চাষাভুসো মানুষের স্বপ্ন

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
আমার বাবা অদ্ভুত, নম্র স্বভাবের চাঁদে পাওয়া মানুষ। চাঁদ উঠলে বাবা বাইরে চলে যেতেন, একা একা মাঠে ঘুরতেন, আর কবিতা বানাতেন। বাতাস উঠলেও তাই, বাবা বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়–তেন, আর কবিতা বানাতেন। বাবা অদ্ভুত স্বভাবের মানুষ। বাড়ির সামনে, রাস্তার পাশে, সুপারির বাতা দিয়ে তৈরি নামাজের স্থান। বাড়ি থেকে দূরে গাছগাছালি নেই, অফুরন্ত মাঠ, মাঠের শেষে বলজুরি খাল ডাকাতিয়া নদীতে গিয়ে মিশেছে। আমার বাবা, কখনো কখনো নামাজের স্থানে ঘুমিয়ে যেতেন। চাঁদ তাঁর ঘুমন্ত চেহারার ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে যেত। ভোর পর্যন্ত চাঁদ তাঁর ঘুমন্ত শরীর নিয়ে খেলত। বোধহয় বাবা স্বপ্ন দেখতেন তাঁর চার ভিটির বাড়িখানির, বিশেষ করে একটা ভিটিতে তিনি গোলাঘর বানিয়েছিলেন, জমিজমা বিশেষ কিছু ছিল না, তবু তিনি শক্ত-সমর্থ করে গোলাঘর খাড়া করে রেখেছিলেন। হয়তো কৃষক পিতার পুত্র : এই বোধ তিনি কখনো হারিয়ে যেতে দেননি।

আমার বাবা, মধ্যে মধ্যে, যেসব স্বপ্ন ঘুম ভাঙলে মনে পড়ত, সেসব বলতেন। আমাদের জানাতেন, কেন সুপারির বাতার ওপর শুয়ে থাকতেন এবং ঘুমাতেন। বাড়ি ছেড়ে এতদূর এসে কেন ঘুমাই জানিস। বাড়ির ভিতর তাজা হাওয়া নেই। হাওয়া সব গিলে নিয়েছে ভিটাগুলি আর মেয়েমানুষের ঝগড়াঝাঁটি। এখানে তাজা হাওয়া সারারাত নাচানাচি করে। তোরা হয়তো জানিস, এক সময় আমি শহরে চাকরি করতাম। সে-চাকরি আমার ভিতরের চাষাভুসো মানুষটাকে মেরে ফেলতে পারেনি। আমি ফিরে পেতে চাইতাম ধুধু মাঠ, সবুজ ঘাস, বহুদূরের পাহাড়, যদিও আমাদের এলাকায় পাহাড় নেই, নেই বলে এলোমেলো পাহাড়ের স্বপ্ন কি দেখতে নেই? আমি নীল দেখতে ভালোবাসতাম, সবুজ দেখতে ভালোবাসতাম, শাদা দেখতে ভালোবাসতাম। এসব রং আমার চোখে খেলা করত, আমাকে ঘুম পাড়াত। স্বপ্ন দেখে দেখে ঘুমানোর মাজেজা আলাদা।
মধ্যে মধ্যে আমার বাবা নবীজির কথা বলতেন। নবীজির সঙ্গে, তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, স্বপ্নে দেখা হয়েছে। নবীজি তাঁকে বলতেন, বহু কষ্টের মধ্যে তিনি বড়ো হয়েছেন। সেই দুঃখ-কষ্ট তাঁকে আল্লাহর কাছে নিয়ে গেছে। মক্কা শহরের তোরণ ছেড়ে তিনি মদিনায় পালিয়েছেন, আকাশের তারার আলোর নিচ দিয়ে, মরুভূমির অন্ধকারে পথ খুঁজে খুঁজে।
বাবা বলতেন, দুঃখ-কষ্ট না পেলে জীবনের মহিমা বোঝা যায় না। গ্রামের গাছপালা ছেড়ে শহরের তোরণে যেমন মধ্যে মধ্যে যাওয়া দরকার, তেমনি শহরের তোরণ ছেড়ে গ্রামের গাছপালার ভিতর ফিরে আসা দরকার।

দুই
এই বোধ থেকে আমি প্রায়ই সুপারির বাতায় ঘুমিয়ে থাকি। আমার স্ত্রী বকাবকি করে। তোমার কী হয়েছে! তুমি বাইরে ঘুমাও কেন। আমার একা ঘুমাতে ভয় করে।
আমার কোনো বোধ নেই। কী জবাব দেব। আমার কোনো জবাব নেই।

তিন
তবু তো কেউ কোথাও আছে, যে আমার কথা ভাবে।
এক রাতে ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ আমার মনে হয় কারো চোখের পানি আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। বিষ্টি নেই। আকাশ নির্মেঘ, নীল এবং শাদা, শাদা এবং নীল।

চার
আমার ভিতরে বাঁচা-মরার ভাবনা জাগে। আমার মনে হয়, আমরা কাউকে বাঁচাতে পারি না। মানুষ, পাখি, প্রাণী, গাছপালা : কাউকে বাঁচাতে পারি না।
হে আল্লাহ, তুমি কি পারো?

পাঁচ
আমি চতুর্দিকে তাকিয়ে পানি খুঁজি। কোন ওপর থেকে এই পানি এসেছে। হঠাৎ আমার মনে হয়, এই বোধটা সত্য, যেমন সত্য ঘুমভাঙা চোখে চারপাশে থাকিয়ে থাকা।
আমার চোখে তাঁর চোখের পানি। তিনি কাঁদছেন। আমার আল্লাহ আমার জন্য কাঁদছেন।

ছয়
জানি না কাকে, হাত তুলে আমি বলি : দয়া করো, দয়া করো।