খান সারওয়ার মুরশিদ ও তাঁর মূল্যবোধ

অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদকে (১৯২৪-২০১২) আমি প্রথম দেখি পাকিসত্মান সাহিত্য সংসদ নামে আমাদের সংগঠনের এক পাক্ষিক সভায়, সাপ্তাহিক বেগম – পরে মাসিক সওগাত – অফিসে, ১৯৫১ সালের একেবারে শেষে অথবা ১৯৫২ সালের একেবারে গোড়ায়। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক, New Values নামে এক উচ্চমানসম্পন্ন সাহিত্যপত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠন সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি এবং পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সহ-সভাপতি – যদিও এই শেষোক্ত সংগঠনে তিনি খুব কমই আসতেন। সেদিন এসেছিলেন এবং ওই আসরে পঠিত একটি কবিতার আলোচনা করেছিলেন। তিনি কথা বলছিলেন একটু থেমে-থেমে, সুনির্বাচিত শব্দ দিয়ে বাক্য গঠন করছিলেন এবং বাংলা বাক্যের মধ্যে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছিলেন না। প্রথম দর্শনেই তাঁর সৌম্য কান্তি আমাকে আকর্ষণ করে, এখন তাঁর ভাষাব্যবহার আমার মনে দাগ কেটে যায়।

পরে, তিনি নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলে, তাঁর কাছে সাবসিডিয়ারি ক্লাসে অল্পদিন ইংরেজি কবিতা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর ব্যাখ্যা অনেক সময়ে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত, কিন্তু তাঁর কবিতাপাঠ এত মনোমুগ্ধকর ও অর্থপূর্ণ ছিল যে, তাতেই আমরা কবিতার সৌন্দর্য ও সুষমা অনেকখানি উপলব্ধি করতে পারতাম।

তবে সে-সময়ে তাঁর সান্নিধ্যে আসার তেমন সুযোগ হয়নি, বরঞ্চ তাঁর পিতা আলী আহমদ খানের সাহচর্যলাভে সমর্থ হয়েছিলাম। তিনি ছিলেন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার এবং – দেশভাগের পর – পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে তাতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আর প্রার্থী হননি, তবে তাঁর পুত্রবধূ নূরজাহান মুরশিদ তখন যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীরূপে ঢাকায় মহিলাদের সংরক্ষিত একটি আসনে জয়লাভ করেন। এ থেকে সারওয়ার মুরশিদের পরিবারের রাজনৈতিক আবহের দিকটা বোঝা যাবে। আমি যে-সময়ের কথা বলছি, তখন আলী আহমদ খান পূর্ব বাংলা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা  করতেন। তাতে আমার একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছিল।

খান সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয় ১৯৫৯ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পরে এবং ক্রমশ তা ঘনিষ্ঠতায় পরিণতি লাভ করে। মনে পড়ে, ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে প্যাট্রিস লুমুম্বা নিহত হলে সেই হত্যাকা–র প্রতিবাদ জানিয়ে এবং সেজন্যে মোশে শোয়েম্বার বিচার দাবি করে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে একটি তারবার্তার খসড়া তিনি তৈরি করেন। তাঁর অভিপ্রায় ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক ওই পরিচয়ে এতে স্বাক্ষর করবেন। মুসাবিদায় কয়েকজনের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল, এখন তাতে একজন প্রবীণ শিক্ষকের স্বাক্ষর আনতে তিনি আমাকে পাঠালেন। আমাদের সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন কিছুটা নৈয়ায়িক প্রকৃতির। তিনি বললেন, লুমুম্বার জন্যে শোক প্রকাশ করা যায়, তাঁর হত্যাকা–র প্রতিবাদও করা যায়, তবে শোম্বে যে এ-ঘটনার জন্যে দায়ী, তা তো প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং তাঁর বিচার চাওয়া ঠিক হবে না। আমি সারওয়ার মুরশিদকে সেকথা জানালে তিনি উত্তেজিত হয়ে অনুচ্চার্য দুটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে কাগজটা একেবারে ছিঁড়ে ফেললেন। আসলে বিষয়টার সঙ্গে আরো একটি প্রশ্ন জড়িত ছিল। পাকিসত্মানে তখন সামরিক শাসন চলছে এবং এই অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে দেশে আমরা কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারছিলাম না। বিদেশে অগণতান্ত্রিক ঘটনার প্রতিবাদ করে সেই ক্ষোভও আমরা ব্যক্ত করতে চেয়েছিলাম।

এই ১৯৬১ ছিল রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের কাল। সারা পৃথিবীতে তা পালনের আয়োজন হচ্ছিল, শুধু পাকিসত্মানে কোনো উদ্যোগ ছিল না। বাংলা একাডেমির পরিচালকের সঙ্গে আলাপ করে বোঝা গেল, তাঁরাও কোনো ব্যবস্থা নেবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই জন্মশতবর্ষপালনে ইচ্ছুক ছিলেন, তবে তার নেতৃত্ব দিতে প্রস্ত্তত ছিলেন না। সারওয়ার মুরশিদ সে-দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মুরশিদকে সভাপতি ও ড. খান সরওয়ার মুরশিদকে সম্পাদক করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। পরে আরো দুটি কমিটি গঠন করা হয়। পাকিসত্মান সরকারের প্রচ্ছন্ন বাধা অগ্রাহ্য করে এই কমিটি তিনটি কাজ সমন্বয় করে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই পদক্ষেপকে সাহসী না বলে পারা যায় না। আবার, ১৯৬৭ সালে পাকিসত্মানের কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী যখন বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র-সংগীতের প্রচার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তখন তার প্রতিবাদে আমরা যে-উনিশজন তাৎক্ষণিক বিবৃতি দিই মুরশিদ ছিলেন তার স্বাক্ষরদাতাদের অন্যতম।

তার আগে ১৯৬৬ সালের একটি ঘটনায়ও তাঁর অংশগ্রহণের কথা বলতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতির শিক্ষক ড. আবু মাহমুদ বিভাগে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং মামলার রায় তাঁর পক্ষে যায়। রায়-ঘোষণার পর আদালত থেকে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়-আবাসে ফিরেছিলেন তখন সরকার-সমর্থক ছাত্র-সংগঠনের কিছু দুর্বৃত্ত তাঁকে ভয়ানক প্রহার করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং শিক্ষক সমিতির এক সভায় মিলিত হয়ে তাঁরা এর প্রতিকার দাবি করেন। এই সভায় এবং সভার পক্ষ থেকে বিবৃতিরচনায় মুরশিদ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

ষাটের দশকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সম্পূর্ণই সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ-সময়ে অল্প কয়েকজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তা বাকিদের কাছে তুলে ধরেছিলেন। এঁরা ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ্, ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী ও ড. খান সারওয়ার মুরশিদ। ষাট দশকের শেষে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা স্বায়ত্তশাসন ও বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতার প্রবল দাবি তুলেছিলেন। এর ফলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পরে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আইন পাই। এর জন্যে সারওয়ার মুরশিদকে আমাদের স্মরণ করতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়-স্বায়ত্তশাসনের যে-অপব্যবহার আমরা পরে করেছি, এঁরা তা কল্পনাও করতে পারেননি, এ-কথাও বলা দরকার।

আরো একটি বড় কাজের সঙ্গে সারওয়ার মুরশিদ জড়িত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে প্রেসিডেন্ট আইউব খান বিদ্যমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার লক্ষ্যে ইসলামাবাদে এক গোলটেবিল বৈঠকে রাজনীতিবিদদের বসতে আহবান করেন। বঙ্গবন্ধু তাতে যোগ দিতে যান, তখন খান সারওয়ার মুরশিদকেও সঙ্গে নিয়ে যান তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে। গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। তখন থেকে – হয়তো তার আগে থেকেই – মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত মুরশিদ পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরামর্শকের ভূমিকা।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিসত্মানি হানাদারদের পাশবিক আক্রমণের পর সারওয়ার মুরশিদ পৈতৃক বাসভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে চলে যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিসত্মান বিমানবাহিনীর বোমানিক্ষেপের পর তিনি সীমান্ত পার হয়ে সপরিবারে কলকাতায় আশ্রয় নেন। সেখানে সব শ্রেণির শরণার্থী শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতির পদ তিনি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সরকার পরিকল্পনা সেল – পরে পরিকল্পনা কমিশন – গঠন করলে তিনি তার সদস্য নিযুক্ত হন। এই সময়ে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসত্মাব প্রণয়ন করেন। দেশের যেসব তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তাদের একটি অংশকে সামরিক বাহিনীতে যুক্ত করা এবং বাকিদের নিয়ে দেশের উন্নয়নের লক্ষে্য একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা, যাতে ওই তরুণদের দেশপ্রেমের উদ্দীপনাকে সৃজনশীল কাজে লাগানো যায়। কিন্তু তাঁর প্রসত্মাবটি বিবেচনার আগেই বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা কলকাতা ছেড়ে ঢাকা চলে
আসেন এবং পরিকল্পনা কমিশনের একজন ছাড়া বাকি সদস্যেরা স্বদেশে নিজেদের পূর্বতন কর্মক্ষেত্রে ফিরে যান।  অনেককিছুর মতো মুরশিদের প্রসত্মাবটিও নতুন প্রশাসনের কাজের ভিড়ে চাপা পড়ে। কলকাতায় থাকাকালে মুরশিদের আরেকটি উলেস্নখযোগ্য কাজ ছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতারচনায় সাহায্য করা। তাজউদ্দীন আহমদ যা বলতে চান, তা তিনি মুখে বলে যেতেন, তারপর হয় আমি বাংলা খসড়া করতাম, মুরশিদ তার ইংরেজি তরজমা করতেন, নয়তো তিনি ইংরেজিতে লিখতেন, আমি বাংলা ভাষ্য রচনা করতাম। সবক্ষেত্রেই তাজউদ্দীন খসড়াটা দেখে দিতেন, প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতেন। এ-কাজটি করতে পেরে আমরা গভীর তৃপ্তি লাভ করতাম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর মুরশিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। সেখানে প্রথম সুযোগেই বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান করে ফরাসি মনীষী অঁদ্রে মলরোকে সম্মানসূচক ডি লিট্ উপাধি প্রদান করেন। আপনারা জানেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রবীণ এই মানুষটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি ট্যাংক বাহিনী পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন এবং তার ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সারা বিশ্বের সমর্থন ও সহানুভূতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাঁর সেই ভূমিকা স্মরণ করে তাঁকে সম্মাননা-জ্ঞাপনের এই একটিমাত্র প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল এবং তাতে মলরো অভিভূত হয়েছিলেন। এ-ছিল জাতির পক্ষ থেকে এই বিবেকবান মানুষের ঋণস্বীকার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুরশিদের স্থায়ী কীর্তি ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজ স্থাপন করা। দেশের সর্বক্ষেত্রে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান নিয়ে গবেষণা করা ছিল এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুরশিদ যখন আর স্বস্তিবোধ করছিলেন না, তখন উপাচার্যের পদটি তিনি ছেড়ে দিতে চান। তারপর তাঁকে পোল্যান্ডে – এবং একইসঙ্গে হাঙ্গেরিতে – বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হয়।

চিত্রকলা মুরশিদের বরাবর প্রিয় বিষয়। পোল্যান্ডে তিনি বাংলাদেশের চিত্রকলার একটি প্রদর্শনী আয়োজন করেন এবং আমাদের কোনো কোনো শিল্পীকে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। দীর্ঘমেয়াদে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন দেবদাস চক্রবর্তীকে। তবে দেবদাসের স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় মেয়াদ শেষ করার আগেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।

দু-বছর বা তার একটু বেশি সময় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে মুরশিদ চলে যান লন্ডনে – কমনওয়েলথ সচিবালয়ে সহকারী মহাসচিবের পদে। তার পাঁচ বছর পর ফিরে এলেন তাঁর ‘দীর্ঘকালের মানস ঠিকানা, আধ্যাত্মিক আশ্রয় এবং সংগ্রামের কেন্দ্র’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বছরখানেক পর তিনি অবসর নিলে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক নিযুক্ত করে। দেশে তখন দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন ও তার উত্তরাধিকাররূপে ছদ্ম-সামরিক সামনের পালা। ১৯৮৭ সালের ৩১শে মার্চ সংবাদপত্রে সারওয়ার মুরশিদসহ ৩১ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক যুক্ত বিবৃতিতে সংবিধানের অধীনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে তার কাছে ক্ষমতা হসত্মান্তর করতে সরকারকে আহবান জানান। আশা প্রকাশ করা হয় যে, এই সরকার রাজনীতিকে অস্ত্রমুক্ত এবং সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত করবেন, দ্রুত সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন, সরকারের কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না এবং কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত করবেন না। পরে ৩১ জনের সবাই আর একসঙ্গে থাকেননি, কিন্তু আমাদের পরিচিতি হয়ে গেল ৩১ জন নাগরিক বলে। সেই ৩১ জনের পক্ষ থেকেই আমরা প্রচারাভিযান চালিয়ে যাই জেনারেল এরশাদের পদত্যাগ এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের সরকার গঠন করা পর্যন্ত। ৩১ জনের একজন অধ্যাপক জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছিলেন।

পঞ্চাশের দশকে রকফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থানুকূল্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইরেজি বিভাগে পূর্ব বাংলার সমকালীন বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কয়েকদিনব্যাপী এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় ইংরেজি ভাষায়। সেখানে পঠিত প্রবন্ধগুলি Contemporary Bengali Writing নামে সম্পাদনা করেন সারওয়ার মুরশিদ। পরে, আশির দশকে, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির হয়ে বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে বাংলায় কয়েকদিনব্যাপী একটি সেমিনারের আয়োজন করেন মুরশিদ এবং সেখানে পঠিত প্রবন্ধ নিয়ে সমকালীন বাংলাদেশের সাহিত্য নামে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে একটি বই প্রকাশ করেন। এই সময়ে তাঁর আগের ইংরেজি সংকলন গ্রন্থটিও পুনর্মুদ্রিত হয়। তাছাড়া তাঁর বাংলা প্রবন্ধ-সংকলন কালের কথাও প্রকাশলাভ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাদিক্রমে প্রায় কুড়ি বছর সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে সম্মানিত ফেলো পদে ভূষিত করে। তিনি তিন বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে খান সারওয়ার মুরশিদ সংবর্ধনা গ্রন্থ। সেই বছরের শেষ দিকেই তাঁর জীবনাবসান হয়।

 

দুই

খান সরওয়ার মুরশিদ ১৯৪৯ সালে – তাঁর শিক্ষকতা জীবনের প্রথম বর্ষেই – ত্রৈমাসিক New Values প্রকাশ করেছিলেন এবং অনিয়মিতভাবে হলেও ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছিলেন। পত্রিকা প্রকাশের সময়ে ঢাকা শহরে কয়জনই বা ইংরেজি পত্রিকার পাঠক ছিল! এ পত্রিকাকে সম্পাদক কতটা গুরুত্ব দিতেন, তা জানা যায় অধ্যাপক জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকীর একটি বক্তব্য  থেকে : ‘তিনি পড়ানোর ফাঁকে তাঁর এই পত্রিকার প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং এমনও ধারণা দিয়েছেন যে তাঁর দুই কাজের [শিক্ষকতা এবং পত্রিকা-সম্পাদনার] মধ্যে কোনটিকে তিনি শেষ পর্যন্ত একক কাজ হিসেবে বেছে নেবেন, সে বিষয়ে তিনি দ্বিধান্বিত।’ অধ্যাপক এ জি স্টক এই পত্রিকা সম্পর্কে যে-অন্তর্দৃষ্টিমূলক মন্তব্য করেছিলেন, তা এখানে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক হবে :

It seems to me that he kept New Values to a broad political outlook, unmistakenly critical of the government but above from party commitment and discreetly general enough in its specific comments to escape suppression, without being merely cantankerous; kept a high standard of writing; kept it, in matters literary and artistic, above the mutual admiration  level which would have made it a ‘little magazine’.

দুর্ভাগ্যের বিষয় নিউ ভ্যালুজের সংখ্যাগুলো এখন পাওয়া যায় না। জীবনসায়াহ্নে সারওয়ার মুরশিদ নিউ ভ্যালুজের নির্বাচিত রচনার একটি সংকলন করেছিলেন – শামসুজ্জামান খান ও কুমার মুরশিদের সম্পাদনায় অচিরেই তা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হবে। সেই পা-ুলিপি অবলম্বন করে পত্রিকাটি সম্পর্কে কিছু বলছি।

প্রথমেই চোখে পড়ে এর সমৃদ্ধ লেখক-তালিকা : এম এন রায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, কাজী আবদুল ওদুদ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, হুমায়ুন কবির, আবু সয়ীদ আইয়ুব, আহমেদ আলী, শিবনারায়ণ রায়, এ কে ব্রোহী, কে হক, কল্ডওয়েল ড্যানিয়েল, এফএসি উইলসন, হেনরি উইডোসন *, এ জি স্টক, মাজহারুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, অজিতকুমার সেন, মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, এ কে নাজমুল করিম, অমলেন্দু বসু, মমতাজুর রহমান তরফদার, রেহমান সোবহান, মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী, বদরুদ্দীন উমর এবং সম্পাদক স্বয়ং। বিষয়বস্ত্তর তালিকাও বৈচিত্র্যে ও বৈদগ্ধ্যে চিহ্নিত। সাহিত্যের নানাদিক নিয়ে বেশ কটি প্রবন্ধ আছে, আছে তুলনামূলক সাহিত্য সম্পর্কেও। সাহিত্যিকদের মধ্যে আলোচিত হয়েছেন গ্যয়টে, ইয়েটস, হপ্টম্যান, জাঁ পল-সার্ত্র, গালিব, ইকবাল, সরোজিনী নাইডু ও নজরুল ইসলাম। তাছাড়া পূর্ব পাকিসত্মানের কবিতা-বিষয়েও একটা আলোচনা পাই। ইসলাম সম্পর্কে বেশ কটি লেখা চোখে   পড়ে : ইসলাম ও বিজ্ঞান, ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি, পাকিসত্মান ও ইসলামি রাষ্ট্র, কমিউনিজম ও ইসলাম এবং তার সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে ধর্ম ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা। ইতিহাস-বিষয়ে প্রবন্ধের মধ্যে পাই পর্তুগিজ পর্যটকের দৃষ্টিতে বাংলা, ওয়াহাবি আন্দোলন এবং উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মন। পাকিসত্মান-সম্পর্কিত একটি রচনার উলেস্নখ আগেই করা হয়েছে। তাছাড়া পাই পাকিসত্মানের সমাজ ও রাজনীতি, পাকিসত্মানের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল এবং দুই অর্থনীতি।

ওপরের তালিকা থেকে বোঝা যায় যে, নিউ ভ্যালুজ কেবল উচ্চমানের সাহিত্য পত্রিকা ছিল না। চিরন্তন কিছু বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে উৎকণ্ঠা, সদ্যপ্রতিষ্ঠিত পাকিসত্মানের রাজনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা, পূর্ববাংলার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব নিয়ে উন্নয়নের আকাঙক্ষা। ১৯৪৭ সালের পর যখন দেশের ক্ষমতাসীন দল এবং তাঁদের সমর্থক সামাজিকদের কাছে রাষ্ট্রের আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পর্কে নানাধরনের আপ্তবাক্য শোনা যাচ্ছিল, তখন নিউ ভ্যালুজ একটি ইহজাগতিক, গণতান্ত্রিক ও সীমিতভাবে হলেও সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল।

দু-একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ‘ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি’ নামে কাজী আবদুল ওদুদের একটি প্রবন্ধ আছে। সম্ভবত তারই ইংরেজি ভাষ্য তিনি নিউ ভ্যালুজে প্রকাশের জন্যে পাঠিয়েছিলেন। পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে – এ-ধরনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, শরিয়ায় অপরাধের যে শাস্তি নির্ণীত হয়েছে, তার সঙ্গে আধুনিক আইনের যে-সংঘাত, তা মিটবে কী করে? শরিয়া আইন যখন প্রবর্তিত হয়, তারপর অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী ধ্যানধারণা অনেক পরিবর্তিত হয়ে অনেক মানবিক হয়েছে এবং আধুনিক আইন এই পরিবর্তিত মূল্যবোধের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। এখন আমরা কোনটা গ্রহণ করব? দ্বিতীয়ত, পাকিসত্মান রাষ্ট্রে উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক অমুসলমান রয়েছে, রাষ্ট্র তাদের প্রতি কেমন আচরণ করবে? ওদুদ বলছেন যে, হযরত মুহম্মদের জীবদ্দশায় মদিনা বা হোদাইবিয়ায় এ-বিষয়ে যে-ব্যবস্থা নেওয়া হয়, পরবর্তীকালের ইসলামি সাম্রাজ্যের ব্যবস্থার সঙ্গে তা ছিল অনেক মানবিক। আধুনিককালে কোনটা আচরিত হবে? হুমায়ুন কবির বলেছেন, ইসলামের নবি বলে গেছেন যে, ধর্মের ভিত্তি হবে যুক্তি – কর্তৃত্ববাদ নয়। যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান এবং তার বিবর্তন অলৌকিকতার যুগের অবসান ঘটিয়েছে। এখন আমাদের সকল ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস ক্রমাগত যুক্তির আলোকে যাচাই করে নিতে হবে। এ কে নাজমুল করিম বলেছেন, মানুষের সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ না দিয়ে কোনো সমাজই আত্মরক্ষার আশা করতে পারে না কিংবা মানবসভ্যতাকে মৌলিক কিছু দিতে পারে না। কিন্তু ইসলামের মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকার তো কাউকে দেওয়া হয়নি।

সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে আমি লেখকদের প্রতি সুবিচার করতে পারিনি। তবে এ-কথা বলতে পারি যে, এসব লেখার মধ্যে অনেক প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে, ব্যক্তির বা সমষ্টির কাছে যা উত্তর দাবি করে। মনে হয়, সেটিই ছিল পত্রিকাটির একটি লক্ষ্য। তেমনি, দুই অর্থনীতির অর্থ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে রেহমান সোবহান যে-প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তাতে পাকিসত্মানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের দিকটা যেমন তুলে ধরা হয়, তাতে এর সমাধান জরুরি বলেই পাঠকের প্রতীতি জন্মায়। পাকিসত্মানের অনুদার পরিবেশে এ-সবই ছিল সাহসিকতার পরিচায়ক।

এ-কথা স্পষ্ট যে, সাহিত্যের চিরন্তনতার সন্ধান ও আধুনিক সাহিত্যের বিচারের পাশাপাশি ধর্ম ও রাষ্ট্র, সমাজ ও ইতিহাস, রাজনীতি ও অর্থনীতির আলোচনা পত্রস্থ করে নিউ ভ্যালুজ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎকে বিশ্বব্যাপী ভাবলোকের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। যখন ভাবা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক নিজের স্বল্প সামর্থ্য দিয়ে এমন একটি পত্রিকার সূচনা করেছিলেন এবং ব্যক্তিজীবন ও রাষ্ট্রজীবনের নানা উত্থানপতনের মধ্যে সতেরো বছর ধরে তা টিকিয়ে রেখেছিলেন, তখন তাঁর কৃতিত্ব অসামান্য বলে বিবেচিত না হয়ে পারে না।

 

তিন

শিক্ষাভাবনায় খান সারওয়ার মুরশিদ প্রণোদনা লাভ করেছিলেন কার্ডিনাল নিউম্যান, জন ডিউয়ি, কার্ল ইয়াসপার্স ও রবীন্দ্রনাথ থেকে। এঁদের মধ্যে, মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তাই তাঁকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। সেখানে তিনি কী পেয়েছেন, তা যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে তিনি জানিয়েছেন, তার মধ্যেই মুরশিদের শিক্ষাভাবনাকে পাব :

তাঁর [রবীন্দ্রনাথের] বিবেচনায় শিক্ষার লক্ষ্য হবে : মনুষ্যত্বের সম্পূর্ণ উন্মোচন, ব্যক্তির সকল শুভ সম্ভাবনার স্ফুরণ, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের যোগ, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যোগ, শিক্ষিত – অশিক্ষিতের  বৈষম্য বিমোচন, আত্মিক ও ব্যবহারিকের মধ্যে সমন্বয়, জ্ঞান বোধ কল্পনা ও সৌন্দর্য-চেতনার কর্ষণ ও বিকাশ, কর্মে জ্ঞানের নিয়োগের দ্বারা জীবনে সম্পন্নতা ও সমৃদ্ধি অর্জন, সৃজনশীলতার সাহায্যে মনুষ্যত্বের পরিচর্যা এবং প্রসার। স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার কেন্দ্রে ছিল এক জীবন-লগ্ন সমাজ-লগ্ন এবং বিশ্ব-লগ্ন, যুক্তি-কল্পনা ও প্রায়োগিক শক্তিতে দক্ষ, পূর্ণ-বিকশিত এবং বিবর্তিত মানুষ। নিঃসন্দেহে এ মডেলটি রেনেসাঁসি। আর শিক্ষার প্রক্রিয়া সম্পর্কে কবি অভিজ্ঞতা নিংড়ে বলেছেন একটি মূল্যবান ও হৃদয়গ্রাহী কথা : দানে এবং গ্রহণে থাকবে ‘আনন্দ’।

উলিস্নখিত শিক্ষা-দৃষ্টিতে সমাজ যে অনুপস্থিত নয় তা পরিষ্কার। আসলে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার উপর এত জোর দিয়েছেন শুধু ব্যক্তির জন্যে নয়, সমাজের জন্যেও। তিনি ভাব ভাষা জীবন ও সমাজকে এক সূত্রে গ্রথিত দেখতে চেয়েছেন, কেননা এ চার সুসমঞ্জস না হওয়ার ফল ব্যক্তিজগতের বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক বিচ্ছেদ, ব্যাপক নিষ্ফলতা।

(কালের কথা, পৃ ১২৮-২৯)

মুরশিদ আরো বলেছেন : ‘প্রযুক্তির দ্বারা প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব অর্জন করে যে পাশ্চাত্য বিশ্বের প্রভু হয়ে বসেছে তার বিজ্ঞানকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন।’ (ঐ, পৃ ১২৯)

অপরপক্ষে, কার্ডিন্যাল নিউম্যান যে ‘জ্ঞানবিজ্ঞানকে তাদের সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের জন্যে মূল্য দিতেন, তিনি ব্যবহারিক জ্ঞানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে উপযুক্ত বিষয় মনে করতেন না’, সে-সম্পর্কে মুরশিদ একমত হননি। তবে নিউম্যানের যে-ধারণার যাথার্থ্য তিনি স্বীকার করেন, তা এই :

তিনি [নিউম্যান] মনের উন্মোচন, জ্ঞানের আত্তীকরণ তো চেয়েছেনই, তিনি আরও চেয়েছেন জ্ঞানের ওপর মনের প্রভুত্ব, তার ব্যবহারে মনের পূর্ণশাসন, একই সঙ্গে মনের কাঠিন্য ও নমনীয়তা। যে প্রক্রিয়া মনকে এই ক্ষমতা দেয়, অধ্যয়ন নিরীক্ষণ কর্ম এবং ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির ওপর তাকে চিন্তা প্রয়োগ করতে শেখায়, তাকেই শুধু উচ্চশিক্ষা বলা যায়…। (ঐ, পৃ ১৩৯)

মুরশিদ আজীবন এই উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন, তবে তাকে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। তাই তিনি বলেছেন :

আমাদের জন্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার লিবারেল দর্শন এবং নিমিত্তবাদী দর্শনকে মেলানো। এই মেলানোর মধ্যে আমাদের আরও কতগুলো দায়িত্ব আছে : শিক্ষার সব স্তরের মধ্যে নিবিড় এবং যৌক্তিক সম্পর্ক স্থাপন, প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে মানববিদ্যা এবং বিজ্ঞানের ওপর সমান জোর দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচিকে যথার্থ ‘ইন্টারডিসিপিস্ননারি’ করা, বিশেষ বা সংকীর্ণ – গভীর জ্ঞানকে অটোম্যাটিক না করে সর্বশেষ স্তরে ঐচ্ছিক করা এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে জাতীয় শিক্ষার সঙ্গে যথোপযুক্তভাবে সমন্বিত করা। (ঐ, পৃ ১৪০)

উচ্চশিক্ষা দান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান কেন্দ্রীয়, তাই এ-সম্পর্কে মুরশিদের উৎকণ্ঠাও অধিক। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ১৯৯৪ সালে তাঁর পর্যবেক্ষণ :

একটি অতি দরিদ্র, পরনির্ভর, বর্বরতার দিকে দ্রম্নত অগ্রসরমান, খ- খ- আত্মসর্বস্ব গোষ্ঠী পরিকীর্ণ, প্রান্তিক সম্পন্নতার এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় আজ প্রায় প্রান্তিক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্যবিত্ত সৃষ্টি করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজ নিজেকে প্রায় বাতিল করে দিচ্ছে নানা অবক্ষয় দ্বারা, সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও। এর ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত কেন্দ্রীয় গুরুত্ব আর নেই, অথচ সমাজের নবায়নের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই।   (ঐ, পৃ ১৮২)

মুরশিদ জানতেন যে, যে-সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান, সেই সমাজের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরে পড়ে। সমাজ মানে সমাজের শক্তিমান ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী। আবার, এই প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয় তার দায়িত্ব পালন করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন তাই অপরিহার্য।

মুরশিদ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার দুটি দিক আছে : ‘প্রাতিষ্ঠানিক স্বশাসন এবং বিদ্যায়তনিক (অ্যাকাডেমিক) স্বাধীনতা, এবং ধারণা দুটো পরস্পর আশিস্নষ্ট হলেও পৃথক।’ (ঐ, ১৫৩) রাষ্ট্রই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থাগমের একমাত্র উৎস হয়, সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ স্বশাসন অসম্ভব। তবে উদারনৈতিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের মতো মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন ও কর্মসূচি অনুযায়ী অর্থ জোগানোর ব্যবস্থা করে। এই স্বশাসন-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সকল অঙ্গে অথবা কর্তৃমণ্ডলীতে ক্ষমতা সম্প্রসারিত হবে, তাদের ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে সংযুক্ত করবে। আর বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা বলতে বোঝাবে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া জ্ঞানচর্চা – পুরনো জ্ঞানের মূল্যায়ন এবং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা।’ (ঐ, পৃ ১৫৩)

এই প্রসঙ্গে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে তিনি উদ্ধৃত করেছেন – তাতে তাঁর নিজের মনের কথা তিনি শুনতে পেয়েছেন।

The university must be free from external control over the range of subjects of study and methods of teaching and research. We have to keep it equally free from the trammels in other directions – political fetters from the state, ecclesiastic fetters from religious corporations, civic fetters from the community and pedantic fetters from what may be called the corporate repressive action of the university itself. (ঐ, পৃ ১০০)

শেষের কথাটি আগের কথাগুলোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে যে-আইন আমরা বিধিবদ্ধ করি, তার একজন প্রবক্তা হয়েও মুরশিদ তার পুনর্বিবেচনার কথা ভেবেছিলেন :

একটি বিশেষ সময়ে বিশেষ অভিজ্ঞতার প্রভাবে মানুষের তৈরি একটা দলিল কোনোদিনই দ্বিতীয় দৃষ্টির দাবি করে না, এমন একটা অবস্থান আমি গ্রহণ করতে পারি না। আমার বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দৃষ্টি প্রয়োজন। … আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনিক স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার করিনি এমন কথা বলতে পারবো না। (ঐ, পৃ ১৭৯)

এই আইনের যে-অপপ্রয়োগ হয়েছে, তার একটা তালিকা তৈরি করে মুরশিদ বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে যেমন বাইরের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হবে, তেমনি তাকে তার নিজের ভেতরের আত্মতৃপ্তির চোরাবালি, মনন এবং জ্ঞানের নিষ্ক্রিয়তা ও অচলতা থেকে রক্ষা করতে হবে।’

 

চার

আরো অনেকের মতো খান সারওয়ার মুরশিদের গৌরববোধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। তাঁর নিজস্ব ধরনে ও ভাষায় এ-সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তা দীর্ঘ হলেও উদ্ধৃতিযোগ্য :

আমার একান্ত ব্যক্তিকথার বাইরে যে যুদ্ধটা ঘটছিল এবং যা কোটি কোটি মানুষের মন এবং জীবনকে বদলে দিচ্ছিল তার কয়েকটি দিক পরিষ্কার করে এবং জোরের সঙ্গে উলেস্নখের দাবি রাখে যদিও তা পরিচিত কথার পুনরাবৃত্তির মতো শোনাতে পারে। এক. এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে এবং প্রায় সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিল, এর জন্যে অসহযোগ আন্দোলনের জঙ্গিতা ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের সংঘাতের ক্রমিকতার মধ্য দিয়ে বাঙালির মনোভূমি তৈরি হয়েছিল। দুই. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম পরীক্ষার প্রস্ত্ততির ডাক হিসেবেই সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ সৈনিক বুঝেছিল। তিন. পঁচিশে মার্চ রাতে ইয়াহিয়ার আকস্মিক কুটিল ভয়াল আক্রমণ এবং হত্যাযজ্ঞ যে ঘটনাধারা সৃষ্টি করে তাতে যেমন ছিল উদ্ভ্রান্ত আতঙ্ক, তেমনি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। এ স্বতঃস্ফূর্ততা এ যুদ্ধের এক বড় উপাদান হলেও একে সংগঠিত করার জন্যে একটি যন্ত্র এবং কাঠামোর প্রয়োজন হয়েছিল, আর তা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান করে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত প্রবাসী অস্থায়ী সরকার। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং তার সহকর্মীরা দক্ষতার সঙ্গে একটি মহান এবং দুরূহ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। চার. মুক্তিযুদ্ধের ‘জাতীয়’ প্রচেষ্টায় মূল শক্তি আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেক দল অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রধান রাজনৈতিক দলটিসহ কারো ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করা চোখে ঠুলি পড়ার সামিল। পাঁচ. এ যুদ্ধের নায়ক অবশ্যই জনগণ কিন্তু তাদের মহান এবং অনন্য প্রতিভূ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। অস্থায়ী সরকারের ক্যাবিনেট-কক্ষ, মুক্তিসেনাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং আশ্রয় শিবির থেকে রণক্ষিত্র পর্যন্ত যেখানেই বাংলাদেশের মানুষ ছিল তিনি ওই ন’মাস অদৃশ্য দেবতার মতো সবার মনে জেগে ছিলেন। তাঁকে স্মরণ করে তাঁর বাণী মুখে নিয়ে অনেকে দেশের জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। পাকিসত্মানের কারাগারে বন্দী নেতা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় যে কত বড় প্রেরণা ছিলেন তার অসংখ্য সাক্ষীর মধ্যে একজন আমি। ছয়. রামের বনবাসের দিনগুলিতে ভরত যেমন রামের পাদুকা সিংহাসনে রেখে রাজ্য শাসন করেছিলেন, তেমনি অস্থায়ী সরকারের নেতারা শেখ মুজিবকে প্রতিনিয়ত উপস্থিত কল্পনা করেই পরম আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরই নামে ন’মাস যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। (ঐ, পৃ ১৫-১৬)

এ-প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে তাঁর মনে যে-প্রশ্নটি জেগেছিল, তা তিনি এখানেই উত্থাপন করেছেন :

পরবর্তীকালে কখনো কখনো আমার মনে এ প্রশ্ন জেগেছে, অনুপস্থিত নেতা নিজেও কি সঠিক উপলব্ধি করেছিলেন দৈহিকভাবে উপস্থিত না থেকেও তিনি ন’মাসের যুদ্ধে কত বড় অবদান রেখেছিলেন? প্রসঙ্গত যদি তিনি তা উপলব্ধি করতেন আওয়ামী লীগের মুজিবনগর অধ্যায়ের প্রতি তিনি একটু যথার্থ কৌতূহল এবং ঔদার্য দেখাতে সক্ষম হতেন। এর ফলে ইতিহাস হয়তো একটু অন্যরকম হতে পারতো, কিছু অমঙ্গলের হয়তো জন্ম হতো না, হলেও ভ্রূণেই তা নিহত হতো। (ঐ, পৃ ১৬)

এরপর তিনি প্রশ্ন করেছেন, স্বাধীনতার ভোরে মুক্তি বলতে আমরা কী বুঝেছিলাম এবং তার উত্তরও দিয়েছেন :

আমরা চেয়েছিলাম চিরতরে ধর্মীয় রাজনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, স্বৈর এবং সামরিক শাসন, পশ্চাৎমুখী রাষ্ট্রচর্চার অবসান। চেয়েছিলাম সহজাতিত্ব, সহনাগরিকত্ব, ক্ষমতায় সম্পদে কৃচ্ছ্রতায় সমান অংশ, উন্নতি এবং বিকাশে সমান ভাগ, একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের স্ফুরিত সম্ভাবনা থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ। নিমিষে দুধের নহর নয়, কোনো স্বপ্নরাজ্য নয় – পরিকল্পিত গতিতে অগ্রসরমাণ আধুনিক জীবনচেতনাঋদ্ধ একটি মানবিক সমাজ। (ঐ, পৃ ১৭)

কিন্তু এ-আশা কেন পূরণ হলো না? মুরশিদের মতে :

মোটা দাগে বলতে গেলে, ঐতিহাসিকভাবে সফল মহৎ আন্দোলনকারীরা অনেকাংশে ব্যর্থ শাসক বলে পরিচিত হলেন। প্রতিশ্রম্নত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পথে তাঁরা বেশিদূর এগুতে পারলেন না। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির সমীকরণের সমস্যা, অতিবিপস্নবী তৎপরতা এবং পরাজিত শত্রম্নর পরিকল্পিত অপপ্রচার বাঙালি মধ্যবিত্তের সুলভ নেতিবাদ ও অসহিষ্ণুতা, হঠাৎ তেলের হন্তারক মূল্য বৃদ্ধি, দেশের উত্তরাঞ্চলে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যা ছিল মূলত বাংলাদেশের প্রকৃতি, মার্কিনী খাদ্য রাজনীতি, সংশিস্নষ্ট এলাকায় ক্রয়ক্ষমতার অভাব ইত্যাদির ফল। এসব মোকাবিলায় ব্যর্থ হলেন তাঁরা। দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের উপর কড়া দৃষ্টি না রেখে সমাজতন্ত্রের শৃঙ্খলা, দক্ষ মানবিক উপাদান এবং কাঠামো নির্মাণ না করে সমাজতন্ত্রের নামে কিছু ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ, এসব ব্যর্থতাও আমাদের নতুন সরকারকে দুর্বল করেছিল। এর ফলে এঁদের অনেক সুকৃতিও উপেক্ষিত হলো। নিরপেক্ষ সমাজ-বিজ্ঞানীদের বিশেস্নষণ অনুযায়ী যে মুহূর্তে এ দেশ সঙ্কট কাটিয়ে, যেমন কৃষি ক্ষেত্রে, সম্পন্নতার দিকে কিঞ্চিৎ অগ্রযাত্রা শুরু করেছিল, সে মুহূর্তে ওঁৎ পেতে থাকা অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের আঘাত হানল। জাতির প্রতিষ্ঠাতাকে অকালে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। আর ফিরে এল যা যা আমরা চাইনি সব কিছু – একমাত্র আশা ছাড়া। (ঐ, পৃ ১৭)

এর জন্যে তিনি অনেকের সঙ্গে দায়ী করেছেন নিজেদের, দেশপ্রেমিকদের একটি অংশকে। তাঁর এসব কথার মধ্যে সংবেদনশীল ও প্রজ্ঞাবান এক দেশপ্রেমিকের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাই।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কথাও তিনি ভেবেছেন, তবে তা অনেকগুলো শর্তসাপেক্ষ। আজ আর সেকথা নয়।

* ৬ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত মিসেস নূরজাহান মুরশিদ ও প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ ট্রাস্ট ফান্ড বক্তৃতা।