গল্পের বয়ান ও বুনোন

সৈয়দ শামসুল হক

গল্পের কি শেষ আছে? সেই কোন আদ্যিকাল থেকে মানুষ কত লক্ষ কোটি অযুত গল্প বলেছে, বানিয়েছে, লিখেছে। এখনো তো ফুরোয়নি সেই নেশা। কোনোকালে ফুরোবে বলেও মনে হয় না। নেশাই বটে। মহাতামাকের চেয়েও কঠিন এ-নেশা। গল্প না বলে মানুষ থাকতে পারে না। গল্প যেন আপনা থেকেই মনের মধ্যে উঠে পড়ে। চারদিকের দেখা-শোনার জীবন ঠেলে আমরা যে এগোই, তার বয়ানটাই গল্প। মৌনী সাধু-উন্মাদের কথা আলাদা। তবে, ওই যে মৌনী উনি, কীসের কোন সাধন কারণে মৌনতা ধরেছেন, তাঁর মনেও গল্প উঠছে পড়ছে। কারণ, তিনি মৌনী হলে কী, বিশ্বটাকে দেখছেন তো! মানুষগুলোকে শুনছেন তো! অমনি তাঁরও মনের মধ্যে গল্পের বুনোন চলছে।
সংসারি মানুষ, মুখর মানুষ। কথা ছাড়া মানুষ নেই। তাদের মুখে গল্পের খই ফোটে। কাজ থেকে ফিরে বাড়িতে গল্প, বাড়ি ফিরতে ফিরতে সহপথিকের কাছে গল্প, কাজের জায়গাতেও হাত চলছে, গল্পও চলছে। হাটেবাজারে গল্প। গঞ্জ-ঘাটে গল্প। স্বজনবাড়িতে যাওয়া হলো কি তারা এলো, তখন গল্প ছাড়া কিছু নেই! গল্পে কান ভরে ওঠে আমাদের প্রত্যহের জীবন। আমরা বলি, আমরা শুনি, কেউ কেউ লিখিও, মানুষ পড়ে।
বলা থেকেই গল্প। আর সেই বলাটাই বা কী? দেখা ঘটনা, শোনা ঘটনা। যা দেখলাম, যা শুনলাম, ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে, শোনাতে মন চায়। কেউ জমিয়ে বলতে পারে, কেউ আলুথালু করে বলে। যা বলে, সেটি গল্পই। কিন্তু একটা দূরত্ব যে ঘটে যায়! দেখা আর বলার মধ্যে অনিবার্য সেই দূরত্ব। মনের রং পড়ে, সেই রঙে দেখা ঘটনারই রঞ্জন পালটে যায়। একই ঘটনা যদি দুজনা দেখে তো বলতে গিয়ে দুরকমের হয়ে যায়। এই দুরকম হয়ে যাওয়াটা আসলে কী? দুরকম হয় কী করে? হয়, বক্তা দুজন আলাদা মানুষ বলে। আলাদা তো শুধু চেহারায় নয়, মানুষ আলাদা তার অভিজ্ঞতা আলাদা বলে। আবার, জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখার ঝোঁকটাও আমাদের জনে-জনে আলাদা। তাই একই দেখা ঘটনা জনে-জনে অন্য রকমের হয়ে পড়ে বলতে গিয়ে।
সাহিত্যে আমরা লেখা গল্পে থাকলেও বয়ান হিসেবে গল্প শুরু হয়েছিলো লেখারও অনেক আগে, সেই যখন মানুষ লিখতেই শেখেনি। এমনকি ভাষাটাও তেমন গড়ে ওঠেনি তখনো, সেই তখন গল্প কি অভাবে ছিলো? না! অনুমান করি কবিতারও আগে গল্পের জন্ম হয়েছিলো। গল্প তো আসলে এক বয়ান, আর এ-বয়ানের শুরু মানুষের করোটির ভেতরে। দূরধূসর যে-কালে মানুষ তখন পর্যন্ত পদ্যের ছন্দমিল উদ্ভাবন করে ওঠেনি, তার অনেক আগেই মানুষ এসে গেছে কথকতায়। গল্প যে আসলেই কথা, এর স্মৃতিটা রয়ে গেছে গল্প-সাহিত্যকে কথাসাহিত্য আর এ-কথককে কথাশিল্পী বলায়।
শিল্প কাকে বলে? মানুষের আকাক্সক্ষা ও অভিজ্ঞতার বয়ান যখন পাথরের টুকরোয় কি চিত্রপটে কি শাদাপাতায় কি সপ্তস্বরধ্বনিতে কি দেহমুদ্রায় বর্জন গ্রহণ রঞ্জন ও সম্পাদন কি বিন্যাসকরণের ভেতর দিয়ে নতুন একটা চেহারা পায়, যা আগেও ছিলো না, পরেও আর হবে না। এই যা হয়ে রইলো – এটাই! এই শিল্প! ভাষায় যখন গল্প, তখন কথাসাহিত্য, আর সেটা যে করলো সে কথাশিল্পী – লেখাতেও, বলাতেও। বলিয়ে এমন কথাশিল্পী আমরা প্রতিদিনের জীবনে কাউকে না কাউকে দেখেছি। সাধারণ ঘটনাও সে যখন বলে, কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে। এমনকি সে যদি বলে – এইমাত্র মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরলাম, তো তাকে জীবিত দেখেও ঘটনা শুনতে অধীর হয়ে উঠি আমরা, তাগাদা দিই – বলো, বলো, কী হয়েছিলো? শিশুকে গল্প বলি, বলতে বলতে একটু যদি থামলাম তো শিশু অধীর হয়ে বলে, তারপর? তারপর কী হলো? এই তারপর-এর শেষ নেই। তারপরটাই হচ্ছে গল্পের এঞ্জিন এগিয়ে যাবার কি ঠেলে নেবার জ্বলন্ত কয়লা। তারপর-এর জবাবে কথক বলতে শুরু করলো তো আমাদের শোনার তৃষ্ণাটি শান্ত হলো।
শোনাটাই! – শোনা থেকেই শুরু! – কল্পনা করি, আদিমকালের শিকারি মানুষ বনে গেছে শিকার করতে। ভাষাও তখন ঠিকমতো মানুষের কব্জায় আসেনি। শিকার থেকে খাদ্য-পশুটিকে এনে কাঁচা কি ঝলসিয়ে খেতে খেতে, কি কাঁচা মাংস ছাড়াতে ছাড়াতে, কি আগুনে ঝলসাতে ঝলসাতে, কী করে কেমন করে পশুটাকে পাওয়া গেলো, তাকে কীভাবে গুলতি কি তীর কি বল্লমের মুখে পতিত করা গেলো, বাহাদুরি করে সে বয়ান নিশ্চয়ই মানুষ দিয়েছে তার দলের মানুষকে। ওই বাহাদুরি শব্দটা! বাহাদুরিটা ফলাতে গিয়ে বয়ানে এক ধরনের রঙ সে নিশ্চয় চাপায়। এমনও কল্পনা করি, তার সঙ্গে আর-যে শিকারিরা ছিলো, তারা হয়তো খুকখুক করে হেসেছে বয়ানে ওই বাহাদুরির রঞ্জন দেখে! মানুষ বুঝি তখনই সচেতন হয়েছে ঘটনা আর বয়ানের বিভিন্নতা আর কল্পনার রঞ্জন সম্পর্কে।
শুধু কি তাই? ওই যে বলেছি জীবনকে দেখার একটা বিশেষ ঝোঁক, কিংবা একে বিশেষ চোখ বলি, অথবা আরো এগিয়ে – দার্শনিক মানস, হ্যাঁ এটাই দেখা একটি ঘটনারও চেহারা পালটে দেয় বয়ানকালে। হাজার হাজার বছর আগের একটি গল্প, মিশরে, ওদের প্যাপিরাসে লিখিত পাওয়া গেছে, গহিন সাগরে জাহাজডুবির এক মাল্লা মরতে মরতে বেঁচে যায়, ফিরে আসে সংসারে। এ-গল্পের বয়ানে ঘটনার অধিক হয়ে ফুটে ওঠে – আশ্বাস! ফুটে ওঠে এই কথাটি যে – ঘোর বিপর্যয় থেকেও মানুষ হাল ছেড়ে না দেবার জেদেই অক্ষত বেরিয়ে আসতে পারে। তখন গল্পের ঘটনার চেয়ে সাহসী ওই খবরটাই মানুষের মনে বড় হয়ে ওঠে। এ-গল্পটি যে প্যাপিরাসে লিখে রাখবার দরকার বুঝেছিলো অনামা সেই লেখক বা তার সময়ের রাজনিযুক্ত লিপিকর, এতেই বোঝা যাবে – জীবনের ওই দর্শনটি শুধু সেই সময়েরই মানুষ নয়, পরের মানুষের জন্যেও বলে রাখবার ঘোর দরকারটি অনুভূত হয়েছিলো।
শুধু দার্শনিক মানস থেকে মানব-জীবনের বয়ান নয়, জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরবার জন্যেও মানুষ সেই আদিকাল থেকেই গল্প বানাতে বলতে শুরু করেছে। এ-গল্প সর্বাংশে বানানো হলেও ভিত্তিতে আছে দেখা-জীবন। আর বয়ানের সঙ্গেই যে বুনোনের কথা ওঠে – আসলে বিষয় আর আঙ্গিক – বলবার কথা আর কীভাবে বলা – সেই বুনোনটারও এক নতুন রকম দেখি – গ্রিসে ঈশপের গল্পে কি ভারতবর্ষে জাতকের কথামালায়। মানুষেরই গল্প, বলা হচ্ছে পশুপাখির শরীর-ছাঁদে। সেই শেয়াল, যে বলেছিলো আঙুরফল টক, ঈশপ দেখেছিলেন ব্যর্থ মানুষের বাক্চাতুরীর একশেষ, এটাই তো তাঁর বলবার কথা ছিলো।
কিংবা সেই যে নেকড়ে, ভেড়ার বাচ্চাকে খাদ্য-সাবাড় করতে চেয়েছিলো জল ঘোলা করবার অপরাধ দেখিয়ে, মৃত্যুমুখে শাবকের মিনতি – না মহারাজ, জল আমি ঘোলা করিনি, তখন সেই নেকড়ে যে বলেছিলো, তুই না করে থাকলে তোর বাপ করেছিলো, আর তৎক্ষণাৎ তার ঘাড় মটকেছিলো, সবলের যে একটা ছুতো চাই-ই চাই দুর্বলকে গ্রাস করবার জন্যে, এটা আসলে মানুষেরই গল্প।
গল্প তো নয় – লোকশিক্ষা! এই লোকশিক্ষাটাই মনে হয় গল্প বয়ানের মূল কারণ। লোকশিক্ষার মূল কথাটাই হচ্ছে সত্যের সাক্ষাতে মানুষকে নিয়ে যাওয়া। এখনো আমরা যে-গল্পগুলো বলেই যাচ্ছি লিখেই যাচ্ছি, সেসবও এক বিচারে লোকশিক্ষার লক্ষ্যেই। আমাদের ভাষায় বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ থেকে আজকের একজন কথাশিল্পী পর্যন্ত – সব গল্পই লোকশিক্ষার কারণে তার বুনোন বটে। মানুষ বাস্তবতাটিকে দেখুক জানুক চিনুক বুঝুক, তবেই গল্প বানানোর কি গল্প লেখার তাড়নাবোধ।
গল্প এক ধরনের সাংবাদিকতাই বটে – আমি বলি এ হচ্ছে সৃজনশীল সাংবাদিকতা। সাংবাদিকের কাছে কী আমরা আশা করি? – তথ্য! গল্পকারও তথ্যই জোগায় – জীবনের তথ্য। সাংবাদিকের সঙ্গে তার তফাৎটা এইখানে যে, সাংবাদিককে কল্পনা থেকে শতহাত দূরে থাকতে হয়, আর গল্পকারের ম্যাজিকটাই হচ্ছে কল্পনা-করণ। এই সুবাদে ইংরেজিভাষার প্রধান এক কথাশিল্পী গ্রাহাম গ্রিনের কথা মনে পড়ছে। সাংবাদিক আর কথাশিল্পীর কাজের পার্থক্যটা ধরিয়ে দিয়ে তিনি বলতেন – গল্প যারা লেখে তাদের কাজটি হচ্ছে জীবন-সত্য শনাক্ত করে তা প্রকাশ করা, কিন্তু সাংবাদিকেরা কী করে? গ্রিনের কথা – সাংবাদিক সত্যকে শনাক্ত করে বটে কিন্তু প্রকাশ করে না! অতএব গ্রাহাম গ্রিনের এই উচ্চারণ যে, সাংবাদিকেরা আসলে লেখে গল্প, আর গল্পকারেরা লেখে সংবাদ!
গল্পকারের এই গ্রিন কথিত ‘সংবাদ’ যে সমূহ বর্তমান পেরিয়ে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত সমর্থ ডানায় ধায়, ঈশপ বা জাতক থেকে আজকের অনেক লেখকেরই অনেক গল্পই তার প্রমাণ। যেমন তৎক্ষণাৎ যে মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি, এর গভীর বেদনাটি আজো কম্পমান আমাদের ভেতরে। আমাদের বর্তমান বাস্তবতা শতাব্দী পেরোনো ওই গল্প-কালের চেয়ে সর্বাংশে ভিন্ন হয়েও এর সম্ভবপরতাটি আজো আমাদের বোধের শেকড়ে গ্রাহ্য – গ্রাহ্য হতেই থাকবে যতদিন মানুষ ওই গল্পের সম্ভবপরতার বাইরে চলে না যাবে, আর, কখনোই যে যাবে না এটাই সত্য।
রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র থেকে আমরা তাঁর দেখা এক পোস্টমাস্টারের কথা জেনেছি বটে, কিন্তু বাস্তবের সে-পোস্টমাস্টার তাঁর গল্পের পোস্টমাস্টারের আদল-অতিরেকে অন্য মানুষ। বাস্তব মানুষের আশ্রয়ে কল্পিত সেই মানুষটি আমাদের প্রত্যেকেরই ভেতর-মানুষ। মানুষ যতদিন থাকবে রবীন্দ্র কল্পিত নির্মিত ওই পোস্টমাস্টারও ততদিন থাকবে গল্পের জগৎ পেরিয়ে আমাদের সমূহ জীবনে। থাকবে – বাস্তবেরও অধিক বাস্তব হয়ে।
কল্পনা! ধরা যাক যে-বালিকাটি একটি মিথ্যা কথা বলেছে যে সে ইশকুলে যাবে না কারণ তার পেট ব্যথা করছে, তাকে আদর করে আমরা বলতে পারি – না, অতটুকু বাচ্চা মিথ্যা কী বস্তু জানে না, ওটা আসলে কল্পনা করে বলেছে – অর্থাৎ কিনা বানিয়ে বলেছে, মনগড়া বয়ান একটা দিয়েছে, গল্পকারের কল্পনা কিন্তু সে জাতের নয়। বরং এটাই, কল্পনা অর্থাৎ উদ্ভাবন যে করেছে কথাশিল্পী, সেটি আগাগোড়া নিজের বানানো হলেও তার ভেতরের সম্ভবপরতাটি ষোলো আনায় ষোলো আনা। এরকম হয়নি বটে, কিন্তু হলে তা সত্যই হতো। হতো! কিংবা চিরন্তন অপেক্ষা তার হবার জন্যে।
সম্ভবপরতাই গল্পের আসল কথা। এই যে বইটির কি পত্রিকার পাতায় এতগুলো গল্প আমরা পড়ে উঠবো, কোনোটিই কি মনে হবে – যাহ্, এরকম হতেই পারে না? পড়তে পড়তেই আমরা প্রবেশ করতে থাকবো লেখকের কল্পনার জগতে, ক্রমে মুছে যাবে আমাদের চারদিকটা, গল্পের ওই জগৎ আর আবহ সর্বাংশে আমাদের জড়িয়ে ধরবে। গল্পের বয়ান ও বুনোন যত প্রতিভাদীপ্ত হবে ততই আমরা লীন হয়ে যাবো গল্পটিতে, আমাদের শরীর-মাংস ধরে উঠবে গল্পের শোণিত। এভাবেই একেকটা গল্প আমাদের গল্প হয়ে ওঠে।
পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পটির জমিদারবাবু হয়ে উঠি আমরা – স্ত্রী না হারিয়েও, রুগ্ণ স্ত্রীর পাশে বসে স্বাস্থ্যবতী দ্বিতীয় কোনো নারীর জন্যে উন্মুখ না হয়েও! এভাবেই আমাদের অভিজ্ঞতায় যা আসেনি তাও আমাদের অভিজ্ঞতায় এসে যায়। গল্প তখন আর গল্পের ঘটনায় থাকে না, ঘটনার আঘাতে জেগে ওঠা সত্যের শাঁসটাই বড় হয়ে ওঠে। ‘নিশীথে’র সত্যটা হচ্ছে অন্যায় জেনেও আমরা যখন অন্যায়টা করি তখন আমাদের ভেতরটাই শুধু আমাদের তিরস্কার করে না, দেয়ালঘড়ির মতো জড়বস্তুও আমাদের শাসায়, ঘড়ির কাঁটাও আমাদের দিকে বিচারকের তর্জনী তুলে ধরে।
প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে আমরা যখন লীন হই, তখন আমাদের ভেতরে সেই মানুষটির সত্য আমরা অনুভব করি যে মানুষ অমাবস্যায় চাঁদের আলোর স্বপ্ন যখন দেখে যেন স্বর্গীয় একটি øানই করে ওঠে সে। কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সেই বড় গল্পটি – এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না – যেখানে নববিবাহিত স্বামী তার স্ত্রীর প্রণয়-কাক্সক্ষায় বানিয়ে বানিয়ে পুরনো প্রেমিকাদের গল্প মিথ্যে করে বলে যাচ্ছে – বলছে ঈর্ষা জাগাতে, ঈর্ষার ভেতর দিয়ে স্ত্রীর ভালোবাসাটি পেতে। আমরা কেউই হয়তো এই কৌশলটির আশ্রয় নিইনি স্ত্রীর ভালোবাসা পেতে, কিন্তু যে-সত্যটি আমাদের মর্মে ঝড় তুলে যায় সেটি হচ্ছে এই – আমরা ভালোবাসা চাই।
গল্পের ওই ভেতর-সত্যটাই আসল, ওটি যে-লেখক সোনার টুকরোর মতো আমাদের কোলে এনে ফেলতে পারেন, তিনিই নমস্য। ব্যাপারটি কিন্তু এত সহজ নয়, এর পেছনে আছে বুনোনের ভাবনা, কেমন করে বললে তবে পাঠক পথভোলা হয়ে গল্পের ভেতরে অবলীলায় এসে পড়বে। আমরা যে লিখি, যত বিশদ করেই গল্পের মানুষ আর ভূগোল লিখি না কেন, সবটা লেখায় আসে না, আসা সম্ভবও নয়। যেটি করা যায় তা হচ্ছে সংকেতের পর সংকেত রচনা করা, আর আশা এই যে, সেই সংকেত গ্রহণ করে পাঠক মনের মধ্যে পুরোটা গড়ে নেবে। পাঠকের এই গড়ে নেওয়াটাও সৃজনশীলতা দাবি করে। পাঠককেও হয়ে উঠতে হয় সৃজনশীল।
সংকেত রচনার উপায় মাত্র দুটি – ভাষা আর গল্পটা কীভাবে বলা। একটা গল্প কতভাবেই না শুরু করা যায়। ধরা যাক ঈশপের সেই শেয়ালের গল্পটি। মাত্রই পাঁচ বাক্যে গল্পটা ফুরিয়ে যায়। বাগানে আঙুর ফলে আছে। বাগানের মালিক বাড়ি গেছে। একটি শেয়াল এসে আঙুর ফল দেখে লোভী হয়ে দাঁড়ালো। চেষ্টা করলো আঙুর পেড়ে খেতে কিন্তু পারলো না। তখন ফিরে যেতে যেতে বললো – আঙুর ফল টক। আমরা বাগানের আঙুর থেকে শুরু করতে পারি। আমরা শেয়ালের হাঁটতে হাঁটতে এসে আঙুর দেখে থমকে দাঁড়ানো থেকে প্রথম বাক্যটি রচনা করতে পারি। এমনকি আঙুর ফল টক – এই উচ্চারণ থেকেও গল্পটা শুরু করা যেতে পারে বইকি।
ফরমায়েশটি সরল মনে হলেও আসলে নয়। গল্প যিনি বলছেন তাঁর মনের ঝোঁকটাই বলে দেয় গল্প শুরু করা যাবে কোনখান থেকে। ওই মনের ঝোঁকটা হচ্ছে লেখকের বা গল্প বলিয়ের একান্ত নিজস্ব বলার জাদু, ছবিটাকে ফুটিয়ে তোলার নিজস্ব তুলির টান।
প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি লিখতে গিয়ে সেই যে আশ্চর্য একটি উপায় ধরে উঠেছিলেন – গল্পটা এখন ঘটছে না, অতীতেও ঘটেনি, ঘটছে বা ঘটবার অপেক্ষায় আছে ভবিষ্যতে, বাংলাভাষায় ওই যে প্রথম তিনি ভবিষ্যৎ ক্রিয়াপদের আশ্রয়ে ওই যে গল্পটি বলে গেলেন – এটি যেমন একটি সত্যের সমুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে তিনি করলেন, একই সঙ্গে গল্প নামে সৃজন মাধ্যমটির শাঁসমূলের চিরন্তন সম্ভবপরতাটিকেও তিনি এই উপায়ে দেখিয়ে গেলেন। আর ভাষা! ভাষাটিতে প্রেমেন্দ্র মিত্র আনলেন কবুতরের বুকের নরোম ছোঁয়া – যেন আমাদের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলা, এতটাই যে আমরা যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এই তন্দ্রালুতাও ওই গল্পের বুনোনের কাজ। বোনা! সে কি কেবল গল্পেরই? চাষি বীজ বোনে। লেখক আমাদের মনে সংকেত বুনে দেন।
চিত্রকর কত মাধ্যমেই না ছবি আঁকেন। কোনো ছবি জলরঙে, কোনো ছবি তেলরঙে, কোনোটি বা শুধু কালি-কলমে। লেখকেরও অবিকল তাই, একেক গল্পের জন্যে একেক ধরনের বাক্যগঠন শব্দচয়ন তাকে ভেবে নিতে হয়। গল্প আর ভাষা! সমরেশ বসু তাঁর স্বনির্বাচিত গল্প সংকলনে দুটোর দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন – তাঁর কথাটি শুনি।
‘ঘরে-বাইরে অনেক সময় অনেক ঘটনা আর চরিত্রের নানা সমাবেশ, বিদ্যুচ্চমকের মতো হঠাৎ এক-একটা গল্প ঝলকিয়ে ওঠে। পথে, পান্থশালায়, শুঁড়িখানায়, ট্রেনে, বাসে, এমনকি আকাশপথেও, এক একটা সামান্য বিষয় কল্পনার আশ্চর্য স্পর্শে হঠাৎ গল্প হয়ে বিদ্যুচ্চমকের মতো মস্তিষ্কে বিঁধে যায়। এটাকে কী বলে? উপাদান? বিষয়বস্তু? ভাষা সেই মুহূর্তে কোনো কাজই দেয় না। নারীর ডিম্বাণুকোষে পুরুষের শুক্রকীট প্রবেশের মতো, সেই মুহূর্তে মস্তিষ্ক কেবল ধারণ করে। অথবা জন্ম নেয়। একটা আশ্চর্য সুখের মতো হৃদয় তখন মথিত হয়। আলোড়িত হয়। এই পর্যন্তই। আর সেই বিদ্ধ হওয়ার মুহূর্তেই, ভাষা তার ছাঁচে ঢালাই হয়ে যায়।
‘মস্তিষ্কের বিদ্ধ ভ্রƒণের সঙ্গে, তার ভবিষ্যৎ অবয়ব বা কলেবর, যাকে আমি সহসা-বিদ্ধ সেই গল্পের বিষয়বস্তুটির ভাষা বলে মনে করি, যা দিয়ে বিষয়টি তার যথার্থরূপে ফুটে উঠছে, ধীরে ধীরে – ভাষা যার নাম, দীর্ঘকাল গর্ভধারণের মতোই যা একাধারে কষ্টকর, যন্ত্রণাদায়ক, অথচ অনিবার্য স্বাভাবিক এবং ভবিষ্যতের একটি দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভরা স্বপ্নের মূর্তি, সেই বাহনও সেই মুহূর্তেই জন্ম নেয়।’
সমরেশের এই কথার পর আর কথা থাকে না। সহসা-বিদ্ধ! গর্ভধারণ! আর, বিষয় শুধু নির্জল বিষয় হিসেবেই আসে না, আসে তার নিজস্ব ভাষা কিংবা ভাষাবোধ নিয়ে! কিন্তু সহসা-বিদ্ধই কি? চোখটি তাঁর খোলা ছিলো বলেই যা দেখছেন ও দেখেই যাচ্ছেন আর মনের মধ্যে তাঁর যে-একটি জীবনবোধ, সেই বোধির সঙ্গে খাপেখাপ যখনই মিলে যাচ্ছে দেখাটি, গল্পের কাঠামো হয়ে যাচ্ছে। আর, শুধু কি এই পথচলতি একটি দেখাই? আগে যে কত দেখেছেন, দুদ্দাড় করে সে-সকলও আছড়ে পড়ছে, সৃজনের তাড়ায় গ্রহণ বর্জন সম্পাদনের কাজ হুড়মুড় করে চলছে তক্ষুনি, কিংবা পরে, অনেক পরে; তারপর এক সময়ে লিখতে বসে যাওয়া।
আমরা যখন প্রথম লিখতে শুরু করি, তখন প্রায় সকলেই অগ্রজের ভাণ্ডার থেকে কালি কলমটা ধার করি। প্রচলের জালে আটকা পড়ি। অস্বস্তিকর নয় এই আটক, সুখেই আমরা অনুসরণ ও অনুকরণ করে লিখে চলি। এটা দোষের নয়, বরং শিক্ষানবিশীরই অনিবার্য একটি পর্যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভালো লাগে তো মানিকের মতোই গল্প লিখি। তারাশঙ্কর তো তারাশঙ্করই। রবীন্দ্রনাথের মতো কালের অত দূরের একজনার মতো লিখে হাত পাকাই না, কাছের কারো কাছেই প্রণত হই। কিন্তু আমাদের কেউ কেউ অচিরে বা কিছুকাল পরে মাথা ওঠাই ওই প্রণতি থেকে, নিজের মতো করে লিখতে চেষ্টা করি। কারো হয়, কারো হয় না। কেউ আমরা ছোট মানিক কি ছোট তারাশঙ্করই হয়ে থাকি একটা জীবন। আবার, শহীদুল জহিরের মতো নিজঝোঁকের লেখকও আছেন যিনি প্রায় শুরু থেকেই কারো মতো লেখেন না।
নিজস্ব এই ঝোঁকটা আসে ভেতর থেকে। সমরেশ-কথিত ওই যে বিদ্যুচ্চমক, ওই চমকের মতোই কেউ কেউ – খুবই কতিপয় কয়েকজন – আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তার নতুন নিয়ে। এই নতুন কি গল্পের বিষয় বা উপাদানের? তা নয়। জীবনের কোনো গল্পই নতুন নয়, বলার ধরনটাই নতুন। জীবনের যত গল্প, সবই পাওয়া যাবে দূর-অতীতের মহাকাব্যগুলোতে – রামায়ণে, মহাভারতে, ইলিয়াড অডিসি, গিলগামেশ কি শাহনামায় কি জাতক-ঈশপেই। ওই যে সংকেত রচনার কথা যে একটু আগে বলেছি, ওই সংকেত রচনার জাদুতেই হয় গল্প নতুন। মহাকাব্যের সাগর থেকে গল্প ছেঁচে সমসময়ের বোধিতে নতুন করে তাকে ঢেলে সাজানো তো হরহামেশাই হচ্ছে – এতটাই পারঙ্গমভাবে হচ্ছে, এমনকি লেখকের অজান্তেই যে, আমরা মূল গল্পটা একেবারেই ঠাহরে পাই না।
হ্যাঁ, আবারো বলি, নতুন কোনো গল্প হয় না, হয় নতুন ধরনে বলা পুরনো গল্পই। গল্পের ভেতরে যে সত্যটা, সেই সত্যের তো হেরফের হেলদোল নেই, সত্যটাকে পৌঁছে দেবার নতুন কথা-বুনোনেই গল্প হয় নতুন। বয়ান আর বুনোন, বিষয় আর বিষয়টি কীভাবে বলা, এই হচ্ছে আমার কাছে আসল। বুনোনটা নিজস্ব চাই, বয়ানের ঢংটাও একেবারে নিজেরই হতে হবে।
বাংলাদেশের এখনকার গল্প যখন পড়ি, তখন লক্ষ করি বয়ান আর বুনোনের দিকে খর নজর, এটা আমাকে সন্তোষ দেয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমার মনে হয়, নতুন হবার ঝোঁকটার সঙ্গে অনেকেরই আন্তরিক যোগটা খুব কম। মনে করছি অনুচ্ছেদরিক্ত বা দীর্ঘ একেকটি অনুচ্ছেদে টানা গদ্য লিখে গেলেই বুঝি নতুন হওয়া গেলো! গল্পের নাম দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর যার তিনিই বুঝি নতুন! কিংবা পরাবাস্তবতার ভাংচুর ছবিতেই বুঝি গল্প! অথবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প একটা লিখতেই হবে, তবে লেখো শোনাকথা আর ইতোমধ্যেই কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া গণহত্যা-ধর্ষণ-বীরত্বের রগরগে বয়ান, তবেই তো একালের গল্প! না, নয়। জীবনের ভেতর সত্যটাই গল্প, আর বিদ্যুচ্চমকের মতো ওই দেখে ওঠাতেই নিজস্ব বয়ানের শুরুটা।
আজকাল আরো এক ব্যাধিতে পেয়েছে আমাদের গল্পকারদের এবং বিশেষ করে ঔপন্যাসিকদের – ব্যাধিটার নাম দিতে চাই – প্রকল্প-বিলাস! একটা ক্ষেত্র কি পেশা কি সামাজিক বা রাষ্ট্রের কোনো বাস্তবতা বাছাই করে ঝাঁপিয়ে পড়ে অকুস্থলে যাওয়া, এনজিওকর্মীর মতো মাঠ ঘোরা, ফিরে এসে গল্প ফাঁদা। আমি মনে করি, এভাবেও গল্প হয় না। মানুষের ভেতরে যে-মানুষ, সেই মানুষের গল্প নিজের ভেতরেই আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। ভেতর-মানুষের গল্পটাই এখন বাংলাদেশের গল্পে আমি খুব কম পাই।
ওই ভেতর-মানুষের গল্পটাই এখন সিনেমা-টেলিভিশনের কালে আমার বেশি করে চাওয়া – এমন গল্প যা টেলিভিশনের নাটকে এঁটে ওঠা যাবে না, সিনেমার পর্দায় যার চিত্রায়ণ সম্ভব নয়। কিংবা আদৌ যদি সম্ভব হয় তবে সে হবে চলচ্চিত্রের বিস্ময়কর একটি উদাহরণ – যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলীযাত্রা নিয়ে গৌতম ঘোষের ছবিটির কথা। এবং তারপরেও বলতে হয়, কমলকুমারের উপন্যাসটি তবু পড়বো, পড়তেই হবে আমাদের, এর বয়ানের নিজস্বতা আর বুনোনের জাদুটির জন্যে, এর বিশেষ ভাষাটির জন্যে বা কেবল সেই জন্যেই।
একটা জীবন আমি গল্পের ভিয়েন চড়িয়ে এতদূর এসেছি। একটা সময়ে, সেই গত শতকের বাষট্টি-তেষট্টি সালেই আমার মনে এসেছিলো রক্তগোলাপ গল্পটি, পেছন ফিরে দেখি আজকাল যাকে জাদুবাস্তবতা বলা হয় সেই কলমটি তখন আমাকে দিয়ে যে ওই গল্পটি লিখিয়ে নিয়েছিলো, এটা আকস্মিক নয়, লাতিন অনুকরণ বা অনুসরণেও নয়, একেবারে আমাদের রূপকথা পরণকথার জলসেচে গল্পটির বয়ান আমি বাস্তব-আখরে করেছিলাম। ওই ছিলো আমার বুনোনের আদল।
আবার, কিছুদিন পরে, লিখতে লিখতে, নতুন গল্প ভাবতে ভাবতে আমার এমনও মনে হয়েছে – গল্প তো কেবল গল্প নয়, আসলে প্রবন্ধই, গল্প-প্রবন্ধ! প্রকৃষ্ট যে-বন্ধন তাকেই বলে প্রবন্ধ। অতএব, জীবনের কোনো সত্যের সঙ্গে ঘটনার যে-বন্ধন নির্ণয় করে গল্পটা লিখছি সে তো গল্প-প্রবন্ধই! আবার, প্রবন্ধ শব্দটির আরেক অর্থ আত্মগোপনকারী কৌশল। এই অর্থে প্রণম্য কৃত্তিবাস লিখেছেন – প্রবন্ধ করিয়া রাজা কহিতে লাগিলো! অতএব যে-গল্প লিখছি বা লিখতে যাচ্ছি তার ভেতরে আমি আমাকে আচ্ছাদিত রেখেই আর-মানুষের কথা বলছি। এই অর্থেই গল্প আমার গল্প-প্রবন্ধ। এইসব ভাবনা এখনো চলেই চলেছে। গল্প যে আসলে কী, সেটা বুঝে উঠতেই এখনো ঘাম ঝরাচ্ছি।
একটা সময় ছিলো যখন ছোটগল্প যাকে বলা হতো আসলে তা ছিলো সংক্ষিপ্ত উপন্যাস। এই অর্থে উপন্যাস যে, গল্পটি পড়ে ওঠার পর সব তৃষ্ণার ইতি ঘটে যায়। আর কিছু জানবার থাকে না গল্পের মানুষগুলো সম্পর্কে। পাবারও কিছু থাকে না। বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ তারাশঙ্কর এঁদের অনেক গল্পের ধারাটিই এরকমের। ক্রমে সেখান থেকে সরে এসে গল্প তার নিজের আকার পায়, ক্রমেই সে মুহূর্তের হয়ে ওঠে, বিদ্যুচ্চমকের মতোই এক ঝলসায় ছবি দেখার হয়ে ওঠে। আর, এখন, সেখান থেকেও সরে এসে, আমার চাওয়া – গল্প হোক দৈববাণীর মতো। যেন, গল্পের শরীরে এমন একটা উচ্চারণ পেলাম যা অনন্ত পর্যন্ত গড়িয়ে গড়িয়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতেই থাকলো, কিন্তু তারই নির্ঘোষে আমার জীবনের মানেটাই বদলে গেলো।
একটা গল্প পড়ে ওঠার পর জীবন আমার সত্যের সঙ্গে বন্ধিত হয়ে যাবে, তবেই তো তাকে বলবো গল্প। এমন গল্প আমি কালে-বিরলে পাই। প্রতিভার কলম আমি তরুণ অনেকের হাতেই দেখি, আর প্রতিদিনও স্মরণীয় লেখা রাশি রাশি হয় না এটাও আমি জানি। বৃক্ষের পর বৃক্ষ বুনে অরণ্য করতে পারলেই না একটি দুটি চন্দনের বৃক্ষ হতে পারে। আর ওই একটি দুটি চন্দনেই অমরার সুগন্ধে প্রবন্ধিত হতে পারে সত্যের সঙ্গে আমাদের যাপিত জীবন।