চারটি প্রিয় রচনা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

 

আমার প্রিয় চারটি রচনার খোঁজ করতে হলো কলকাতার বোরক পত্রিকার সম্পাদকের বিশেষ অনুরোধে। তিনি চাইছেন বাংলা বই ও বইপড়া নিয়ে পত্রিকার একটি সংখ্যা বের করবেন এবং সেজন্য আমাকে বলেছেন আমার পছন্দের এমন কয়েকটি বইয়ের ওপর লিখতে যেগুলো খুব বিখ্যাত নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ বটে।  অনেক ক’টি কথা মনে পড়লো, শেষ পর্যন্ত তালিকা দাঁড়াল চারটিকে নিয়ে। এগুলো হচ্ছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রামের সুমতি’ (১৯১৪), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ (১৯৪৫), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’ (১৯৪৮) এবং শিবরাম চক্রবর্তীর মস্কো বনাম পন্ডিচেরী (১৯২৯)। এদের সবক’টি যে স্বতন্ত্র বই, তা নয়, ‘নয়নচারা’ ও ‘হারানের নাতজামাই’ ছোটগল্প; রামের সুমতি ও মস্কো বনাম পন্ডিচেরী বইয়ের আকারে বের হলেও বড় আকারের রচনা নয়, প্রথমটি একটি বড় গল্প, দ্বিতীয়টি একটি প্রবন্ধ।

গল্প তিনটিকে প্রকাশের সাল ধরে সাজানো গেল, প্রবন্ধটিকে রাখতে হলো আলাদা করে। এই চারজন লেখক সমান মাপের নন, তাঁরা সবাই এক ধরনের লেখা যে লেখেননি সেটা তো জানাই আছে আমাদের, তবে তাঁরা পরস্পরের কাছাকাছি সময়ের মানুষ, রচনাগুলো প্রকাশের সময়কাল চার দশকেরও কম; এবং পড়তে গিয়ে দেখা গেলো রচনা চারটির ভেতর একটা ঐক্য আছে। সেটা হলো ক্ষমতার প্রশ্ন। বস্ত্তত রচনা চারটিকে নিয়ে আমার এই লেখাটির যদি বিকল্প শিরোনাম দিতে হয় তবে সেটা হতে পারে ‘বাঙালির জীবনে ক্ষমতার প্রশ্ন’। ক্ষমতা নিয়ে জিজ্ঞাসাটা আগেও ছিল, এখনো রয়ে গেছে।

 

দুই

শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ পড়েছেন অথচ চোখ ভেজান নি, এমন পাঠকের সংখ্যা বিরল। কিশোর বয়সে অনেকের সঙ্গে আমারও ওই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এত বছরে আবার পড়তে গিয়ে দেখলাম শরৎচন্দ্রের খুব একটা স্বাভাবিক শক্তি ছিল পাঠকের হৃদয়কে আর্দ্র করবার। এমন দক্ষতা অন্য লেখকদেরও নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু শরৎচন্দ্রের যতটা ছিল ততটা আর কারো মধ্যে দেখা যায় না। ‘রামের সুমতি’র সীমিত পরিসরে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে, সবগুলোই স্বাভাবিক, এবং সবক’টিই রাম ও তার বৌদিকে ঘিরে। বৌদিটির নাম নারায়ণী; তাঁর বয়স যে অনেক হয়েছে তা নয়। মাত্র তিনি ছাবিবশে পড়েছেন, রামের বয়স এখন ষোলোর কাছাকাছি; সম্পর্কটা হতে পারতো ভাই-বোনের, কিন্তু হয় নি যে তার কারণ দুজনের বিশেষ পরিস্থিতি। নারায়ণী যখন শ্যামলালের ঘরে আসেন স্ত্রী হয়ে তখন তার বয়স তেরো, পুতুল খেলার ওই বয়সে তাঁর ঘাড়ে এসে পড়ে সংসারের সকল ভারসহ রামকে পালনের দায়িত্ব। রামের বয়স তখন মাত্র আড়াই। রামকে রেখে রামের মা, অর্থাৎ নারায়ণীর শাশুড়ি, তাঁর সংক্ষিপ্ত বৈধব্য জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। তারপর থেকে রামকে নারায়ণীই লালনপালন করে আসছেন। তাঁর নিজেরও একটি পুত্রসন্তান আছে, কিন্তু নারায়ণী আপন সন্তানকে যতটা না সময় দেন তার চেয়ে বেশি সময় দেন তাঁর এই দেবরটিকে। নারায়ণীর ছেলের নাম গোবিন্দ, সে রামের দারুণ ভক্ত। কাকুর সঙ্গে সে ছায়ার মতো থাকে।

রাম যে দুষ্টুমিতে পাকা সেই কথা দিয়েই গল্পের শুরু। রামের এসব দুষ্টুমিতে নারায়ণী যে বিরক্ত হন না, তা নয়, রাগও করেন, কিন্তু রাম যা কিছু করে ও করতে পারে তা নারায়ণীর প্রশ্রয়ের কারণেই। তার জীবনে বৌদির চেয়ে বড় কেউ নেই। আসলে রামের তো কেউই নেই। বাবা নেই, মা নেই, মাসি-পিসি কেউ নেই। যে-শ্যামলালের সংসারে সে মানুষ হচ্ছে তিনিও রামের আপন ভাই নন; সৎভাই। নারায়ণীর কাছে রামের দুষ্টুমি অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না, তাঁর কাছে রাম এখনো দুধের বালক, তার বয়স বাড়ে নি, বাড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে; রামকে তিনি মায়ের চোখে দেখেন। আপন মা জীবিত থাকলেও অতটা আদরযত্ন রাম পেত কি না সন্দেহ যতটা সৎবৌদির কাছ থেকে সে পায়; এবং সে নিজেও হয়তো তার নিজের মাকে অতটা ভালোবাসতে পারতো না যতটা সে তার এই বৌদিকে ভালোবাসে।

হিসাব করলে দেখা যাবে, শরৎচন্দ্রের এই বড় গল্পটির প্রধান চরিত্র রাম নয়, প্রধান চরিত্র নারায়ণীই। নারায়ণী আছে বলেই রাম আছে, না-থাকলে বা ভিন্নভাবে থাকলে রামের জীবনকাহিনি মোটেই উল্লেখযোগ্য হতো না; রামের হয়তো-বা বনবাসই ঘটতো। রাম না থাকলেও নারায়ণী কিন্তু থাকতেন। তাঁর সংসারে তিনিই প্রধান। স্বামী শ্যামলাল কর্তৃত্ব করতে আসেন না। তার আসল কারণ নারায়ণীর ব্যক্তিত্ব। সে-ব্যক্তিত্বে যেমন স্নেহ আছে, তেমনি রয়েছে দৃঢ়তা এবং কর্তব্যপালনের অভ্রান্ত নৈতিকতা। নারায়ণীর ব্যক্তিত্বের কাছে সকলেই নত থাকে, স্বামীসহ। স্বামী তো মনে মনে তাঁকে ভয়ই করেন।

সংসারের সব দায়িত্বপালন নারায়ণীকে একাই করতে হয়, এ নিয়ে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই; কিন্তু নারায়ণী যেটা মোটেই সহ্য করবেন না সেটা হলো তাঁর কর্তৃত্বে অন্যের হস্তক্ষেপ। সব ক্ষমতা নারায়ণীর হাতে নেই, থাকবার কথাই ওঠে না। কেননা সংসারটা তাঁর নয়, তাঁর স্বামীর; কিন্তু স্নেহ-মমতা ও কর্তব্যপরায়ণতার ভেতর দিয়ে নিজেকে এমনভাবে ছড়িয়ে রেখেছেন যে তাঁকে মান্য না করে উপায় নেই।

শ্যামলাল দরিদ্র নন, কিন্তু তাই বলে যে অত্যন্ত সচ্ছল তাও নয়। তাঁর বাড়িতে পুকুর আছে, জমিজমা আছে, সবকিছুই পেয়েছেন পৈতৃক সূত্রে, কয়েক ঘর বাগদী প্রজাও রয়েছে, নগদ টাকাও আছে অল্পস্বল্প, কিন্তু তবু তাঁকে চাকরি করতে হয় জমিদারের কাছারিতে, যে জন্য জমিদারের মন জুগিয়ে চলা ভিন্ন উপায় থাকে না। নারায়ণী সবকিছু একাই করেন। রান্নাবান্না, তরকারি কোটা, কাজের লোকদের খাটানো, স্বামী, সন্তান ও দেবরের দেখাশোনা। স্নান করতে তাঁকে যেতে হয় নদীর ঘাটে, স্নান সেরে কলসি ভরে নিয়ে আসেন খাবার জল। এসব নিয়ে তাঁর কোনো অনুযোগ নেই। তাঁর নানাবিধ কাজকর্ম তাঁকে বরং চরিতার্থতাই দেয়।

কিন্তু গোলযোগের সৃষ্টি করেন অন্য কেউ নয় নারায়ণীর নিজের মা। নারায়ণীর মাও দুঃখিনী। তিনি একান্তই ক্ষমতাহীন। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন, তাঁর ছোট মেয়েটির বয়স মাত্র দশ। বিধবা অবস্থায় এই মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের আশ্রয়ে কোনোমতে টিকে ছিলেন, হঠাৎ করে সেই ভাইটিও মারা যাওয়াতে তাঁর আর কোনো আশ্রয় রইলো না। এ ক্ষেত্রেও কর্তব্যপালনে নারায়ণীর সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটে নি। স্বামীকে সম্মত করিয়ে মা ও বোনকে তিনি নিজের সংসারে নিয়ে এসেছেন।

কিন্তু গোল বাধলো এর পরেই। ক্ষমতাবঞ্চিত বিধবা মা কন্যার সংসারে নিতান্ত আশ্রিতা হিসেবে থাকতে রাজি হলেন না। নারায়ণীকে না-মেনে উপায় নেই, কিন্তু রামকে তিনি মেনে নেবেন কেন? রাম কে? সে তো নারায়ণীর দেবর মাত্র, তাও আপন নয়, বৈমাত্রেয়। নারায়ণীর সংসারে রাম যে অতটা জায়গা দখল করে থাকবে এটা সহ্য করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়লো। রামকে তিনি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে পেলেন, এবং ছেলেটিকে কীভাবে আশ্রয়চ্যুত করা যায় সে-কাজে যতরকম তৎপরতা সম্ভব ছিল সবই করতে থাকলেন। লজ্জা-সংকোচের ধার ধারেন নি; কখনো কখনো আচরণ করেছেন নিতান্ত হাস্যকর। তবে শেষ পর্যন্ত সফল হলেন। শ্যামলাল রামলালকে আলাদা করে দিলেন। ঘর ভাগ হলো, উঠানে বাঁশের শক্ত বেড়া পড়ল, এমনকি রান্নাঘরটিও বিভক্ত হয়ে গেল।

এর আগে একবার বাড়ি ভাগাভাগির কথা উঠেছিল। রামের দুষ্টুমিতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে শ্যামলালই প্রস্তাবটা করেছিলেন। নারায়ণী সেটাকে নাকচ করে দিয়েছেন। বলেছেন, ওকথা মুখেও এনো না। যোগ করেছেন, ‘কাকে নিয়ে ও পৃথক হবে? মা আছে না বোন আছে, না একটা মাসি-পিসি আছে? ওকে রেঁধে খাওয়াবে কে?’ বিষয়-সম্পত্তি আয়-রোজগারের প্রসঙ্গ তোলেন নি, বলেছেন, রেঁধে খাওয়াবে কে? খাওয়া ও খাদ্য অতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই জীবনে। শরৎচন্দ্র তাঁর কথাসাহিত্যে খাবার-দাবারের ওপর খুবই গুরুত্ব দেন; কিন্তু সেটা অবাস্তবিক কিছু নয়, বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে রান্নাবান্না, খাওয়া, যত্ন করে খাওয়ানোর যে-স্থান সেটাই তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে। নারায়ণীর দৃষ্টি এবং তাঁর মাতা দিগম্বরীর দৃষ্টি এক্ষেত্রে অভিন্ন।

আর নারায়ণী যে রামের পুরুষ আত্মীয়ের অভাবের কথা বললেন না, বললেন কেবল মা-বোন, মাসি-পিসি না থাকার কথা সেটাও খুবই বাস্তবসম্মত উক্তি। বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীনদের সংসারে নারীর যে-ভূমিকা তা সবসময়ে দৃশ্যমান নয়, তবে সর্বদাই মুখ্য। পুরুষ আয় করে, স্বীকৃত কর্তৃত্ব পুরুষেরই, কিন্তু সংসার চালু রাখার দায়িত্ব মেয়েদেরই। শ্যামলাল কর্তা, কিন্তু ভেতরের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব তাঁর নয়, সেটা তাঁর স্ত্রী নারায়ণীর। ওই ভাগাভাগি প্রসঙ্গেই নারায়ণী তাঁর স্বামীকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন :

দেখ, তের বছর বয়সে মেয়েরা যখন পুতুল খেলে বেড়ায় তখন মা আমার মাথায় সংসারটা ফেলে স্বচ্ছন্দে স্বর্গে চলে গেলেন। তিনি দেখছেন এ ভার আমি বইতে পারি কি না। রেঁধেচি-বেড়েছি ছেলে মানুষ করেচি, লোক-লৌকিকতা কুটুম্ব সংসার সমস্ত এই একটা মাথায় বয়ে বয়ে আজ ছাবিবশ বছরের আধ-বুড়ো মাগী হয়েছি। এখন আমার সংসার ঘরকন্নার মধ্যে যদি হাত দিতে এস, সত্যি বলছি তোমাকে, ডুব দিয়ে মরব।

শ্যামলাল আর কথা বাড়াবার সাহস করেন নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রামকে আলাদা করে দিতে হয়েছে। নারায়ণী সেটা ঠেকাতে পারেন নি। মহৎ সাহিত্য সমাজবাস্তবতাকে ধারণ করে, এবং ধারণ করে বলেই মহৎ হয়। ‘রামের সুমতি’তেও এই বাস্তবতাটা আছে। নারায়ণীরা যতই চান না কেন একান্নবর্তী পরিবারকে রক্ষা করতে পারবেন না, সেটা ভেঙে পড়বেই। স্বার্থ তো আছেই, খুব কার্যকরভাবে আছে প্ররোচনা; এক্ষেত্রে সেটা জুগিয়েছেন নারায়ণীর মাতা দিগম্বরী। এটা অনেকটা সাতচল্লিশের দেশভাগের মতোই ঘটনা। সাধারণ হিন্দু ও মুসলমান কেউ চায় নি, কিন্তু তবু ভাগ হয়েছে, কারণ সুবিধাভোগী ও সুবিধালোভীরা সেটা চেয়েছে, এবং প্ররোচনা এসেছে তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে। দেশভাগের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষটা ছিল ইংরেজ; নারায়ণীর স্বামী ও দেবরের ভাগাভাগিটার ক্ষেত্রে তৃতীয়পক্ষ হচ্ছেন দিগম্বরী। তাঁর স্বার্থ ছিল, রামমুক্ত সংসারে আপন ক্ষমতা বাড়বে – এমন আশা তিনি পোষণ করতেন।

ঘরবাড়ি ভাগ হলো, রাম বিপদে পড়লো, এবং অন্যত্র চলে গেলে বৌদি খুশি হবেন মনে করে ছোট্ট একটি পোটলা নিয়ে সে অজ্ঞাত ঠিকানায় মামাবাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। এ দৃশ্য বড়ই করুণ। রাম যদি সত্যি সত্যি চলে যেত সেটা ট্র্যাজিক হতো ঠিকই, কিন্তু রাম  রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার বৌদির কাছে পথখরচার টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে এটা জেনে নারায়ণী যখন সব মান-অভিমান দূরে ঠেলে তাকে ডেকে ঘরে নিয়ে এলেন তখনকার দৃশ্যটা দাঁড়ায় অনেক বেশি হৃদয়স্পর্শী। এমন যদি হতো যে রাম চলে গেছে, তাহলেও তার কিছু বিষয়সম্পত্তি আছে, তার মামারা হয়তো তার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন; নারায়ণী কাতর হবেন, কিন্তু মেনে নেবেন, এরকমের কিছু একটা ভেবে পাঠক তাঁর নিজের সংবেদনশীল হৃদয়কে নিজের অজান্তেই হয়তো শান্ত করতে পারতেন, কিন্তু সমস্ত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নারায়ণী যখন ক্রন্দনরত রামকে বুকের কাছে টেনে নিলেন, কোলে নিয়ে যত্ন করে তৈরি খাবার খাইয়ে দিতে শুরু করলেন তখন বাঙালি পাঠকের পক্ষে অশ্রু সংবরণ করা সত্যই কঠিন হয়ে পড়ে।

শেষের ওই দৃশ্যটা ভুলবার নয়। নারায়ণী নিজের মাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, বলছেন এখন একটু সামনে থেকে যাও, ছেলেটাকে খাইয়ে দিই, এবং মা যখন বলছেন যে, ওই অবস্থায় তাঁর পক্ষে আর মেয়ের বাড়িতে থাকা হবে না, তখন নারায়ণী বলছেন,

আমিও এই কথাটাই তোমাকে মুখ ফুটে বলতে পারছিলুম না মা, সত্যি তোমার এখানে থাকা হবে না। তোমার চোখে চোখে আমার এত বড় ছেলে যেন আধখানা হয়ে গেছে। ও যে হোক যা হোক আমার বাড়িতে আমার চোখের সামনে ওকে শাস্তি দিতে আমি কাউকে দেব না। আজ তুমি থাক, কাল কিন্তু বাড়ী যেয়ো। তোমার খরচপত্র আমি সমস্ত পাঠিয়ে দেব কিন্তু এখানে তোমার আর থাকা হবে না।

মাতা দিগম্বরীর কাছে কন্যার এই আচরণ অবিশ্বাস্য,

দিগম্বরী কাঠ হইয়া কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন। রাম বুকের ভিতর হইতে আস্তে আস্তে বলিল, না, বৌদি, উনি থাকুন, আমি ভাল হয়েচি, আমার সুমতি হয়েচে – আর একটি বার তুমি দেখ।

তখন

নারায়ণী আর একবার তাহার মুখ ধরিয়া ললাটে ওষ্ঠাধর স্পর্শ করিয়া চোখের জলের ভিতর দিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তুই এখন ভাত খা।

শরৎচন্দ্র বাস্তববাদী কথাসাহিত্যিক। নিজের দূরত্ব বজায় রেখে তিনি তাঁর গল্পের মানুষগুলোকে দেখছেন, কিন্তু তাঁর পক্ষপাত যে কোন দিকে তা লুকানো থাকে নি। গল্পের প্রয়োজনে দিগম্বরীর প্রতি তাঁর অপক্ষপাত ঘটেছে। বস্ত্তগতভাবে দিগম্বরী একেবারেই ক্ষমতাহীন, নিঃস্ব; ক্ষমতা অর্জনের জন্য তাঁকে সর্বদাই ব্যস্ত থাকতে হয়। সে-ব্যস্ততার বর্ণনা বড় উজ্জ্বল। বিশেষ করে নারায়ণীর স্নেহ-ভালোবাসা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পটভূমিতে।

একদিন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, রাম স্কুল থেকে ফেরেনি, উৎকণ্ঠিত ক্রোধে নারায়ণী অধীর হয়ে উঠেছেন।

এমন সময় দিগম্বরী নদী হইতে গা ধুইয়া, সংসারের সংবাদ লইয়া, রামের অমঙ্গল কামনা করিয়া, বড় মেয়ের মতিবুদ্ধির অবশ্যম্ভাবী ফলাফল প্রতিবাসিনীদের কাছে ঘোষণা করিয়া, শোকে তাপে অসময়ে অল্পবয়সে নিজের মাথার চুল পাকাইবার কারণ দর্শাইয়া নিজেকে বড় মেয়ের প্রায় সমবয়সী বলিয়া প্রচার করিয়া, ভাইয়ের সংসারে কিরূপ সবর্বময়ী ছিলেন তাহার বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস বলিয়া ধীরে সুস্থে বাড়ি ফিরিতেছিলেন, এমন সময় পথিমধ্যে এক কান্ড শুনিয়া তিনি উড়িতে উড়িতে বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিলেন।

এই বাক্যে দিগম্বরীর কর্মতৎপরতার হঠাৎ মোড়-নেওয়াটা তুলে ধরবার প্রয়োজনে ‘এমন সময়’ কথাটা দুবার এসে গেছে।

কাহিনীর বয়ানে রাম এবং তার প্রতিপক্ষ দিগম্বরী উভয়ের  ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বর্ণনার ক্ষেত্রেই কিছুটা অতিরেক আছে এমনটা বলা যাবে। সেটা ঘটেছে একজনের প্রতি পক্ষপাত এবং অপরজনের প্রতি কৌতুকমিশ্রিত বিরূপতার কারণে। লেখক মনে হয় কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছেন রামের বয়সের ব্যাপারটা নিয়ে। হিসাবমতো তার বয়স ষোলোর কাছাকাছি হবার কথা। ওই বয়সের কিশোরের পক্ষে বৌদির কোলে বসে ভাত খাওয়াটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলা কঠিন। কাজের মেয়ে নৃত্যকালীর চোখে রামের বয়স বারো তেরো, কিন্তু তদ্সত্ত্বেও অর্থাৎ বারো-তেরো হওয়ার পরেও তার জ্ঞানবুদ্ধির ‘স্বাভাবিক’ বৃদ্ধি না দেখে নৃত্যকালী বিস্মিত।

‘রামের সুমতি’র কাহিনিটি এগোয় সংলাপের মধ্য দিয়ে। রামের একটি উক্তি আমার নিজের কৈশোরিক স্মৃতিতে বিশেষভাবে উজ্জ্বল ছিল। নানা রকমের নালিশ শুনতে শুনতে উত্ত্যক্ত হয়ে নারায়ণী বলছেন, ‘কোনদিন কি একটু সুমতি হবে না? লোকের কথা যে আমি আর সহ্য করতে পারিনে।’ শুনে রামলাল বলছে, ‘কে লোক তার তার নাম বল।’ ওই উক্তিটি পুনরায় পাঠ করে মনে হলো পরিচিত জনের সাক্ষাৎ পেলাম।

আরেকটি উক্তিও স্মরণে রাখবার মতো। সেটি রামের নয়, নারায়ণীর। দিগম্বরী হামেশাই রামের চূড়ান্ত সর্বনাশ কামনা করেন। সেদিন মাত্রাটা একটু বেশিই হয়েছিল। প্রতিক্রিয়ার বর্ণনাটি এ-রকমের,

কাছে বসিয়া নারায়ণী তরকারী কুটিতেছিলেন। তিনি বিদ্যুৎবেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন, মা।

এরপরে শরৎচন্দ্রের মন্তব্য, ‘শুনিয়াছি সন্তানের মুখে মাতৃসম্বোধনের তুলনা নাই। নারায়ণীয় মুখে মাতৃসম্বোধনের আজ বোধ করি তুলনা ছিল না। ঐ এক ডাকে দিগম্বরীর বুকের রক্ত হিম হইয়া গেল। কিন্তু নারায়ণীও আর কিছু বলিতে পারিলেন না। দেখিতে দেখিতে তাঁহার দুইগন্ড বাহিয়া টপ্ টপ্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।’

 

তিন

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গল্পটিতে দুঃখ আরো গভীর। এতো গভীর যে সেখানে চোখ বেয়ে যে কান্না ঝরে পড়বে এটাও সম্ভব নয়; চোখের পানি ভেতর থেকেই শুকিয়ে গেছে, কষ্টের তাপে।

সাধারণ বাঙালির জীবনে খাদ্যের প্রাচুর্য কবে ছিল জানি না, এমনকি আধুনিককালেও তো প্রাচুর্যের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। ‘নয়নচারা’র পটভূমিটা দুর্ভিক্ষের। দুর্ভিক্ষের নয়, মন্বন্তরের। পঞ্চাশের মন্বন্তরের, যাকে গণহত্যাও বলা হয়। ভিক্ষা দেবারও লোক নেই; অনাহারে, মৃত্যুভয়ে, খাদ্যশূন্য গ্রাম থেকে মানুষ পালিয়ে এসেছে শহরে। অসংখ্য মানুষ। ‘ফুটপাথে ওরা সব এলিয়ে পড়ে রয়েছে। ছড়ানো খড় যেন।’ খড়ের মতোই শুকনো, অসহায়, ক্ষমতাহীন। শরৎচন্দ্রের গল্পটিতে গ্রামীণ পরিবারের পরিধির ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বটা প্রবল ছিল, ওয়ালীউল্লাহর গল্পে পারিবারিক দ্বন্দ্ব আর সম্ভব নয়। মন্বন্তরে পীড়িত যে-মানুষেরা খাদ্যের খোঁজে রাজধানীতে চলে এসেছে তাদের পরিবার নেই, পরিচয় নেই; একান্নবর্তী পরিবার তো অকল্পনীয়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবারও নেই। এখানে কোনো দিগম্বরীর সন্ধান পাওয়া যাবে না, তবে পাওয়া যাবে নামহীন, পরিচয়হীন ভূতনিকে, অনাহারে শুকিয়ে যে ভূতের মতো হয়ে গেছে, যার ভাই ‘ভূত’ মারা গেছে। ভূতনি শুধু কাঁদতে পারে, ভাইকে সহায়তা দেবে এমন ক্ষমতা তার বিন্দু পরিমাণ নেই। সে নিজেও অচিরেই মারা যাবে, ধরে নেওয়া যায়। মৃত্যু তার সন্ধান পেয়েছে, মৃত্যু তাকে ছাড়বে না।

‘রামের সুমতি’ পাঠককে কাঁদায়; ‘নয়নচারা’র সে-ক্ষমতা নেই। তার কারণ এই নয় যে, শরৎচন্দ্র অনেক বড় লেখক ওয়ালীউল্লাহর তুলনায়। কারণ এই যে, এখানে যে-জীবনের কথা আছে সে-জীবনে ক্ষুধার যন্ত্রণার দাপটে অন্যসব অনুভূতি শক্তিহীন হয়ে পড়েছে, এখানে মানুষগুলো আর কাঁদে না, তারা আর্তনাদ করে। আর্তনাদ শুনলে অন্য মানুষের কান্না আসে না, জন্ম হয় ভয়ের।

গল্পের নায়ক আমু। ভূতনির মতো সে-ও পৌঁছে গেছে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। বয়স মনে হয় বেশি নয়। তবে কত তা আমরা জানি না। কিন্তু দেখতে পাই তার শুকনো দেহে প্রাণের কিছুটা এখনো অবশিষ্ট আছে, যে জন্য সে হাঁটতে পারে। নানা কিছু কল্পনাও করে সে তন্দ্রার মধ্যে। আমু রাম নয়। মন্বন্তরের সময় রামলালরা শহরে আসে নি, তারা হয়তো গ্রামেই আছে, খাদ্যের প্রাচুর্য যে তাদের ঘরে আছে এমন নয়, তবে তারা মধ্যবিত্ত, সম্বল যেটুকু আছে তার জোরে ঠিক বেঁচে না থাকলেও টিকে আছে। শহরে যারা এসেছে তারা বিত্তহীন, তারা ভূমিহীন। গ্রামে হিন্দু মুসলমানের পার্থক্য ছিল। ১৯৪৫ সালে লেখা নয়নচারা গল্পের সময়টাতে দুপক্ষের মধ্যবিত্তের ভেতর সাম্প্রদায়িক বিরোধটা বেশ প্রবলই ছিল; কিন্তু যারা নিরন্ন তাদের জীবনে ওসব বিলাসিতা নেই, খাবার নিয়ে যে মান-অভিমান করবে এটা অকল্পনীয়। ‘রামের সুমতি’র শেষ দৃশ্যে নারায়ণী ভাত খাইয়ে দিচ্ছে রামকে; ‘নয়নচারা’র সমাপ্তিও কিন্তু ওই ভাত দিয়েই। তবে একেবারে আকাশ আর পাতালের দূরত্ব। কলকাতা শহরের একটি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমু খাবার চাইছিল।

[…] তার গলার সুড়ঙ্গ দিয়ে একটা আর্তনাদ বেয়ে বেয়ে উঠছে ওপরের পানে, এবং যখন সে-আর্তনাদ শূন্যতায় মুক্তি পেল, রাত্রির বিপুল অন্ধকারে মুক্তি পেল, অত্যন্ত বীভৎস ও ভয়ঙ্কর শোনাল তা। এ কি তার গলা – তার আর্তনাদ? সে কি উন্মাদ হয়ে উঠেছে? অথবা কোনো দানো কি ঘর নিয়েছে তার মধ্যে? তবু, তবু তার মনের প্রশ্নকে উপেক্ষা করে সুড়ঙ্গের মতো গলা বেয়ে তীক্ষ্ণ তীব্র বীভৎস আর্তনাদের পর আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে লাগল, আর সে থর থর করে কাঁপতে লাগল আপাদমস্তক। অবশেষে দরজার প্রাণ কাঁপল, কে একটা মেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। এসে আস্তে আস্তে অতিশান্ত গলায় শুধু বললে : নাও।

ভাত। ভাত দিয়েছে মেয়েটা আমুকে। না-দিলে, দরজার প্রাণ না কাঁপলে, আমু ওখানেই পড়ে যেত, ভাত পেয়ে বাঁচল সে। ভাত ছাড়া বাঙালি বাঁচবে কী করে? প্রাণের ওই শর্ত কার্যকর ছিল ১৯১৪-তে শরৎচন্দ্রের গল্পে, কার্যকর তা ১৯৪৫-এ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পেও। এই বাস্তবতার ওপরে উঠতে কেউ কেউ পেরেছে, বেশির ভাগই পারে নি। সাহিত্যে ক্ষমতাহীনতার সে-ইতিহাস লেখা আছে।

আমুর ময়লা কাপড়ের প্রান্তে যে মেয়েটি ভাত ঢেলে দিলো সে কে? সে কি নারায়ণী? না, নারায়ণীর তো কলকাতা শহরে আসবার কথা নয়, সে আসেও নি। তবে নারায়ণীর ভেতর যে-স্নেহ ছিল      সে-রকম একটা কিছু আমু অন্নদাতা ওই মেয়েটির মধ্যে দেখে থাকবে। নইলে তার প্রতিক্রিয়াটি এরকমের হবে কেন?

ত্রস্তভঙ্গিতে ময়লা কাপড়ের প্রান্ত মেলে ধরে সে ভাতটুকু নিলে, নিয়ে মুখ তুলে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল মেয়েটির পানে। মনে হচ্ছে যেন চেনা-চেনা। না হলে সে চোখ ফেরাতে পারবে না কেন।

মেয়েটিকে সে প্রশ্ন করে : ‘নয়নচারা গাঁয়ে কি মায়ের বাড়ি?’ গোটা গল্পে এই একটিই স্পষ্ট উক্তি; অন্যগুলো অস্ফুট শব্দ ও আর্তনাদ। তার নিজের গ্রামের মেয়ে না হলে ওই রকমের দয়া কেন দেখাবে তাকে, ওই মেয়েটি? রামের যে-ক্ষমতাটুকু ছিল তার ছায়াটুকুও আমুর জন্য নেই। তার দশা তো পথের কুকুরের মতো। নারায়ণীর জন্য নদী ছিল, স্নান করবার, পানীয় জল সংগ্রহ করবার। আমুদের গ্রামেও নদী আছে, ময়ূরাক্ষী তার নাম, সে-নদী শহরে নেই; তবে তার স্মৃতিটুকু আছে, যে-জন্য শহরের প্রশস্ত রাস্তাটাকে তার ময়ূরাক্ষী বলে মনে হয়।

যে-মেয়েটিকে আমু মা বলে ডাকল তার ক্ষমতা নারায়ণীর তুলনায় সামান্য হবার কথা। মন্বন্তরের সময় ভাত দেবার লোক কম ছিল শহরে, কিন্তু কেবল ওই ভাতটুকুই সে দিতে পেরেছে, আর কিছু নয়। আমুর প্রশ্নে সে যে সাড়া দেবে সেটাও তার পক্ষে সম্ভব হয় নি।

মেয়েটি কোনো উত্তর দিলে না। শুধু একটু বিস্ময় নিয়ে

তার পানে চেয়ে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলে।

দুঃখ দেখে মেয়েরা তবু সাড়া দেয়, পুরুষরা দেয় না। সেটিই আমুর অভিজ্ঞতা। এর আগে একটি মেয়েকে দেখতে পেয়েছিল ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যেতে। তার পরণে লালপেড়ে শাড়িটিতে যেন রক্ত ঝলকাচ্ছে। মেয়েটি হঠাৎ দুটি পয়সা দিলো। তখন আমুর মনে হয়, মেয়েটির মাথায় সাজানো যে-চুল সেটি সে চেনে, ওটি নয়নচারা গাঁয়ের মেয়েদের মাথার চুল ভিন্ন অন্যকিছু নয়। গ্রামত্যাগে উদ্যত রাম তার বৌদির কাছে দুটি টাকা ধার চেয়েছিল। দুটি না পেলেও একটি পাবে বলে আশা। আমু পায় দুটি পয়সা। কিন্তু তবু মেয়েরাই যে ভাত দেয়, পয়সা দেয়, সেটি দেখবার বিষয়। বাঙালির জীবনে মেয়েদের কর্তৃত্ব না থাকলেও করুণাদায়ী একটা ভূমিকা থাকে, টের পাওয়া যায়।

আমুর যখন হাঁটবার শক্তি ছিল, সেই সময়ে একবার একটি ক্ষীণ আওয়াজ তার গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, বেরিয়ে এসে ঘুমন্ত বাড়িগুলোর গায়ে ঘা খেয়ে ফিরে এসেছিল তার কানে : ‘মা গো, চাট্টি খেতে দাও।’ এর আগে দোকানে ক’কাঁদি কলা ঝুলতে দেখে তার মনে হয়েছিল, কলা নয়, যেন হলুদরাঙা স্বপ্ন ঝুলছে। তার ভেতরটা কেঁদে উঠেছিল, ‘কোথায় গো, কোথায় গো নয়নচারা গাঁ?’

আমুর ক্ষমতা নেই। থাকলে সে ময়রার দোকানে গিয়ে মিষ্টি খেতো, হোটেলে গিয়ে ভাত দাবি করতো। সে দেখে, ময়রার দোকান দেখে, হোটেল দেখে; সেখানে ক্ষমতাবানদের যাতায়াত দেখে। দোকানের লোকেরা ক্ষমতাবান, তারা তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছিল, যেন সে পথের কুকুর। হোটেলের সামনে গিয়ে খাবারের চমৎকার গন্ধে তার ভেতরে একটা ক্রোধের ভাব জেগে ওঠে। সে কাঁপতে থাকে থরথর করে। দাঁড়িয়ে থাকে ‘প্রতিবাদী’ ভঙ্গিতে। অবশেষে ভেতর থেকে কে একজন চেঁচায়, আরেকজন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ‘হীন ভাষায় কর্কশ গলায় তাকে গালাগাল’ দিতে থাকে। আমু প্রস্ত্তত হয়েই ছিল। ক্ষিপ্তের মতো সে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটার ওপর। কিন্তু পারবে কেন? ‘চকিতে ঘটিত বহু       ঝড়-ঝাপটার পর দেহে অসহ্য বেদনা’ নিয়ে আবার সে পথ ধরে। এবার নিজেকে সে দেখতে পায় সম্পূর্ণরূপে নিঃস্ব অবস্থায়। তার পা ভেঙেছে, চলতে কষ্ট। আবছা অন্ধকারে সে দেখে একটি মানুষ ফুটপাথে পড়ে গোঙাচ্ছে, ‘একটু তফাতে যে কটা লোক উঁচু হয়ে বসে রয়েছে তাদের মুখে কোনো সাড়া নেই। শুধু তারা নিঃশব্দে ধুঁকছে।’ আমু ভয় পায়। সে ছায়া দেখে, মৃত্যুর। সে পালাতে চায়।

আমুর কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা আছে হোটেলওয়ালার, ময়রার, ক্ষমতা আছে দোকানির। আর আছে গোটা ব্যবস্থার। যে-ব্যবস্থাটা রাষ্ট্রীয়, যে-ব্যবস্থা মানুষকে উদ্বাস্ত্ত করে, অভুক্ত রাখে, মেরে ফেলে। আমুর সেটা বুঝবার কথা নয়। আমু এসেছে প্রান্তবর্তী এমন গ্রাম থেকে যেখানে সে চশমাপরা কোনো লোক দেখেনি। ভেসে এসেছে সে শ্যাওলার মতো। পরিণত হয়েছে খড়কুটোতে। কিন্তু সন্ধ্যার আবছায়াতে অভুক্ত আমুর মনে হয় শহরের বিপুল জনস্রোতকে ছাপিয়ে উঠেছে বিশাল এক শক্তি। তার নিজের ভেতর বিদ্রোহ জেগে ওঠে। ‘কে তুমি, তুমি কে? জানো, সারা আকাশ আমি বিষাক্ত রুক্ষ জিহবা দিয়ে চাটব, চেটে… রক্ত ঝরাব।’ কিন্তু ওই অচেনা, বিশাল, নির্মম, সর্বগ্রাসী শক্তিশালীর সঙ্গে সে পারবে কেন? অচিরেই তাই

আমুর সমস্ত মন ক্ষুব্ধ, এবং নুয়ে রয়েছে অনুতপ্ত অপরাধীর মতো। সে ক্ষমা চায়; শক্তিশালীর কাছে সে ক্ষমা চায়। যেহেতু শক্তিশালীর অন্যায়ও ন্যায়, ন্যায়ের প্রতি অন্যায় করা গুরুতর পাপ। সে পাপ করেছে, এবং তাই সে ক্ষমা চায় – দু’টি ভাত দিয়ে শক্তিশালী তাকে ক্ষমা করুক। চারধারে তো রাত্রির ঘন অন্ধকার, শক্তিশালীর ক্ষমা করার কথা জানবে না কেউ, শুনবে না কেউ।

‘নয়নচারা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম জীবনের রচনা। তাঁর প্রথম বই একটি গল্পসংকলন, সেটিরও ওই গল্পের নামেই নামকরণ করা হয়েছিল। ‘নয়নচারা’ গল্পের নামে ‘চারা’ শব্দটি হয়তো একেবারে তাৎপর্যহীন নয়; আমু একটি চারা গাছ, সে উৎপাটিত হয়েছে। বাস্ত্তহারা হবার সংকটটা গ্রামবাসী শ্যামলালের পরিবারের জন্য যে একেবারে অজানা ছিল তা নয়। স্কুলে জমিদারপুত্রের সঙ্গে রাম মারামারি করেছে। শ্যামলাল ভয় পেয়েছিলেন তাঁকে গ্রাম ছাড়তে হবে বলে। জমিদার মহানুভব। তিনি এবারের মতো রামকে ক্ষমা করে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু মনিবের ছেলের গায়ে হাত তোলার অপরাধে শ্যামলাল তাঁর ভাইকে ক্ষমা করবেন কোন সাহসে? বিপদের কথাটি আগেই তিনি ভাবছিলেন, এবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন রামকে আলাদা করে দেবার। তবে ওটা ঘরবাড়ি ভাগ করা মাত্র। তার বিপরীতে আমুর উৎপাটন একেবারে সমূলে; সে বাঁচবে কিনা সেটাই সন্দেহ, ঘরেফেরা পরের কথা।

ওয়ালীউল্লাহ শরৎচন্দ্র থেকে আলাদা। তাঁর ভাষা, রচনারীতি, ঘটনার প্রতি নিস্পৃহতা – সবই অন্য রকমের। ‘নয়নচারা’র সমাপ্তিটাকে তিনি মিলনাত্মক করতে পারেন নি। অন্নদাত্রী, মেয়েটি আমুর মাতৃসম্বোধনে কোনো জবাব দেয়নি, কিছুটা বিস্মিত হয়েছে, এবং সশব্দে না হলেও দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে ঠিকই। আমুর জন্য দরজাটা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল, অন্য কোনো দরজা যে খুলবে তেমন আশাও অতিসামান্য।

ক্ষমতাহীন উৎপাটিত মানুষদের প্রতি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আকর্ষণ এই গল্পে যেমন আছে তাঁর অন্য লেখাতেও তেমনি পাওয়া যাবে। তাঁর সবচেয়ে পরিচিত রচনা লালসালুর যে ইংরেজি অনুবাদ তিনি নিজেই করেছিলেন, সেটির নাম দিয়েছিলেন ট্রি উদআউট রুটস। তাঁর সর্বাধিক পঠিত গল্প ‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’ বাস্ত্তহারা নিম্নমধ্যবিত্তের কাহিনি। তুলসীগাছটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। গল্পের শেষেও সেভাবেই রয়ে যায়, এবং শেকড় গাড়তে অসমর্থ মানুষদের দুর্ভাগ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। গল্পটির আদি সংস্করণের শেষ বাক্যটি ছিল এইরকমের, তুলসীগাছটিকে ‘মানুষ বাঁচাতে চাইলে বাঁচাতে পারে অর্থাৎ যার বাঁচা বা সমৃদ্ধ হওয়া আপন আত্মরক্ষার শক্তির উপর নির্ভর করে না।’ চূড়ান্ত সংস্করণেও ওই বক্তব্যটিই আছে। একটু আচ্ছাদনের ভেতরে।

 

চার

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’ লেখা হয়েছে ১৯৪৮ সালে; ‘রামের সুমতি’র সঙ্গে এর বিস্তর দূরত্ব, যেমন সময়ের তেমনি বিষয়বস্ত্তর। দু’গল্পের মাঝখানে রয়েছে দু’টি বিশ্বযুদ্ধের, একটি  মন্বন্তরের এবং কৃষকদের একটি সংঘবদ্ধ মুক্তি সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও প্রভাব। এই গল্পের মানুষগুলো উৎপাটিত নয়, সংঘবদ্ধ। ওই সংঘবদ্ধতার দরুনই তারা বেঁচেছে, নইলে তাদেরকে আমুদের মতো একাকী আশ্রয় খুঁজতে হতো শহরের ফুটপাথে। কিন্তু ক্ষমতার প্রশ্নটি এখানেও ঠিকই আছে, বরঞ্চ আরো পরিষ্কারভাবেই রয়েছে। ইংরেজের রাষ্ট্র এবং স্থানীয় জোতদার একসঙ্গে মিশেছে কৃষকদেরকে শোষণ ও দমন করার কাজে। জমিদার এখানে জোতদারে পরিণত, কিন্তু তার দাপট অধিক। যে-কৃষক জমিতে ধান ফলায় তারা একাট্টা হয়েছে, ফসলের অর্ধেক তারা জোতদারকে দেবে না, দেবে তিন ভাগের একভাগ; এ নিয়ে লড়াই বেধেছে, জোতদারের পক্ষে আছে লাঠিয়াল, আছে পুলিশ, রয়েছে অবনত আদালত; কৃষকদের শক্তি শুধু এক জায়গাতেই, তাদের ঐক্যে। ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পটি দু’পক্ষের এই লড়াইকে নিয়েই। মানিকের যে-গল্পসংকলনে এই গল্পটি আছে তার নাম ছোট বড়, সেখানে গ্রামের ছোট ছোট কৃষকেরা অত্যন্ত বড় অর্থাৎ শক্তিশালী হয়ে যায় একতার জোরে, আর খুবই বড় যে রাষ্ট্র ও জোতদার তারা ছোট হয়ে পড়ে ছোটদের বিশাল প্রতিরোধের মুখ পড়ে।

কৃষকদের সাথে আছে ভুবন মন্ডল, তাদের নেতা। ভুবনকে পুলিশ খোঁজে, কিন্তু ধরতে পারে না। সে এ-গ্রামে ও-গ্রামে চলাফেরা করে, এ-ঘরে ও-ঘরে থাকে, কৃষকদেরকে সাহস ও পরামর্শ দেয়, কৃষকরা তাকে রক্ষা করে। তার গোপন অবস্থানের খবর পেয়ে এক মধ্যরাতে পুলিশের ও জোতদারের যৌথবাহিনী হানা দেয়। তিন দিন তিন রাত ধরে ধান কেটে পুরুষেরা ঘুমিয়ে ছিল, তাছাড়া হানাদারেরা এসেছিল নির্দিষ্ট ঘরের খবর পেয়ে। ভেতর থেকে কেউ খবর দিয়েছিল, যে কোনো ঘরে ভুবন আছে। ঘরটি বৃদ্ধ হারানের। তবু, এর মধ্যেও পুলিশের আগমনের ঘটনা টের পেয়ে গেছে গ্রামবাসী, উলু ও শাঁখের আওয়াজে তারা জেগে উঠেছে, এবং যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে ছুটে চলে এসেছে। দেড়শ দু’শ লোক গর্জন করে বলছে তারা ধানের জন্য যে-জান কবুল করেছিল সেই জান দেবে তবু গ্রামে তল্লাশি হতে দেবে না।

রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল। থামাল হারানের মেয়ে, ময়নার মা। পুলিশের বিএ পাশ দক্ষ দারোগা মন্মথের মুখোমুখি হয়ে সে বললো, সে চোর ডাকাত নয়, তার ঘরে যে এসেছে সে অন্য কেউ নয়, সে তার মেয়ের জামাই, জগমোহন। জগমোহন রাগ করে বসে ছিল, এতদিন আসে নি, যৌতুক মেটানো হয় নি বলে, এখন এসেছে। ভুবনকে জগমোহন সাজিয়ে হানাদারদের ফেরত পাঠিয়ে দিলো ময়নার মা।

অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমতী এই ময়নার মা। বিধবা মানুষ, তার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সে নববই বছর বয়সের বুড়ো প্রায়-বধির বাবার যত্ন নেয়, নিজের ছেলে ও মেয়ের ভালোমন্দ দেখে, ভুবনকে ঘরে নিয়ে এসেছে নিজের উদ্যোগে, এখন তাকে রক্ষা করলো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও অভিনয়দক্ষতার সাহায্যে। যেন শরৎচন্দ্রের নারায়ণীই, ভিন্ন শ্রেণির এবং অন্য অবস্থানের। নারায়ণীর মতোই গল্পে সে-ই প্রধান, সেই মুখ্য। কিন্তু তার ঘরে খাবারের প্রাচুর্য নেই, প্রচন্ড অভাব আছে; সব কাজ সে একাই করে, তাকে সাহায্য করবে এমন কেউ নেই সংসারে। ‘কুপির আলোতেই টের পাওয়া যায় প্রৌঢ় বয়সের শুরুতেই তার মুখখানাতে দুঃখ-দুর্দশার ছাপ ও রেখা কি রুক্ষতা ও কাঠিন্য এনে দিয়েছে। ধুতিপরা বিধবার বেশ আর কদমছাঁটা চুল চেহারায় এনে দিয়েছে পুরুষালি ভাব।’ নারায়ণীর তুলনায় তার কষ্ট অনেক বেশি। একাধারে সে মা, মেয়ে, শাশুড়ি, গৃহকর্ত্রী ও কৃষকদের নেত্রী। সকল ভূমিকাতেই সমান দক্ষ। কোনো কাজে তার আপত্তি নেই, বিচ্যুতি নেই। পরামর্শ না শুনলে ভুবনকে সে ধমকায়, পরাক্রমশালী দারোগাকে সে বোকা বানিয়ে ছাড়ে। পুরুষশূন্য গ্রামে পুলিশ এলে ঝাঁটা বঁটি হাতে মেয়ের দল নিয়ে তাদেরকে পার করে দিয়েছে গ্রামের সীমানা। একা পেয়ে তার জোয়ান ছেলেটাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলে ময়নার মা যে কাঁদবে এমন সময় নেই। কিন্তু তার চোখ কান্নায় ভরে যায় মেয়ের জামাই জগমোহনের আচরণে। লোকটা তার ছেলের বয়সী হবে, সে বড়ই তার মাতার ভক্ত, মায়ের দিব্যি মাথায় নিয়ে চলে এসেছে শাশুড়ির ওপর অত্যাচার করতে। শুনেছে সে যে ভুবনের সঙ্গে তার স্ত্রী ময়না এক বিছানায় শুয়েছিল; তাই সত্বর এসে গেছে তদন্ত করতে এবং ময়নার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে। ময়নার মা প্রাণপণে জগমোহনকে তোয়াজ করে, পাড়াপ্রতিবেশীর বাড়ি থেকে মুড়িমোয়া এনে সামনে ধরে, খেতে বলে, থাকার জন্য অনুনয় করে, তার ছেলেকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে তাই জামাইকে রেখে সান্ত্বনা পাবে, এমন কথা বলে, আবার রেগে গিয়ে জগমোহনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারও করে, কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হয় না, মন টলে না জগমোহনের। সে এসেছে ক্ষমতা দেখাতে, ক্ষমতার জোরে সে ময়নাকে কাঁদাবে। এবং সে কাঁদায়, ময়নার বিলাপ শুনে পাড়াবেড়ানি নিন্দাছড়ানি নিতাই পালের বৌ চলে আসে খবরের লোভে, সঙ্গে অন্য মেয়েরাও; তাদের দেখে ময়নার মা সম্বিৎ ফিরে পায়। ময়নার মা তাদেরকে জানায় যে, ময়না কাঁদছে তার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে বলে। অনিচ্ছুক পদে মেয়েরা ফিরে যায়, তাকে ঘাঁটাবার সাহস কারো নেই।

সেই ময়নার মাকে ঘাবড়ে যেতে হয় মেয়ের জামাই হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে দেখে। জগমোহন এসেছে পরের দিন বিকেলে, উপযুক্ত ভঙ্গি এবং গায়ে যথোপযুক্ত ঘরকাচা শার্ট, কাঁধে মোটা সুতির সাদা চাদর জড়িয়ে। আসার পথে মাথুরের খোঁজ করেছে সে। মাথুর পলাতক, ভুবনের খবর সে-ই দিয়েছে পুলিশকে, গ্রামবাসী অপেক্ষা করছে তাকে শাস্তি দেবে বলে। বুঝতে বাকি থাকে না জগমোহনের ওঠাবসা কোন ধরনের মানুষের সাথে।

জগমোহনের জোরটা এইখানে যে সে ময়নার স্বামী, এবং ময়নার একজন স্বামী প্রয়োজন। ময়নাকে তাই কাঁদতে হয়। ময়নার মা’র চোখে জল আসে। ‘সারা দিন পরে তখন তার দু’চোখ জলে ভরে যায়। জোতদারের সাথে দারোগা পুলিশের সাথে লড়াই করা চলে, অবুঝ পাষন্ড জামাইয়ের সাথে লড়াই নাই।’

কিন্তু অবুঝ পাষন্ড এই জগমোহনও বদলে যায় দারোগা মন্মথ যখন ময়নার থুতনি ধরে ‘আদর’ করতে যায়। দারোগাকে চমকে দিয়ে জগমোহন লাফিয়ে এসে ময়নাকে আড়াল করে গর্জে ওঠে। ময়নার প্রতি ভালোবাসার কারণে নয়; ময়না তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, দারোগা সেখানে হস্তক্ষেপে উদ্যত হয়েছে – এই কারণে। পরিণামে দারোগা মন্মথ বাড়ির সকলকে, বুড়ো হারানকে পর্যন্ত, গ্রেপ্তার করে আসামি নিয়ে রওনা হয়ে যায়। কিন্তু এবার তার বিপদ ঘটে। শত শত মানুষ এসে হাজির হয়। শুধু ওই গাঁয়ের নয়, আশেপাশের গাঁয়ের লোক ছুটে এসেছে।

মন্ডলের জন্য বলে মানে বোঝা যেত, হারানের বাড়ীর লোকের জন্য চারদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে। মানুষের সমুদ্রের, ঝড়ের উত্তাল সমুদ্রের, সঙ্গে লড়া যায় না।

আমরা বুঝতে পারি যে, শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ একটা হয়েছে। ‘আসামিদের’কে ধরে নিয়ে যেতে পারেনি পুলিশ। আহত হয়েছে জগমোহন। গল্পের শেষ লাইনগুলো এরকমের :

ময়না তাড়াতাড়ি অাঁচল দিয়েই রক্ত মুছিয়ে দিতে আরম্ভ করে জগমোহনের। নববই বছরের বুড়ো হারান সেইখানে মাটিতে মেয়ের কোলে এলিয়ে নাতির জন্য উতলা গলায় বলে, ছোঁড়া গেল কই? কই গেল? হায় ভগবান।

হারান যাকে ‘ছোঁড়া’ বলে ডাকাডাকি করছে সে হারানের ছেলে। ওই ছোঁড়া ভুবন মন্ডলকে পার করে দিতে গেছিল, ময়নার মায়ের ঘরে রাতকাটানোর পরে। পুলিশ তাকে আটক করেছে, তার ফেরার পথে। অবুঝ পাষন্ডস্বভাব জগমোহনের পক্ষেও টের না পেয়ে উপায় থাকে না যে নিজেকে সে যতই ক্ষমতাবান মনে করুক না কেন সেও ক্ষমতাহীন, দারোগা-পুলিশের কাছে। দারোগা-পুলিশের ক্ষমতাটা এসেছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে। রাষ্ট্রই আসল শত্রু, পরাধীন দেশের মানুষদের, যদিও সব সময়ে সেটা তারা বোঝে না।

দু’রাতের মাঝখানে কয়েক ঘণ্টা নিয়ে ‘হারানের নাতজামাইয়ে’র কাহিনি। সময়টা ঘটনায় ভরপুর। ‘নয়নচারা’র কাহিনিও অতটা সময়েরই। কিন্তু সেখানে এত ঘটনা নেই, এমন সংলাপও নেই। আমু তো প্রায় কথাই বলে না, ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পে সবাই কথা বলে। অনেক কথা। ক্ষমতাবানের, ক্ষমতাহীনের। বড় পরিষ্কার ও স্পষ্ট ময়নার মা’র কথাগুলো। ময়না তার বাপের সাথে শুয়েছিল বলাতে জগমোহন হেসে উঠেছিল। ব্যঙ্গ করে বলেছিল ‘বাপ নাকি?’ জবাবে ময়নার মা,

বাপ না? মন্ডল দশটা গাঁয়ের বাপ। খালি জনেমা দিলেই বাপ হয় না, অন্ন দিলেও হয়। মন্ডল আমাগো অন্ন দিছে। আমাগো বুঝাইছে, সাহস দিছে, এক সাথে করছে। না তো চন্ডী ঘোষ নিত বেবাক ধান। তোমারে কই জপু, হাতে ধইরা কই, বুইঝ্যা দ্যাখো, মিছা গোসা কইরো না।

অতিসাধারণ কৃষকদেরই একজন হচ্ছে গফুরালী। সেও গর্জন করে ওঠে গ্রামের যে-বিশ্বাসঘাতক ভুবন মন্ডলের অবস্থান পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে তাকে চরম শাস্তি দেবে বলে।

দাঁতে দাঁত ঘষে গফুরালী বলে, দেইখা লমু কোন হালা

পিঁপড়ার পাখা উঠছে। দেইখা লমু।

মন্মথ দারোগা যখন দেখে জোর করে লাভ হবে না, তখন সে নরম পথ ধরে। বলে সে আইনের লোক, হাকিমের দরখাস্তী পরোয়ানা নিয়ে এসেছে হারানের ঘর তল্লাশ করতে। তল্লাশ করে যদি আসামি না পায়, ফিরে চলে যাবে। এতে বাধা দিয়ে হাঙ্গামা তৈরি করা উচিত নয়, সেটা খারাপ হবে, বেআইনি কাজ হবে। গফুর তখন চেঁচিয়ে বলে, ‘মোরা তল্লাশ করতি দিমু না। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দুশো গলা সায় দেয়, দিমু না।’ বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠকদের কাছে গফুর নামটি অপরিচিত নয়। শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের এই কেন্দ্রীয় চরিত্রটি আগে তাঁতি ছিল, এখন কৃষকে পরিণত হয়েছে। চাষের জন্য একমাত্র অবলম্বন বৃদ্ধ ষাঁড়টিকে হারিয়ে এবং গো-হত্যার অপরাধে প্রায়শ্চিত্তের খরচ জোগাতে হবে এই আতঙ্কে গফুরকে তার কিশোরী মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে রওনা দিতে হয়েছিল শহরের পাটকলের দিকে। যাবার মুহূর্তে নিরুপায় গফুর খোদার কাছে প্রার্থনা করে যারা তার মহেশের মৃত্যুর জন্য দায়ী তারা যেন শাস্তি পায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গফুরের অবস্থানটা একেবারে আলাদা; সে প্রার্থনা করে না, অন্যদের সঙ্গে মিলে সে রুখে দাঁড়ায়। এ-পরিবর্তনটা নিতান্ত সামান্য নয়।

পরিবর্তন আরো এসেছে। সাম্প্রদায়িকতা বাংলার সমাজে কঠিন ব্যাধি; সাহিত্যে তার প্রবেশ যে ঘটে নি তা নয়, এবং সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান উপেক্ষিত থেকেছে – এ-অভিযোগও অন্যায্য নয়। ‘নয়নচারা’র নায়কটি যে মুসলমান তা তার নাম এবং জগৎ সম্পর্কে তার ধারণার ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি দেয়; কিন্তু দুর্ভিক্ষে বাস্ত্তহারা মানুষদের দৃষ্টিতে কে মুসলমান কেইবা হিন্দু সে-বিবেচনা একেবারেই অমূলক; আমুকে যে মেয়েটি ভিক্ষা দেয় তার হিন্দুই হবার কথা, কিন্তু তার ওই পরিচয় আমুর কাছে অবান্তর; পাঠকের কাছেও বৈকি। এদিক থেকে তেভাগা আন্দোলনের সালিগঞ্জ গ্রাম কলকাতা শহরের চেয়েও অগ্রসর, সেখানে গফুর এবং হারান পরস্পরের অতি আপনজন। মানুষে মানুষে যে-বিচ্ছিন্নতা ‘রামের সুমতি’তে সত্য ছিল, তারই চূড়ান্ত পরিণতি দেখি ‘নয়নচারা’তে, আর ঠিক উলটোটা প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে ‘হারানের নাতজামাই’তে।

বড় লেখকরা তাঁদের লেখার উপজীব্য ব্যক্তি ও ঘটনা থেকে নিজেদের শৈল্পিক দৃঢ়ত্ব বজায় রাখেন। এই নিয়মের মধ্যেও শরৎচন্দ্রের পক্ষপাত ছিল নারায়ণী ও রামের প্রতি; সে-তুলনায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অধিকতর নিয়ন্ত্রিত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ‘হারানের নাতজামাই’ লেখেন তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, তাঁর মনোজগতে বড় রকমের একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে; তাঁর সমস্ত সহানুভূতি ও সমর্থন ময়নার মা’দের প্রতি, কিন্তু এর মধ্যেও তাঁর শৈল্পিক সময় অসামান্য বৈকি। যেন দূর থেকে দেখছেন, নৈর্ব্যক্তিকভাবে বলছেন।

 

পাঁচ

ইতিহাস এগোয়। নারায়ণীদের ছোট জগৎটা আরো ছোট হয়ে যায় আমুর গল্পে এসে। আমুর তবু একটা নাম আছে, ময়নার মা’র তাও নেই, নিজের মেয়ের নামেই আপন পরিচয় তার। কিন্তু ময়নার মা’রা বড় হয়ে ওঠে আন্দোলনের ঐক্যে, তাদের জগৎটা আর ছোট থাকে না। নারায়ণীদের জীবনযাপনের কথা বলতে গিয়ে শরৎচন্দ্র ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্মানসূচক ‘ন’ যোগ করেন : নারায়ণী তো বটেই এমন কি দিগম্বরীও কথা ‘বলে না’, তাঁরা কথা ‘বলেন’। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহতে এসে ওই ‘ন’ আর থাকে না, সকলেই সমান হয়ে যায়। এদিক থেকে ইতিহাস ঠিকই এগিয়েছে, বলা যাবে। কিন্তু তবু শ্রেণি তো ভাঙে না। ‘রামের সুমতি’র জমিদার, ‘হারানের নাতজামাই’তে আর জমিদার থাকে না, জোতদার হয়ে যায়। কিন্তু সে তার শোষণ ও নির্যাতনকারী চরিত্রটি হারায় না। ‘নয়নচারা’তে জমিদার জোতদার নেই; কিন্তু তাদের পেছনে একটি দৈত্য আছে, যার নাম ‘রাষ্ট্র’। সে আছে ভয়ংকর বীভৎস এক চেহারা নিয়ে।

‘নয়নচারা’ গল্পের শেষে মধ্যবিত্ত মেয়েটি আমুর দয়ালু ও কৃতজ্ঞ সম্ভাষণে কিছুটা বিস্মিত হয় ঠিকই, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ওই দরজা আমুর জন্য আবার খুলবে এমন আশা নেই। আর যে-কৃষকেরা তেভাগা আন্দোলন করে সাময়িকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল, সেই ক্ষমতা তো তারা ধরে রাখতে পারে নি। ইংরেজের উস্কানি এবং কংগ্রেস ও লীগের ক্ষমতালোলুপতার কারসাজিতে তেভাগা হারিয়ে গেছে, আধাআধি ভাগ ফেরত এসেছে। ভুবন মন্ডল সম্ভবত চলে গেছে পশ্চিমবঙ্গে, দেশভাগের কারণে। ক্ষমতাহীন বাঙালি মুক্ত হবে কী করে?

 

ছয়

না, মুক্ত হতে পারে নি। বাঙালির জীবনে মুক্তি আসে নি। কেন আসেনি তার একটা ব্যাখ্যা দেখতে পাই শিবরাম চক্রবর্তীর মস্কো বনাম পন্ডিচেরীর ক্ষুদ্রাকৃতি বইটিতে।

শিবরাম হাসির গল্পের লেখক হিসেবে সুপরিচিত। বস্ত্তত ওই ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ। তাঁর হাসির লেখা আমার কৈশোরে ছিল অত্যন্ত প্রিয়পাঠ্য। পরবর্তীকালে তাঁর মস্কো বনাম পন্ডিচেরীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এই বইতেও শিবরাম হাসি-খুশি, যেন ঠাট্টা করছেন, কিন্তু যা লিখেছেন তা খুবই জরুরি ও গভীর। বইটি লেখা হয় ১৯২৯ সালে, ওই সময়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বেশ প্রবল ছিল। ১৯২৬ সালে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাস পথের দাবী; পাঁচ বছর পরে ১৯৩১-এ রুশ-ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাশিয়ার চিঠি প্রকাশিত হয়। মাঝখানে শিবরামের মস্কো বনাম পন্ডিচেরী। সে-সময়ে প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্নটি ছিল কোন পথে মুক্তি আসবে, সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লবের পথে, নাকি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বিপ্লব-পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াতে মানুষের সাংস্কৃতিক ও বৈষয়িক উন্নতির যে-দৃশ্য রবীন্দ্রনাথই দেখেছেন সেটি তাঁকে অভিভূত করেছিল, এবং তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, তাঁর মনে হয়েছে ওখানে না গেলে তাঁর জন্য তীর্থযাত্রা অপূর্ণ থাকতো। পথের দাবীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন ছিল না, বরঞ্চ বিরোধিতাই ছিল; সে-বইতে যে-বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে সেটা ভদ্রলোকের বিপ্লব, মেহনতি মানুষের নয়। রাশিয়ার চিঠিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে যে-উন্নতি ঘটেছে তার প্রশংসা করা হলেও তার জন্য যে বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ তাকে মেনে নিতে প্রস্ত্তত ছিলেন না। শিবরাম চক্রবর্তীর অবস্থান কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। তিনি রুশ বিপ্লবের পক্ষে লিখেছেন।

তাঁর ওই বইটি আমার কাছে একাধারে আনন্দদায়ক ও বিস্ময়কর ঠেকেছিল। প্রথম কারণ তিনি হাস্যকৌতুকের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, গভীর গম্ভীর চিন্তার জন্য নয়। কিন্তু এ-বইটিতে দেখা গেল যে, তিনি তাঁর কালের বড়মাপের মানুষদের অনেককেই ছাড়িয়ে গেছেন, চিন্তার অগ্রগামিতায়। দ্বিতীয় কারণ এই যে, ওই রচনাটিতে তিনি তাঁর নিজের পরিহাসদৃপ্ত সাহিত্যিক রীতিটি মোটেই পরিহার করেন নি, উলটো তাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন। মস্কো বনাম পন্ডিচেরী সাহিত্য হিসেবে খাটো নয়। এই দুটি ব্যাপারই কৌতূহলোদ্দীপক। সাহিত্যিক মূল্যের সঙ্গে বইটির ঐতিহাসিক মূল্যও রয়েছে। দুদিক থেকেই রচনাটি মূল্যবান।

এই বই রচনার প্রেক্ষাপটের একটি বর্ণনা আছে শিবরামের ‘ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর’ নামক আত্মজৈবনিক রচনায়। সেখানে তিনি লিখছেন, তখন

এদেশে গান্ধীজির অহিংস অসহযোগের অভ্যুদয় উদ্দাম। ও-দেশে ঘোরতর সহিংস সংগ্রামে সারা রাশিয়াকে বে-জার করে, সেই সঙ্গে জারের বন্ধু পশ্চিম য়ুরোপীয় রাষ্ট্রদেরও বেজায় রকমের ব্যাজার করে বলশেভিকদের অভ্যুত্থান। এদিকে ইহলোকের সশরীরে লোকোত্তরজ্ঞান সাধনায় পন্ডিচেরীর সাধকবৃন্দ, তার ওপরে কংগ্রেসের রাজনীতি মঞ্চে দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র ও জহরলালের আবির্ভাব – সবমিলিয়ে এক ধুমধাড়াক্কা।

কমিউনিজম বিষয়ে তিনি যে খুব একটা জানতেন তা নয়। সে  সময়ে মার্কসবাদী বইপত্র তেমন একটা পাওয়া যেত না। এর মধ্যেই তিনি কমিউনিজমের ভেতরকার ‘সর্বজনীন সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বক্তব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।’ তবে তাঁর স্মরণে আছে যে,

না-বোঝা কমিউনিজমের সেই অশিক্ষিত পটুত্বের বাহাদুরি আমার ‘মস্কো বনাম পন্ডিচেরী’ সেকালের অনেককেই ভুলিয়ে ছিল, তার ভেতর সশস্ত্র বিপ্লবীরাও ছিলেন বলে আমি জানি।… কিন্তু আসলে তা ছিল মস্কো নিয়ে পন্ডিতি আর পন্ডিচেরী নিয়ে মস্করা। তার বই কিছু নয়।

অস্বাভাবিক হতো না শিবরাম যদি রাজনীতির ব্যাপারে নিস্পৃহ থাকতেন, আর রাজনীতি নিয়ে যদি মাথাই ঘামালেন তাহলে তাঁর পক্ষে জাতীয়তাবাদী হবার কথা। কিন্তু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সীমানাটা তিনি বুঝে ফেলেছিলেন, জানতেন যে জাতীয়তাবাদীরা যা চায় সেটা হলো রাষ্ট্রক্ষমতার হস্তান্তর মাত্র, মানুষের মুক্তি নয়। কিছু দিন তিনি সাপ্তাহিক যুগান্তর পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন, যে-পত্রিকার লক্ষ্য ছিল, তাঁর ভাষায়, ‘জমিদার মহাজন গুরু পুরোহিত থেকে শুরু করে ধনিক বণিক শাসনকারী শোষণকারী সবার বিরুদ্ধে, সামাজিক সর্ববিধ অনাচারের বিরুদ্ধে আগাডম বাগাডম’। ওই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে অল্প সময়ের জন্য হলেও জেল খাটতে হয়েছিল।

মস্কো বনাম পন্ডিচেরী বইটি লেখা কেন জরুরি হয়ে পড়েছিল তার ব্যাখ্যা বইয়ের শুরুতেই তিনি দিয়েছেন। সেই সময়ে ‘পন্ডিচেরীর নয়া ব্রাহ্মণরা পৈতে ছিঁড়ে বলশেভিকদের বাপান্ত থেকে শাপশাপান্ত করতে লেগেছিল।’ তারা ‘জেহাদী’ রচনা ছাপছিল – প্রবাসী ও ভারতবর্ষ পত্রিকায়। তাই তিনি দেখলেন কলমধরা দরকার; সে-জন্যই ওই রচনাটিতে হাত দেওয়া। পন্ডিচেরী তখন অরবিন্দ ঘোষের আশ্রম। স্বদেশি আন্দোলনের সময় অরবিন্দ ছিলেন চরমপন্থী। চরমপন্থা প্রচারের দায়ে তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন। বছরখানেক কারাগারে কাটিয়ে মুক্ত হয়ে তিনি ব্রিটিশ ভারতেই আর থাকেন নি, চলে গেছেন ব্রিটিশ শাসকদের আওতার বাইরে ফরাসি-শাসিত পন্ডিচেরীতে। সেখানে তিনি একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দিব্যজ্ঞানের সন্ধানে যোগসাধনে ব্রতী হন, এবং ওই পথের মাহাত্ম্য প্রচার শুরু করেন। শিবরাম এই ‘নব্যব্রাহ্মণ্যবাদে’র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।

কিন্তু, হায়, বেশি দূর কিন্তু এগোতে পারেন নি। জাতীয়তাবাদের ছায়া তাঁর সঙ্গেই ছিল, সেটি তাঁর চিন্তাতে যে ছায়াপাত করেনি তা নয়, বেশ ভালোভাবেই করেছে। তিনি লিখেছেন,

[…] সাম্যবাদ এদেশেরই চারা – বিদেশের কলম নয়। বিদেশে কমিউনিজমের বাস্তব চেহারা যাই হোক না কেন, তার আদর্শবাদী যে রূপ তা ভারতীয় মনেরই অনুরূপ। সাম্যের মূল ভারতীয় ঐতিহ্যের অন্তর্গত, তার অন্তর-গতি আমাদের মনের ফল্গুধারায়। সমস্ত মানুষের সমত্ব আর মানুষের প্রতি মমত্ব – এইবোধের সৃষ্টি এখানে এতই সহজ যে, এর জন্য মার্কসীয় তত্ত্বের অপেক্ষা রাখে না। উপনিষদে উপ্ত, আর বুদ্ধদেবে অঙ্কুরিত হয়ে গান্ধীজিতে এসে তা শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হয়েছে। গান্ধীবাদই, আমার মনে হয়, কমিউনিজমকে সম্পূর্ণ করতে পারবে। একদিন তা করবেও।

এটা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, এবং এখনো মনে হওয়ার স্মৃতিভার থেকে মুক্তি পাই নি যে, শিবরাম কী ঠাট্টা করছেন?  ‘সম্পূর্ণ করা’কে কি তিনি শেষ করে দেওয়া হিসেবে ব্যবহার করছেন না তো?

সেটা অবশ্যই করছেন না। এবং করছেন না বলেই বোঝা যাচ্ছে আমাদের এই উপমহাদেশে অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক বিপ্লবটি কেন সম্পন্ন হয় নি। সুভাষ চন্দ্র বসু অহিংসপন্থী ছিলেন না। আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটানোর ব্যাপারে তাঁর অঙ্গীকার অত্যন্ত দৃঢ় ছিল, কিন্তু তিনিও সমাজতন্ত্রকে দেশীয় রূপ দেবার পক্ষপাতী ছিলেন।

 

সাত

সাহিত্য ইতিহাসের ভেতর থেকেই রচিত হয়, এবং সাহিত্যের নিজের ভেতরও ইতিহাস থাকে। আমার পছন্দের তিনটি কথাসাহিত্যিক রচনাতে আমাদের সামাজিক ইতিহাসের একাংশকে দেখতে পাই। শেষ রচনাটি প্রাবন্ধিক, সেখানে মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস কোন পথে এগোলে সামাজিক ইতিহাস ভিন্ন পথ নিতে পারতো তার আভাস দানের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি। আসলে পন্ডিচেরী ততটা দুর্বল ছিল না, যতটা ধারণা করা হয়েছিল এবং মস্কোও ততটা শক্তিশালী ছিল না, যতটা হবে বলে আশা করা গিয়েছিল।