জঁ লুক গোদার নারী, বিপ্লব এবং সিনেমা

আগে অমরত্ব, তারপর মৃত্যু। এই তো অভীষ্ট ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নন্দিত এবং নিন্দিত পরিচালক জঁ লুক গোদারের। আজ নয়, তাঁর সেই যৌবনের দিন থেকেই, সেই পঞ্চাশের দশক, প্যারিস শহর তখন পৃথিবীর সেরা প্রতিভাদের কেন্দ্রে, সবদিকেই, সাহিত্য, শিল্প, নাটক। কিন্তু সিনেমায় ক্রমশ গ্রাস করছে হলিউড। যদিও এই প্যারিসেই জঁ রেনোয়া রয়েছেন। কিন্তু হলিউডি চাপে তিনি খানিক কোণঠাসাই। সাহিত্য-শিল্প-নাটকে যেমন প্যারিস তখন সারা পৃথিবীতে প্রায় এক নম্বরে, সিনেমার ক্ষেত্রে কোনো এক অজানা ইশারায় সে হয়ে উঠছে ক্রমশই পরজীবী। এরকম এক সময়ে সুইজারল্যান্ড থেকে প্যারিসে পা দেন ১৯ বছরের গোদার, সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে পড়াশোনা করার জন্যে। কিন্তু গোদার, যাঁর ছোটবেলা থেকেই প্রিয় বিষয় সিনেমা, তিনি কেন জড়িয়ে পড়বেন অ্যানথ্রোপলজিতে? স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে তিনি প্রায় যেতেনই না। পরিবর্তে ঘুরে বেড়াতেন প্যারিসের লাতিন কোয়ার্টারের ‘সিনেমা থেক’-এ। সেখানে নিয়মিত দেশ-বিদেশের অন্যধারার সেরা সিনেমা দেখানো হতো। এছাড়া ছিল কয়েকটি সিনেমা ক্লাব। সেগুলিও গোদারের নিয়মিত ভ্রমণের তালিকায় চলে এলো। ‘সিনেমা থেক ফ্রান্সিস’ চালাতেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক আন্দ্রে বাঁজা। চলচ্চিত্র সংক্রান্ত একটি পত্রিকাও বের করতেন তিনি Ñ কাইয়ে দু সিনেমা। সেখানে সিনেমা নিয়ে লেখালেখি শুরু করলেন জঁ লুক গোদার। সম্পূর্ণ অন্য ভাবনায়, অন্য চিন্তায়, চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ। যেরকম ভাবে চলচ্চিত্রকে এর আগে কেউ দেখেনি। আর এখানেই তিনি পেয়ে গেলেন তাঁর সম্ভাবনার আরো চারজন বন্ধু Ñ ফ্রাসোয়া ত্রুফো, এরিক রোমার, ক্লদ শ্যাব্রল এবং রিভেত। যাঁরা পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠবেন

পৃথিবীর সিনেমার বিদ্রোহী পঞ্চপাণ্ডব। প্রায় আমূল বদল আনবেন সিনেমা-দুনিয়ায়। এঁরা সকলেই তখন জড়িয়ে পড়েছেন কাইরে দু সিনেমায় লেখালেখি সূত্রে। লাতিন কোয়ার্টারের ‘সিনেমা-থেক’-এ তখন নিয়মিত দেখানো হতো দেশ-বিদেশের সেরা সিনেমা। আন্দ্রে বাঁজার সম্পাদনায় তখন অত্যন্ত সিরিয়াস চলচ্চিত্র পত্রিকা Ñ কাইয়ে দু সিনেমা। লেখক হিসেবে সেখানে জড়ো হলেন একঝাঁক তরুণ তুর্কি যুবক, যাঁরা অতীতের ক্লিশে ছবিগুলিকে তাঁদের লেখনীতে বাতিল করলেন। ফরাসি সিনেমাকে তাঁরা নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করতে চাইলেন। তীব্র সমালোচনা করলেন হলিউডি সিনেমার। এই তরুণ তুর্কি দলে রয়েছেন Ñ জঁ লুক গোদার, অ্যালা রেনে, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, ক্লদ শ্যাব্রল, এরিখ রোমার এবং রিভেট। আর রয়েছেন কাইয়ে দু সিনেমার সম্পাদক আন্দ্রে বাঁজা। ১৯৫৪ সালে এই তরুণদের চলচ্চিত্রভাবনা ক্রমশই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এই সময়েই তো পুরনো ভাবনার ফরাসি ছবি সম্পর্কে কাইয়েতে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো লিখলেন, ‘এই ধারার ছবিগুলি ফরাসি

সংস্কৃতির পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’ ফরাসি আর গোদারের কাছে তো সিনেমা সমালোচনা চলচ্চিত্র নির্মাণের মতোই, শুধু ক্যামেরার বদলে কলম। যখন সিনেমা নির্মাণ করছেন তিনি তখনো এই কথাটিকেই সামান্য বদলে বলেছেন, ‘চলচ্চিত্র নির্মাণ আমার প্রবন্ধ লেখারই সমতুল, শুধু কলমের বদলে আমি ক্যামেরা ব্যবহার করি।’ গোদারের সিনেমা আসলে সিনেমা-প্রবন্ধ। চলচ্চিত্রে গল্প বলায় তিনি কখনোই বিশ্বাস করেননি। বরং চলচ্চিত্র তাঁর কাছে এক দার্শনিক ভাবনা প্রয়োগের বিকল্প।

পঞ্চাশের দশকে সেই কাইয়ের দিনগুলি ছিল তাঁদের প্রাত্যহিক দিনযাপনের আবশ্যিক অঙ্গ। তাঁদের স্বপ্ন বা জাগরণে ছিল শুধু সিনেমা। অন্য সিনেমা। যা কিছু পুরনো, যা কিছু ক্লিশে, তাকে ভেঙেচুরে বাতিল করে নতুন সিনেমার জন্ম দেওয়া। কাইয়ে দু সিনেমার সিনেমা রিভিউতে উঠে এলো সেই ভাবনাই। বিশেষ করে গোদার এবং ত্রুফো সিনেমা সমালোচনার মধ্যে দিয়ে সরাসরি নেমে পড়লেন প্রচলিত সিনেমার বিরুদ্ধে। আর গোদার তো সরাসরি বাতিল করলেন হলিউড সিনেমাকে। বললেন, ‘ফরাসি সিনেমা আর্থিকভাবে দরিদ্র আর মার্কিনি সিনেমায় রয়েছে চিন্তার দারিদ্র্য।’ তাই গোদার প্রথম ছবি ব্রেথলেসতেই তীব্রভাবে বিদ্রƒপ করলেন হলিউডি থ্রিলারকে। এর আগেই ফিচার ছবি করে ফেলেছেন ত্রুফো। পঞ্চপাণ্ডবের আরো তিনজনও ছবি করলেন। সব মিলিয়ে ফরাসি সিনেমায় এলো এক নতুন হাওয়া। নিউ ওয়েভ। নবতরঙ্গ। এমন একটি আন্দোলন, যা ফরাসি সিনেমার আঙ্গিক এবং ভাবনাকে প্রায় আমূল পালটে দেয়। একে অনেকটাই সিনেমা বিপ্লবই বলা যায়। পুরনো যা কিছু দু-চারটিকে বাদ দিয়ে সবকিছুকেই বাতিল করো, এই ছিল ফরাসি নবতরঙ্গের সেøাগান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অবশ্য ফরাসি দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নতুন করে নতুন কিছু করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে এই নতুন করে নতুন সিনেমার সন্ধান করাটা এক আন্দোলনে রূপ নিল। আন্দোলনের সঙ্গেই যুক্ত থেকেছে সেখানকার দেশিয় সংস্কৃতি। যেমন চল্লিশ বা পঞ্চাশের ফরাসি সিনেমায় প্রবলভাবে ছিল হলিউডি প্রভাব। নবতরঙ্গের পরিচালকেরা প্রথমেই সেই প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করলেন ফরাসি সিনেমাকে। সিনেমায় টানা গল্প বলার ঝোঁক ছিল সেই সময়কার ফরাসি সিনেমাতে। পঞ্চাশের দশকের শেষ অবধি ফরাসি সিনেমা ছিল সাহিত্যনির্ভর। এই সাহিত্যনির্ভরতা থেকে সিনেমাকে বের করে আনলেন নবতরঙ্গের পরিচালকেরা। এলো সিনেমায় অথর থিওরি। নবতরঙ্গের প্রাথমিক শর্ত। পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই প্যারিস অন্যান্য শিল্পকলার মতোই চলচ্চিত্র চর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। পঞ্চপাণ্ডবের নেতৃত্বে জন্ম নিল ফরাসি সিনেমায় নবতরঙ্গ। নিউ ওয়েভ। গোদার  প্রথম ফিচার ছবি ব্রেথলেসতেই হয়ে উঠলেন প্রচলিত ধারা ভেঙে নতুন ধারার পরিচালক। এই ছবি করার আগে গোদার ছোট ছবি ও ডকুমেন্টারি করেন। ব্রেথলেস ফরাসি সিনেমায় প্রায় বিপ্লব আনল। এতদিনকার সমস্ত প্রথা ভেঙে তৈরি হলো এই ছবি। ফরাসি সিনেমার আইক্লোনোক্লাস্ট হয়ে উঠলেন জঁ লুক গোদার।

১৯৬০ সালের কান চলচ্চিত্র-উৎসবে রীতিমতো সাড়া জাগালেন গোদার। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করলেন যে, ফরাসি সিনেমায় এক নতুন হাওয়া এসেছে।

এর পরেই ত্রুফো নির্মাণ করেন ফোর হানড্রেড ব্লোজ এবং আলা রেনে করলেন হিরোসিমা মোন-আমুর। কান চলচ্চিত্র উৎসবে কাইয়ে গোষ্ঠীর পরিচালকদের দারুণ সাফল্যে সকলেই বুঝল যে, ফরাসি সিনেমায় দিনবদলের দিন এসে গেছে।

কলাকৈবল্যবাদ নয়, বরং কম বাজেটে, নবাগত অভিনেতাদের সঙ্গে নিয়ে, নতুন নতুন আঙ্গিক আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে ধ্রুপদী ছবি নির্মাণ করা, যা কখনোই হবে না হলিউডি ছবির নকল। বরং সে-ছবি হয়ে উঠবে হলিউডি ছবির বিপ্রতীপ। আরেকটা মূল কথা হলো, চলচ্চিত্র হবে পরিচালকের। লেখার ক্ষেত্রে যেমন লেখক, সিনেমার ক্ষেত্রে তেমনই হয়ে উঠবেন পরিচালক। আগেই বলেছি, লেখার ক্ষেত্রে যেমন কলম, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তেমনই ক্যামেরা। সিনেমায় কলমের পরিবর্তে ব্যবহার করলেন ক্যামেরা। অর্থাৎ ‘অথর থিওরি’ প্রতিষ্ঠিত হলো ফরাসি সিনেমায়। অথর থিওরির ভাবনা অবশ্য শুরু হয় আন্দ্রে বাঁজার কাইয়ে দু সিনেমাতেই। সেখানেই গোদার, ত্রুফো, শ্যাব্রল, রোমার, রিভেট Ñ এই পঞ্চপাণ্ডবসমেত অন্যান্য লেখক এই অথর তত্ত্বের চর্চা চালাচ্ছিলেন। পঞ্চাশের শেষে এবং ষাটের দশকের শুরুতে এই অথর তত্ত্ব প্রয়োগ করলেন এইসব চলচ্চিত্র-সমালোচক থেকে উঠে আসা চলচ্চিত্র-পরিচালক।

গোদার বিশ্বাস করতেন, চলচ্চিত্রের প্রাথমিক অন্বেষণ হলো ‘মন্তাজ’-এর অন্বেষণ। তিনি তাঁর ছবিতে যে-মন্তাজ প্রয়োগ করেন তা আইজেনস্টাইনের মন্তাজ থেকে আলাদা। এখানে চলচ্চিত্র ভাষার আরেকটি শব্দের সঙ্গে পরিচয় করে রাখা দরকার। তা হলো মিজঁ অ সিন। মন্তাজ তৈরি হয় সম্পাদনার টেবিলে। মন্তাজ যেমন একাধিক শট পাশাপাশি সাজিয়ে ওই শট বা দৃশ্যের বাইরে অন্য এক অর্থ শব্দের। আর শব্দ ও ইমেজের সংঘাতে নির্মিত হয় গোদারীয় মন্তাজ, যা চলচ্চিত্র ভাষায় আরেক নতুন আঙ্গিকের জন্ম দেয়। পিকাসোর কিউবিজম যেমন চিত্রভাষায় এনেছিল বিপ্লব, গোদারীয় মন্তাজ সিনেমার ভাষায় ঠিক সেই কাজই করে। ঠিকই এভাবেই সিনেমার ভাষা এক ক্রমবিবর্তনের পথ দিয়ে আজকের ডিজিটাল যুগে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে চিহ্নবিজ্ঞান চলচ্চিত্রে এক বড় ভূমিকা পালন করছে। গোদারের চলচ্চিত্র সমস্ত পারিপার্শ্বিক আর্ট ফর্মকে আত্মসাৎ করে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ‘মিজঁ অ সিন’ হলো সেট-লাইট-পোশাক দৃশ্যের প্রধান চরিত্রগুলিকে নিয়ে এক অন্য অর্থ নির্মাণ। গোদার মন্তাজ ও মিজঁ অ সিন Ñ এই দুইয়ের বাইরেও ইমেজের এক স্বতন্ত্র জগতের কথা বলেন।

গোদারের ব্রেথলেস বাণিজ্যিকভাবেও সফল হলো। ‘নবতরঙ্গ’ আসার আগে বাণিজ্যিকভাবে ফরাসি ছবির হাল খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। ফলে প্রযোজকরা টাকা বিনিয়োগ করতে চাইছিলেন না। কিন্তু গোদার ও ত্রুফোর ছবি আন্তর্জাতিক সফলতার পাশাপাশি ফরাসি দেশে বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার ফলে ‘নবতরঙ্গে’র পরিচালকদের ছবিতে প্রযোজকরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হলেন। ফলে সেই সময় ‘নবতরঙ্গে’র পরিচালকদের প্রযোজক পেতে কোনো অসুবিধা হলো না এবং এদের কম বাজেটের চলচ্চিত্রগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আর গোদার ক্রমশই হয়ে উঠতে থাকলেন স্বতন্ত্র। এমনকি ফরাসি সিনেমার পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যেও তিনি স্ব-স্বভাবে আলাদা হয়ে উঠলেন। ক্রমেই তিনি হয়ে উঠলেন ফরাসি সিনেমার আইক্লোনোক্লাস্ট। আর তখনই তো নির্ধারিত হয়ে যায় অমরত্ব তাঁর অবশ্য ভবিতব্য আর মৃত্যুভাবনা সে তো তাঁর প্রথম ফিচার ছবি ব্রেথলেশ-এই প্রোথিত। ব্রেথলেশের নায়কের যাত্রাপথ ক্রমশই তো মৃত্যু-অভিমুখী। যার সম্প্রসারণ পাই গোদারের পরবর্তী সময়ের বেশকিছু ছবিতে, যেমন – আলফাভিল, পিয়ের লে ফু বা উইক এন্ড ইত্যাদিতে।

দুই

গোদারের ছাত্রজীবনে প্যারিস অস্তিত্ববাদীদের স্বর্গরাজ্য। জঁ পল সার্ত্র, কার্লো পন্টিরা ব্যাপকভাবে অস্তিত্ববাদ চর্চা করছেন। কার্লো পন্টি আবার নতুন ব্যাখ্যায় ফিরিয়ে আনছেন হেগেলিয়ান দর্শনকে। ইতোমধ্যেই সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ সঙ্গক্রান্ত বইগুলি প্রকাশিত হয়ে গেছে, বেরিয়ে গেছে নারীবাদের বাইবেল সিমোন দ্য বোভোয়ারের সেকেন্ড সেক্স। অদিকে আলবেয়ার ক্যামু লিখলেন দ্য রেবেল। এই রকম একসময়ে প্রথম ফিচার ছবি করার আগে গোদার একটি ছোট ছবি করেন অল দ্য বয়েজ আর নেমড পাট্রিক নামে। সেই ছবিতে নায়িকার হাতে হেগেল গ্রন্থ। সেই বছর ফরাসি সিনেমায় মুক্তি পেয়েছে ত্রুফোর প্রথম ছবি ফোর হানড্রেড ব্লোজ। পাশাপাশি মুক্তি পেয়েছে রেনোয়ার পিকনিক ইন দ্য গ্রাস এবং রবার্ট ব্রেসেঁর পিকপকেট। এই রকম একসময়ে গোদার সিনেমার প্রায় সমস্ত ব্যাকরণ ভেঙে প্যারিসের পথে শুটিং করছেন তাঁর প্রথম ফিচার ব্রেথলেসের। যে-ছবি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে দেয় সিনেমার ভাষা। গোদার আগের সিনেমার সমস্ত প্রয়োগ ব্যাকরণকে ভেঙে শুধু ফরাসি সিনেমা নিয়ে বিশ্বসিনেমায় নিয়ে আসেন এক অন্য হাওয়া, যা সব অর্থেই অন্যরকম। তবু এটা ঠিক, এই ধরনের এক বিপ্লবসম কাণ্ড করার জন্যে সেই সময়ের ফরাসি সাংস্কৃতিক পরিবেশটা যথেষ্ট অনুকূলে ছিল। লেফট ব্যাংকের চলচ্চিত্রকারেরা একটা পরিবেশ তৈরি করেই রেখেছিলেন। তবে লেফট ব্যাংককে অনুসরণ করে গোদার চলচ্চিত্র নির্মাণে এলেন না। তিনি কী ছবি করতে চান তা তো তিনি ছকে রেখেছিলেন সেই চলচ্চিত্র সমালোচনার সময়কালেই। তাঁরা ভাবতেন, লেখা আর চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রভেদটা হলো পরিমাণগত, গুণগত নয়। ব্রেথলেস সম্পর্কে গোদার পরবর্তী নানা সময়ে নানা মন্তব্য করেছেন। তাঁর ছবির মতোই তাঁর মন্তব্যও জটিল এবং অর্থবাহী। তিনি ব্রেথলেস নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি ব্রেথলেস ছবি করার সময়ে ভেবেছিলাম, এমন একটা ছবি করব যেখানে দর্শক তার যে-কোনো অভিব্যক্তির অভিজ্ঞতার খোঁজ পাবে। এখান থেকেই আমার চিন্তার শুরু। ইতোমধ্যে আমরা রবাট ব্রেসের মতো পরিচালক পেয়েছি। অ্যালা রেনে হিরোসিমা মাই লাভ-এর মতো ছবি করেছেন, যা সিনেমার এক চূড়ান্ত রূপ নিয়ে এলো। এই সময় আমার মনে হলো, একটা শেষ আঁচড় দেওয়া যাক না। তবে ব্যাপারটাকে হতে হবে এমনই যাতে দর্শকদের মনে হয়, তারা একটা নতুন জিনিস দেখছে Ñ সিনেমা যেন এই মাত্র আবিষ্কার  হলো। আমি চেয়েছিলাম প্রচলিত গল্পেরই পুনর্নির্মাণ কিন্তু একেবারে অন্যভাবে, যা সিনেমায় হয়নি। আর এটা করার কারণ ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।’ সিনেমা নির্মাণে হলিউড যে ধ্রুপদী ধারা নির্মাণ করে রেখেছিল সারা পৃথিবীতে, সেটাই কালাপাহাড়ের মতো ভাঙতে শুরু করলেন গোদার। নতুন করে চলচ্চিত্র আবিষ্কারে মাতলেন। চলচ্চিত্র তাঁর প্রেমিকা। সিনেমার মধ্যে দিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান তাঁর প্রেমকে। তাঁর নায়কেরা বেশিরভাগ সময়েই আউটসাইডার। তাঁরা প্রতিনায়ক। ব্রেথলেস ছবির নায়ক তো নিজের সম্পর্কে বলেনই, অভঃবৎ ধষষ ও ধস ধহ ধৎংবযড়ষব। গোদারের নায়ক-নায়িকারা কখনোই গ্লামার-রঞ্জিত নন। যদিও গদারের ছবিতে অভিনয় করেই বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন জঁ পল বেলমন্ডো বা আনা কারিনারা। আর ব্যক্তিগত জীবনে তো আনা গোদারের প্রেমিকা এবং স্ত্রী। তাঁদের যুগলজীবন বেশিদিনের ছিল না, কিন্তু তাঁদের প্রেম ছিল আজীবন। অন্যের ঘরণী হয়েও এই প্রেমকে অত্যন্ত সযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন আনা। আর গোদার, আনার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর, নতুন করে বিয়ে করেছেন অভিনেত্রী অ্যানেন উইয়াজেমস্কিকে। আনা নামক এই বারুদবালিকাকে কখনোই ভুলতে পারেননি গোদার। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর সঙ্গে একটি অসুখী দাম্পত্যের স্মৃতি থাকলেও জঁ লুক গোদারের সিনেমাজীবন কখনোই সার্থক হতো না যদি না আনা কারিনার মতো কোনো নারী তাঁকে সঙ্গ দিতেন। আনাই ছিলেন গোদারের সিনেমার প্রধান অনুপ্রেরণা। মেরিলিনের মতো এক প্রেম থেকে আরেক প্রেমে গেছেন আনা। গোদারের সঙ্গে বিবাহও যে খুব বেশিদিন টিকেছে এমন নয়। তবে এ-কথা সবসময় স্বীকার করেছেন আনা যে, সিনেমার সমস্ত অনুষঙ্গই তিনি  শিখেছেন গোদারের কাছে। গোদারের সঙ্গে যোগাযোগ না হলে তাঁর জীবন মডেলিংয়ের মধ্যেই আটকে থাকতো। এতো বড় অভিনেত্রী হয়ে ওঠা হতো না তাঁর। ব্রেথলেসের পর ১৯৬০ সালের শেষের দিকে গোদার শুরু করলেন দ্য লিটল সোলজার। এই ছবর নায়িকা গোদার প্রেমিকা আনা কারিনা। দ্য টাইম অব অ্যানেকশন ইজ পাস্ট, দ্যাট অব রিফ্লেকশন ইজ বিগিনিং, দ্য লিটল সোলজার শুরু হয় এই বাক্যবন্ধেই। অ্যানেকশন ছবির দিন শেষ, ভাবনা-ছবির দিন শুরু। প্রথম ফিচার ব্রেথলেসতেই মার্কিনি অ্যানেকশন ছবিকে বিদ্রƒপ করেছিলেন তিনি। তবে এবার সরাসরি অ্যানেকশনের চেয়ে ভাবনার ওপর জোর দিতে চাইলেন অনেক বেশি। নয় আত্মজৈবনিকতা, না হয় যৌনতা, অথবা নারী-পুরুষের প্রেম ও তজ্জনিত শয্যাদৃশ্য, এই নাকি নবতরঙ্গের প্রায় সমস্ত পরিচালকের ছবির প্রধান বিষয়। এই রকম এক অভিযোগ ভালোভাবেই উঠছিল নবতরঙ্গের বিপক্ষে। গোদার এই অভিযোগ নস্যাৎ করার জন্যই কি বেছে নিলেন তৎকালীন এক অতি-বিতর্কিত রাজনৈতিক বিষয়? ১৮৩০ সাল থেকেই আলজেরিয়া ফ্রান্সের উপনিবেশ। আর ১৯৫৫ সাল থেকে আলজেরিয়ার মানুষ স্বাধীনতার জন্যে ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালাচ্ছে। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য আলজেরিয়ায় ফরাসি নাগরিক জীবন দুর্বিষহ। জাতীয়তাবাদী ‘ওএএস’ গোষ্ঠী, সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে আলজেরিয়াকে দ্বিতীয় উপনিবেশক হিসেবে রেখে দিতে চায়। এই ছবির বিষয় হয়ে উঠল এটাই। আর তখন থেকেই সমকালীন রাজনীতি গোদারের ছবির অন্যতম বিষয় হয়ে উঠল। প্রেম, নারী এবং রাজনীতি Ñ এই তিন বিষয়ই গোদারের আজীবন সিনেমা-বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান বিষয়।

লিটল সোলজার্স থেকে সেই শুরু, গোদারের বয়স তখন ৩১ এবং জীবনের শেষ ফিচার ইমেজ বুক, সবেতেই বারবার ফিরে ফিরে এসেছে সাম্প্রতিক রাজনীতি-অতীতের নানা রাজনৈতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ঠিকই চিরকাল বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। বিশ^াসী ছিলেন ডায়ালেকটিকে। তাঁর ছবির সিনেমার এতদিনকার সমস্ত গঠনকাঠামো ভেঙে প্রতিষ্ঠা পায় সেই সংঘাত, যা থিসিস অ্যান্টিথিসিসের মধ্যে আসে এক চলচ্চিত্রগত সিন্থেসিস। তাঁর বামপন্থা কখনোই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। থাকার কথাও নয়। তাই গোরিনের সঙ্গে একত্রে তিনি ছবির মধ্যে মাওবাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করে যান। লা শিনোয়া অথবা ফার ফ্রম ভিয়েতনাম বা লেটার টু জেন কিংবা ব্রিটিশ সাউন্ড এই ধরনের ছবিগুলিতে কখনো একা বা কখনো দলবদ্ধভাবে দর্শককে রাজনীতি সচেতন করার জন্যেই তৈরি হয়। শেষের দিকে ফেয়ারওয়েল টু লাঙ্গুয়েজ ছবিতে তিনি মানুষে মানুষে সংযোগসূত্রের কথাই নিয়ে আসেন। দুই নারী-পুরুষ পাশাপাশি এক ঘরে থাকে। কিন্তু কেউ কারো কথা বোঝে না। তাদের মধ্যে রয়েছে এক কুকুর, সেই কুকুরের ভাষাই সেই ভাষা বুঝিয়ে দেয় একে অপরকে। তাই ছবির নাম বিদায় ভাষা Ñ ফেয়ারওয়েল টু লাঙ্গুয়েজ। গোদার এইরকমই। আজীবন বিতর্কিত। হয়তো আপাতভাবে দুর্বোধ্য। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই তাঁকে বিশ্বচলচ্চিত্রে। সন্দেহহীনভাবে এটা ঠিক যে, গোদারের ছবি দেখতে হলে দর্শকদেরও তৈরি হতে হয়। মানসিক পরিশ্রম করতে হয়। দুর্বোধ্য বলে একঘরে করে দেওয়া যায় না তাঁর ছবিকে। সিনেমা নিছক বিনোদন Ñ এই কথায় কখনোই বিশ্বাস করেননি গোদার। ছবিতে শুধু গল্প বলতে তিনি রাজি নন। পর্দায় একটা গল্প দেখতে যান দর্শক। বিনোদনই আসল। এসব কথা তাঁর কাছে অর্থহীন। গল্প থাকতে পারে ছবিতে, তিনি বলেন, কিন্তু তাকে যে আদি-মধ্য-অন্ত এই ক্রমেই থাকতে হবে, এমন নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, আলাদা করে সিনেমার সত্য বলে কিছু হয় না। ‘সিনেমা ইজ আ ট্রুথ টোয়েন্টি ফোর টাইমস ইন এ সেকেন্ড।’ এটাই সিনেমা-সত্য। এটাকেই কাজে লাগিয়ে তিনি সিনেমাকে অস্ত্র করে তোলেন। তাই উইক এন্ড ছবির টাইটেলে নিজের নাম লেখেন Ñ জঁ লুক সিনেমা গোদার।

তিন

ইউনেশিয়া। সাপোর্টেড সুইসাইড। আমরা যখন আপনার পরের ছবির আশায় অধীর আগ্রহে দিন গুনছি, তখন আপনি আত্মহননের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেন এই সিদ্ধান্ত আমরা জানি না। তবে এতো গোদারীয় পদক্ষেপ নয়। কথা রাখলেন না আপনি। আপনি বলেছিলেন, ‘যতদিন না সিনেমা আমাকে প্রত্যাখ্যান করে ততদিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যাব আমি।’ চলচ্চিত্র তো কখনোই প্রত্যাখ্যান করেনি আপনাকে। আপনি নিজেই একসময় তো চলচ্চিত্রের মৃত্যু ঘোষণা করেন। পর্দা জুড়ে লিখে বলেন, ‘সিনেমা ইজ ডেড।’ ২০৬ মিনিটব্যাপী সিনেমার ইতিহাস রচনা করলেন। হিস্ট্রি (স) দু সিনেমা।আবার ফিরে এলেন সিনেমায়। আপনার রচিত সিনেমার নবজন্ম হলো। সিনেমাকে ভালোবাসতেন গোদার। কিন্তু আবেগ দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে। গোদার বলেন, নারীকে চুমু খাওয়া যায়, সিনেমাকে নয়। তবু নারীর কাছে নয়, সিনেমার কাছেই আপনার প্রত্যাশা। যতদিন সিনেমা ফিরিয়ে দেয় আপনাকে ততদিন আপনি থেকে যাবেন চলচ্চিত্রের কাছে। সেই আপনার যৌবনের কাল। পাগলের মতো প্রেমে পড়েছিলেন গোদার আনা কারিনার। সেই আনার মুখচ্ছবি ঘিরেই তো গোদারের সেই সংলাপ, ‘হোয়েন য়ু ফটোগ্রাফড এ ফেস, য়ু ফটোগ্রাফড সোল বিহাইন্ড ইট।’ নারীর আত্মাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন আপনি। তাই আনার প্রেমপর্বের মধ্যে তৈরি হওয়ায় এ উইম্যান ইজ এ উইম্যান-এ খুব স্বাভাবিকভাবেই ছবির মধ্যে তাদের ভালোবাসার আত্মজৈবনিকতা চলে আসে। ১৯৬৬ সালে গোদার ও আনার প্রেম চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছে। এতটাই যে ম্যাস্কুলিন ফেমিনিন ছবিটি তাঁদের প্রেমের অর্থে হয়ে উঠল আত্মজৈবনিক। নায়ক পল ও নায়িকা মাদলেইন যেন বিকল্পভাবে গোদার-কারিনাই। পলকে আত্মহত্যা করতে হয়। হয়তো আনাকে হারিয়ে গোদারকেও সেই পথে যেতে হতো, কিন্তু গোদারকে বাঁচিয়ে দেয় তাঁর সিনেমাপ্রেম। তাঁর সঙ্গে যোগ হয় সমসাময়িক রাজনীতি। পাশাপাশি তাঁর জীবনে আসে আরেক নারী Ñ অ্যানেন উইয়াজেমস্কির। লা চিনয়েসের নায়িকা। গোদার-অ্যানেনের প্রেমপর্বের শুরু লা চিনয়েস ছবির শুটিংয়ের মধ্যেই। এই ছবির শুটিং শেষ হওয়ার পরেই অ্যানেনকে বিয়ে করেন গোদার। তার আগেই আনা কারিনা বিয়ে করেছেন অভিনেতা পিয়ের ফাবরিকে। তবে সেটাও বছর চারেকের জন্যে। এরপর আরো দুবার বিয়ে করেন তিনি। গোদার কিন্তু অ্যানেন উইয়াজেমস্কিরকেও ছেড়ে দেন। এরই মধ্যে গোদার কিন্তু তাঁর নানা ছবিতে নায়িকা করেন আনা কারিনাতে। প্রতিশ্রুতিমতো আনাও সেইসব ছবিতে অভিনয় করেন এবং সেই সব ছবিতেই বারবার ফিরে আসতে থাকে তাঁদের প্রেমের স্মৃতি। যেমন দ্য লিটল সোলজার, এ উইম্যান ইজ এ উইম্যান, মাই লাইভ টু লিভ, ব্যান্ড অব আউটসাইডার, আলফাভিল, পিয়ের লে ফু, মেড ইন ইউ এস এ, অ্যানেন্টিসিপেশন অফ লাভ ইন দ্য ইয়ার ২০০০। গোদারের সঙ্গে আনার শেষ ছবি এই অ্যানেন্টিসিপেশন অফ লাভ। ম্যাস্কুলিন ফেমিনিন গোদার ও আনার প্রেমের অমর সাক্ষী। আত্মজৈবনিকতায় ভরপুর। সেই ছবির নায়ক পলের যে স্বগতোক্তি : ‘আমি তোমার সঙ্গে বাঁচতে চাই। তুমি আজ রাতে আমার সঙ্গে কেন দেখা করছো না। নক্ষত্রের হচ্ছে ক্ষয়, মাদলেইন, এ যেন আমার হৃদয়ের ক্ষয়। এই শহরের মধ্যে ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছি আমি। মনে করো সেই স্মৃতি : তুমি উঠে আসছো সুইমিংপুল থেকে, প্রায় নিরাভরণ তোমার শরীর। নক্ষত্র ক্ষয়। আমি তোমার সঙ্গে বাঁচতে চাই। আমরা আবার একসঙ্গে যাব ক্যাসিনোতে। জুয়া খেলব স্লট মেশিনে। দেখো তোমার সামনে বিমানবন্দর, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে নাও। বুকে টেনে নাও আমাকে। আমরা এবার উড়ব।’ হ্যালো, কন্ট্রোল টাওয়ার, বোয়িং ৭৩৭ ডাকছে কারাভেলকে। পল ডাকছে মাদলেইনকে। তা যেন প্রেমিক গোদারেরই

কথা। যিনি নব্বই পেরিয়েও চিরপ্রেমিক। জানতে ইচ্ছে করে আত্মহননের শেষ মুহূর্তে কী ছিল আপনার শেষ কথা।