চট্টগ্রামে তাঁর ষোলো বছর

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ষোলো বছর চট্টগ্রামে কাটিয়েছেন। অবশ্য স্বাধীনতার পরে সংবিধানের বাংলাভাষ্য রচনার সূত্রে দীর্ঘ ঢাকাবাস এবং দুয়েকবার লম্বা সময়ের জন্য বিদেশবাসের ফলে তাঁর চট্টগ্রাম অবস্থানে মাঝে মাঝে ছেদ পড়েছে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রিডার (বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক) পদে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগসমূহে জ্যেষ্ঠ পদের সংখ্যা খুবই কম থাকায় পদোন্নতিও সহজ ছিল না। তখনো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নতুন, ঢাকা (প্রতিষ্ঠা ১৯২১) ও রাজশাহী (প্রতিষ্ঠা ১৯৫৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে এটি প্রদেশে তৃতীয় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে কলা অনুষদের মাত্র চারটি বিভাগ নিয়ে (বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, ইতিহাস) বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করেছিল। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুবের আমলে চট্টগ্রামবাসীকে বেশ আন্দোলন-সংগ্রাম করেই এটি চট্টগ্রামে আনতে হয়েছিল। এ-সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, প্রকল্প পরিচালক ও প্রথম উপাচার্য ড. এ.আর মল্লিকের উদ্যোগে সম্ভবত তাঁর পূর্বতন কর্মক্ষেত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, অনেকেই এসেছিলেন চট্টগ্রামে। কেউ কেউ বিদেশ থেকে এসেও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। এভাবে বেশ আকস্মিকভাবে চট্টগ্রাম দেশের উচ্চতর বিদ্যাচর্চার অনেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের কর্মময় উপস্থিতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কবি ও লেখক সৈয়দ আলী আহসান গোড়াতেই বাংলা বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আনিসুজ্জামান এ-বিভাগে জ্যেষ্ঠতায় দ্বিতীয় জন হিসেবেই যোগ দেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য অনেকের যোগদানের চেয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যুক্ত হওয়ার তাৎপর্য ছিল ভিন্নমাত্রার ও সুদূরপ্রসারী। এখানে তিনি যখন যোগ দিচ্ছেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩২ বছর; কিন্তু এরই মধ্যে মেধা, গবেষণা ও অধ্যাপনার গুণে তিনি উচ্চ শিক্ষাঙ্গন, বাংলা ভাষা-সাহিত্য চর্চার জগৎ এবং মননশীল প্রবন্ধের জন্য দেশজোড়া – অনেকাংশে কলকাতাসহ দেশের বাইরেও – সুপরিচিত, জনপ্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত। তবে তখনকার সময়ের বিচারে তাঁর দেশজোড়া খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ষাটের দশকে দেশে জায়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জোয়ারে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের যে-অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাতে এই তরুণ শিক্ষাবিদের সক্রিয় সুস্পষ্ট বলিষ্ঠ ভূমিকা। তরুণ এই শিক্ষাব্রতীর মানস কেবল নিজ পেশা ও নিজের মূল কর্মক্ষেত্র – গবেষণা-অধ্যাপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর মানসে দেশ, মানুষ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং সমকালীন রাজনীতি ও ঘটনাপ্রবাহের সক্রিয় ভূমিকা ছিল অত্যন্ত জোরালো। দেশ, মানুষ ও সময়ের দাবি একজন সচেতন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে আনিসুজ্জামান কখনো এড়াতে পারেননি, বরং বলা উচিত, এড়াতে চাননি। বরাবর – জীবনের শেষদিন পর্যন্ত – এরকম ডাকে সাড়া দিয়ে গেছেন, প্রয়োজনে অন্যদের ডেকে নিয়ে নিজেই যথোপযুক্ত কাজের উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে তিনি যখন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে প্রদেশবাসীর বিরাট সাফল্যের অব্যবহিত পরে চট্টগ্রাম এলেন তখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরাই নন, জেলার প্রগতিশীল মহলের মধ্যেও প্রত্যাশার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।
তাঁর মনে স্থান-কাল-পাত্রের এই চেতনা এবং এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির বীজ পত্তন হয়েছিল শৈশবে। দশ বছর বয়স পর্যন্ত আনিসুজ্জামানের পরিবারের বাস ছিল কলকাতায়। এই মহানগরীতেই তিনি উপমহাদেশের কালান্তরের প্রেক্ষাপটে বাঙালি-জীবনে গভীর দীর্ঘ ক্ষত রেখে যাওয়া তিনটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ঘটনা বা দুর্ঘটনা তিনটি পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে, দিয়েছে ইন্ধন; এগুলো হলো – দাঙ্গা, দেশভাগ ও দেশান্তর। স্বাধীনতারই ফসল দেশভাগ তথা বাংলাভাগ, যার সূত্র ধরেই ঘটে গেছে মর্মান্তিক ট্র্যাজিক ঘটনা – হিন্দু-মুসলমানে রক্তাক্ত দাঙ্গা এবং কোটি মানুষের মানবেতর মর্মন্তুদ পরিণতি, উদ্বাস্তু জীবন। এরকম তীব্র, প্রকাণ্ড, জলজ্যান্ত মানবিক বিপর্যয়, ইতিহাসের বিয়োগান্তক ঘটনা বালকের সংবেদনশীল মনকে গভীরভাবে নাড়া না দিয়ে পারে না। এরকম ক্ষত ও তার জের জাতিকে যেমন টানতে হয়েছে তেমনি দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবীকেও বহন করতে হয়। অভিজ্ঞতার এমনতর সূচনায় মনের পরিণতি ঘটে দ্রুত।
পূর্ব পাকিস্তানে এসে তাই স্কুলজীবন শেষ হতে না হতেই সহজেই পনেরো বছরের বালকের পক্ষে ভাষা-আন্দোলনে নিজের অবস্থান বুঝে নিতে দেরি হয় না। সেই শুরু। এই সময়েই তিনি যাতায়াত শুরু করেন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের বিভিন্ন আসরে, অলিখিত যোগ ঘটে এই সংস্থার সঙ্গে। পরিচয় ঘটতে থাকে এর বিভিন্ন বয়েসি – তবে সকলেই তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ – দেশের মেধাবী, সৃজনশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে। তাঁর সতেরো বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে তরুণ আনিসুজ্জামান একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গে সচরাচর বলা হয়ে থাকে যে, তিনি মাঠপর্যায়ের কর্মী থেকেই ধাপে ধাপে এত বড় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। আনিসুজ্জামানও একদিকে যেমন মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন, অন্যদিকে সকল স্তরের শিক্ষায় মনোযোগী ছাত্র ছিলেন, গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিজের সর্বোচ্চটি সম্পূর্ণ দিয়েই সফল হয়ে ভবিষ্যতে আরো এগিয়ে যাওয়ার শক্ত ভিত্তি তৈরি করে নিয়েছিলেন। সংগীতজ্ঞ ও লেখক সন্জীদা খাতুন মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, একটি রোগা-পাতলা ছেলেকে দেখতাম সাইকেল চালিয়ে প্রুফের বান্ডিল নিয়ে বাবার কাছে আসতে, এবং তা কাটা হলে পরের দিন এসে সে-ই নিয়ে যেত। তিনি একজন কর্মী হিসেবেই যুগপৎ দেশব্রতী ও মানবব্রতী হওয়ার জীবনসাধনা শুরু করেছিলেন।
আনিসুজ্জামানের এই মানস এবং তার ভিত্তিতে যে-জীবন তাতে মানুষ-দেশ-ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল নির্ভেজাল। তদুপরি তাঁর সহজাত জীবনবীক্ষা, বিচিত্র বিষয়ে কৌত‚হল, জীবনের নানা ক্ষেত্রে ও পর্বে সৃষ্ট অসংগতি-বিসংগতির প্রতি মনের সাবলীল কৌতুকি প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা তাঁর ব্যক্তিত্বকে করেছে সবল ও সরস। আবার কঠিন দুঃসময়ে তিনি স্থিতধী, অবস্থান গ্রহণে ক্ষিপ্র এবং উদ্যোগ গ্রহণে সাহসী; যখন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রতিক‚লতা, কূট-সংকীর্ণতা, অন্যায় আঘাত জীবননাট্যে বিয়োগান্তক পরিণতি অনিবার্য করে তোলে তখনো তিনি রণাঙ্গনে, আয়ুধ তাঁর উচ্চ মূল্যবোধ ও সযত্নে নির্মিত সবল বিবেক। তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক প্রসন্নতা ক্ষুণ্ন হতো না কখনো।

দুই
১৯৬৯ সালের জুন মাসে এই মানুষটি চট্টগ্রামে বসত গড়লেন। দীপ্তিমান দুটি চোখ, একহারা ঋজু গড়ন, সরল বাঙালি পোশাক, সেই সঙ্গে ভারী গভীর কণ্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণে ব্যক্ত প্রাঞ্জল বক্তব্যে শ্রোতাদের ওপর তাঁর উপস্থিতির অভিঘাত হলো প্রবল কিন্তু ব্যক্তিত্বের প্রসন্নতায় মাধুর্যমণ্ডিত; এবং এই ব্যক্তিত্বের প্রতি ছাত্র-তরুণ-সচেতন নাগরিকদের আকর্ষণ হয়ে উঠল স্বতঃস্ফূর্ত, অমোঘ, প্রবল – প্রায় ভক্তের একাগ্রতায় সভামঞ্চে, সাংগঠনিক সান্নিধ্যে তাঁকে পাওয়ার এবং এই প্রাপ্তির অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তির ইচ্ছায় কেবলই তা হয়েছে প্রসারিত। গোড়া থেকেই চট্টগ্রামে তাঁর গুণগ্রাহীদের বৃত্ত এভাবে বেড়েছে, সম্প্রসারিত হয়েছে।
মনে রাখতে হবে তখন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান মাত্রই শেষ হয়েছে, কিন্তু তার রেশ তো কাটার নয়ই, বরং তা এক নতুন জাতির নির্মাণে ও উত্থানে পুষ্টি সঞ্চার করে চলেছে। এই আন্দোলনের প্রবল অভিঘাতে সত্যিই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের তখত্ উলটে গেল, লৌহমানব আইয়ুব খানের পতন হলো; জাতীয় নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলো সামরিক শাসন, প্রত্যাহার হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বন্দি মুজিব ও মামলার আসামিরা পেলেন নিঃশর্ত মুক্তি। মুক্ত মুজিবকে ছাত্র-জনতা সম্মানে-ভালোবাসায় অভিধা দিলো বঙ্গবন্ধু।
জনতা তখন বিজয়ের আনন্দে উদ্বেল। দিকে দিকে একই স্লোগান ধ্বনিত হয়েছে – জয় বাংলা, এক নেতা এক দেশ – বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ, তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। কোথাও উচ্চারিত হয়েছে স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে স্লোগান। মানুষ তখন দল-মত-নির্বিশেষে নেতা মুজিবের পেছনে কাতারবন্দি একতাবদ্ধ, স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বাজি রাখতে উন্মুখ।
এরকম এক সময়ে আনিস স্যার আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা এবং সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে শহর থেকে দূরে পাহাড়ঘেরা প্রকৃতির কোলে শান্ত ছোট্ট ক্যাম্পাসের অখ্যাত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে এলেন। বলতেই হবে আজীবনের নাগরিক, বরাবর আন্দোলন-সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থানে অভ্যস্ত এবং তাঁর গঠনপর্বের দীর্ঘকালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন – ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে টানা ষোলো বছরের অভ্যস্ত জীবন ছেড়ে আসা সহজ ছিল না। মনে হয় নিতান্ত চাকরির পদোন্নতি ছাড়াও হয়তো অন্য বিবেচনা কাজ করে থাকবে। ভাবি, তিনি কি জীবনে একটা বদল, আমূল পরিবর্তন চাইছিলেন, যা তাঁর মতো স্থিতধী মানুষের মধ্যেও একটা ব্যস্ততার তাগিদ তৈরি করেছিল?
গত শতকের ষাটের দশকে আমাদের বাসায় নিয়মিত সাহিত্য আসর বসতো। একটি সংগঠন ছিল, চট্টগ্রাম সাহিত্য সংসদ – চট্টগ্রামের এ-ধরনের সংগঠনের সভাপতির পদ যেন বাবা সাহিত্যিক আবুল ফজলের জন্য বাঁধাই ছিল এবং এটির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি; সম্পাদক ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন তরুণ প্রভাষক, বাবার প্রাক্তন প্রিয় ছাত্র মুহাম্মদ ইউনূস, পরবর্তীকালে নোবেল বিজয়ী। ঊনসত্তরে অবশ্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে, বৃত্তি নিয়ে পিএইচ.ডি করছেন। এই সময়ে রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে সাহিত্য আসরের আয়োজন কমেছে। ইউনূসভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তখন তরুণ লেখক ও উদ্যমী কর্মী সুধাংশু ভট্টাচার্য আয়োজনের কাজ করতেন। দুর্ভাগ্য, তিনি একাত্তরের প্রথম পর্বেই দখলদার পাক সেনাদের হাতে শহিদ হন। তখন যে কয়েকটি আসর বসেছিল তাতে আনিসুজ্জামানের উপস্থিতি তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রাসঙ্গিক বক্তব্য এবং প্রাঞ্জল ভাষা ও খাদের গম্ভীর কণ্ঠস্বরের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল। বলা দরকার, বাংলা বিভাগের প্রধান সৈয়দ আলী আহসানও এসব আসরে উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁর সুললিত ভাষা, স্পষ্ট উচ্চারণ ও কাব্যিক উপস্থাপনারও ছিল ভিন্নতর আকর্ষণ। বলা বাহুল্য, এ-দুজনের উপস্থিতি সাহিত্যসভার মান ও মূল্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি বলে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত দেখা হওয়ার সুযোগ ছিল না। কবি মোহাম্মদ রফিক, আলতাফ হোসেন ও আরো কয়েকজনের সঙ্গে কাব্য-সাহিত্যের ছোট বৃত্তে তখন আমি বাঁধা পড়েছি। ছাত্ররাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কাজ থেকেও একটু দূরে। তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ঊনসত্তরের আগে-পরে যে-দুটি বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল – ১৯৬৮ তো গোর্কি এবং ১৯৭০-এ লেনিন জন্মশতবার্ষিকী – তাতে কর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলাম। পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির চট্টগ্রাম শাখাই দুটি অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা। এ-সংগঠনেরও সভাপতি বাবা, সম্পাদক ছিলেন অ্যাডভোকেট শফিউল আলম। পরের অনুষ্ঠানটিতে আনিস স্যার বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছেন, কোনো অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন কি না মনে নেই।
স্বাধীনতার আগে এরকম দূর থেকে শ্রোতা হিসেবেই প্রধানত তাঁকে দেখেছি, যদিও ব্যক্তিগত পরিচয় আগেই হয়েছিল। মনে পড়ছে স্বাধীনতার পরপর, যখন সদ্য স্বাধীনতা লাভের উত্তেজনা ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে সরগরমভাবে উপস্থিত, তখন যুদ্ধফেরত বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে একটি বড় সমাবেশ হয়েছিল মুসলিম হলে। সেখানে হলের বাইরে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় এবং উষ্ণতার সঙ্গে আমরা হাত মেলাই, তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। স্পষ্ট মনে পড়ে তাঁর পরনে ছিল প্যান্ট ও বুকখোলা ফুলহাতা শার্ট। তখন তাঁর ট্রেডমার্ক পোশাক পাজামা-পাঞ্জাবি ছাড়াও এ-পোশাকও তিনি পরতেন, তবে কম।
১৯৭৩ সালে আমি এমএ পরীক্ষা শেষ করে ঢাকা থেকে ফেরার পরে আমার ওপর চাপ ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার। বাবা তখন উপাচার্য, আমি সেই সময়ে আহামরি রেজাল্ট ছাড়া তাঁর অধীনে যোগ দেওয়া সমীচীন মনে করিনি। নিরুপায় বাবা তখন অনেককে দিয়েই আমায় চাপ দিয়েছিলেন, তখন আনিস স্যারও একবার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ চাপ ছাড়াই প্রস্তাব আকারে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ততদিনে আমি অবশ্য মনে মনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার বিপক্ষে কয়েকটি শক্ত যুক্তি খাড়া করেছিলাম। তাঁকে কিছু বলিনি, কিন্তু বন্ধুমহলে বলেছিলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয় হলো ডেকাডেন্ট ইনস্টিটিউশন, এতে যুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের উপযোগী কোনো কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি মেতে থাকলাম চট্টগ্রামে চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা নিয়ে, প্রথমে খণ্ডকালীন শিক্ষক, পরে পূর্ণ শিক্ষক, পঁচাত্তর থেকে উপাধ্যক্ষ এবং পরের বছরের শেষনাগাদ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছি। এ-সময় অন্যদিকে নজর দেওয়ার ফুরসত না থাকলেও চলচ্চিত্র সংসদে বেশ সক্রিয়ভাবেই জড়িত ছিলাম। এখানেই আনিস স্যারের সঙ্গে আমার সাংগঠনিক সংযোগের সূত্রপাত। একসময় আমরা তাঁকে সংগঠনের সভাপতি হতে অনুরোধ করলে তিনি রাজি হন। বরাবর এ-সংগঠনের কাজে আমি সক্রিয় অংশীদার ছিলাম, একপর্যায়ে সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছি। একবার অস্ট্রেলিয়ার একজন চলচ্চিত্র পরিচালক বা সমালোচককে নিয়ে আমরা একটা সেমিনার আয়োজন করেছিলাম, তাতে স্যার উপস্থিত মতো ইংরেজিতে বক্তৃতা করেছিলেন। ইংরেজিতেও তাঁর সাবলীল সুন্দর ভাষণের দক্ষতায় সেদিনের মুগ্ধতার কথা এখনো ভুলিনি।
স্বাধীনতার পরে প্রাথমিক উত্তেজনার মধ্যেই আনিস স্যারকে সংবিধানের বাংলাভাষ্য রচনার জন্য প্রায়ই ঢাকায় থাকতে হতো। আবার ১৯৭৪-এর দিকে তিনি লম্বা সময়ের জন্য গবেষণার কাজে বিলেত গেলেন। ফিরলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার দু-চারদিন আগে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, তারপরই জেলহত্যা এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গনে ওলটপালট অবস্থায় আমরা তখন হতোদ্যম, হতাশ এবং একধরনের চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছি। তবু এরই মধ্যে ১৯৭৬-এর একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান ঘিরে আমরা তরুণরা উদ্যোগী হলাম রাজপথে নামার। প্রভাতফেরি মিছিলে পরিণত হলো, জয়বাংলা স্লোগানও উঠল। ঢাকা থেকে শিল্পী কলিম শরাফী সাহস করে এসে যোগ দিয়েছিলেন, আনিস স্যারকে কেন ডাকা হয়নি মনে পড়ছে না।

তিন
আমরা ভালোভাবে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন গুছিয়ে করতে শুরু করি ১৯৭৮ থেকে। ততদিনে জিয়ার মধ্যে সামরিক শাসনের ভূমিকা ছেড়ে রাজনৈতিক পরিচয়ে রাষ্ট্রনেতা হওয়ার আকাক্সক্ষা জেগেছে। সামরিক আইনের কিছু কিছু বিধান শিথিল হয়েছে, সভা-সেমিনার আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের দফতরের অনুমোদনে শুরু করা যাচ্ছিল। সামাজিক অঙ্গনের বামপন্থী সংগঠন, যেমন উদীচী, খেলাঘর, মহিলা পরিষদ, মৈত্রী সমিতি, আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদ, শান্তি পরিষদ এবং ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি রাজনৈতিক-আধা-রাজনৈতিক সংগঠন প্রকাশ্যে-নেপথ্যে সক্রিয় হয়ে উঠছিল। দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তখন এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নানা কাজে অনুঘটকের ভূমিকায় ছিলেন। এসব সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গেই আনিস স্যারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তো ছিলই, তাছাড়া তাঁর আজীবনের বিশ্বাস তাঁর মধ্যে যে আদর্শ ও চিন্তাধারার প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করেছিল তা তাঁকে এসব আয়োজনের সঙ্গেই যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তখন সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বরে অবশ্যই এবং সম্ভব হলে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী বা এরকম আরো উপলক্ষকে ঘিরে বড় আকারে সেমিনার, সভা, সমাবেশ আয়োজনের সূচনা হলো। আমি তখন উপরোল্লিখিত কোনো সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থেকেও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংযোগের সূত্রে সব কাজেই যুক্ত থেকেছি; ক্রমে আমাদের শিশু প্রতিষ্ঠান ফুলকি হয়ে ওঠে এসব আয়োজনের সাংগঠনিক কেন্দ্র। এসব উপলক্ষে প্রচারপত্র-আমন্ত্রণপত্রের খসড়া রচনার দায়িত্ব পড়ত আমার ওপর। সবমিলিয়ে এ-ধরনের সময়োপযোগী সম্মিলিত আয়োজনের সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদকের দায়িত্বও প্রায়ই আমার ওপরে পড়েছে। আর প্রায় সব আয়োজনেরই – স্যার চট্টগ্রাম থাকলে – সভাপতি নির্বাচিত করা হতো তাঁকেই। এ-কথা বলা যায় যে, আমাদের দুজনের নির্বাচন ছিল যেন স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত। আনিস স্যার সভাপতি, আমি সম্পাদক – এভাবে বিস্তর কমিটি গঠিত হয়েছে মোটামুটি সিপিবির বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক গণসংগঠনের সংগঠক-কর্মীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। তাঁদের জন্য সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য আনিস স্যার এবং নির্দলীয় আমাকে সাংগঠনিক কাজে সামনে রাখাই ছিল কাজ চালানোর সময়োপযোগী কার্যকর কৌশল। আমার এবং আরো কয়েকজনের বুদ্ধিতে এসব কমিটি হতো উপলক্ষ-নির্ভর, এর কোনো স্থায়িত্ব ছিল না। অনুষ্ঠানের পরে হিসেবপত্র চুকিয়ে তার আর অস্তিত্ব থাকত না।
জিয়ার শাসনকাল এবং পরবর্তী এরশাদের সামরিক শাসনের প্রথম দিক ছিল প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। বলতেই হবে, এ-সময় মাথার ওপর আনিস স্যার ছিলেন ঝড়-বৃষ্টিতে ছাতার মতো, পরম নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তবে এটাও বলতে হবে, তিনি কিন্তু কেবল আলংকারিক ভূমিকায় ক্ষান্ত থাকতেন না, রীতিমতো সাংগঠনিক সভাতেও যোগ দিতেন; আমাদের কোনো খসড়ায় মাহবুবভাইয়েরও – লেখক ও গবেষক ড. মাহবুবুল হক – সংশয় থাকলে আনিস স্যার ছিলেন শেষ নিশ্চিন্ত আশ্রয়, তাৎক্ষণিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাছাড়া আমাদের আয়োজনের বাইরেও এ-ধরনের প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন আয়োজনেও তিনি নিয়মিত যোগ দিতেন। বিরাশি-তিরাশির দিকে মাঝে কিছুদিন বিদেশে ছিলেন, এছাড়া ১৯৮৫-র জুনে চট্টগ্রাম ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁকে নিয়েই অন্তত সাত-আট বছর আমাদের সামরিক স্বৈরাচারী শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সম্মিলিত উদ্যোগগুলো, বলা যায়, সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ষাটের দশকের মতো এই সময়ে, বরং সংখ্যায় অনেক বেশি ও বহরে অনেক বড় বড় আয়োজন এ কয়েক বছরে সারাদেশেই হয়েছে। চট্টগ্রাম তাতে এগিয়ে ছিল। তখন পুনরায় বাঙালি জাতীয়তা, বাঙালি সংস্কৃতি, প্রগতিশীল চেতনার পক্ষে প্রচুর লেখালেখি, নানা সভা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে সারাদেশে। চট্টগ্রামে আমাদের তৎপরতায় অভিভাবক ছিলেন আনিসুজ্জামান। তাঁকে মাথায় রেখে আমাদের পক্ষে মাঠে সাহসী কাজে সক্রিয় হওয়া সম্ভব ছিল। এর একটি বড় কারণ পরিচিতির পাশাপাশি তাঁর জন-ভাবমূর্তি এবং সরকারি-বেসরকারি নানা বিভাগ ও স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ।
এসব কাজের সূত্র ধরে কয়েকটি অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ আনিস স্যারের গুণগ্রাহীদের জানানো যায়। একবার ভাবতে হবে, স্যার থাকতেন শহর থেকে প্রায় কুড়ি মাইল দূরে ক্যাম্পাসে। সেখান থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে একাই শহরে আসতেন এবং অনুষ্ঠানাদি শেষে আবার – এবং প্রায়ই বেশ রাতে – একইভাবে বাড়ি ফিরতেন। এটা তাঁকে অনেক সময় সপ্তাহে হয়তো চার-পাঁচদিনও করতে হতো। অনেক সময় সামান্য সাংগঠনিক সভাতেই – হয়তো আমাদের বা আমাদের মতো অন্যদের চাপাচাপিতে – একইভাবে আসা-যাওয়া করতেন। কোনোদিন আমরা বা অন্য কেউ তাঁর ওপর এর শারীরিক ধকল এবং আর্থিক ব্যয়ের কথা বিবেচনায় আনিনি, স্যার কোনোদিন বলেনওনি, তাঁর আচরণে-কথায় ঘুণাক্ষরে কিছু প্রকাশ করেননি। তখনই লক্ষ করেছি এমন মানুষের অনুরোধে এমন সব অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত হতেন, এই একই রকম কষ্ট স্বীকার করে, যা হয়তো আমরাও ওই বয়সে পরিহারের সুযোগ খুঁজতাম! তাঁর সৌজন্য কিংবা প্রীতিবোধ তাঁর ব্যক্তিত্বের মতো এতই সহজাত ও স্বাভাবিক যে এ নিয়ে অনুযোগ জানিয়ে কেউই কৃতকার্য হননি।
কেবল যে বিষয় ও নিজ অবস্থান এবং সংবেদনশীল দায়বদ্ধ মানুষ ছিলেন তা নয়, তিনি একজন সাহসী মানুষও ছিলেন। হয়তো তাঁর সততা ও বিবেকবোধের শক্তি তাঁকে সাহসী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এরশাদের সামরিক শাসনের প্রথম দিকে বেজায় কড়াকড়ি চলছিল, আমরাও অনেক রাত ঘরে থাকতে পারছিলাম না। এ-সময়ে একবার একটা সেমিনারের পরে গুজব রটল বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী-সংস্কৃতিকর্মীদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হবে। গুজব দ্রুত ডালপালা মেলতে থাকল, এমন সময় কেউ একজন খবর দিলো ড. অনুপম সেনকে গ্রেফতার করা হবে বা হয়েছে। শুনে আমরা যখন স্যারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছি এবং নানা উদ্বেগে কাতর তখন স্যার স্বভাবজাত ধীর কণ্ঠে বললেন, চলো, অনুপমের খবর নিতে হবে। তাঁর কথায় গাড়িতে উঠলাম এবং নিজে গাড়ি চালিয়ে অনুপমদার বাসার দিকে রওনা দিলেন। অনুপমদাকে বাসায় পেয়ে আমরা আশ্বস্ত হলাম। বলা বাহুল্য, অপ্রত্যাশিতভাবে স্যারকে পেয়ে অনুপমদা ও বউদিও মহাখুশি। আমরা গ্রেফতারের কথা আর তুলিইনি, বরং লুচি-তরকারি ও চায়ে মনোযোগ দিই।
১৯৮৫-তে স্যার ঢাকায় ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে শেষ বড় কাজ করেছি সে-বছরের গোড়ায় চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন আয়োজনে। সেবারই প্রথম ঢাকার বাইরে এমন আয়োজন, পরে এক বছর অন্তর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে সম্মেলন আয়োজনের রেওয়াজ চালু হয়। উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি স্যার, সম্পাদক মিহিরদা – সংগীতশিক্ষক মিহির নন্দী, আর নির্বাহী সম্পাদক আমি। সাংগঠনিক মূল দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়েছিল, যদিও আরো অনেকের পরিশ্রমেই এটি সার্থক হয়েছিল। সম্মেলনে বরাবর একটা ঘোষণা পাঠ করা হয়, প্রথম দিকে যার বেশির ভাগ খসড়া আমার। আমাদের অনুরোধে স্যার একটি খসড়া করে দিয়েছিলেন, তবে পরে ঢাকার বন্ধুজন এবং এ-সংগঠনের তখনকার প্রাণ অবিস্মরণীয় ওয়াহিদভাইয়ের – সংগীতজ্ঞ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট সংগঠক ও লেখক ওয়াহিদুল হক – পরামর্শে অনেক পরিবর্তন করা হয় তাতে। বহুজনের কাজে এবং একটি সংগঠনের নির্দিষ্ট অভিপ্রায়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে একটি খসড়ায় যে হাত দিতে হবে, পরিবর্তন ঘটবে তা যেন তিনি জানতেনই। তাঁর খ্যাতি কিংবা ভাবমূর্তির কোনো চাপ আমাদের বোধ করতে হয়নি। আনিস স্যারের সঙ্গে কাজ করা সহজ এ-কারণেই, তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে বাস্তবতার দাবি ও পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারতেন এবং অধিকাংশের অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ এগিয়ে যেতে সহায়তা করতেন অনায়াসে। তিনি কোনো কাজের – বড় কাজ, বহুজনের কাজে তো নয়ই – পথে কখনো অন্তরায় হননি, এমনকি মানসিক বাধারও কারণ হননি।
একবার তাঁর সঙ্গে একটি ব্যতিক্রমী কাজের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তাঁর পছন্দের রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তাব দিলে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্বের পরে স্যার রাজি হয়েছিলেন। যথাসময়ে স্যার ছোট ছোট স্লিপে গানের তালিকাও দিয়েছিলেন এবং কিন্তু তালিকা সম্পূর্ণ হয়েছিল কি না বা অনুষ্ঠানটা তখন আয়োজন করা সম্ভব হয়েছিল কি না মনে পড়ছে না। তবে অনেক পরে তিনি ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মভূষণ খেতাবে ভূষিত হলে তাঁর সম্মানে আমরা চট্টগ্রামে একটা আলোচনা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম ২০১৪ সালের জুন মাসে। তাতে আলোচনার পরে আনিস স্যারের প্রিয় গান পরিবেশন করেছিল শুদ্ধ সংগীতচর্চার সংগঠন রক্তকরবীর সদস্যরা। অনুষ্ঠানে পরিবেশিত কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ করছি – দিনের বেলায় বাঁশি তোমার (রবীন্দ্রনাথ), তুমি অন্তহীন বিরাট (রজনীকান্ত), বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে (অতুলপ্রসাদ) ও আজি তোমার কাছে ভাসিয়া যায় (দ্বিজেন্দ্রলাল)। অনুষ্ঠানটা শেষ করেছিল শীলা রজনীকান্তের বেলা যে ফুরায়ে যায় গানটি দিয়ে।
তাঁর সঙ্গে আমার আরেকটি কাজ, যা তাঁর জীবনে শেষাবধি বজায় ছিল, যে-কাজে মাথার ওপরে তাঁকে না রেখে চালিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতে পারি না, কেননা সত্যিই তা কঠিন, সে-কথা বলে শেষ করব।

চার
পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরে, বিশেষত জেলহত্যার পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতা এবং তার জন্য পুরো জাতির এত সংগ্রাম ও ত্যাগের এই পরিণতি দেখে ভীষণ হতাশ হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলাম। তখন আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে শিশুদের নিয়ে প্রথমে নাটক মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিই এবং পরে ছোটদের সাংস্কৃতিক পাঠ ও চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগে মনপ্রাণ ঢেলে দিই। এভাবে ১৯৭৬ সালেই যাত্রা শুরু হয় শিশু প্রতিষ্ঠান ফুলকির। প্রথমে আমার মা চট্টগ্রামের পরিচিত নারীনেত্রী উমরতুল ফজল ছিলেন সভাপতি, দু-বছর পরে ১৯৭৮ সালে আমাদের অনুরোধে আনিস স্যার এ-পদ গ্রহণ করে, বলা বাহুল্য, কাজটার গুরুত্ব ও মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যতদিন চট্টগ্রামে ছিলেন এ-পদে পরিবর্তন আনার কথা আমরা ভাবিইনি। ১৯৮০ থেকে আমি সম্পাদক হলেও এর মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বরাবর ফুলকির সব পরিকল্পনা ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে আমাকে মুখ্য ভূমিকা নিতে হয়েছে। আর কাজটি বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রে থেকেছে শীলা, জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি। এই সময়ে ফুলকির জীবনে অনেক সংকট গেছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের জন্মস্থান চারুকলা কলেজ অঙ্গন ছেড়ে আসতে হয় ১৯৭৮ সালের প্রথমেই। সাময়িকভাবে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের – বর্তমান শিল্পকলা একাডেমির মহড়া ভবন – বারান্দায় ঠাঁই মেলে। সে-বছরের শেষে দুটি ছোট কক্ষ ও একটি অসমান উঠোন নিয়ে বর্তমান ৪৬ বৌদ্ধ মন্দির সড়ক, নন্দনকাননে আমরা উঠে আসি। স্থান নাড়াচাড়ায় ছাত্র যেমন কমেছে, শিক্ষক ও কর্মীদের বেশিরভাগ চারুকলা কলেজকেন্দ্রিক হওয়ায় তাদেরও অনেকেই আর যুক্ত হননি। এই কঠিন সময়ে আমরা নানাভাবে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করেছি এবং আনিস স্যার ফুলকির কল্যাণে যেকোনো অনুরোধ রক্ষা করেছেন। তাঁর নাম ব্যবহার করে চাঁদা তুলেছি, নতুন নতুন কার্যক্রম চালু করে ছাত্র ও আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। এই সময়ে ফুলকি চট্টগ্রামের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চার সাংগঠনিক কাজের দফতর ও যোগাযোগ কেন্দ্র হয়ে ওঠায় এসব উদ্যোগের সূত্রে ফুলকির পরিচিতি এবং উভয় দিকের একজন প্রধান সংগঠকের ভূমিকার জন্য আমারও যোগাযোগ ও পরিচয়ের পরিধি বাড়তে থাকে। আর এসব উদ্যোগের সাংগঠনিক অভিভাবক হিসেবে আনিস স্যার, যিনি ফুলকিরও সভাপতি, যুক্ত থাকায় ফুলকির দুঃসময়ে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীকে পেয়ে যাই, সংগঠনের পরিচিতি, গ্রহণযোগ্যতা সবই বাড়তে থাকে। মনে আছে কঠিন সময়ের এক পর্যায়ে ১৯৮০-র দিকে আমি ও শীলা হাল ছেড়ে দেওয়ার অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম। তখন আনিস স্যার শীলার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, বন্ধ করো না, আরেক বছর চেষ্টা করো। পরের বছর আমরা লেখাপড়ার স্কুল, ফুলকির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সহজপাঠ, চালু করি এবং সত্যিই এরপর, নানা বাধাবিঘ্ন এলেও, আর পিছু হটতে হয়নি, অর্থকষ্ট সঙ্গী হয়ে থাকলেও এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা ছাড়া অন্য চিন্তা মাথায়ই আসেনি।
এরপরে স্যার ঢাকায় গেলেও ফুলকির প্রয়োজনে, শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজে তাঁর সহযোগিতা, অংশগ্রহণ যখনই চেয়েছি, তিনি অকুণ্ঠিত চিত্তে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৮৬ থেকে দু-তিন বছর ধরে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করে যখন জমিটা কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখনো স্যারের চট্টগ্রাম আসার সুযোগ কাজে লাগিয়েছি। তাঁকে নিয়ে শহরের দু-একজন ধনী মানুষের বাড়িও গেছি। প্রসঙ্গত এ-কাজে স্মরণ করতেই হবে কামালভাইকে – চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বর্ণাঢ্য ব্যক্তি ডা. কামাল এ. খান – যাঁর যোগাযোগের সূত্র ধরেই অনেক ধনীর বাড়িতে ধরনা দিয়েছি। অনুরোধ জানালে বা প্রস্তাব দিলে আনিস স্যার সঙ্গে যেতে কখনো দ্বিধা করেননি, নির্দ্বিধায় আমাদের সঙ্গী হয়েছেন।
ফুলকিতে আমরা গোড়া থেকেই বলেছি যে, শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ না থাকা আমাদের শিক্ষার একটি বড় দুর্বলতা। সংস্কৃতি শব্দটা আমরা অবশ্যই কেবল এর ব্যবহারিক কলাচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিনি, এর সামগ্রিক জীবনশৈলী অর্থে ও তাৎপর্যে ব্যবহার করেছি। ফুলকিতে গোড়া থেকেই, সেই ১৯৮১ সাল থেকেই, শিক্ষা-সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করেই চলছে, স্কুলশিক্ষায় যে-ধারা পরে অনেকেই গ্রহণ করেছেন। পরে মূলধারার অন্যান্য স্কুলে এ-ধরনের সাংস্কৃতিক পাঠ ও অনুশীলনের গুচ্ছ-কার্যক্রম তৈরি করে প্রথমে চট্টগ্রামে ও পরে দেশের বিভিন্ন জেলায় নির্বাচিত স্কুলে চালু করি। সমন্বিত শিক্ষা-সংস্কৃতি কার্যক্রম নামে এটি এখনো চালু আছে। এ-কাজ জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য ঢাকায় বিভিন্ন সময় যত সেমিনার, মুক্ত আলোচনা, সংবাদ সম্মেলন করেছি সবটাতে আনিস স্যার উপস্থিত থেকে অংশ নিয়েছেন। একসময় শিক্ষার এই নতুন ধারা নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজের অভিপ্রায় থেকে আমরা গঠন করি বিদ্যাসাগর-রোকেয়া শিক্ষা ট্রাস্ট। এটিরও সভাপতি স্যার, আমি সম্পাদক। আজো এই কমিটিই বহাল রয়েছে, করোনার কারণে ট্রাস্টি বোর্ড তো অনেকদিন বসতেও পারেনি। এই ট্রাস্টের বেশিরভাগ সভা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় কক্ষে হয়েছে, শেষ কয়েক বছর সব সভাই অবশ্য স্যারের বাসাতে আয়োজিত হয়েছে। প্রতিবার সভার দিনে সকালে ফোন করে জানতে চাইতেন, মোমেন, তোমার সভায় কতজন উপস্থিত হবে? বিকেলে বাসায় গিয়ে গরম শিঙাড়া, কেক দেখে বুঝতাম সংখ্যাটা আগে জানা কেন জরুরি।

পাঁচ
তাঁর চট্টগ্রাম ত্যাগের সিদ্ধান্তটা শহরে আমাদের কাছে একটু আকস্মিকভাবেই এসেছিল। নিশ্চিন্ত আশ্রয় আকস্মিকভাবে সরে যাওয়ার বা হারানোর বাস্তবতা চিন্তা করাও ছিল তখন কঠিন। চট্টগ্রামে নানা মহল থেকে তাঁকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অনুরোধ, কখনো দাবি, জানানো নয়। ক্রমে বুঝতে পারি এ-সিদ্ধান্ত অপরিবর্তনীয়, ভেবেচিন্তে সময় নিয়েই তিনি নিয়েছেন। আগেও স্বাধীনতার পরে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যোগী হলেও তা নানা কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বোঝা গেল এবারের সিদ্ধান্ত পাকা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে – কেবল তাঁর বিভাগ নয়, অন্যান্য বিভাগের ছাত্রদেরও প্রবল আপত্তি, জোরালো দাবি, অসহায় বেদনার্ত অনুরোধ উঠেছিল, তা ঠেলে এককথায় ঠাঁই নাড়ানো সহজ হয়নি। দূরে থেকে একেক সময় মনে হয়েছে বোধহয় সিদ্ধান্ত তাঁকে পালটাতে হবে, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও। শুনেছি ছাত্ররা অনশন ধর্মঘটেরও হুমকি দিয়েছিল, কেউ কেউ তাঁর দাবির পথ অবরোধ করে কথা না নিয়ে অনির্দিষ্টকাল অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছিল। তবে স্থিতধী দূরদর্শী মানুষটি তাঁর ভাবনা থেকে সরেননি। দিনে দিনে দেশ যেভাবে ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে, এবং দিনে দিনে মেধাবী প্রগতিশীল শিক্ষকদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার হিড়িক এতই বেড়েছিল এবং শিবির-অধ্যুষিত ক্যাম্পাসের পরিবেশ যেভাবে পালটেছে তাতে, আজ মনে হয়, মনে হয় তাঁর সেদিনের সিদ্ধান্ত সময়োচিতই হয়েছিল – তাঁকে কেন্দ্রে থেকেই জাতীয় পরিসরে ভূমিকা পালন করতেই হতো। তাঁর মতো কর্মীসংলগ্ন, কর্মোদ্যোগী, সাহসী বিচক্ষণ বুদ্ধিজীবীকে পেয়ে দুর্যোগময় সময়ে দেশকে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার যে-সংগ্রাম তা উপকৃত হয়েছে। তাঁকে কাছে পাওয়ার নিশ্চয়তায় থেকে আমরা কখনো তা বিবেচনায় তো নেই-ই নি, হয়তো অনুভবই করতে পারিনি যে চট্টগ্রামবাসের দীর্ঘ ষোলো বছরে বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় ফেরার জন্য তাঁর ওপর কী ধরনের চাপ ছিল। কিন্তু তা যে ছিল সে-কথা ভাবতে না পারার কারণ নেই। তা যে যথেষ্ট ছিল সে-কথা ভালোভাবে বুঝতে স্যারের ঢাকায় থাকার গুরুত্ব তুলে ধরেন একবার ঢাকায় অর্থনীতিবিদ ড. মোশাররফ হোসেনের বাসায় একটি ছোট্ট ঘরোয়া বৈঠকে উপস্থিত থাকার সুবাদে। একটু বিলম্বে স্যার উপস্থিত হলে গৃহকর্তা স্বয়ং এবং ঘটনাচক্রে সেখানে উপস্থিত বাম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরও কথাটায় সায় দিয়েছিলেন।
আনিস স্যারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিনই ছিল। কেননা কেবল শিক্ষক বা বিপুল ভাবমূর্তির আকর্ষণে তিনি ছাত্রদের মধ্যেই প্রবল আকর্ষণ তৈরি করেননি, তাঁর আরো দক্ষতা-সক্ষমতার সঙ্গে সহকর্মীদের পরিচয় ঘটেছিল, তাঁর ওপর নিশ্চিত নির্ভরতাও তৈরি হয়েছিল। স্বভাবতই তাঁদের দিক থেকে সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য আবদার, অনুরোধ, দাবি উঠেছিল। কেবল বিবৃতি, ঘোষণা, আমন্ত্রণপত্রের খসড়া নয়, তিনি প্রশাসনিক, দাফতরিক কাজেও ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী, দক্ষ। যে-কোনো প্রশাসনিক ড্রাফট, সভার বিবরণী, প্রস্তাব, সিদ্ধান্ত, ফাইলে মন্তব্য, সুপারিশ ইত্যাদি রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আমাকে অনেকেই পরে বলেছেন, দাফতরিক কাজের যাবতীয় খসড়া রচনায় তাঁরা আনিস স্যারের কাছেই তালিম পেয়েছেন। অনেকের সরল স্বীকারোক্তি ছিল, তাঁর ভূরি ভূরি সংশোধনী, পরিমার্জনা দেখেও সেই মানের দাফতরিক খসড়া রচনার দক্ষতা তাঁদের অর্জিত হয়নি। যোগদানের পর থেকেই স্যার বিভাগীয় প্রধান, অনুষদের ডিন, হলের প্রাধ্যক্ষ বা অন্যান্য প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। কখনো এ নিয়ে কথা ওঠেনি। ছোটবড় সবার সঙ্গে স্যারের সম্পর্ক হতো আন্তরিক, গভীর। এসব সম্পর্ক কতটা আন্তরিক, কতটা গভীর ছিল তা বোঝা যায় যখন মেয়ের বিয়েতে তিনি বিভাগের পিয়ন থেকে যে-রিকশায় ছোটবেলায় কন্যা স্কুলে যেত সেই রিকশার চালককেও নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং তারাও রেলের একটি গোটা কম্পার্টমেন্ট সংরক্ষণ করে দলবেঁধে ঢাকায় গিয়ে আনন্দে সেই বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন।
শহরে আমরা ঠিক করেছিলাম, তাঁর জন্য আমরা তাড়াহুড়া করে প্রথাগত বিদায় অনুষ্ঠান আয়োজন করব না, কারণ তিনি তো আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন, বরাবর চট্টগ্রাম আসবেনই। যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক, চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে, এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অজানা মহল থেকে একটি বেনামি প্রচারপত্র বিলি হলো। সেটি শহরেও কারো কারো কাছে ডাকে পাঠানো হয়। দেখলাম সেটি একেবারে নোংরা কথায় পরিপূর্ণ। আমাদের মনটা তেতো হলো, দুঃখে ভরে গেল – এ কেমন রুচি, এমন নোংরা মনের মানুষেরও বাস আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে? ভাবতেও পারা যায় না। জানি স্যার থাকবেন অবিচলিত, নিজের পথে নিঃসংশয়, এ-মালিন্য তাঁকে স্পর্শ করবে না। তবুও ক্ষত তো একটা নিশ্চয় হয়েছে, হৃদয়ে ক্ষরণ নিশ্চয় হচ্ছে। আমরা দ্রুত আনিস স্যারের বিদায় উপলক্ষে চারুকলা কলেজের মনোরম প্রাঙ্গণে (এখন আর তা নেই, পুরো জায়গাটাই ভবনে আকীর্ণ) দিনব্যাপী প্রীতি-সমাবেশের আয়োজন করেছিলাম। সব মহলের গুণগ্রাহী এবং আমাদের কর্মীবাহিনীকে তাতে উপস্থিত করেছিলাম। গান, খাওয়া-দাওয়া এবং ছোট ছোট আড্ডায় সময়টা ভালোই কেটেছিল।
তাঁকে কেবল একবার বিচলিত দেখেছি আমি ঢাকাগামী রাতের মেইলে ওঠার আগে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। বিদায়ী যাত্রার আগে অকস্মাৎ খবর পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গে সঙ্গে যোগ দেওয়া যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে, কেন? কারণ এরশাদ সরকার নাকি নতুন নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় তাঁর পক্ষে তখন যোগ দেওয়া সম্ভব হবে না, এমনটা জানিয়েছেন তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শামসুল হক। এদিকে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিলিজ চেয়ে চিঠি দিয়ে দিয়েছেন। যেন আকস্মিক একটা অনিশ্চয়তা – চাকরির অনিশ্চয়তা – এবং একটা অনভিপ্রেত অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে তাঁকে সেদিন সত্যিই বিচলিত দেখাচ্ছিল। বিচলিত হওয়ার বড় কারণ, তাৎক্ষণিক ও সাময়িক বিপদমুক্তির জন্য পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর অনুরোধ তখনকার কর্তৃপক্ষ রাখেনি। ফলে অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই তাঁকে সপরিবারে ঢাকা-যাত্রা করতে হচ্ছিল। ভেতরের খবর আমার জানা ছিল না, তবে খানিকটা খোঁজখবর নিয়ে বুঝতে পেরেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ – তখন উপাচার্য ইংরেজি বিভাগের বর্ষীয়ান শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী – এ-সময় তাঁর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াননি, তা পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন হিতৈষী সিন্ডিকেট সদস্যের কাছ থেকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অভ্যন্তরীণ শিক্ষক রাজনীতির দ্বন্দ্ব, এবং তারও চেয়ে বেশি, স্যারের খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা-জনপ্রিয়তা, বিশেষত চট্টগ্রামের মানুষ না হওয়া সত্তে¡ও ক্যাম্পাসে ও নাগরিকসমাজে তাঁর এমন সম্মান-ভালোবাসায় প্রবীণদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন। সম্ভবত তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এসব অসংগত অনভিপ্রেত ঘটনার মাধ্যমে।
শেষ করি একটি কথা বলে। অন্য অনেকের মতো তাঁর অন্যতম গুণগ্রাহী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক গোলাম মুস্তাফাও তাঁকে যখন একবার অনুরোধ করেছিলেন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাছবিচার করার জন্য এবং সম্ভব হলে বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই পরিহার করতে, তখন তিনি নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, মোমেন অনুরোধ করলেও যাব না?
তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সাংগঠনিক কাজের নানা স্মৃতির মাধুর্যকে ছাপিয়ে তাঁর এ-উক্তিটি আমার জন্য বড়ই স্বস্তিদায়ক, তৃপ্তিকর, আনন্দদায়ক। আজীবন তিনি অনেক মানুষকেই স্বস্তি দিয়েছেন, তৃপ্ত করেছেন এবং আনন্দে রেখেছিলেন। সৌভাগ্যবান আমি তার বাইরে নই।