চার খুঁটির শামিয়ানা

পারভীন সুলতানা

সুনসান দুপুর ভালো নীরবতা ধারণ করে ছিল এতক্ষণ। শুধু হাওয়া লেগে কবরের ওপর লটকানো জরির রঙিন ঝালর আর মালাগুলোয় একটা নরম কচকচে শব্দ তৈরি হচ্ছে। বাতাসের আদরে বুড়ির দুচোখের পাপড়িতে ঘুম জমে উঠেও জুত করতে পারছে না। সবেমাত্র থিতু হওয়া ঘুমে ব্যাঘাত
করছে উকুনের কুটকুটানি। বুড়ি চোখ খুলে বিরক্ত হাতে লুকিয়ে থাকা উকুনের অন্বেষণ করে ব্যর্থ হয়। নিরুপায় হয়ে সে স্বামীর কবরে ঝোলানো রঙিন ঝালরের দোল খাওয়া দেখে, রাংচিতা কাগজের কচরমচর শব্দ শোনে কান পেতে। এমন সময় হাওয়ারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বৃক্ষের ডাল তোলপাড় করে শোঁ-শোঁ শব্দ বয়। হাওয়ার শব্দ। ঝড় হবে। বুড়ি যেমন শুয়েছিল তেমনি শুয়ে থাকে। তার না আছে সংসার, না আছে গৃহস্থী। একটু দূরে বসতপাড়ায় বউঝি আর  বেটাছেলেদের নানামাত্রিক চিৎকার আর চেঁচামেচিতে সুনসান দুপুর ছিঁড়ে-খুঁড়ে যেতে থাকে। উঠোনে শুকোতে দেওয়া ধান, কিংবা
রোদে মেলানো কাপড়-চোপড় অথবা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সংসারী মানুষজন।

দেখতে দেখতে পুরো আকাশ ভেঙে ঝমঝম শব্দে দামাল মেঘের নাচানাচি শুরু হয়। মোটা মোটা দাগের বৃষ্টিতে একটু আগের শুকনো মাটি রং বদলাতে থাকে। ঝোপঝাড় ঘন সবুজাভ হয়ে ওঠে। সমস্ত হইচই ঝিমিয়ে আসে বৃষ্টির তোলপাড় করা মাতমে। মাটি থেকে কেমন একটা উমুল উমুল গন্ধ ওঠে। প্রাণটা ভরে ওঠে বুড়ির। কবরের ওপর সিমেন্টের পাকা ছাদ, তার ওপর লাল-নীল ঝালর তোলা শামিয়ানা। দরবেশের কবরে পানির ছাট এসে পড়ারও উপায় নেই। বুড়ি অনেকক্ষণ পর বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর জুতসই বন্ধনে একটা ডাকাবুকো উকুন চেপে ধরে চনমনে বোধ নিয়ে ভাবে, ভালোই, বেঁচে থাকতেও দরবেশকে কেউ গা, মাথা ভিজিয়ে গোসল করতে দেখেনি। মরার পরও পানির ছাট থেকে অধরাই রয়ে গেল। এক হাতে উকুনটাকে চুলের জঙ্গল থেকে বের করা সম্ভব নয় দেখে বুড়ি উঠে বসে এবং দুহাতের নিবিড় তৎপরতায় সেটাকে টেনে তোলে। ক্ষুদ্র জীবটাকে নিয়ে খানিকক্ষণ তামাশা করে। এক ফাঁকে ওটা মাটিতে পতিত হলে বুড়ি তার ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়েই টিকটিকির মতো সরু ও সাবধানী চোখে খুঁজে বের করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় এবং হতাশ হয়ে বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে। মাতম করা বৃষ্টির শব্দ এইবার ভালোভাবে কানে যায় বৃদ্ধার। এত জোর বৃষ্টি হচ্ছে যে উঠোনের মাটিতে পানি জমতে শুরু করেছে। জলের পতন ছাড়া আর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না চারপাশে। কাজকর্ম গুছিয়ে মানুষগুলো মুরগির মতো খোঁয়াড়বন্দি হয়ে আছে। রাতের চেয়েও গভীর নীরবতায় মগ্ন হয়ে আছে গ্রাম। শুধু পুকুরঘাট থেকে এক দঙ্গল হাঁসের উল্লাসমুখর প্যাঁকপ্যাঁক ছাড়া সারাদুনিয়া যেন মূক ও বধির হয়ে আছে। বৃষ্টি আর হাওয়ার যোগসাজশে তৈরি প্রায়ান্ধকার শীতলতা চারপাশে অদ্ভুত মাদকতা তৈরি করে। হঠাৎ করেই বুড়ির মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঘাই মারে – এমন ঝড়-বাদলে দুপুরের খাবার দিয়ে যাবে তো…। কিন্তু চিন্তাটা বেশিক্ষণ থিতু হওয়ার সুযোগ পায় না। তার কপালে যে কটা দুশ্চিন্তার ভাঁজ জমে উঠে মুখটাকে বেজার ও চিমসে করে তুলেছিল সেই রেখাগুলোই তার বুড়োটে চামড়ার আরো অসংখ্য ভাঁজে তলিয়ে যায়। বন্ধ ঠোঁট জোড়া হাঁ হয়ে তার দাঁতহীন মাঢ়ির গোলাপি আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে – তার স্বামী দরবেশ, সিমেন্টের আস্তর দু’হাতের ঘায়ে ভেঙে দুমড়ে হাই তোলার ভঙ্গিতে হাতগুলো উঁচুতে তুলে উঠে বসেছে। এত বড় কর্মকান্ডেও কোনো শব্দ হয় না। একবার বুড়ির দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়, কিন্তু তোয়াক্কা করে না। লোকটার গায়ে সেই বিলেতি সাহেবদের পুরনো কোট, গলায় অসংখ্য মোটা মোটা লাল খয়েরি দানার মালা। জটা চুলের দঙ্গল লেপ্টানো, পাকানো দড়ির গোছা যেন। লোকটা দাঁড়িয়েইে ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে কবরের ওপর বিছানো দামি সিল্কের চাদরটা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে। তবে এ প্রচেষ্টায় বেশিক্ষণ নিযুক্ত থাকা বিরক্তিকর লাগে তার কাছে। চাদরটা সে বৃষ্টির ভাসমান পানিতে নিক্ষেপ করে। বুড়ির চোখ বিস্ফারিত হয়।
উঠোনের টলটলে পানি মুহূর্তে ঘোলা হয়ে ওঠে। চাদরটা গলে গলে কাদার রং ধারণ করে। অনেকক্ষণ পর ওটা অদৃশ্য হয়ে যায়। দরবেশ আবার নিজের কবরের থানে ফিরে আসে। রঙিন কাগজের ঝালরগুলোয় এবার তার আক্রোশ ঝাড়ে। পটপট শব্দে সুতোর বাঁধনগুলো ছিঁড়তে থাকে। গমগমে গলায় আওয়াজ করে লোকটা – আমার বাসরসজ্জা সাজাইছে! মুর্দার কবরে এইসব কী? আমারে শান্তিতে ঘুমাইতে দে ও আবদুল কুদ্দুস…। তারপরই পতন, তারপরই আরো হাওয়ার দাপাদাপি, মেঘের অঝোর ক্রন্দন। পতনের ধপাস শব্দে বুড়ির অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ভয়-ডর কারে বলে বুড়ি তা আমলে আনে না। গেরস্থপাড়া থেকে দূরে প্রায় ধানি ক্ষেতখোলা আর জঙ্গলের কাছাকাছি এই জায়গায় সে আর তার স্বামী দরবেশ দীর্ঘ বছর ধরে বসবাস করে আসছে। মাত্র সাড়ে তিন মাস বা তার কাছাকাছি সময় হতে চললো দরবেশ দেহত্যাগ করেছে। লোকটা মারা যাওয়ার পর তার প্রথম পক্ষের ছেলে কুদ্দুস প্রস্তাব দিয়েছিল তাকে সতভিটায় গিয়ে থাকতে। বুড়ি রাজি হয়নি। তবে ওরা তাকে তিনবেলা খাবারটা দিয়ে যায়। এতেই বৃদ্ধা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। দরবেশ বেঁচে থাকতেও দিন-দুনিয়ার খুব একটা খবর রাখত না। প্রথম পক্ষের চার কন্যা, এক পুত্রের জমজমাট সংসার রেখে মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াত। তবে ওয়াক্তের নামাজ কাজা দিত না, দেখানো ভন্ড পির-ফকিরের মতো নিজেকে জাহির করার চেষ্টাও ছিল না তার মধ্যে। আর লোকটা যে একেবারে বিবাগী ছিল তাও তো নয়। দেশ প্রান্তর ঘুরেফিরে ঠিকই সে ফিরে আসত আপন ভিটায়। সম্ভবত কিছু কিছু বুজরুগি ছিলই। স্ত্রীর কাছেও তা ছিল রহস্যময়। তার বিড়বিড়ানি ঠোঁটের দোয়া-দরুদে লোকজন উপকারও পেয়ে থাকতে পারে। সবচেয়ে আলোড়ন তোলে মোড়লের নাতির দীর্ঘ বছরের মৃগীরোগ সেরে যাওয়ায়। দরবেশ কোনো ঝাড়ফুঁকও করেনি শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, আল্লাহর হুকুম হইলে সাইরা যাইবো তোর রোগবালাই। এরপর সত্যি সত্যি বছর তিনেক হলো সেই রোগ আর দেখা যায় না। লোকজন তো তাই বলাবলি করে। বুড়ি একাকী স্বামীকে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিল, আফনে কী সত্য সত্যই কামেল ফির হয়্যা গেছেন? দরবেশ রাগ করেনি, সদুত্তরও করেনি পরিষ্কারভাবে। শুধু হাত ওপরে তুলে তর্জনী দিয়ে বিশেষ ইঙ্গিতে স্মিত হেসে জানিয়েছিল, সবই তার ইচ্ছা, আমি কোন ছাড়! প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েরা খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত লোকটাকে। তারও কোনো প্রতিবাদ করত না সে। বছর-ত্রিশেক আগে নেত্রকোনা জেলার মদনপুরে ‘শাহ সুলতানের’ মাজার শরিফে জয়তুন্নেসা আকুল হয়ে বিলাপ করছিল। স্বামী আর উঠতি বয়সের দুই ছেলে গিয়েছিল কংস নদীর উজানে সিলেটের হাওরে ধান কাটতে। ফিরতি পথে ঝড়ে পড়ে লঞ্চডুবিতে নিখোঁজ হয় তিন-তিনজন ব্যাটাছেলে। জয়তুন্নেসার দেওর, ভাসুরেরা ‘অপয়া’ অপবাদে ভিটাছাড়ার পাঁয়তারা করলে গ্রামের একটা প্রাণীও তার পক্ষে কথা কয় না। জয়তুন্নেসার আহাজারিতে গাছের পাতা ঝরতে থাকলেও মানুষের মন টলেনি। অসহায় মাঝবয়সী এই রমণী শোকের ভারে পেরেশান হয়ে ছুটে আসে হজরত শাহ সুলতানের দরগা শরিফে। সেখানেই তার দুঃখে সমব্যথী হয়ে জয়তুনকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয় এই লোক। পতিত জীবন থেকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য দরবেশের হাত ধরে আবার নতুন করে জীবন তরি ভাসায় প্রায়স্খলিত যৌবনের জয়তুন্নেসা। তারপর দরবেশের সঙ্গিনী হয়ে নানা পথ অতিক্রম করে উঠে আসে নতুন স্বামীর বাড়ি। কুমিল্লার লাকসাম জংশন থেকে পশ্চিমে মাইল-তিনেক দূরের এক অচেনা গ্রাম কামারকুয়ায়। দরবেশের এ বিবাহে গ্রামে কোনো তোলপাড় ওঠে না। পুরুষ লোকের বিয়ে করা ডাল-ভাতের মতোই সহজ বিষয় মনে হয় লাকাবাসীর কাছে। এছাড়া লোকটার না আছে জায়গা-জমি, না কোনো সম্পদ। ছেলেমেয়েরা থম মেরে থাকে দেড়-দুদিন। শুধু মাঝবয়সী বউটা ঘণ্টাকয়েক বিলাপ করেছে নিস্তেজ গলায়। ভাটি বয়সের নয়া বউ নিয়ে দরবেশ তার পড়াভিটায় খানিকটা জায়গার ঝাড়জঙ্গল কেটে থাকার মতো একটা ছাপরা তেরি করে নেয়। প্রতি বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর জিকির-আজকার শুরু হয় ঘরের সামনের উঠানে। ফকিরালি কিসিমের কিছু লোকও জুটত এসে। রাত ভোর করে জিকির করার ক্লান্তিতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকত দরবেশ। ক্রমশ লোকটাকে ঘিরে কীভাবে কীভাবে যেন একটা বিশ্বাস তৈরি হতে থাকে লোকজনের দিলে। দরবেশের একটা বড় গুণ ছিল মিথ্যা-টিথ্যায় না ভজিয়ে মানুষের মধ্যে মোহ তৈরি করা। মানুষের দেওয়া টাকা-পয়সা গ্রহণেও সে লোভী ছিল না, বরং বলত – তুমরা আমার ভিডায় বিন্দু ঘর তুলি দ্যাও, অসহায় এতিমগোর জন্যি মাথাগুঁজার ব্যবস্থা করি দ্যাও। আমি আল্লার অধম বান্দা নিজির তো ওগোর নাগি কিছু করার সাধ্যি নাই…। চারদিকে রব ছড়িয়ে পড়ে – আহ্ কী নেক বান্দা! লোভ নাই, ভাঁওতাবাজি নাই…। জয়তুন্নেসা মাঝে মধ্যে সন্দেহের চোখে স্বামীর দিকে তাকাত – উদ্দেশ্য কী লোকটার, সেয় চায় কী? বিয়ের বছর-সাতেক পর শরীরী ক্ষুধাও মিইয়ে আসে মানুষটার। ঘরেও সর্বক্ষণ জপতপ করে, এখানে তো লোক দেখানো কিছু ছিল না। কী শীত, কী গ্রীষ্ম সারাবছর মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমাত। মাটির সানকিতে সে যৎসামান্য খাওয়া-দাওয়া করত। এসবও লোকজনের দৃষ্টিগোচর হতো বইকি। দরবেশের সঙ্গে মানুষজন ‘বাবা’ যোগ করায় সে হয়ে ওঠে দরবেশ বাবা।
এ এলাকার এমপি সাহেব ইলেকশনের আগে তার কাছে জোড় হাতে দোয়া চাইতে এলে দরবেশ স্মিত হেসে নির্ভার গলায় বলেছিল – তার মর্জি হলি নিশ্চয় আপনে জিতিবেন…। ‘জিতিবেন’ শব্দটার মাদকতায় এমপি সাহেবের আর পরবর্তী শব্দগুলো শোনার প্রয়োজন পড়ে না বরং তিনি তার পুরো শরীরটা ঝুঁকিয়ে দরবেশকে কদমবুসি করেন। ইলেকশনে জিতে এমপি সাহেব প্রথমেই একটা গরু, চাল-ডাল আর মোমবাতি নিয়ে হইরই করে হাজির। ধুম-ধাড়াক্কা কান্ড যাকে বলে। এমপির নির্দেশেই দরবেশের ভিটায় পাকা ঘর ওঠে। এমনকি তার জন্য আগাম কবরও বাঁধিয়ে ফেলা হয়। দরবেশের মৃত্যুর পর তাকে সমাহিত করার কবরের স্থানটুকুর ওপর সিমেন্টের পাকা ছাদ উঠলেও চারপাশে কোনো দেয়াল ওঠানো হয় না। ঠিক মৃত্যুর মাঝবয়সী রাতেই দরবেশ স্ত্রী জয়তুন্নেসাকে ডাকে – ঘুমাই গেছ নি? বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমও কমে এসেছে বৃদ্ধার। তার বয়স এখন প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। বয়সের হিসাব একেবারে নির্ভুল না হলেও কাছাকাছি জানে জয়তুন। বড় একটা বানের সময় তার জন্ম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিরিশের মাঝামাঝি ছিল। তার ছেলে দুটো বেঁচে থাকলে…। এর বেশি ভাবার সাহস হয় না বৃদ্ধার। বুকের মধ্যে এইসব পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। একাকী থাকলেই তীরবেঁধা পক্ষিনীর মতো টাটকা যন্ত্রণা এখনো টের পায় সে। স্বামীর ডাকে সাড়া দেয় বৃদ্ধা – ঘুম আহে না, বড় বিপাকে আছি একটা সুরা পড়ি দ্যান না। দরবেশ বোঝে তার স্ত্রী মশকরা করছে না; সত্যি সত্যি সমীহ করেই বলছে। মাঝপ্রহরের নীরবতাকে টোকা মারে দরবেশের গভীর গলার স্বর – বউ তুমিও ইসব বিশ্বাস করো? সব দয়ালের খেলা, তার উছিলা হওনেরও সাহস করি না। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সরব হয় – চলো তুমারি একটা জিনিস দেখাই, – উঠবা? বৃদ্ধার জড়তাভরা শরীর নড়তে ইচ্ছুক না হলেও আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করে। সারাশরীর ব্যথায় টনটন করে – ঘষা গলায় বলে, বুড়া হাড্ডি খালি টনটনায়…। দরবেশও পরাজিত গলায় বলে
– আমার শইল্লেও বড় অশান্তি। ভিতরে ভিতরে জ্বরে কড়মড়ায়, কারে কই, ডাক্তর কইবরাইজ দেহানোর কতা কলি মাইনষে হাসবো… কইতে পারি না। বৃদ্ধা নড়বড়ে পায়ে উঠে আসে। দীর্ঘদিন ধরে আলাদা শোবার ব্যবস্থা তাদের। দরবেশ মাটির বিছানায় ঘুমালেও বৃদ্ধা
জয়তুন্নেসা পারে না। হাড় কনকন করে। তারপর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় মাঝে মধ্যেই। গরমের দিন দরজাও বন্ধ করে না দরবেশ।

আকাশজুড়ে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। বুনো ঝোপঝাড়ের শিরা-উপশিরাকে প্রতিভাস করে তুলেছে উজ্জ্বল পশর। অ-নে-ক বছর পর একজোড়া দম্পতি আলোকবিহারে যায়। শরীরে যৌবনের ছিটে-ফোঁটাও নেই। বার্ধক্য এসে গ্রাস করেছে সবকিছু। তারা ধীরপায়ে হাঁটে। দরবেশের বাঁধাই করা কবরের শিয়রে এসে দাঁড়ায় দুজোড়া শিথিল পা। দরবেশ বিষণ্ণ স্বরে বলে – এইখানে আমার কববর খোঁড়া হইছে। কিন্তুক এইরকম ব্যবস্থা আমার পছন্দ নারে বউ। ইটপাথরের বিছানা। তার ওপরে ছাদ। আহা, এহানে এট্টু চান্দের পশর পড়ে নাই দেহ বউ…। আচমকা লোকটা বুক চেপে বসে পড়ে। তারপর অনেক কষ্টে স্ত্রীর রুগ্ণ কাঁধে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে, চলো ঘরো যাই, আমার কষ্ট হইতাছে। সেই রাতেই সব শেষ।

ভোরবেলা ফজরের নামাজের সময় ইমাম সাহেব শোকবার্তাটি জানানোর সময় অদ্ভুত একটা কথা জানান। গতরাতে তিনি প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য বাইরে বের হলে নিজ চোখে দেখেছেন ‘দরবেশ বাবা’ তার স্ত্রীকে নিয়ে কবরটি দেখাচ্ছেন…। অর্থাৎ আজকেই যে তার মৃত্যু হবে বিষয়টি তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন।দরবেশের জানাজায় হাজার হাজার মানুষ উপচে পড়ে। মৃত্যুর সময় নিজ গোরে আসার খবরটি আশপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে যায়। লাশের কাছে আতর-লোবান জ্বালানোর আগেই এক বেহেশতি খুশবুতে সারা আঙিনা ভরপুর থাকে। এখানে আসা লোকজন লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে এ সত্যটা যাচাই করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। দাফনের পর কবরটি মাজারের অবয়বে সাজানো হয়। সিমেন্টের আস্তর দেওয়ার সময় পেটের স্থানটি সামান্য উঁচু করে পায়ের দিকে তালু আকারে নামানো হয়। সিল্কের ‘গেলাপ’ বিছানোর পর ওপর থেকে মনে হতে থাকে সত্যি সত্যি একজন মানুষ পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।

মাজারটির সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য মুরিদানরা দরবেশের একমাত্র পুত্রকেই নির্বাচন করে। পুত্র আবদুল কুদ্দুস শানে কপাল ঠুকে – বাবা, বাবা, ও বাবা ও আমার দরবেশ বাবা… বিলাপে এতই মুহ্যমান হয়ে পড়ে যে কাঁচা খুনে তার কপাল রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। তার মোটা গলার আহাজারির সঙ্গে যোগ দেয় দরবেশের
স্ত্রী, চার কন্যার মেয়েলি মিহি গলার বিলাপ।

পুরনো ভিটা ছেড়ে মাজারেই পড়ে থাকে আবদুল কুদ্দুস। নিজ হাতে সে জরির ঝালর টানায় বাপের কবরে। আতর লোবান জ্বালায়। আশপাশের ঝোপঝাড় কেটে অজুখানা তৈরি করে। বেশবাসও পালটে যায় আবদুল কুদ্দুসের। লম্বা দাড়ির গোছায় মেন্দি মাখে। চোখে সুরমা ছাড়াও কানে গুঁজে রাখে টকটক গন্ধওয়ালা আতর। একদিন মাগরেবের ওয়াক্তে মসজিদের ইমাম সাহেবের অজুর জন্য সে নিজে বদনা ভরা পানি নিয়ে বিনয়ে গদগদ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলে ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বলেন, আবদুল কুদ্দুস এইসব কী, আপনের পিতা একজন নেকদার কামেল হুজুর ছিলেন, আপনে তার সন্তান, আপনের হাতে কেন আমার অজুর পানির বদনা…। আল্লাহতায়ালা আমারেও দুইখান হাত দিছেন। আবদুল কুদ্দুস বোঝে না কথাটা তাকে ব্যঙ্গ করে নাকি প্রশংসা করে বলা হয়েছে। তবে এজন্য সে কোনো তাপ-অনুতাপ বোধ করে না। কিছুদিনের মধ্যেই তার চিকন শরীরে মাংস লাগতে শুরু করে। সে তার স্কুলপড়ুয়া ছেলে দুটোকে স্কুল ছাড়িয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করে। আজকাল তো তার বাড়িতে চুলা ধরানোর প্রয়োজন হয় না বললেই হয়। প্রায় প্রতিদিনই মাজারে মানত করা ‘শিরনি’ আসে। ইতোমধ্যে তিনটা ছাগল আর দুইটা গরুও এসেছে মানত হিসেবে। শুক্রবার জুমার দিন হাঁস-মুরগি ছাড়াও ডিম আর শাকসবজিও আসতে শুরু করে। আবদুল কুদ্দুস দিশেহারা হয়ে ভাবে, মাজার সংলগ্ন একটা ঘরকে সে গরু-ছাগলের গোয়াল হিসেবে ব্যবহার করবে কিনা। তবে কুদ্দুস সাবধানী হতে চেষ্টা করে। ইতোমধ্যেই লোকজনকে বোঝাতে সক্ষম  হয়েছে যে, সে শুধুই এখানকার একজন খেদমতকারী। নিকৃষ্ট গোলাম মাত্র। আর একটা কর্তব্য সে এখনো পর্যন্ত ঠিকমতো পালন করে যাচ্ছে – বাপের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে তিন বেলা খাবার পাঠানো।

বৃষ্টির বেগ একটু একটু কমে এলে ফোঁটাগুলো রুগ্ণ আর সরু হয়ে পড়ে। তিরতির করে নামা পানির বিন্দুকে লোকজন আর বেশিক্ষণ তোয়াক্কা করে না। ঝড়ে কাঁপা বৃক্ষগুলোও নিজেদের সামাল দিয়ে থিতু হওয়ার চেষ্টা করে যেন। কিন্তু থেমে থাকে না ব্রহ্মচারী বাতাসের উদ্দাম বিচরণ। চঞ্চল ও স্থৈর্যহীন হাওয়ারা ধানি মাঠের পেট বরাবর সাঁতার দিয়ে ক্ষেতখলা ডিঙিয়ে স্বেচ্ছাচারী হয় যত্রতত্র। বৃদ্ধা জয়তুনন্নেসা তবু শুয়েই থাকে। ঠান্ডা হাওয়া পেটের খিদেটাকে আরো ক্ষুরধার করে তুলেছে। সে অপেক্ষমাণ দৃষ্টিতে পথের রেখায় তাকিয়ে থাকে। স্বামীর কবরের ওপর টানানো শামিয়ানায় বৃষ্টি না ঝরলেও বন্ধ থাকে না বাতাসের বেপরোয়া তৎপরতা। শামিয়ানাটা বাতাসের তোড়ে ফুলে ফুলে ওপরের দিকে উড়ে যেতে চাইলেও চার খুঁটির শক্ত বাঁধনে পেরে ওঠে না। নিরুপায় শামিয়ানা চারকোনা অবয়ব নিয়ে ছটফট করে।