মনজুরুল হক
কমছে জাপানের জনসংখ্যা। নতুন খবর এটা মোটেও নয়। জাপানের এক সময়ের বর্ধিষ্ণু বিভিন্ন জনপদকে এখন ক্রমশ হালকা হয়ে আসা জনবসতির কারণে দেখা দেওয়া নানারকম সমস্যা সামাল দেওয়ার উপায় নিয়ে রীতিমতো মাথা ঘামাতে হচ্ছে। সমস্যার চটজলদি সমাধান অবশ্য দেশের শক্ত করে সাঁটা দুয়ার জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ হয়ে পড়া এশিয়ার অন্য কিছু দেশের জন্য খুলে দেওয়ার মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এ-কথা যে জাপানের নীতিনির্ধারকদের জানা নেই তা অবশ্য নয়। সেই পথে অগ্রসর হলে নতুন নানারকম সমস্যাও যে এর মধ্য দিয়ে দেখা দিতে পারে, সে-বিষয়টি সর্বদা তাদের মনে রাখতে হওয়ায় সহজ সেই রাস্তায় পা বাড়ানোর মতো সৎসাহস তারা দেখিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে হ্রাস পাওয়ার সমাধান খুঁজে নিতে বিকল্প নানারকম পথের সন্ধানে তাদের থাকতে হচ্ছে।
জাপানের জনসংখ্যার এই দ্রুত নিম্নমুখী পথে ধাবমান গতির খোঁজ স্বল্পকালীন সময়ের জন্য টোকিও, ওসাকা কিংবা দেশের অন্য নগরকেন্দ্রগুলো ভ্রমণে আসা পর্যটকদের চোখে না পড়ারই কথা। উলটোভাবে বরং জনসংখ্যার চাপের ভ্রান্ত দিকগুলোই তাদের চোখে বেশি করে ধরা দিতে পারে। বিশেষ করে টোকিওর ব্যস্ত নগরকেন্দ্র শিবুইয়ার পথচারী পারাপারের ট্রাফিক-বাতির সামনে দাঁড়িয়ে যখন তারা অবাক হয়ে দেখবেন কয়েক মিনিট অন্তর সবুজ বাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পদচারণায় রাস্তা পার হচ্ছেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ, তখন হয়তো অবাক হয়ে তারা ভাববেন, ‘কোথা থেকে আসছে মানুষের এই অফুরান স্রোত?’ বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখা জাপানের আরো অনেক কিছুর মতো এও হচ্ছে এক মরীচিকা, দেশের ভ্রান্ত এক ছবিই কেবল ক্ষণিকের ভ্রমণে আসা বিদেশি পর্যটকের সামনে যা তুলে ধরছে। জাপানের জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা সমস্যার আঁচ পেতে হলে যেতে হবে দেশের দূরবর্তী বিভিন্ন পল্লি জনপদে, নাগরিক জীবনের হৃদ্কম্পন যেখানে এখন সহজে ধরা পড়ার মতো বিপদ সংকেতের আঁচ দিচ্ছে।
এই গ্রীষ্মে আমার সুযোগ হয়েছিল ঠিক সেরকম এক জনপদে পদচারণার। টোকিওর প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত আকিতা জেলা হচ্ছে শীতকালজুড়ে সবচেয়ে বেশি তুষারপাত হওয়া অঞ্চলগুলোর একটি। ফলে জেলার কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোতে নাগরিক জীবন সহজ, আরামপ্রদ জীবন একেবারেই নয়। এ-কারণেই জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতার সঙ্গে উন্নত নাগরিক জীবনের খোঁজে তরুণ প্রজন্মের দেশের বড় শহরগুলোর দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা আকিতার জনসংখ্যার বিন্যাসের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব রেখে চলেছে। ফলে এখন সমগ্র জেলায় এমন এক ভারসাম্যহীন অবস্থা দেখা দিচ্ছে, জনসংখ্যার হিসাবের পরিসংখ্যান যখন বাস্তব অবস্থার খুবই উদ্ভট এক ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। আকিতা জেলায় যেমন প্রতি একশজনের মধ্যে গড়ে ত্রিশজনের বেশির বয়স এখন পঁয়ষট্টি বছর কিংবা এর বেশি। এই হার হচ্ছে জাপানের অন্য যে-কোনো জেলার চেয়ে বেশি। অন্যদিকে এর বিপরীতে শূন্য থেকে চৌদ্দ বছর বয়সসীমার শিশুদের আনুপাতিক হার হচ্ছে প্রতি একশজনে মাত্র প্রায় এগারোজন, যা হচ্ছে সারাদেশের হিসাবের মধ্যে সর্বনিম্ন। জেলার পল্লি অঞ্চলগুলোতে এই ভারসাম্যহীনতা হচ্ছে আরো অনেক বেশি ভয়াবহ।
দুই
আগেই বলেছি, এই গ্রীষ্মে আমার সুযোগ হয়েছিল আকিতার দূরবর্তী কয়েকটি অঞ্চলে যাওয়ার। তা আমার জন্য অন্য যে-সুযোগ তৈরি করে দেয় সেটা হলো, জনসংখ্যা সমস্যার এই ব্যাপ্তিকে কাছে থেকে দেখা এবং এর সমাধান খুঁজে পাওয়ার কোনো চেষ্টা গ্রামবাসীর পাশাপাশি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ চালিয়ে যাচ্ছে, তা অনুধাবন করতে পারা। এর মধ্য দিয়েই আমার চোখে ধরা দিয়েছে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রণীত রূপকল্পের সঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতির অভিনব হলেও খুবই ফলপ্রসূ যোগসাজশের চমৎকার এক ছবি, এই লেখার মধ্য দিয়ে পাঠকদের সঙ্গে যা আমি ভাগাভাগি করে নিতে চাই।
দুদিনের সেই ভ্রমণে আমার প্রথম গন্তব্য ছিল আকিতা জেলার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত পাহাড়ঘেরা গ্রাম কামিকোয়ানি। গ্রাম হিসেবে কামিকোয়ানির আত্মপ্রকাশ ১৯৯০ সালে, জাপানে যখন মেইজি পুনরুত্থান-পরবর্তী আধুনিকতার পথ ধরে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজিয়ে নেওয়া হয়েছিল, কামিকোয়ানি তখন থেকেই হয়ে ওঠে বর্ধিষ্ণু এক কৃষিপ্রধান গ্রাম। গ্রীষ্মের স্বল্পকালীন সময়ে ধানের ফলন ছাড়াও আপেল ও অন্যান্য ফলের আবাদ যেখানে নিয়মিতভাবে করা হতো। কৃষিজমির পরিচর্যা ও ফসলের আবাদ বংশানুক্রমিকভাবে পরিবারভিত্তিক হওয়ায় বর্ধিষ্ণু সেসব কৃষি-পরিবারে নতুন প্রজন্মের আগমন সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি, কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহর অভিমুখে যাত্রাও জনসংখ্যার ওপর বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলতে পাড়েনি। এর কারণ হলো, পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তান ঐতিহ্যগতভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী গণ্য হওয়ায় ছোট ভাইবোনদের ভাগ্যান্বেষণেকিংবা বৈবাহিক সূত্রে অন্যত্র চলে যাওয়া ছিল সমাজের প্রচলিত রীতি এবং এর মধ্য দিয়ে পরিবারের পেশাগত অবস্থান বজায় থাকায় জনসংখ্যার ভারসাম্যকে তা কখনো সেভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি।
এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যেমন কামিকোয়ানির জনসংখ্যা ছিল সাত হাজার, জাপানের গ্রামের সেই সময়ের সার্বিক অবস্থার সঙ্গে যে-সংখ্যা অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেই ষাটের দশক থেকেই শিল্পায়নের সমৃদ্ধ পথ ধরে জাপানের যাত্রা শুরু হলে দ্বিতীয়বারের মতো জনসংখ্যার ব্যাপক স্থানচ্যুতি জাপানে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। শহরাঞ্চল, বিশেষত শিল্পনগরীগুলোতে নতুন অনেক কাজের সুযোগ তৈরি হওয়া আর সেইসঙ্গে নগরজীবনের চাকচিক্য ও ভোগ-বিলাসের নানারকম ব্যবস্থা তরুণ সমাজকে কাছে টানতে শুরু করলে সেই প্রজন্মের অনেকেই তখন নিজেদের আদি নিবাসের মোহের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে শহরের পথে ধাবিত হতে শুরু করে।
জাপানে প্রথমবারের মতো সেরকম প্রবণতা দেখা গিয়েছিল মেইজি-পরবর্তী শিল্পায়নের সময়ে, বিশেষ করে পল্লি অঞ্চলের তরুণীরা যখন দলবেঁধে নতুন গড়ে ওঠা কল-কারখানায় কাজ করতে শহরমুখী যাত্রা শুরু করেছিল, সে-সময়টা অনেকটা যেন আমাদের তৈরি পোশাক খাতের বিকাশের সময়ের সঙ্গে তুলনীয়। দ্বিতীয় দফার ব্যাপক স্থানত্যাগে শহরমুখী যাত্রাকারীদের অধিকাংশই ছিল তরুণ প্রজন্মের নারী-পুরুষ, চাকরির সুযোগের পাশাপাশি নগরজীবনের বাহারি চাকচিক্য যাদের কাছে মনে হয়েছিল অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
আমার দেখা একসময়ের সেই বর্ধিষ্ণু পল্লি কামিকোয়ানির জনসংখ্যা স্থানত্যাগের সেই পথ ধরে হ্রাস পেতে পেতে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই হাজার ছয়শোজনে, যে-জনসংখ্যার অর্ধেকের কাছাকাছি আবার হচ্ছে পঁয়ষট্টি বছর কিংবা বেশি বয়সী। ফলে পল্লির ঐতিহ্যবাহী জীবন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত নানারকম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা এখন হয়ে উঠছে রীতিমতো কষ্টসাধ্য কাজ। গ্রামের কয়েকটি বসতির জনসংখ্যা হ্রাস পেয়ে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে যাওয়ায় ছাত্রের অভাবে সেখানকার স্কুলগুলো যাচ্ছে বন্ধ হয়ে। কামিকোয়ানি গ্রামের সেরকম একটি লোকালয়ের নাম হচ্ছে ইয়াগিসাওয়া, যেখানে এখন নয়টি পরিবারের মাত্র ষোলোজন সদস্যের বসবাস। ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে শহরাঞ্চলে ভ্রমণ সহজতর হয়ে ওঠার পর ইয়াগিসাওয়ার তরুণরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় বসতি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে শুরু করে। তাদের সেই প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় স্থানীয় কিছু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। সেরকম একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য হচ্ছে ইয়াগিসাওয়া বানগাকু নাচ, বাঁশির সুর আর ঢোলকের বাজনার সঙ্গে খুবই প্রাণবন্ত যে-লোকনৃত্য মঞ্চে পরিবেশন করা হয়।
প্রয়াত পূর্বপুরুষের আত্মাকে শান্তিতে রাখার উদ্দেশে নিবেদিত গ্রীষ্মকালীন ওবোন উৎসব এবং শস্যের ভালো ফলনের জন্য প্রার্থনা জানানোর আয়োজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এই ইয়াগিসাওয়া বানগাকু নাচ, পনেরোজনের মতো অংশগ্রহণকারীর প্রয়োজন যে-নাচের মঞ্চ-উপস্থাপনায় দরকার হয়। স্থানীয় বসতির জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়া থেকে দেখা দেওয়া নর্তকীর ঘাঁটির কারণে সে-অঞ্চলে ১৯৮৯ সালের পর থেকে বানগাকুর মঞ্চায়ন আর দেখা যায়নি, যা বানগাকুর চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার মতো বিপদের সম্ভাবনা সম্পর্কে সেখানকার বৃদ্ধদের একসময় শঙ্কিত করে তোলে। বৃদ্ধদের কয়েকজন মিলে একটি বাদক দল গড়ে তুললেও বার্ধক্যের কারণে কষ্টসাধ্য নাচের পারদর্শিতা দেখানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেরকম এক দুঃসময়ে, ২০০৯ সালের নভেম্বরে কামিকোয়ানি গ্রামের প্রাইমারি ও জুনিয়র হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্কুলের বালক-বালিকাদের বানগাকু নাচ শিখিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ইয়াগিসাওয়ার বৃদ্ধদের শরণাপন্ন হলে তাঁরা সেই ডাকে সানন্দে সাড়া দেন এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বানগাকু নাচ শিখিয়ে দেওয়ায় নিয়োজিত হন। তাঁদের সেই আন্তরিক উদ্যোগের ফলে ২০১০ সালের অক্টোবরে দুই দশক পর আবারও বানগাকু মঞ্চস্থ করা হয় এবং তখন থেকে প্রতিবছর নিয়মিতভাবে স্কুলের বিভিন্ন উৎসব ছাড়াও বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে কামিকোয়ানি সংস্কৃতি প্রকল্প চালু থাকার সময় ছাত্রছাত্রীরা দর্শকদের জন্য বানগাকু নাচের আয়োজন করে থাকে।
ইয়াগিসাওয়ার বৃদ্ধদের নিজস্ব অংশগ্রহণ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং শিশু-কিশোরদের উৎসাহী অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। গ্রামের যে-চারজন বৃদ্ধ এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী বৃদ্ধ এ-বছর ছিয়াত্তর বছরে পদার্পণ করেছেন এবং সবচেয়ে বেশি বয়সী বৃদ্ধের বয়স আটাশি বছর। আটাশি বছর বয়সী সেই বৃদ্ধ তোশিও সাতো একইসঙ্গে ইয়াগিসাওয়া বানগাকু সংরক্ষণ সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। বানগাকুর মঞ্চায়ন দেখতে আসা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন, তাঁদের সংরক্ষণ উদ্যোগের সঙ্গে গ্রামের অন্য কয়েকটি লোকালয়ের অধিবাসীরাও যোগ দিয়েছেন এবং প্রতিদিন এক থেকে দুঘণ্টা ধরে শিশুদের সঙ্গে তাঁরা বানগাকু নাচের অনুশীলন করেন। ভিডিওতে ধারণ করে রাখা অতীতের বানগাকু-মঞ্চায়ন দেখে শিশুরা অনুশীলন করে থাকে এবং ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মারাও ইদানীং এতে যোগ দিচ্ছেন।
বানগাকু নাচ হচ্ছে সাধারণত ঐতিহাসিক কাহিনিভিত্তিক নাচের মঞ্চায়ন। বানগাকুর সনাতন অকৃত্রিম ধারায় সাধারণত বারোটি অধ্যায় থাকে, নাচের মোট সংখ্যা যেখানেচবিবশটি। সময়ের স্বল্পতা, দক্ষ নর্তকীর অভাব এবং শিশুদের জন্য নাচ সহজবোধ্য করে তুলতে সেসব নিয়ম এখন কঠোরভাবে অনুসরণ করা হলেও কাহিনির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কোনোরকম রদবদল হয়নি। শিশুরা সাংবাদিকদের জন্য বানগাকুর বিশেষ মঞ্চায়ন শুরু করার আগে তোশিও সাতো বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, ‘আমরা হলাম কৃষক মানুষ আর সখের নাচিয়ে। ফলে মঞ্চ-উপস্থাপনায় ভুলত্রুটি হলে ক্ষমার চোখে তা দেখবেন।’
আটাশি বছরের বৃদ্ধ তাঁর স্বভাবসুলভ বিনয়বোধ নিয়ে সে-কথা বললেও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সেদিনের দেখানো ঐতিহ্যবাহী নাচে আন্তরিকতার কোনো অভাব একেবারেই দেখা যায়নি। নাচ যে কেবল হারিয়ে যাওয়া স্থানীয় এক সংস্কৃতিকে আবারো ফিরিয়ে এনেছে তাই শুধু নয়, গ্রামবাসীর জীবনে তা নতুন উদ্যম নিয়ে এসেছে এবং আশপাশ ও দূরের অনেক জায়গা থেকেও জাপানি পর্যটকরা আসছেন বানগাকুর মঞ্চায়ন উপভোগ করতে।
তিন
জাপানের গ্রামীণ জীবনে নতুন করে সজীবতা এনে দিতে দেশজুড়ে স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা নিয়ে নানারকম প্রকল্প আজকাল হাতে নেওয়া হচ্ছে। আকিতা জেলার কামিকোয়ানি গ্রামকে আবারো জনকোলাহলে মুখর এক জনপদ হিসেবে গড়ে তুলতে ২০১১ সাল থেকে যে কামিকোয়ানি প্রকল্প চালু করা হয়, বানগাকু নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে তারই একটি অংশ। এর এক বছর পর, ২০১২ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক শিল্পকলার অভিনব এক বার্ষিক প্রদর্শনী, সেইসঙ্গে আমন্ত্রিত শিল্পীদের গ্রামে এসে ছবি আঁকার বিশেষ এক ব্যবস্থা।
গ্রীষ্মকালে ছেষট্টি দিন ধরে চলা শিল্পকলার উন্মুক্ত প্রদর্শনীকে অনেকটা বলা যায় ইনস্টলেশন ডিসপ্লের এমন এক সংস্করণ, শিল্পীরা যেখানে উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশকে বেছে নেন তাঁদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম দর্শকদের কাছে নিয়ে যাওয়ার গ্যালারি হিসেবে। আমাদের ভ্রমণের সময় গ্রামের এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা নানারকম শিল্পকর্ম সহজেই চোখে পড়ছিল। কোথাও-বা পাহাড় আর ধানক্ষেত পেছনে রেখে কাঠের দন্ডের মধ্যে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে রঙিন কিছু প্লাস্টিক পাত, প্রকৃতির রঙের সঙ্গে মিলে যা তৈরি করে নিয়েছে খুবই দৃষ্টিনন্দন এক দৃশ্যপট। এর একটু দূরেই দাঁড়িয়ে অভিনব এক বাড়ি, সাদা রঙের ফুলেফেঁপে ওঠা যে-বাড়ির চেহারাই বলে দেয় এর শৈল্পিক মাধুর্যের কথা। কোথাও আবার ধানক্ষেত ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে ধান মাড়াইয়ের কাজে ব্যবহারের মইয়ের সারি। সেখান থেকে অল্প দূরে নদীর ওপর দন্ডায়মান পুরনো কাঠের পুলের রেলিং থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নানা রঙের কাপড়, যা সেতুর মধ্যে নিয়ে এসেছে রংধনুর ছোঁয়া। শিল্পী তাঁর সেই নয়নাভিরাম শিল্পকর্মের নাম দিয়েছেন ‘রংধনুর ওপর দিয়ে’।
গ্রামীণ পরিবেশকে সামনে রেখে আয়োজিত সমকালীন চিত্রকলার আরেকটি দিক হলো ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স’ কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিবছর তরুণ কিছু শিল্পীকে গ্রামে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এ বছর যেমন কুড়ি বছর বয়সের পাঁচজন শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ছেষট্টি দিন ধরে গ্রামে অবস্থানকালে ছবি আঁকায় তাঁরা নিয়োজিত থাকেন এবং নিজেদের আঁকা ছবি গ্রামের বন্ধ হয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত একটি স্কুলভবনে দর্শকদের জন্য প্রদর্শন করবেন। তরুণ শিল্পীদের প্রতিভা বিকাশে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি কাটিয়ে ওঠায় গ্রামবাসীকে সাহায্য করাও হচ্ছে প্রকল্পের পেছনের উদ্দেশ্য। এবারের আমন্ত্রিত পাঁচ শিল্পীর মধ্যে চারজন হচ্ছেন জাপানি, অন্যজন এসেছেন তাইওয়ান থেকে। তাঁদের মধ্যে তিনজনের সাক্ষাৎ ভ্রমণকালে আমরা পেয়েছি। তিনজনই বড়মাপের ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। পরিত্যক্ত স্কুলভবনের বিস্তৃত ক্লাসরুম এখন হচ্ছে তাঁদের স্টুডিও, বড় আকারের ছবি আঁকার মতো খোলামেলা জায়গার ব্যবস্থা যেখানে সহজেই করে নেওয়া গেছে।
তাইওয়ানি শিল্পী চেন ই-চিয়া ছবি আঁকার জাপানি রীতি নিহঙ্গা অনুসরণে ছবি এঁকে থাকেন। আমরা যখন স্কুলভবনে যাই, বড় প্যানেলে বাঁশঝাড়ের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলায় তিনি তখন ব্যস্ত। গ্রামে বসবাস করে যে নানারকম দৃশ্য তাঁর চোখে পড়েছে এবং বিভিন্ন যেসব অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ তাঁর হয়েছে, এর সবই একসময় পরোক্ষে হলেও নিজের আঁকা ছবিতে ফুটে উঠবে বলে চেন ই-চিয়া মনে করেন।
যে দুই তরুণ জাপানি শিল্পীর দেখা সেখানে আমাদের মিলেছে, তাঁরা হলেন জাপানের প্রাচীন রাজধানী শহর কিওটোর অধিবাসী ইয়াসুনোরি কিনুকাওয়া এবং তোহোকু শিল্পকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, পঁচিশ বছর বয়সী তরুণী নোজোমি তানাকা। কিনুকাওয়া তাঁর ছবির পর্দায় স্মৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে ভালোবাসেন, আর তাঁর পছন্দ হচ্ছে ইন্ডিগো ব্লু বা গাঢ় নীল রং। এছাড়া লাল রংও তাঁর মনঃপুত বলে জানালেন এই শিল্পী। এর কারণ হলো, নীল হচ্ছে জাপানের আধ্যাত্মিকতার রং আর লালের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় মানুষের মনে গভীরে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি। তিনি মনে করেন স্মৃতি সবসময়ই হচ্ছে কিছুটা অস্পষ্ট, কিছুটা রহস্যঘেরা। ফটোগ্রাফিকে ছবির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করলেও বিশেষ কোনো দৃশ্যপট যেন তা এড়িয়ে যেতে পারে, সেজন্য সাদা প্যানেলে নীল রঙে নানারকম স্মৃতির কোলাজের এক সমন্বয় তিনি শ্রেণিকক্ষের স্টুডিওতে আঁকা ছবিতে ফুটিয়ে তুলছেন।
তিন শিল্পীর মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে প্রতিভাবান হচ্ছেন নোজোমি তানাকা। মিশ্রমাধ্যমের কাজে শৈল্পিক মুন্শিয়ানার ছাপ তাঁর ছবিতে সহজেই দৃশ্যমান। আমরা যেদিন শিল্পীদের সাক্ষাৎলাভে পরিত্যক্ত স্কুলভবনটিতে গিয়েছিলাম, কাঠের প্যানেলে ধাতব পাত সংযুক্ত করে নতুন একটি কাজ তিনি তখন মাত্র হাতে নিয়েছেন। তবে এরই মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়া যা ছবিটি স্কুলভবনের দোতলায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেটা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। পঁচিশ বছর বয়সী সেই তরুণীর নিজের আঁকা সেই ছবির নামকরণ করেছেন ‘উৎসবের দিনের আগুন’। দুমাস ধরে টানা কাজ করে ছবিটি আঁকা তিনি শেষ করেছেন। জাপানের ইয়ামাগাতা জেলার যে-অঞ্চলে শিল্পীর আদি নিবাস, সেখানে শরৎকালে দেখা কৃষিজমিতে রঙের আগুনের চমক সেই ছবিটি আঁকার পেছনে অনুপ্রেরণা জোগায় বলে জানালেন শিল্পী। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক হচ্ছে এর মূল বিষয়।
চার
জাপানের মূল দ্বীপ হোনশুর উত্তরের দূরবর্তী এক গ্রামে শিল্পকলার এই অসাধারণ পৃষ্ঠপোষকতার পেছনে যিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন, তিনি হলেন আকিতা শিল্পকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাসাইয়া শিবাইয়ামা। নিইগাতা জেলায় প্রকৃতির উন্মুক্ত বিস্তৃতিতে আয়োজিত এচিগো চারুকলা প্রদর্শনীর সাফল্য আকিতা জেলায় সেরকম কিছু একটা করতে পারায় তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কামিকোয়ানির অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যে আকৃষ্ট হওয়ার পর গ্রামের জনসংখ্যা সমস্যা সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন এবং জনবলের স্বল্পতার কারণে ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকৃতির সেই অপরূপ দৃশ্যপটকে ধরে রাখতে হলে কিছু একটা যে করা দরকার, সে-চিন্তা তখন তাঁর মাথায় আসে। নিজে তিনি ভাস্কর্যের শিল্পী হওয়ায় শিল্পকলার সঙ্গে সম্পর্কিত পথ ধরে গ্রামের জীবনকে উজ্জীবিত করে নেওয়ার বাসনা তিনি মনে মনে পোষণ করছিলেন। কামিকোয়ানির মেয়র ইওশিও নাকাতার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করার পর দুজনেই তাঁরা আধুনিক শিল্পকলা প্রকল্প শুরুতে ছোট আকারে চালু করতে সম্মত হন। প্রকল্পের প্রথম বছর অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ লাখ ইয়েন, জাপানের বাস্তবতায় যে-তহবিলের পরিমাণ হচ্ছে খুবই সামান্য। এ বছর বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় তিন কোটি ইয়েনের কিছু বেশিতে।
আধুনিক শিল্পকলার অভিনব সেই প্রকল্পের কল্যাণে কামিকোয়ানি এরই মধ্যে আকিতা জেলার পরিচিত এক গ্রাম হয়ে উঠেছে এবং শিল্প-প্রদর্শনী চলার সময় জাপানের অন্যান্য এলাকার লোকজনও এখন ভ্রমণ-গন্তব্য হিসেবে কামিকোয়ানিকে বেছে নিচ্ছেন। গত বছর যেমন প্রকল্প চালু থাকার সময় বারো হাজার ভ্রমণকারী কামিকোয়ানি ঘুরে গেছেন। এই সংখ্যা হচ্ছে গ্রামের মোট জনসংখ্যার চারগুণেরও বেশি। ভ্রমণকারীরা শিল্পকলার উন্মুক্ত প্রদর্শনী দেখা ছাড়াও বানগাকু নাচ উপভোগ করছেন, গ্রামবাসীর চালানো ক্যাফে ও রেস্টুরেন্টে আহার সেরে নিচ্ছেন এবং ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কিছু স্যুভেনিরও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে গ্রামের অর্থনীতিতেও প্রকল্প নিয়ে আসছে কিছুটা সচ্ছলতা।
তবে মেয়র নাকাতা মনে করেন, প্রকল্পের লক্ষ্য কেবল স্বল্পমেয়াদি সময়ে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনেই সীমাবদ্ধ নেই। তিনি বলেছেন, ‘পণ্যের কেনাবেচা সম্পর্ক গড়ে তোলা কিংবা সম্পর্ক বজায় রাখার বেলায় পর্যাপ্ত নয়, কেননা দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তা কখনো গড়ে তোলে না। তবে প্রকল্পের কারণে গ্রামের জন্য এক ধরনের ভালোবাসা যাদের মনে দেখা দেবে, বারবার এখানে তারা ফিরে আসবেন। আমাদের গ্রামবাসীকে এটা উৎসাহিত করবে এবং নিজেদের গ্রামকে তারা আরো বেশি করে ভালোবাসবেন।’
শিল্পকলার মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়া থেকে দেখা দেওয়া বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গ্রামের জন্য এসবই হচ্ছে হয়তো সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, গ্রামকে এবং গ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিলুপ্তির সম্ভাবনার মতো সমস্যার মুখেও যা টিকিয়ে রাখবে। r
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.