জনগণের বুদ্ধিজীবী’ জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

ভরসার বাতিঘর, জাতির বিবেক, পথপ্রদর্শক, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংরক্ষণে সদা সক্রিয় আমাদের প্রিয় আনিসুজ্জামান স্যার চিরবিদায় নিয়েছেন। তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে যে-শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা অপূরণীয়। বিশেষ করে এই করোনা-দুর্যোগের সময় তাঁর মতো প্রজ্ঞাবান জাতীয় ব্যক্তিত্বের অভাব খুবই অনুভূত হচ্ছে। স্যারের সঙ্গে আমার ছিল এক আত্মিক সম্পর্ক। আমার অভিভাবক। মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথিকৃৎ জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সকল অর্থেই একজন অনুকরণীয় শিক্ষক ছিলেন। জাতির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে তাঁকে দেখা গেছে সম্মুখসারিতে। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন এবং নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি সদা তৎপর ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে তিনি জাতিকে চিরকৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করে গেছেন।
স্বল্পভাষী, নিপাট ভালো মানুষ, নীতিতে অটল কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষক আনিসুজ্জামান স্যার বিশ্বখ্যাত একজন গবেষক ছিলেন। পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও জ্ঞানকেন্দ্রে তিনি অতিথি-গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। জ্ঞানচর্চার নামে পাশ্চাত্য-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে এদেশের বুদ্ধিজীবী-গবেষকদের পথ দেখিয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাই আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তাঁর ভূমিকা আমরা দেখেছি। ওইসময় তিনি কেবল বাংলাদেশ নয়, বরং উপনিবেশিত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা আফ্রিকা আর এশিয়ার দেশগুলোতে যাঁরা জ্ঞানচর্চা করেন তাঁদের ঔপনিবেশিকতার প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে নিজ দেশীয় বাস্তবতায় শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চায় উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এজন্য আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণে ভূষিত করেছে। দুবার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগদ্ধাত্রী’ পুরস্কার এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিটপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সৃষ্টিশীলতা ও মেধা বিশ্বজুড়েই স্বীকৃত। তাঁর অনুরাগী-অনুগামী গবেষকরাও বিশ্ববীক্ষার চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। আমি নিজেও গবেষণাকাজে তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি, এখনো পাচ্ছি। যতদিন গণবান্ধব গবেষণা করবো ততদিন আমার অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে তিনি থাকবেন।
শুরুতেই বলেছি, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তিনি রেখেছেন অসাধারণ ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর অবদানে ধন্য হয়েছে এদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে অবদান রেখেছেন নতুন দেশের মানবসম্পদ গঠনপ্রক্রিয়ায়। বাংলা একাডেমিতে তাঁর অবদান নতুন করে লেখা অদরকারি। বাংলাভাষা চর্চার সর্বজনীন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিতে বাংলা একাডেমিতে তাঁর কাজের কোনো তুলনা নেই – একথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। মুসলমান মানস ও বাংলা সাহিত্য, স্বরূপের সন্ধানে, আমার একাত্তর, বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে, কাল নিরবধি, বিপুলা পৃথিবীর মতো অসংখ্য কালজয়ী সাহিত্য ও সৃষ্টিশীল কর্মের জন্য তিনি চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের মাননীয় উপদেষ্টা, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন বহুমুখী এক বিরল প্রতিভা। শিল্প-সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
তবে সবার আগে তাঁর পরিচয় তিনি আমাদের শিক্ষক। এই শিক্ষকতার ক্ষেত্রেও তিনি নিজের সবটুকু শক্তি, সৃষ্টিশীলতা ও প্রতিভা বিনিয়োগ করেছেন উদার চিত্তে। তাই একজন অ্যাকাডেমিক হিসেবেও তিনি অনন্যদের কাতারেই থাকবেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে তিনিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রকৃত অর্থেই আধুনিক ও মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করার বিষয়ে তাঁর চিন্তা ও কর্ম আমাদের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমার মতো যারা ভাগ্যবান, তারা তো সরাসরিই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে অমূল্য নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সহকর্মীদের যেভাবে সময় দিয়েছেন তা শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং বিশ্বের যে-কোনো দেশের বুদ্ধিজীবী-শিক্ষকদের জন্য অনুকরণীয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন একজন আদর্শ বুদ্ধিজীবী। কথাসাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যথার্থই গ্রামসির ভাষায় আনিসুজ্জামানকে একজন ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। একজন শিক্ষক এবং একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি যেমন মানুষের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি মাঠের আন্দোলনেও সবসময় তরুণদের পাশে থেকেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা এদেশের কয়েক প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো জাতীয় ইস্যুগুলোই নয়, স্থানীয় ইস্যু যেগুলোর জাতীয় মানস গঠনে ভূমিকা রয়েছে, সেগুলোতেও তিনি সমান সরব থেকেছেন। এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে গত শতাব্দীর শেষ ভাগে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের নামকরণ নিয়ে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি অনশন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন ঢাকা থেকে গিয়ে। এসব আন্দোলনে লেখালেখির বাইরে গিয়ে মাঠের আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় তাঁকে হুমকিতে পড়তে হয়েছে, পুলিশ প্রহরায় থাকতে হয়েছে। তিনি পিছু হটেননি। পরিণত বয়সে এসেও এমন সাহসিকতা দেখিয়ে তিনি একদিকে তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছেন, অন্যদিকে বুদ্ধিজীবীদের ওপর দেশের আপামর জনসাধারণের আস্থা বাড়াতেও ভূমিকা রেখেছেন। নিজের রাজনৈতিক মতামতের প্রশ্নে আপস না করেও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে এবং ইতিহাস-চর্চায় নিরপেক্ষ থাকার ক্ষেত্রেও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বহু প্রশ্নে অনেক জাতীয় বুদ্ধিজীবী যখন দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারেননি, সেখানেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নিরপেক্ষ থেকে নির্মোহ বর্ণনা ও মূল্যায়ন হাজির করেছেন। এ-কারণেই রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের কাছেও তিনি সমাদৃত হয়েছেন, ভবিষ্যতেও হবেন।
আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক এবং জাতির বিবেক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের গুণগান করে শেষ করা যাবে না। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সামনাসামনি দেখা হয়েছিল কয়েক মাস আগে গত ফেব্রুয়ারিতে। ওইসময় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ওটাই সম্ভবত তাঁর সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারের বিষয় ছিল – ‘নান্দনিক বঙ্গবন্ধু’। জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে তাঁর জীবন ও কর্মের নান্দনিকতা নিয়ে গবেষণা করছি শুনে তিনি সোৎসাহে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং কীভাবে গবেষণাটি এগিয়ে নেওয়া যায় সে- বিষয়ে কিছু অমূল্য উপদেশও দিয়েছিলেন সেদিন। সাক্ষাৎকারটি পড়ে পাঠক বঙ্গবন্ধুর নান্দনিকতা নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মূল্যায়ন কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন। পাশাপাশি দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী হিসেবে, একজন ইতিহাসমনস্ক গবেষক হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নির্মোহ চিন্তাকাঠামো, ভাবনার গভীরতা, উদার চিন্তার প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং জনমানসের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার বিষয়েও একটা স্পষ্ট ধারণা পাবেন বলে আশা করছি।

আমার প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর যে-ব্যক্তিত্ব, তাঁর যে-চরিত্র, তাঁর যে সংস্কৃতিপ্রীতি, তাঁর কণ্ঠ, তাঁর দেহসৌষ্ঠব, শিল্প-সংস্কৃতিজনদের সঙ্গে তাঁর যে-সম্পর্ক, শিক্ষকদের প্রতি তাঁর যে-শ্রদ্ধা, একেবারে সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর যে-ভালোবাসা, রবীন্দ্রনাথকে তিনি যেভাবে ধারণ করেছেন, নজরুলকে যেভাবে ধারণ করেছেন সব মিলিয়েই একটা নান্দনিক চরিত্র বলে মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে। আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণ, মতামত সবমিলিয়ে এ-বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
অধ্যাপক আনিসুজ্জামন : বঙ্গবন্ধু যে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান ভালোবাসতেন, গুনগুন করতেন এবং তাঁর বক্তৃতার মধ্যে যে-ব্যবহার করতেন এই কথা আমরা সবাই জানি। আব্বাসউদ্দীনের গান শুনে তিনি বিশেষভাবে মোহিত হতেন। বলেছেন যে, ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বাতাস যখন বয়ে যায়, তখন ধানক্ষেতের যে-ছবি তিনি দেখেন তার সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের গানের সাযুজ্য তিনি দেখতে পান। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আরো একটু আছে সেটি হচ্ছে, অল্প বয়সে যখন তিনি দিল্লি-আগ্রা গিয়েছিলেন তখন বিশেষ করে সেখানকার স্থাপত্য দেখে, ভাস্কর্য অতটা নয়, তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তিনি কেন মুগ্ধ সেটারও একটা বর্ণনা আছে, তা থেকে বোঝা যায় যে মানুষটির মধ্যে একটি নান্দনিক বোধ ছিল। এই যে প্রাসাদ দেখছেন, সমাধি দেখছেন এগুলোর খালি ব্যবহারিক দিকটাই তাঁর চোখে পড়েনি, এর অন্তর্নিহিত যে-সৌন্দর্য সেটা তিনি দেখেছেন তাঁর তরুণ বয়সে।
পরবর্তীকালে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি তার যে-ভালোবাসা সেটা নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এলেন, তারপর নানা জায়গায় তিনি বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলতে থাকলেন। বাংলা একাডেমিতে গিয়ে তিনি বাংলা ভাষা প্রচলনের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়ার প্রসঙ্গে বললেন। আমি দু-একটা ঘটনার কথা বলি – ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান রচিত হয়। স্থির হলো যে, এ কে এম আব্দুর রউফ গোটা সংবিধান হাতে লিখবেন এবং তারপর সংসদ সদস্যগণ তাতে সই করবেন। বঙ্গবন্ধু শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন যে-কপিটায় সই করা হবে সেটায় অলংকরণ করে দেওয়ার জন্য। এটা আনমনেই এসেছিল। বঙ্গবন্ধু বলে দিলেন যে, বাঙালি সংস্কৃতির রূপ যেন এর পাতায় ফুটে ওঠে। জয়নুল আবেদিন সে-দায়িত্ব নিলেন, তাঁর সঙ্গে সমরজিৎ রায়চৌধুরী, হাশেম খান, আবুল বারক আলভী, জনাব আবুল ইসলাম প্রত্যেক পৃষ্ঠার চারদিকে অলংকরণ করলেন, এবং আবেদিন সাহেব বললেন যে, পুস্তানিটা হবে নকশিকাঁথার একটা ছবি, এবং সেটা হলো। সে-সময় আমার মনে আছে আবেদিন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বলছেন যে একটা লোক-সংস্কৃতি জাদুঘর করে দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন এবং এই আলোচনার ভিত্তিতে সোনারগাঁয়ে লোক-সংস্কৃতি জাদুঘর গড়ে উঠল। এটাও লোক-সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে-ভালোবাসা এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর যে-সার্বিক ভালোবাসা তার অংশ।
আমার প্রশ্ন : সংবিধান রচনার সঙ্গে আপনিও যুক্ত ছিলেন। সে-প্রসঙ্গে বলুন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : আমি লেখার ভাষাগত দিকটা দেখেছিলাম। অন্যদিকে দেখেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। তিনি যেভাবে ভাষার ব্যবহার করেছেন, তাঁর আঞ্চলিক-বাংলা মিশিয়ে বলার মধ্যেও আমি একটা নান্দনিকতা দেখি। প্রথমত, এটা তাঁর অন্তরের ভেতর থেকে আসছে; দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর মতো ভাষা। এবং যে-কথাগুলো বলছেন সেই কথাগুলো বলার পেছনে তাঁর যে-প্রত্যয় এটা খুবই নান্দনিক আমি বলব। কাজেই নানাভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুর নান্দনিকতা দেখি। এখন সারাজীবন তিনি রাজনীতি করেছেন, রাজনীতির মানুষ তিনি, কাজেই রাজনীতির পরিচয়ই তাঁর প্রধান পরিচয়। কিন্তু সেইসঙ্গে দেখা যায় যে, এই মানুষটি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি প্রবল ভালোবাসা পোষণ করেছেন। এবং তাঁর হৃদয়ের মধ্য থেকেই নান্দনিকতার এই অনুভূতিটা নানা সময় ফুটে ওঠে। এটাই চরিত্রের নান্দনিক বৈশিষ্ট্য বলে আমাদের গণ্য করতে হবে।
আমার প্রশ্ন : আমরা জানি যে, তিনি খুব উদারমনা, আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনেও তিনি খুব গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এবং সবাইকে নিয়ে কাজ করেছেন। যদি সেদিকে একটু আলোকপাত করেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : অসাম্প্রদায়িকতার কথা যদি আমরা বলি তাহলে প্রথম বলতে হবে যে, তিনি ১৯৪৭-এ যখন কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন তখন তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সোহরাওয়ার্দী বিদায়কালে বলেন – ‘যাও, দেখো পূর্ববাংলায় যেন দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হয়।’ তখন বঙ্গবন্ধু মনে করলেন যে, অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্র ছড়ানো তাঁর দায়িত্ব। সেটা আমরা কলকাতায় থাকাকালীন দাঙ্গার সময়েও তাঁর ভূমিকার কথা জানতে পারি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে। তো এইভাবেই তিনি কাজ আরম্ভ করেছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগ করতে চেয়েছিলেন ১৯৫৩ সালে। তখন মওলানা ভাসানী বলেছিলেন যে, এখন করো না, নির্বাচন হয়ে যাক, এখন করলে মুসলিম লীগ এটা নির্বাচনী প্রচারণায় আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। তো ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরে ১৯৫৫-তে গিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম আওয়ামী লীগ হলো। তার আগে মুসলিম ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ হয়েছিল। তারপরে প্রাদেশিক পরিষদে যে যুক্ত নির্বাচন প্রথার পক্ষে প্রস্তাব পাশ হলো সেখানেও বঙ্গবন্ধুর একটা ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান গণপরিষদে যখন সংবিধান পাশ হচ্ছে – দেশের নাম হবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র, তিনি আপত্তি করলেন। বললেন যে, এটা শুধু প্রজাতন্ত্রই হবে। এই যে নানানভাবে আমরা দেখছি তিনি অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছেন, সেটাকে গ্রহণ করছেন এবং হিন্দু-মুসলমান যাতে একসঙ্গে থাকেন তার চেষ্টা করছেন। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ১৯৬৪ সালে যখন দাঙ্গা লাগল তখন তিনি ট্রাকের ওপর চড়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়িয়েছেন, এবং সেখানে লেখা ছিল ‘পূর্ব বাংলা রুখে দাঁড়াও’। এ-সবই তাঁর নান্দনিক চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এবং তাঁর রাজনৈতিক কর্মের মধ্য দিয়ে এই যে সবাইকে টেনে আনার এই ব্যাপারটা দেখি, এই যে উচ্চ-নিম্ন নির্বিশেষে সবাইকে তিনি টানছেন, এটাকেও আমি বলব তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক বোধ এবং নান্দনিকতা।
আমার প্রশ্ন : আমরা তাঁর আত্মজীবনীতে ও রোজনামচাতেও দেখতে পাই যে, কারাগারের ভেতরে একেবারে সাধারণ যারা কয়েদি, লেদুর মতো কয়েদি অথবা কফিলুদ্দিন যে কি না একজন পাগল, তাদেরকে নিয়ে তাঁর যে পাতার পর পাতা লেখা, তাদের সম্পর্কে যে মানবিক অনুভূতি, এবং সেগুলো পরবর্তীতে সংবিধানেও (সাম্য) প্রতিফলিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার মূল্যায়ন কী?
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : সে তো আছেই। কিন্তু আমি বিশেষভাবে বলব কারাগারে থাকতে তিনি সামান্য জায়গায় বাগান করেছেন। এগুলো আমি বলব তাঁর নান্দনিকতার পরিচয়। এবং বলা হয় যে, তিনি সব মানুষের নেতা। এগুলো তিনি তাঁর জীবনে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। যাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে তার অধিকাংশের নাম তিনি মনে রাখতে পারতেন। এটি কিন্তু কম কথা নয়। মানুষকে তিনি সবসময় কাছে আসতে দিয়েছেন। তিনি যখন অসুস্থ ছিলেন, তাতেও লোকজনের আগমন বন্ধ হয়নি। এবং যে-ই এসেছে তার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি ১৯৭৪ সালের একসময় তাঁকে বলেছিলাম আপনার শরীর ভালো না, আপনি ঢাকার বাইরে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন। তিনি বললেন, ‘আমার কাছে তো লোক আসবে।’ তখন আমি বললাম, আসলে দেখা দেবেন না। তখন তিনি বললেন, ‘মানুষকে খেতে দিতে পারছি না, পরতে দিতে পারছি না, দেখাও যদি না করি তাহলে আমার আর কী থাকবে।’ এই যে তাঁর মানুষের সঙ্গে একাত্মতা এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল।
আমার প্রশ্ন : ১৯৭২ সালে তিনি ফিরে এলেন, দেশ পুনর্গঠনে হাত দিলেন। সেগুলো ছাড়াও লাখ লাখ মা-বোন যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন, পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের সময় তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে একটু বলবেন স্যার?
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : আমি জানি এঁদের সসম্মানে পুনর্বাসিত করতে খুব জোর দিয়েছিলেন। এবং কোনো পরিবার তাঁদের ফিরিয়ে নিতে না চাইলে তাঁদেরকে বলা যে, না নিতে হবে, তাঁদের পিতার নাম তিনি শেখ মুজিব লিখতে বলেছিলেন। এভাবে তিনি তাঁদের যোগ্য সম্মান দিতে চেয়েছেন।
আমার প্রশ্ন : আমি শুনেছি আপনাকে নাকি শিক্ষা সচিবেরও দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরকম একটা ভঙ্গুর দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে তিনি কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। এ-বিষয়ে জানতে চাই।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : যখন শিক্ষা কমিশনের কাজের উদ্বোধন হয় আমি জানতে চেয়েছিলাম বাজেটের কত অংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়। তখন তিনি আমাকে বললেন – ‘এগুলো নিয়ে চিন্তা করবেন না, আমি দরকার হলে ভিক্ষা করে টাকা নিয়ে আসব। কিন্তু আপনারা একটা ভালো শিক্ষানীতি দেন যাতে দেশ একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে।’ পরে অবশ্য আমরা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট দিতে দেরিও করলাম, তখন আবার দেশের দুর্ভিক্ষ অবস্থা। এটা আর আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ বা প্রয়োগ করার সময় হলো না। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন যে এমন একটা শিক্ষানীতি আমরা গ্রহণ করি, যাতে করে সকলেই শিক্ষার আওতায় আসে। এবং সকলেই একটা উপযুক্ত শিক্ষা পায় যা দিয়ে তারা স্ব-নিয়োজিত হয়েও খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। এই যে মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে হবে, শিক্ষা তার অবলম্বন হবে – এটা তাঁর চিন্তার মধ্যে ছিল।
আমার প্রশ্ন : তরুণ প্রজন্ম এই মুজিব বর্ষে বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে স্মরণ করতে পারে?
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : তরুণ প্রজন্ম যদি বঙ্গবন্ধুর ৭ মাচের্র বক্তৃতা শোনে ঠিকমতো তাহলেই তারা জানবে যে, বঙ্গবন্ধু কী ছিলেন, কেমন ছিলেন এবং এটি তাদের জানা দরকারও। তারপরে তাদের বোঝা দরকার যে, বঙ্গবন্ধু একটা দুঃসময়ে দেশের হাল ধরেছেন। মানুষের আকাঙ্ক্ষা তখন তুঙ্গে ছিল, তারা ভেবেছিল স্বাধীন হবার পরপরই তাদের সব আশা বোধহয় পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা তিনি পূরণ করতে পারেননি। সে-সময়কার কঠিন বাস্তবতায় সেটা সম্ভবও ছিল না। কিন্তু তিনি নানাভাবে এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠিত করেছিলেন। এবং আরো যে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এজন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতে হবে।

পুরো জাতি যখন করোনা আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত, ঠিক এমনই এক কঠিন সময়ে কেন আনিসুজ্জামান স্যারকে যেতে হলো এভাবে? এই প্রশ্ন বুকে চেপেই প্রত্যাশা করছি, করোনামুক্ত বাংলাদেশ হবে আরো আধুনিক, মানবিক, উদার গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়ভিত্তিক। যেমনটি তিনি সর্বদাই চাইতেন। আরো চাইতেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকে। কেবল তাঁর আদর্শের প্রতি অনুগত থেকেই আমরা পারি জাতির এই বিবেকের প্রতি প্রকৃত বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে। স্যারের আত্মা শান্তিতে ঘুমাক – সেই প্রার্থনা করছি।