প্রথমপর্ব
গ্রন্থারম্ভ
বিরহিণী রাধিকার বিরহ-বর্ণনা।
সম্প্রতি ইচ্ছে হইলো করিতে রচনা ॥
বসন্তের রূপ দেখে বলে রাধা, ঠিক।
মাধবী ফুলের চেয়ে কোমল অধিক ॥
কামজ্বরে অতিশয় হইয়া আকুল।
কৃষ্ণের বিরহ-দুঃখে হয় সেব্যাকুল ॥
কৃষ্ণকে ভেবে ভেবে মনে লজ্জা পায়।
তার কাছে গিয়ে সে যে রতি করতে চায় ॥
একমন হয়ে রাধা সখী সঙ্গে যায়।
কৃষ্ণের সন্ধানে বনে ঘুরিয়া বেড়ায় ॥
রাধিকার কানে কানে বলে সহচরী।
কৃষ্ণের কথায় আছে সরস মাধুরী ॥
বসন্তে বর্ণনা করে বসন্তের রাগে।
ভণিতায় লেখে নাম, বনকাণ্ড ভাগে ॥
গীত
রাগ : বসন্ত ॥ তাল : যতি
এখন বসন্তে হরি ঘুরিয়া বেড়ায়।
যুবতীর সাথে হরি নাচে আর গায় ॥
লবঙ্গলতার ঘ্রাণ ভেসে আসে ঠান্ডা হাওয়ায়।
কুহু কুহু সুরে কোকিলের মতো মৌমাছিরা গায় ॥
ফুল মৌপানে মৌমাছির স্থান হয় বৃক্ষের ডাল।
যার স্বামী দূরে থাকে, তার স্মৃতি হয়ে ওঠে কাল ॥
মৃগনাভি ঘ্রাণে বৃক্ষতে ব্যাপ্ত হয় সৌরভ তার।
যুবকের মন কামের আঁচড়ে পুড়ে হয় ক্ষার ॥
সোনানির্মিত কামের ছত্র, যেন নাগেশ্বর ফুল।
তীক্ষèপাথরে তৈরি নাগেশ্বর, মন হয় ব্যাকুল ॥
দারুণ বিশ্ব দেখি জীবন্ত ফুল যেন সদা হাসে।
কেতকী নির্মল হয়ে বিরহী রথাকে যেন পাশে ॥
মাধবীর ঘ্রাণে মল্লিকার ফুল খুব মনকাড়া।
মুনির জন্যে স্বামী রাস্ত্রীকে খুন করে দিশাহারা ॥
মাধবীর আলিঙ্গনে খুশি হলো মুকুলিত আম।
অতি পবিত্র যমুনা জলে স্বচ্ছবৃন্দাবন-ধাম ॥
জয়দেব রচিত অদ্ভুত এ-গিরিধারী বিহার।
সেই সুন্দর বৃন্দাবনলীলা, হোক তার বিস্তার ॥
শীতল সুগন্ধ নিয়ে বইছে বাতাস।
বনরাজি ঘিরে আছে জীবন্ত প্রকাশ ॥
সামান্য বেগে বায়ু, কুঁড়ির তবু ভয়।
আঘাত আসতে পারে এমন সময় ॥
তীব্র চাপে বন রাজি হয়ে যায় হিম।
তার গন্ধে অবশেষে সেও তো অসীম ॥
পোড়ে মন বিরহীর, শেষ হয় আয়ু।
কেতকীর গন্ধে ধীরে বয়ে যায় বায়ু ॥
নরপতি কীসে-কাজ দিয়ে যে পাঠান।
পাঠালেন সেনাপতি প্রাণের সমান ॥
তাতে পায় সুখ আর মনেতে উচ্ছ্বাস।
বিরহীর দুঃখে প্রাণ হয় যে উদাস ॥
প্রথমসর্গ
মাধবী ফুলের গন্ধে কাড়ে মন, মল্লিকা ফুলের ঘ্রাণ আসে।
মুনির জন্য স্বামীগণ যদি নামে নিজস্ত্রীর ধ্বংস-বিনাশে ॥
বিকশিত মাধবীর আলিঙ্গনে, আনন্দে মুকুলিতআম।
বিশাল যমুনাজলে বৃন্দাবনধুয়ে দিলে হয় স্নিগ্ধধাম ॥
জয়দেব রচিত এ-অভিনব কাব্যগাথা, গিরিধারী বিহার।
সেই বৃন্দাবন লীলা, চারদিকে মঙ্গলের ঘটাক বিস্তার ॥
শীতল সুগন্ধ যুক্ত মৃদু মন্দ বয়ে যায় উদাস বাতাস।
বন ও বনানীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার অপূর্ব আভাস ॥
বাতাসের ঝাপটা লেগে কেঁপে ওঠে পরাগের সুস্নিগ্ধ মূল।
কিছু তো দলিত হয়, কিছু হয় বিকশিত মল্লিকার ফুল।
তাহার মিশ্র প্রাণে হাওয়া এসে দিয়ে যায়কি ছুটাশীতল।
সেই ঘ্রাণে বন-বনানী হয়ে ওঠে আনন্দে ভীষণ উচ্ছল ॥
উত্তপ্ত বিরহী মনে যতোটুকু আয়ু ছিলো, শেষ হয় আয়ু।
কেতকী ফুলের গন্ধে ঝিরিঝিরি বয়ে যায় মৃদুমন্দ বায়ু ॥
কিবা প্রয়োজন আছে, নরপতি মারবে কেন এ-পঞ্চবাণ।
পাঠাইলো সেনাপতি, যে তাহার একেবারে প্রাণের সমান ॥
তাহাতে অনেক সুখ পায়সে, বাড়েতারমনেরউৎসাহ।
বিরহীর প্রতি বাড়ে, অন্তরের যতো টান, পেয়েতীব্রদাহ ॥
আরসে-বসন্তে ফুটিল যে ফুল।
গান করে মৌমাছি হইয়া আকুল ॥
বিকশিত মধু গন্ধে লোভী ভ্রমরগণ।
ভুল করে দোলা দেয় আম্রকানন ॥
সে-কাননে উল্লসিত কোকিল সকল।
তুলছে মধুর সুর, করে কোলাহল ॥
সেই কোলাহলে ধরে ভয়ানক রোগ।
আক্রান্ত জনের হয় জীবন-বিয়োগ ॥
ধ্যান করে পরবাসী, ভাবে সংগোপনে।
প্রাণের সমান প্রিয়া পাবে কতোক্ষণে ॥
বিরহে ব্যাকুল হয়, মনে জাগে প্রিয়া।
বাণ বিদ্ধ দুঃখ নিয়ে চিন্তিত হিয়া ॥
রাধিকা আসবে জেনে হয় উল্লসিত।
এইদিন কোনোমতে পেরুবে নিশ্চিত ॥
রসালো বসন্তে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া বয়।
তাহাতে লোকের দেহ সুশীতল হয় ॥
দখিনা বাতাস উড়ে উত্তরে তেযায়।
তা দেখিয়া মনে জাগে ভিন্ন অভিপ্রায় ॥
চন্দন-কৌটাতে থাকে বিষধর সাপ।
বিষের জ্বালায় বাড়ে দুঃখ পরিতাপ ॥
সে-কারণে সব ছেড়ে গেলোসে-নির্দয়।
দুঃখিত হৃদয় নিয়ে দূর-হিমালয় ॥
লোকে বলে দুর্বিষহ সময় আমার।
আর বলে কথাগুলো দুঃখিত জনার ॥
শীতল রসালো ডালে দেখিয়া মুকুল।
কোকিল আনন্দে নাচে হইয়া ব্যাকুল ॥
কুহু কুহু সুরে ডাকে শুধু নিরন্তর।
শুনে ডাক বিরহীরে ধরে কামজ্বর ॥
শোনো সখী, এই হলো দুরন্ত বসন্ত।
বিরহীর জন্যে তার প্রাণ যে অনন্ত ॥
অশিক্ষিত নারী সঙ্গে লীলা করে হরি।
মনে ভাবে মিথ্যে সব রাধিকা সুন্দরী ॥
স্বচক্ষে দেখবে ভেবে দূতি ছুটে যায়।
রাধিকার কাছে এসে বলে সে উপায় ॥
দূতি বলে, ওগো রাধা, শোনো হে সুন্দরী।
এই দেখো মাধবের লীলার মঞ্জরী ॥
অনেক নারীর সাথে হাসিমুখ নিয়ে।
করে কতো প্রেম দেখো আালিঙ্গন দিয়ে।
মিথ্যে কি বলিতে পারি আমি দূতি হয়ে ॥
গীত
রাগ : রাম গিরিতাল : যতি
শোনো বিলাসিনী রাধা, শ্যামে তুমি দেখলে সেখানে গিয়ে।
বসন্ত সময়ে বিলাস করে সে মুগ্ধ যতো বন্ধু গণ নিয়ে ॥
পীত বাসপরে, গলে বনমালা, চাঁদ তার কালো অঙ্গে।
লীলায়মত্ত, গলায় মালিকা, হাসি ও রতিরস সঙ্গে ॥
পুষ্ট স্তন ধরে আলিঙ্গন ক’রে কৃষ্ণ গান শোনে আগে।
পেছনে গোপিকা নানা তান ধরে গান গায় পঞ্চরাগে ॥
কৃষ্ণমুখে চেয়ে কটাক্ষও করে, করে কামকেলি বৃদ্ধি।
কোন সে বঁধুয়া কৃষ্ণমুখ সুধা পান করে পায় সিদ্ধি ॥
গালছুঁয়ে রেখে কথা বলা-ছলে রাধা কানে মুখ দিয়া।
নিতম্বে তাহার, চুমু দেয় কৃষ্ণ, পুলকে কাঁপে যে হিয়া।
কেলি-কৌতূহলে যমুনার কূলে বেতেরসে-পঞ্চবনে।
প্রেমরসে মজে অন্তর্বাস ধরে টেনে নেয় নিজ সনে ॥
হাতের কাঁকন করে কনকন, করতালি দিতে দিতে।
রঙ্গে-ঢঙ্গে নাচে গোপীগণ সঙ্গে গোপীনাথে প্রশংসিতে।
কাউকে চুম্বন এবং আলিঙ্গন, কারো সাথে করে রতি।
হাসে যেই সখী, কারো দিকে চোখ, ছুটে যায় কারো প্রতি ॥
বলে জয়দেব, কী আর বলবো, যদি যাও তারে ঠাঁই।
সেই সে-যুবতী, তবুও সে বলে, কৃষ্ণের তো দোষ নাই ॥
কৃষ্ণরূপ দেখো তুমি মদনমোহন।
সংসারের সব লোকে দাওনি রঞ্জন ॥
নীলপদ্ম শতদল দেখিয়া শ্যামল।
মধুরসে-মূর্তিধরে, নাম সুকোমল ॥
সেইরূপ দেখে সুখী হয় সব লোক।
যারা দেখে নাই, তারা দেখে সে-আলোক ॥
রাধা এবং কৃষ্ণ যায়, দূরতর বঙ্গে।
দুজনেই খেলে তারা নানা রতিরঙ্গে ॥
রাধা-কৃষ্ণ শুধু করে এই রতি রঙ্গ।
কামকলায় বিহ্বল আনন্দিত অঙ্গ ॥
বসন্তের কালে মুগ্ধ হয়ে যায় হরি।
উল্লসিত মনে সে যে ঘোরে সুখ করি’ ॥
ওগো সখি, দেখি আমি অদ্ভুত বিহার।
দৃশ্যমান হয় তাতে তাদের শৃঙ্গার ॥
সুন্দর, স্তম্ভিত তারা মুগ্ধতায় বলে।
সাধারণে কেলি হয়, বোকা কহে ছলে ॥
দ্বিতীয় সর্গ
যে নারীর সঙ্গে নেই কৃষ্ণের পিরিত।
তাই দেখে রাধা তার হারায় সংবিত ॥
আপনার উৎকর্ষ নেই হরি স্থানে।
থাকাও উচিত নয় আর এই খানে ॥
আমাকে ছাড়িয়া করে অন্য সনে রতি।
এই ভেবে চলে যায় ক্রোধ নিয়ে অতি ॥
তা দেখিয়া ভ্রমরেরা গুনগুন গায়।
মাধবী লতার বনে সেতো স্থানপায় ॥
তাহাতে হইয়া লীন হতভাগীরাই।
সখিদের দিকে চেয়ে কিছু বলে তাই ॥
ইচ্ছা, চিন্তা, গুণকথা করিয়াস্মরণ।
উদ্বেগ, প্রলাপ, রোগমরণ-লক্ষণ ॥
পাগলিনী বেশ তার মরণ দশা হয়।
বিরহে রাধার প্রাণ আর নাহি রয় ॥
এই অবস্থাতে রাধা অত্যন্ত ব্যাকুল।
কৃষ্ণ-গুণগান করে সখিদের কুল ॥
গীত
রাগ : গুজ্জরীতাল : যতি
সখি ওগো, কৃষ্ণকে প্রায়ই মনে পড়ে।
কৃষ্ণ শুধু মোর সঙ্গে পরিহাস করে ॥
দুঠোঁটে ধরিয়া বাঁশি তোলে শুধু তান।
দু’চোখে কাজল, দুলে ভরে তার কান ॥
ময়ূর চন্দ্রিকা যেন চুলে শোভা পায়।
যেন ইন্দ্রধনু চিহ্ন মেঘের মাথায় ॥
হাজার সুন্দরী তাঁকে আলিঙ্গন করে।
হাত, পা, মুখের শোভায় আন্ধার সরে ॥
মোহিত করিতে গোপী করিয়া চুম্বন।
দুঠোঁটে দুঠোঁট রেখে স্মিত হয় মন।
মেঘে যেন চাঁদ ভাসে, কপালে চন্দন।
দয়াহীন চাপ দেয় ধরে দুই স্তন ॥
গালে তার মণিময় স্নিগ্ধ অলংকার।
গেরুয়া বসন পরে করে স্ত্রী-আচার ॥
কদম তলায় বসে কৃষ্ণ পায় ভয়।
অন্তরে নীরবে ঢেউ তরঙ্গিত হয় ॥
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.