চিহ্নহীন

মণিকা চক্রবর্তী

সূর্যটা তখন সমস্ত আকাশ পারাপার করে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। কোথা থেকে একটা প্রবল বাতাস এসে দুলিয়ে দিলো তার ঘাড়ের কাছে ঘামে লেপ্টে থাকা উদ্দাম চুলগুলোকে। চল্লিশ ফুট উঁচু বাঁশের ঝোলার ওপর দাঁড়িয়ে ঝুলতে ঝুলতে শাজাহান ভাবে, আইজকার লাইগ্যা কাম শেষ হইল। ঝুলতে ঝুলতেই সে তার শার্টের পকেটে রাখা বিড়িটি ঠোঁটে চেপে রেখে অতি সাবধানে ধরায়। যে-কোনো মুহূর্তে পিছলে যেতে পারে হাত বা পা। সারাদিনের কাজের পর তখন অবশ হয়ে আসে বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পা দুটো। প্রতিদিন সকাল ৯টায় সে নিয়ম করে আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দেয়ালে রং লাগাতে ওঠে। বিশাল উঁচু ঝোলায় উঠতে উঠতে তার বুকের ভেতর মোচড় দিতে থাকে ভয়ে। সে ক্রমাগত আল্লাহর নাম জপতে জপতে আল্লাহকে ডাকে আর বলে, আল্লাহ ঘরের দুইডা এতিম মানুষ পালনের ক্ষেমতা দে। তার সঙ্গে থাকা
অনেক শ্রমিকই এই কাজ করতে গিয়ে ওপর থেকে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে, কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে সারা জীবনের জন্য। এখানে সে দিনে পাঁচশো টাকা মজুরি পায়। টাকার পরিমাণটা তার কাছে ভালোই মনে হয়। পঞ্চাশ টাকায় দুপুরের খাবারের পর তার হাতে আরো সাড়ে চারশো টাকা থাকে। বস্তির এক রুমের ঘরটার ভাড়া দিতে হয়। দুবছরের একটি মেয়েশিশু আর বৃদ্ধ নানি ছাড়া ওর কেউ নেই। প্রায়ই সে ভাবে, এ-কাজটি সে ছেড়ে দেবে; কিন্তু এক দুঃসময়ে এ-কাজটিতে জড়িয়ে পড়ার পর সে আর কাজটি ছাড়তে পারে না। তাছাড়া এতদিনে সে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই কাজে। বিল্ডিংয়ের গায়ে নানা রঙের রং লাগাতে তার ভালোই লাগে; কেমন জানি নেশা নেশা লাগে রঙের গন্ধে। মাথার কত ওপরে আকাশ আর কত নিচে মানুষ! মাঝখানে সে ঝোলার মধ্যে ভাসে। যত উঁচুতেই ওঠে, আসমান আরো উঁচু হয়ে দূরে সরে যায় তার কাছ থেকে। উঁচু ঝোলার ওপর দাঁড়িয়ে বুকের ভিতর ভয়ংকর মোচড় খেতে খেতে সে নিচের দিকে তাকায়। তবু নির্বিকারভাবে বিল্ডিংয়ের গায়ে রং লাগাতে থাকে। প্রথম প্রথম তার খুব ভয় লাগত। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। চল্লিশ ফুট উঁচুতে উঠে আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখির দিকে তাকিয়ে থাকত সে। ছোট্ট দুইটা ডানা নিয়ে আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো পাখি। অভ্যস্ত হতে হতে একসময় সে বুঝে নেয়, পুরোটাই একটা রহস্যময় ব্যালেন্সের ব্যাপার। এসব কাজ করতে করতে সে মাঝে মাঝে তার ছোটবেলায় দেখা সার্কাসে দড়ির ওপর ঝোলার দৃশ্যটি নিজের মধ্যে দেখতে পায়, আর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে জয়ী ভাবার এক অপার আনন্দ নিজের মধ্যেই উপভোগ করে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কার পর সে বিস্মিতভাবে নিজের বেঁচে থাকাকে উপলব্ধি করতে করতে সন্ধ্যার পর কারওয়ানবাজারে ছোট বস্তির ঘরে এক অপার আনন্দ নিয়ে ঢোকে। এ-আনন্দে সে নিজেও বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করে, এত সুখ সুখ ভাব লাগে ক্যা? দুবছরের বাচ্চাটি এখন স্পষ্টই তাকে আব্বু বলে ডাকে। ঘরে ফিরে সে শিশুটিকে পাশে নিয়ে কিছুটা সময় শুয়ে থাকে।

দুই
চোখ দুটি বন্ধ করে শাজাহান চৌকির ওপর শুয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করে সে কত কিছু যে দেখে! দৃশ্যের পর দৃশ্যের ঢল নামে। মেয়েটা আব্বু আব্বু বলে নিজের খেয়ালে খেলতে থাকে তার বুকের ওপর। এ সময় শুরু হয় তার নানির অনর্গল কথা বলা : ও শাজাহান, এহানে তুই এলকা এলকা কী করবি? ল, আমরা দেশে যাইগা। তুই কামে গেলেগা আমার ডর করে। খালি মনে হয়, এহনি খারাপ খবরটা আইল বইলা।
শাজাহান চুপ করে পড়ে থাকে।
নানি আবার বলে, ‘এহানে তোর মাইয়া পালব কেডা? আমি শরীলে জুত পাই না। তোর মাইয়ার লগে হারাডা দিন দৌড়ান লাগে। ক্যান যে আমি ঢাকায় আইসা তোর এইহানে উঠলাম! এহন আমার হইছে যত জ্বালা। এই পুতলাডারে ফালাইয়াও যাইতাম ফারি না।’
‘দেশে আমার কী আছে নানি। তোমার ছাওয়াল-পাওয়াল আছে, তুমি যাও। আমার মাইয়া এলকাই বড় হইব।’
‘তোর খালি বড় বড় কতা! তোর বউ এই ল্যাদা বাইচ্চা ফালাইয়া যহন গেলগা, তহন তোর কী অবস্থা ছিল হে কথা বস্তির মাইনসে হক্কলেই জানে।’
‘আমারে তো হক্কলেই ফালাইয়া গ্যাছে। আমার কইলজাডা তো হক্কলের আগে কামড়াইয়া খাইছে আমার মায়। হে কিছ্চা তো তুমি হকলই জানো। তয় পুরান প্যাচাল আনো কে?’
‘রাগ করিস না বাপ! তোর ভালার লাইগ্যাই কই। এ-কামে ছাড়ান দিয়া ল দেশে যাইগা। জমি কিনমু, ঘর বানাইয়া দিমু তোরে। তোর মাইয়ারে পাইল্যা দিমুনি সুন্দর কইরা। তোর মায়ে যা করতে পারে নাই, আমি তা কইরা দিমুনি।’
‘দেশে আমি যামু না নানি, দেশ-গেরাম আমি বহুত আগেই ছাড়ছি। আমি হইলাম গিয়া বিরান মাঠের এলকা গাছ। আমারে ছায়া দিব কে?’
প্রতিদিনই এরকম বাগ্যুদ্ধের পর শাজাহান অসাড় হয়ে চুপ করে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে। নানির সঙ্গে কথা কইলেও শাস্তি, না কইলেও শাস্তি। কোনো রেহাই নেই। আরো কিছু কথা অনর্গল বলার পর নানি বাটিতে করে কিছু মুড়ি আনে। শাজাহান তখনো চোখ বন্ধ করে থাকে আর দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখতে থাকে। সেসব দৃশ্যের ভিতর সে নিজেকে কেবলই তাড়া খাওয়া কুকুরের ভয়ে দৌড়াতে দেখে। সে নিজেও জানে না, সে কিসের জন্য দৌড়ায়। আর দৌড়াতে দৌড়াতে তার হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকে, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তারপর সে ভয়ংকরভাবে ভীত হতে হতে অতিকষ্টে নরম পা দুটি নিয়ে বাঁশের ঝোলার ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। আর তখনি তার নিজ¯ অস্তিত্বটাকে সে ভুলে যেতে থাকে। ওপরে বিশাল আকাশ, নিচে মাটি, আর সে পড়ে যাওয়া আর না-পড়ে যাওয়ার মাঝখানে।

তিন
জন্মের পর থেকেই সে মায়ের চোখের জল দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। মা কেবলি বলত, ‘বাবা তুই রোজগার না করলে আমাগোরে খাওন দিব কেডা? তোর বাপে অন্য একজনরে লইয়া ঘর করে। হে বাইতে আমাগো জায়গা হইবো না। তুই রোজগার কর। আমি তোর নানুর ধারে জমি কিনুম।’ আর সেই ছোটবেলা থেকেই মায়ের আশা পূরণের জন্য সে শুধু দমছুটভাবে নিজেকে নিয়ে ছুটেছে অনবরত। সাত বছর বয়সে সে কাজ নিয়েছিল এক হিন্দুবাড়িতে। বেতন দেওয়া হতো বছর শেষে তার মায়ের হাতে। সেখানে সে অনেকগুলো গরুর দেখাশোনা করত। এত ছোট আর শক্তিহীন ছিল সে যে, ঠিকভাবে গরুগুলোর লাগাম ধরতে পারত না। খুব ভয়ে ভয়ে সে থাকত সারাদিন। গরুগুলো অন্যের ক্ষেতে চলে যেত প্রায়ই। আর তার সামর্থ্য ছিল না বলে প্রায়ই এদের খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিত জমির মালিক। সারাদিন ঘাস কাটা, গরুঘর পরিষ্কার করা আর গরুর গোসল এসব শেষ করে সন্ধ্যাবেলায় তার চোখে প্রবল ঘুম নেমে আসত। তবু সন্ধ্যায় রেহাই ছিল না। তখন শুরু হতো ঘরের কাজ। সারা দিনরাতের এত খাটুনির পর তারা তাকে একটা থালায় ঘরের বাইরে খাবার দিত। খাবারটা এমনভাবে দিত যেন ওর ছোঁয়া না লাগে। একবারের বেশি ভাত সে নিতে পারত না। পেটে ক্ষিধে থাকলেও সে না খেয়েই উঠত। আবার চাইলে হয়তো ওরা ভাত দিত কিন্তু রান্নাঘরের এত কায়দাকানুন ছিল যে, এসব পার করে তার ভাত চাইবার ইচ্ছেই হতো না। বছর শেষে তার মা এসে টাকাগুলো নিয়ে যেত আর বলত, ‘আর একটু কষ্ট করে থাক বাবা।’ দিনের পর দিন এভাবে খেটে তিন বছর পূর্ণ হওয়ার পর তার মা বলল, ‘এবার তুই একটু বড় হইছস। এহন তোরে তোর জামাল মামার লগে রাজশাহী পাঠামু। ওইখানে এক চা দোকানে তোর কাম ঠিক হইছে।’
‘এত দূরে যামু কেন? আমাগো নেত্রকোনায় কি চায়ের দোকান নাই?’
‘হ আছে। তয় দূরে গেলে তাড়াতাড়ি সেয়ানা হবি। জমি কিনার লাইগা আরো বিশ হাজার ট্যাকা লাগব। দিব ক্যাডায়? তোর বাপ আছে?’
ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েও সে মায়ের আফসোসের কাছে হার মানে। খুব তাড়াড়াড়িই চলে যায় নতুন ঠিকানায়। রাজশাহী শহরের এক কোণে এক বড় চা-দোকানে তার রাত-দিন কাটে। মালিক তাকে ভালোবাসে খুব। প্রতিদিন সে ষাট টাকা করে পায় আর খাবার খায় মালিকের বাসায়। কাজটি তার খুব ভালো লাগে। এখানে খাবারের কোনো অভাব নেই। সকালে পরোটা ভাজার পর কয়েকটা সে এমনিই খেতে পারে। অন্য কর্মচারীরাও তাকে ভালোবাসে। অনেক সময় কাস্টমাররা খুশি হয়ে তাকে বখশিশ দেয়। এভাবে সে বেতন ছাড়াও অনেক বেশি টাকা আয় করে।
দীর্ঘ তিন বছর সে বাড়ি যায়নি। এমনকি ঈদের দিন যখন সব বাসায় চলছে আনন্দ আয়োজন, সে নিজের জন্য একটি নতুন জামাও কেনেনি। সব টাকা কৃপণের মতো মায়ের জন্য জমা করেছে তিলে তিলে। মালিককে বলেছে, তিন বছর পর বাড়ি যাবে কাজ ছেড়ে দিয়ে।
তিন বছর পর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেই ঈদের দিনটি সত্যিই এলো। কতদিন সে মায়ের মুখ দেখেনি। তখন আজকের মতো মোবাইল ফোনও নেই যে খবরাখবর জানা যাবে। অসম্ভব ভিড়ের মধ্যে সে বাসে সিটও পেল না। অথচ তার মনে হলো, প্রজাপতির মতোই যেন বাতাসের ওপর ভর করে বাড়ি পৌঁছেছিল সেদিন। সঙ্গে মায়ের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি টাকা। পথে যেতে যেতে তার মনেই হচ্ছিল না, গত কয়েকটি বছরে সে কী পরিমাণ কষ্ট করেছে ভিক্ষুকের মতো। মানুষের বাড়ির উচ্ছিষ্ট খেয়ে খেয়ে যে-জীবন, দিন-রাত কঠোর পরিশ্রমের যে-পীড়ন সব সে সহ্য করেছে এমন একটি দিনের জন্য। যে প্রিয় শৈশবটা সে পায়নি, আজ যেন বাড়ি যেতে যেতে সে তাকেও দেখতে পেল। সে নিজেকে দেখতে পেল, গুলতি হাতে পাখির পেছনে দৌড়াচ্ছে মনের আনন্দে। মনে পড়ল সে-নদীর কথা যে-নদীর পাড় থেকে সে শামুক কুড়াতে যাচ্ছে হাঁসের ছানার জন্য। ঘুড়িটাকেও সে দেখতে পেল, যা সে কোনোদিন ওড়াবার অবকাশ পায়নি, আজ তা হাসতে হাসতে সাত আসমানের কাছে পৌঁছাচ্ছে নির্বিঘেœ।
ঈদের আগের দিন বাড়িতে পৌঁছে সে সবাইকে দেখতে পেল। মামা-মামি, নানা-নানি, বাড়ির আশপাশের প্রতিবেশীদের। কিন্তু মা কই? অনেক মানুষের অনেক কথার ভিড়ে সে স্পষ্ট করে একটা রহস্যময় চাপা ফিসফাস টের পেল। পরে সঠিকভাবে জানতে পারল, তার মা আবার বিয়ে করেছে এক বছর আগে এই গ্রামেই। কাল ঈদের দিন সে নতুন স্বামীকে নিয়ে আসবে। একটা বাজপড়া তালগাছের মতো সে তাৎক্ষণিকভাবে পুড়ে গিয়েছিল। আর কী হয়েছিল সে-সময় তার মনে নেই। কখন ঘাড় কুঁজো করে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে লরঝরে পায়ে একটা বাসে চড়ে ঢাকার কোনো একটি পার্কে বসে ঈদের দিনটি কাটিয়েছিল, তার মনে নেই। তার মনে আছে, পার্কের বেঞ্চিতে বসে সে এত জোরে জোরে কেঁদেছিল আর একসময় সে তন্দ্রার ঘোরে টের পেয়েছিল, মাছি এসে ভনভন করেছিল তার কানে। মশারা শুঁড় ফুটিয়েছিল তার নাকে। সে জীবিত না মৃত তা বুঝে উঠতে উঠতে নিজেকে ঠিকমতো চিনতে পারছিল না। তারপর নিজের ওপর আর পৃথিবীর কারো ওপর ভরসা না করেও সে দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছিল কয়েকটি দিন পার্কে বসেই।

চার
কতবার যে এই জীবনে প্রচণ্ড দুঃখে থেমে গেছে সময়! আবার নতুন করে চলা শুরু করেছে সে সেই থেমে পড়া বিন্দু থেকে। ঢাকায় আসার পর দুই-তিন বছর ঘুরেফিরে খেয়েদেয়ে আর ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে জমানো টাকাগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার পর কিছুদিন সে ঢাকার ফুটপাতে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বেচতে শুরু করল। তখন সে কারওয়ানবাজারে থাকে। সেখানেই একদিন আচমকা পরিচয় হলো মিলি নামের একটি মেয়ের সঙ্গে। কারওয়ানবাজার রেললাইনের পাশের বস্তিতে ওদের ঘর। সে সুযোগ পেলেই ভ্রু বাঁকা করে শাজাহানের সঙ্গে মশকরা করে। তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কোনো এক অজানা আকাক্সক্ষায় কেঁপে ওঠে শাজাহানের ঠোঁট। মিলি আকস্মিকভাবে, হঠাৎ তীব্রভাবে ওর সামনে এসে পড়ে আর তার হাসির আওয়াজে তার সময়গুলো আকাশে উড়ে-চলা পাখিদের মতো দ্রুত মিলিয়ে যায়। সে কাজে পিছিয়ে পড়ে। একদিন শুক্রবারে মিলির জোরাজুরিতেই আচানক ওদের বিয়ে হয়ে যায়। মিলির একমাত্র বড়ভাই বিয়েতে উপস্থিত থাকে। শাজাহানের পক্ষে কেউ থাকে না। সে-সময়টা শাজাহানের বলতে গেলে ভালোই কেটেছিল। মিলির শরীরের একটা তীব্র আকর্ষণ আর ওর আশ্রয়ে শাজাহান আশ্বস্ত ছিল। জীবনের একটা দিশা পেয়েছিল সে-সময়। তবু বাদ সাধল ওর রোজগার। শাজাহানের অল্প আয়ের সঙ্গে মিলি মানিয়ে নিতে পারে না। এক বছরের মধ্যেই গর্ভে সন্তান আসার কারণে সে বাসাবাড়ির ছুটা কাজগুলো ঠিকভাবে করতে পারে না। বাচ্চাটা হওয়ার তিন মাস পরই কাউকে কিছু না বলে তার নবজাত শিশুটির সামনে একটি অস্থির ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ফেলে রেখে সে অন্য এক লোকের সঙ্গে পালিয়ে যায়।

পাঁচ
শাজাহানের পৃথিবীটা খুব নরম ছিল না কখনোই। তবু মিলিকে ঘিরে তার একটি স্থান তৈরি হয়েছিল। তার টানে সে নিজের ভিতর তৈরি করেছিল জীবনে টিকে থাকার এক নতুন অভ্যাস। তাতে আকাক্সক্ষা ছিল, স্বপ্ন ছিল, প্রত্যাশা ছিল আর ছিল এ-জায়গাটি হারিয়ে ফেলার এক গভীর আতঙ্ক। বারবার ভাগ্য তাকে বঞ্চনা করেছে, তাই কোথাও একটা আতঙ্ক গভীর বেদনার মতো তার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে ছিল। তার নিভৃত আতঙ্কটি যখন সত্যে পরিণত হলো, সে পরিত্যক্ত শিশুটির দিকে তাকিয়ে কঠিন আর মৃতের মতো পড়ে থাকল কয়েকটা দিন। নিজের ভেতরে উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি সে পেল না। বাচ্চাটা যখন দুধের জন্য তীব্র স্বরে চিৎকার করতে করতে তার শ্রবণের সহ্য শক্তিকে অতিক্রম করে যেত, সে তখন উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হতো। তারপর জীবনের প্রবল প্রত্যাখ্যান, প্রবল বিচ্ছিন্নতা, প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে এক গভীর মমতায় ওর মুখে দুধের ফিডার ভরে দিত। শিশুটিকে শান্ত করার জন্য তার পাশেই শুয়ে থাকত। এরপর এটি তার অভ্যাসে পরিণত হলো। রাত-দিন শুয়ে থেকে শিশুটিকে আশ্বস্ত করত যে, তার মা তার পাশেই আছে। বাচ্চাটার পাশে শুয়ে থাকতে থাকতে সে একটা দারুণ ব্যাপার রপ্ত করল। সে চোখ বন্ধ করে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া আগের দৃশ্যগুলোতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বারবার হারিয়ে যেতে থাকত। কী যেন পেত সে? নিজেকে এই অন্যরকম ঘূর্ণিতে ফেলে দিয়ে নিজেকেই নতুন করে আবিষ্কারের এক নেশা তাকে পেয়ে বসল। সময়ের ভারে বিক্ষত এই মানুষটির আবেগ একদিন স্তিমিত হয়ে এলে সে আবিষ্কার করে, ঘরভাড়া দেওয়ার কোনো টাকা নেই। শিশুটির দুধ কেনার টাকাও শেষ। তখনই হাতের কাছে বস্তি ভেঙে অ্যাপার্টমেন্ট উঠছে। অনেক শ্রমিক দরকার। সে আর দেরি করে না। প্রতিদিন পাঁচশো টাকা। তার জন্য অনেক ভালো; কিন্তু সেখানে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আতঙ্ক। তার ক্ষীণ শরীরের তরুণ শিরার রক্ত তাকে সতর্ক করে। তবু সে থামে না। তার অদ্ভুত তেতো জীবন বহু আগেই মৃত্যুকে তার বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখেছে পরম মমতায়। মৃত্যুকে সে আর ভয় পায়নি। নিজেকে ঠেলে দিয়েছিল বাতাসের দিকে নিঃসঙ্গ পতাকার মতো।
নানা অসুখে-বিসুখে আক্রান্ত হওয়ার পর নানি আর তাকে ছেড়ে যায়নি। যদিও সারাক্ষণ একটি ক্ষীণ আশা তার রয়েছে, যে-কোনো সময় শাজাহান হয়তো বাড়ি যেতে রাজি হবে। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই বৃদ্ধ বয়সে সে ছেলে আর ছেলেবউ দ্বারা প্রচণ্ড উপেক্ষিত ছিল। তাই সেবার বিনা খরচে চোখের ছানি অপারেশনের সুযোগ পেয়ে পাশের বাড়ির কালুর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকায় আসে। কালু নাকি কারওয়ানবাজারে শাজাহানকে বেশ কদিন দেখেছে। এ-খবর বাড়িতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই বুড়ির মনে হলো, শেষ বয়সে পোলাটারে যদি একটু কাছে পাইতাম! সেই যে খুঁজে পেতে শাজাহানের বাড়িতে আসা, তারপর থেকে বুকে হেঁটে, হামা দিয়ে সে-ই আগলে রাখছে সংসারটাকে। মাঝে মাঝে শাজাহানের মনে হয়, নানি না থাকলে সে কেমনে পালত বাচ্চাটাকে? দুমাসেই তো তার খবর হয়ে গেছিল! আইজ পেট খারাপ, কাইল জ্বর। রাইতভর ঘুম নাই। তবু তো নানি দিশাহীনের মতো অবস্থায় তাকে নিশ্চিন্তি দিয়েছিল। নানির কথা মনে করে কৃতজ্ঞতায় তার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।

ছয়
এলোমেলোভাবে চলে যাওয়া জীবন কঠিন বিপদগুলো পাড়ি দিতে দিতে একসময় স্থিত হতে চায়। শাজাহান প্রায়ই একা বসে বসে আবিষ্কার করে, এমন কী রহস্য ছিল মিলির মধ্যে যে, তাকে কিছুতেই ভোলা যায় না? এরকম বিশ্বাসঘাতকতার পরও! নিজের দিকে তাকিয়ে তার করুণা হয়। সে নিজের মনেই নিজেকে ধিক্কার দিতে চায়। মনডা এত পাগল পাগল করে ক্যা। হেই ছেনাল মাগি পলাইছে অন্য মাইনষের লেঙ্গুর ধইরা! তয় আমি কেন বুকের আন্ধারে ওরে তন্ন তন্ন কইরা খুঁজি! আর খুঁজবাম না আমি। ওরে ধাক্কাইয়া বাইর কইরা দিমু ভিতর থেইকা। ঘরের ঘুপচিগুলোতে সে সেই একান্তে কাটানো পুরনো গন্ধগুলো খুঁজতে থাকে নীরবে। মাঝে মাঝে শরীরী আকাক্সক্ষাগুলো সেসব পুরনো গন্ধের ভিতর থেকে হঠাৎ ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়। একদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে দুজন শ্রমিককে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শোনে।
‘আইজ যাইবেন নিহি?’
‘কই?’
‘কে? ভুইল্যা গেলেন? এত তাড়াতাড়ি?’
‘না ভুলি নাই। তয় খরছা তো ম্যালা। মাল খসানোর লাইগ্যা এত খরচা পোষায় না?’
‘কী কন মিঞা? এত সুন্দর হোটেল। আপনে যেমুন চান হেমুন পাইতাচেন? যদি শাহা পরা, সিন্দুর পরা হিন্দু মাইয়া চান তাও পাইবেন। যদি চান এসকাট বেলাউজ পরা ছুড়ি, হেও পাইবেন। চলেন আইজ যাই। এলকা যাইতে ভালো লাগে না।’
‘আপনে এলকাই যান।’
‘মাত্র আড়াইশো ট্যাকা লাগে। আমি ধার দিমুনি। চলেন যাই।’
শাজাহান দুপুরে কাজের জায়গায় বসে ভাত চিবুতে চিবুতে শ্রমিক দুটোর কথা শুনছিল। রাত নয়টার দিকে সে বাচ্চার জন্য দুধ কিনতে যেয়ে শ্রমিক দুটোকে দেখতে পায় কারওয়ানবাজারে একটি আবাসিক হোটেলের সামনে। সে কিছুক্ষণ ওদের দূর থেকে দেখে। পরে সামনে এসে নিশ্চিত হয়, ওরাই। সে একটি বিড়ি ধরিয়ে বিড়িটা ফুঁকতে ফুঁকতে তার ঘরের দিকে এগোতে থাকে। তখন রাস্তাগুলো আস্তে আস্তে খালি হচ্ছে। বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার ওপর আলোটা বড় মৃদু। ঘরে ফিরে তার ঘুমোতে ভালো লাগল না। শুয়ে পড়েছিল, পরে আবার উঠে পড়ল। সে আবার ওই হোটেলটার কাছে এসে চারদিকে একটু ঘুরে বেড়াল। রাস্তা এখন একেবারেই ফাঁকা। জায়গায় জায়গায় অন্ধকার। কয়েকটা রাস্তার কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। সে হোটেলটার কাছ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে ভেতরের দৃশ্যগুলোকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছুই দেখতে পেল না। ভারি পর্দা, মৃদু আলো, লোকজনের ছায়ার নৃত্য সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নাটকীয়তা তাকে ভয়ংকরভাবে এক অসহ্য হাতছানি দিতে থাকল। সে হাত দিয়ে তার মানিব্যাগ হাতড়ে দেখল, তাতে প্রায় সাড়ে তিনশো টাকার মতো আছে। রাস্তায় একা একা দাঁড়িয়ে তার বুকটা ধুকপুক করতে থাকে। একটু দূরে দু-তিনটি টহলদার পুলিশকে দেখে সে আর বিন্দুমাত্র রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার সাহস করে না। অতি দ্রুত হোটেলে ঢুকে পড়ে।
সে অতি দ্রুত হোটেলের দোতলায় চলে যায়। আর সিঁড়ির মুখে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে একটি মেয়েকে সে হোটেলের অল্প আলোতে এক রুম থেকে অন্য রুমে যেতে দেখে। মেয়েটি মধ্যবয়সী, সালোয়ার-কামিজ পরা। চুল আঁচড়েছে সুন্দর করে। অল্প আলোতেও মেয়েটির পরিপাটি ভাবটি বোঝা যাচ্ছে। ওরকম বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে দেখে মেয়েটি রুম থেকে বের হয়ে আসে আর তাকে জিজ্ঞেস করে আসার কারণ। শাজাহান লজ্জায় মুখ নিচু করে থাকে। মেয়েটির গায়ের সেন্টের গন্ধ তার স্নায়ুর ওপর একটা মদিরতা তৈরি করে। মেয়েটি তখন আর কোনো কথা না বলে শাজাহানকে ভিতরে নিয়ে যায়। ভিতরে একটি রুমের স্বচ্ছ কাচের দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি শাজাহানকে কাচের ভেতর দিয়ে দেখে যে-কোনো একটি মেয়েকে পছন্দ করতে বলে। শাজাহান খুব অবাক হয়ে দেখে আর শ্রমিক দুটির কথার সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। সত্যিই এখানে অনেক রকম পোশাক পরা মেয়েরা রয়েছে। একটি মেয়ে শুধু ব্রা আর পেন্টি পরে আছে। কেউ আবার বেনারসি শাড়ি পরে নতুন বউয়ের ভাব ধরেছে। ভিতরে হালকা সাউন্ডে গান হচ্ছে। ডিসকো দেওয়ানে হা হা। মেয়েটি শাজাহানকে তাড়া দিতে থাকে। তার হাতে বেশি সময় নেই। সে নিশ্চিত হতে চায় শাজাহানের কাছে টাকা আছে কি-না।
শেষ পর্যন্ত শাজাহান এলোচুলের একটি মেয়েকে পছন্দ করে। মেয়েটির পিছনের দিকে ছড়ানো খোলা চুল শাজাহানের মনের ভিতরে পড়ে থাকা কোনো এক দুঃখবোধের সঙ্গে মিলে যায়। মেয়েটির চেহারাও সে ভালো করে দেখে না। আর সেই মেয়েটিকে নিয়েই সে একটি চিলতে কামরায় ঢুকে পড়ে। রুমটিতে চৌকি থাকে, মাথার ওপরে ইলেকট্রিক ফ্যানের ভনভন আওয়াজ, অল্প আলো, সস্তা পাউডারের গন্ধ। শাজাহান তীব্রভাবে সম্মোহিত হয়ে থাকে। বোঝা না বোঝার বাইরে সে বোকার মতো মেয়েটির মুখের দিকে তাকায়। তার শ্যামলা মুখের উদাস চাউনিতে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার কষ্ট অন্ধকার ছায়ার মতো লেগে থাকে। কোনো প্রশ্ন নেই। মেয়েটি তার কাপড়-চোপড় খুলে চৌকির ওপর শুয়ে পড়ে। শাজাহানের উত্তেজনা এখন ভয়ে রূপ নিয়েছে। সে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে চুপচাপ অন্ধকারে নিঃঝুম পড়ে থাকে। একটু আগের শরীরী ব্যাপারগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে যেতে থাকে। মেয়েটি এবার উঠে বসে। চিন্তিত মুখে বলে, ‘আমারে কি আফনের পচন্দ হয় নাই?’ শাজাহান বলে, ‘আপনে মাইন্ড কইরেন না। এই নেন আড়াইশো ট্যাহা। আমার ক্যান জানি ঘুম ধরতাছে। আপনে আমার সাথে শুইয়া থাহেন, আমার শইলডা ভালা ঠেকতাছে না।’ মেয়েটি তৎক্ষণাৎ ছেড়ে রাখা কাপড়গুলো আবার তড়িঘড়ি করে পরে শুয়ে পড়ে। তার চোখে দুই-এক মিনিটের মধ্যেই গভীর ঘুম নেমে আসে। শাজাহান মেয়েটির সঙ্গে ঘুম আসার কথা বললেও তার মোটেই ঘুম আসে না। তার শরীর আগুনের মতো পোড়ে। তার গলার কাছে একটা অব্যক্ত হাহাকার কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। তার মনে হতে থাকে, আন্ধার রাইত যেন হুইয়া আছিল তামাম দুইন্যায়, আর এই মাইয়াডা য্যান জোনাক পোকের লাহান জ্বইল্যা উঠল আন্ধারে। তয় বুকের ভিতরটা পোড়ে কে? এ তো খালি শরীরের আগুনে জ্বলা না। তয় কি এই খারাপ মাইয়া মানুষটারে আমি ভালোবাইস্যা ফালাইলাম! হায় আল্লা!
মধ্যরাতে মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে শাজাহানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে। সে বলতে থাকে, শবেবরাতের রাইত বাদে গত সাত বছরে কোনো রাইতে ঘুম পাড়তে পারি নাই। আপনে কেমন মানুষ সারা রাইত নিজে জাইগ্যা বইয়া আমারে ঘুম পাতাইলেন? সে-রাতের পর থেকে শাজাহান আরো বহুবার ওখানে গেছে শুধু মেয়েটিকে পাশে নিয়ে শুয়ে থাকার জন্য। সে কি তবে তার জীবনের মধ্যে মেয়েটিকে পেতে চায়? হয়তো চায়। কিন্তু কুৎসিত, খারাপ, আশাহীন পৃথিবীতে সে জানে, এ-মেয়েটিকে সে কখনো পাবে না। কোনো এক মধ্যরাতে মেয়েটির ওপর শরীরের সব আগুন নেভানোর পর এক শান্ত নৈরাশ্য নিয়ে সে তার ঘরে ফিরে যায়। সেই যাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার শেষ সম্বল দীর্ঘশ্বাস। মেয়েটির জন্য এক নতুন যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খায়। সে প্রায়ই তার কাছে যায়, তাকে বুকে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে, অথবা কখনো তার শরীরে সমস্ত ব্যর্থতা নিয়ে দুমড়ে ভেঙে পড়ে, কখনো তাকে শান্তিতে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। তার নিজের জীবনের গোলকধাঁধাটিকে সে আর কিছুতেই আবিষ্কার করতে পারে না। প্রতিদিন শূন্য থেকে শূন্যতর হতে শুরু করা জীবন নিয়ে ঝুলতে ঝুলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, চিহ্নহীন, এক অসম্ভবের মতো।