। ক্যামিইর ছোট বোনকেও তিনি প্ররোচিত করতেন ক্যামিইকে পীড়ন করার জন্য। ছোটভাই পলের স্মৃতিতে এসব ঘটনা গাঢ় প্রভাব রেখে যায়। তাঁর নাটকে যুদ্ধরত বোনদের দৃশ্য বারবার ফিরে এসেছে। La Jeune Fille Violaine নাটকের এক জায়গায় গরম ছাই দিদির চোখে ছুড়ে দিয়েছিল বোন। ক্যামিইর বাবা ছিলেন উচ্চপদস্থ চাকুরে এবং মুক্তচিমত্মায় বিশ্বাসী। ছোটবেলা থেকে ক্যামিই মাটির অসাধারণ মূর্তি তৈরি করতেন। তাঁর এই অসামান্য প্রতিভা বাবার চোখে ধরা পড়ল। বন্ধু আলফ্রেড বুশে ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভাস্কর। ক্যামিইকে তিনি নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। এই বয়সেই ক্যামিই ভাই পল, বিসমার্ক, নেপোলিয়ানের অসাধারণ মূর্তি করেছেন। করেছেন কল্পনানির্ভর কাজ – ডেভিড ও গলিয়াথ। কোনো প্রশিক্ষণ নেই, তবু কারিগরি দক্ষতার চূড়ান্ত বিন্দু স্পর্শ করেছে প্রতিটি কাজ। সংবেদনশীল জীবনের কোমল আলোছায়া ও লাবণ্যদ্যুতি প্রতিটি মূর্তির মুখে। ক্যামিইর চোখে তখন ভাস্কর হিসেবে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। তিনি যাবেন কাজ শিখতে। ১৮৮১ সালে তিনি ভর্তি হলেন আকাদামি কোলারসিতে, যেখানে তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন বুশে। বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই রদ্যাঁর সঙ্গে কাজ করো তুমি, তাই না?’ সেই মুহূর্তে কথাটি সত্যি ছিল না। কিন্তু পরে ক্যামিইর জীবনে কথাটি দৈববাণীর মতো সত্যি হয়ে উঠল, যখন এক সকালে সেই আর্ট কলেজে দায়িত্ব নিতে এলেন রদ্যাঁ। তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি পড়ল ক্যামিই আর তাঁর অসাধারণ কাজগুলোর ওপর। এবং এরপর তাঁদের কারো জীবনই আর আগের মতো থাকল না। সময়টা ১৮৮৩ সাল। ক্যামিই তখন উনিশ বছরের এক বহ্নিশিখা।

 

দুই

হ্যাঁ, বহ্নিশিখাই ছিলেন ক্যামিই। আত্মবিশ্বাসে, উচ্ছ্বাসে, জীবনের অন্তর্নিহিত দীপ্তিতে ভরপুর। সতেরো বছর বয়সেই বিস্ময়কর সব সৃজন করে চলেছেন তিনি। একটু একটু করে অনুভব করছেন সেই পৃথিবীকে, যে-পৃথিবী প্রতিভার মূল্য বোঝে, স্বীকৃতি দেয়, দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৫১ সালে, যখন তাঁর তিরাশি বছর, পল ক্লদেল স্মৃতিচারণ করেছিলেন আঠারো বছর বয়সের ক্যামিইর সেই স্বর্ণপ্রভ দিনগুলোর আর তাঁর চোখ-ধাঁধানো রূপের। লিখেছিলেন, ‘in the full glow of her youth and her genius, her splendid forehead overhanging magnificent deep-blue eyes, her mouth more proud than sensual, that mighty tuft of auburn hair falling to her hips. An impressive air of courage, of frankness, of superiority, of gaiety – the air of someone who has received much.’ যেন প্রাচীন কোনো ভাস্কর্যের প্রতিমা জমাট, গতিহীনতা থেকে রক্ত-মাংসের জীবনে নেমে এসেছে।

অন্যদিকে রদ্যাঁ তখন ভাস্কর হিসেবে খ্যাতির মধ্যগগনে। অসাধারণ সব ভাস্কর্য সৃষ্টি করে চলেছেন। মদ্যপ, গ্রাম্য, মাঝারি ধরনের শিক্ষিত (ফরাসি ভাষাটাও ভালো জানতেন না), সান্ধ্য আসরগুলোয় অপ্রতিভ, একটু যেন বেশি ইন্দ্রিয়প্রবণ – পল ক্লদেলের ভাষায়, ‘এক ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন শুয়োর’ – কিন্তু হাড়, পেশি, রক্ত-মাংসের বিপুল শক্তি ও ভয়াবহ বন্যতা তাঁর ভাস্কর্যগুলোর শরীরে। কাছে গেলে যেন সেই শরীরগুলো থেকে স্বেদ ও ক্ষীণ প্রস্রাবের গন্ধও পাওয়া যাবে। যেন সর্বকালের জান্তবতার ভাস্কর তিনি। রক্ত-ক্লেদ-বসার ঈশ্বর।

ক্লদ মোনের বাড়ির এক নৈশভোজের আসরে একবার রদ্যাঁ উপস্থিত। সামনের টেবিলে বসে থাকা চারজন আকর্ষণীয় তরুণীর দিকে তিনি পুরো সময় স্থির আগ্রাসী চোখে তাকিয়ে থাকলেন অন্যদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে। রীতিমতো অস্বসিত্ম নিয়ে সেই চার তরুণী একে একে টেবিল ছেড়ে চলে যায়। আর একবার এক কবির তরুণী বান্ধবীকে রদ্যাঁ গোপনে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। অনেক পরে সেই কবির ক্রোধ সিত্মমিত হয়, যখন তিনি দেখেন ‘her image, already alive, rising out of the clay, more beautiful than even.’

স্বাভাবিকভাবেই কামিইর সঙ্গে এক তীব্র আকর্ষণের সম্পর্ক তৈরি হলো রদ্যাঁর। এত বিখ্যাত একজন মানুষের সংস্পর্শে ক্যামিইও ভেসে গেলেন। ক্যামিই হয়ে উঠলেন রদ্যাঁর সহায়ক এবং প্রেমিকা। রদ্যাঁ তখন পূর্ণোদ্যমে সৃষ্টি করেছেন ‘গেটস অফ হেল’ এবং ‘বার্গারস অফ ক্যালে’। রদ্যাঁ এবং ক্যামিই দুজনেই প্রভাবিত হলেন একে অপরের শিল্প-ধারণায়। রদ্যাঁর ‘Galatee’-এর ছায়া পড়ল ১৮৮৭ সালে করা ক্যামির ‘The girl with the bunch of wheat’-এ। এবং ক্যামিইর ‘The wave’-কে মনে রাখল রদ্যাঁরThree Faunesses’। রদ্যাঁকে বলা যায় অ্যানাটমির ঈশ্বর। সার্জেনের ছুরির মতো নিখুঁত তাঁর চোখ ও হাত। কিন্তু শিল্প-সমালোচকরা মনে করেন, রদ্যাঁ একটি আদর্শ অনড় ভঙ্গিকে পাথরে বা ধাতুতে মূর্ত করে তুলতেই নিজের প্রতিভার সর্বস্ব ব্যয় করতেন। এ-প্রসঙ্গে ‘Gates of Hell’ বা ‘Age of Bronze’ এরকম সব ভাস্কর্যের কথা বলেন তাঁরা, যেগুলো স্থানিকভাবে অনড়, মহান ঐতিহ্যযুক্ত এবং আদর্শভাবে ভঙ্গিসর্বস্ব। গতিকে ভাস্কর্যে আনার কথা ভাবতেন তিনি তখনো। এখানে মনে পড়তে পারে রামকিংকরের ‘কলের বাঁশি’র কথা, যেখানে বাঁশির শব্দে ছুটে যাচ্ছেন দুজন রমণী কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। বাতাসে বসনাঞ্চল উড়ছে। ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়ালে মনে হবে, মূর্তিগুলো এত দ্রম্নত ধাবমান যেন কয়েক মুহূর্তেই তারা চোখের আড়ালে চলে যাবে। হাড়-পেশির প্রবল উপস্থিতিই তাঁর ভাস্কর্যের প্রাথমিক ভিত্তি। তাঁর বিখ্যাত ‘Penseur’-এ একটি মানুষের শরীর থেকে পেশির স্রোত যেন গড়িয়ে নামছে লাভার মতো। কিন্তু মানুষটির আত্মা – তার চিমত্মাস্রোত, তার অনুভূতির জগৎ সেখানে নেই। তার মুখে কোনো সূক্ষ্ম কম্পন নেই। কোনো ঢেউ সেখানে জেগে ওঠে না, ভেঙে পড়ে না। মুখটি দেখে মনে হয়, সে পরবর্তী ফুটবল ম্যাচ নিয়ে চিমিত্মত মাত্র। কিন্তু ‘La Penseur’এ মুখের মধ্যে নির্ভুল উঠে এলো চাপা বিষাদ, বিধুর বেদনা, সুদূরতা আর ভোরের আলোর মতো এক কোমলতা।  ‘La Penseur’ (দ্য থিংকার)-এর কয়েক বছর পরে করেছিলেন রদ্যাঁ ক্যামিইর মুখের এই ভাস্কর্য। তখন ক্যামিইর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছেন তিনি। তাঁদের সম্পর্কের উষ্ণতা তীব্র প্রভাব ফেলেছে তাঁদের কাজে। চিমত্মায় নতুন দিগন্ত, প্রকাশের নতুন ভাষা রদ্যাঁ খুঁজে পাচ্ছেন ক্যামিইর কাজে। এর আগে রদ্যাঁর বিষয় কেন্দ্রীভূত ছিল ধর্মীয় ঘটনা অথবা বিখ্যাত মনীষীদের
প্রতিকৃতি – যাচ্ছিল চার্চের চত্বর, রাস্তা বা বাগানের শোভাবর্ধনের জন্য।  ক্যামিইর সংস্পর্শেই রদ্যাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়। রক্ত-মাংসের প্রবলতা থেকে অনুভূতি ও ধারণার জগতে পা রাখলেন তিনি। আর এটি ঘটল এমন এক সময়ে, রদ্যাঁর সৃষ্টির জগৎ যখন প্রায় মরুভূমির মতো অনুর্বর। নতুন ধারণার উদ্গাতা হিসেবে খ্যাতি ছিল না তাঁর। কিন্তু ক্যামিইর কাজের মধ্যে তিনি নিজের নতুন রাস্তাটি দেখতে পেলেন।

 

তিন

ক্যামিই ও রদ্যাঁর সম্পর্ক ছিল বাত্যাসংকুল। তীব্র আকর্ষণে তাঁরা কাছে এসেছেন পরস্পরের। আবার মাঝে মাঝে দূরে সরে গেছেন। শরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ছিল তাঁদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে। পারী শহরে তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন না, গুঞ্জন জীবন্ত হয়ে ওঠার ভয়ে। মাঝে মাঝেই তাঁরা চলে যেতেন দূরে, নিভৃতে পরস্পরের কাছে আসতে। সামাজিক অনুষ্ঠানে পরস্পরের সঙ্গে তাঁরা আনুষ্ঠানিক দূরত্ব রেখে চলতেন। তবু বিভিন্ন সালোঁর সন্ধ্যায় বুদ্ধিদীপ্ত এবং অবশ্যই শোভনভাবে এই সম্পর্কের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরেই আসত মৃদু হাসির তরঙ্গ তুলে। প্রসঙ্গটি তাঁরা নিজেদের বন্ধুদের মধ্যেই রাখতেন রসালো চর্চার একটা বিষয় হিসেবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, ছাপার অক্ষরে কোথাও এই সম্পর্কে, ফরাসিরা যাকে বলতেন ‘Belle Epoque’, কোনো উলেস্নখ নেই। রদ্যাঁর প্রথমদিকের জীবনীলেখকরা শুধু এক ‘গভীর প্রেমে’র উলেস্নখ করেই কলম তুলে নিয়েছেন। একবারও ক্যামিইর নাম আসেনি সেখানে।

প্রচুর চিঠি চালাচালি হতো দুজনের মধ্যে। রদ্যাঁ লিখছেন, ‘প্রিয়তমা, তোমার লাবণ্যময় শরীরের সামনে হাঁটু মুড়ে ঝুঁকে আমি জড়িয়ে আছি তোমাকে।’ কখনো সদ্য তারুণ্যের আবেগে ক্যামিই লিখছেন, ‘আমি নগ্নদেহে ঘুমোতে যাই নিজেকে বোঝাতে যে, তুমি সঙ্গে আছো আমার। কিন্তু ঘুম থেকে জেগে দেখি পাশে তুমি নেই।’ রদ্যাঁর মধ্যে ক্যামিই খুঁজে পেলেন তাঁর শিক্ষক, তাঁর প্রেমিক, তাঁর শিল্পীজীবনে সার্থকতার পথ-দেখানো আলো। জীবনের পরিপূর্ণ আনন্দ-স্রোতে তিনি ভেসে যাচ্ছেন তখন। আর রদ্যাঁও ক্যামিইর মধ্যে খুঁজে পেলেন একই সঙ্গে তীব্র সুষমাময় শরীর, অবসানহীন সৌন্দর্য আর একজন সূক্ষ্ম, মননশীল, সুদক্ষ শিল্পীকে। রম্ন্য দ্য য়ুনিভার্সিতে রদ্যাঁর আতলিয়েরে সারাদিন কাজে ডুবে থাকেন দুজনে। সূক্ষ্ম কাজে ক্যামিই ছিলেন রদ্যাঁর চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। মার্বেলের কোনো ভাস্কর্যে সূক্ষ্ম স্পর্শ বেশি দরকার হয়। ক্যামিই সেটা করতেন। রদ্যাঁ কখনো করেননি। কোনো মূর্তির কারিগরি সূক্ষ্ম ও জটিল অংশগুলো, আর হাত-পা ইত্যাদি রদ্যাঁ ক্যামিইকে দিয়ে করাতেন, বলেন কেউ কেউ। ভাস্কর্যের জগতে তো বটেই, আংশিকভাবে চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও সাধারণভাবে কোনো শিল্পকর্মে অনেকের হাত থাকে। যিনি গুরু তাঁর নামেই যদিও সবাই সেই কাজটিকে জানে। একটি শিল্পকর্মের কোন অংশটি মূল শিল্পীর আর কোন কোন অংশে তাঁর ছাত্রছাত্রীর করস্পর্শ রয়েছে, শিল্পের আলোচনায় এটা এক ধারাবাহিক প্রসঙ্গ। রদ্যাঁর ভাস্কর্যগুলোও তার বাইরে নয়। অন্য শিক্ষানবিশদের নিয়ে, আর সব শিল্পীর মতোই, কিছুই বলেননি রদ্যাঁ; কিন্তু ক্যামিই সম্পর্কে তিনি ছিলেন সপ্রশংস।

কথাপ্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, ‘আমি শুধু তাকে সোনার খোঁজটুকু দিয়েছি। কিন্তু যে-স্বর্ণভাণ্ডার সে অর্জন করেছে সেটা পুরোপুরি তার নিজের।’ মোরহাৎর্, যাঁর কথা দিয়ে এই লেখাটির শুরু, জানিয়েছেন, সব বিষয়ে রদ্যাঁ তাঁর (ক্যামিই) সঙ্গে আলোচনা করে নিতেন কোনো সিদ্ধামেত্ম পৌঁছানোর আগে। যতক্ষণ না ক্যামিই একমত হতেন, রদ্যাঁ নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না। শিল্পী ক্যামিইর সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধার কথা পরবর্তী সময়েও বলেছেন তিনি। কিন্তু ১৮৮০-৯০ সালের আগে এসব মূল্যায়নের সময় ছিল না। তখন তীব্র ভালোবাসায় আছেন তাঁরা এবং অসাধারণ সব সৃষ্টি করেছেন ‘Camille with short hair’ (১৮৮২), ‘Mask of Camille’ এবং ‘Camille weaing a Bonnet’ ক্যামিইর ভাস্কর্যের গতিময়তা মনে রেখে রদ্যাঁ সৃষ্টি করেছেন ‘বার্গারস অফ ক্যালে’। রদ্যাঁর প্রভাবে ক্যামিই আঁকছেন ‘Couching Woman’ (১৮৮৫)। ১৮৮৮ সালে করছেন ‘Bust of Auguste Rodin’। এছাড়া ‘The Waltz’। আর তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টিশকুন্তলা’। ক্যামিইর করা রদ্যাঁর আবক্ষমূর্তি তাঁর শিল্পগত উৎকর্ষের জন্যই প্রিয় সংগ্রহ ছিল রদ্যাঁর। ১৮৮৮ সালের শাঁজেলিজের প্রদর্শনীতে প্রথম দেখানো হলো ক্যামিইর একক কাজ ‘শকুন্তলা’। দীর্ঘ বিরহের পর নারী আর পুরুষের মিলনের উদ্বেল সমর্পণ ও আনন্দ এক অসাধারণ নান্দনিক মাধুর্যে ধরা আছে ভাস্কর্যটিতে। পল ক্ললদেলের বর্ণনায় – ‘নতজানু পুরুষটি মুখ তুলে, তার হাত আলগোছে ঘিরে আছে নারীটির অসাধারণ লাবণ্যময় শরীর। ভালোবাসার আবেশে চোখ বুজে ঝুঁকে পড়েছে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে। বাঁ-হাতটি যেন অবশভাবে ঝুলে আছে। ডান হাতে সে কোমলভাবে আড়াল করছে তার বুক। যেন এভাবে সে বেঁধে রাখতে চাইছে হৃদয়ের আবেগ-গভীর স্পর্শের আসন্ন মুহূর্তে, এই আনন্দ-শিহরণের চেয়ে পবিত্র আর কী আছে?’

‘শকুন্তলা’ সে-বছর পেল সম্মান এবং মর্যাদার পুরস্কার। বাইরের জগতে ক্যামিইর প্রথম বড় স্বীকৃতি। ক্যামিই ভাবছেন, এবার হয়তো আসবে স্বাধীনভাবে নিজের কাজ করার জন্য দরকারি আর্থিক সহায়তা আর গ্যালারির পৃষ্ঠপোষকতা। পরিবর্তে এলো চাপা গুঞ্জন নানা সমালোচকের থেকে। ‘শকুন্তলা’ নাকি আসলে রদ্যাঁরই কাজ, ক্যামিই শুধু লাবণ্যযোজনা করেছেন।

বছরদুয়েক আগে ১৮৮৬ থেকেই তাঁদের সম্পর্কে একটা ঝড়ো সময় শুরু হয়েছিল। পারী ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে গেলেন ক্যামিই। তার আগেই রদ্যাঁর সামাজিক মেলামেশার অনুষ্ঠানগুলোয়, যেখানে একসময়ে সৃষ্টির যথেষ্ট পূজা পেতেন ক্যামিই, সেগুলোই অসহ্য ঠেকতে লাগল ক্যামিইর কাছে। আর ছিলেন রোজ ব্যরে – রদ্যাঁর সমত্মানের বিবাহহীন মা – একা হাতে যিনি সামলেছেন রদ্যাঁর গার্হস্থ্য ও মেজাজ-হারানো আক্রমণাত্মক শিল্পীকে। ক্যামিইর খোঁজে রদ্যাঁও ইংল্যান্ডে পা রাখলেন। অঙ্গীকার করলেন ক্যামিই ছাড়া আর কারো শিক্ষক হবেন না তিনি, শিল্পীমহলের আক্রমণে পাশে থাকবেন ক্যামিইর আর ইতালি থেকে ফিরে বিয়ে করবেন ক্যামিইকে। ক্যামিইও রাজি হলেন প্রতিমাসে চারবার রদ্যাঁর সঙ্গে মিলিত হতে। কিন্তু যা সন্দেহ করতেন আগে, সেটাই ক্রমে স্থির বিশ্বাসে জেনে গেলেন, প্রথম জীবনের বান্ধবী এবং সুখ-দুঃখের সাথিকে ছেড়ে রদ্যাঁ কোনোদিনই ক্যামিইর সঙ্গে ঘর বাঁধবেন না। তাঁর ছককাটা জীবনে এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য রদ্যাঁর নেই। তাঁদের সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই এবং তাঁদের ভালোবাসা নিভৃত অন্ধকারেই বাঁধা থাকবে সারাজীবন।

‘বালজাক’ ভাস্কর্যগুলো শেষ করার জন্য রদ্যাঁ তখন সারাদিন প্রেততাড়িতের মতো কাজ করে চলেছেন। ক্যামিইর হাতে সৃষ্টি হচ্ছে ‘ঢেউ’, ‘পলাতক ঈশ্বর’, ‘জরায়িত বৃদ্ধ’ এবং ‘অদৃষ্ট’।

‘অদৃষ্ট’ ভাস্কর্যটির রেখায় ফুটে উঠেছে রদ্যাঁ ও ক্যামিইর সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার ইতিহাস। ভাস্কর্যটির দুটি ভাগ। প্রথমটিতে বাঁ জানুতে ভর দিয়ে শক্তিমান পুরুষ কাছে আসতে বাধা দিচ্ছে এক মাঝবয়সী নারীকে। বাঁ-হাতে সে ছুঁয়ে আছে পাশের তরুণীকে। ক্যামিই যখন প্রধান এবং একমাত্র নারী রদ্যাঁর জীবনে, যখন প্রেমের জোয়ারে ভাসছেন দুজনে – রোজ ব্যরে যেখানে অনভিপ্রেত। দ্বিতীয় ভাগে কদাকার প্রৌঢ়ার আলিঙ্গনে তমসাচ্ছন্ন মুখের পুরুষটি মুখ ফিরিয়ে, সেই তরুণী ফিরে আসার আর্তি জানিয়ে হতাশায়-দুঃখে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। রদ্যাঁ ফিরে যাচ্ছেন ক্যামিইকে নিঃস্ব করে দিয়ে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এভাবে জনসমক্ষি চলে আসায় রদ্যাঁ বিরক্ত ও বিব্রত। সম্ভবত তাঁরই ইচ্ছায় রাষ্ট্রীয় চারুকলা বিভাগ থেকে কাজ শেষ করার প্রতিশ্রম্নত অর্থ আর আসে না ক্যামিইর কাছে। অসমাপ্ত থেকে যায় ভাস্কর্যটি। কোনো প্রদর্শনী থেকে আর ডাক আসে না। ভাস্কর্যের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর টাকার। সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার অর্থ সাহায্য ছাড়া যে-কাজ করা অসম্ভব। যৎসামান্য অর্থ সাহায্য পাঠাতেন ক্যামিইর বাবা আর রদ্যাঁ, যাতে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাটুকু হয় কোনোভাবে। অযত্নে অন্তরালে পড়ে থাকা তাঁর আঁকা অসাধারণ কিছু পোর্ট্রেট দেখে দর্শকদের এমন অনুশোচনা হয় – যদি ছবি আঁকাকেই জীবিকা করে নিতেন তিনি, তাহলে হয়তো নিজের খাবারের পয়সা বাঁচিয়ে একটু একটু মার্বেল কিনে, আইল সেন্ট লুইসের আবর্জনায় ঠাসা, আলোহীন দুই কামরার ছোট্ট ঘরে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে নিজেকে নিঃশেষ হয়তো করতে হতো না তাঁকে এভাবে। বাইরে বেরোনোর মতো জামাকাপড় কেনা আর ছেঁড়া জুতো বাতিল করার মতো পয়সা ছিল না বলে দোকানে রাতের খাবার কিনতে যেতেও সংকোচ হতো না তাহলে তাঁর। কিন্তু তিনি ক্যামিই। নিখুঁত ফর্ম ও রঙের ব্যবহারে চমকে দেবেন। কিন্তু তাকে পুঁজি করবেন না। তিনি ভাস্করই থাকবেন শেষ পর্যন্ত। ঘরের এখানে-সেখানে অজস্র ছবি এঁকে গুঁজে রাখতেন। দৈনন্দিন জীবনের অজস্র টুকরো টুকরো স্কেচ। রদ্যাঁর সঙ্গে তুলনা এড়াতে নিজের মনেই বলবেন – ছবির প্রতিটি মানুষই কিন্তু জামাকাপড় পরে আছে। নগ্নশরীরের পূজারি রদ্যাঁর প্রভাব থেকে এভাবেই নিজেকে মুক্ত করে নিচ্ছেন যেন তিনি।

 

চার

রোজ ব্যরে আর রদ্যাঁকে নিয়ে ক্যারিকেচার এঁকে রদ্যাঁকে পাঠাতেন ক্যামিই। তখন তিনি পুরোদস্ত্তর প্যায়ানোইয়াক। বেড়াল আর অন্ধকার নিয়ে তাঁর ঘরে একা বসে থাকেন। চুল সাদা হয়ে গেছে অকালে। মোটা হয়ে গেছেন। সেই সম্মোহক লাবণ্য এখন অবসিত। কিন্তু রোজ ব্যরে আর রদ্যাঁর সম্পর্ক নিয়ে অসম্ভব স্পর্শকাতর। কিন্তু এই সম্পর্কের ভিত্তিটুকু ছিল ওই দুই মানুষের জীবনে। খালি পেট আর খালি মানিব্যাগের পটভূমিকা রদ্যাঁ-ব্যরের সম্পর্কের অন্যতম অনুঘটক। অবস্থানগত সাযুজ্যেই তাঁদের মধ্যে সেতু গড়ে উঠেছিল। ব্যরে অশিক্ষিত, উচ্চসমাজে অযোগ্য। কিন্তু ক্রীতদাসের মতো তিনি বশংবদ ও মূক। আর এটাই সত্যি যে, রোজ ব্যরে এমন না হলে রদ্যাঁর জীবনে এভাবে জুড়ে যেত না ক্যামিইর জীবন। পঞ্চাশ বছর একসঙ্গে থাকার পর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে রোজ ব্যরে বিবাহিত হয়েছিলেন রদ্যাঁর সঙ্গে। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ও তন্নিষ্ঠ সেবা সিলমোহর পেল একভাবে।

ক্যামিইর অধরাই হয়ে থাকল সব।

প্যায়ানোইয়া-আক্রান্ত ক্যামিই তখন রদ্যাঁর প্রতি চূড়ান্ত ভয়, অবসাদ, সন্দেহ ও ঘৃণা নিয়ে ঘুমোতে যান রোজ, সেসব অনুভূতি নিয়েই পরদিন জেগে উঠবেন বলে। রদ্যাঁ লোক পাঠিয়েছেন ক্যামিইর কফির কাপে বিষ মেশানোর জন্য। নিজে অভুক্ত থেকে সেই টাকায় কেনা পাথরে তৈরি ছোট ছোট ভাস্কর্য রদ্যাঁ লোক পাঠিয়ে চুরি করে পাঁচ হাজার, দশ হাজার ফ্রাঁতে বিক্রি করছেন। তাই চমৎকার সব মূর্তি তৈরি করে, একসময় নিজেই হাতুড়ি দিয়ে সব ভেঙে, লুকিয়ে মাটির নিচে পুঁতে দিচ্ছেন, যাতে রদ্যাঁ নিয়ে না যেতে পারেন। তারই মধ্যে ছোটখাটো প্রতিকৃতি তৈরি করছেন রদ্যাঁর – যাতে রদ্যাঁ জানতে পারেন তিনি অনুতপ্ত, ক্ষমাপ্রার্থী – এবং তাঁকে আবার কাজের জগতে ফেরার ছাড়পত্র দেন।

প্রতিবেশীরা তাঁকে এড়িয়ে যান। শিশুদের ভালোবাসতেন ক্যামিই। (রদ্যাঁকে একবার বলেছিলেন, শিশু না থাকলে কোনো নারী-পুরুষের ভাস্কর্যে পূর্ণতা আসে না। বৃত্ত অসম্পূর্ণ থেকে যায়) কিন্তু প্রতিবেশীরা তাঁদের শিশুদের ক্যামিইর ছোট্ট ঘরের ত্রিসীমানায় যাওয়া নিষেধ করে দিয়েছিল। পল ক্লদেল দীর্ঘদিন বাইরে ছিলেন। ফিরে এসে ক্যামিইকে দেখে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন তিনি। সালটা ছিল ১৯১০। জার্নালে লিখলেন, ‘Camille insane, enormous, with a soiled face, speaking incessantly in a monotonous metallic voice.’

১৯১৩ সালের ২ মার্চ বাবা মারা গেলেন ক্যামিইর। তিনি জানলেন না। তিনদিনের মধ্যে পল ক্লদেল তাঁকে উন্মাদাগারে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করে দিলেন। তার দিনপাঁচেক পর হাসপাতাল থেকে মোটা দুজন লোক দরজা ভেঙে ক্যামিইকে নিয়ে যায় উন্মাদাগারে পৌঁছে দিতে। ‘দরজা ভেঙে’ – কারণ ভয়ে দরজা খোলেননি ক্যামিই। ভয়ে মাটিতে কয়েকটি বেড়াল নিয়ে তিনি নিরুপায় বশ্যতা স্বীকারের ভঙ্গিতে বসেছিলেন।

পরের উনত্রিশ বছর উন্মাদাগারেই কাটাবেন তিনি। মুক্তি আসবে মৃত্যুর মাধ্যমে। পাগলাগারদ থেকে প্রচুর চিঠি লিখতেন ক্যামিই। সহজ ভাষায়, যুক্তি-শৃঙ্খল মেনে। শুধু লিখতে লিখতে কখনো রদ্যাঁর প্রসঙ্গ এলে না-লেখা সাদা কাগজগুলো কেঁপে উঠত মৃত্যুভয়ে। পল ক্লদেলকে চিঠিতে একবার লিখেছিলেন, ‘পাগলাগারদ একটা বিশেষ উদ্দেশ্যেই বানানো হয়। মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করে দিতে। এসব মানুষের চিৎকার আর নিতে পারছি না আমি।’ উচ্চপদের প্রশাসক ও কূটনীতিক পলের হয়তো উপায় বা সদিচ্ছা ছিল না। ডাক্তাররা বারবার জানিয়েছেন, ক্যামিই সাধারণভাবে প্যায়ানোইয়াক – তাঁকে পাগলাগারদে রাখার প্রয়োজন নেই। কর্ণপাত করেননি কেউ। মাকে চিঠি লিখেছিলেন ক্যামিই, গ্রামের একটা ছোট্ট ঘরে তাঁকে থাকতে দেওয়ার জন্য। মা রাজি হননি।

১৯০৫ সালে কিছুদিন ভাই পল ক্লদেলের কাছে ছিলেন যখন, একটি অসাধারণ প্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন পলের। এবং এর কাছাকাছি সময়েই করেছেন ‘Conversationalist’ (১৮৯৭) এবং ‘The wave’ (১৯০০)। নানারঙের দুষ্প্রাপ্য পাথরে করা এই ভাস্কর্যগুলোতে তিনি আনলেন কম্পোজিশনের এক নতুন ধরন, যেখানে বাঁকে বাঁকে আনলেন এক সাংগীতিক সুষমা।

রদ্যাঁর জীবনে ক্যামিই প্রবল সমস্যা নিয়ে এসেছেন। রদ্যাঁর সঙ্গে তীব্র সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা শারীরিক এবং মানসিকভাবে ধ্বংসসত্মূপ করে দিয়েছিল ক্যামিইকে। কিন্তু এসব আপাতসত্যের আড়ালে গভীর নির্জন অন্য কোনো স্রোত স্পর্শ করে থাকত তাঁদের দুজনকে, যা বাইরের পৃথিবীর দিগমেত্মর পরপারে।

এবং এটাও আমাদের ধারণায় কোনোদিনই আসবে না, কেন জীবনের শেষ উনত্রিশ বছর একটি নিম্নমানের উন্মাদাশ্রমে থাকতে হলো তাঁকে অভুক্ত, হিংস্র সত্যিকারের উন্মাদদের সঙ্গে যারা তাঁর খাবার কেড়ে নিত, তাঁর নামে আসা উপহার যারা আত্মসাৎ করত। যখন উনপঞ্চাশ বছর ক্যামিইর, উন্মাদাগারে চলে যেতে হয় তাঁকে। পরবর্তী উনত্রিশ বছর কেমন ছিল তাঁর জীবন, সে-কথা জানার উপায় নেই। শুধু ডাক্তাররা এই উনত্রিশ বছর ধরেই বলে গেছেন যে, সাধারণ পারসিকিউসন ম্যানিয়ায় আক্রান্ত ক্যামিইকে এমন কঠিন শাসিত্ম বরাদ্দ করার কোনো যুক্তি নেই। এক অর্থে ক্যামিই ছিলেন বলিপ্রদত্ত। আর বলিপ্রদত্তের বেলায় সাধারণ নিয়মকানুন আর খাটে না।

ক্যামিইর এক বন্ধু একবার বলেছিলেন, ‘বেড়ালদের খেতে দেওয়া, বেড়ালদের সঙ্গে থাকতে চাওয়ার জন্যই কাউকে নিশ্চয় পাগলাগারদে রাখা যায় না।’ শেষজীবনে অনুতাপে দীর্ণ পল ক্লদেল লিখেছিলেন, ‘যখনই তার কথা ভাবি আমার মুখ ছাইয়ের দমবন্ধ করা বিস্বাদে ভরে যায়।’

রদ্যাঁর জীবনীকার গ্রানফিল্ড লিখেছিলেন, জীবনের প্রামেত্ম এসে রদ্যাঁ তাঁর সংগ্রহশালায় ক্যামিইর একটি টেরাকোটা প্রতিকৃতিকে যখন মমতার সঙ্গে ছুঁয়ে আছেন, একজন দর্শক তাঁকে বললেন, ‘তিনি তো এখন পাগলাগারদে চারশো মাইল দূরে, তাই না!’ সহসা আমূল কেঁপে উঠে রদ্যাঁ বলেছিলেন কর্কশ কান্নাভেজা গলায় – ‘অন্য যে কোনো বিষয়ে যদি কথা বলতেন, এটি আমার জন্য ছেড়ে দিয়ে।’

 

পাঁচ

গুরুতর অসুস্থ, চেতনা-আচ্ছন্ন রদ্যাঁ মেঁদর বাড়িতে চোখ বুজে শুয়ে। একবার ঘোরলাগা চোখ খুলে বললেন – ‘সে কোথায়… আমার স্ত্রী?’ ‘এই তো এখানেই’ – বলে রোজ ব্যরেকে নিয়ে এলেন তাঁরা। তখনো বিবাহ করেননি রদ্যাঁ পঞ্চাশ বছরের বিশ্বস্ত সঙ্গী ব্যরেকে। চোখ বুজে মাথা নেড়ে রদ্যাঁ বললেন – ‘না-না। এ নয়। অন্য আরেকজন – অন্য আরেকজন…।’

সেই আরেকজন তখন চারশো মাইল দূরে উন্মাদাগারে বসে কাঁচা ডিম আর খোসাসুদ্ধ আলু নিজে সেদ্ধ করে খাচ্ছেন, যাতে চারপাশে ঘুরে বেড়ানো রদ্যাঁর অনুচররা তাঁর খাবারে বিষ মেশাতে না পারে।

রাত্রে, মস্নান আলোয় আলুভোজী মানুষদের সামান্য নৈশাহারের দৃশ্য এঁকেছিলেন ভ্যান গঘ। তাদের মুখে শূন্যতা ছিল। কিন্তু ভালোবাসাও ছিল। কিন্তু আলুভোজী ক্যামিইর এই মুখটি নিজের অসামর্থ্যে আর ক্যামিইর প্রতি সম্ভ্রমের জন্যই কোনোদিন আঁকতেন না ভ্যান গঘ। r