বাংলা কাব্য-রূপান্তর : অসীম সাহা
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় সর্গ
করিতে করিতে রতি যুবতীকে নিয়া।
রাধাকে মনে করে হয় ব্যাকুল হিয়া ॥
রাধার অনেক গুণ করিয়া স্মরণ।
অনুতাপ ক’রে কৃষ্ণ বলে সারাক্ষণ ॥
সংসারে আবদ্ধ তার জীবন ও প্রাণ।
রাধিকার রূপ-গুণ প্রকৃতির দান ॥
সকল গোপীর চেয়ে রাধিকা রূপসী।
অমৃতবচন মুখে যেন পূর্ণ শশি ॥
রাধিকাকে মনে রেখে সেই কৃষ্ণহরে।
সর্বদা তাহার রূপ-গুণ ধ্যান করে ॥
ব্রজের সুন্দরীগণ সব ত্যাগ করে।
বনে বনে রাধিকাকে শুধু খুঁজে মরে ॥
এভাবে করিলো কৃষ্ণ বনমাঝে ভাগ।
চেয়েও সে পায় না তো রাধা-অনুরাগ ॥
কামেতে কাতর হয়ে অনুতাপ করে।
বিষাদে ভরলো মন কালিন্দীর ’পরে।
নিজেকে দেখিয়া কৃষ্ণ ভিন্নরূপ ধরে ॥
বিলাপ করিয়া শুধু হরি হরি করে ॥
গীত
রাগ : গুজ্জরী ॥ তাল : যতি
হরি হরি নাম করে চলে গেলো রাধা।
রাগ করে অথবা সে মনে পেয়ে বাধা ॥
অপরাধ-ভয়ে আমি ফিরতে না পারি।
গোপী নিয়ে ব্যস্ত কৃষ্ণ মোরে গেলো ছাড়ি ॥
কী করিবে রাধিকা গো, কী বলিবে নিজে।
ধনে-জনে কী সে-সুখ, ঘরে শুরু কী যে ॥
ভাবি, সেই মুখ যার, ভুরু তার চাঁদ।
রক্তপদ্ম ’পরে যেন ভ্রমরের ফাঁদ ॥
রাধাকথা মনে ক’রে, করে রে রমণ।
মিথ্যে মিথ্যে বনে বনে করে সে ভ্রমণ ॥
জানি, রাধা ঈর্ষাতে হয় ভিন্ন মতি।
কোথা গেলে পাবো তারে করিতে প্রণতি ॥
চলে এসো, দেখো প্রিয়া, ধরা দাও মোরে।
পূর্বমতো আলিঙ্গনে প্রাণ দাও ভরে ॥
অন্যায় ক্ষমা করো, করবো না এমন।
দেখা দিয়ে প্রাণ রাখো, কামে জ্বলে মন ॥
জয়দেব বলে, হরি দূর করো দুখ্।
রাধা আর তোমা’ প্রতি হবে না বিমুখ ॥
এইভাবে বিরহেতে হইয়া ব্যাকুল।
বিলাপ করেন কৃষ্ণ, যায় জাতিকুল ॥
মনে মনে কামদেব হয়ে মূর্তিমান।
রাগ করে সকলকে মারে পঞ্চবাণ ॥
বিরহজ্বালায় সে তো সব যায় ভুলে।
সবিনয় কথা বলে কামকথা তুলে ॥
দেব নই, আমি হরি, তুমি হলে রাধা।
প্রিয়ার বিরহে আমি হয়ে যাই আধা ॥
হৃদয়টা নয় তার সাপেদের পতি।
পদ্মসম কণ্ঠ তার মধুর তা অতি ॥
নিতম্ব নয় তাহার, চন্দন-সরল।
রাগ করে কৃষ্ণ বলে, ধুমসী কেবল ॥
রমণীর সঙ্গে শোয় সে-শঙ্কর যোগী।
আমি যে একলা শুধু বিরহ-বিয়োগী ॥
ফুলের কাঁটায় বিদ্ধ করো না গো আর।
চন্দ্রিমা-কলায় যদি দাও কুলাধার ॥
জগজ্জয়ী মন্মথ বলে যদি তোমায়।
দুর্জনে বধ করে যশ পাওয়া যায় ॥
দৃষ্টিতিরে মন মোর বিদ্ধ করে রাধা।
এখনো তো উপশম হইলো না আধা ॥
রাধাকে স্মরণ করে কৃষ্ণ পুনর্বার।
যেন তার দুঃখ নিয়ে ভাবে একবার ॥
ধনুকেতে বিদ্ধ করে, পেয়ে কটা তির।
মোহ থেকে মর্মব্যথা হতে পারে ধীর ॥
যাবার উদ্যোগ নিয়ে চুল হয় ভার।
কুটিল ও কালোরূপ হয় যে তাহার ॥
শোনো, সুন্দরী রাধা, করছে বাজে কাজ।
ভালো হয়ে মন্দ করা মানে না সমাজ ॥
ফুলের মতন তার ঠোঁটে রঙ্গ ফোটে।
দেখিয়া আমার মনে আনন্দ যে ওঠে ॥
আদিঅন্ত সুন্দর স্তন দুটি তোমার।
কেন মোর মনে নেই সঠিক বিচার ॥
রাধিকার সাথে আছে মনের সংযোগ।
তবে কেন হয় শুধু বিরহ-বিয়োগ ॥
রাধা-অঙ্গ স্পর্শে পাই সুখের প্রকাশ।
দুই ঠোঁটে উষ্ণতার জিভের উচ্ছ্বাস ॥
সেই স্নিগ্ধচিহ্ন দেখে জুড়ায় দু’চোখ।
সে-মুখপদ্মগন্ধে নাক হয় অশোক ॥
অমৃতের মতো কথা শুনে সখি-কান।
পঞ্চেন্দ্রিয় অঙ্গযোগে পায় না বিধান ॥
যদি এই বিষক্রিয়া হতো তিরোহিত।
তা হলে এ-মন হতো রাধিকাতে প্রীত ॥
রাধিকাতে যদি হয় মনের মিলন।
বিরহের রোগ তবে বাড়ে কী কারণ ॥
তরুপল্লব যেন ধনুক মূর্তিমান।
কর্ণপাণি ছিলাখানি করে শুধু টান ॥
সহজ কটাক্ষে যেই মারে সেই বাণ ।
কামবাণের এভাবে করে সে সন্ধান ॥
যে অস্ত্রে জগৎজয় করিলো মদন।
সে-অস্ত্রধারীকে কি তা করে সে অর্পণ ॥
যখন জানলো সে, যুদ্ধের কেউ নাই।
তখন সে অস্ত্র রাখে রাধিকার ঠাঁই ॥
সেই কামবাণ রাধা করে সমর্পণ।
সেই হলো কামে নয়, পাথরে ভাঙন ॥
চতুর্থ সর্গ
যমুনার তীরে কৃষ্ণ হইয়া অস্থির।
মনোহর বেতবনে বসে আছে ধীর ॥
রাধিকার প্রেমভাবে হয় সে আকুল।
চঞ্চল মন নিয়ে ভাবে তাহার মূল ॥
এসময় রাধিকার সখি এলো সেথা
কৃষ্ণচন্দ্র বলে, রাধা-বিরহের কথা ॥
গীত
রাগ : কর্ণাট ॥ তাল : একতাল
কামজ্বরে কাতর হইয়া উষ্ণতায় স্মরণ করলো মিতা।
মাধবের বিরহেতে ব্যাকুল ললিতা ॥
নিন্দা করে চন্দ্রিমাকে মনে দুঃখ পেয়ে।
সর্পের বিষসম বাতাস আসে ধেয়ে ॥
কামজ্বরে জর্জরিত, অবিরত মনোমাঝে স্থায়ী তার বাস।
তোমাকে যে উপহার, তার উপরে পাখি এক পদ্মপলাশ ॥
অনেক বিলাস করে অভিলাষে শোকার্তকে তারা মনে করে।
আলিঙ্গন সুখের কারণ হয়, তাকে নিয়ে শোয় শয্যা’পরে ॥
বইছে মদন, দু’চোখ কোমল, পদ্মফুলের মতো সে-মুখ।
যেমন চাঁদ থেকে, রাজার দন্তাঘাতে গলে পড়ে তীব্র সুখ ॥
কুমিরের ’পরে শ্যামমূর্তি ধরে তোমাকে সে বলে, মৃগে মত্ত।
হাতে দিয়ে তির, মুকুলেতে নিবিড় প্রলাপ করে রাধা কত্তো॥
পদতলে তোর পড়িলো মাধব, নিরন্তর এই কথা বলে।
তোমার প্রতি তাই বিমুখ হয়ে যাই, মোর গাত্রদাহ চলে ॥
মনে ধ্যান করে তোমায় আগে ধরে বিলাপ করে শুধু হাসে।
বিষণ্ন সে-মুখে দূরে চলে দুখে, তারপর সব ব্যথানাশে ॥
হয়ে সবিনয় জয়দেব কয়, গিরিধর করো সব হিত।
করো অভিসার, পুরাও রাধার মনে দাও কৃষ্ণের পিরিত ॥
শোনো প্রভু কৃষ্ণচন্দ্র, বলি সব আগে।
এ-অবস্থা তার বিরহের অনুরাগে ॥
নিজ ঘর তার, শুধু খেলিবার স্থান।
যেন বা নারীর বনবাসের সমান ॥
ঘিরে আছে তাকে, প্রিয় সখিগণ যতো।
সেগুলো এখন যেন বা জালের মতো ॥
অন্তরেতে তাপ আর নিশ্বাসে বাতাস।
জ্বলন্ত আগুনেতে বাড়ায় দীর্ঘশ্বাস ॥
তোমার বিরহে এতো দুঃখ রাধিকার।
আপনাকে ভাবে সে যে হরিণী-আকার ॥
বাঘ যেন খুব বেশি করিয়া গর্জন।
কামবশে ঘৃণাভরে করে আচরণ ॥
এ-দুঃখ সাগরমাঝে নাই রে নিস্তার।
দয়াময় হয়ে কেন করো না বিচার ॥
মন থেকে করে না সে তবু কিছু ভাগ।
নিষ্ঠুর হইয়া সে তো করে অনুরাগ ॥
যার সাথে যার প্রেম সেই শুধু বোঝে।
রাধিকার নিষ্ঠুরতা যায় না রে তেজে ॥
গীত
রাগ : দেশাগ ॥ তাল : একতাল
হরি হে, তোমারই এ-বিরহিণী রাধা।
অতি অপরূপ দেহ – করিলে তা আধা ॥
স্তনযুগলে তাহার আছে মণিহার।
সে-কারণে মন তার গুরুতর ভার ॥
শরীর শীতল হয় চন্দনের মতো।
বিষ শুধু মনে ভয় আনে অবিরত ॥
উত্তপ্ত হৃদয়ে তার ওঠে যে নিশ্বাস।
নিরন্তর হয় সে যে কামেতে হতাশ ॥
চারদিকে দেখা যায় উজ্জ্বল সে-চোখ।
খণ্ড খণ্ড নীলপদ্ম চেয়ে দেখে লোক ॥
করতাল-মাঝে আর কপালের ভাঁজে।
নতুন চন্দ্রিমা যেন আকাশের মাঝে ॥
নতুন ফুলের কুঁড়ি জেগে ওঠে যেই।
আগুনের শিখা যেন দেখা দিলো সেই ॥
সারাদিন মণিমুখে হরি হরি বলে।
বিরহে মরণ হয় নিয়মের ছলে ॥
জয়দেব-মনে হয় দুঃখ খুব ভারি।
দুইজনে দুঃখ দূর করো গিরিধারী ॥
পুনরায় দূতি করে কৃষ্ণে নিবেদন।
রাধার-বিরহানলে অনেক বেদন ॥
রোমকূপ শিহরিত, করে সে চিৎকার।
কখনো দুখেতে সে যে কাঁপে বারবার ॥
কখনো চিন্তিত হয়ে করে সে বিলাপ।
কখনো কুঞ্চিত চোখ, হয় মনস্তাপ ॥
মাটিতে গড়িয়ে ফের উঠতে সে চায়।
ভুল হয় বারবার আর মূর্ছা যায় ॥
এমন অদ্ভুত জ্বরে সেই নিতম্বিনী।
বাঁচবে না, সারাক্ষণ মনে তার গ্লানি ॥
রাধিকার জন্যে তুমি প্রসন্নতা দাও।
শৃঙ্গাররস দিয়ে তুমি তাকে বাঁচাও ॥
সকল গোপীর মধ্যে তার মতো নাই।
অতএব রস নিয়ে বাঁচুক সে, চাই ॥
একমন হয়ে সে যে পাঠালো আমায়।
তুমি করিরাজ, বলো কে তাকে মারায় ॥
কামজ্বরে রাধিকা কাতর খুব হয়।
ভীষণ কঠিন রোগ সারবার নয় ॥
তুমি ছাড়া চলবে না, করো অঙ্গীকার।
তুমি তো সঠিক বৈদ্য, করো উপকার ॥
যেইভাবে রাধিকার দুঃখ দূরে যায়।
তুমি বের করো তবে তেমন উপায় ॥
কায়মনোবাক্যে তার তোমাতে বিশ্বাস।
খুব দ্রুত গিয়ে তার ঠোঁটে দাও শ্বাস ॥
তোমার দেহসঙ্গরস অমৃতভাবে।
তুমি ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ না খাবে ॥
এভাবে রাধার দুঃখ ঘুচাও না যদি।
জানে সে তোমার মন বজ্র নিরবধি ॥
কামশরে বিদ্ধ হয়ে রাঙা হয় রাধা।
তোমার বিরহে মনে পায় খুব বাধা ॥
যদি চিন্তা করে রাধা পদ্মের চন্দন।
তাতে আরো বেড়ে যায় তাহার ক্রন্দন ॥
কিন্তু আজকাল পাবে কৃষ্ণের সে মিল।
এই শান্তি নিয়ে তার মন হয় নীল ॥
তুমি ছাড়া ওগো নাথ গতি নেই আর।
অতি প্রিয়তম জেনো তুমি রাধিকার ॥
একান্তে থেকে করে তোমার সে ধ্যান।
অতি কৃশ দেহ নিয়ে হয় সে অজ্ঞান ॥
তুমি ছাড়া বিরহের গ্লানি তার যতো।
শোনো নন্দীপুত বলি, শোনো ইচ্ছেমতো ॥
একান্তে দু’চোখ বুজে দেখে সে নয়ন।
ভাগ্যদোষ দিয়ে কাঁদে শুধু সারাক্ষণ ॥
নিমেষ না দেখি তোমার বিরহ সহিতে।
পূর্বকথা মনে করে থাকে না সে হিতে ॥
এখন তোমার সাথে হয় না তো দেখা।
তবুও মুকুল গাছে ধরে থাকে একা ॥
ঝরে পড়ে না দেখে, রাধিকা নাহি সয়।
কেবল নিশ্বাস মাত্র আছে কৃষ্ণময় ॥ (চলবে)
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.