গৃহবাসী সন্ন্যাসিনী

অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ

তখন শেষ বিকেল, আলোয় দিনান্তের রূপ। বদলে গেছে উঠোনের গাছের ছায়া। দূরে কোথাও গরু ডাকছে, টুংটাং শব্দে বেজে উঠছে গলার ছোট্ট ঘণ্টা। মেঠোপথে ফসলবোঝাই খামারের গাড়ি হেলতে-দুলতে চলেছে। নীল শার্ট গায়ে শাবল কাঁধে শ্রমিকরা চলেছে ক্লান্ত, ভারী পায়ে। মৃদু বাতাসে মাছির ঝাঁক নেচে বেড়াচ্ছে কখনো বা মানুষের মুখের ওপর, কখনো নিচে। নীরব নিশ্চল রাতের কাছে দিনের নতিস্বীকারের আগে সবকিছুতে যেন মৃদু কাঁপন উঠেছিল।

লুইজা এলিসের মধ্যেও এসেছিল প্রাত্যহিক মৃদু আলোড়ন। সারা বিকেলটা ও বসার ঘরে জানালার পাশে বসে শান্ত মনে সেলাই করছিল, এবার সুঁচটা নকশায় গেঁথে কাপড়টা যথারীতি ভাঁজ করে কাঁচি সুতো আর আঙুলঢাকাসহ বিশেষ ঝুড়িটাতে রাখল। মেয়েলি এই কাজের জিনিসগুলো কখনো যেখানে-সেখানে রেখেছে বলে মনে পড়ে না, এরা ওর দীর্ঘ কালের সঙ্গী – সেই কতকাল থেকে ব্যবহার করছে, যেন ওর অস্তিত্বেরই অংশ।

একটা সবুজ অ্যাপ্রোন কোমরে বেঁধে নিল লুইজা, মাথায় দিলো সবুজ ফিতে বাঁধা খড়ের টুপি, তারপর চায়ের সঙ্গে খাবার জন্য ছোট এক নীল রঙের চায়না বাটি হাতে ছোট্ট বীচিহীন আঙুর তুলতে বাগানে গেল। আঙুর তোলা শেষ করে পেছনের দরজার সিঁড়িতে বসে বোঁটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে সাবধানে অ্যাপ্রোনে রাখল, পরে মুরগির খোপে ছুড়ে দিলো। সিঁড়ির পাশের খামের ওপর বোঁটা পড়ে নেই তো? তীক্ষè নজরে দেখে নিল।

ধীর শান্ত চলাফেরা লুইজার, নিজের জন্য চা করতেই অনেক সময় লাগে ওর; কিন্তু এমন সুন্দর করে গোছায় মনে হয় যেন নিজেই নিজের অতিথি। ছোট্ট, চৌকোনো টেবিলটা রান্নাঘরের একেবারে মাঝখানে বসানো, মাড়  দিয়ে ইস্ত্রি করা টেবিলের কাপড়টার চারপাশ ঘিরে চকচক করছে ওরই নিজের হাতে সেলাই করা ফুলের নকশা। চায়ের ট্রেতে থাকে দামি, ভারী কাপড়ের নকশা-তোলা গোলাপি ন্যাপকিন, তার ওপর বসানো

চা-চামচভর্তি কাট-গ্লাসের লম্বা একটি পাত্র, রুপোর ছোট্ট কলসিতে ক্রিম, বোন চায়নার চিনির বাটি, আর একটিমাত্র গোলাপি রঙের পিরিচসহ চায়ের কাপ। লুইজা সবসময়ই বোন চায়নার বাসন ব্যবহার করত। ওর প্রতিবেশীরা কিন্তু করত না। এ নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে কানাকানিও করত। ওরা সাধারণ বাসনপত্র দিয়ে প্রাত্যহিক কাজ চালাত, বোন চায়নার বাসন তোলা থাকত বসার ঘরের আলমারিতে। অথচ লুইজা ওদের চেয়ে অন্যরকমভাবে বড় হয়েছিল তা নয় বা ওর আর্থিক অবস্থাও ওদের চেয়ে যে ভালো তাও নয়। তবু বোন চায়না ছাড়া ও অন্য কিছু ব্যবহার করত না। রাতে খাবে বলে নিয়েছিল একটি কাচের পাত্রভরা চিনি মাখানো আঙুর, একটি থালায় ছোট ছোট কিছু কেক, সঙ্গে একটা হালকা সাদা বিস্কুট, আর ছিল গোটা দুই নিপুণ হাতে কাটা লেটুস পাতা – অসাধারণ এই লেটুস পাতা ওর নিজেরই যত্নে বেড়ে উঠেছে, কারণ লেটুস ও খুব পছন্দ করে। খাবারটা একেবারে কম নয়, আলতো হাতে একটা একটা তুলে ও মন দিয়ে খেয়ে নিত এবং এতো দ্রুত শেষ হয়ে যেতো যে একটু বিস্ময়ই লাগত।

চা খাওয়া শেষ করে থালাভরা বেক করা ভুট্টার কেক নিয়ে পেছনের উঠোনে গিয়ে লুইজা ডাকত, ‘সিজার! সিজার! তখন শিকলের শব্দ তুলে অস্থির দৌড়ে সাদায়-হলুদে মেশানো কুকুরটা ওর ছোট্ট কুঁড়ের দরজায় এসে দাঁড়াত। কুঁড়েটার অর্ধেক লম্বা লম্বা ঘাস আর ফুলে ঢাকা। লুইজা ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে খাবারটা সামনে রাখে। তারপর ঘরে ফিরে চায়ের বাসন-কোসন ধুয়ে সযত্নে মুছে তোলে। গাঢ় হয়ে নামছিল অন্ধকার। খোলা জানালা দিয়ে আশ্চর্য তীক্ষè আর জোরালোভাবে ভেসে আসছিল ব্যাঙের মিলিত ডাক, আর মাঝে মাঝে সে-ডাক বিদীর্ণ করে আসছিল গেছো ব্যাঙের নিচু স্বরের গুঞ্জন। লুইজা ওর পাতলা সুতোর সবুজ চেকের অ্যাপ্রোনটা খুলে রাখল, ওর পরনে ছিল সাদায়-গোলাপি ছাপার একটি অনতিদীর্ঘ পোশাক। তারপর আলো জ্বালিয়ে আবার সেলাই নিয়ে বসল।

প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে জো ড্যাগেট এলো। হাঁটাপথে ওর পায়ের ভারী শব্দ পেয়ে লুইজা উঠে সাদা-গোলাপি ছাপার অ্যাপ্রোনটা খুলে রাখল, ওর পরনে ছিল নিচে ক্যামব্রিকের বর্ডার দেওয়া সাদা লিনেনের পোশাক, এটা ওর অতিথির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। তাছাড়া সেলাই নিয়ে বসার ক্যালিকো অ্যাপ্রোন ছাড়া এটা ও পরে না। সাদা-গোলাপি অ্যাপ্রোনটা দ্রুত হাতে গুছিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে রাখতেই জো ড্যাগেট এসে ঢুকল।

ঘরটা যেন জো-র উপস্থিতিতে ভরে গেল। দক্ষিণের জানালায় সবুজ খাঁচায় ঘুমন্ত ছোট্ট ক্যানারি ছটফটিয়ে জেগে উঠে হলুদ পাখা দুটো দিয়ে পাগলের মতো খাঁচার তারে বাড়ি মারতে লাগল। জো ড্যাগেট ঘরে ঢুকলেই পাখিটা ওরকম করে।

অচঞ্চল আন্তরিকতায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে লুইজা বলল, ‘শুভ সন্ধ্যা।’

‘শুভ সন্ধ্যা লুইজা।’ জোরালো কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিলো জো। লুইজা ওর জন্যে চেয়ার টেনে দিয়ে মুখোমুখি বসল, মাঝখানে রইল টেবিলটা। মেরুদণ্ড সোজা করে ভারী পা দুটো সামনে রেখে খুশি মেজাজেই ঘরের চারদিকটাতে চোখ বুলিয়ে নিল জো – একটু অস্বস্তি যে হচ্ছিল না তা নয়। লুইজাও সরু হাত দুটো ভাঁজ করে কোলের ওপর রেখে নমনীয়ভাবে সোজা হয়ে বসে রইল।

‘দিনটা ভালো ছিল’, জো মন্তব্য করল।

‘সত্যিই ভালো ছিল দিনটা’, মৃদুস্বরে সম্মতি জানাল লুইজা, পরে বলল, ‘তুমি কি কাজে গিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ, ওই দশ একরের জমিটাতে সারাদিন কাজ করেছি, বেশ কঠিন কাজ।’

‘তা তো বটেই।’

‘হ্যাঁ, রোদে বেশি কষ্ট হয়।’

‘তোমার মা ভালো আছেন তো আজ?’

‘হ্যাঁ, মা বেশ ভালো।’

‘লিলি ডায়ার আছে তো, না?’

ড্যাগেট লাল হলো, ধীরে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ, মায়ের কাছেই আছে।’ জো-র বয়স একেবারে কম নয়; কিন্তু ওর চেহারায় এক ধরনের ছেলেমি ভাব আছে। লুইজা ওর ছোট, চেহারাও ওর চেয়ে উজ্জ্বল আর মসৃণ; কিন্তু ভাব-ভঙ্গিতে লোকে ভাবে ও বয়সে বড়।

‘মনে হয় তোমার মায়ের জন্য ও অনেক করে’, লুইজা আবার বলল।

‘আমারও তাই ধারণা, ওকে ছাড়া মা কীভাবে চলবে জানি না’, বিব্রত উষ্ণতা নিয়ে কথাটা বলল ড্যাগেট।

‘ও সত্যিই খুব কাজের মেয়ে আর দেখতেও সুন্দর’, মন্তব্য করল লুইজা।

‘হ্যাঁ বেশ ভালো দেখতে।’

কথা বলতে বলতে টেবিলে রাখা বই নাড়াচাড়া করছিল ড্যাগেট। লাল রঙের চৌকোনো একটা অটোগ্রাফ অ্যালবাম ছিল আর ছিল লুইজার মায়ের ‘ইয়ং লেডিস গিফট বুক’ নামে একটি বই। জো একটির পর আরেকটি খুলে দেখে অ্যালবামটা গিফট বুকের ওপরে রাখল। লুইজা তাকিয়েছিল, একটু অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। শেষে উঠে গিয়ে অ্যালবামটাকে নিচে দিয়ে আগের অবস্থানে রাখল। বইগুলো ওভাবেই ছিল।

একটু অপ্রতিভ হাসি হেসে ড্যাগেট বলল, ‘এই ওপর-নিচ করে আলাদা কি হলো?’

লুইজা একটু বিরক্তির হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে জানাল, ‘আমি ওভাবেই রাখি।’

আবার হাসতে চেষ্টা করে জো বলল, ‘তুমি সবকিছুকে হার মানাবে।’ রক্তিম হলো ওর বড়সড় মুখটা।

আরো ঘণ্টাখানেক পর জো উঠে পড়ল; কিন্তু বেরোবার পথে কার্পেটে হোঁচট খেল এবং সামলে নিতে গিয়ে টেবিলে রাখা লুইজার সেলাই ঝুড়িটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। প্রথমে লুইজার দিকে তাকাল জো তারপর দেখল সুতো খুলতে খুলতে দৌড়ে চলছে সুতোর লাটিম এবং অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ওটা ধরার চেষ্টা করতে লুইজাই ওকে থামাল,  বলল, ‘ছেড়ে দাও, তুমি চলে গেলে আমি উঠিয়ে রাখব।’ একটু কঠিন স্বরেই কথাগুলো বলল লুইজা, হয়তো জো-র অস্থিরতায় সামান্য বিরক্ত হয়েছিল এবং ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টায় যেন বাধ্য হলো ওভাবে বলতে।

বেরিয়ে এসে জো ড্যাগেট সন্ধ্যার মিষ্টি বাতাস দীর্ঘশ্বাসে টেনে নিল। নিজেকে মনে হলো যেন সভ্য-ভব্য এক ভালুক, ঢুকে পড়েছিল সাজানো দোকানে।

পক্ষান্তরে লুইজারও নিজেকে সাজানো ঘরের মালিক বলেই মনে হচ্ছিল, তবে বহুক্ষণ সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকলেও দয়া ছিল মনে।

এবার প্রথমে ও গোলাপি এবং তার ওপর সবুজ অ্যাপ্রোনটা পরে নিয়ে ছড়িয়েপড়া সম্পদ সেলাই ঝুড়িটাতে তুলে রাখল, কার্পেট সোজা করল। তারপর মেঝেতে ল্যাম্পটা রেখে আঙুল দিলে কার্পেট  ঘষে দেখতে লাগল।

‘কত যে ধুলো এনেছে ঘরে, জানতাম।’ ব্রাশ আর ধুলো তোলার পাত্র এনে জো-র চলার পথটা ও ঝাড় দিলো।

এসব জানলে জো আরো বিভ্রান্ত হতো, ওর অস্থিরতাও বাড়ত; কিন্তু লুইজার প্রতি ওর আনুগত্য একটুও কমে যেত না। সপ্তাহে দুদিন ও লুইজা এলিসকে দেখতে আসে এবং প্রতিবারই লুইজার যত্নে সাজানো, মিষ্টি আমেজ মাখানো ঘরটাতে বসে মনে হতো লেসের বেষ্টনীর ভেতর বসে আছে। জো নড়াচড়া করতেও দ্বিধা করত – কী জানি যদি একটা পা বা হাত জবুথবু ভাবে পড়ে পরীর জাল ছিঁড়ে যায়! আর ওরকম কিছু ঘটে যায় কি না লুইজা যে তা সভয়ে লক্ষ করছে সে-ব্যাপারে সবসময়ই জো সচেতন থাকত।

কিন্তু তবু লেস ও লুইজা অনিবার্যভাবে জো-র সত্যিকার শ্রদ্ধা, ধৈর্য্য ও আনুগত্যের দাবিদার। পনেরো বছরের পূর্বরাগের পর এই তো এক মাসের মধ্যেই ওদের বিয়ে। যদিও চৌদ্দ বছর ওদের দেখা হয়নি আর চিঠিপত্র সেও কেবল মাঝে-মধ্যে আদান-প্রদান হয়েছে। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল জো এবং চৌদ্দ বছরে তার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছিল। প্রয়োজনে ও পঞ্চাশ বছরও থাকতে পারত; তারপর হয়তো লুইজাকে বিয়ে করার জন্য দুর্বল শরীরে, স্খলিত পায়ে ফিরে আসত, বা ফিরতই না।

কিন্তু চৌদ্দ বছরেই ওর যথেষ্ট উপার্জন হয়েছিল আর যে-মেয়েটি  ধৈর্য্যসহকারে, কোনো প্রশ্ন না করে এতোদিন ওর অপেক্ষায় ছিল, তাকে বিয়ে করবে বলেই ফিরে এসেছিল।

ওদের বাগদানের পরই লুইজাকে ও জানিয়ে দিলো যে, বিয়ের আগেই ওর কর্মক্ষমতা ও নিশ্চিত করে নিতে চায় এবং সেজন্য নতুন খামারগুলোতে ওকে কাজ করতে হবে। লুইজা শুনে ওর চিরাচরিত শান্ত মাধুর্যে সম্মতি দিলো। জো-র দীর্ঘ, অনিশ্চিত যাত্রার আগেও লুইজা ওর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারায়নি, অথচ জো তার কঠিন সিদ্ধান্তে উৎফুল্ল থাকলেও শেষ সময়ে সামান্য ভেঙে পড়েছিল, তখনো লুইজা কিন্তু একটু রক্তিম হয়েই ওকে চুমু দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছিল।

ভাঙা গলায় বেচারা জো বলেছিল, ‘বেশিদিন লাগবে না।’ কিন্তু চৌদ্দ বছর লাগল।

এই চৌদ্দ বছরে বহু কিছুই ঘটে গেল। লুইজা মা হারাল, ভাই হারাল এবং পৃথিবীতে একা হয়ে পড়ল। আর তখন লুইজার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ওদের দুজনেরই অগোচরে ঘটে গেল। ও এমন দৃঢ়তায়, এমন অবিচল ভঙ্গিতে জীবনের পথে চলতে শুরু করল যার পরিসমাপ্তি কেবল মৃত্যুতেই হতে পারত। শান্ত, নির্মল আকাশের নিচে হয়তো ওর পথ মসৃণই ছিল; কিন্তু সেইসঙ্গে আবার এতোটাই সংকীর্ণ ছিল যে, পাশাপাশি দুজনের চলার পথ সে নয়।

জো ফিরেছে শুনে (আসার আগে কিছু জানায়নি জো) লুইজার প্রথমে একটা বিভ্রান্তিকর অনুভূতি হলো, যদিও মনের এ-ভাবটা ও নিজের কাছেই স্বীকার করেনি আর জো এরকম কিছু স্বপ্নেও ভাবেনি। পনেরো বছর আগে থেকেই জো-কে ও ভালোবেসে আসছে, অন্তত নিজে তাই মনে করত। বিয়ে যে-জীবনের যুক্তিসংগত অধ্যয় এবং সম্ভাব্য আকাক্সক্ষা – এভাবেই ওর জানা ছিল। এ-বিষয়ে ওর মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি শান্ত লক্ষ্মী মেয়ের মতো ও শুনেছিল। ধীর বুদ্ধি, বিনয়ী ও পরিমিত স্বভাবের জন্য ওর মাকে সবাই বিশেষভাবে চিনত। জো ড্যাগেট এগিয়ে এলে লুইজা যখন তাকে গ্রহণ করল তখন ওর মা বিচক্ষণের মতো কিছু কথা ওকে বলেছিলেন – কখনো ইতস্তত করেননি। জো লুইজার প্রথম এবং একমাত্র প্রেমিক ছিল।

এই এতোগুলো বছর লুইজা জো-র প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে, অন্য কাউকে বিয়ে করার সম্ভাবনার স্বপ্নও ওর মনে কখনো আসেনি। ওর জীবনের অন্তত গত সাতটা বছর এক ধরনের আনন্দময় শান্তির মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে, প্রেমিকের অনুপস্থিতি ওকে কখনো অসুখী বা অধৈর্য্য করেনি, তবে তার ফিরে আসার প্রতীক্ষাই ও করেছে, যার অনিবার্য পরিণতি ছিল বিয়ে। কিন্তু সমস্ত বিষয়টাকে ও এমন এক ভবিষ্যতে ফেলে রেখেছিল যার অবস্থান প্রায় আরেক জীবনের সীমানায়।

জো আসবে, ওদের বিয়ে হবে – চৌদ্দটা বছর এই আশাই ও করেছে, অথচ জো-কে দেখে ও যেমন বিস্মিত হলো তেমনি ওর মনটাও থমকে গেল, যেন ওরকম কোনো চিন্তাই ও করেনি কোনোদিন।

জো-র হতবুদ্ধি অবস্থা এলো পরে। প্রথম দেখার মুগ্ধতা নিয়েই ও লুইজাকে দেখেছিল। সামান্যই পরিবর্তন হয়েছিল লুইজার – সুরুচিপূর্ণ ব্যবহার ও মাধুর্যের কিছুই ও হারায়নি, আর ঠিক আগের মতোই আকর্ষণীয় সেই চেহারা। ও নিজে লক্ষ্য অর্জন করেছিল, যথেষ্টই উপার্জন হয়েছিল এবং তখন থেকেই ওর কানে যেন জোরালো মিষ্টি সুরে প্রেমের বাঁশি বাজতে শুরু করেছিল। এ পর্যন্ত যেসব গান শুনে ও অভ্যস্ত তার সবটাতেই লুইজার নাম ভেসে উঠত এবং বহুদিন পর্যন্ত ওর আনুগত্য-উৎসারিত বিশ্বাস ছিল যে, ওই নামই ও শুনছিল; কিন্তু শেষে মনে হচ্ছিল, বাতাস একই গান শোনালেও তাতে নামটা যেন বদলে যাচ্ছিল। কিন্তু লুইজার কাছে ওই সুরেলা বাতাস কোনোদিনই গুঞ্জনের চাইতে বেশি ছিল না, তারপর তা স্তিমিত হতে হতে একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্যমনস্কভাবে একটু শুনেই আস্তে সরে গিয়ে বিয়ের পোশাকটা নিয়ে বসে কাজ শুরু করত।

নিজের বাড়িটা জো অত্যন্ত চমৎকারভাবে প্রায় সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছিল। ওই বাড়িতেই তো বিয়ের পর থাকবে ওরা, কারণ জো মাকে ছাড়তে পারবে না আর মাও তার পুরনো বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না। সুতরাং লুইজাকেই ছাড়তে হবে ওর বাড়ি। প্রতিদিন সকালে উঠে ‘নিজের হাতে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন’ করা জিনিসপত্র দেখতে দেখতে মনে হতো, প্রিয় বন্ধুদের ও যেন শেষবারের মতো দেখছে। কিছু সে সঙ্গে নিতে পারবে না তা নয়, কিন্তু পুরনো পরিবেশ হারিয়ে নতুন অবস্থানে ওদের তো আগের মতো দেখাবে না। তাছাড়া ওর একাকী জীবনের সুখময় কিছু দিক ছিল, যা একেবারেই ছেড়ে দিতে হবে। দৈনন্দিন প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে যে-সৌখিন কাজগুলো ও করত তার পরিবর্তে হয়তো কঠিন কোনো কাজের ভার ওর ওপর ন্যস্ত হবে। লোকজন আসবে, আতিথেয়তা করতে হবে, জো-র প্রয়োজন দেখতে হবে, বৃদ্ধ-দুর্বল মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে। ওদিকে একজনের বেশি সাহায্যকারী রাখা হিসেবি গ্রামীণ জীবনের নিয়মবহির্ভূত হবে। লুইজার একটা ফুল-ফলের নির্যাস তৈরি করার যন্ত্র ছিল এবং প্রতি গ্রীষ্মে ও মহানন্দে গোলাপ, পেপারমিন্ট ও স্পিয়ারমিন্টের নির্যাস তৈরি করত। একসময় ওর এ-যন্ত্র আর ব্যবহার হবে না। বেশকিছু নির্যাস ওর আছে আর কেবল শখের এ-কাজটা করার সময় পরে হবে না। জো-র মা এ-ধরনের কাজকে নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করেন আর ইতোমধ্যে সে-ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন। দু-টুকরো কাপড় একত্র করে সেলাই করা ওর একটি শখ – এ এক ধরনের আনন্দ ওর, ব্যবহারিক প্রয়োজনের বিষয় নয়। কতবার যে সেলাই খুলে নতুন করে সেলাই করেছে, তা ও কখনো স্বীকার করবে না। দীর্ঘ, মিষ্টি বিকেলে জানালার পাশে বসে মিহি কাপড়ে সূচিশিল্প ফুটিয়ে তোলা লুইজা যেন শান্তিরই প্রতীক। কিন্তু ভবিষ্যতে এরকম নির্বোধ বিলাসিতার সুযোগ বিশেষ মিলবে বলে মনে হয় না। এই বয়সেও উদ্ধত ও ধূর্ত জো-র মা এবং জো অকপট  পুরুষালি অভব্যতায় কুমারী জীবনের এইসব সৌন্দর্যসৃষ্টিতে হয় হাসবে, না হয় ভ্রু কোঁচকাবে।

শিল্পীর উৎসাহে লুইজা ওর একলার বাড়ি পরিচ্ছন্নভাবে গুছিয়ে রাখত। জানালার কাচ পালিশ করতে করতে ঝিকমিকিয়ে উঠলে ওর ভেতরটা জয়োল্লাসে কাঁপত। ওর আলমারির তাকে নিখুঁতভাবে ভাঁজ করা কাপড়গুলো ল্যাভেন্ডার আর মিষ্টি লবঙ্গের গন্ধে জড়ানো থাকত। পরে কি থাকবে এভাবে? তাও তো নিশ্চিত নয়। ওর চোখে ভেসে উঠত ঘরের চারদিকে নোংরাভাবে ছড়ানো স্থূল পুরুষালি জিনিসপত্র আর তা থেকেই কেবল ধুলো আর বিশৃঙ্খলা ওর সূক্ষ্ম ছন্দময়তার মধ্যে।

ওর আরেকটি চিন্তা ছিল সিজারকে নিয়ে। সিজার আসলেই সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছিল। জীবনের বড় অংশটাই নির্জন কুঁড়েতে কাটিয়ে দিলো, নিজের সমাজ থেকে যেমন বিচ্যুত, তেমন ওর প্রকৃতিগত নির্মল আনন্দ থেকেও। বড় হয়ে কোনোদিন সিজার উডচাকের গর্ত দেখেনি বা প্রতিবেশীর রান্নাঘরের দরজায় হাড়! না, সে-আনন্দ শিহরণ কোনোদিনই পায়নি। ছোট্টবেলায় একটা দোষ করে ফেলেছিল বলেই জীবনটা এভাবে কাটাতে হলো। শান্ত চেহারার নিরীহ কুকুরটার পক্ষে কতটা অনুতপ্ত বোধ করা সম্ভব কেউ জানে না; কিন্তু অনুতাপ ও প্রত্যক্ষ করছে এবং ওকে পুরোপুরিভাবে প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছিল। বয়স হয়ে গিয়েছিল, এখন আর জোরে তেমন ডাকতে বা ঘর্ঘর শব্দ করতে পারে না, মোটা হয়ে গিয়েছিল, ওর বয়সী, ঝাপসা চোখের চারপাশে চশমার মতো হলদেটে বৃত্ত তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখনো সেই প্রতিবেশী আছে যার হাতে সিজারের শক্ত সাদা দাঁতের চিহ্ন মোছেনি আর সে-কারণে চৌদ্দটা বছর সিজার শিকলে বাঁধা অবস্থায় একটি কুঁড়েতে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছিল। ক্রুদ্ধ, ব্যথাকাতর প্রতিবেশী, সিজারের মৃত্যু নয় নির্বাসন দাবি করেছিল। লুইজার ভাই তখন ছোট্ট কুঁড়েটা বানিয়ে ওকে শিকল দিয়ে রেখে ছিল। গলায় শিকল দিয়েই মাঝে মাঝে ওকে বার করা হতো, আসলেই বন্দির মতো জীবনটা কাটাল ও। গ্রামের কেবল বাচ্চারই নয়, বড়রাও কেউ কেউ ওকে ভয়ংকর কিছু ভাবত। মায়েরা সাবধান করে দিত ছেলেমেয়েদের, তবে ভয়াবহ বিষয়টিকে ওরা যাচাই করে দেখতে চাইত এবং লুকিয়ে লুইজার বাড়িতে গিয়ে পেছন থেকে পাশ থেকে কুকুরটাকে দেখতে চেষ্টা করত। হঠাৎ কখনো সিজার ভাঙা গলায় ডেকে উঠলে ওরা ভয় পেত। লুইজার উঠোনে বাঁধা সিজারের প্রতি পথচারীদের দৃষ্টি পড়লে তারা প্রশংসা নিয়েই দেখত; কিন্তু শিকল যথেষ্ট শক্ত কি না তাও জানতে চাইত। সিজার আসলেই খুব সাধারণ একটা কুকুর; কিন্তু সবসময় শিকলে বাঁধা অবস্থায় থাকার জন্য ওকে যথার্থভাবে কারো জানার সুযোগ হয়নি আর মন্তব্যও হতো সেই কারণে। শিকলে বাঁধা থাকতে থাকতে ওর চেহারায় স্বাভাবিকতা ছিল না, আর শরীরটাও বিশাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সহজ মেজাজের মানুষ জো ড্যাগেট বিচক্ষণও তো বটে, সিজারকে ও বুঝতে পারত।  লুইজার সতর্কবাণী সত্ত্বেও নির্ভয়ে কাছে গিয়ে পিঠ চাপড়ে দিত। জো ওকে ছেড়ে দিতেও চেষ্টা করেছিল; কিন্তু লুইজার জন্য পারত না। প্রায়ই বলত – ‘সিজারের মতো নিরীহ স্বভাবের কুকুর এ-তল্লাটে আর নেই, ওকে বেঁধে রাখা নিষ্ঠুরতা, আমি বার করে নিয়ে যাব একদিন।’

ওদের সম্পদ ও মঙ্গল-অমঙ্গল যেদিন একত্রিত হবে তখন একসময় জো ওকে নিয়ে যাবে – এ-ভয়টা লুইজার ছিল। মনে হতো, শান্ত, অরক্ষিত গ্রামে ক্ষিপ্ত হয়ে ঘুরছে সিজার আর নিরীহ বাচ্চাগুলোর রক্ত  ঝরছে। সিজার ওর ভাইয়ের কুকুর, তাই নিজে খুবই ভালোবাসত ওকে আর সিজারও খুব সুশীল ব্যবহার করত লুইজার সঙ্গে; কিন্তু তবু ওর হিংস্রতার কথা ভুলত না লুইজা। সবাইকে কাছে যেতে বারণ করত আর কখনো মাংস বা হাড় খেতে দিত না। ওর খাওয়া দেখতে দেখতে বিয়ের পরের কথা ভাবতে ভয়ই হতো লুইজার। কিন্তু নিজের নিভৃত জীবনের শান্তি ও স্বস্তির বদলে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা, সিজারের ক্ষিপ্ত মেজাজে বিচরণের আশংকা, ক্যানারির অস্থির ডানা ঝাপটানো – এর কোনো কিছুর জন্যই বিয়ে বা বিবাহিত জীবনকে প্রত্যাখ্যান করার কথা এক মুহূর্তের জন্যও লুইজার মনে স্থান পায়নি। জো ড্যাগেট ওকে ভালোবেসেছিল, এতো বছর ওর জন্যই কাজ করেছে, ওর প্রতি অবিশ্বস্ত হয়ে লুইজা কি ওর মন ভেঙে দিতে পারে! বিয়ের পোশাকটাতে ও অসাধারণ সুন্দর সূচিশিল্প ফুটিয়ে তোলে এবং সময় গড়িয়ে বিয়ের দিনের মাত্র এক সপ্তাহ অবশিষ্ট থাকে। সেদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যা, পরদিন বুধবার, এবং এক সপ্তাহ পরই বিয়ে।

সে-রাতে আকাশে পূর্ণচাঁদ। প্রায় ন’টার সময় লুইজা হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গেল। রাস্তার দু-ধারেই পাথরের পাঁচিলঘেরা ফসলি ক্ষেত। পাচিলঘেঁষে কিছুদূর অন্তর অন্তর বুনো চেরিফুলে ভরা ঝোপ আর বুড়ো আপেল গাছ। পাঁচিলের ওপর বসে লুইজা কেমন একটু বিষণ্ন চিন্তামগ্নতায় নিজের চারপাশটা দেখে নিল। ওর দুপাশে একত্রে গাঁথা দীর্ঘ ব্লুবেরি আর মিডো-সুইটের ঝোপ জড়ানো ছিল লতানো ব্ল্যাকবেরি আর হর্সব্রায়ারের সঙ্গে। মাঝখানে ওর বসার জায়গা সামান্যই ছিল। উলটোদিকে রাস্তার ওপাশেই একটি গাছের বিস্তীর্ণ শাখা-প্রশাখার ভেতর দিয়ে ঝলমল করছিল চাঁদ, আর সে-আলোয় রুপোর মতো ঝিকমিক করছিল পাতাগুলো। সারাটা রাস্তাজুড়ে ছিল টুকরো টুকরো রুপোলি আলো-ছায়ার খেলা। বাতাস ভরে ছিল অদ্ভুত এই মিষ্টি গন্ধে। অস্ফুটে লুইজা উচ্চারণ করল, ‘কি জানি বুনো আঙুরের গন্ধ নয় তো?’ কিছুক্ষণ বসার পর উঠে পড়বে ভাবছিল; কিন্তু পায়ের শব্দ আর চাপা স্বরের কথা শুনে স্থির হয়ে রইল। নির্জন জায়গা, ওর একটু ভয় করতে লাগল। ভাবল, ছায়ার আড়ালে চুপ করে থেকে তাদের ওকে পেরিয়ে চলে যেতে দেবে।

কিন্তু ওর কাছে আসামাত্র ওদের গলার স্বর, পায়ের শব্দ থেমে গেল। ওর মনে হলো, মালিকেরা এসে দেয়ালের ওপরই বসেছে। ভাবছিল, কীভাবে ওদের চোখের আড়ালে পালিয়ে যাবে আর তখনি নিস্তব্ধতা ভেঙে একটি গলার স্বর ওর কানে এলো। জো ড্যাগেটের গলা, স্থির হয়ে শুনতে লাগল ও।

কথার আগেই দীর্ঘশ্বাসটাও লুইজার পরিচিত। ‘তাহলে তুমি মন ঠিক করেই ফেলেছ, তাই না?’ জো বলল।

অন্য স্বরে উত্তর এলো, ‘হ্যাঁ, আমি পরশুদিন চলে যাব।’

লুইজা বুঝতে পারল লিলি ডায়ারের গলা। গলার স্বর লিলির প্রতিকৃতি হয়ে এলো ওর মনে – ও একটি দীর্ঘকায়, সুঠাম, সুন্দর মেয়েকে দেখতে পেল, চাঁদের আলোয় আরো সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে, তার শক্ত হলদেটে চুল বেণিতে আবদ্ধ। সুস্থির, গ্রামীণ শক্তিতে ভরপুর, পূর্ণ প্রস্ফুটিত, কর্তৃত্বসম্পন্ন মেয়েটি যেন এক রাজকন্যা। গ্রামের মানুষের কাছে প্রিয় ছিল লিলি ডায়ার, কারণ প্রশংসা পাওয়ার মতো গুণাবলি ছিল ওর, মনটা যেমন ভালো ছিল তেমন দেখতে, তাছাড়া বুদ্ধিমতিও ছিল। ওর প্রশংসা প্রায়ই লুইজার কানে আসত।

‘বেশ, আমার তো কিছু বলার নেই’, জো বলল।

‘কী আর বলার থাকবে তোমার’, লিলি ডায়ার উত্তর দিলো।

ভারী স্বরে জো পুনরাবৃত্তি করল, ‘না, একটি শব্দও বলার নেই।’

কিছুক্ষণ নীরব রইল দুজনেই, তারপর জো বলল, ‘এই গতকাল যা ঘটল তাতে আমার দুঃখ নেই – আমরা যে একে অন্যকে কীভাবে দেখি সেই গোপন কথাটাই জানা হয়ে গেল, মনে হয় আমাদের জানাই ছিল। আমি অবশ্য আর কিছুই তো করতে পারি নে। এই তো আগামী সপ্তাহেই বিয়ে। যে-মেয়েটি আমার জন্য চৌদ্দটা বছর অপেক্ষায় রয়েছে আমি তো তাকে ছেড়ে দিয়ে তার বুকটা ভেঙে দিতে পারিনে।’

‘মনে করো না তাকে ছেড়ে দিলে আমি তোমাকে বিয়ে করব’, হঠাৎ প্রচণ্ড জোর দিয়ে কথাটা বলল লিলি ডায়ার।

‘না, সে-সুযোগ হবে না, তবে ওরকম কিছু হলে তুমি যে আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে, তাও আমি বিশ্বাস করি না।’

‘দেখে নিও, আমি করব না। সম্মান সম্মানই, সত্য সত্যই। আমি কখনোই সেই সব পুরুষের কথা দ্বিতীয়বার ভাবতে যাব না যারা আমার জন্য বা অন্য মেয়ের জন্য নিজের সম্মান ও সত্যের মর্যাদা রাখে না। তুমি দেখে নিও জো ড্যাগেট।’

‘বেশ, তুমিও শিগগিরই দেখতে পাবে আমি তোমার বা অন্য কোনো মেয়ের জন্য এরকম কিছু করব না’, প্রত্যুত্তর দিলো জো। ওদের গলার স্বরে মনে হচ্ছিল ওরা যেন একে অপরের সঙ্গে রাগারাগি করছিল। লুইজা সাগ্রহে শুনছিল।

‘তুমি মনে করছ তোমাকে চলে যেতেই হবে – আমার দুঃখ এখানেই; জানিনে, তাই হয়তো সবচেয়ে ভালো’, জো বলল।

‘অবশ্যই, ওটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান, আমাদের দুজনেরই সাধারণ বুদ্ধি আছে বলেই আশা করছি।’

‘মনে হয় তোমার কথাই ঠিক’, বলেই জো-র গলার স্বর কোমল হয়ে উঠল, বলল, ‘আচ্ছা, লিলি বলো তো – আমি কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ভালোই চলতে পারব; কিন্তু যে-কথাটা আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে – তুমি খুব বেশি অস্থির হয়ে পড়বে না তো বিষয়টা নিয়ে?’

‘তুমি জানতে পারবে, একজন বিবাহিত পুরুষের জন্য আমি তেমন অস্থির হবো না।’

‘বেশ আশা করছি তুমি হবে না – আশা করি হবে না লিলি, ঈশ্বর জানেন আমি তাই চাই, আর – আমি আশা করি – শিগগিরই তুমি অন্য কারো দেখা পাও।’

‘না পাওয়ার কোনো কারণ দেখছি না’, হঠাৎই লিলির গলার স্বর বদলে গেল, পরিষ্কার মিষ্টি স্বরে এতোটাই জোরে কথা বলছিল যে রাস্তার ওপারেও শোনা যেতে পারত। বলল, ‘না, জো ড্যাগেট, যতদিন বেঁচে আছি বিয়ে আমি আর করব না; আমার বুদ্ধি আছে, নিজেকে আমি শেষ করেও ফেলব না, বোকার মতো কিছুই করব না, কিন্তু এ-ও জেনে রেখো, বিয়ে আমি আর কোনোদিনই করব না। তোমাকে আমি যেভাবে দেখেছি তা আর কারো জন্য হবে না – আমি ওই ধরনের মেয়ে নই।’

তখনই একটা বিস্ময়সূচক উক্তি এবং ঝোপের আড়াল থেকে মৃদু উত্তেজনাময় আলোড়নের শব্দ লুইজার কানে এলো। তারপর আবার লিলির কথা শোনা গেল, গলার স্বরে মনে হলো ও যেন জেগে উঠেছে। বলল, ‘এসব আর নয়, এই শেষ, বেশ অনেকটা সময় তো কাটল এখানে, এবার বাড়ি যাই।’

ওরা উঠে পড়ল, হতবুদ্ধি লুইজা ওখানে বসেই ওদের ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া পায়ের শব্দ শুনল। কিছুক্ষণ পর নিজেও উঠে বাড়ির দিকে রওনা হলো। পরদিন ঘরের কাজ যথারীতি সম্পন্ন করল, ওসব যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক ছিল, তবে বিয়ের পোশাকটা নিয়ে আর সূচিশিল্প ফোটাতে বসল না, জানালার পাশে বসল ঠিকই, কিন্তু গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে। সন্ধ্যাবেলা জো এলো। লুইজা এলিস কোনোদিনই জানত না যে ওর কূটনৈতিক বুদ্ধি আছে, মাত্র ওই সন্ধ্যায়ই ও জানল, যদিও ছোটখাটো নারীসুলভ অস্ত্রশস্ত্রের মতোই ওর কূটনীতিও ছিল নম্র ও ভদ্র। তখন পর্যন্ত যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে, ও সব ঠিকই শুনেছিল এবং ওর সত্য ও আনুগত্য থেকে সরে গেলে জো-কে চরম আঘাত দেওয়া হবে না। ও চাইছিল ওর ইচ্ছার কথা আগে প্রকাশ করার চাইতে জো নিজে কিছু বলুক এবং সে-কাজটা ও সার্থকভাবেই করল। শেষ পর্যন্ত ওরা একটা সমঝোতায় পৌঁছাল; কিন্তু কঠিন ছিল সমস্ত ব্যাপারটা। কারণ লুইজার মতো জো নিজেও সন্ত্রস্ত ছিল – কী জানি যদি নিজের প্রতারণার কথাটা প্রকাশ পেয়ে যায়।

লিলি ডায়ারের উল্লেখ করল না লুইজা। শুধু বলল, জো-র বিষয়ে অভিযোগ করার কোনো কারণই ঘটেনি, কেবল এতো দীর্ঘ সময় ও একরকমভাবে জীবনযাপন করে আসছে যে, পরিবর্তনের কথা ভাবতেই মনটা পিছিয়ে যাচ্ছে। ড্যাগেট বলল, ‘বেশ, আমি কিন্তু কখনোই পিছিয়ে যাইনি লুইজা, আমি সত্যি কথাই বলব, – তাই হয়তো ভালো হবে, আর তুমি যদি আরো সময় চাইতে তবে আমি আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তোমার জন্যই অপেক্ষা করব। আশা করি তুমিও তা জানো।’

‘তা আমি জানি’, লুইজা বলল।

সে-রাতে বহুদিন পর ওরা দুজন অনেক বেশি স্নেহ-কোমলভাবে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল। দরজায় ওরা যখন একে অপরের হাত ধরে দাঁড়াল তখন শেষবারের মতো বিষণ্ন স্মৃতির ঢেউ ভাসতে লাগল ওদের মনে।

‘বেশ যা হোক; এভাবে যে সব শেষ হয়ে যাবে আমরা কেউ তা ভাবিনি, তাই না লুইজা?’ জো বলল।

মাথা নাড়ল লুইজা, ওর শান্ত চেহারা সামান্য কেঁপে উঠল।

‘তোমার কখনো কোনো দরকারে আমাকে জানাবে। আমি তোমাকে কোনোদিনই ভুলব না লুইজা’, বলে ওকে চুমু দিয়ে পথে নেমে পড়ল জো।

সে-রাতে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ লুইজা একটু কাঁদল, তবে কেন তা ও জানত না। কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো ও যেন এক সম্রাজ্ঞী, যে-রাজ্য হারানোর আশংকায় ছিল তা দৃঢ়ভাবে ওর অধিকারে যুক্ত হলো।

এখন তবে সিজারের ছোট নগণ্য কুঁড়েটা ঘিরে থাকবে দীর্ঘ আগাছা আর ঘাস, ছাদে বরফ জমবে বছরের পর বছর; কিন্তু অরক্ষিত গ্রামে ক্ষিপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ ও কখনো পাবে না। এখন থেকে ছোট্ট ক্যানারি পাখি হলদেটে শরীরটা গোল করে রাতের পর রাত শান্তিতে ঘুমাতে পারবে, বুনো ভয়ে জেগে উঠে খাঁচার শিকে ডানা ঝাপটানোর দরকার হবে না। লুইজা এখন গোলাপের নির্যাস তৈরি করবে, পালিশ করবে ওর জিনিসপত্র, ধুলো ঝাড়বে যতক্ষণ না মনমতো হয়, তারপর ল্যাভেন্ডারে মুড়ে সরিয়ে রাখবে। সেদিন বিকেলে বেশ প্রশান্ত মনে ও সেলাই নিয়ে জানালার পাশে বসল। ঋজু, দীর্ঘকায়, প্রস্ফুটিত লিলি ডায়ার গত হয়ে গেছে, ওর মনে কোনো অস্থিরতা নেই। নিজের জন্মগত অধিকার ছেড়ে দিলে কোনোদিন জানা হতো না ওর হাঁড়ির খাবার কত সুস্বাদু – এই পরিতুষ্টি নিয়েই তো চলেছে ও এতোদিন; অচঞ্চল ও স্থির এই জীবনকেই ও জন্মগত অধিকার বলে জেনেছে। আগামী দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় যেন এক মালায় গাঁথা মুক্তো – প্রতিটি একই রকম মসৃণ, নিখুঁত ও নির্মল আর তখন ওর হৃদয়টা কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। বাইরে গ্রীষ্মের প্রদীপ্ত বিকেল, বাতাস মুখরিত ছিল মানুষ, পাখপাখালি আর মৌমাছির ব্যস্তসমস্ত ফসল তোলার শব্দে, হইচই ছিল, ছিল ফসল কাটার ধাতব অস্ত্রের শব্দ, পাখির মধুর ডাক আর মৌমাছির দীর্ঘ গুঞ্জন। আশ্রমবাসিনী নয়, তবু সন্ন্যাসিনীর মতোই প্রার্থনার ভঙ্গিতে লুইজা আগামী দিনের কথা ভাবতে লাগল।

লেখক পরিচিতি : মেরি এলেনর উইলকিনস ফ্রিম্যান

মেরি এলেনর ফ্রিম্যান ছোটদের জন্য গল্প, কবিতা রচনা করে সাহিত্যজীবন শুরু করেন। বড়দের জন্য লেখা তাঁর প্রথম গল্প , ‘A shadow famil,’ বস্টন খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপরই ‘Two old lovers’ গল্পটি Harper’s Bazaar নামক পত্রিকায়। তিনি বেশ কিছু উপন্যাসও লিখেছেন; কিন্তু তাঁর সবচেয়ে ভালো কাজ ছিল দুটি ভলিউমে প্রকাশিত ছোটগল্প।

তিন বছরের ব্যবধানে মা ও বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার জন্য মেরিকে লেখালেখির ওপর নির্ভর করতে হয় এবং সৌভাগ্যক্রমে তাঁর উপন্যাস ও বিশেষভাবে ছোটগল্প পাঠকরা সাদরে গ্রহণ করে আর এভাবেই তাঁর সাহিত্যজীবন সার্থক হয়ে ওঠে। ১৯২৬ সালে মেরি ফ্রিম্যান বিশেষ সম্মানজনক পদক লাভ করেন এবং একই বছরে তিনি দুজনের মধ্যে ছিলেন অন্যতম নারী, যিনি প্রথম ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড লেটারসে’র সদস্যপদ লাভ করেন।

মেরি ফ্রিম্যানের প্রধান চরিত্র পরিণত বয়সী নারী; তারা দৃঢ়ভাবে বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছে, জীবনকে চটুল মোহজালে আবদ্ধ রাখেনি আর এখানেই তাদের বিভাজন ঘটে গেছে সমকালীন নায়িকাদের সঙ্গে। মেরির নায়িকারা আত্মসম্মান অক্ষুণ্ন রেখে জীবনের প্রতিকূলতাকে সহনশীলভাবে মেনে নিয়েছে। প্রেমিকের জন্য চৌদ্দ বছর অপেক্ষমাণ লুইজা তার জীবনে এক ধরনের নির্লিপ্ত শান্তি খুঁজে পেয়েছিল, তারপর বিয়ে যখন অনিবার্য হলো তখন সেই পরিবর্তিত অবস্থাকেও সে এক ধরনের উচ্ছ্বাসহীন প্রশান্তিতে গ্রহণ করল। ফ্রিম্যানের অন্যান্য রচনার মতো এখানেও পুরুষের উপস্থিতিকে বিশৃঙ্খলা হিসেবেই দেখানো হয়েছে।

গল্পের শেষে লুইজা মহৎ মানসিকতায় গল্পের পরিসমাপ্তি টেনে আত্মসম্মান যেমন অক্ষুণ্ন রেখেছে, তেমনি নিজের স্বস্তির জীবনটা নিশ্চিতভাবে ফিরে এসেছে ওর কাছে। ১৮৫২ সালের ৩১ অক্টোবর ম্যাসাচুসেটসের র‌্যান্ডল্ফ শহরে মেরি ফ্রিম্যানের জন্ম। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৩০ সালের ১৩ মার্চ, নিউ জার্সির মেটুচেনে।