গভীর অশ্রু

দোতলা বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন মঞ্জুর সাহেব। তার দৃষ্টি নিচে গলির দিকে। তার ক্লান্ত চোখদুটো কী যেন খুঁজছে। তার বাসার ঠিক সামনেই তিনতলা বাড়ির ছায়া এসে পড়েছে রাসত্মায়। সেখানে একদল ছেলে ক্রিকেট খেলছে। শহরে আজকাল খেলার মাঠ হয়ে গেছে দুর্লভ বস্ত্তর মতো। মঞ্জুর সাহেবের প্রায়ই এদের দেখে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। তাদের সময় তারা সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। বিকেল হলেই তাদের গ্রামের স্কুলমাঠে চলে যেতেন ফুটবল খেলতে। তিনি সুস্থভাবে গ্রামে আছেন আর ফুটবল খেলতে যাননি, তার জীবনে এরকম কোনো দিনের কথা মঞ্জুর সাহেবের মনে পড়ে না। আর শহরে ছেলেমেয়েদের তাদের জীবনের মতোই এই বিশাল অট্টালিকার মাঝে আটকে পড়ে খেলতে হয়ে। এই তো কদিন আগেও তো এরা খেলত পেছনের মাঠটায়। কিন্তু সেখানেও এখন বিরাট বিল্ডিং গড়ে উঠছে। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি এসে খেলার মাঝে বাধা দিচ্ছে। ছেলেগুলো তখন তাদের স্টাম্প, ব্যাট উঠিয়ে পাশে সরে যাচ্ছে। একবার সামান্য দেরি হওয়ায় ড্রাইভার ঝাঁঝালো ভাষায় খানিকটা কথা শুনিয়ে গেল।

মঞ্জুর সাহেব অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিলেন। আজ রাসত্মায় কী যেন নেই। তার ভেতরটা কেমন যেন খচখচ করছে। রিটায়ার করার পর থেকে প্রতিদিন বিকেলে বারান্দায় বসে এই দৃশ্যই তো দেখেন। ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করতে থাকে। মাঝেমধ্যে দু-একজন পরিচিত লোক ওপরে তাকিয়ে হেসে তার খোঁজখবর নেয়। কোনো কোনো দিন ছেলেদের ক্রিকেট বল চলে আসে ওপরে। ওরা খুব কাঁচুমাঁচু মুখ করে মঞ্জুর সাহেবের কাছে বল চায়। মঞ্জুর সাহেব অবশ্য প্রত্যেকবারই হাসিমুখে ওদের বল ফিরিয়ে দেন। তিনিও তো একসময় ওদের মতোই ছিলেন।

সবকিছুই তো ঠিকই আছে। কিন্তু তবু আজ মঞ্জুর সাহেবের মনে হচ্ছে কিছু একটা সত্যি যেন আজ রাসত্মা থেকে উধাও হয়ে গেছে। অনেক খুঁজেও মঞ্জুর সাহেব বের করতে পারলেন না। ভাবলেন, হয়তো মনের ভুল। মনটা হয়তো আজ বেশিই অস্থির হয়ে পড়েছে। ভেতর থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই এনে পড়ার চেষ্টা করলেন মঞ্জুর সাহেব। তবু চোখদুটো থেকে থেকে বারবার চলে যাচ্ছিল রাসত্মার দিকে। শেষে উঠে এলেন বারান্দা থেকে।

পরদিন বিকেলে মঞ্জুর সাহেব আবার গিয়ে বারান্দায় বসলেন। কিন্তু আজো তার সেই একই অনুভূতি হলো। তিনি আজো অজানা কিছু একটা খুঁজে বেড়ালেন। চোখদুটো বারবার রাসত্মার এদিক থেকে সেদিকে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। তিনি বেশিক্ষণ সেখানে বসে
থাকতে পারলেন না। বুকটা বারবার কী যেন একটা হারিয়ে ফেলার আশংকায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

পরের দিন বিকেলে মঞ্জুর সাহেব তার স্ত্রীকে নিয়ে এলেন বারান্দায়। রাসত্মার দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাবেয়া, এই রাসত্মাটা দেখছ। তোমার মনে হচ্ছে না, রাসত্মাটা থেকে কিছু একটা হারিয়ে গেছে?’

রাবেয়া বেগম রাসত্মার দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বললেন, ‘কই? সবই তো ঠিক আছে। রাসত্মা থেকে আবার কী হারিয়ে যাবে?’

মঞ্জুর খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহা! তুমি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখো না। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?’

রাবেয়া বেগম মঞ্জুর সাহেবের দিকে ভ্রূ কুঁচকে জবাব দিলেন, ‘অ্যাই, তোমার কী হয়েছে বলো তো? রাসত্মা তো রাসত্মাই। রাসত্মায় লোকজন হাঁটবে, গাড়ি চলবে। এর ভেতর আবার হারিয়ে যাওয়ার কী আছে?’

মঞ্জুর সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘উহ্‌! তুমি বুঝবে না। আমার রাসত্মাটার দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন যেন খচখচ করছে।’

রাবেয়া বেগম কাছে এসে মঞ্জুর সাহেবের কপালে হাত রেখে বললেন, ‘তোমার কী শরীর খারাপ? এমনভাবে কথা বলছ কেন? রিটায়ার করে কী মাথাটাই খারাপ বানিয়ে ফেললে?’

মঞ্জুর সাহেব রাবেয়া বেগমের হাতটা সরিয়ে বললেন, ‘তুমি যাও তো এখান থেকে। শুধু শুধু ফাজলামি করো না।’

রাবেয়া বেগম একটু হেসে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, যাচ্ছি। রাগ করছ কেন? আমি তোমার আর আমার জন্য কফি বানিয়ে আনছি। তারপর না হয় দুজনে মিলে রাসত্মায় কী হারিয়েছে তার রহস্য উদ্ঘাটন করব। ঠিক আছে?’

মঞ্জুর সাহেব কিছু বলার আগেই রাবেয়া বেগম চলে গেলেন বারান্দা থেকে।

রাবেয়া বেগম চলে যাওয়ার পর মঞ্জুর বসে পড়লেন তার ইজি চেয়ারটায়। তার হঠাৎ মনে হলো, রাবেয়া ঠিক বলেনি তো? তার কি সত্যি সত্যি মাথা গুলিয়ে গেছে? তিনি কী উলটোপালটা চিন্তা করা শুরু করেছেন? আস্তে আস্তে কী তিনি প্রলাপ বকা শুরু করবেন? তারপর কাউকে চিনতে পারবেন না। তখন সবাই মিলে তাকে হয়ত ঘরে আটকে রাখবে।

মঞ্জুর সাহেব মাথা ঝাঁকি দিয়ে উঠলেন। তিনি এইসব কী ভাবছেন। তিনি বেশ সুস্থ আছেন। মঞ্জুর সাহেব আবার ভাবতে লাগলেন তার তিন কুলে কেউ পাগল ছিল কিনা। নাহ্! তার আত্মীয়দের ভেতর তো কেউ পাগল ছিল না। তবে ছোটবেলায় তাদের গ্রাম থেকে বেশ দূরের একটা গ্রামে তিনি তার এক দূরসম্পর্কের ফুপু মারা যাওয়ার পর গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে শুনেছিলেন তার এই ফুপু নাকি পাগল ছিলেন। কিন্তু অত দূরের সম্পর্ক থেকে কি জিন আসা সম্ভব? কে জানে? হয়ত বহু আগের কোনো পূর্বপুরুষের মধ্যে এই পাগলের জিন ছিল। কারো ওপর প্রভাব বিসত্মার করতে পারেনি, শেষমেশ তার ভেতরই প্রকট হয়ে দেখা দিলো। আচ্ছা, পাগলামিটা কি আদৌ জিন থেকে আসে?

 মঞ্জুর সাহেব আবারো মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। তিনি এগুলো কী আজেবাজে চিন্তা করছেন। তিনি মনে মনে বেশ কিছু জটিল অংক করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ছেলেবেলায় তার ব্রেন বেশ শার্প ছিল। বড় বড় যোগ-বিয়োগ, ল.সা.গু, গ.সা.গু, মুখে মুখেই করতে পারতেন। একগাদা কবিতাও মুখস্থ ছিল তার। প্রিয়ডিক টেবিল পর্যন্ত মুখস্থ করেছিলেন।

বেশ কিছু জটিল যোগ-বিয়োগ করার পর আশ্বস্ত হলেন তার মস্তিষ্ক এখনো বেশ পরিষ্কার আছে। তিনি ভেতরে গিয়ে তার পুরনো ক্যাসেট পেস্নয়ারটা অন করে রবীন্দ্রসংগীত চালালেন। রবীন্দ্রসংগীতকে মঞ্জুর সাহেবের একধরনের থেরাপির মতো মনে হয়। যে-কোনো পরিস্থিতিতেই রবীন্দ্রসংগীত মনকে শান্ত করতে পারে।

কিছুক্ষণের মধ্যে রাবেয়া বেগম সত্যি সত্যি দু-কাপ কফি নিয়ে এলেন। কফি খেতে খেতে মঞ্জুর সাহেব রাবেয়া বেগমের সঙ্গে ছাড়া-ছাড়া ভাবে গল্প করলেন। কিন্তু তার চেতনার বিরাট একটা অংশ জুড়ে রাসত্মাটাই থেকে গেল। আর খুব সামান্য এক শঙ্কা পাগল হয়ে যাওয়ার!

আজ মঞ্জুর সাহেবের মন প্রচ- খারাপ। তীব্র এক অস্বস্তি কাজ করছে তার ভেতর। একই সঙ্গে তার বারবার মনে হচ্ছে, তিনি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছেন না তো! অথচ এই রাসত্মার ব্যাপারটা বাদ দিলে তিনি পুরোপুরি স্বাভাবিক।

মঞ্জুর সাহেব একবার ভেবেও ছিলেন তিনি ডাক্তারের কাছে যাবেন। কিন্তু তিনি জানেন, এই বয়সে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলে লোকে এমনিতেই পাগল বলা শুরু করবে। মাথা খারাপ না হলেও তখন থেকে মাথা খারাপ হওয়া শুরু করবে।

রাতে মঞ্জুর সাহেবের মন খানিকটা ভালো হয়ে গেল। অনেকদিন পর তিনি তার পুরো পরিবার সঙ্গে খেতে বসলেন। তার একমাত্র ছেলে রাজীব আর পুত্রবধূ আনিলা দুজনেই ডাক্তার। আনিলা চেম্বার থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এলেও রাজীব বেশিরভাগ দিনই ফেরে রাত করে। আজ রাজীব চেম্বার থেকে অনেক আগে ফিরে এসেছে।

খেতে বসে আজ বেশ একটা পারিবারিক আড্ডা জমে গিয়েছিল। বেশির ভাগ দিন মঞ্জুর সাহেব আর তার স্ত্রী নীরবে কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করেন।

রাবেয়া বেগম রাজীবের ছোটবেলায় কুকুর পোষার গল্প শোনাচ্ছিলেন আনিলাকে। রাজীব একদিন স্কুল থেকে একটা কুকুরছানা এনেছিল। বাসায় আনার পর মায়ের ভয়ে সে-কুকুরটা একটা বাক্সে লুকিয়ে রেখেছিল। দুদিন পর মঞ্জুর সাহেব টের পেয়েছিলেন কুকুরছানার উপস্থিতি। রাজীব ভেবেছিল তার বাবা বোধহয় কুকুরছানাটি রাখতে দেবেন না। কিন্তু রাজীবকে অবাক করে দিয়ে বাবা যে শুধু অনুমতি দিয়েছিলেন কুকুর পোষার তা-ই নয়, বরং হইচই করে তিনি কুকুরটার জন্য আস্ত একটা ডগ হাউসও বানিয়ে দিয়েছিলেন নিজ হাতে।

কুকুরটা যেদিন মারা যায় সেদিন রাজীব নাকি চিৎকার করে কেঁদেছিল। তখন সে ক্লাস টেনে পড়ে।। অতো বড় একটা ছেলে ওইভাবে কাঁদতে পারে রাজীবকে না দেখলে কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবে না। প্রায় দুদিন রাজীবের প্রচ- জ্বর ছিল।

গল্পটা শেষ হওয়ার পর রাজীব তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানো বাবা। আমাদের এই-গলি রাসত্মায় একটা মেয়ে কুকুর ছিল। এইবার চারটা বাচ্চা হয়েছিল। ছোট্ট ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা। আমি রোজ চেম্বার থেকে ফেরার পথে ওদের জন্য পাউরুটি, বিস্কুট কিনে আনতাম। গত কিছুদিন ধরে দেখি কুকুরগুলো নেই। কাল ওইখানের চায়ের দোকানদারের কাছে খোঁজ নিলাম। লোকটা বলল, বাচ্চাগুলো সারাদিন ঘেউ ঘেউ করত বলে আমাদের মহল্লার কয়েকজন মিলে বাচ্চাগুলোকে দূরে কোথায় জানি ফেলে দিয়ে এসেছিল। মা কুকুরটাও তার পরদিন বেরিয়ে যায়। আর ফেরেনি। মনে হয় বাচ্চার খোঁজে বেরিয়েছিল। শুনে এত কষ্ট লাগল। প্রচ- রাগও হচ্ছিল। মানুষের বাচ্চা সারাদিন কাঁদলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অন্য প্রাণী একটু শব্দ করলেই দোষ। আমরা মানুষরা আসলে সবসময় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য দুর্বলের ওপর জোর খাটাই।’

রাজীবের কথাগুলো শুনতে শুনতে মঞ্জুর সাহেবের বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভারি হয়ে আসছিল। তার মনের ভেতরের সেই অস্বস্তিটা হঠাৎ করে কোথায় যেন উবে গেল। খচখচ করাও বন্ধ হয়ে গেছে। তার বদলে তার মনে জমা হয়েছে একরাশ দুঃখ আর অভিমান।

দুঃখের কারণটা তিনি জানেন। কিন্তু অভিমান হচ্ছে কেন তার? কার ওপর এতো অভিমান? অভিমান করেও কী আদৌ কোনো লাভ আছে? মঞ্জুর সাহেব খাওয়ার সময় আর কোনো কথা বললেন না। খুব ধীরে ধীরে খাওয়া শেষ করলেন তিনি। হাত ধুয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন। তাকে আজ কাঁদতে হবে। সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে কাঁদতে হবে। বহু বছর আগে যেভাবে তিনি কেঁদেছিলেন ঠিক সেই ভাবে।