গেরিলা নির্মাতার গেরিলা

গোলাম শফিক

 বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে গেরিলাদের বলেছিলেন ‘গরিলা’। এ-বচন অহেতুক ছিল না। গরিলা একটি বলবান প্রাণী, যে-বল বা শক্তির প্রতীক ছিলেন আমাদের গেরিলারাও। তাছাড়া বিশেষ কায়দায় অনিয়মিত খন্ডযুদ্ধ বলতে যা বোঝায় তার শাব্দিক প্রকাশ ‘গেরিলা’, ‘গরিলা’ দুটোই। এ গেরিলারাই একাত্তরে গরিলার মতো জলে ভিজে, রোদে পুড়ে, পাহাড়ি মৃত্তিকায় সরীসৃপবৎ বুক ঘষে-ঘষে শত্রু হননে এগিয়ে গেছেন। তারা ঝোপঝাড়ে থেকে মনকাঁটাবিদ্ধ পাটাকে অতিকষ্টে টেনে, বেতঝোপের কাঁটায় নাক-কান ক্ষত করে অাঁচড়বিদ্ধ মুখটা নিয়ে, কচুরিপানা বা জলজ লতাগুল্ম মাথায় করে শত্রুর চোখ বাঁচিয়ে পগার-পুকুর-জলাশয় অতিক্রম করে, নদী সাঁতরে, সাপ-হিংস্র প্রাণী ও ততোধিক হিংস্র ‘দুশমনে’র ছোবল-থাবার ভয় অগ্রাহ্য করে দেশমাতৃকার টানে পথ চলেছেন। কখনো অনাহারে দীর্ঘ সময় কাটানোয় পেট লেগেছে পিঠে, তবু ট্রিগারে ধরা তর্জনীটা ছিল শক্ত-সামর্থ্য। এমনি এক মরণপণ লড়াইয়ে নয় মাস পর পৃথিবীর পঞ্চম শ্রেষ্ঠ সামরিক বাহিনী কাবু হয়ে পড়ে আমাদের ‘বিচ্ছু’ বাহিনীর কাছে।

দেশের এ-সূর্যসন্তানদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন আরেক গেরিলা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি নমস্য, প্রাতঃস্মরণীয়। শিল্পের পথেও তিনি একজন গেরিলা, অনেক শ্বাপদসংকুল পথ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়। তিনিই প্রথম চলচ্চিত্র (সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস ও নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে) নির্মাণ করে দেখালেন পাকবাহিনীরও একটি সুনির্দিষ্ট চরিত্র ছিল। অন্য কোনো চলচ্চিত্রে পাক সামরিক অফিসারদের কোনো ক্যারেক্টার ডেভেলপ করেনি। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক চলচ্চিত্রের এক অসম্পূর্ণতা যা ঘোচালেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। অবশ্য এটিই তাঁর প্রথম যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নয়, এর আগেএকাত্তরের যীশু নির্মাণ করে দর্শকদের চমকে দিয়েছিলেন। সে-চমক এখনো অব্যাহত। গেরিলা চলচ্চিত্রে তিনি বাঙালিদের প্রকৃত বীর হিসেবে চিত্রিত করেন।

বাঙালি বীরের জাতি। আলতাফ মাহমুদ, খোকন কমান্ডার থেকে শুরু করে সবাই হানাদারদের কাছে অকপটে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে দেয়, কাপুরুষের মতো গোপন করে না। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা আজাদ ধরা পড়লে কোনো কথা না বলে সশস্ত্র প্রতিপক্ষের মুখে থুথু ছুড়ে মারে। ওইদিকে দেখি বাঙালির আত্মসম্মানও আছে। কারণ নয়ন গোয়ালাকে ভারত চলে যেতে বললে সে যেতে অস্বীকার করে, ওইপারে গেলে সে হবে রিফিউজি। এ বীর বাঙালি হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে, দেশমাতৃকার জন্য যে-কোনো মুহূর্তে আত্মাহুতিতে প্রস্ত্তত ছিল। পাকবাহিনীর পার্টি থেকে বিলকিস (জয়া আহসান) উঠে গেলে মিসেস খানকে (শম্পা রেজা) সৈন্যরা থাকতে বলে। তাই বিলকিসের নিষ্ক্রমণকে নিষ্কণ্টক করার জন্য সে থেকে যায়। তার চোখে পানি টলমল করছে এজন্য যে, একটু পরই মুক্তিযোদ্ধাদের বোমার আঘাতে স্থাপনাটি উড়ে যাবে, তাতে সেও মারা পড়বে। এটি ছিল দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার প্রস্ত্ততি, যদিও এ-ধ্বংসযজ্ঞে শেষাবধি তার মৃত্যু হয় না।

এ-চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি অনেক। লালমনিরহাটগামী একটি ট্রেনে চড়ে বসে বিলকিস। অনেক কিছু সে প্রত্যক্ষ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর একজন লুঙ্গিপরা চেকার অদ্ভুত কায়দায় যাত্রীদের তল্লাশি করে। বিরক্তির সঙ্গে জানায়, দিনরাত ডিউটি করে তার মাথা ঠিক নেই। এক অতিসাধারণ অপ্রকৃতিস্থ নারীকে তারা অহেতুক সন্দেহ করে গাড়ি থেকে নামিয়ে ফেলে। সে চিৎকার করে বলে, মুই বাড়িত্ যাইয়ুম। এরই মধ্যে একবার ক্যানভাসারও আসে। যুদ্ধে জীবিকা বন্ধ থাকে না। বিলকিস একপর্যায়ে ট্রেনের দরজার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ায়, যেন সে মুক্তবাতাস নিচ্ছে। এ-মুক্তবাতাস কবে আসবে প্রতিটি বাঙালির জন্য – এটিই যেন জিজ্ঞাস্য ছিল। অতঃপর বিলকিস যায় জলেশ্বরী গ্রামে। সেখানে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয় সে। এই গ্রাম তাঁর স্মৃতির আকর। পথে আকস্মিকভাবে সাক্ষাৎ হয় মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের সঙ্গে। সে বিলকিসের ভাই খোকন কমান্ডারের দলের সদস্য। তার মনে পড়ে ভাইবোনের ছেলেবেলার স্মৃতি। তারা খেলছে, ভাইটি লাটিম ঘোরায় হাতে, যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিলকিসের মাথাটাই ঘুরছে। তার পথযাত্রার মধ্যে খোকন কমান্ডারের দল একটি ব্রিজ ভাঙে, তাতে ট্রেন আটকা পড়ে বিলকিসের যাত্রাও বিঘ্নিত হয়। সিরাজের সহায়তায় নদীনালা পার হয়ে শেষাবধি পৌঁছে জলেশ্বরী গ্রামে। একটি পরিত্যক্ত স্থানে আবদ্ধ অবস্থায় জীবন বাঁচাতে শুঁটকি মুখে দেয়, কোনোমতে বেঁচে থেকে একপর্যায়ে শুনতে পায়, মাইকে ভেসে আসছে – ‘কুখ্যাত ডাকাত ও ভারতের দালাল খোকন কমান্ডার’ ধরা পড়েছে। পরে আবার শুনতে পায়, পাকিস্তান রক্ষার স্বার্থে ‘আল্লাহর নামে’ তাকে কোরবানি দেওয়া হয়েছে। এ চলচ্চিত্রে দা-ছোরার ব্যাপক ব্যবহার প্রদর্শন করা হয়। পাকিস্তানিদের রাজনীতি ছিল ধর্মভিত্তিক, ধর্মের নামেই সৃজন করেছিল           রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী। রাজাকাররা ইসলামি জোশে পথেঘাটে মানুষকে জবাই করেছিল।

একজন প্রত্যক্ষ ও নিবেদিত মুক্তিযোদ্ধা এ-চলচ্চিত্র দেখে মন্তব্য করেছিলেন, আমরা এভাবে যুদ্ধ করিনি। তাহলে কীভাবে? সেটি হৃদয় দিয়ে বোঝার বিষয়। তারপর তার পিছু লাগি এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মূল সত্যটি উদ্ঘাটনের চেষ্টা করি। তিনি বোঝাতে চাইলেন এতে কৃত্রিমতা আছে এবং চলচ্চিত্রটি অতিরিক্ত প্রসাধনিক। তাকে বলি, যে-কোনো শিল্পসৃষ্টিই কৃত্রিম। খোলামেলা বাস্তবকে হুবহু শিল্পে প্রয়োগ সম্ভব নয়। তবে প্রসাধন অথবা গ্ল্যামার বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা জানতে চাই। বলা হয় যে, স্বামীকে নিরন্তর খুঁজে ফেরা বিলকিসকে এতোটা গ্ল্যামারাস করা ঠিক হয়নি। চরিত্রটি সে-সময়কার বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তাছাড়া সংলাপের অ্যাকসেন্ট বা স্বরভঙ্গি যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। আরেকজন বোদ্ধা দর্শকের সঙ্গে আলাপ করে বুঝি, বিলকিসকে অতিরিক্ত প্রতিবাদী মনে হয়েছিল, এমনকি স্বামীর বিরুদ্ধেও। স্বাধীনতার স্পৃহার চেয়েও তার মধ্যে যেন ফেমিনিজম প্রকট হয়ে উঠেছিল।

চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় পর্বে বালুচ সৈন্যের অভিনয়ে শতাব্দী ওয়াদুদ উতরে গেছেন, কিন্তু চরিত্রটি উতরায়নি। কারণ প্রথম পর্বে তিনি পাঞ্জাবি সৈন্যের ভূমিকা রূপায়ণ করেন। কেবল একটি গোঁফের অদল-বদলের মাধ্যমে শতাব্দী পাঞ্জাবি-বালুচের খোলস ভেদ করতে সমর্থ হননি। এতো বিগ বাজেটের চলচ্চিত্রে এক অভিনেতার দ্বৈত রূপায়ণ কেন প্রয়োজন হলো তা অজ্ঞাত। পাঞ্জাব ছাড়া অন্যান্য প্রদেশের অধিবাসীরা বাঙালির মতোই শোষিত এবং নিঃগৃহীত। সিন্ধি হিসেবে জুলফিকার আলি ভুট্টো বাঙালির জাত-শত্রুতে পরিণত হওয়া ছিল একটি দুর্ভাগ্য। মূলত তারই নেতিবাচক ভূমিকার কারণে অঘটনগুলো একটির পর একটি ঘটতে থাকে। তদুপরি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল পাঞ্জাব। কয়েক বছর আগে একজন বাঙালি কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় কাজে পাকিস্তান গমন করলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত (বর্তমান পাখতুনখোয়া) প্রদেশের এক নাগরিকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি বাঙালি ভাইটির হাত ধরে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন যে, তোমাদের সালাম, কারণ তোমরা পারো – আমরা পারি না। তোমাদের মতো পাঞ্জাবি নরপশুদের আমরা ঘৃণা করলেও এখন পর্যন্ত আলাদা হতে পারিনি – তোমরা পেরেছ।

পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। বেলুচিস্তানের নেতা আকবর বুগতির রক্তের দাগ এখনো শুকিয়ে যায়নি। এ রক্তবীজ থেকে একদিন জন্ম নেবেন শত-সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ভেতরে ভেতরে এ প্রদেশের অধিবাসীরা কেবলই ফুঁসে উঠছে। প্রদেশটির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টির সভাপতি সরদার আখতার মেঙ্গাল বলেন, তাদের ৬ দফার সঙ্গে শেখ মুজিবের ৬ দফার তফাৎ নেই। তাদের দাবি মানা না হলে বালুচরা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবেন না। জাতীয়তাবাদী এ বালুচ নেতা ২৭ সেপ্টেম্বর (২০১২) প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে চলা শুনানিতে এ ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এ নেতার কথামতো বেলুচিস্তান একদিন সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়ে গেলে গেরিলা চলচ্চিত্রের এ-অংশটি কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে?

একথা ঠিক যে, অবস্থানগত দূরত্বের কারণে একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানকে সহজে কাবু করতে সমর্থ হয়েছিল। আর এ অবস্থানগত কারণেই সিন্ধি, পস্ত্তন, কাশ্মিরি, বালুচদের সঙ্গে পাঞ্জাবিদের একাত্মতাও গড়ে ওঠে, দূরত্ব সৃষ্টি হয় বাঙালিদের সঙ্গে। কিন্তু মনের কথাটি কী ছিল? পাঞ্জাবি ছাড়া অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করেছে। বালুচরাও তা-ই। গেরিলার বালুচ সামরিক অফিসার অত্যন্ত কামুক। বারবার সে বিলকিসের চুলের ঘ্রাণ নেয়। ‘ভিলেজ গার্ল’ ও হিন্দু মেয়েদের প্রতি তার দুর্বলতা অসীম – এ-কথা সে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে। শ্রান্ত-ক্লান্ত বিলকিসকে ভোগ করার মানসে সে তাকে স্নান সেরে সাফ-সুতরো হয়ে আসার আদেশ দেয়। কারণ সে বলে, আই কান্ট স্মেল ইওর রটেন্ট পুশি। এর চেয়ে কামুক পৃথিবীতে আর কে? কিন্তু সে পাঞ্জাবি না হয়ে হয় বালুচ। তবে এ-মন্তব্যে কোনো সরলীকরণ করা হচ্ছে না।

চলচ্চিত্রটিতে ইনফরমার মিসেস খানের ভূমিকায় রূপায়ণকারীর চরিত্রটি মূর্ত হয়নি। একটি অস্পষ্টতা রয়েই গেছে, যদিও শম্পা রেজার অভিনয় ছিল অনবদ্য। ক্যামেরার কাজ অত্যন্ত ভালো। ধরা হয়েছে বিশাল ক্যানভাস। পুরো ক্যামেরার কাজ এ-চলচ্চিত্রে যে চলচ্চিত্র-ভাষা তৈরি করেছে তা আমাদের একটি মহৎ চলচ্চিত্রের সিংহদুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। অনেকদিন পর এ-ভাষাটি আমরা খুঁজে পেলাম। তবে ট্রেনের দীর্ঘ দৃশ্যে হঠাৎ করে কাহিনির ভয়াবহতা হারায়। কোনো টেনশন অব্যাহত রাখে না। তাছাড়া ট্রেনের রং যুদ্ধকালীন ট্রেনের রঙের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

অতিরিক্ত অর্থ তৈরি না করলেও সংগীত ও আবহের প্রয়োগ যথাযথ ছিল, যেটি আমাদের চলচ্চিত্রে এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এদেশের চলচ্চিত্রে একসময় সংগীতের আয়োজন-প্রস্ত্ততি ভালোই ছিল। অর্কেস্ট্রার প্রয়োগ মন্দ নয়। একটি উদাহরণ : আমজাদ হোসেনের জন্ম থেকে জ্বলছি চলচ্চিত্রটি দেখলে বোঝা যায় অনেকগুলো ভায়োলিন একসঙ্গে বেজে উঠছে, যদিও সংগীতকে পূর্ণতাদানের জন্য চেলোর ব্যবহার ছিল না।

গেরিলার আরেকটি উটকো বিষয় – চলচ্চিত্রটিতে আগুনের অ্যানিমেশন চোখে লেগেছে। রাতের দৃশ্যগুলো অতিরিক্ত উজ্জ্বল মনে হয়েছে। আলো-অাঁধারির খেলাটি অতোটা পরিষ্কার হয়নি। সিনেমাটোগ্রাফির ক্ষেত্রে আলোর পরিস্ফুটন উত্তম হলেও আলো কোনো চরিত্র হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

যে-কোনো শিল্প-সৃজনের ক্ষেত্রে ইনকনসিসটেন্সি বা ঘটনার পারম্পর্যহীনতাও একটি স্টাইল হতে পারে। তবে একটি যুক্তি থাকতেই হয়। গেরিলা চলচ্চিত্রটি কিছু র‌্যানডম ঘটনাকে জোর করে ধারাবাহিকতা দেওয়ার প্রচেষ্টায় ভাস্বর। ফলে এটি ক্লাসিক্যাল ন্যারেটিভ হয়নি, আবার এক্সপেরিমেন্টাল ন্যারেটিভ হিসেবেও দাঁড়াতে পারেনি। ইনফরমার মিসেস খান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যার হাত কেটে ফেলে জল্লাদরা, এ দুটো চরিত্র মূল গল্পের সঙ্গে মেলে না। অথচ অধ্যাপকের চরিত্রে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় কী দুর্দান্ত অভিনয়ই না করলেন।

এসব দুর্বলতাকে এড়ানো সম্ভব হলে দর্শকের ওপর চলচ্চিত্রটির প্রভাব আরো সুদূরপ্রসারী ও মনোগ্রাহী হতে পারত; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্ষেত্রেও আরো প্রভাববিস্তারী হতো।

চলচ্চিত্রটি সরকারি অনুদানের হলেও হয়তো মোট ব্যয় অনুদান অর্থের দশ-এগারো গুণ অতিক্রম করে যায়। নাসির উদ্দীন ইউসুফ (তদীয় কন্যা এশা ইউসুফ) ও ইমপ্রেস টেলিফিল্মের মতো ঋজু মেরুদন্ডী নির্মাতা বিধায় এখনো খাড়া আছেন। এটি আসলে তাঁদের একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। এ-চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তাঁরা শিল্প-সৃজনের চূড়াটি স্পর্শ করতে চেয়েছেন।

চলচ্চিত্রটির কিছু অসংগতি নির্দেশ করা হলো এ জন্য যে, এটিই তাঁর শেষ চলচ্চিত্র নয়। ভবিষ্যতে তিনি আরো চলচ্চিত্র নির্মাণ করে অতীতের সকল শিল্প-নির্মাণকে ম্লান করে দেবেন প্রত্যাশা করি। একটি চলচ্চিত্রে যেমন দেখার আছে ক্যামেরার ক্যারিশমা, উত্তম অভিনয়, শিল্পোত্তীর্ণ নির্মাণশৈলী, মন্তাজীয় উৎকর্ষ – তেমনি সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও পারম্পর্যের মাধ্যমে তাক লাগিয়ে দেওয়ার সুযোগটিও নিহিত থাকে। দুর্বলতা স্বীকার করে নিলেও একটি মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র সংশোধনের সুযোগ একেবারেই নেই। সবাই স্যাম বেনেগাল নন, যিনি অতৃপ্ত হৃদয়ে সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারেন : আমি নেতাজির জীবনভিত্তিক বোস, দ্য ফরগোটেন হিরো চলচ্চিত্রটি আবার নির্মাণ করব।

Published :