চিরজনমের কবি-প্রিয়ার খোঁজে

কবি ও রহস্যময়ী ষ বিশ্বজিৎ চৌধুরী ষ প্রথমা প্রকাশন

ঢাকা, ২০২০ ষ ৩৫০ টাকা

কবি, গল্পকার ও সংবাদকর্মী বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কবি ও রহস্যময়ী উপন্যাসের প্রধান দুই পাত্র-পাত্রীর নাম নজরুল এবং ফজিলতুন্নেসা। উপন্যাস হলেও চরিত্রগুলো সত্য; ইতিহাস থেকে উঠে আসাই কেবল নয়, বাংলাভাষীদের খুব কাছের, বড় আপনজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান নারী শিক্ষার্থী  ফজিলতুন্নেসা ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যকার ধোঁয়াটে ও অমীমাংসিত এক সম্পর্ক নিয়েই রচিত উপন্যাসটি।     

অবিভক্ত ভারতবর্ষের ময়মনসিংহ জেলার করোটিয়ার

কুমল্লিনামদার গ্রামের এক হতদরিদ্র স্কুলশিক্ষকের মেয়ে ফজিলত পাড়াগাঁয়ের স্কুল থেকে মাসিক পনেরো টাকা বৃত্তি নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে যখন ঢাকায় এসে ইডেন কলেজে ভর্তি হন, তখনই সবাই মনে করেছে – এ-মেয়ের অনেক পড়া হয়ে গেছে। ইডেনের পাঠ শেষ করে মেয়েটি বেথুন-যাত্রা করলে চোখ কপালে ওঠে সমাজের। বেথুনের পড়া শেষ করেও থামে না মেয়েটি। এবার গন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গে নবস্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন অদম্য ফজিলতুন্নেসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের তদানীন্তন প্রধান ড. নলিনীমোহন বসু যাঁকে ‘ঝড়ের মুখে প্রদীপ শিখা’ বলে মনে করতেন।    

একে তো বিশ্ববিদ্যালয়, তার ওপর অংক নিয়ে পড়া! পূর্ববাংলার সাধারণ মুসলমান পরিবারের কোনো মেয়ের পক্ষে এতোদূর আসা সেকালেই কেবল নয়, শতবছর পর একালেও খুব একটা দেখা যায় না। আজো অনেক মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পেছনে প্রধান লক্ষ্য থাকে ভালো ঘর-বর পাওয়া। উচ্চশিক্ষিত হয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে সমাজের কল্যাণে কাজ করার স্বপ্ন খুব কম মেয়েই লালন করে। মেধা, উদ্যম, কর্মনিষ্ঠা আর সীমাহীন ধৈর্য ফজিলতুন্নেসাকে সচল রেখেছে সকল ঝড়ঝঞ্ঝার মুখে। নিজের সময়ের চেয়ে শতবছর এগিয়ে থাকা এই মেয়েটির কথা লোকের মুখে মুখে। বোদ্ধামহলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক চলছিল তখন। বাংলার সাহিত্যের আকাশে স্ফুলিঙ্গের মতো আবির্ভূত কাজী নজরুল ইসলামের পূর্ববঙ্গ সফরের সময় ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াটা তাই বিচিত্র কিছু নয়। ‘দেশটাকে মাথায় তুলে নাচছেন, আর নাচাচ্ছেন’ সপ্রতিভ, দুর্বিনীত, দুর্বার, চিরবিদ্রোহী নজরুল। সম্মোহনী গায়কিতে শ্রোতা ভোলানো, অট্টহাসিতে আসর মাতানো সেই নজরুল বড়ই অপ্রতিভ হয়ে পড়েন ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে। যাঁকে ঘিরে গণমানুষের নিরন্তর উন্মাদনা, সেই তিনিই কি না উন্মাদ হয়ে বারবার ছুটে যান ফজিলতের কাছে।

প্রকৃতই ফজিলতুন্নেসাতে নজরুলের মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। নারীশক্তির জয়গান গাওয়া নজরুল চোখের সামনে একজন মেয়েকে এগিয়ে যেতে দেখছেন, যিনি চিরাচরিত শারীরিক সৌন্দর্যের ধার ধারেন না, বরং ব্যক্তিত্ব ও মেধার দ্যুতি যাঁর সৌন্দর্যে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। তবে দেওয়ান বাজার রোডের দু-কামরার ঘরের সামনের এক চিলতে উঠোনে ছোট্ট বাগানে ফুল ফোটানো  ফজিলত গণিতের কারাগারে বন্দি বলে আক্ষেপেরও শেষ ছিল না নজরুলের। নজরুল অকপটে বলেই ফেলেন, শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করলেই তাঁকে বেশি মানাত। সাহিত্য ভালোবাসলেও, ফুল ফোটাতে জানলেও, ফজিলতের প্রথম ভালোবাসার নাম গণিত। নজরুলকে তাই ছেড়ে কথা বলেন না তিনি। মেয়ে মানেই সৌন্দর্যের প্রতীক – এই ঘেরাটোপের ভেতর আবদ্ধ স্বয়ং নজরুল, যিনি কি না নর-নারীর সমতার কথা বলেন তাঁর কবিতায়! তবে কি আর সকল সাধারণ পুরুষের মতো তিনিও নারীর অবয়বটাকেই  বড় করে দেখেন? একটি মেয়ের প্রতিভা ও যোগ্যতার কোনো মূল্যই কি নেই কবির কাছে? চিরচেনা নজরুলের এই রূপ মেনে নিতে দ্বিধা হয়। কবি হলেও তিনি মানুষ বই অন্য কিছু তো নন!

উপন্যাসের নাম কবি ও রহস্যময়ী হলেও কবি নিজেও কিন্তু কম রহস্যময় নন। বন্ধু মোতিহারকে লেখা চিঠিগুলোতে ঘুরেফিরে অংকের পঙ্কে অন্তরীণ সেই মানবীর কথাই উঠে এসেছে।

প্রকৃতপক্ষে ফজিলতুন্নেসা ছিলেন আপাদমস্তক স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ একজন মানুষ। প্রতিটি কদম তাঁর হিসাব করা। কবির মতো বেপরোয়া বা বেহিসেবি হওয়ার অবকাশ তাঁর ছিল না, বাসনাও

ছিল না। ব্যক্তিত্বের কঠিন আবরণ ছিল তাঁর রক্ষাকবচ। কবির নিবেদন প্রত্যাখ্যান না করে তাঁর কোনো উপায় ছিল না। তবে মনের গহিনে কবির জন্য আলগোছে তুলে রাখা ভালোবাসাটুকু লুকিয়ে রেখেই লালন করতে চেয়েছিলেন, করেছিলেনও জনমভর। ভালোবাসার স্বীকৃতি কিংবা ঘর বাঁধার স্বপ্নের কথা মনের কোণে ঠাঁই দেননি যদিও।

‘বাঙালী মুসলিম নারীদের রানী’ ফজিলতুন্নেসার চরিত্রের যে-বিষয়টি ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে তাহলো, বেগম রোকেয়াকে আদর্শ মানলেও রোকেয়ার ছায়া খুব একটা দেখা যায় না তাঁর কর্মে ও চরিত্রে। লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন, সে কেবলই নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য, কারণ তাঁকে প্রমাণ করতেই হবে – তিনি পারেন। আশপাশের মেয়েরা তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হতো, সন্দেহ নেই। খবরের কাগজে নারীমুক্তি বিষয়ে নিবন্ধ রচনার মাধ্যমে নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করে সুশীল সমাজের প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। তবে নিজের ছোট বোনকে রাঁধুনি বানিয়ে একপ্রকার তার ওপর ভর করেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর বিজয়রথ। বিষয়টা নিয়ে কিঞ্চিৎ গ্লানিবোধ থাকলেও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতোটাই নিমগ্ন ছিলেন যে, বোনের শিক্ষা নিয়ে ভাবার অবকাশই মেলেনি তাঁর। আধুনিক নারী বাইরের দুনিয়ায় আলো ছড়িয়ে ঘরে এসে খাদ্যের জন্য অন্য কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না, বরং হেঁসেল থেকে রাজ্যপাট সামলাবে সমান দক্ষতায় – বেগম রোকেয়া এমন নারীমুক্তির স্বপ্নই দেখেছিলেন।

কবি ও রহস্যময়ী উপন্যাসে সময়কে লেখক ধারণ করেছেন নিপুণ ও নিখুঁতভাবে। ১৯২৮ সালের ঢাকার পথঘাট, নাগরিক ব্যস্ততা, ছায়াবৃক্ষ ও জলাশয়ের বর্ণনা পাঠককে নিমিষেই নিয়ে যায় অন্য ভুবনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের জন্য বরাদ্দ আবাসিক এলাকা ফুলে ফুলে ভরা। ঠিক যেন ছবিতে দেখা ‘ইংল্যান্ডের পল্লীনিবাস’। কাজী মোতাহার হোসেনের বাড়ির চৌহদ্দির বর্ণনা – বহির্বাটী থেকে অন্দরমহল, হেঁসেল, আঙিনা, সাজু বিবির ঘরকন্না – বনেদি মুসলমান পরিবারের জীবনযাত্রার এক নিখাদ ছবি। মাত্র একশ বছরে সকল ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যকে মাটিচাপা দিয়ে

ইট-পাথর-লোহালক্কড়ের এক প্রাণহীন শহর নির্মাণ করে ফেলেছি আমরা পরের প্রজন্মের জন্য।

নজরুলের ব্যর্থ প্রণয় উপন্যাসের মূল উপজীব্য হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের অবস্থান, উপস্থিতি ও ভূমিকা গল্পের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কবির সঙ্গে বিজ্ঞানের অধ্যাপকের বন্ধুত্বে ভাই, বন্ধু ও প্রেমিক সত্তা সমভাবে বর্তমান। কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে পুকুর ছিল। সেই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে বসে মাঝরাতে বাঁশি বাজান নজরুল – এই দৃশ্য চিত্রায়নে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কলমের জুড়ি নেই বলতে হয়। পাঠকমাত্রই কল্পনায় দেখতে পান নিঝুম নিস্তব্ধ রাতে আলোর ভেলায় ভেসে ভেসে বাঁশিতে নিমগ্ন ঝাঁকড়া চুলের নজরুল। 

অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে এ-গল্পে কিছুতেই পার্শ্বচরিত্রে রাখা যায় না। অধ্যাপক মোতাহার গণিতের পণ্ডিত, পরিসংখ্যানে উচ্চতর ডিগ্রি তাঁর। তথাপি শিল্প-সাহিত্যের সমঝদার কেবল নন, রীতিমতো চর্চা করেন। খেলাধুলা করেন। একই সঙ্গে ধার্মিকতা বজায় রাখেন পুরোমাত্রায়। মোতাহার হোসেনের সহধর্মিণী সাজেদা খাতুনের অবস্থানও অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য গল্পের গাঁথুনিতে। সাজুবিবির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে। স্বল্পভাষী অতিসাধারণ মানুষটির বিচক্ষণতা ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা সম্পর্কে লেখকের উক্তি – ‘একা হাতে এত বড় পরিবারের সবকিছু সামলাচ্ছেন, বাড়ীতে নানা সময় নানা ধরনের অভ্যাগতদের আপ্যায়নের দিক সামলে নিচ্ছেন কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে, তবে নিজের মতামতটা জারি রাখেন নীরবে।’ সংসারে নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের যারা অতিমাত্রায় সরব ও উচ্চকণ্ঠ, তাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে সাজুবিবির অভিযোগহীন নীরব কর্তৃত্ব।

মোতাহার হোসেনের পারিবারিক সুস্থির জীবন দেখে মনে হতে পারে, এমন নিশ্চিন্ত নির্ভার একটা গৃহকোণ তো নজরুলেরও থাকতে পারত। পরক্ষণেই ভাবনায় আসে, কবি যে তিনি। বিশ্বজিৎ চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, ‘নিয়ম-অনিয়মের ধরাবাঁধা পথ বলে কিছু নেই লোকটার জন্য।’ স্ত্রী-পুত্র আছে সংসারে। কৃষ্ণনগরে বাস তাদের। অথচ কলকাতার কোনো এক ধনাঢ্য জাহানারা চৌধুরী, ঢাকায় অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথের কন্যা উমাসহ অনেক মেয়েকে জড়িয়েই গল্পেরা ডালপালা ছড়ায়। তবে এই মুহূর্তে ফজিলতুন্নেসাকেই বোধহয় প্রাণে ধরেন নজরুল। এই প্রণয়ে পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার তাড়া নেই। অধ্যাপক বন্ধুকে লেখা হৃদয় খুলে দেওয়া চিঠিগুলো হেঁয়ালিতে ভরা, বড়ই শিশুতোষ বলে মনে হয়। কণ্ঠপ্রদাহ রোগের সঙ্গে কবির পরিচয় তখন থেকেই, থেকে থেকে রক্তও আসে। বাঁশি আর বাজবে না, সুর খেলবে না কণ্ঠে, কলমও থেমে যাবে শিগগির – হয়তো জানা হয়ে গিয়েছিল মনে। চিরজনমের কবিপ্রিয়ার অবহেলায় নজরুলের আহত অভিমান পাঠকহৃদয়কে ভিজিয়ে দেয়। পথে পথে বড় হওয়া দুখু মিয়ার জীবনেও নাকি ‘স্যাডনেসে’র অভাব ছিল! এতোকাল কান্না ছিল না চোখে! ‘দুঃখ-জাগানিয়া’ অতঃপর ‘চোখের জলের প্রিয়া’ হয়ে কাব্যলক্ষ্মীকেই বুঝি নতুন প্রাণ দান করে। চোখ ভরা জল নিয়ে কলম ছুটে চলে নজরুলের। এ-জল কবির কাছে রক্তের চেয়েও দামি। ‘আচ্ছা বন্ধু, ক’ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়, তোমাদের বিজ্ঞানে তা বলতে পারে?’ – এমন কথা কেবল নজরুলই বলতে পারেন। নজরুল বলেই কি না কে জানে, স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও এতো মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পরও তাঁকে আমরা বহুগামিতার অপবাদ দিয়ে দূরে ঠেলে দিতে পারি না, যেমন পারেননি তাঁর ‘প্রাণের দোসর’ মোতিহার।

উপন্যাসের শেষের দিকে এসে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ফজিলতুন্নেসার বিলেতযাত্রার সূচনায় হাওড়া জংশনে রাজকীয় কায়দায় বিদায় জানানো হয় তাঁকে। আলো-ঝলমলে সেই সকালের পর লেখক পাঠককে নিয়ে যান পঞ্চাশ বছর পরের ঢাকায়। অশীতিপর মোতাহার হোসেনের সাক্ষাৎপ্রার্থী তরুণ সাহিত্যিক আবদুল মান্নান সৈয়দ। হাতে ফজিলতুন্নেসার খাতা, যা যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে রাখতেন ফজিলত, কারণ খাতা ভরা নজরুলের নিজ হাতে লেখা কবিতা। বাবা মৃত্যুশয্যায়, বিলেতের কাজ শেষ না করেই ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে। একসময় ইডেন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, পরবর্তীকালে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ঘর বাঁধেন, মা-ও হন; কিন্তু সে-ঘর টেকে না। ছন্দ আসে না সংসারে। বুকের গহিনে নজরুলের জন্য তৈরি করা সিংহাসনে আর কাউকে বসাতে পারেননি ফজিলত। নির্বাক কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পর বছর না ঘুরতেই তাঁর ‘চোখের জলের প্রিয়া’ অনুসরণ করেন কবিকে। তবে কি নজরুলের ভালোবাসারই জয় হয়েছে? বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কলমে উঠে আসে মোতিহারের দীর্ঘশ্বাস – ‘দীর্ঘ অপ্রাপ্তির বেদনা পাড়ি দিয়ে সুর ও বাণীর মালা গেঁথে ঠিকই তো তিনি ছুঁতে পেরেছেন অধরা মাধুরী।’

কবি ও রহস্যময়ী উপন্যাসের প্রধান উপকরণ বা অবলম্বন নজরুলের চিঠিগুলো। খ্যাতিমান নজরুল-গবেষকদের রচনা ও সাক্ষাৎকার রসদ জুগিয়েছে উপন্যাসে। টুকরো টুকরো সত্য গল্পগুলোকে একসূত্রে গেঁথে উপন্যাসের অবয়ব দিয়েছেন লেখক সহজ-সরল-প্রাঞ্জল গদ্যে। ক্ষেত্রবিশেষে কল্পনার ভেলাও ভাসিয়েছেন তিনি। প্রতিটি চরিত্র ও ঘটনা ফুটিয়ে তুলেছেন পরম যত্নের সঙ্গে। দুই বোনের টাঙ্গায় করে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, আপ্যায়নের আদবকেতা, পারিবারিক সম্পর্কের জটিল রসায়ন ভাবনার খোরাক জোগায়। কলকাতা থেকে আগত প্রশান্ত চ্যাটার্জি নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেনের দাবার চালের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়ে যেমন করে কিস্তি মাত করেছেন লেখক, তাতে তাঁকেই একজন দক্ষ দাবারু বলে মনে হয়। আবার দুই বোনের কলকাতা ভ্রমণের সুবাদে পাঠকের ১৯২৮ সালের কলকাতা শহরের একটা খণ্ডচিত্র দেখারও সুযোগ হয়ে যায়। সওগাতের কর্ণধার মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের ক্ষণকালের উপস্থিতি তাঁর মানবিক ও সাংস্কৃতিক উদারতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং সুখী পারিবারিক আবহের একটা চিত্র তুলে ধরে। কেবল ফজিলতুন্নেসা কিংবা সাজেদাই নন, উপন্যাসের প্রতিটি নারী চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক অনুভূতির কথা লেখকের কলমে জীবন্ত হয়ে ধরা পড়েছে। কে বলে নারীর মন দেবতাও পড়তে পারেন না? বিশ্বজিৎ চৌধুরী বেশ দক্ষতার সঙ্গেই নারীমনের কানাগলির খোঁজ পেয়েছেন এবং অব্যক্ত আনন্দ-বেদনার পাঠোদ্ধার করেছেন।

ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্রগুলোতে প্রাণসঞ্চার করেছেন কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। নিরলস গবেষণা ছাড়াও অনেক ছোটাছুটি করতে হয়েছে তাঁকে তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে। ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনাকে নিখুঁতভাবে জোড়া লাগিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন শতবছর আগের ঢাকা ও কলকাতার মানুষ ও সংস্কৃতিকে। এখানেই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর সার্থকতা।