চিন্তা ও ভাষা

১. পাখি আগে না ডিম আগে

এই তর্কটার কথা সবাই জানেন। ডিম পাখি পাড়ে, কিন্তু পাখিও তো ডিম ফুটেই বেরোয়। তাহলে কে আগে কে পরে? এই তর্কের এখনো মীমাংসা হয়নি বললে কথাটা একটু অতিরঞ্জন হবে। মীমাংসা হয়েছে, তবে সাধারণ পাঠক সেটা সবাই জানেন না বলে মনে হয়। অবশ্য তর্কটাই যে আছে তাও অনেকে জানেন না। কিন্তু লেখাপড়া করা মানুষের মধ্যে এ নিয়ে হয়তো কখনো প্রশ্ন ওঠে, যাদের মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান নেই তারা সহজে এর উত্তর পান না। মনোবিজ্ঞান বা মনোভাষাবিজ্ঞানে অনভিজ্ঞ পাঠকের জন্য এই লেখা।

চিন্তা আর ভাষার ব্যাপারে এই একটা সমস্যা ছিল। হয়তো এখন মনে হতে পারে, আরে! এটা একটা সমস্যা নাকি? ওটা তো ছিল একটা আপাত-সমস্যা, তবু প্রশ্নটা অনেকদিন ধরে আমাদের ঝামেলায় ফেলেছে। বিশেষ করে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে – মানুষ আগে চিন্তা করে তারপর কথায় তা প্রকাশ করে, নাকি ভাষা ছাড়া মানুষ চিন্তা করতেই পারে না, ভাষাই চিন্তার একমাত্র বাহন? অর্থাৎ প্রথম একদল অনেক ক্ষেত্রেই দুয়ের সম্ভাব্য বিচ্ছেদ কল্পনা করে, বলে যে ভাষা ছাড়াও চিন্তা করা যায়। তারা অবশ্য এমন চরম কথা বলেন না যে, ভাষায় চিন্তা করা যায় না। ভাষার মধ্যস্থতায় চিন্তা অবশ্যই করা যায়, ভাষায় চিন্তা প্রকাশিত হয়। মানুষের যদি ভাষা না অর্জিত হতো তাহলে মানুষ এত বিচিত্র চিন্তা করতেই পারত না, প্রকাশ করতে তো পারতই না; কিন্তু ভাষা ছাড়াও চিন্তা করা সম্ভব। আরেক দল বলে বা বলত যে, দূর! ভাষা ছাড়া চিন্তা সম্ভবই নয়। প্রথম দলে আছেন চমস্কির এককালের এমআইটির ছাত্র জেরি ফোডোর আর দ্বিতীয় দলে আছেন ভিগোৎস্কি নামক রুশ মনোবিজ্ঞানী, আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী ব্লুমফিল্ড – এবং আরো কেউ কেউ।

ফোডোরের যুক্তি, আচ্ছা, পশুপাখির তো ভাষা নেই, কিন্তু তারা কি চিন্তা করে না? কিংবা যে-শিশু ভাষা শেখেনি, তার কি কোনো চিন্তাপ্রক্রিয়া নেই? ‘সামনে গাছপালাগুলো নড়ছে, কে জানে ওখানে আমাদের বিপদ লুকিয়ে আছে কি না -’ হরিণ বা জেব্রার দল কি এরকম ভাবে না? এখনো নানা জায়গায় যে বর্ষার পরে হনুমানের দল চলে আসে খাবার-ফল ইত্যাদি লুটপাটের বাসনা নিয়ে – তাদের কি কোনো চিন্তা থাকে না যে, ‘এই সময়ে ফলটল পাকবে, চলো দলবেঁধে উদ্যোগ নিই?’ শিশু কি কখনো তার মা সম্বন্ধে ভাবে না যে, ‘এই মহিলার ওপর আমি খাদ্য বা অন্যান্য ব্যবস্থার জন্যে বেশ নির্ভর করতে পারি, তাই এই মহিলা কাছে থাকলে আমার ভালো লাগবে।’ নিশ্চয়ই পশুপাখিরা এবং শিশুরা এমন ভাবে। এমনকি ফোডোর আরো একটা অতি অকাট্য যুক্তি দিতেই পারতেন; জীবজগতের বিবর্তনের যুক্তি, সেটা হলো, ‘আরে মানুষ তো বহুদিন কথা বলতেই শেখেনি, তা যখন তাদের ভাষা ছিল না তখন কি তারা চিন্তা করত না? নিশ্চয়ই করত।’ ঠিক কথা! মানুষ এসেছে পৃথিবীতে তা প্রায় আশি-নব্বই হাজার বছর হবে; আর তার ভাষা তৈরি হয়েছে বড়জোর চল্লিশ হাজার বছর আগে। তাহলে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর কি সে আদৌ চিন্তা করেনি? এসব যুক্তি কেউ অস্বীকার করার কথা ভাবে না।

বস্তুতপক্ষে চমস্কির একটি কথাতেও এই ইঙ্গিত আছে বলে মনে হয়। দুই হাজার সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বক্তৃতায় তিনি মানুষের বিবর্তনে ভাষাবোধ বা ভাষাক্ষমতা কীভাবে জন্মাল তার কথা বলেছিলেন ((Chomsky, 2000 : 17))। বলেছিলেন যে, হয়তো পঞ্চাশ বা ষাট হাজার বছর আগে, মানুষের বা মানব-অভিমুখী উন্নত ‘প্রাইমেট’দের মধ্যে কোনো একটা ‘জিন’ বা কিছু ঢুকে পড়ে, যার বলে মানুষ ভাষার দিকে এগিয়ে যায়। পরে কেউ কেউ বলেছেন যে, এই জিনটার নাম Fox P2। অন্য কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে এই জিনগত সংযুক্তি ঘটেনি, তাই অন্য কোনো প্রাণীর ভাষাও নেই। চমস্কির

কথাগুলো তুলে দিই – Let us imagine a higher primate wandering around. It lacks the language organ but it has something like our brain and other organs, including sensorimotor systems sufficiently close to ours, and also a conceptual-intentional system sufficiently close to ours so that it can think about the world more or less the way we do in so far as that is possible without language. But it doesn’t have language and cannot articulate such thought Ñ even to itself. কল্পনা করুন যে, একটি উচ্চস্তরের নরবানর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর ভাষা-অঙ্গ নেই, কিন্তু আমাদেরই মতো মস্তিষ্ক আর অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। আছে অনুভব আর সঞ্চালনের প্রণালী যা অনেকটা আমাদেরই মতো, আর সেইসঙ্গে আছে একটা চিন্তা আর ইচ্ছানির্মাণের প্রণালী, যাতে তারা পৃথিবী সম্বন্ধে ভাবতে পারে – সেও আমাদেরই মতো, অন্তত ভাষা ছাড়া যতটা এসব থাকা সম্ভব। কিন্তু এ প্রাণীর ভাষা নেই, তাই সেসব চিন্তা উচ্চারণ করতে পারে না, এমনকি নিজের কাছেও।

আমরা প্রথমেই এই আধুনিক সিদ্ধান্তটি, হয়তো শেষ সিদ্ধান্তটি দিয়ে শুরু করলাম যে, চিন্তা আগে, ভাষা পরে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে অনেক বিতর্কের পথ পেরোতে হয়েছে। এ-প্রবন্ধে সেই বিতর্কের সূত্রগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব। এবং শেষকালে এই ইঙ্গিতও দেওয়ার চেষ্টা করব যে, জানি না সে-চেষ্টার আদৌ দরকার আছে কি না – ভাষার সাহায্যে চিন্তার মধ্যে যে-ঐশ্বর্য সঞ্চারিত হয়েছে, তা ভাষা ছাড়া সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ ভাষা ছাড়া চিন্তা সম্ভব হলেও ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে চিন্তার যে বিস্তার, বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি ঘটেছে তা ভাষার আগে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না।

এখানে যে-প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে সেগুলো হলো – ১. কোনটা আগে, চিন্তা না ভাষা? ২. যদি চিন্তা আগে হয় তা কীভাবে হলো? ২. যারা ভাষা আগে বলে সাব্যস্ত করেন তাদের যুক্তি কী? ৩. ভাষা আগে মানে কী – ক. ভাষা ছাড়া চিন্তা সম্ভব নয়? খ. ভাষা চিন্তাকে রূপ দেয় বা নিয়ন্ত্রণ করে? ভাষাপ্রভাবিত কিংবা ভাষানিয়ন্ত্রিত চিন্তা কী ধরনের চিন্তা? এই প্রশ্নটাকেই আবার দুভাগে ভাগ করা যায় – ক. ব্যক্তির পরিপার্শ্ব-বোধের (নিসর্গ ও তার নানা উপাদান, সময় রঙের ধারণা, পরিমাপ, দূরত্ব) – ইত্যাদি কি তার ভাষার শব্দাবলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? খ. ভাষা কি তার সামাজিক, জাতীয় ইত্যাদি বোধ ও সংস্কৃতির নানা বিষয় সম্বন্ধে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করে দেয়? অর্থাৎ ভাষা কি একটি মানসিক জেলখানার মতো, যার থেকে ভাষী কখনো বেরোতে পারে না?

 

২. ভাষাবিচ্ছিন্ন চিন্তা সম্ভব, সম্ভব নয় : চারটি তত্ত্ব

 

ক. আচরণবাদ, ভাষা আগে, চিন্তা পরে

স্টাইনবার্গ ওশ্চিয়ারিনি (১৯৯৩) এ-প্রসঙ্গে শক্ত-নরম চারটি তত্ত্বের উল্লেখ করে সেগুলোর বিচার করেছেন। প্রথম তত্ত্বটি যাঁরা মনোবিজ্ঞানে আর ভাষাবিজ্ঞানে আচরণবাদী বা Behaviourist নামে পরিচিত, তাঁদের। শুধু তাঁদের নয়, তাঁদের মধ্যে কট্টরদের, যেমন, লেনার্ড ব্লুমফিল্ড, বিএফ স্কিনার প্রভৃতি। তাঁদের কথায়, কথা না ফুটলে, কথার ক্ষমতা না থাকলে চিন্তা সম্ভবই নয়। তাই এটার একটা নাম identity view কথা আর চিন্তা অনন্য; কথা ছাড়া চিন্তা অভাবনীয়। অর্থাৎ কথা আগে, চিন্তা তার পরে। আচরণবাদীরা মানুষের সব কাজকেই (এমনকি ভাবনা আর অনুভবকেও) প্রকাশ্য ‘আচরণ’ বা behavior বলে মনে করেন, যা প্রকাশ্য নয়, তা আছে বলে মনে করেন না। আচরণের আড়ালে থাকা মনকে এঁরা প্রায় অস্বীকারই করেন। পশুদের যে মন আছে, চিন্তা আছে, সে-চিন্তা তারা একভাবে প্রকাশও করতে পারে, তা বোধহয় আচরণবাদীরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। তাঁদের মতে চিন্তা হলো ‘অব্যক্ত ভাষ্য’ sub-vocal speech, অর্থাৎ ভাষার সাহায্যে মনে মনে ভেবে নেওয়ার ঘটনা, বা অনুচ্চারিত ভাষা। এঁদের কাছে ‘ভাষা’ মানে উচ্চারিত ভাষা বা speech. এ ছাড়া আর কোনো ভাষার অস্তিত্ব এই আচরণবাদীরা স্বীকার করেন না। এখানেই পাঠকদের বলে রাখা ভালো যে, চমস্কি প্রমুখ আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানী speech-কে অর্থাৎ উক্ত বা উচ্চারিত ভাষাকে যথার্থ ভাষা বলে স্বীকার করেন না। এঁদের কাছে speech হলো বহিঃপ্রকাশিত ভাষা, বহির্ভাষা বা বীঃ externalized language (e-language)। কিন্তু এই বহির্ভাষার ভিত্তিতে আছে একটা অন্তর্ভাষা বা Internalized language (l-language), যেটার অধিষ্ঠান আমাদের মনে অর্থাৎ মস্তিষ্কে। সেটা নিয়মবদ্ধ, বিচ্যুতিহীন, সুশৃঙ্খল – এবং সেটা আছে বলেই আমাদের বহির্ভাষা আছে, তার নিয়ম মেনেই আমরা আমাদের কথাগুলো বলার চেষ্টা করি। আচরণবাদীদের কথা হলো, যেমন লেনার্ড ব্লুমফিল্ড বলেন যে, fully literate person এমন একটা উপায় তৈরি করেছে Ñ a system of internal substitute movements which serve him for private purposes, such as thinking and silent reading, in place of audible speech sounds (1961 : 31, 1942-এর পেপার থেকে) অর্থাৎ একজন পূর্ণ সাক্ষর লোক ভাষা উচ্চারণ না করে তা নিঃশব্দে মনের মধ্যে চিন্তার আকারে তৈরি করতে পারে – তাই ভাষার বিকল্প, যেমন সে-বই সামনে নিয়ে নিঃশব্দে পড়ে যেতে পারে। ভাষা আছে বলেই মানুষ তা পারে, যেমন পড়ালেখা জানা মানুষ নিঃশব্দে পড়তেও পারে। তাই চিন্তা অনুচ্চারিত নিঃশব্দ কথা ছাড়া আর কিছু নয়। ব্লুমফিল্ড আবার এর মধ্যে ‘পুরো সাক্ষরে’র প্রসঙ্গ এনে ফেলেন, এমন অদ্ভুত এবং অবাস্তব ইঙ্গিত করেন যে, নিরক্ষর লোকেরা চিন্তা করতে জানেন না। কিংবা হয়তো সাক্ষর লোকেদের নিঃশব্দ পড়ার সঙ্গে সমান্তরাল টানেন নিঃশব্দ চিন্তাকে। পড়া যেমন মুদ্রিত শব্দনির্ভর, ওই চিন্তাও তেমনি অনুচ্চারিত, কিন্তু শব্দ-সাজানো বাক্যনির্ভর।

অন্যদের কাছে যাওয়ার আগে ব্লুমফিল্ডের অস্ত্রেই ব্লুমফিল্ডকে ঘায়েল করা যায় বলে আমাদের ধারণা। তাঁর Language (১৯৩৩) বইয়ের একেবারে প্রথমেই আছে দুটি তরুণ-তরুণীর কথা – জ্যাক আর জিল। তারা গ্রামের পথ দিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় জিল দেখল রাস্তার পাশের আপেল গাছে আপেল ফলেছে, দেখে জিলের মনে হলো তার খিদে পেয়েছে। সে তখন জ্যাককে বলল, ‘জ্যাক, আমাকে একটু আপেল পেড়ে দেবে?’

খুব ভালো কথা। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে আচরণবাদী ব্লুমফিল্ড ব্যাখ্যা করেন stimulus আর response, অর্থাৎ ‘প্রেরণা’ আর ‘সাড়া’ – এই দুটি পরিচিত ধারণা দিয়ে। অর্থাৎ আপেল দেখেই জিলের মনে হলো তার খিদে পেয়েছে, তাই সে জ্যাককে ভাষায় ওই অনুরোধ করল। এবার আমাদের প্রশ্ন – জিলের যে মনে হলো, তা কি ভাষা ছাড়া মনে হতো না? শারীরিক খিদের অনুভব পশুপাখি, বা কথাহীন শিশুদের হয় কী করে? এই অনুভব কি চিন্তা নয়, তাতে মস্তিষ্কের কোনো ভূমিকা নেই। আমরা পরের অংশে এই প্রশ্নটিকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি।

বলা বাহুল্য, আচরণবাদীদের কথার জবাবে পালটা প্রশ্ন করা হয়, তাহলে মহাশয়, পশুদের কি চিন্তা করার ক্ষমতা নেই, তারা চিন্তা করে না? আর স্বাভাবিক শিশু, যে তখনো কথা শেখেনি, সে কি কিছু ভাবে না? মূক ও বধির, কথাশক্তিহীন শিশু ও মানুষেরা কিছু ভাবে না। তাদের কোনোরকম চিন্তা করার ক্ষমতা নেই? আগে কথা বলতে হবে, তারপর চিন্তা করতে হবে, এ-কথা তো জীবজগতের বিবর্তনের দ্বারাই অপ্রমাণিত হয়ে যায়। মানুষ কতদিন ভাষা ছাড়া বেঁচেছে বলুন – অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার বছর আগেও তো তার ভাষা বলতে আমরা এখন যা বুঝি তা ছিল না। কাজেই মানুষের কাছে এলে ওই তত্ত্বটা আরো বেশি প্রশ্নাধীন হয়ে পড়ে। এক ধরনের চিন্তা পশুরা নিশ্চয়ই করে, জৈবিক অস্তিত্বের সঙ্গেই যে চিন্তা জড়িত। কোথায় কোথায় খাবার পাওয়া যাবে, খাবার পেলে সন্তানদের জন্য তা নিয়ে আসতে হবে, খাবার যদি প্রাণীজাতীয় হয় তাহলে তা শিকার করার কৌশল কী করতে হবে, কোন ধরনের বাসস্থান তার আর তার সন্তানদের পক্ষে ভালো হবে, কার এবং কী থেকে তাদের বিপদ আসতে পারে – সেসব চিন্তা তারা করে না। এত বড় আশ্চর্য কথা! এখানে এমন দাবি করলে তো হবে না যে, পশুদের মধ্যে কোনো আরিস্তোত্লের মতো দার্শনিক নেই, কোনো পশুর হাতে গাল রেখে চিন্তানিমগ্ন মূর্তি ভাস্কর রদ্যাঁ বানিয়ে যাননি, কাজেই পশুরা চিন্তা করে না। পশুরা যথেষ্ট চিন্তা করে। ‘ওই যে সামনে মূর্তিটা দেখা যাচ্ছে সে আমার বন্ধু না শত্রু, এই যা বস্তুটা সামনে পড়ে আছে তা কি আমার খাদ্য না খাদ্য নয়, আজ কোনদিকে গেলে সহজে খাদ্য মিলবে, ওই মহিলার সঙ্গে কি আমি আমার সাময়িক পশু-সংসার পাততে পারি, আমার সন্তানগুলোকে কীভাবে রক্ষা করব, আমার দলের মধ্যে হিংস্র পশু আক্রমণ করেছে, আমি কীভাবে আমার দলকে রক্ষা করব?’ ইত্যাদি নানা চিন্তা পশুকে নানা সময়ে করতে হয় এবং ভাষার সাহায্য ছাড়াই সে তা করে।

মানুষের কথাহীন শিশুদের বিষয়টাও একই। ‘সামনে যে মহিলাটি আছেন, ইনি আমার খুব পরিচিত, এঁর শরীরের একটা অংশে আমার খাদ্য আছে, আমার এখন এর কাছে যেতে হবে’ – এও এক ধরনের চিন্তা। সে হয়তো শব্দ দিয়ে এই কথাগুলো ভাবে না, অর্থাৎ ‘সামনে’, ‘মহিলা’, ‘ইনি’, ‘আমার’, ‘পরিচিত’ ইত্যাাদি কোনো কথাই তার আয়ত্ত হয়নি, কিন্তু সে যে মাকে দেখলেই তার শরীরের ওই খাদ্যজোগানদার অংশের দিকে এগিয়ে যায়, তা তো আমরা প্রত্যহই দেখি। কথার ক্ষমতা ছাড়াই শিশুর মনে এ-চিন্তা জাগতে পারে, আবার অন্য কোনো মহিলাকে দেখেও সে বুঝতে পারে, তাঁর বুকে তার খাদ্য নেই। প্রিয় খেলনা দেখে সে যে হাত বাড়ায়, তাও ওই চিন্তা থেকে যে, ‘এটা আমার ভালো লাগছে, এটা আমি চাই।’ বা ‘ওই আওয়াজটা আমার ভালো লাগছে না, ওটা ভয়ংকর কিছু নয় তো?’ এমন বললে হবে না যে, এগুলো চিন্তা নয়, শুধু ‘ঈশ্বর আছে কি নেই, মানুষ মৃত্যুর পর কোথায় যায়’, ‘উত্তর-আধুনিকতার ভুল কোথায়’ – এসব চিন্তাই চিন্তা। মূক ও বধির শিশু এবং মানুষদের নিয়েও প্রচুর গবেষণা হয়েছে এই বিষয়টা দেখার জন্য। এটাও দেখা গেছে যে, কথা বলার ক্ষমতা আসার আগেই কথা বোঝার ক্ষমতা (comprehension)  জন্মায় শিশুদের। কথা বুঝতে পারাটাই এক ধরনের চিন্তাপ্রক্রিয়া। মূক-বধিরদেরও যে কথা বোঝার ক্ষমতা আছে তা তো আমরা দেখিই, কাজেই কথা একটুও না বলতে পারলেও তারা এক ধরনের চিন্তাপ্রক্রিয়ার সাহায্যে অন্যের কথা বুঝে নেয় এবং আরেক ধরনের চিন্তাপ্রক্রিয়ার সাহায্যে সেই কথা পালন করতে বা অস্বীকার করতে এগোয়। যদি কথার প্রতি উদাসীন থাকে, তাও একটা চিন্তিত সিদ্ধান্তের বিষয় – ‘আমি এ কথাটাকে কোনো মূল্যই দিতে চাই না।’ ভাষাবিজ্ঞানীরা আইরিশ লেখক নোলান আর জাপানি বালিকা রিয়ের কথা বলেছেন, যাঁরা কথা বলতে পারার আগে লেখা পড়তে পারতেন, এবং লেখা থেকে শব্দের মানে বুঝতে পারতেন। তার মানে তাঁদের চিন্তার সামর্থ্য তৈরি হয়েছিল। আরো একটা সাংঘাতিক পরীক্ষার কথা পাই আমরা – স্মিথ বলে একজন গবেষক নিজের শরীরে ইনজেকশন দিয়ে শরীরে সাময়িক প্যারালিসিস বা আড়ষ্টতা সঞ্চার করেছিলেন – যখন তাঁর কথা বলার কোনো ক্ষমতাই ছিল না। ওই সময় কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্যে তিনি শ্বাস নিয়েছেন। তখন কি তাঁর চিন্তাশক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছিল? একেবারেই না। তিনি পরে তাঁর প্রতিবেদনে জানান যে, তিনি ওই অবস্থাতেও চিন্তা করতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর সহকারীরা তাঁকে কিছু অংক কষতেও দেয়, তাও তিনি ঠিক ঠিক কষে দেন। অর্থাৎ কথা বলার ক্ষমতার সঙ্গে চিন্তার ক্ষমতার কোনো সাক্ষাৎ সম্পর্ক নেই। যদি থাকত তাহলে কথা বলার ক্ষমতা যদি কারো পরে লোপ পায় (এমন অনেকের ক্ষেত্রে হয়েছে, যেমন সম্প্রতি প্রয়াত প্রসিদ্ধ পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং), তাহলে তাঁর চিন্তার ক্ষমতাও লোপ পেত। এমনটা কখনো ঘটে না। স্টিফেন হকিংয়ের মতো প্রবল চিন্তাশীল মানুষ এ পৃথিবীতে কতজন ছিলেন? আর শিশুর বিকাশে এমন দেখা গেছে এবং পরীক্ষাতেও প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের ঘরেও তা দেখতে পাই – কথা বলার আগে শিশু কথা বুঝতে শেখে। কথা বোঝা আর সেই বোঝা অনুযায়ী কাজ করা – নিঃসন্দেহে এক ধরনের চিন্তাশক্তির পরিচয় – যা আচরণবাদীরা অগ্রাহ্য করেন। তারা যখন ব্লক সাজায়, সাজিয়ে স্তূপ বা ওই ধরনের নানা গঠন তৈরি করে, বা জিগস পাজলের ছবির টুকরো বসায় তখন কোনটার পরে – ওপরে বা পাশে কোনটা সাজাতে হবে তার চিন্তা এবং সিদ্ধান্ত তারা সহজেই নেয়। আর কথা আগে বুঝতে না শিখলে কথা উচ্চারণ বা উৎপাদন করাও শিশুর পক্ষে সম্ভব হতো না, আচরণবাদীরা এ-কথাটাতেও তেমন আমল দেন না। তাঁদের তত্ত্ব ভ্রান্ত, এতে সন্দেহ নেই।

এ থেকেই যে-প্রশ্নটা উঠে পড়ে তা হলো, কথা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, না চিন্তা কথাকে? আচরণবাদীরা যেন প্রথমটাকেই বিশ্বাস করেন। কিন্তু চিন্তা যে কথা বলাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার একটা প্রমাণ হলো মিথ্যাভাষণ। আমি ভাবছি এক, আর বলছি অন্য – এই হলো মিথ্যাভাষণের মূল কথা। কাজেই মিথ্যা বলব এই চিন্তা আগে আসে, তার থেকে শুরু হয় মিথ্যা কথা বলা।

 

খ. তত্ত্ব দুই : চিন্তার জন্য ভাষা অপরিহার্য

তত্ত্ব দুই, তিন ও চার মূলত একই তত্ত্বের রকমফের, স্টাইনবার্গ ও শ্চিয়ারিনি তাকে তিনটি সূক্ষ্ম ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলোর প্রবক্তা মোটামুটিভাবে দুই আমেরিকান – এডওয়ার্ড সাপির (১৮৮৪-১৯৩৯) আর বেঞ্জামিন লি হোয়র্ফ (১৮৯৭-১৯৪১)। প্রথমজন বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী, দ্বিতীয়জন শৌখিন তত্ত্বজিজ্ঞাসু, কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে তাঁর মতামত যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে।

এই তত্ত্বকে ‘ভাষা-সাপেক্ষবাদ’ বা Linguistic RelativismÕ নাম দেওয়া হয়। আগের তত্ত্বের সঙ্গে এর একটু তফাৎ আছে। তা হলো, আচরণবাদীরা মনে করেন ভাষা আগে, চিন্তা তার পরে আসে; আর এঁরা মনে করেন ভাষার সাহায্যে চিন্তা উৎপাদিত হয়। রুশ মনোবিজ্ঞানী ভিগোৎস্কিও এ-কথা বলেন, Ôthought is born through wordsÕ (1934 : 153), তাই এই মতটাকে বিশেষ করে সাপির-হোয়র্ফ হাইপোথিসিস নাম দেওয়া হয়েছে। এটির অন্য ইংরেজি নাম Linguistic Determinism বা ভাষা-সাপেক্ষবাদ কিংবা ভাষা-নিয়ন্ত্রণবাদ।

এর যে প্রাথমিক কথা যে ভাষা ছাড়া চিন্তা করা যায় না – তা আগের তত্ত্বের আলোচনাতেই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে গেছে। আগের তত্ত্বের কথা ছিল যে, ভাষা থেকেই চিন্তার উদ্ভব, এটি তুলনায় একটু উদার। কারণ আগের তত্ত্বে ভাষা বলতে শুধু কথা বলার ক্ষমতা বুঝিয়েছে। আর এই তত্ত্বে ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ চেহারা কল্পনা করা হয়েছে – কথা বোঝার ক্ষমতাও তার অঙ্গ। সাপিরের কথা খুব স্পষ্ট – অনেকে ভাবেন যে … … they can think, or even reason, without language is an illusion. (Sapir, 1921 : 15)। ভিগোৎস্কির কথা আমরা ওপরে উদ্ধার করেছি। ভাষা সম্বন্ধে এঁদের মতো আচরণবাদীদের চেয়ে উদারতর হলেও, এঁদের মতোও গ্রহণযোগ্য নয়। তার কারণ, আগেই বলেছি, পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, মূক ও বধির মানুষেরা, যারা কথা শুনতে পান না, বলতেও পারেন না, তাদেরও চিন্তার ক্ষমতা আছে। হেলেন কেলার তাঁর এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত। স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে নানা ক্ষেত্রে শ্রুতি ও বাকপ্রতিবন্ধীদের বুদ্ধি বা চিন্তার ক্ষমতা কম নানা পরীক্ষাতে এও অপ্রমাণিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় কথা, যারা একটির চেয়ে বেশি ভাষা জানেন – অর্থাৎ বহুভাষীরা – তাঁদের চিন্তার ক্ষমতা কি একভাষীদের চেয়ে বেশি? সাম্প্রতিক মনোবিজ্ঞানে একাধিক ভাষা জানলে মেধার একটু হেরফের ঘটে তা বলা হয়েছে, কিন্তু তা বহুভাষীকে একভাষীর চেয়ে স্বতঃসিদ্ধভাবে বেশি চিন্তা ক্ষমতাবান করে তোলে না।

 

তৃতীয় তত্ত্ব : ভাষা মানুষের প্রাকৃতিক প্রতিবেশের বোধকে নিয়ন্ত্রণ, এমনকি নির্মাণ করে

এঁদের মতের – linguistic determinism বা ভাষা-সাপেক্ষবাদের – সোজা বিবরণ হলো – মানুষ যে-ভাষা বলে, সে-ভাষা তার জীবন আর

পৃথিবীকে দেখার বোধকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ মানুষ আগে একটা শব্দ পায়, আর সেই শব্দ তাকে তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করে। যত শব্দ, তত অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য; আবার শব্দ যত কম, অভিজ্ঞতা তত সীমাবদ্ধ। যেমন ধরা যাক, আদি আমেরিকান হোপিদের ভাষায় পাখির একটা নাম আছে; কিন্তু আর যা কিছু ওড়ে সবই একটা শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় – পোকামাকড় থেকে অ্যারোপ্লেন আর তার পাইলট পর্যন্ত। এস্কিমোদের ভাষায় বরফের নানা চেহারার যত শব্দ আছে ইংরেজি বা বাংলা ভাষায় তত নেই, ইংরেজিতে তবু গোটাপাঁচেক আছে, বাংলায় তাও নেই। নানা ভাষার রঙের নাম আর ধারণা, জ্ঞাতি নাম আর ধারণা থেকেও আপাতভাবে মনেই হতে পারে যে, হ্যাঁ, ব্যাপারটা বুঝি এরকমই। আমাদের বাঙালিদের ‘ভায়রাভাই’, ‘জামাইবাবু’ আর ‘শালা’ সবই ইংরেজিতে brother-in-law ইংরেজরা কি এই তিনটে সম্বন্ধকে এক বলে ভাবে? তা মোটেই নয়। তাই হোয়র্ফ যেমন বলেছিলেন, ÔWe cut nature up, organize it into concepts, and ascribe significance as we do, largely because we are parties to an agreement to organize it in this way Ñ and agreement that holds throughout our speech community and is codified in the patterns of our language.Õ এতে largely থেকে community পর্যন্ত অংশ বাদ দিয়ে পড়লে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে। অর্থাৎ আমরা   প্রকৃতিকে (বা জীবন-অভিজ্ঞতাকে) কেটেকুটে বিভিন্ন ধারণায় সাজিয়ে তুলি, আর তাতে অর্থ দিই, মূলত আমরা একটা চুক্তির দ্বারা ওই রকমভাবে প্রকৃতিকে বা পৃথিবীর অভিজ্ঞতাকে সাজিয়ে তুলতে বাধ্য; এই চুক্তিতে আমাদের ভাষাগোষ্ঠীর সবার অংশ আছে, আর আমাদের ভাষার বিন্যাসের মধ্যেই এই চুক্তির শর্তগুলো তৈরি আছে।

হোয়র্ফ উদাহরণ হিসেবে আদি আমেরিকান হোপি ভাষার উদাহরণ এনেছিলেন। সে-ভাষায় নাকি ‘সময়’বাচক শব্দের সংখ্যা খুবই কম, তাই ইউরোপীয়-আমেরিকানদের সময়ের ধারণা – সময় ধারাবাহিকভাবে অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে চলে নাকি হোপিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে হোপিরা বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎকে নিখুঁতভাবে তফাৎ করে না। পরবর্তী গবেষণায় হোয়র্ফের বক্তব্য ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। হোপিরাও দিব্যি পশ্চিমি সময়ের ধারণা বুঝে নিতে পারে। অন্যদিকে এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষা যখন শিখে নেয়, তখন তার মধ্যে দুই ভাষার দুরকম নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই অভিজ্ঞতার মধ্যে লড়াই বেধে যায় কি? না, বিশ্ববীক্ষার এমন কোনো দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় না। এস্কিমোদের ভাষায় বরফের নানা চেহারার (জমাট বরফ, জলে ভাসা বরফ, গুঁড়ো বরফ, ইগলু তৈরির জন্য বরফের ইট, বৃষ্টিতে পড়া বরফ ইত্যাদি) জন্য প্রায় দেড় ডজন শব্দ আছে, ইংরেজিতে সে তুলনায় বরফবাচক শব্দ পাঁচটি বা Ñ ice, snow, sleet, icicles, slush, frost। তার অর্থ এই নয় যে, এস্কিমোদের পরিবেশে থাকলে কোনো ইংরেজ ওই শব্দগুলোর অর্থ অনুযায়ী বরফকে তফাৎ করতে পারবে না। কোনো ভাষায় রঙের শব্দ কম থাকলেও তারা সাতটা রংকে আলাদা করে চিনতে পারে না তা নয়। দরকার হলে অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করে বা নিজেদের ভাষায় যৌগিক শব্দ তৈরি করে তারা ধারণার সে-ফাঁক পূরণ করে। ধরা যাক ‘মভ’ (mauve) বা লাইলাক রঙের ধারণাগুলো আমাদের বাংলাতে ছিল না। কিন্তু লেখাপড়া-জানা বাঙালি মেয়েদের এই রংটিকে চিহ্নিত করতে কোনো অসুবিধে হয় না, কারণ মভ রঙের নানা বস্তু তারা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তাই উলটো কথাটাই সত্য যে, মানুষের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকেই শব্দ তৈরি হয় – শব্দ থেকে অভিজ্ঞতার সৃষ্টি সবসময় হয় না। এস্কিমোরা বরফে আচ্ছন্ন প্রতিবেশে নানা কাজে বরফের ভিন্ন ভিন্ন রূপের সঙ্গে পরিচিত হয় বলেই তাদের ভাষায় বরফভিত্তিক অতগুলো শব্দ তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ (যা চিন্তার একটি রূপ) থেকেই শব্দের বা ভাষার সৃষ্টি, শব্দ বা ভাষা থেকে অভিজ্ঞতার সৃষ্টি নয়।

দুই ভাষা বাদ দিয়ে এক ভাষা থেকেই আর একটা অনুরূপ দৃষ্টান্তও দেওয়া যায়। আমরা যারা একটা ভাষা বলি, তাদের অভিজ্ঞতাও তো হুবহু এক নয়। আমি বাঙালি ‘ভদ্রলোক’, ‘শিক্ষিত’ বলে নিজেকে মনে করি, আমাদের দুজনের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র এক নয়। বলেই আমাদের শব্দের ভা-ারও সর্বাংশে এক নয়। আমার চেয়ে একজন চাষি ধানের অনেক বেশি নাম জানেন, আমি জানি না। একজন মৎস্যজীবী অনেক বেশি মাছের নাম জানেন, একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী জানেন অনেক বেশি গাছ আর ফুলের নাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনটা আগে হয় – তিনি আগে ধানের নাম জানেন, না তার চাষের কাজের অভিজ্ঞতার সূত্রে একে একে ধানের নানা রূপের সঙ্গে তার পরিচয় হয়, ফলে তিনি সেগুলোকে আলাদা করে চিনতে শেখেন যেমন তাদের নামগুলোও তার স্মৃতিতে থিতু হয়ে যায় – এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা জানি, আগে অভিজ্ঞতা, তার পরে নাম তৈরি বা নাম জানা হয়। মৎস্যজীবী আর উদ্ভিদবিজ্ঞানী সম্বন্ধেও একই কথা।

 

তত্ত্ব চার : ভাষা আমাদের সাংস্কৃতিক বিশ্বদৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মাণ করে

এই তত্ত্ব ওপরের তত্ত্বের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। যেমন ধরা যাক, আমাদের বাংলা ভাষায় মামা, কাকা, জ্যাঠা – সবই ইংরেজিতে uncle নামে চলে। সেখানে বাংলার তুলনায় ইংরেজি জ্ঞাতিসম্পর্ক under-distinguished বা উননির্দিষ্ট। কিন্তু দরকার হলে ইংরেজ maternal uncle বলে ‘মামা’র ধারণাটিকে প্রকাশ করতেই পারে। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা ভাষা এবং বিশ্ববীক্ষা  হোয়র্ফ যাকে বলেন (metaphysics) তৈরি করে, ভাষা বিশ্ববীক্ষা তৈরি করে না, অভিজ্ঞতাকেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না।

ছেলেবেলায় আমরা দেবদেবী-রাক্ষস-খোক্কস-পরিদের গল্প শুনি বলে আমরা সারাজীবন সেগুলোতে বিশ্বাস করে চলি বা চলতে বাধ্য – এমন আজগুবি কথা কে মানবে। মানুষ নাস্তিকও হয় ওইসব শব্দের বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করে। ভাষার আক্ষরিক অর্থ ছাড়িয়ে আমাদের চিন্তা বাস্তবের নিজস্ব ধারণা তৈরি করে নেয়। আমাদের ভাষায় ‘আকাশ সমুদ্রে এসে মিশেছে’ বা কবিতার অনেক কথা – ‘ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’ যেমন – তা আমরা কখনোই আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করি না। ফলে ভাষা আমাদের বাস্তব পরিবেশ-জ্ঞানকে এবং সামাজিক ও মানবিক সংস্কৃতির বোধকে নির্মাণ বা নিয়ন্ত্রণ করে – এ-কথা একেবারেই মান্য নয়। আবার ভাষায় শব্দ নেই বলে সে-সম্বন্ধে আমাদের ধারণাও নেই, এ-কথাও সত্য নয়। ভাষায় যখন অন্য ভাষা থেকে নতুন শব্দ আসে, তখন খুব সহজেই নতুন নতুন ধারণা আমাদের ভাষায় এসে ঢুকে যায়, আমরা তা নিয়ে কাজকর্ম করতে কোনো অসুবিধে বোধ করি না। এ-কথা বোধ হয় সবাই জানেন যে, খুব কম ভাষা আছে, যাতে বিদেশি শব্দ প্রবেশ করেনি। ওইসব শব্দকে বলে ঋণশব্দ বা loanword। ইংরেজি ভাষায় ঋণশব্দের সংখ্যা আর সব ভাষার চেয়ে অনেক বেশি। তার মানে কি এই যে, এসব বহিরাগত শব্দ এসে ইংরেজদের ভাবনার জগতে একটা ধুন্ধুমার তৈরি করে দেয়, যার ফলে ইংরেজদের চিন্তাপ্রণালি বিপদগ্রস্ত হয়? একেবারেই নয়। সব ভাষার মানুষই বিদেশি শব্দকে স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করতে পারে।

আরেকটা কথা এই যে, সাপির আর হোয়র্ফ ‘ভাষা’ বলতে কী বুঝেছেন তা স্পষ্ট নয়। তাঁরা ভাষা বলতে অনেক ক্ষেত্রে এক, অভিন্ন, সংগত কথাপ্রণালী বুঝিয়েছেন। আসলে চমস্কির ওই e-language আর l-language যেমন আছে, তেমনি বাইরের দিক থেকে দেখলে একটা ভাষা তো অনেকগুলো উপভাষা আর শ্রেণিভাষার সমষ্টি বা গুচ্ছ। যদি ভাষা আমার বিশ্ববীক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে উপভাষাও নিশ্চয়ই তাই করে, মেদিনীপুরের উপভাষার মানুষ আর চট্টগ্রামের উপভাষার মানুষ (উভয়েই বাঙালি এবং বাংলাভাষী) যেহেতু বিপুলভাবে পৃথক দুটি উপভাষা বলেন, তাদের বিশ্ববীক্ষা অনড়ভাবে ভিন্ন হওয়া উচিত। অথচ একটা স্তরে, প্রমিত বাংলার মাধ্যমে, তাদের পরস্পরের সঙ্গে আদান-প্রদানে কোনো অসুবিধে হয় না। আবার ভাষা প্রায় এক অথচ দুটি সাংস্কৃতিক জগৎ আলাদা, তাও তো দেখা যায়। উৎসের দিক থেকে হিন্দি আর উর্দু প্রায় একই ভাষা, অন্তত ব্যাকরণের হিসাবে। তা সত্ত্বেও হিন্দিভাষী আর উর্দুভাষীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক অর্থাৎ অভিজ্ঞতার পার্থক্য কম নয়। অনুবাদের বেলায় সাপির-হোয়র্ফ তত্ত্বের দুর্বলতা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশে দেশে সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে, দর্শন ও চিন্তাপ্রণালির পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তা হয় ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার জন্য, ভাষার জন্য হয় না। আর তাই অনুবাদে বিশেষ বাধাও ঘটে না। বহু প্রাচীনকাল থেকেই অনুবাদ সম্ভব এবং অবশ্যকর্তব্য বলে মানুষ মনে করেছে এবং সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য পার্থক্য মানুষে মানুষে মৌলিক ঐক্যকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি।

 

৩. তাহলে কী দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত

যেখানে এসে শেষ পর্যন্ত রফা করতে হয় তা এই – চিন্তারও নানা রকম আছে। আছে আমাদের প্রতিবেশের সঙ্গে সংঘাতে তৈরি নানা রকম চিন্তা, যা অনেক সময় আমাদের জৈবিক অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে জড়িত। আগে বলা কতকগুলো কথার পুনরাবৃত্তি করি – সামনে যে-বস্তুটা পড়ে আছে ওটা কি আমার খাদ্য হতে পারে? ওই যে একটা প্রাণীর মুখ দেখলাম গাছপালার আড়ালে (বা গায়ের গন্ধ পেলাম) সে আমার বন্ধু না শত্রু? জঙ্গলে হলুদ এক রকমের শিখা জ্বলছে, হঠাৎ গরম লাগছে এসে গায়ে, কী একটা গন্ধও আসছে – সবাই পালাও, বিপদ! এই অনুভবগুলো প্রাণীরা বা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে শেখেনি, কারণ তাদের ভাষা নেই। প্রথমদিকে আমরা ভাষাহীন শিশুর চিন্তা সম্বন্ধে যা বলেছি তাও অনেকটা এরকম। কিন্তু তাও যে চিন্তা, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

কিন্তু ভাষা একবার অর্জিত হওয়ার পর মানুষের চিন্তা তার এই জৈবিক (খাদ্য ও শরীরের অন্যান্য ক্রিয়া, যৌনতা, সন্তানপালন,

প্রাকৃতিক ও অন্যান্য প্রতিবেশগত বিপদ-আপদ ইত্যাদির) সূত্র থেকে বেরিয়ে গিয়ে যে বিশাল বিস্তার ও সূক্ষ্মতা লাভ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তার চিন্তার জগতে একটা বিস্ফোরণ ঘটে বলা যায়। একটা বড় সুবিধে হয়েছে যে, মানুষ তার স্মৃতিকে ভাষার মাধ্যমে সঞ্চয় করতে পেরেছে, সুরক্ষিতও করতে পেরেছে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর স্মৃতি আছে, আর আমরা জানি স্মৃতি যেমন এক ধরনের চিন্তা, তেমনি স্মৃতি অন্য চিন্তাকে উসকে দেয় ও সহায়তা করে। হাতির স্মৃতিশক্তি খুব প্রবল, তা আমরা জানি। কিন্তু মানুষের ভাষার স্মৃতি তার লাখ লাখ অভিজ্ঞতাকে প্রকাশের সুযোগ এনে দিয়েছে। মানুষ যত কথা বলে প্রতিটি বাক্যে তার চিন্তা নিহিত থাকে, আর প্রতিদিন যে হাজার হাজার বই মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয় তারও প্রতিটিতে মানুষের চিন্তার অভাবিত ব্যাপ্তি ও সূক্ষ্মতা লক্ষ করা যায়। চিন্তার এই বিশদতা অবশ্যই ভাষা ছাড়া সম্ভব হতো না। অজস্র শব্দ মানুষের স্মৃতিতে সঞ্চিত হয়েছে। তারই ফলে মানুষের ইতিহাসবোধ তৈরি হয়েছে এবং ইতিহাসের নানা ঘটনা ও বৌদ্ধিক বিতর্কের মহাফেজও সে জমিয়ে তুলতে পেরেছে। ভাষা যতদিন মৌখিক পর্যায়ে ছিল ততদিন ব্যক্তিগত স্মৃতিজুড়ে হয়তো সংহত গোষ্ঠীর স্মৃতিভা-ার তৈরি করেছে। পরে লেখা আবিষ্কার হওয়ার পর স্মৃতি ও ইতিহাস ক্রমে সর্বজনীন ব্যাপ্তি লাভ করেছে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছে তার নানা দর্শন ও বিদ্যা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিষয় ও তার পরিভাষা। চিন্তার এই গভীরতা ও বিস্তার অবশ্যই ভাষা ছাড়া সম্ভব ছিল না। তার ফলেই মানবশিশুর শিক্ষা সম্ভব হয়েছে এবং পূর্বপুরুষের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রজন্মের পর প্রজন্মে সঞ্চারিত করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই চিন্তার শুধু পরিমাণগত নয়, বিপুল গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তার মূলে আছে ভাষা, কারণ ভাষা ছাড়া শিক্ষা হয় না, সে-শিক্ষা মুখে মুখেই হোক, আর মুদ্রিত পাঠেই হোক।

তাই মানুষের মন ও প্রকাশের বিবর্তনে চিন্তা আগে, ভাষা পরে। ভাষা চিন্তা বা বোধকে, অভিজ্ঞতাকে কঠোর ও স্থায়ীভাবে নির্মাণ বা নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং অভিজ্ঞতাই ভাষায় শব্দের উপাদান জোগায়। তবে ভাষা না হলে মানুষের জৈবিক অস্তিত্বের প্রাথমিক চিন্তাগুলোর বাইরে এত বিচিত্র ও সূক্ষ্ম বহুজটিল চিন্তা সম্ভবই হতো না, এও সমান সত্য।

 

উল্লেখপঞ্জি

‘ভাষার ঘাটতি তত্ত্ব : বার্নস্টাইনের বিভ্রান্তি’, পবিত্র, সরকার, ১৯৯৮, পৃ. ১৩৯-১৫৩। …, ১৯৯৮, ভাষা দেশ কাল, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ।

Aitchison, Jean, 2003, Words in the Mind, London : Blackwell Publishing

Carruthers, Peter, 1996, Language Thought and Consciousness, Cambridge : Cambridge University Press.

Carroll, John B. (ed.), 1964, Language Thought and Reality : Selected Writings of Benjamin Lee Whorf, Cambridge, Mass : The MIT Press.

Crystal, David, 1987, The Cambridge Encyclopedia of Language, Cambridge :  Cambridge University Press.

Steinberg, Danny D. and Natalia V. Sciarini, 1993, An Introduction to Psycholinguistics, Harslow, England etc. : Pearsons/ Longmans.

Vygotsky, L. S., 1934/ 1962, Thought and Language, Cambridge, MS., MIT Press.