খুঁজে যেন পাই

মো. মুনিরুজ্জামান
১৯৯৯ সালের এপ্রিলের কোনো এক প্রখর দুপুরের কথা, ভাঙাপথ অতিক্রম করে রিকশা এসে থামলো ধানমন্ডির ৫নং রোডে অবস্থিত গ্যালারি শিল্পাঙ্গনের সামনে। রিকশা থেকে নেমে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মৃদুপায় প্রবেশ করলেন গ্যালারি-অভ্যন্তরে। ইতোমধ্যেই গ্যালারি-বারান্দা থেকে দেখামাত্র আমিও এগিয়ে গেলাম। সালাম শেষে অতিথিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন? ভরদুপুরে আসতে কষ্ট হয়নি তো? ডান হাতে ছাতা উঁচু করে বললেন, এটাই ভরসা, তাছাড়া তোমাদের এখানে আসতে মন চায়, রোদ কোনো বিষয় নয়।
খ্যাতনামা সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, আমাদের ফয়েজ ভাই, তাঁরই উদ্যোগে নির্মিত গ্যালারি শিল্পাঙ্গন আমিই পরিচালনা করতাম। অফিসকক্ষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, এক কাপ চা গ্রহণ, তারপরেই অতিথি আমাকে বললেন, চলো দেখে আসি।
মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল, গতকাল আমিই ফোনে বলেছিলাম বাড়ির প্রধান ফটকের ডানদিকের দেয়ালটা অনেকখানি ভেঙে পড়ে আছে। কে বা কারা ভাঙলো আপনার এসে একটু দেখা দরকার। ছাতা মাথায় দুজনে হাঁটতে শুরু করলাম। সামান্য পথ, তাই রিকশায় ওঠা পছন্দ করলেন না। চলার পথে অনুরোধ করেছিলাম, ছাতাটা আমার হাতে দিন, আপনার কষ্ট হবে। ঠোঁটের পাশে ছোট্ট হাসির রেখা টেনে বলেছিলেন, যে-দেয়ালটা পড়ে গেছে, ষাটের দশকের শেষে ওই বাড়ি ও দেয়ালের প্রতিটি ইটে আমার স্পর্শ আছে। সেদিনগুলোও এমনি রোদেলা দুপুর ছিল। এ-পথচলা কোনো কষ্টের নয়। আগেই বলেছিলাম অল্প পথ, তাই এ-মুহূর্তে ধানমন্ডির ৪নং রোডের ২১নং বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ালাম দুজনে।
পাঠক বন্ধুরা আপনারা এতক্ষণ হয়তো নিশ্চয় বুঝে গেছেন কে এই অতিথি, তিনি আর কেউই নন, সবুজে ঘেরা এই ছোট্ট বাড়িটির প্রাণপুরুষ, এই উপমহাদেশের ক্ষণজন্মা চিত্রকর, ঢাকা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং ছাপাই চিত্রশিল্পের জনক শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন, মনে হলো খুবই কষ্ট পেয়েছেন। আর পাবেনই না বা কেন। যে দরদ ও ভালোবাসা দিয়ে গড়া এই ছোট্ট কুটির, তাকে যাঁরা চেনেন এবং কাছের মানুষ, সকলেই উপলব্ধি করতে পারবেন তিনি কতটা আঘাত পেতে পারেন।
স্যারের মনের অবস্থা দেখে আমি বললাম, স্যার, আমি জেনেছি দানব ট্রাকের ধাক্কায় এ-অবস্থা হয়েছে। কিছুই করার নেই, যত দ্রুত সম্ভব ঠিক করে ফেলতে হবে। তাৎক্ষণিক স্যারের অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করলাম। দুদিনের মধ্যেই পূর্বের অবস্থায় ফিরে এলো দেয়াল। দু-চারদিন পর স্যার এলেন, দেখলেন এবং বোধকরি সেদিন থেকেই স্যার আমাকে খানিকটা আস্থায় নিলেন বলে আমার বিশ্বাস।
এত বড় মাপের মানুষ, ৯০ বছরের জীবন ও জীবনী, তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে হবে, এটা ভাবতে আমার ভয় হয়। কিন্তু নাছোড়বান্দা আবুল হাসনাত, আমাদের প্রিয় হাসনাত ভাই। শুনেছি তিনি যাঁর পেছনে লাগেন তাঁকে নাকি লেখক বানিয়ে ছাড়েন। ভাবছি, হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার ছাত্রজীবনে পরিচয় হলো না কেন! হলে হয়তো আমি পরীক্ষাগুলোতে এত খারাপ করতাম না।
স্যারকে দূর থেকে দেখা ১৯৭৭ সাল থেকে, তখন আমি চারুকলার প্রথম বর্ষের ছাত্র। খানিকটা দূর থেকে দেখতাম সুদর্শন এবং অপার ব্যক্তিত্বের অধিকারী, আমি কেন কারো সাহস হতো না তাঁর সঙ্গে যেচে কথা বলতে। ’৮৩ সালের শেষ দিকে ঠিক হলো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা মিলে শিক্ষা ভ্রমণে যাব এবং তা ভারতে, অনেক অর্থের প্রয়োজন, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ছবি সংগ্রহ করে প্রদর্শনী হবে শিল্পকলার বৃত্তাকার গ্যালারিতে। সফিউদ্দীন স্যারের কাছে ছবি চাওয়ার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর।
একে তো ছবি বিক্রি করেন না এবং শিক্ষক ও সিনিয়র ভাইদের কাছে শুনেছি কাউকে ছবি দিলে অনেক দিন, বছর, এমনকি যুগ অবধি পরখ করতেন। যিনি ছবিটি সংগ্রহ করবেন তাঁর আগ্রহের ধৈর্য কতটুকু বা তিনি সত্যিকারের ছবি ভালোবাসেন কিনা, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল তিনি পেতে পারেন শিল্পী সফিউদ্দীনের একটি চিত্রকর্ম হয়তো বিনামূল্যে অথবা অল্পমূল্যে।
এত কিছু জানার পরও আমরা তাঁর দ্বারস্থ হলাম, কেননা যদি তাঁর একটি চিত্রকর্ম জুটে যায় তাহলে আমাদের আর পিছু ফিরে তাকাতে হবে না। মনে আছে, কোনো এক সকালে আমি ও দু-একজন সহপাঠী বন্ধু দরজায় কড়া নাড়াতে স্যার নিজেই দরজা খুললেন, পরিচয় দিলাম এবং আমাদের উদ্দেশ্য বা ইচ্ছার আর্জি তুলে ধরলাম। তিনি আমাদের বসার আদেশ করে নিজেও বসলেন। নানা কথার ফাঁকে আমাদের কাজ ও চারুকলার ছাত্র হিসেবে করণীয়সহ নানা কথা বলে চা খাইয়ে গেট পর্যন্ত এসে বিদায় জানালেন এবং আবার দেখা হবে এ-কথাও বললেন। আমরা গেটের বাইরে এসে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললাম, বন্ধু ব্যাপারটা কেমন হলো? স্যার এত অমায়িক স্নেহে আমাদের ধন্য করলেন; কিন্তু ছবি দেবেন কিনা কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।
যাই হোক, আমরা স্যারের স্বামীবাগের বাসা থেকে বিদায় নিলাম এবং কলেজে এসে আমাদের শিক্ষাভ্রমণ কমিটিকে জানালাম সব কথা। ইতোমধ্যে আমরা প্রদর্শনীর অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সম্ভবত দিন চারেক পরে হঠাৎ প্রিন্টমেকিং বিভাগ থেকে প্রেসম্যান শওকত ভাইয়ের (তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই) মাধ্যমে ডাক এলো আমরা যারা তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম তাদের কাউকে ডাকছেন। উৎসাহ এবং ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে গেলাম।
আমাদের দেখে জানতে চাইলেন, ভারতের কোথায় কোথায় যাচ্ছি। উত্তরে জানালাম – স্যার, ইচ্ছা আছে অজন্তা, ইলোরা, জয়পুর, কোনারখ, আগরা, আত্তরগাবাদ, মথুরা, জগন্নাথ মন্দির, খাজুরাহসহ ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখব। বললেন, কোনারকের সূর্যমন্দিরে যেহেতু যাবে উদয়গিরি, খন্ডগিরি দেখতে ভুলো না। এই বলে অতিযত্নে কাগজে মোড়ানো একখানা ফোলিও সাইজের ফাইল আমাদের হাতে তুলে দিলেন। তাঁর সামনে সাহস হলো না খুলে দেখার। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিয়ে এসে ক্লাসে ঢুকলাম এবং খুলে সবাই অবাক বনে গেলাম তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘Sound of water’-এর একটি প্রিন্ট এ-মুহূর্তে আমাদের হাতে। সবাই মিলে আনন্দ ও হইচই করলাম। সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রদর্শনীর মর্যাদাই বাড়িয়ে দিলো, ওই চিত্রকর্ম এবং প্রদর্শনীতে সর্বাধিক মূল্যে বিক্রি হয়েছিল সেই ‘Sound of water’। স্যারকে আমরা নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমাদের একটি শিক্ষা হলো। কৌশল করে মানুষের মন ছোঁয়া যায় না এবং তা হলেও ক্ষণস্থায়ী হয়, কিন্তু সততা ও শ্রদ্ধা-ভক্তির মাধ্যমে যে-মন ছোঁয়া যায়, তা চিরস্থায়ী হয়।
১৯৯৫ সালের দিকে একবার সিদ্ধান্ত হলো, বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে একটি চিত্রপ্রদর্শনী হবে ওমানের মাসকট শহরে। তখন ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আমাদের সবার প্রিয় মানুষ মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী। যাওয়ার জন্যে আমারও সুযোগ হয়েছিল; শিল্পী রফিকুন নবী, মুস্তাফা মনোয়ার এবং খ্যাতনামা আলোকচিত্রী ও গবেষক ড. নওয়াজেশ আহমেদের সঙ্গে। মজার ব্যাপার হলো, এবারও সফি স্যারের ছবিটি চাওয়ার দায়িত্ব পড়ল আমার ঘাড়ে।
যেহেতু ইতিমধ্যে কিছুটা স্যারের আস্থায় ছিলাম, তাই খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কন্ডিশন ছিল বিক্রি করা যাবে না এবং ফেরত দিতে হবে। কেননা, ওই প্রিন্টটি তাঁর আর আবশিষ্ট ছিল না। মাসকটের সোসাইটি ফর ফাইন আর্টসে প্রদর্শনী শেষে সবার ছবি রাষ্ট্রদূতের জিম্মায় রেখে আসি। তিনি সুবিধাজনক সময়ে পাঠাবেন। কিন্তু কথামতো ‘জলের নিনাদ’ হাতে বহন করে এনে স্যারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
শিল্পী ও শিল্পানুরাগী সবাই জানেন, গ্যালারি চিত্রকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ধানমন্ডির স্যারের বাড়িতে; যে-বাড়ির বর্ণনা আপনারা আগেই পেয়েছেন। এই চিত্রক গ্যালারি প্রতিষ্ঠায় যাঁদের অবদান না বললেই নয়, তাঁরা হলেন – স্যারের পরিবারের সব সদস্য, বিশেষ করে ভাবি (মিসেস সফিউদ্দীন), শিল্পী আহমেদ নাজির। কেননা, স্যারের কাছে প্রস্তাব রাখার সাহস তখনো অর্জন করতে পারিনি। ভাবি ও খোকনের ইচ্ছা ছিল বলেই এই কঠিন কাজটি করা আমার ও জহিরের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। বলা বাহুল্য, শিল্পী জহিরও স্যারের খুব স্নেহভাজন ছিলেন এবং গ্যালারি চিত্রক প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। স্যার এ-ধরনের ইচ্ছা মনে পোষণ করতেন বলে তাঁর বাড়িতে চিত্রক গ্যালারির যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখে। আমরাও অতিসতর্ক ছিলাম, যেন স্যারের কথার বরখেলাপ না করি। ১১ বছর স্যারের বাসাটি চিত্রক গ্যালারি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। স্যার ও স্যারের পরিবার আমাদের দুজনকে সবসময় তাঁর পরিবারের সদস্য মনে করতেন। আমরা যেন এক পরিবারের মতো সবার দুঃখ ও আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম।
২০০৬ সালে স্যার স্বামীবাগের বাসা ছেড়ে ধানমন্ডিতে স্থায়ী হলেন। হাঁটুতে সামান্য আঘাত এবং বার্ধক্যজনিত কারণে স্যার দিন দিন দুর্বল হতে লাগলেন। একসময় শয্যাশায়ী হলেন চলাফেরার শক্তি হারালেন; কিন্তু মনের শক্তি এতই প্রবল যে, প্রতিনিয়ত কল্পনায় ছবি অাঁকতেন, ছবি নিয়ে কথা বলতেন এবং স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসতেন আপনজনের সঙ্গে। পরিবারের যে-কোনো কাজেই জহিরের ডাক পড়ত। জহির তা আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করতো। আমার যাতায়াতটা কম থাকলেও সবসময় লক্ষ থাকত স্যারের প্রতি।
যখনই কাছে গিয়ে বসতাম, স্যার কেমন আছেন উত্তরে হাতটা হাতে রাখতেন, বলতেন, ভালো নেই, ছবি অাঁকতে পারি না। এই না-পারাটাই যেন তাঁর অসুখ ও বেদনার কারণ, তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হতো না।
যে-মানুষটি নিরলস সাধনা করে গেছেন ছবি নির্মাণে। ভক্তি, যুক্তি, ধর্ম, ধ্যান – সবই ছিল যাঁর শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা। লোভ, মোহ যাঁকে কোনোদিন দোদুল্যমান করেনি। মৃদুভাষী কিন্তু শিল্পকলা ও আত্মজীবনী প্রসঙ্গ এলে ক্যামেরার অন্তরালে তিনি ছিলেন বিরামহীন কথাশিল্পী। তিনি বলতেন, দেশ ও মানুষের জন্য ছবি অাঁকতে পারলে তা কালের পথ বেয়ে মানুষের মাঝে স্থান করে নেয় আপন গতিতে। তার জন্য প্রচার-প্রচারণার দরকার হয় না।
সুখ অনুভব করি, যখনই ভাবি, মানবতাবাদী, মিতব্যয়ী এই মহৎ মানুষটি আমাদের কত না কাছের মানুষ ছিলেন। কথার ছলে আমাদের কত আপন করে নিয়েছিলেন। আর মন ভারি হয়ে যায় যখনি ভাবি জয়নুল, কামরুল, সুলতান, কিবরিয়ার মতো তিনিও আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আমরা আজ সত্যিই যেন অভিভাবকহীন।
কে জানত হায়, এই মহান শিল্পীর পরিবারের একজন হয়েই, হাসপাতাল থেকে আঞ্জুমানে অন্তিম স্নান শেষে স্কয়ার হাসপাতালের মরচুয়ারিতে একদিন একরাত বিশ্রামে রেখে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সহস্র মানুষের ভালোবাসা নিবেদন শেষে, কিছুক্ষণ নিজের গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষণিক বিশ্রাম। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে সতীর্থ শিল্পাচার্য জয়নুল, পটুয়া কামরুল ও কালের মহাবিপ্লবী কবি নজরুলের সঙ্গে একই ড্রইংরুমের আলাদা আলাদা সজ্জায় শায়িত রেখে এলাম। যখন কবরে নেমেছিলাম, মনে হলো যেন ধূসর ক্যানভাসে একটি সাদারেখা অঙ্কন করে মাটির যবনিকা টেনে দিলাম চিরদিনের তরে। হে মহান চিত্রকর, শান্তিতে ঘুমাও। আমরা জাগ্রত আছি তোমারই চারিধারে।