ছায়ার সমান্তরাল

নীলপাড় মেরুন শাড়ির কুঁচির দোলাচল আর একটি মিষ্টি নারীকণ্ঠ – এই দুইয়ের আবেদন উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না বলে কুয়াশার মতো ঘোলাটে মাথাব্যথা নিয়েও সাজিদ বাঁদিকে ঘুরে তাকায়। সে-সময় সে নিজেকে মৃদু তিরস্কার করে, কারণ সাজিদ জানে এই কাজটি তার স্বভাববিরুদ্ধ হয়েছে। পথ চলতে ঘাড় ঘুরিয়ে যেসব পুরুষ বুভুক্ষু চোখে মেয়েদের রূপ দেখে, তাদের সে নিজেই অপছন্দ করে। তবে হাজিরা খাতা আর হোয়াইট বোর্ড মার্কার হাতে বিজ্ঞান ভবনের ২০১ নম্বর কক্ষ থেকে বেরিয়ে দৃষ্টিটা সে ঘুরিয়েছিল অবচেতনেই। করিডোর পেরিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল চশমাপরা একজন তরুণী শিক্ষক গভীর মনোযোগ দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। তার শব্দচয়ন আর বোর্ডের আঁকিবুকি দেখে বোঝা গেল পড়ানোর বিষয় অর্থনীতি। এক ঝলক এই দৃশ্য দেখে হঠাৎ সামান্য গতিরোধ হলেও সে প্রায় স্বাভাবিক পায়ে এগিয়ে যায়। বিভাগে নিজের কক্ষে ফিরে এসে পিয়নকে এক কাপ চা দিতে বলে সাজিদ। গরম আদা-চায়ে চুমুক দিয়ে খানিক আগে দেখে-আসা প্রভাষকের মুখখানা স্পষ্ট করে মনে করার চেষ্টা করে। মায়ামেশা শ্যামলা মুখ, চোখজোড়া টানাটানাই মনে হলো – একে তো আগে কোথাও দেখেনি, নতুন জয়েন করল নাকি? কী নাম মেয়েটির? অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে দিনের দ্বিতীয় ও শেষ ক্লাসে ঢুকে নিজের ভেতর কেমন অন্যমনস্কতা টের পায় সাজিদ। ঘণ্টা বাজার দু-তিন মিনিট আগেই  ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবে, তারপর তৃতীয়তলায় অর্থনীতি বিভাগের উদ্দেশে সিঁড়িতে পা রাখে। সেখানে গিয়ে কোনো শিক্ষককে না পেয়ে পিয়নকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের বিভাগে নতুন কোনো শিক্ষক জয়েন করেছে?’

‘স্যার সে তো দুই মাস আগের কথা, বরিশাল থেকে এসে সাইফুর রশিদ স্যার জয়েন করলেন।’

‘না, না – কোনো মহিলা?’

‘জি না স্যার, আমাদের তো কোনো ম্যাডাম নেই, সবাই স্যার।’

কিন্তু সাজিদ স্পষ্ট মনে করতে পারে ভদ্রমহিলা ইকোনমিক্সই পড়াচ্ছিলেন। ডেস্কে কিছু কাজ জমে আছে, তবু এখন আর বিভাগে ফিরতে ইচ্ছে করে না। কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রেখে মনে হয় মাথার ডান দিকে ভোঁতা ব্যথার ভাবটা ক্রমেই তীক্ষè হচ্ছে। এই অক্টোবরেও রোদের তেজটা কমেনি, সামান্য পথ বলে রিকশা নিতে ইচ্ছে করে না, সে রাস্তার বাঁপাশ ধরে হাঁটতে থাকে। ওই প্রভাষক সম্পর্কে ভাবতে-ভাবতে সাজিদ হেড ক্লার্ককে ফোন দিয়ে বলে, ‘আমিন ভাই, আমাদের কলেজে নতুন কোনো টিচার জয়েন করেছে দু-একদিনের মধ্যে?’

‘কই না তো, সাইফুর রশিদ স্যারই সর্বশেষ।’

ফোন কেটে দিয়ে পিচঢালা মসৃণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে মনে হয় সেখান থেকে উত্তাপ বিকিরিত হয়ে তার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। টিস্যুতে কপাল আর গলার ঘাম মুছে সাজিদ কড়ই গাছটার ছায়ার নিচে মিনিটখানেক নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা ভর্তিগ্লাস তুলে নিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয়। দোকানির কাছ থেকে একটা গোল্ডলিফ কিনে সন্তর্পণে টান দিতে দিতে বাসার দিকে এগোয় সাজিদ। নিজের নাতিদীর্ঘ চলমান ছায়ার দিকে তাকিয়ে আবার মূর্ত হয় সেই একহারা গড়ন মেয়েটির চেহারা, টানাটানা চোখ। তাহলে সে কাকে দেখল? নাকি পুরোটাই দৃষ্টিভ্রম? টানতে বিস্বাদ লাগায় সিগারেটের বাকি অংশ রাস্তায় ফেলে পদতলে পিষতে-পিষতে তার মনে পড়ে সে ওই কক্ষে ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চকের আঁকিবুকি দেখেছিল। কিন্তু এই কলেজের কোথাও তো এখন আর ব্ল্যাকবোর্ড নেই। যেগুলি ছিল সেগুলি বেশ আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন কলেজের কোথাও চক খুঁজে পাওয়া যাবে না, সর্বত্র হোয়াইট বোর্ড আর মার্কার। এবার সে নিশ্চিত তার দেখার ভেতর কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। ঘরের কাছাকাছি এসে সে যখন সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠছিল তখন তার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে বোর্ডের ডানদিকে ইংরেজিতে লেখা ‘ডেট : ১৮/৯/১৯৮০’। এটা তো ২০২১ সাল আর সে দেখছে ১৯৮০। প্রায় একচল্লিশ বছর পেছনে, তাহলে পুরো ব্যাপারটা কি সত্যিই কোনো ইন্দ্রজাল?

পরদিন একটা ক্লাস নিয়ে বেলা সাড়ে দশটার দিকে কলেজের উত্তর দিকে মেহগনি বাগানের ভেতর দাঁড়িয়ে তরুণ সহকর্মী ইমতিয়াজ আর তারিফের সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করে সাজিদ। বৃত্তান্ত শুনে ওরা বেশ মজা পায়। দু-ব্যাচ সিনিয়র লম্বাটে ইমতিয়াজ তামাশার ছলে বলে, ‘তুমি দিনে-দুপুরে ভূত দেখতে শুরু করেছ। এটা বিবাহে বিলম্ব করার ফল। ঘরে ভাবি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ব্যাচমেট তারিফ বলে, ‘আমার এক চাচাতো শালি আছে, খুব সুন্দরী – দেখবেন নাকি একবার? তাকে একবার দেখলে ওসব ঘোরটোর সব কেটে যাবে।’

লঘু ঠাট্টা-রসিকতার মধ্য দিয়েই আসর শেষ হয়, ইকোনমিক্সের লেকচারার বিষয়ক রহস্যের কিনারা পায় না সাজিদ। তখনই ঠিক করে অহেতুক এ-বিষয় আর কারো সঙ্গে শেয়ার করে নিজেকে তামাশার পাত্র করা ঠিক হবে না।

এদিকে মা ডেকে পাঠানোয় এর একদিন পরে সাজিদকে বাড়ি যেতে হয়। বৃহস্পতিবার সরোজগঞ্জ গিয়ে শোনে, মা সত্যি-সত্যি ছেলের জন্য পাত্রী ঠিক করেছেন, কাল শুক্রবার মেয়েটিকে দেখতে যেতে হবে। ডায়াবেটিক পেশেন্ট বাবা চার বছর আগে অনেকটা অকালেই কিডনি ফেইলিওরে পৃথিবী ছেড়েছেন বলে সাজিদ নিঃসঙ্গ মায়ের মুখের ওপর ‘না’ বলতে পারে না। শুক্রবার সকালবেলা মেজো মামা আর ছোট খালুর সঙ্গে তাকে সুবোধ বালকের মতো পাত্রী দেখতে রওনা হতে হয় মেহেরপুর। ব্যাংক কর্মকর্তার বাড়িটা বাসস্ট্যান্ড থেকে বেশি দূরে নয়। টুকটুকে ফর্সা গোলগাল চেহারার মেয়েটি ইতিহাসে অনার্স পড়ছে। সাজিদের মনটা কেমন বিক্ষিপ্ত ছিল বলে মেয়েটির সঙ্গে তার কথা বলার কোনো ইচ্ছে হয় না, যা বলার মামা আর খালুই বলেন। পাত্রীপক্ষের একজন বলেন, ‘বাবা, তোমরা না-হয় পাশের ঘরে দুজন আলাদা বসে একটু কথা বলে নাও।’

মেজো মামা সাজিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে বলেন, ‘সেটা তো হতেই পারে, সাজিদ?’

সাজিদ মৃদুকণ্ঠে বলে, ‘না মামা, আপাতত দরকার নেই।’

ওরা যখন চায়ে চুমুক দিচ্ছে তখন ভেতর থেকে নানারকম গুরুপাক খাবারের গন্ধ আসে, বোধহয় অহেতুক বাহুল্য আয়োজন করেছেন গৃহকর্তা। খাবারের গন্ধে ক্ষুধার বদলে কেমন গা-গোলানো ভাব হয় সাজিদের, চায়ের কাপ টেবিলে রেখে মনে হয় এখান থেকে দ্রুত বিদায় নিতে পারলেই বাঁচে। খালু এক ফাঁকে সাজিদকে ঘরের বাইরে রাস্তার পাশে ডেকে এনে বললেন, ‘কী – তোমার পছন্দ হয়নি?’

সাজিদ মাথা চুলকে বলে, ‘আমি এখনই কিছু বলতে পারছি না।’

‘কেন কী সমস্যা? কখন থেকে দেখছি তুমি মনমরা হয়ে আছো।’

‘ঠিক জানি না, কেন যেন আমার মন টানছে না আসলে।’

‘কেন মেয়ে দেখতে সুন্দরী, ফ্যামিলি ভালো, এতো হেজিটেশন কিসের? তলে তলে প্রেমট্রেম করে রেখেছ নাকি – তেমন হলে সেটা স্পষ্ট করে বলো!’

‘না না খালু, সেসব কিছু নয়। এখনই হ্যাঁ-না কিছু বলার দরকার নেই। আপনি বরং সময় চেয়ে নিন।’

‘ঠিক আছে, কিন্তু আপা আমাকে বলেছিল তোমরা আংটি পরিয়ে আসবে।’

‘আংটিটা আপাতত আপনার কাছেই থাক। যাওয়ার সময় মেয়েটির হাতে এই পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েন।’ সাজিদ নতুন নোটগুলো মুড়িয়ে খালুর হাতে দিয়ে দেয়।

ওরা কথা বলছিল একটা বড় কদমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে। এখন তো গাছে ফুল নেই – ফুলের সময় নয়। আশপাশে কোনো ফুলের গাছও চোখে পড়ে না। তবু কোত্থেকে সাজিদের নাকে তীব্র সুগন্ধ এসে আঘাত করে। গন্ধটা কি ফুলেরই, নাকি অন্যকিছু? সে চারপাশে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায়, তবে খালুকে এ-বিষয়ে কিছু বলে না। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তেরছা আলো এসে পড়ে তার মুখে। তখন সাজিদের আবার সামান্য মাথাব্যথা অনুভূত হয়। সে বলে, ‘চলুন ভেতরে যাই। বেশি দেরি করা যাবে না। সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরতে হবে।’

সন্ধে লাগার আগেই তারা ঘরে ফেরে। তবে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই সাজিদ ‘না’ বলায় মা মনঃক্ষুণ্ন হন। মাকে বোঝাতে গেলে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যাবে ভেবে সে নীরবই থাকে, খালু আর মেজো মামার কাছ থেকেই মা বৃত্তান্ত জেনে নেন।

রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না, সাজিদের আশঙ্কা হয় বিশ^বিদ্যালয়-জীবনের ইনসমনিয়াটা আবার ফিরে আসবে নাকি। মনে মনে ঘুম প্রার্থনা করতে করতে সে মনস্থ করে, কাল বাবার পুরনো কবরটা ঠিকঠাক করে জিয়ারত করবে। আর পরশুই ফিরে যাবে কর্মস্থলে, কেন যেন এবার বাড়িতেও ভালো লাগছে না। নির্জন ঘরে বালিশে মাথা রেখে সে নিজেকে পাত্রীবিষয়ক দ্বিধার কারণ জিজ্ঞেস করে। তাতে প্রথমত জবাব পায়, বিয়ের জন্য সে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। এই জবাবটি যথেষ্ট সন্তোষজনক নয় বলে সে দ্বিতীয় কারণ অনুসন্ধান করে। সেখানে যে-উত্তরটি আসে তা অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম এবং অকাট্যই মনে হলো। বিশেষ করে সেদিনের সেই করিডোর পেরোনোর মুহূর্ত থেকে সাজিদের অবচেতন মনে যে-মেয়েটির বিচরণ, সে দেখে-আসা পাত্রীটির মতো নয়। তাহলে কেমন সেই নারী? সাজিদ চেহারাটি স্পষ্ট দেখার জন্য দু-চোখ বন্ধ রাখে। ধীরে ধীরে মনের পর্দায় মূর্ত হয় সাত-আটদিন আগে দেখা সেই প্রাণবন্ত তরুণী শিক্ষিকার মুখ। কিন্তু তাকে সে কোথায় পাবে – এমন কোনো বাস্তব নারী তো তার আশপাশে নেই। সেদিন মাথাব্যথার ঘোরে কী দেখতে কী দেখেছিল তার ঠিক নেই। কিন্তু সে তো মেয়েটির চেহারা আর চৌকস ভঙ্গিমা স্পষ্ট মনে করতে পারছে, দিব্যি কানে ভাসছে ওর মিহি কণ্ঠ, দেখতে পাচ্ছে বোর্ডের লেখা। আর উনিশশো আশি সালের সেই তারিখ। তবু কি ব্যাপারটা স্বপ্ন ছিল? ‘ও আমি স্বপ্নে দেখলাম মধুমালার মুখ রে।/ স্বপন যদি মিথ্যা হইতো আংটি ক্যামনে বদল হইলো গো মা ধন।’ মধুমালা-মদন কুমারের স্বপ্নঘোর হয়েছিল গভীর রাতে, সাজিদের ক্ষেত্রে দিনে-দুপুরেই তাই ঘটল? যে-মেয়ের অস্তিত্বই জানে না, তার কথা সে মাকে কীভাবে বলবে? জীবনটা যদি সত্যি রূপকথার মতো হতো তাহলে মা হয়তো নৌবহর দিয়ে তাকে পাঠাতো সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপার থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনতে। এই রমণীর প্রতিমূর্তি মগজে ধারণ করে সে তো অন্য কোনো নারীর জীবনসঙ্গিনী হতে পারবে না, কোনো নারীকে এভাবে প্রতারণা করা অনুচিত। তার চেয়ে বরং কোনো এক রহস্য-ছায়ার সমান্তরালে, সুরভিত বাতাসের পাশে নিঃসঙ্গ থাকা ভালো।

তিন বছর বিরতির পর আবার কলেজের ম্যাগাজিন বের হবে – এই মর্মে প্রিন্সিপাল ম্যাগাজিন কমিটি ঘোষণা করলেন, সেখানে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সাজিদ। কনভেনর এই বিষয়ে মিটিং শেষে সাজিদকে দায়িত্ব দিলেন এ যাবত যতো ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে সেগুলি পর্যবেক্ষণ করে তার সারসংক্ষেপ তাকে জানাতে। নির্দেশমতো সাজিদ সেদিনই লাইব্রেরিতে গিয়ে ১৯৬৬ সাল থেকে মোট সাতটি পুরনো কলেজবার্ষিকী সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে আসে। রাতে সেগুলি ঘাঁটতে-ঘাঁটতে ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত আবাহন নামক ম্যাগাজিনে শিক্ষকদের ছবির মধ্যে একটি ফটোগ্রাফে তার দৃষ্টি আটকে যায়। হ্যাঁ এই তো – এই মহিলাকেই সে সেদিন দেখেছিল লেকচার দিতে – মুখের সেই আদল, চশমার ফ্রেমটিও এক। ছবির নিচে নাম লেখা সৈয়দা রিজওয়ানা ইসলাম, প্রভাষক অর্থনীতি। এই রিজওয়ানাকে সে কীভাবে দেখল এতোকাল পর ক্লাসরুমে – এর মধ্যে তো চারটে দশক তলিয়ে গিয়েছে মহাকালের গহ্বরে। ঘড়িতে যখন রাত দেড়টা তখনো ঘুম না আসায় বিছানা ছেড়ে সে দরজার ছিটকিনি খুলে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। দখিনের রাত-বাতাসটা কেমন হিমহিম লাগে। এর সঙ্গে ভেসে আসছে কী একটা ফুলের গন্ধ। হাস্নাহেনা, নাকি গন্ধরাজ? সে খানিক বুকভরা শ^াসের সঙ্গে মাদকতা-মেশানো সেই সুবাস গ্রহণ করে। খানিক পর মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে, কেমন একটা নেশাসক্ত ভাব। আরো একবার মনোযোগের সঙ্গে শ^াস নিয়ে বুঝতে পারে, না, এ তো কোনো ফুলের গন্ধ নয় – এটা নিশ্চিত কোনো দামি পারফিউম হবে, সেটা নারীর জন্যই মানানসই। অদূরে কোথাও একটা পেঁচা ডাকছে। অন্ধকার গাছপালার মাথায় ঘোলাটে চাঁদের দিকে তাকিয়ে কেমন ভয় ভয় লাগে। রাত বাড়ছে – নির্ঘুমতার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া যাবে না। সামান্য ভীত ও দ্বিধাগ্রস্ত মনে টলকানো শরীরটা নিয়ে সে সাদা ফিনফিনে মশারির ভেতর ঢুকে পড়ে।

পরদিন কলেজে গিয়ে কাজের ফাঁকে সাজিদ অনুসন্ধান করে ওই সময়ের – মানে ১৯৮০ সালের কোনো শিক্ষক এই শহরে অবস্থান করছেন কি না। বস্তুত সেদিন অপরাহ্ণের ওই দৃশ্যাবলির রহস্য উন্মোচন ছাড়া তার মুক্তি নেই। গণিতের শিক্ষক ধ্রুবপদ ব্যানার্জির কাছে তথ্য পাওয়া গেল সেই সময়ের রিটায়ার্ড অধ্যাপক জালালউদ্দীন আর অধ্যাপক যুগল কিশোর শর্মা আজো বেঁচে আছেন; এই শহরেই বাড়ি তাঁদের। মাথার ভেতর বিচিত্র জিজ্ঞাসা আর ভাবনারাশি নিয়ে বিকেলে সাজিদ শহরের সুকান্ত সড়কে অধ্যাপক জালালউদ্দীনের বাড়িতে উপস্থিত হয়। বৃদ্ধ লোকটি তাঁর পুরনো কর্মস্থলের একজন তরুণ শিক্ষককে পেয়ে খুশিই হন। ভেতর থেকে দ্রুতই চা-নাস্তা চলে আসে। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে ১৯৮১-এর ফেব্রুয়ারিতে রিজওয়ানা এখান থেকে বদলি হয়ে খুলনার বিএল কলেজে চলে যান। এর তিন মাসের মধ্যেই ওই ঘটনাটা ঘটে।’

‘কী ঘটনা স্যার?’

‘ওনার পৈতৃক বাড়ি ছিল যশোর-খুলনা রোডে বামুনদিয়া বাজারের কাছে। ভেবেছিলেন যতদিন বিয়েশাদি না হচ্ছে বাবার বাড়ি থেকে অফিস করবেন। বাসে তো মাত্র ৩০-৩৫ মিনিটের পথ। সেদিন ক্লান্ত শরীরে খুলনা থেকে ফেরার পথে বাসে ঘুমিয়ে পড়েন। মাথাটা হয়তো বাইরে বেরিয়ে ছিল সামান্য। একটা ট্রাক ক্রস করার সময় আঘাত লাগে মাথার ডানদিকে। ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল। মারাত্মক হ্যামারেজ ছিল, অপারেশন সাকসেসফুল হয়নি। অ্যাক্সিডেন্টের পাঁচদিনের মাথায় পিজি হাসপাতালে মারা যান। আমরা সবাই গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। একটা আশ্চর্য কোইন্সিডেন্স হলো, যেদিন উনি মারা যান সেদিনই তাঁর বিয়ের তারিখ নির্ধারিত ছিল। পাত্রপক্ষের লোকজন, স্বয়ং পাত্রও এসেছিল জানাজায়। আমার মনে আছে, ওইদিন ছেলেটি খুব কেঁদেছিল। বোধহয় প্রেমই ছিল ওদের, হয়তো খুব গভীর।’

‘আচ্ছা উনাকে কোথায় দাফন করা হয়েছিল আপনার মনে আছে। পারিবারিক গোরস্তানে, নাকি অন্য কোথাও?’

‘না বাড়িতে নয়, জায়গাটার নাম বামুনদিয়া আগেই বলেছি, ওটা তো একটা পৌরসভা – সেই গোরস্তানে।’

‘গোরস্তানটা তো এখনো আছে, কী বলেন?’

‘তখনই ওটা বেশ বড় ছিল, সরকারি জায়গা, নিশ্চয়ই থাকবে। এসব তো উঠে যাওয়ার বিষয় নয়।’

যেভাবে পরিকল্পনা করে রেখেছিল পরের শুক্রবার ২২ তারিখ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সাজিদ বামুনদিয়া রওনা হয়ে যায়। ছোট্ট শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশায় গোরস্তানের সামনে পৌঁছতে দশ মিনিটেরও কম সময় লাগল। শুক্রবার বলে গোরস্তানের দুটি গেটই খোলা ছিল। পূর্ব দিক দিয়ে ঢুকে সে কবরগুলোর নেমপ্লেটগুলো পড়তে থাকে। কিন্তু প্রায় পুরো গোরস্তান পরিভ্রমণ করেও রিজওয়ানা নামে কোনো কবর চোখে পড়ে না। খুঁজতে খুঁজতে পশ্চিম প্রান্তে চলে এসে সাজিদ ভাবে, তার সমাধি রক্ষা করার মতো কেউ বোধহয় নেই। তাহলে কি এখন সৈয়দা রিজওয়ানার বাড়িতে যেতে হবে? সেখানে পাওয়া যাবে কাউকে? তারা দিতে পারবে কবরের সন্ধান? এ-কথা ভাবতে ভাবতে একটা ঝোপের ভেতর বাঁধানো কবরে শে^তপাথরের নেমপ্লেট দেখে সে চমকে ওঠে। দু-হাতে বুনো ঝোপ সরিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায় – ‘এখানে শায়িত আছেন সৈয়দ আশরাফুজ্জামান ও জাহেদা বেগমের কন্যা মরহুমা সৈয়দা রিজওয়ানা ইসলাম, জন্ম : ২৯ মে ১৯৫৪; মৃত্যু ২১ মার্চ ১৯৮১।’ সাজিদ কবর বেষ্টন করে রাখা লতাগুল্ম টেনে তুলতে শুরু করলে লতাপাতার বুনো গন্ধে ভরে ওঠে পরিবেশ। তখন হঠাৎ পেছন থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘উনি আপনার কী হন?’

সাজিদ চমকে তাকিয়ে দেখে ৬০-৬৫ বছর বয়সী শুভ্র শ্মশ্রুধারী একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নির্বাক দেখে লোকটা আবার বলে, ‘এই কবরের কাছে বহুদিন কেউ আসে না তো, তাই জিজ্ঞেস করছি।’

‘আমার পরিচিত। উনি যে-কলেজে চাকরি করতেন আমি সেখান থেকে এসেছি।’

‘কিন্তু আপনার যা বয়স তাতে তো বুঝতে পারছি আপনার জন্মের অনেক আগেই তাঁর মৃত্যু।’

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি তাঁকে দেখেনি। তিনি আমার আত্মীয় সম্পর্কেরও কেউ নন। তবু কবরে শায়িত এই মানুষটাকে আমার কিছুদিন ধরে খুব চেনা মনে হচ্ছে। তাই এতদূর থেকে ছুটে আসা।’

‘বুঝেছি। এরকম হতে পারে। হয় কারো কারো ক্ষেত্রে।’

‘কেন এমন হয় বলতে পারবেন?’

‘আমি ঠিক জানি না। তবে শুনেছি পৃথিবীতে মানব জনমের আগে মালিক আত্মাগুলিকে বানিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেন। পৃথিবীতে এসে সেই পূর্বপরিচিত আত্মারা নিজেদের আপন বলে মনে করে। আপনার ক্ষেত্রে এমন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।’

‘বাহ্, আপনার কাছে তো নতুন কথা জানলাম।’

‘অবশ্য এ-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই – আমারও শোনা কথা।’

‘তা হোক, তবু তো একটা যুক্তি পাওয়া গেল, আত্মা সম্পর্কে এমন কথা আমিও শুনেছি।’

‘আসল কথা কী বাবা – এ- জগতের বিচিত্র রহস্যের কতটুকুই বা আমরা জানতে পারি।’

কুষ্টিয়া ফিরে গিয়ে সাজিদ মাকে ফোন করে বলে, ‘তোমরা মেহেরপুরের মেয়েটির বাবাকে পাকা কথা দিতে পারো, আমার কোনো আপত্তি নেই।’

মা মুহূর্তকাল সময় নষ্ট না করে নেমে পড়েন দায়িত্বে, তিনি জানেন তাঁর ছেলের মন আবার যে-কোনো সময় বেঁকে বসতে পারে।

বিয়ের আসরে সাজিদের মগজে আবার কেন যেন সেই সংশয়বোধটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করতে থাকে। মনে হয়, হঠাৎ ঘোরের মধ্যে সে যেন পরিণতি না ভেবেই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু এ দাম্পত্য জীবন আদৌ সুখের হবে না। আগামী জীবন তার জন্য মারাত্মক এক পরীক্ষা ছাড়া কিছু নয়। এ পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে তাকে তিলে তিলে মরতে হবে।

ফুলশয্যায় নববধূ দ্বিধা-জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাকে এমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন? চোখদুটো এতো লাল!’

‘কদিনের দৌড়াদৌড়ির জন্য হতে পারে। মাথাটা বেশ ব্যথা করছে।’ তার অস্বস্তি যে মেয়েটির দৃষ্টি এড়ায়নি সেটা টের পেয়ে সাজিদের ভেতর একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করে।

‘তাহলে তুমি শুয়ে পড়ো, আমি মাথা টিপে দিই। ওষুধ খাবে কোনো?’

‘না, দেখি কিছুক্ষণ।’ মেয়েটির শুভ্র হাত এগিয়ে আসে সাজিদের কপালের দিকে। নববধূর হাতখানা অস্বাভাবিক শীতল বলে বোধহয় তার।

রাত আড়াইটার দিকে কাঁপুনি দিয়ে জ¦র আসে সাজিদের। কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়েও সে-কাঁপুনি কিছুতেই থামে না দেখে শঙ্কিত নববধূ শাশুড়ি আর একমাত্র ননদকে ডেকে আনে।

সাজিদের বড় বোন থার্মোমিটার দিয়ে তাপ মেপে বলে, ‘জ¦র তো একশ তিনের কাছাকাছি, এতো রাতে কোথাও তো ডাক্তারও পাওয়া যাবে না।’

মা বলেন, ‘তুই আমার ঘর থেকে দুটো প্যারাসিটামল নিয়ে আয়। আর মাথায় বেশি করে পানি দিতে হবে। এমন একটা সময় ছেলেটার এভাবে জ¦র এলো।’ মায়ের অসহায় কণ্ঠে কাঁদো-কাঁদো ভাব।

মা আর আপা পালাক্রমে মাথায় পানি দিতে থাকলে সাজিদ বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ চোখ মেলে দেখে দৃষ্টির সামনে জানালার পর্দাটা দুলছে ভীষণ। ঠিক তখন সে চার মাস আগেকার সেই তীব্র গন্ধটা টের পায়। সৌরভের তীব্রতায় মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে, কেমন নেশা-নেশা – কোনো নারীশরীরের মাদকতা ঘরের বাতাস জুড়ে।

ঘোরের ভেতর সামান্য চোখ মেলে সাজিদ নববধূকে বলে, ‘জানালাটা বন্ধ করে দিতে পারো?’

নববধূ জানালা বন্ধ করতে করতে বলে, ‘আকাশে মেঘ করেছে, বাইরে এলোমেলো বাতাস।’

সাজিদ কাউকে বলতে পারে না – সে জানালা বন্ধ করতে বলেছে বাতাসের জন্য নয়, ওই অসহনীয় সুগন্ধের জন্য।

ছেলের দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে দেখে পানি ঢালায় সামান্য বিরতি দিয়ে মা বলে, ‘বেশি কষ্ট হচ্ছে বাবা?’

সাজিদের ভেতরে আবার কাঁপুনিটা বাড়ছে। সে বলে, ‘মা, আমি কি কোনো ভুল করলাম?’

‘কেন, মানিক আমার – কিসের ভুল।’

‘ঘর জুড়ে একটা তীব্র গন্ধ টের পাচ্ছ তোমরা কেউ?’

বড় বোন বকুল বলে, ‘গন্ধ তো আছেই কিছু – বউয়ের নানান মেকআপ আর গায়ের পারফিউম হয়তো -’

‘না, আপা গন্ধটা বাইরে থেকে আসছে, আগেও এসেছিল – চার মাস হলো মাঝে মাঝে আসে রাতে, তোমাদের বলা হয়নি। কিন্তু আজ যে এমন ভয়ংকর তীব্র! আমি সহ্য করতে পারছি না।’

‘কী বলছিস তুই -। মা সাজিদের জ¦রটা আরো বাড়ছে, আমার মনে হয় ও ভুল বকছে। এখনই ডাক্তারের কাছে নেওয়া দরকার।’

নববধূ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সাজিদের দিকে। জ¦রের ভেতরেও সেই দৃষ্টিতে বিচিত্র অনুভবের ছাপ প্রত্যক্ষ করে সে। এই মেয়েটি আজীবন বুকে ধারণ করে থাকবে এক নষ্ট বাসররাতের স্মৃতি। ঘোরের ভেতর স্ত্রীর নামটা মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে। শরীরের সব রক্তচাপ এসে জমেছে যেন জ¦রতপ্ত মগজের ভেতর। জ¦র বেশি বেড়ে গেলে লোকে কি মরেও যায়? কে জানে।

দ্বিতীয়বার আর নববধূর চোখের দিকে তাকাতে পারে না সাজিদ। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে দু-চোখের পাতায়। এই ঘোর ঘোর ভাবটা এখন নেহাত মন্দ লাগছে না। ঘোরের ভেতরেও সে টের পায়, বাইরে শন শন আওয়াজ – এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি নামছে ঝুপঝুপ করে। এখন ফেব্রুয়ারি – বসন্তের বৃষ্টি। এই বৃষ্টি কি ধুয়ে দিতে পারবে সেদিনের সেই অশরীরী ছায়ামূর্তি – ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে দুর্বৃত্ত সৌরভ? এসব অবচেতনার প্রবাহ সাঁতরে সাজিদ যখন ভাবছে ভোর হতে আর কত বাকি,

তখন গভীর তন্দ্রায় তার দু-চোখ বুঁজে আসে।

ভাইয়ের মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে বকুল আর্তচিৎকার করে ওঠে, ‘একশ ছয়ের ওপরে, মা কী হবে এখন!’

ততক্ষণে বকুলও সেই তীব্র সৌরভটা পেতে শুরু করেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘মা অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে! ভাই আমার – এ কী হলো তোমার!’

সাজিদ সম্ভবত বেপরোয়া সৌরভটা পাচ্ছে না আর। এদিকে বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই, বালক বয়স থেকে ফাল্গুনের বৃষ্টি খুব প্রিয় ছিল তার।