গণেশ পাইনের অ্যঅনিমেশনের ছবি র্শনীদপ্রকার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত প্র-আকার

মৃণাল ঘোষ

গণেশ পাইনের কার্টুন-চিত্র বা অ্যানিমেশনের ছবি প্রসঙ্গে আসার আগে আমরা একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব ষাটের দশক-পরবর্তী আধুনিকতাবাদী ভারতীয় চিত্রকলায় গণেশ পাইনের অবদান কী? এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় – ভারতীয় আধুনিকতার এক স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় বা ‘আইডেনটিটি’ তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর প্রজন্মের বা তাঁর কাছাকাছি সময়ের আরো কয়েকজন শিল্পী ভিন্ন ভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন এ- ক্ষেত্রে। মীরা মুখোপাধ্যায়, জগদীশ স্বামীনাথন, ভূপেন খক্কর, গণেশ হালুই প্রমুখ আরো অনেকে এ-লক্ষ্যে কাজ করেছেন বা করছেন। এই আত্মপরিচয়-সম্পৃক্ত আধুনিকতাবাদী আঙ্গিক শুধু পাশ্চাত্যের প্রতিফলন বা অনুকরণ নয়, গণেশ পাইনের ক্ষেত্রে অন্তত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের এক সমন্বিত রূপ। সেখানে যে ‘প্রাচ্য’ বা ‘দেশজ’ – তা একদিকে যেমন রূপগত বা কর্মকেন্দ্রিক, অন্যদিকে তেমনি কৌমচেতনাভিত্তিক জাতীয় ইতিহাস ও প্রাক্-ইতিহাসকেন্দ্রিক। সেই ইতিহাস যতটা না এসেছে ওপরের স্তরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে, তার চেয়ে বেশি কৌম-মগ্নচেতনার অন্ধকার থেকে। এই কৌমচেতনা পুরাণকল্প বা মিথ তৈরি করে। গণেশ পাইনের ছবিতে পুরাণকল্পের প্রভাব অপরিসীম। এই পুরাণকল্পকে আবার তিনি আধুনিক জীবনের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের প্রতীক করে নিয়েছেন। সেভাবে অতীত ও বর্তমানকে মিলিয়েছেন। হিংসাতাড়িত, মৃত্যুতাড়িত যে বর্তমান – তারই স্বরূপ উদ্ঘাটনে পুরাণকল্পের প্রতীক ব্যবহার করেছেন। সেদিক থেকে প্রতিবাদী-চেতনাই তাঁর ছবির প্রধান একটি সুর। এভাবেই প্রাচ্যের রূপচেতনা ও পুরাণকল্পের অন্তর্লোক এবং প্রাচ্যের অভিক্ষেপে গড়ে ওঠা পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বাকীর্ণ রূপকল্প – এ দুটি উৎসকে সমন্বিত করে তিনি চিরন্তন কালপ্রবাহের অন্তর্নিহিত আলো-অাঁধারির বার্তাকে মেলে ধরেছেন তাঁর ছবিতে। আধুনিকতাবাদী চিত্রকলায় এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁর অজস্র ছবির মধ্যে আমরা দুটি ছবির উল্লেখ করছি – ১৯৭১-এর ‘হারবার’ ও ১৯৭২-এর ‘ফিশারম্যান’।

২ জুন ১৯৮৬ তারিখে প্রকাশিত আজকাল পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – ‘মাঝে মাঝে মনে হয় আমার সমস্ত ছবিই যেন পেন্ডুলামের মতো দুলছে দুটো বিন্দুতে। একটা বিন্দু ন্যাচারাল ফর্মের যেগুলি একটু বাস্তবধর্মী কাজ। আর অন্য বিন্দুটিতে থাকে জ্যামিতিক কর্ম বা মেজাজ।’ এখানে যাকে তিনি বলছেন ‘ন্যাচারাল ফর্ম’, সেটি যে শুধুই অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদী রূপরীতি, তা নয়। যদিও অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতাতেও তাঁর দক্ষতা ছিল অবিসংবাদিত। স্বাভাবিকতার সেই দক্ষতা দিয়েই তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে ঐতিহ্যগত রূপ এবং পুরাণকল্পের কল্পরূপকেও ধরতেন। তারপর তার ভেতর আধুনিকতার সংঘাতকে আনতেন কিউবিস্ট জ্যামিতির দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে। এই দুই রূপরীতিকে তিনি এমনভাবে সমন্বিত করেছেন  যে, তা যেমন অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বা সামগ্রিকভাবে নব্য-ভারতীয় ঘরানার স্বদেশ-দর্শনকে অতিক্রম করে তার ভেতর উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতীয় বাস্তবকে স্পন্দিত করেছে, তেমনি পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী প্রকল্পের আঙ্গিক-উদ্ভূত যে প্রতিবাদী চেতনা তাকেও দেশীয় ঐতিহ্য ও পুরাণকল্পের চেতনা দিয়ে রূপান্তরিত করে নিয়ে এই ঐতিহ্যেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে নিয়েছে। এই সমন্বয়েরই অত্যন্ত সার্থক রূপকার গণেশ পাইন। এই সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন আমাদের ছবির আধুনিকতাবাদী আত্মপরিচয়।

এই আঙ্গিক-বিন্যাসে তাঁর প্রধান অবলম্বন ছিল কল্পরূপ বা ফ্যানটাসি। প্রথম জীবনে যে-যে উৎস থেকে তিনি এই কল্পরূপ আহরণ করেছেন কার্টুন বা অ্যানিমেশনের ছবির চর্চা তার একটি। একেবারে শৈশবে গণেশ পাইন আপনমনে শেস্নটে ছবি অাঁকতেন। তখন তাঁর এক আশ্চর্য অনুভূতি হতো। ওখানে বাস্তব-অবাস্তব বলে কিছু নেই। শেস্নটের ওইটুকু পরিসরের মধ্যে যা খুশি তাই ঘটানো যায়। পরে ১৯৬১ সাল থেকে, তখন তাঁর বয়স ২৪, যখন তিনি এই কার্টুন অ্যানিমেশনের ছবির চর্চায় এলেন, তখন তিনি বলেছেন, তাঁর অনুভূতি হয়েছিল। তাঁর কথা উদ্ধৃত করছি – ‘এখানে গল্পের গরু যেমন গাছে উঠে যায় অনায়াসে, এই কার্টুন অ্যানিমেশন যখন দেখতাম ফিল্মাইজড অবস্থায়, তখন আমার মনে হতো, এ তো আশ্চর্য এক ক্ষেত্র, যেখানে যা খুশি তাই ঘটানো যায়।’

১৯৬১ সাল। সবে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন। চাকরি-বাকরির চেষ্টা করছেন। পাচ্ছেন না। পাশাপাশি বুক ইলাস্ট্রেশন, বুক কভার ইত্যাদি ফরমায়েশি কাজ করছেন। সে-সময় তাঁর এক বন্ধু তাঁকে এসে বলেছিলেন – তুমি তো চাকরির চেষ্টা করছো, পাচ্ছো না। যতদিন না পাও একটা মজার কাজ আছে, করতে পারো, যদি তোমার পছন্দ হয়। সেই বন্ধুর সূত্রেই যোগাযোগ হয় মন্দার মলিস্নকের সঙ্গে। ২০৯ বিধান সরণি, ঠনঠনিয়ায় ওখানেই ছিল তাঁর মন্দার স্টুডিও। সেখানে তিনি অ্যানিমেশন ফিল্ম তৈরির কাজ করতেন। গণেশ পাইন সামান্য পারিশ্রমিকে অ্যানিমেশনের ছবি অাঁকা শুরু করেছিলেন ওখানে। কেমন করে তিনি করতেন এই ছবি, এ-প্রশ্নের উত্তরে গণেশ পাইন বলেছিলেন :

এই যে ছবিগুলো আপনি দেখছেন, এটা একটা স্টোরি বোর্ড। গল্পটা মন্দার মলিস্নক মশায়ের তৈরি। এখন এই স্টোরি বোর্ড থেকে প্রতিটা চরিত্র যখন নির্দিষ্টভাবে অাঁকা হল, তখন, এটা দীর্ঘ শ্রমসাপেক্ষ একটা পদ্ধতি। এক ধরনের ট্রেসিং-এর প্রসেসে হয়ত একটা হাত উঠছে। তার একটি করে ফ্রেম তৈরি করতে হয়। সেকেন্ডে চবিবশটা করে গেট যায়, এইটাই নিয়ম। এই রকম একটা রেশিওতে একটার পর একটা করে ছবি অাঁকতে হত। কাগজের ড্রয়িং ত হল, তারপর তার উপর সেলুলয়েড ফেলে, তার উপর ইঙ্ক দিয়ে ট্রেস করা হত আউট লাইনটা। তারপর উল্টোদিক থেকে, ওপেক কালারে, আমরা পোস্টার কালারই ব্যবহার করতাম, যেখানে যে রঙ দরকার, সেই রঙ দিয়ে ভরে দেওয়া হত। এইভাবে। তারপরে এক একটি সেলুলয়েড একটি নির্দিষ্ট পিনে রেখে স্টপ-গেট ক্যামেরা বলে আর কি, যাতে একটা মাত্র শট নেওয়া যায়, তারপর ওটা ক্লোজ করে আরেকটা। এইভাবে হত।

এভাবে নিবিষ্ট ধৈর্যে, অসামান্য নিপুণতায় তিনি এঁকেছেন ওয়াল্ট ডিজনি ধরনের কার্টুনের ছবিগুলো। পশুপাখির অবয়ব বিন্যাসে, অভিব্যক্তিতে ও গতিভঙ্গিতে মানুষের মত কিছু বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছেন। অবয়বকে কোথাও প্রসারিত, কোথাও সংকুচিত করে অভিব্যক্তিতে আনন্দ, বিস্ময় ও কৌতুক সঞ্চারিত করেছেন। পশ্চাদপটে থাকে অরণ্য। সেই অরণ্যের রূপায়ণে কোনো ‘ডিস্টর্শন’ আনেন না। নীল আকাশের নিচে শান্ত, শ্যামলিমা পরিম-লে পশুপাখিরা তাদের সৌহার্দ্য ও প্রীতির জগৎ উন্মীলিত করে। কোথাও উন্মুক্ত থাকে প্রেক্ষাপট। তারই ভেতর পশুপাখিদের সঞ্চরণ। কোথাও আবার পশুদের অভিব্যক্তিকে বোঝাতে তিনি ‘বিগ ক্লোজআপ’ ব্যবহার করেন। সেখানে চোখ, মুখ, মুখগহবরের রূপায়ণকে রেখার ধরন ও বর্ণ-প্রয়োগের বৈশিষ্ট্যে কতগুলো স্বতন্ত্র তলে বিন্যস্ত করে অভিব্যক্তিবাদী কল্পরূপের সঞ্চার করেন। পঞ্চতন্ত্রের কথামালার পরিম-লকে তিনি তাঁর মত করে দৃশ্যভাষায় রূপান্তর করেন।

এই গল্পের প্রেক্ষাপট হিসেবে যে-নিসর্গ থাকে, তাকেও তিনি আলাদা করে এঁকেছেন। বাংলা-বিহার-ওড়িশা অঞ্চলের প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য আছে স্বচ্ছ জলরঙে অাঁকা সেই কল্পিত নিসর্গগুলোর। পরিপূর্ণ বা স্বতন্ত্র ছবি হিসেবে তিনি নিসর্গ চিত্র কমই এঁকেছেন। একসময় কাশ্মিরে বা পুরীতে বেড়াতে গিয়ে নিসর্গের ছবি করেছেন। আবার টেম্পারার ছবিতে প্রেক্ষাপট হিসেবে অনেক সময় নিসর্গ এসেছে। সেদিক থেকে স্বচ্ছ জলরঙে অাঁকা এই স্নিগ্ধ নিসর্গগুলো তাঁর চিত্রচেতনার এক আলাদা দিক তুলে ধরে। তথাপি এই সজল স্নিগ্ধ নিসর্গগুলোর মধ্যেও তাঁর মগ্নচেতনার রহস্যময়তার অবিচ্ছেদ্য কিছু আভাস সম্পৃক্ত থাকে। গাছের ডাল-পালাগুলোর বিন্যাস, তাদের গায়ে কোটরের ভেতরের অন্ধকারগুলো একটু লক্ষ করলে বোঝা যায়, নম্র স্বাভাবিকের ভেতরেও শিল্পী কী করে রহস্যময় অাঁধারের ব্যঞ্জনা আনেন। এভাবে এই ছবিগুলোর ভেতরেও গণেশ পাইনের নিজস্ব মননের পরিচয় প্রচ্ছন্ন থাকে।

এই কার্টুন ও নিসর্গের ছবিগুলো গণেশ পাইনের স্বতন্ত্র ঘরানার কাজ। তাঁর নিজস্ব যে চিত্রদর্শন, তার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। কিন্তু এগুলো চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি যেমন কল্পরূপের রহস্যলোককে নানা দিক থেকে অনুধাবন করেছেন, তেমনি অংকনের সূক্ষ্ম নিপুণতাও আয়ত্ত  করেছেন। এই চর্চা নিঃসন্দেহে তাঁর নিজস্ব রূপরীতিকে সমৃদ্ধ করেছে।

গণেশ পাইনের অ্যানিমেশনের এই ছবিগুলো নিয়ে বিগত ফেব্রম্নয়ারি-মার্চ মাস জুড়ে (২০১৭) প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে আকার-প্রকার গ্যালারিতে। এই ছবিগুলো গণেশ পাইনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন শৈবাল ঘোষ নামে একজন শিল্পী। জলরঙে অসামান্য কাজ করতেন তিনি। গণেশ পাইনের খুবই প্রীতিভাজন ছিলেন। শৈবাল ঘোষের অকাল-প্রয়াণের পর ছবিগুলো চলে যায় অন্য একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহে। সেখান থেকেই এই ছবি সংগ্রহ করেন আকার-প্রকার কর্তৃপক্ষ।

এ উপলক্ষে ২৪ মার্চ ওই গ্যালারিতেই একটি আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল ‘অজানা গণেশ পাইন : তাঁর প্রথমদিকের কাজ ও জীবন’। সেখানে এই কাজগুলো এবং গণেশ পাইনের অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা করেন প্রণবরঞ্জন রায়, অঞ্জন সেন, সৌরভ রায় ও বর্তমান প্রতিবেদক। r