শিউলি গাছের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখদুটো হঠাৎই বড়োসড়ো এক লাফ মারলো আকাশে। বহুকাল বাদে আজ ঘটনাটা পুনরায় ঘটলো।

তুলো-পেঁজা সাদা সাদা মেঘের বুটি দেওয়া ঝকঝকে নীল আকাশ। তিনটে চিল ডানা কাত করে ঘুরছিল। যেন চাঁদোয়ার তলায় বড় পোকারা ওড়ে।

মাঝে মাঝেই নীল রঙের মধ্যে চোখ ধাঁধিয়ে হারিয়ে ফেলছিলাম ওদের দু-একটাকে। আবার খুঁজে পাচ্ছিলাম খানিকবাদে।

ওরা ডানা ভাসিয়ে চক্কর মারছে গোল হয়ে। উঠছে নামছে। গলানো সোনার মতো এত্তো এত্তো রোদ্দুরে ডানা পেতে দিয়ে, বুক নামিয়ে দিয়েছে ছায়া ছায়া মাটির দিকে। ওরা পৃথিবীকে দেখছে। পেনসিল টর্চের মতো সুচোলো চোখ দিয়ে।

রোজ রোজ কত চিল পৃথিবীকে দেখার জন্য আকাশে উড়ে যায়! আমি ভাবলাম।

হঠাৎ আমার চোখদুটো আটকে গেল আরো ওপরে একটি কালো বিন্দুর ওপর। তীক্ষন নজর চালিয়ে আবিষ্কার করলাম, ওটাও চিল। অনেক ওপরে একেবারে আকাশের গা লেপটে উড়ছে। সূর্যের কাছাকাছি একা একা কেন উড়ছে ও? ভেবে পেলাম না। হয়তো একসময় নিচের চিলগুলোর সঙ্গী হয়ে আকাশে উড়ছিল ও! আসেত্ম আসেত্ম উঠে গিয়েছে আরো ওপরে। নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছে ওপরে ওঠার দরুন।

ওপরে উঠলে সবাই নিঃসঙ্গ হয়ে যায়।

নীল আকাশের গায়ে কালো বিন্দুর মতো ডুবছিল, ভাসছিল ওটা। আমি অনেকক্ষণ ওকে চোখের আড়াল হতে দিলাম না।

এককালে, আমার সেই প্রথম কৈশোরে, প্রায় দিনই ঘটতো এটা। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম আকাশের দিকে, ধীরে ধীরে ক্ষুদে ক্ষুদে চিলেরা আমার চোখে ধরা দিতো সুদূর আকাশের বুকে। এসব আমার ছেলেবেলার ঘটনা। স্মৃতিতে আটকে রয়েছে আজ অবধি। আজ তাই নিঃসঙ্গ আমি একলাটি বসে বসে ভাবছিলাম ছেলেবেলার ওইসব ঘটনার কথা।

একসময় আমার মনে হলো, চিলেরা কি এখনো আকাশের সঙ্গে গা মিলিয়ে ওড়ে? খাঁ-খাঁ দুপুরে এখনো মাঝ-আকাশে সূর্যের নাগাল পেতে চায় ওরা?

ভাবতে ভাবতে, অনেককাল বাদে আজ আবার দূর-আকাশের পানে তাকালাম আমি। দেখলাম, আমার কৈশোরের চিলগুলো আগের মতোই দূর-আকাশের বুকে সেই একই ভঙ্গিমায় ভাসছে। ইস, আমি আজ কত বছর পরে দেখলাম সেই দৃশ্য! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম দৃশ্যটা। মনের খোপে খোপে আরো সব দৃশ্য নড়েচড়ে উঠলো। তাহলে কি টুনটুনি পাখিরাও রয়েছে দুনিয়ায়! বেনে বউয়েরা বাঁশের ঝাড়ে পাখা ঝাপটায় এখনো! কাশফুল কি তেমন করেই ফোটে পুজোর সময়টাতে! আশ্চর্য আমি এতদিন কিছুই দেখতে পাইনি কেন? আজই বা এতোদিন পরে হঠাৎ কেন চোখ চলে গেল সুদূর আকাশে?

এতো উঁচুতে উড়ে উড়ে কী মজা পায় চিলেরা? কী দেখে? আমি ভাবলাম।

সবুজ ধানের ক্ষিতকে ছককাটা রুমাল, ছোট ছোট নদীকে শাড়ির রুপোলি পাড়, বন-জঙ্গল, গা-গঞ্জকে ছোট ছোট ঝোপ বলে মনে হয় কি চিলেদের? এতকিছু দেখার চোখ কি রয়েছে ওদের?

কৈশোরের সেই দিনগুলো চিলের ডানার মতো গভীর ছায়া ফেলে যায়। হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোর মধ্যে চিলের সাদা বুকের মতো ধুকপুক করতে থাকে স্মৃতি। স্মৃতির শামুকের মধ্যে বালি ঢুকে খচখচ করতে থাকে। লালা ক্ষরণ হয় অবিরাম। যন্ত্রণারা মুক্তোর মতো টলটলে হয়ে ওঠে। পলকা মন ভারি হয়ে ওঠে কিসের ভারে।

মনে পড়ে যায় চোরচিতা গাঁয়ের সেই মেয়েটিকে। দাদার বিয়েতে কী কারণে মান করেছিল। সে-মান ভাঙাতে হয়েছিল আমায়। টগরের মতো চোখদুটি তুলে বলেছিল, ‘আপনি কেন এলেন?’

কেন যে এলাম তা এই বয়েসেও বসে বসে ভাবি।

ভাবি, বন্দনা বলে সেই কিশোরীর মুখ। বিন্দুর ছেলেতে বিন্দুর পার্ট করতে গিয়ে বারবার মিনতি করেছিল আমায়, ‘আপনি দেখিয়ে দিন।’

তারা সব এখন কোনো ঘরের ঘরনি হয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার করছে। সবকিছু পেয়ে তাদের জীবন ভরে উঠেছে, কানায় কানায়। কেবল আমি …।

তবু আমার মনের একান্ত আঙিনাটিতে মাঝে মাঝে দয়া করে রাঙা পায়ের ছোঁয়া দিয়ে যায়। এমনই করুণাময়ী তারা সব। কেবল ছোঁয়া দিয়েই যায় না। লক্ষ্মীর মতো সুঠাম পা দুখানি ফেলে ফেলে তারা সময় করে দু-দ- পায়চারি করে যায় আমার চত্বরে। নিজেদের সংসার ফাঁকি দিয়েও আমার মতো অভাগাকে তারা কত কিছু বলে ভুলিয়ে যায়।

দত্তদিঘির চার পাড়ে বকুল আর কেলিকদম গাছেরা দিঘির জলে নিজেদের ছায়া দেখতে দেখতে কাঠ হয়ে যেতো। লাল শাপলার ফুলে, দামে … আগাছায় …, খরগোশ-ডাহুক আর জলপিপিদের উঁকিঝুঁকির ফাঁকে ফাঁকে ঘন হয়ে আসে আরো একটি ছবি। কলি বসে থাকে ঘাটের পাশ ছুঁয়ে। ডুরে শাড়ির পাড়ে অসংখ্য চোরকাঁটা বিঁধিয়ে। আমাকে পাশে বসে তুলে দিতে হয় সমস্ত চোরকাঁটা।

দুপুরের থমথমে আকাশে নীল চাঁদোয়ার পাশাপাশি শঙ্খচিলেরা চক্কর মারে। ওদের দেখতে দেখতে কলি সবিস্ময়ে বলে, ‘চিলগুলো সব সময় আকাশেই থাকে। বল?’

‘আকাশেই তো দেখি।’ চোরকাঁটা থেকে চোখ সরাই না আমি।

‘সন্ধের পর ওরা কোথায় থাকে?’ কলির নিস্পৃহ প্রশ্ন।

ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ চিমন্তা করতে ভালো লাগে না আমার। হালকা চালেই বলি, ‘আকাশেই থাকে।’

‘দূর বোকা!!’ কলি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে; ‘রাতে আকাশে থাকবে কী করে? ঘুমোবার জায়গা কই ওখানে?’

ভারিক্কি চালে আকাশে চোখ ফেলে কলি বলে, ‘রাতে ওরা গুচ্ছাতদের আশথ গাছে থাকে। ভোর হলেই উড়ে যায় আকাশে।’

কথাটা মোটেই মনঃপুত হয়নি আমার। কিন্তু কলির কথার পিঠে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

বলি, ‘হবেও বা।’

ভাবতে ভাবতে গলাটা ভারি হয়ে এলো আমার। কলি এখন কোথায় কে জানে। একটিবার দেখা হলে তাকে এখন বুঝিয়ে বলা যেতো, চিলেদের কথা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যেতো, চিলেরা শঙ্খচিলেরা – একবার আকাশে উঠলে আর নামে না, নাবতে পারে না।

কিন্তু থাক। দেখা হয়ে লাভ নেই। এই বয়সে কলির ছেলেমানুষি ভুলটা ভাঙিয়ে কী হবে? বরং কলি এই বিশ্বাস নিয়ে থাকুক, কিনা, দুনিয়ার সব চিল সন্ধের পর নেমে আসে মাটিতে। মাটির বুকে বেড়ে ওঠা গাছের ডালে ডালে আশ্রয় পায় ওরা রাতের মতো। অশ্বত্থ গাছের খাঁজে খাঁজে জমে থাকা নিটোল অন্ধকারে বুক ঠেকিয়ে তারা চোখ বোজে। চিকন পাতার ঝিরে ঝিরে হাওয়া কাঁপন তুলে যায় তাদের ক্লান্ত ডানায়। দুরুদুরু বুকে।

সুমিতাকে ইদানীং জীবনানন্দতে পেয়েছে ভীষণ। কাল সন্ধেবেলায় ও ভরাট গলায় আবৃত্তি করছিল : ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল।’ পাশের ঘর থেকে শুনতে শুনতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম বারবার। দত্তদিঘির কালো জলের ওপর ভেসে থাকা এক টুকরো নীল আকাশকে মনে পড়ছিল বারবার।

একসময় বই বন্ধ করে সুমিতা আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ভাসাভাসা চোখে দেখল আমার মুখ, চোখ, কপাল, চিবুক। তারপর

 

ক্লান্ত পায়ে চলে গেল।

 

চিলের কান্না ছিল কলির একেবারেই অসহ্য।

দু-কানে আঙুল চেপে গোমড়া মুখে শুধিয়ে বসতো, ‘চিলেরা সারাক্ষণ এতো কাঁদে কেন রে? অন্য পাখি তো কই কাঁদে না?’

কী উত্তর দিই আমি? আমতা আমতা করি। একখানা জবাবের জন্য ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকতো কলি। বড় অস্বসিত্ম লাগতো।

বলতাম, ‘অনেক ওপরে উঠতে হয় যে ওদের।’

‘তাতে কী? কাঁদতে যাবে কেন?’

‘ওপরে উঠতে হলে হালকা হতে হয় যে। কাঁদলে বুক হালকা হয়ে যায় অনেক।’

কলির মোটেই পছন্দ হতো না আমার ব্যাখ্যা। সেসব ওর খুব ছেলেবেলার কথা। তার অনেকদিন বাদে, ওর শাড়ি থেকে চোরকাঁটা বেছে দেওয়ার দিনে কলিকে শুনিয়েছিলাম অন্য কথা। বলেছিলাম, চিলেদের মাটির মায়া ভীষণ। কিন্তু মাটিতে তাদের থাকার জায়গা নেই। চিলেরা তো বাসা বাঁধতে পারে না কোনোদিন। আকাশেই তাদের বাসা। মাটির বুকে সকলের নিরাপদ শান্তির আশ্রয়গুলো দেখে তারা কাঁদে, আর শাপ দেয়, মাটির প্রাণীদের।

কলি ব্যথাজাগানো গলায় শুধিয়েছিল, ‘চিলেদের শাপ ফলে?’

আবার দোটানার মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে বলেছিলাম, ‘ফলে বইকি, কারো কারো বেলায় ফলে।’

‘কেন, কারো কারো বেলায় কেন?’ কলির বিস্ময় বেড়ে যায়।

বলি, ‘যাদের সুন্দর বাসা আছে সববাইকে নিয়ে, তাদের বেলায় ফলে যায় চিলেদের শাপ।’

স্পষ্টতই শিউরে উঠতে উঠতে কলি বলেছিল, ‘চিলেরা ভালো মানুষ না। আমি কখখনো চিলেদের দিকে তাকাবো না। তুমিও তাকিও না।’

কলির কথা রাখতে পারিনি। আমি অনেকবার চিলের দিকে তাকিয়ে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কলকাতার জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়ার আগে আমি অসংখ্যবার চিলের কান্না শুনেছি।

কলকাতায় অসংখ্য মানুষের ভিড় থেকে কলিকে আবিষ্কার করতে আমার বিশ বছর লেগে গেল। আমার কপালে ভাঁজ পড়লো। আমার চুল একটা-দুটো করে সাদা হতে লাগলো। ঢিপির মতো চোয়াল হলো। চোখের গহবর গভীর হলো। জিভ-তালু শুকিয়ে আসতে লাগলো। গায়ে ঘামের গন্ধ তীব্র হলো।

কলি হাঁটছিল জাদুঘরের পাশ দিয়ে। দেখেই চিনেছিলাম আমি। আমাকে কলির চিনতে পারার কথা নয়। তবু চিনতে পারলো। সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে আপাদমস্তক দেখলো অনেকক্ষণ। স্থির কালো চোখ আমার চোখের ওপর রাখলো অক্লেশে। আমিই নামিয়ে নিলাম চোখ।

কলি একসঙ্গে অনেক কথা শুধোলো আমায়। আমি গুছিয়ে উত্তর দিতে পারছিলাম না সবকিছুর। খানিকক্ষণ আমায় লক্ষ করে কলি বলল, ‘মনটা তোমার মাটিতে নেই, মনে হচ্ছে? কোথায় উড়িয়েছো মন? কত উঁচুতে?’

খানিকক্ষণ আমায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কলি বলল, ‘চলো আমার বাড়ি।’

‘আজই? অন্যদিন না হয় …।’

‘এক্ষুনি।’ কলির চোখের তারা স্থির।

সেদিন কলি সুরঞ্জনবাবুর কাছে আমার কী পরিচয় দিয়েছিল জানি না। সুরঞ্জনবাবু সারাক্ষণ আমার সারাগায়ে দৃষ্টি বুলোচ্ছিলেন থেকে থেকে। সৌজন্য-মাখানো কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে ওঁর চোখ দুটো কিলবিলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আমার মুখের ওপর।

সুমিতার ওপর আমি ঠিক রাগ করিনি কোনোদিন। গার্লস কলেজের বাংলার লেকচারার বলে ওর ব্যস্ততা ছিল আমার চেয়ে অনেক বেশি। পড়ানো, খাতা দেখা ছাড়াও আরো অনেক কাজে নিজেকে পাকে পাকে জড়িয়েছিল সে। মাঝে মাঝে আমাকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করতো। অনেকদিন পরে তোলা শাড়ির পাট ভাঙার মতো।

কলির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দত্তদিঘির ভিজে আকাশটা দেখতে চাই আজকাল মাঝে মাঝে। সেগুলো হঠাৎ হঠাৎ আবিষ্কার করে সুমিতা কেমন গম্ভীর হয়ে যায়।

মেয়েরা সবকিছু আগাম বুঝে ফেলে। ওদের চোখে বুঝি পেরিস্কোপ লাগানো আছে। অলক্ষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওরা সব খেলা দেখে নেয়।

গেল মাসে পরপর তিন রোববার নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েও কলি বলেছিল, ‘তোমায় একদিন ভালো করে খাওয়াবো। মনের মতো করে।’

আমি কলির মনটাকে পড়তে গিয়ে হাহাকার করে উঠেছি। কলি আমার কাঙালপনা টের পেয়েছে নিশ্চয়ই। সে আমায় করুণা করার জন্য এক পায়ে খাড়া।

ছেলেবেলায় দত্তদিঘির পাড়ে পাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেওয়া জীবনটার কথা প্রায়ই তোলে কলি। দুহাতে মুঠো মুঠো করে তুলে আনে সেদিনের দিনগুলোকে। মাঝে মাঝে আকুল গলায় বলে ওঠে, ‘তারপর তুমি কোথায় গেলে সুজিতদা, তুমি কোথায় চলে গেলে?’

কলির বিয়ের সময় আমি ছিলাম না। আজ বুঝতে পারি, কলি সেদিন তার নরম উদ্বেল বুকখানাকে নিয়ে আমার কথাই ভেবেছিল সারাক্ষণ।

মস্নান হেসে বলি, ‘যাবে নাকি একবার? চলো, দুজনে যাই আবার। দত্তদিঘির পাড়ে তোমার শাড়ির চোরকাঁটা বেছে দিই শেষবারের মতো।’

কলির গালে এখনো অনেক রক্ত জমা রয়েছে। বয়েসি মুখটা লজ্জায় গাঢ় হয় তার। মৃদু গলায় বলে, ‘সেই ডুরে শাড়িটা তো বিয়ের পর পরিইনি আর। সেটা ফেলে এসেছি ওখানেই।’

আমি মনে মনে স্বীকার করি। সব শাড়ির পাড়ে চোরকাঁটা লাগে না। লাগলেও তোলা যায় না তো। কলির সেই ডুরে শাড়িখানা আজ কোথায় ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গিয়েছে।

আজ পেটে একটু বেশি মাত্রায় পড়েছে।

সুমিতা আজ তিনদিন গেছে তারাপীঠ বক্রেশ্বর। কলেজের এক্সকারশনে। সেখানে গরম জলের ফোয়ারায় গা পেতে দিয়ে শরীরে উত্তাপ নিচ্ছে হয়তো সে।

যাওয়ার আগেও আমি জানতাম না, সে যাবে। শেষ মুহূর্তে ভ্যানিটি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, ‘একটু বাইরে যাচ্ছি আজ। তারাপীঠ। দিন তিনেক পরে ফিরবো।’

আড়চোখে আমাকে একপলক দেখে নিয়ে বলল, ‘সাবধানে থেকো, বেশি রাত্রির জেগে লিখো না।’

সুমিতা ব্যস্ত ছিল তখন। ঘনঘন ঘড়ি দেখছিল। আমি সুমিতার মুখের দিকে চাইলাম। না, কোনো রাগ, দ্বেষ কিংবা অভিমান কিছুই নেই ওর চোখে।

ওর কপালে অতি সূক্ষ্ম বিন্দু বিন্দু ঘাম ছিল। কানের দুপাশের চুল ফুরফুরিয়ে উড়ছিল। আঁচল খসে পড়ছিল বারবার। আমি চেয়ে দেখলাম, সুমিতার মুখে কোনো গুমোট নেই। স্বাভাবিক মুখ। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যস্ততা। তার সঙ্গে যেন সামান্য উদাসীন অবজ্ঞা মিশেছে। আমার মনে হলো, সুমিতাকে একটু সাহায্য করা প্রয়োজন। বেরোবার সময় ওকে একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে দেওয়া বোধ করি আমার কর্তব্য।

চাকর ডেকে নিজের তত্ত্বাবধানে বাক্স-প্যাঁটরা নিচে নামালাম আমি। ট্যাক্সি ডাকিয়ে তুলে দিলাম ওকে। যাওয়ার মুখে ব্যস্তসমস্ত চোখে আমার দিকে একটিবার চাইলো ও। আমি একচিলতে হাসার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। অল্প ঝাঁকুনি খেয়ে ট্যাক্সিটা এগিয়ে গেল।

বাড়িতে ফিরে এসে লেখার টেবিলটাতে আপ্রাণ খোঁজাখুঁজি করলাম আমার কলম। ঢকঢক করে জল খেলাম, চা বসাতে বললাম  চাকরকে। এই সবকিছু মিলিয়ে আমি যেন অকস্মাৎ কুম্ভক সাধনায় ডুব দিলাম।

সুমিতার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঠিক কী, আজো তা বোঝা গেল না তেমন করে। একসঙ্গে থাকি। খাই-দাই। কাজকর্ম করি। ওর পাওনাগন্ডা ঠিক ঠিক মিটিয়ে চলি সাধ্যমতো। সময় থাকলে সুমিতাও আমার কপালে হাত-টাত রাখে। শরীরের খোঁজখবর নেয়। আমার  জন্য টুকিটাকি দরকারি জিনিস কেনাকাটা করে আনে। খোকার কথা তোলে।

খোকা আমাদের একমাত্র সমন্তান। নরেন্দ্রপুর মিশনে রয়েছে আজ আট বছর। পড়াশোনায় মোটামুটি। সুমিতাকে নিয়ে ক্বচিৎ দেখতে যাই খোকাকে। মায়ের সঙ্গেই ওর যা কিছু কথাবার্তা হয়। ফেরার সময় আমি দু-চারটা মামুলি উপদেশ-টুপদেশ দিয়ে আসি।

সবকিছুই তো চলছে স্বাভাবিক, আমি পাঁচজনের মতোই। গেল পাঁচ বছর সুমিতাকে রাগতে দেখিনি। আমিও রাগিনি। সুমিতার চোখ-মুখ স্বাভাবিকই লাগে। আত্মবিশ্বাসের ভিতের ওপর খানিক ব্যস্ততা আর ঔদাসীন্য মিশে থাকে। অভিমানে ভারি হয়ে আসা মুখ তো মনে পড়ে না সুমিতার। কিংবা ক্রোধে ফেটে পড়া।

তবু সুমিতার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন জমা রয়েছে মনে।

মাঝে মাঝে মনে হয় দুটি কলের পুতুল যেন আমরা। আমাদের রাগ নেই, অভিমান নেই, হাসি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। একটা স্বাভাবিক চলতি সংসারের বুকে দম দেওয়া পুতুলের মতো হেঁটে চলে বেড়ানোর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা নেই। একটা একঘেয়ে বিরক্তিকর স্বাভাবিকতা। একটা নিষ্প্রাণ নিরুত্তাপ শান্ত ভাব। একটা শীতল ঔদাসীন্যের দূরত্ব।

একটু বেশি মাত্রায় চড়িয়েছি কি না জানি না, আজ আমার মনের মধ্যে এসব কূট প্রশ্ন দানা বাঁধছিল অনেকক্ষণ। ছিপি খোলা সোডার বোতলের মতো উপচে পড়ছিল ওগুলো। আমার কি একটা সংসার আছে? আমি কি বিবাহিত? আমার কি খোকন বলে একটি ছেলেও রয়েছে? মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগছিল। এই যে আমার দোতলা বাড়ি, সামনের একচিলতে বাগান, আমার লেখার ঘরে আলমারি টেবিল, লেখার সরঞ্জাম, পানের উপকরণ, অ্যাশট্রে, ক্যালেন্ডার। এই যে আমাদের শোবার ঘর, ডবল খাটের ওপর পুরু গদিতে টানটান পাতা জমকালো চাদর, আলমারি, আলনা, ড্রেসিং টেবিলে প্রসাধন সামগ্রী, জোড়া ফ্রেমে আমাদের ফটো, ফুলদানি, স্টিরিও – এসব, এসব কি আমারই? আমার সংসারই কি এগুলো? আমি কি এই বাড়িরই মানুষ?

কলি আবদার করছিল কিছুদিন আগে, ‘তোমার সংসারটা আমায় দেখাবে না?’

চরম সংকটের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে একটু হাসার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম আমি।

‘আমার সংসার?’ আমি হাসার চেষ্টা করছিলাম।

‘আমার সংসার তো?’ আমি পুনরায় হাসার চেষ্টা করছিলাম।

‘মানে, ওই আমার সংসারটাই তো?’ আমি আবারো হাসার চেষ্টা করেছিলাম।

অবশেষে বলেছিলাম, ‘বেশ তো। নিয়ে যাবো একদিন। সুমিতা খুশি হবে তোমায় দেখে।’

‘এই কথাটুকু বলতে তোমার এত সময় লাগলো’, কলি যেন কিছু আঁচ করল।

কথাটুকুই শুনে তোমরা আঁচ করে ফেলো মুহূর্তে। ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সংসারটাকে তো মুহূর্তে বুঝে ফেলবে। যেন তোমার নিজের হাতে আঁকা ছবি। কিংবা নিজের লেখা কোনো কবিতা। মুহূর্তে বুঝবে, আমাকে কত, কত করুণা করার প্রয়োজন রয়েছে তোমার। বাড়ির সামনে মরা অশ্বত্থের শুকনো ডালগুলোকে দেখে তোমার মনে হতে পারে কত কথা। আমি অবশ্যই তখন তোমায় বোঝাবো, সুমিতা ওটা কেটে ফেলার কথা বলেছে। কিন্তু ওটা কাটতে গেলে বুকজুড়ে তীব্র ব্যথা চাগিয়ে ওঠে আমার। সুমিতাকে বোঝাতে চেষ্টা করি। নতুন ডালপালা গজালে চিকন পাতায় ভরে যাবে সারাগাছ, নরম কচি পাতায় পাতায় শিহরণ জাগাবে হাওয়া। পছন্দ হয়ে গেলে রাতের বেলায় শঙ্খচিলের আস্তানাও হতে পারবে ওটা।

সুমিতা ব্যস্ততার মাঝেও অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে আমাকে। রাজ্যের বিস্ময় যেন জমে ওঠে তার দুচোখে। আমায় দেখতে দেখতে সে হয়তো কত কিছু ভাবে তখন।

ভাবতে ভাবতে, আমি লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে মাথাটা নামিয়ে দিই মাটির দিকে।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, আমার সংসারটা কিছুতেই দেখাবো না কলিকে। কিছুতেই না।

সুরঞ্জনবাবু কয়েকদিন ধরেই কেমন উসখুস করছিলেন। একদিন ফাঁক পেয়ে শুধোলেন, ‘চিলের কান্না নিয়ে আপনার নিজস্ব তত্ত্বটা কী?’

আমি বুঝতে পারি, কলিই তাকে বলেছে কোনো সময়।

মৃদু হেসে বলি, ‘আমার কোনো তত্ত্ব নেই। ছেলেবেলায় মন বড় বেয়াড়া রকমের ভাবালু হয়। সেই সময়েই কখনো কলিকে হয়তোবা বলেছিলাম কিছু। ওই বয়সে যা হয় আর কী।’

সুরঞ্জনবাবুর চোখদুটো স্থির হয়ে এঁটে বসেছিল আমার মুখের ওপর। ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘কিন্তু আপনার কথাটা এখনো ভোলেনি কলি। সে এখনো চিলের দিকে তাকায় না।’

আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। উদ্ভ্রামেত্মর মতো দৃষ্টি নিয়ে কলিকে চারপাশে খুঁজলাম। সুরঞ্জনবাবুর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে অনেকগুলো নীরব মুহূর্ত কেটে গেল আমার।

বুক চেপে ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি আর কোনো দিনও হাজির হবো না কলির সামনে।’

দুচোখে গভীর কৃতজ্ঞতা ফুটিয়ে সুরঞ্জনবাবু বললেন, ‘প্লিজ।’

ওর কাগজের মতো সাদা মুখে রক্তের ছোঁয়া লাগলো আবার।

খানিক আগে কলির থেকে অন্তত পাঁচশো মাইল দূরে বসে আমি একামেত্ম কথা কইছিলাম সুরঞ্জনবাবুর সঙ্গে।

ওকে প্রাণপণে বোঝাতে চাইছিলাম আমি। বলেছিলাম, ‘এখন, ওইদিনের শেষবেলায় আমি মনেপ্রাণে চাই, কলি সুখী হোক। বিশ্বেস করুন সুরঞ্জনবাবু, কলির কোনো ক্ষতি হয় – এ আমি ভাবতেও পারি না।’

‘হয়তো তাই।’ সুরঞ্জনবাবু বহুদূর থেকে উত্তর দিলেন, ‘হয়তো তাই। তবু কলি আজো উড়ন্ত চিল দেখতে ভয় পায়।’

শিউলি গাছের থেকে চোখ তুলে নিয়ে আমি চিলেদের দেখি পলকহীন চোখে। ছেলেবেলার বাচালতার মাশুল গুনতে গুনতে ভাবছি, কলির আকাশ দেখা বন্ধ করেছি আমি। কলি বোধ করি এখন বিশ্বাস করে, দুনিয়ার সব মানুষের অর্ধেকটা মাটিতে থাকে, অর্ধেকটা চিল হয়ে আকাশে উড়ে যায়। সুদূর আকাশের বুকে গা ভাসিয়ে তারা হাজার হাজার চোখ দিয়ে মাটির ঘর-সংসারগুলোকে দেখে। চেরা চেরা করুণ গলায় ওরা কাঁদতে থাকে অবিরাম। তীক্ষন দুটি চোখের মণি দিয়ে তারা চুষে চুষে খেতে থাকে মাটির বুকের নরম নরম সুখ। সূর্যের কাছাকাছি থেকে ওদের পিপাসা কিছুতেই মেটে না। কিছুতেই তারা ক্ষমা করে না মাটিকে।

গতকাল কলির একখানা চিঠি পেয়েছি। টলমলে মুক্তোর মতো চিঠি লিখেছে আমার কৈশোরের কলি। লিখেছে, ‘তুমি যে শহর ছেড়ে এভাবে চলে যাবে তা আমায় জানাতে পারতে। কেন চলে গেলে, সে তুমিই জানো। তবে চোখের আড়াল হলেই হারালাম, এমন কথা ভাবার বয়স পেরিয়ে এসেছি অনেকদিন। তুমিই কেবল ছেলেমানুষের মতো পালিয়ে গেলে। যেমনটি গিয়েছিলে আমার বিয়ের আগে আগে।

… তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার ঘর ভাঙার ক্ষমতা আকাশের চিলেদের নেই। সে-ভয় আমি করিনে।

… দত্তদিঘির পাড়ের থেকে আজ এত বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে তুলেছি যে-ঘর, তুমি বারবার পালিয়ে গিয়েও আমার সে-ঘর ভাঙতে পারবে না …।’

আরো অনেক কথা লিখেছে কলি। আমার মধ্যে, কেবল চরকার মতো ভোঁ-ভোঁ আওয়াজ তুলেছে একটা কথা। কলির ঘর ভাঙে না।

ভাবছিলাম আকাশের চিলেদের কথা।

কলির খবর ওরা বোধকরি রাখে না। কেবল কলির চিঠিখানা পেলেই চিলেদের পক্ষে দুনিয়ার সববাইকে ক্ষমা করে দেওয়া সম্ভব।

ভাবতে ভাবতে শিহরিত হচ্ছিলাম আমি। আবেগে উথলে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম, … এতো উঁচুতে, সেই আকাশের নীল চাঁদোয়ার পাশাপাশি কী দিয়ে পাঠাই কলির চিঠিখানা। হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে, ইথারে ছড়িয়ে দিয়ে, কিংবা আরো কোনো অলৌকিক উপায়ে, … কী করে কলির কথাগুলো পৌঁছে দিই আমি ওদের কাছে?

কী করে একখানা চিঠির বিনিময়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসি দুনিয়ার সববাইয়ের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ষমা!