গঙ্গার উৎস, আমার সভ্যতার উৎসমুখ

কৃষ্ণেন্দু পালিত

নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে। নদীকে কেন্দ্র করে সে বসতি গড়েছে, গড়ে উঠেছে সভ্যতা। নদীও নানাভাবে প্রভাবিত করেছে মানুষের সমাজজীবন, সমৃদ্ধ করেছে, জন্ম দিয়েছে সভ্যতার। যুগে-যুগে বদলে দিয়েছে সভ্যতার ইতিহাস। নদীকে নিয়ে তাই মানুষের রোমান্টিসিজমের শেষ নেই। সৃষ্টি হয়েছে গান-গল্প-কবিতা, গড়ে উঠেছে হাজার আখ্যান। সেসব আখ্যান কখনো ধর্মের আধারে, কখনো ইতিহাস-আশ্রয়ী, কখনো সামাজিক প্রেক্ষাপটে। ‘নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?’ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের মতো এ-প্রশ্ন তাই অনেকেরই। বিশেষ করে সে-নদীর নাম যদি হয় গঙ্গা। গঙ্গার অবদান বলে শেষ করার নয়। ভারতবাসীর জীবনে সে মাতৃস্বরূপা। মানুষ তাকে দেবীর আসনে বসিয়েছে। দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা। আমি আমার সেই সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক গঙ্গার উৎস দর্শনে বেরিয়েছি। গঙ্গোত্রী, গোমুখ হয়ে তপোবন অবধি যেতে চাই। দেখতে চাই আকাশগঙ্গা। মহাদেবের জটা থেকে যার উৎপত্তি।

হাওড়া থেকে উপাসনা এক্সপ্রেসে চেপে পরদিন হরিদ্বার পৌঁছলাম বিকাল পাঁচটায়, নির্ধারিত সময়ে। হরিদ্বার থেকে গঙ্গোত্রী যাওয়ার বাস মাত্র দুটি, ছাড়ে খুব ভোরে। সিট বুক করতে হয় আগে থেকে। তড়িঘড়ি হোটেলে লটবহর ফেলে ছুটলাম জিএমও (G.M.O) বাসস্ট্যান্ডে। কপাল খারাপ, টিকিট মিলল না। অগত্যা উত্তরকাশীর টিকিট কেটে ফিরে এলাম। হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশীর দূরত্ব ১৭৩ কিলোমিটার, গঙ্গোত্রী ২৭৪ কিলোমিটার। এখানে বসে একটা দিন নষ্ট না করে যতটা পারা যায় এগিয়ে থাকা। সেইসঙ্গে উত্তরকাশীটাও দেখা হয়ে যাবে।

পরদিন উত্তরকাশী (১১৫৮ মিটার) পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে গেল। তিনদিকে অর্ধচন্দ্রাকার ভাগীরথী আর উত্তরে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি মাঝে উত্তরকাশী, বর্তমানে জমজমাট জেলাসদর। ভাগীরথী এখানে উত্তরবাহিনী। কথিত আছে শিবরূপী কিরাত আর অর্জুনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ এখানে হয়েছিল। অর্জুন এখানেই পশুপাত অস্ত্র লাভ করেন। এমনকি পঞ্চপা-বকে পুড়িয়ে মারার জন্য দুর্যোধন এখানেই জতুগৃহ নির্মাণ করেছিলেন। একসময় কাশী থেকে বিতাড়িত দেবতারা এসে কলোনি গড়ে তোলেন এই উত্তর হিমালয়ে, নাম তাই উত্তরকাশী। উত্তরকাশীর দুপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বরুণা আর অসি নদী। স্কন্দপুরাণে এবং হিউয়েন সাঙের বিবরণীতেও উত্তরকাশীর উলেস্নখ পাওয়া যায়।

বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া একটা হোটেলে উঠেছি। স্নান-খাওয়া সেরেই বেরিয়ে পড়লাম একটুও সময় নষ্ট না করে। হেঁটেই দেখে নেব যতটা সম্ভব। যাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য নেহরু মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট (N.M.I), বিশ্বনাথ মন্দির এবং সাধুসন্তদের আখড়া উজালি। এছাড়া যাঁরা ট্র্যাকিং করতে ভালোবাসেন, ডোডিতাল থেকে ঘুরে আসতে পারেন। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় না থাকায় এ-যাত্রায় ডোডিতাল অদেখা থেকে যাবে।

হোটেল থেকে উজালির দূরত্ব সামান্য। হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে যাই সেখানে। ভাগীরথীর তীর ঘেঁষে ছোট-ছোট মন্দির আর সাধুদের আখড়া। কিছুক্ষণ উজালিতে কাটিয়ে রওনা দিই N.M.I-এর উদ্দেশে।

কিছুদূর এগোতে নদীর ওপর ঝুলন্ত লোহার সেতু, সেতু পেরিয়ে আরো পাঁচ কিলোমিটার N.M.I। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে পথের খোঁজ নিতে-নিতে এগিয়ে চলি। পথে পরিচয় হয় স্থানীয় দুই যুবকের সঙ্গে, দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। এতদিন বাদে তাদের নাম আর মনে নেই। অনুরোধ করতে তারাও আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হল। অসংখ্য বাঁক পেরিয়ে, চড়াই ভেঙে ঘণ্টাদুয়েকের ব্যবধানে পৌঁছলাম গন্তব্যে। ইনস্টিটিউটের ভেতরে কংক্রিটের কৃত্রিম পয়েন্ট, সেখানে পাহাড়ে চড়ার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পর্বতারোহণ শিক্ষার পাশাপাশি পাহাড়-সংক্রান্ত বই, বইয়ের লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম আছে এখানে। এছাড়া স্বাধীনতা-সংগ্রামী নানা ফড়নবিশের স্মৃতি ধরে রাখা আছে তার নামাঙ্কিত মিউজিয়ামে।

N.M.I থেকে ফিরতে রাত আটটা বাজল। যদিও এখানে সূর্য অস্ত যায় দেরিতে। সারাদিনের ধকলে আমরাও ক্লান্ত। এখন একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। বিশ্বনাথ মন্দিরে যাব কাল সকালে। উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রীর দূরত্ব মাত্র ১০১ কিলোমিটার, সময় লাগবে ঘণ্টাতিনেক। ধীরে-সুস্থে কাল দুপুরের পরে বেরোলেই চলবে।

পরদিন সকালে, একটু বেলা করেই বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনে গেলাম। জায়গাটির নাম ভৈরব চক। বাসস্ট্যান্ড থেকে দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার। এখানে বিশ্বনাথের মন্দির ছাড়াও আছে দেবী কালিকা, দুর্গা, ভৈরব, ব্রহ্মা, দত্তাত্রেয়, একাদশ রুদ্র, পরশুরামসহ মোট ৩৬৫টি মন্দির। উত্তরকাশীর দর্শনীয় স্থান বলতে মোটামুটি এটুকু। মন্দির দেখা শেষ হলে হোটেলে ফিরে এলাম। তল্পিতল্পা গুটিয়ে দুপুর একটা নাগাদ গঙ্গোত্রীগামী শেয়ার জিপে চাপলাম। শরীর এলিয়ে দিলাম সিটে। ক্লামিত্মতে চোখের পাতা বুজে এল। ঘণ্টাখানেকও গেল না, মানুষের হই-হট্টগোলে তাকিয়ে দেখি ভয়ংকর জ্যামে আটকে আছে আমাদের গাড়ি। যতদূর চোখ যায় সার-সার গাড়ির জটলা। মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে অসংখ্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, মালভর্তি বড় একটা টেলার বাঁক নিতে গিয়ে রাস্তার ওপর আড়াআড়ি উলটে পড়েছে। একজন মানুষ গলার মতো অবশিষ্ট জায়গা নেই। উত্তরকাশীতে খবর গেছে, ক্রেন এসে মাল আনলোড করে যতক্ষণ না টেলারটাকে সরাতে পারছে, ততক্ষণ কিছু করার নেই। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ঘুরে দেখে এসে জানাল, ভয়ংকর অবস্থা। রাত কাবার হয়ে যাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে। টেলারের দুপাশেই ছোট-বড় মিলিয়ে কয়েকশো গাড়ির লাইন। যাত্রীদের কেউ-কেউ ফিরে যাচ্ছেন পুরনো গন্তব্যে, কেউ আবার কাছাকাছি আজ রাতটার মতো আস্তানা খুঁজে নিচ্ছেন। জায়গাটার নাম মলস্না। ছোট্ট জনপদ। অল্পকিছু দোকানপাট আর হাতেগোনা গোটাকয় বাড়িঘর। উত্তরকাশী থেকে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। ড্রাইভার ভদ্রলোক সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। সঙ্গে মহিলা বা শিশু নেই, সকলেই যুবক, হেঁটে পেরিয়ে যান জ্যামটুকু। ওদিকেও অনেক গাড়ি ফিরে যাচ্ছে, একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। পরামর্শ যুক্তিসম্মত মনে হলো আমাদের, টেলারের এপার-ওপার মিলিয়ে প্রায় দুকিলোমিটার জ্যাম পেরিয়ে এসে সত্যিই গঙ্গোত্রী যাওয়ার শেয়ার জিপ পেয়ে গেলাম। উত্তরকাশীর প্যাসেঞ্জার নিয়ে এসেছিল, বেগতিক দেখে এখানে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে। তবে ভাড়া চাইল তিনগুণ। সুযোগ বুঝে দাঁও মারতে চাইছে আরকি। শেষমেশ দরদাম করে ওটাকে দ্বিগুণে নামানো গেল।

গঙ্গোত্রী পৌঁছলাম সন্ধ্যা সাতটায়। তিন ঘণ্টার পথ ছঘণ্টায়। গঙ্গোত্রীতে আজ ট্যুরিস্টের চাপ নেই। যাত্রীরা এসে পৌঁছাতে পারেনি রাস্তার বাধায়। হোটেলগুলো ফাঁকা। সস্তায় ঘর মিলল। উঠলাম নবনির্মিত একটা হোটেলে, যার কনস্ট্রাকশন তখনো কিছুটা বাকি তবে অবস্থানগুণে অসাধারণ। গঙ্গার ওপর ঝুলন্ত ঘর, চারপাশে কাচের দেয়াল, সুদর্শনশৃঙ্গ ঘরে বসেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাতে আলো নেভালে চাঁদ এসে উঁকি মারে বিছানায়। মনে পড়ে, দুদিন বাদে পূর্ণিমা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমরা সেদিন গোমুখ হয়ে তপোবন পৌঁছাব। জ্যোৎস্নালোকে কেমন দেখাবে ভাগীরথী শৃঙ্গ, কেমন লাগবে শিবলিঙ্গ, ভৃগুপন্থ বা অন্যান্য নামি-অনামি তুষারশৃঙ্গ? কল্পনায় সেসব দৃশ্য দেখতে-দেখতে আর মোম জ্যোৎস্নায় অবগাহন করতে-করতে, একটানা গঙ্গার কলধ্বনি শুনতে-শুনতে কখন যেন চোখের পাতা বুজে আসে।

 

দুই

পরদিন ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হলো। এর জন্য দায়ী আমাদের গড়িমসি। কেননা আজ বিশ্রাম। ট্র্যাকিং শুরুর আগে উচ্চতাজনিত আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যেই এই সিদ্ধান্ত। আজ সারাদিন গঙ্গোত্রীতেই কাটাব। ঘুরে দেখব চারপাশ। বর্তমানে গঙ্গার উৎসস্থল গোমুখ হিমবাহ। গেস্নাবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে দিন-দিন বরফের গলনাঙ্ক বাড়ছে, পেছনে সরে যাচ্ছে হিমবাহ। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখের দূরত্ব এখন ১৯ কিলোমিটার। কোনো এক সময় গঙ্গার উৎস ছিল এই গঙ্গোত্রীতেই। গঙ্গোত্রীকে ঘিরে তাই সহস্র পুরাণকথার জন্ম হয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা এখানে পুণ্যার্জনের আশায় ছুটে আসেন। প্রকৃতিপ্রেমীরা আসেন সৌন্দর্যের আকর্ষণে, জিওলজিস্টরা আসেন তাদের গবেষণার প্রয়োজনে আর আমার মতো আধা রোমান্টিক, আধা বাস্তববাদী আর আধা নাসিত্মকরা আসেন আপন সভ্যতার ধারক ও বাহকের জন্মস্থান প্রত্যক্ষ করে অতীতকে উপলব্ধি এবং কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যে।

পাইন আর দেওদারের ছায়ায় ঢাকা স্বর্গ ও মর্ত্যের সন্ধিস্থল, ভাগীরথী গঙ্গার উৎসলোক এই গঙ্গোত্রীর (৩০৪৮ মিটার) অন্যতম প্রধান আকর্ষণ শ্বেতশুভ্র গ্রানাইট পাথরে তৈরি ২০ ফুট উঁচু সোনালি শিখর-শোভিত গঙ্গা মায়ের মন্দির। অষ্টাদশ শতকে নেপালের প্রধান সেনাধ্যক্ষ অমর সিং থাপা এটি তৈরি করান। মন্দিরে দেবী গঙ্গা ছাড়াও আছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, যমুনা, অন্নপূর্ণা, ভগীরথ ও শঙ্করাচার্যের মূর্তি। পরবর্তীকালে জয়পুরের মহারাজ এই মন্দির সংস্কার করান।

মন্দিরের পাশে ভৈরব বা ভাগীরথ শিলা – রাজর্ষি ভগীরথ এখানে বসে তপস্যা করেছিলেন। স্মারকরূপে তৈরি হয়েছে ভগীরথের মন্দির। মন্দিরের উত্তরে গৌরীকু- এবং দক্ষিণে সূর্যকু-। কথিত আছে, সগর রাজার ষাট হাজার সন্তানের নশ্বর দেহে প্রাণ সঞ্চারের জন্যে মহর্ষি ভগীরথ গঙ্গাকে পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপে কপিলমুনির আশ্রম পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার শেষে উদ্দেশ্য সাধন হলে নিজেকে সাগরে বিলীন করেন গঙ্গা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আত্মীয়-নিধনের পাপস্খলনে দেবযজ্ঞ করতে পা-বরাও এসেছিলেন গঙ্গোত্রীতে। নিদর্শন হিসেবে চিরবনের ভেতরে আজো আছে পা-বগুহা। কেদারগঙ্গা ভাগীরথীর সঙ্গে মিলে প্রকৃতিদত্ত শিলারূপী শিবলিঙ্গের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এখানে। জলোচ্ছ্বাস থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য শিব এখানে বসেই জটাজালে রুদ্ধ করে গতিরোধ করেন গঙ্গার। জলমগ্ন পাথররূপী শিবলিঙ্গ আজো দেখা যায়। দেখা যায় উত্তরের বরফাবৃত সুদর্শন শিখর। অনেকটা গঙ্গোত্রীর মাথায় মুকুটের মতো শোভা পাচ্ছে সুদর্শন। দিন-রাত চবিবশ ঘণ্টা মুখরিত হচ্ছে জলের কলতানে। যুগ-যুগ ধরে বয়ে চলেছে গঙ্গা-ভাগীরথী। এই গঙ্গাকে নিয়েই গঙ্গোত্রী। ধর্মীয় কাহিনি বাদ দিলেও শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেই গঙ্গোত্রী আসা যায়।

 

তিন

প্রয়োজনীয় মালপত্র রুকস্যাকে ভরে পরদিন সকাল ঠিক আটটায় বুজবাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। অতিরিক্ত মালপত্র থাকল হোটেলের ক্লকরুমে। সঙ্গে গাইড কাম পোর্টার সৎপাল ২২ বছরের শক্ত-সমর্থ যুবক। গত রাতেই তার সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম। দিনপ্রতি পারিশ্রমিক নেবে ৫০০ টাকা। সরকার নির্ধারিত রেট। সব মিলে তিন-চারদিনের ট্র্যাক। আজ যাব ১৪ কিলোমিটার। পুরোটাই চড়াই। শুরুতেই খাড়া সিঁড়ি। প্রায় হাফ কিলোমিটার একটানা হাঁটার পর থামি, পাখির চোখে দেখে নিই গঙ্গোত্রী শহর, গঙ্গামায়ের মন্দির। এক কিলোমিটারের মাথায় গঙ্গোত্রী ন্যাশনাল স্যাঙ্কচুয়ারির চেকপোস্ট। এখানে পারমিশন দেখাতে হয়। প্লাস্টিকের জলের বোতলের জন্যে জমা দিতে হয় বোতলপ্রতি ৫০ টাকা। ফিরে এসে বোতল দেখালে টাকাটা ফেরত পাওয়া যায়। গোমুখ প্লস্টিক ফ্রি জোন। দূষণের হাত থেকে হিমবাহকে বাঁচানোর জন্যেই এত কড়াকড়ি।

চেকপোস্ট থেকে ছাড়পত্র মিললে আমাদের আবার পথ চলা শুরু হয়। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে রাস্তা, বাঁ-দিকে খাড়া পাহাড়, ডাইনে খাদ – বহু নিচে গঙ্গা বইছে। সামনে সুদর্শন পর্বত। পাইন, দেওদার আর চিরগাছের ছায়ায় ঢাকা এ-পথের নৈসর্গিক শোভা অসাধারণ। মাঝে-মাঝে ভূজগাছ চোখে পড়ে। ডালে-ডালে পাখির কিচিরমিচির আর গঙ্গার কলতান শুনতে-শুনতে পথ হাঁটি মন্থর গতিতে। একটানা বেশিদূর হাঁটা যায় না। হাঁফ ধরে আসে। তবু থামার উপায় নেই, থামলেই ঘুমে চোখ বুজে আসছে। অদ্ভুত এক ঘুমঘোর আমাদের শরীর জুড়ে। কে জানে কেন এমন হচ্ছে! পথ-ক্লামিত্ম বা উচ্চতাজনিত কারণে হতে পারে। যত ওপরে উঠছি বাতাসে তত অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে। পথের পাশে একজন ভদ্রমহিলাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলাম। পাশে তার স্বামী বসে আছেন। পরিচয় হলো, কলকাতার লোক। ছোট-ছোট দুটো বাচ্চাকে নিয়ে সপরিবারে এসেছেন গোমুখ দর্শনে। বাচ্চাদুটি গাইডের সঙ্গে এগিয়ে গেছে চিরবাসার দিকে। গঙ্গোত্রী থেকে চিরবাসার দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। গঙ্গোত্রী-ভূজবাসার মধ্যে একমাত্র জনপদ। চিরগাছের ঘন সবুজে ঢাকা সে এক অসাধারণ মনোরম উপত্যকা। চিরবাসায় পৌঁছে আমরা দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর্বটি সেরে নেব। বাঙালি দাদা-বউদিকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার পথ চলতে শুরু করি।

চিরবাসায় (৩৫০০ মিটার) পৌঁছাতে দুপুর। কোথায় সে চিরবাসা? ছবিতে দেখা বা পত্রপত্রিকায় পড়া চিরবাসার সঙ্গে কোনো মিল নেই। না কোনো দোকানপাট, না হোটেল-লজ। এমনকি জনবসতিও নেই। ট্যুরিস্ট ছাড়া স্থানীয় কোনো মানুষও চোখে পড়ল না। বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-ওদিক কিছু ধ্বংসচিহ্ন পড়ে আছে। সৎপাল জানায়, গত বছর পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। দূষণ ঠেকাতে এ-বছর (২০০৮) থেকেই একগাদা নতুন নিয়ম করেছে সরকার। এসব তারই ফল। দোকান-হোটেলসহ পুরো জনপদটাই তুলে দিয়েছে। আমরা একটি পরিত্যক্ত ছাউনির নিচে বসে সঙ্গের শুকনো খাবার দিয়ে দুপুরের আহার পর্বটি সেরে নিলাম। আগে এখানে ১৪ খানা হোটেল ছিল, এখন মাত্র দুটোর পারমিশন। সে-দুটোও অনেক নিচে। এমনকি ঘোড়াও নিষিদ্ধ হয়েছে এ-পথে। এখন নিজের পা ভরসা। ডান্টির পারমিশন থাকলেও ভাড়া অত্যধিক। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। প্রথম দর্শনে কিছুটা হতাশ হলেও সরকারের এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে একজন প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে শেষ পর্যন্ত খুশিই হলাম। ভোটের রাজনীতির দিকে না তাকিয়ে আমাদের রাজ্য কখনো পারবে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে!

সবমিলে চিরবাসায় ঘণ্টাখানেকের ব্রেক। তারপর আবার পথ চলা। সামনে এখনো পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। এ-প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলে রাখি, আগামীতে যারা গোমুখ দর্শনে যাবেন, শুকনো খাবারের পাশাপাশি সঙ্গে পর্যাপ্ত জল নিতে ভুলবেন না। এ-পথে জলের খুব অভাব। অতিরিক্ত জল খেলে শরীর ভারী হবে। হাঁটতে অসুবিধা হবে। জলের বিকল্প হিসেবে তাই সঙ্গে কিছু কিশমিশ, হরীতকী, আমলকী বা লজেন্স-জাতীয় খাবার নিন।

চিরবাসা পার করতে চড়াইয়ের আধিক্য আরো বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে কমতে থাকল গাছপালার সংখ্যা। একসময় চারপাশ ধু-ধু। কোথাও সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। যতদূর চোখ যায় অদ্ভুত রুক্ষতা। শেষ দেড় কিলোমিটার গিলা পাহাড়। অনবরত গড়িয়ে নামছে ছোট-বড় বিভিন্ন মাপের নুড়িপাথর। যে-কোনো মুহূর্তে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। সৎপাল তাড়া লাগায় পা চালিয়ে হাঁটার জন্যে। এখানে বিশ্রাম নেওয়া চলবে না। যে-কোনো মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে। নেমে আসতে পারে যমদূতের মতো বড় কোনো পাথরখ-। সারাদিনের পথশ্রমে এমনিতেই ক্লান্ত, তারপর প্রাণান্তকর চড়াই, অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যা তো আছেই… একটুতে হাঁফ ধরে আসছে, তবু প্রাণভয় বড় ভয়! কীভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে জায়গাটা পার হয়েছিলাম জানি না, জানি না কোথা থেকে পেয়েছিলাম সেই অমানুষিক শক্তি –  ধ্বসা বা গিলা পাহাড় হতেই সামনে প্রকা- বাঁক, বাঁক ঘুরতেই হাসি ফুটল আমাদের মুখে। সামনেই লালবাবার আশ্রম। অর্থাৎ ভূজবাসায় (৩৭৮০ মিটার) পৌঁছে গেছি আমরা।

ভূজবাসায় পৌঁছে লালবাবা আশ্রমে উঠলাম। গরম চা মিলল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে। কিছুটা চাঙ্গা হলাম। কিছুক্ষণ পর রুটি আর ডাল। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল চারটে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বিশ্রাম নিতে কম্বলের তলায় ঢুকতে হল। জনপ্রতি তিনখানা করে কম্বল মিলেছে। একটি পাতার জন্যে, অন্য দুটি গায়ের। বড় একটা ঘরে প্রায় কুড়িজনের থাকার ব্যবস্থা। খাওয়া-থাকাসহ দিনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা। রাত আটটা নাগাদ কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে রাতের আহার সেরে আবার কম্বলের তলায়।

 

চার

পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরোতেই বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার পালা। গতকাল ভালো করে দেখা হয়নি। সকালের মেঘমুক্ত পরিবেশে ভূজবাসা সত্যিই তুলনাহীন। চারপাশে নামি-অনামি সব পর্বতশৃঙ্গ, মাঝখানে বাটির মতো উপত্যকা – উপত্যকায় লালবাবার আশ্রম ছাড়াও সরকারি বাংলো, আবহাওয়া দফতর ও কিছু স্থায়ী টেন্ট আছে ভাড়া খাটানোর জন্যে। তবে সবচেয়ে বড় এবং নির্ভরযোগ্য লালবাবার আশ্রম। গোমুখযাত্রীদের ৯৯ শতাংশ আশ্রয় নেন এখানে। উত্তরে ভাগীরথী ১, ২, ৩ ছাড়াও ভৃগুপন্থ ও শিবলিঙ্গ স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। আজ আমাদের গন্তব্য ওই শিবলিঙ্গের পাদদেশে, অর্থাৎ তপোবন পর্যন্ত।

সকালের জলখাবার ডালিয়ার পায়েশ আর চা খেয়ে গোমুখের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি আমরা। ভেবেছিলাম খুব সকালে বেরোব, অথচ বেরোতে-বেরোতে আটটা পার হয়ে গেল। পুরো ভূজবাসার আনাচে-কানাচে একচক্কর ঢুঁ মেরে আসতে গিয়েই এত দেরি।

গোমুখ পৌঁছলাম সকাল দশটায়। দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার। পথ অপেক্ষাকৃত কম চড়াই। চড়াই-উতরাই মেশানো। শেষ এক কিলোমিটার পথ বলে কিছু নেই। বড়-বড় বোল্ডারের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলা। এক কিলোমিটার আগে থেকেই চোখে পড়ে গোমুখ হিমবাহ। বাকি পথটুকু হেঁটে গেলাম ঘোরের মধ্যে। গোমুখের কিছু একটি উন্মুক্ত মন্দির, দেবতা মহাদেব। কোনো পূজারি নেই। নিজের দায়িত্বে পূজা দিতে হবে। পূজার উপকরণ কাজু, কিশমিশ, বিস্কুট, লজেন্স… যার কাছে যা আছে। অনেকেই এখানে পুজো দিয়ে গোমুখ দর্শনে যান।

গোমুখ (৪২৫৫ মিটার) সত্যিই মুগ্ধ করল। নীলাভ বরফের হিমবাহ ফেঁড়ে স্বর্গের অমৃতধারা মর্ত্যে নেমে আসছে সশব্দে। ধরণিকে করছে সুজলা-সুফলা। হাজার জনপদ তার তীরে-তীরে। ভিন্ন তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা – তবু এক সূত্রে গ্রথিত। গেঁথেছে গঙ্গা। গঙ্গা ভারতীয় সভ্যতার ধারক ও বাহক। ভারতবাসীর মাতৃস্বরূপা। হিন্দুদের দেবী। সঙ্গীদের দুজন স্নান করল এখানে। আরো অনেক ভ্রমণার্থীকে দেখলাম স্নান করতে। নিশ্চয় পুণ্যার্জনের আশায়! একে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা তারপর বরফগলা জল – কতটা স্বাস্থ্যসম্মত কে জানে! বিপজ্জনক অন্য কারণেও। অনবরত ভেঙে পড়ছে বড়-বড় বরফের চাঙ। কাছে যাওয়া এবং জোরে শব্দ করা নিষেধ এখানে। ভাইব্রেশনে ভাঙন আরো ত্বরান্বিত হয়। তা ছাড়া ট্র্যাকিং চলাকালীন স্নান করা উচিত নয় বলেই জানি। তাতে পেশির সমস্যা হয়। অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সে-কথা সঙ্গী দুজনকে জানিয়েও তাদের নিবৃত করতে পারলাম না। আমি পুণ্যার্জনের আশায় আসিনি, পাপ-পুণ্যে আমার বিশ্বাস নেই। সমতলের মানুষ আমি, গঙ্গাসাগরের দেশের লোক, শেষ থেকে শুরুতে, মোহনা থেকে উৎসে এসেছি একরাশ কৌতূহল নিয়ে – সে কেবল গঙ্গানামী এক নদীর উৎস দেখতেই নয়, আমার সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎস দেখতেও বটে। কৃতজ্ঞতায় নতজানু হই সেই উৎসস্থলে। মনে-মনে প্রণাম জানাই সহস্রকোটি।

গোমুখের সামনে প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেল তবু মুগ্ধতার ঘোর কাটে না। শেষ পর্যন্ত গাইড সৎপাল তাগাদা লাগাতে সম্বিৎ ফেরে। সামনে এখনো পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। ৭০০ চড়াই। পথ বলে কিছু নেই। এ-যাত্রায় সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। তাড়াতাড়ি না করলে ফিরতে পারব না। এদিকে তপোবনে রাত কাটানোর মতো প্রস্ত্ততি নিয়েও আসিনি।

আবার পথ চলতে শুরু করি আমরা। গোমুখ হিমবাহের ওপর দিয়ে পথ। যদিও সে অর্থে পথ বলে কিছু নেই। পাথরের পর পাথর সাজিয়ে নিশানা রেখে গেছে পূর্বতন যাত্রীরা। তাদের নিশানা ধরেই এগোনো। অসম্ভব চড়াই আর বন্ধুর এ-পথে উঠতে গিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিছুদূর এগোনোর পর এক ঝরনার মুখোমুখি, জল নামছে তিরতির করে। সৎপাল বলে, আকাশগঙ্গা। তপোবনের নদী এখানে ঝরনা হয়ে নামছে, মিশছে হিমবাহে। হিমবাহের ভেতর ফল্গুধারায় বইছে। গোমুখ থেকে আবার প্রকাশ্যে, নাম তখন ভাগীরথী। আকাশগঙ্গা ঝরনার ধার ঘেঁষে, কখনো ঝরনার ওপরের বড়-বড় বোল্ডারের ওপর পা ফেলে-ফেলে সন্তর্পণে উঠতে লাগলাম আমরা। এটা শর্টকাট রাস্তা। একটু উঠছি, একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। শ্বাস নিচ্ছি জোরে-জোরে। এর আগে কখনো এত খাড়াপথে উঠিনি। যে দুজন গোমুখে স্নান করেছিল, তাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ল মাঝপথে। কান্নাকাটি জুড়ে দিলো ফিরে যাওয়ার জন্যে। এদিকে তপোবন আর মাত্র তিন কিলোমিটার। ঘাড় উঁচু করলে দেখা যাচ্ছে মাথার ওপর পতাকা উড়ছে। এত কাছে এসে ফিরে যাওয়ার অর্থ হয় না। তপোবন দেখার স্বপ্ন বহুদিনের। সেই স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে… অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজি করালাম। বন্ধুরা বিভিন্নভাবে সাহায্য করলাম। কখনো পেছন থেকে ঠেলে ওপরে উঠতে সাহায্য করলাম তো কখনো টেনে তুলতে লাগলাম। মাঝে একবার পথও হারিয়েছি। আগেই বলেছি, পথ বা পথরেখা বলে কিছু নেই এখানে। মাঝে-মাঝে বরফের বিশাল হাঁ-মুখ মৃত্যুগহবর, ভূগোলের ভাষায় যাকে বলে ক্রিভার্স। মুহূর্তের অসতর্কতায় গিলে নেবে হিমবাহের গভীরে। মাঝে-মাঝে বরফের চাঙ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি দূরে-কাছে, মাঝে-মাঝে বরফ ফাটার শব্দ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডেঞ্জার জোন পেরিয়ে যেতে হবে। নজর পায়ের দিকে। মুহূর্তের অসতর্কতায় বড় বিপদের আশঙ্কা, এমনকি জীবনহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে।

অবশেষে দুপুর একটা বেজে পনেরো মিনিটে তপোবন (৬৫৪৩ মিটার) পৌঁছলাম। এখানে বাসিন্দা বলতে একজন মাত্র সাধু, নাম গান্ধারীবাবা। গুহার মধ্যে আশ্রম বানিয়ে বাস করছেন। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেছেন ইষ্টদেবতা শিবকে। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় গুহার ভেতরে। খুব বেশি হলে তিন ফুট উঁচু দরজা। বাবার চোখ একফালি কালো কাপড়ে ঢাকা। কারো মুখ তিনি দর্শন করবেন না, একমাত্র আরাধ্য দেবতা শিব ছাড়া। গান্ধারী যেমন স্বামীর জন্যে স্বেচ্ছা অন্ধত্ববরণ করেছিলেন, তিনি করেছেন জগৎ স্বামীর জন্যে। বছরদেড়েক হলো এই ব্রত নিয়েছেন। আগে পাঁচ বছর ছিলেন মৌনী বাবা। আদি নিবাস বিহারের কিষানগঞ্জ জেলায়। এর বেশি কিছু জানা গেল না বাবাকে প্রশ্ন করে।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি শিবলিঙ্গ পর্বতের পাদদেশে। শুধু শিবলিঙ্গের চূড়াটা দেখা যাচ্ছে, বাকি অংশ মেঘ-কুয়াশায় মোড়া। লেখক জগদীশচন্দ্রের ভাষায় – ‘এই তবে মহাদেবের জটা।’ আশ্রমের সামনে দিয়ে বইছে আকাশগঙ্গা নদী। খুব বেশি হলে ফুট চার-পাঁচ চওড়া আর ফুটখানেক গভীর। তিরতির করে বইছে স্রোত। নদীর তীর বরাবর ঘুরে অনেকটা হেঁটে আসি আমরা। নদী পার হয়েও অনেক দূর পর্যন্ত যাই। এত উঁচুতে এতটা বিসত্মৃত জায়গা জুড়ে (৫X২ কিলোমিটার) সমতল ভূভাগ সত্যিই বিস্ময়কর। চারপাশে রুক্ষ পাহাড়, মাঝখানে মনোরম সবুজ উপত্যকা, সিজনে সে ফুলের ডালি সাজিয়ে অপরূপা হয়ে ওঠে – নাম তাই তপোবন। রাতটা এখানে কাটালে কেমন হয়? প্রস্তাব বন্ধু মনোজের। আমরা উৎসাহিত হয়ে উঠি। সৎপাল পাশেই দাঁড়িয়েছিল, সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে বলল, রাতে তাপমাত্রা মাইনাস তেরো ডিগ্রিতে নেমে যায়। অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কাছেপিঠে হসপিটাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বলতে সেই গঙ্গোত্রী, হাঁটাপথে দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। এতটা পথ নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগেই বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আসার পথে দেখেছিলাম অসুস্থ একজন মানুষকে বাঁশে বেঁধে নামাচ্ছে দুজন পোর্টার। তপোবনে রাত কাটাতে গিয়ে সাফোকেশনের শিকার হয়েছে। তখনো হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে বুক। দৃশ্যটা মনে পড়তেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো।

দুপুরে গান্ধারী বাবা আমাদের নিজের হাতে তৈরি রুটি আর ডাল খাওয়ালেন। তাকে নগদ ২০০ টাকা এবং কিছু শুকনো খাবার (ছাতু, চিনি, বিস্কুট ইত্যাদি) দক্ষিণা হিসেবে দিয়ে তিনটে নাগাদ বিদায় নিলাম তপোবন থেকে। ততক্ষণে কুয়াশা কেটে স্পষ্ট হয়েছে শিবলিঙ্গ, রোদ উঠেছে ঝলমলে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভাগীরথী ১, ২, ৩, শিবলিঙ্গ ছাড়াও অসংখ্য নাম-না-জানা তুষারশৃঙ্গ। আমাদের বিদায় জানাতে এসে শেষ মুহূর্তে গান্ধারী বাবা দূর-আকাশের দিকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে কী যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, ওপরে বৃষ্টি হয়েছে। জল বেড়েছে আকাশগঙ্গায়, জল বেড়েছে আকাশগঙ্গা ঝরনায়। ঝরনা এখন খরস্রোতা, খরস্রোতা নদীও। যে-পথে এসেছিলাম, সে-পথে ফেরা এখন আর সম্ভব নয়। গাইড সৎপালকে অন্য পথ ধরতে বললেন।

পেছনে পরে থাকল গান্ধারী বাবা, আকাশগঙ্গা, আর শিবলিঙ্গ – বিকল্প পথে ফিরতে শুরু করলাম আমরা। একে পথ না বলে মরণফাঁদ বলাই ভালো। পাহাড়ে ধস নেমেছে, সেই ধসের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে অবতরণ। নির্দিষ্ট কোনো পথ দূরের কথা, পথের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। পায়ের তলায় গুঁড়ো নুড়িপাথর হড়কে যাচ্ছে বারবার। বিপজ্জনক জায়গাগুলোতে সৎপাল হাত ধরে পার করে দিচ্ছে। একবার তো পায়ের তলার বোল্ডারটা হড়কে গেল, শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে বসে পড়লাম, সামনের বড় পাথরের চাঙটা ধরে সামলানোর চেষ্টা করলাম, সেটাও ছিটকে গেল। নিশ্চিত পতনের ঠিক আগের মুহূর্তে চিলের মতো ছোঁ মেরে আমার কাঁধের কাছে খামচে ধরল সৎপাল। তার তৎপরতায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলাম। পুরো ঘটনাটাই ঘটে গেল মুহূর্তের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কিছুটা নামার পর ঝরনাটা চোখে পড়ল। কোথায় সে শান্ত রূপ? রীতিমত রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। সশব্দে প্রবল বেগে জল নামছে। এ-পথে নামা আর সুইসাইড করতে যাওয়া সমার্থক। বেশ কয়েকবার বড়-বড় বরফের ফাটল বা ক্রিভার্সের সামনে এসে পথ আটকে গেল।

তখন পথ বদলে অন্য পথের সন্ধান। এরই মধ্যে শুরু হল আবার শিলাবৃষ্টি। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল সবার। পাহাড়ে শিলাবৃষ্টি যে কী ভয়ংকর, দুর্ভাগ্যবানরা জানেন। এক-একটা বরফের টুকরো বহুগুণ ওজন নিয়ে নেমে আসে। মোটামুটি পঞ্চাশ গ্রামের একটা মাথায় পড়লে রক্তারক্তি কা- হয়ে যাবে। এমনকি জীবনও যেতে পারে। কে জানে কতক্ষণ স্থায়ী হবে! এক-একটা টুকরো গুলির মতো গায়ে এসে বিঁধছে। এভাবে ঝুঁকি নিয়ে এগোনো অসম্ভব, আমরা থামতে চাই। সৎপাল তাড়া লাগায় তাড়াতাড়ি নামার জন্যে। সন্ধে হয়ে আসছে। অপেক্ষা করতে গেলে বিপদ আরো বাড়বে। ওই অবস্থাতেই পথ চলতে হয়। সৌভাগ্য মিনিটদশেকের মধ্যে শিলাবৃষ্টি থেমে যায়। তবু এই পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গোমুখ পৌঁছাতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। এতক্ষণ নিজের পায়ের দিকে ছাড়া অন্য কোনো দিকে তাকানোর অবকাশ হয়নি। গোমুখে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। শ্বাস নিতে ওপরের দিকে তাকালাম। স্পষ্ট শিবলিঙ্গ। শিবলিঙ্গের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ। ব্যাকগ্রাউন্ডে কালচে নীল আকাশ। এবার আর মনে-মনে নয়, দুহাত একত্র করে প্রণাম জানাই এই অনির্বচনীয় ঐশ্বরিক দৃশ্যকে।

ভূজবাসা পৌঁছাতে রাত নটা বাজে। রাতটা লালবাবার আশ্রমে কাটিয়ে সকালেই নেমে যাব গঙ্গোত্রী, সেখান থেকে হরিদ্বার হয়ে সোজা… মোহনার দেশে ফিরে যাব আমরা।