জন্মদ্বিশতবর্ষে মাইকেল : তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপ

বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম অবিস্মরণীয়। তাঁর পরেও কোনো কোনো কবি বিদ্রোহ বা দ্রোহের কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে কবিমাত্রই অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহ ঘোষণা করেন। সে-বিচারে অধিকাংশ কবিই বিদ্রোহের কবি। এই বিদ্রোহ মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক। সাহিত্যিক বিদ্রোহ ভিন্ন বিষয়। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহের পথিকৃৎ মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

ব্যক্তিজীবনে ও শিল্পদর্শনে মাইকেল ছিলেন উল্টো হাওয়ার পন্থী। তাঁর মানসতাকে সহজেই ‘বিদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা ছিল বাংলার রেনেসাঁসের ভরকেন্দ্র। রামমোহন রায় ও ডিরোজিওর প্রভাবে হিন্দু কলেজের নব্যশিক্ষিত তরুণদল তখন বিদ্রোহের ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সমাজ-সংসারের প্রচলিত ধ্যানধারণা। ডিরোজিওকে শিক্ষক হিসেবে না পেলেও হিন্দু কলেজের ছাত্র হিসেবে তাঁর আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন মাইকেল। তখন হিন্দু কলেজ শিক্ষা বিস্তারে সারাদেশে খ্যাতির শীর্ষে ছিল। মাইকেলের জীবনী লেখক যোগীন্দ্রনাথ বসুর ভাষায় –

মধুসূদন যে সময়ে হিন্দু কলেজে প্রবেশ করিলেন, তখন ইহার পূর্ণ যৌবনাবস্থা। ছাত্রদিগের ও শিক্ষকগণের গৌরবে হিন্দু কলেজ তখন বঙ্গদেশের বিদ্যালয়সমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছিল।

এমন একটি বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন মাইকেল। সহপাঠী হিসেবে এ-কলেজে তিনি পেয়েছিলেন রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, গৌরদাস বসাক ও রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতো কৃতী ছাত্রদের। মধুসূদন সম্পর্কে গৌরদাসের অভিব্যক্তি ছিল – ÔModhu was a genius.Õ কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন। তাঁর লেখা কবিতা Bengal Spectator, Calcutta Literary Gazette, জ্ঞানান্বেষণ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।

ছাত্রজীবন থেকেই মাইকেল উচ্চাভিলাষী ছিলেন। শেক্সপিয়র, মিল্টনের দেশ ইংল্যান্ডে গেলে যে তিনি বড় কবি হতে পারবেন – এ-বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না। বন্ধু গৌরদাস বসাক তাঁর জীবনী লিখবেন এমন একটি আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল। সেই সূত্রে একটি চিঠিতে তিনি গৌরদাসকে লিখেছিলেন –

How should I like to see u writing my life if I

happen to be a great poet Ñ which I am almost

sure I shall be if I can go to England.

রেনেসাঁসের মূল প্রবণতা মানবমুখিনতা। কোনো অলৌকিক বা দৈবশক্তি নয়, মানুষ নিজেই তার ভাগ্যের নিয়ন্তা – এই দর্শন ছিল ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রাণভোমরা। এই দর্শনকেই রেনেসাঁসের শিল্পী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন মাইকেল। তিনি নাটক ও কাব্য রচনা করেছিলেন ধর্মীয় ও পৌরাণিক বিষয়বস্তু নিয়ে। জীবনের শেষ পর্বে কিছু নীতিকবিতা ও সনেট বাদ দিলে তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মের উৎস ছিল ধর্ম, পুরাণ ও ইতিহাস। এসব সৃষ্টিকর্মে তিনি দেবতাদের জয়গান করেননি, বরং গৌরবান্বিত করেছেন মানুষকে। দেবতাদের বদলে অসুরদের প্রতি ছিল তাঁর সহানুভূতি। পরাজিত অসুরদের বীরত্বের প্রশংসা করেছেন তিনি। মানুষকে তিনি বিবেচনা করেছেন অসুরের সারিতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, উদারনৈতিকতা, যুক্তিবাদ, ইহজাগতিকতা – রেনেসাঁসের এ-বৈশিষ্ট্যগুলিকে মাইকেল ধারণ করেছিলেন। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহের প্রথম ধ্বজাধারী।

রেনেসাঁসের মূল্যবোধে লালিত বিদ্রোহী মাইকেলের কাছে দেবদেবীদের অলৌকিক শক্তির কাছে অসুরের তথা মানুষের পরাজয়কে ন্যায্য মনে হয়নি। তাই দেবতাদের গৌরবগাথাসমৃদ্ধ পৌরাণিক কাহিনির নতুন ভাষ্য রচনা করেছিলেন তিনি। এই ভাষ্য রচনার জন্য মাইকেলকে কাব্যের নতুন রূপ আবিষ্কার করতে হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যে ‘মহাকাব্য’ নামে পরিচিত। তাঁকে নতুন করে ভাষা ও ছন্দ আবিষ্কার করতে হয়েছে। তিনি জানতেন, মহাকাব্যের বিশাল পটভূমিতেই মানবজীবনের উদাত্ত মহিমা পরিস্ফুট করা সম্ভব। নতুন ছন্দে পয়ারের শৃঙ্খল মোচন ও অমিত্রাক্ষরের প্রবহমানতার ফলে রাবণের জীবনকাহিনি ও জীবনভাগ্য রূপায়িত করা সম্ভব হয়েছে। এই ছন্দ যেন অনিবার্য ছিল মেঘনাদবধ কাব্যর আবির্ভাবের জন্য। তিনি আগে ছন্দ আবিষ্কার করেছেন, পরে মহাকাব্য রচনা করেছেন।

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন মেঘনাদবধ কাব্য। মাইকেল ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরও পৌরাণিক রাবণ ও মেঘনাদকে নতুন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের বিপরীতে রামায়ণকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপস্থাপন করেছিলেন মাইকেল। এই দৃষ্টিভঙ্গি অলৌকিক ও দৈবভাবনা থেকে মুক্ত। পৌরাণিক আবরণ ভেদ করে রামায়ণের চরিত্রসমূহকে ইহলৌকিক ভূমিতে সংস্থাপন করেছেন মাইকেল। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা এখানে দেবদেবী নন, রাবণ ও মেঘনাদ রাক্ষস নন। রাম, লক্ষ্মণ পররাজ্য আক্রমণকারী। রাবণ ও মেঘনাদ দেশরক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। রাবণের দেশপ্রেম পরাধীন দেশের বাসিন্দা মাইকেলকে মুগ্ধ করেছিল। মাইকেলের প্রথাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি মেঘনাদবধের অন্যতম বিশেষত্ব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে নয়, এর আঙ্গিক ও ভাবের মধ্যেও পালাবদলের সুর লক্ষণীয়। এই পরিবর্তন মাইকেলের বিদ্রোহী সত্তারই পরিচায়ক। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন –

মেঘনাদবধ কাব্যে, কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনাপ্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃতি নহে। ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে। কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙ্গিয়াছেন এবং রাম-রাবণের সম্বন্ধে অনেক দিন হইতে আমাদের  মনে যে একটা বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহারও শাসন ভাঙ্গিয়াছেন।

বাংলা সাহিত্যে অন্তত তিনটি কাব্য প্রকরণ প্রবর্তন করেছিলেন মাইকেল – মহাকাব্য, সনেট ও মনোনাট্য। তাঁর পূর্ববর্তী আটশো বছরে কাহিনিকাব্য ছিল। কিন্তু আদি-মধ্য-অন্তসংবলিত, সুবিন্যস্ত, ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তি ও কালচিহ্নিত বহুমাত্রিক কাব্য ছিল না। এই শূন্যতা মাইকেল পূরণ করলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘মধুসূদন আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রথম দ্বার উন্মোচনকারী।’ বিংশ শতাব্দীতে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মন্তব্য করেছিলেন যে, বিশ্বের আদিম উর্বরতা আর নেই। সারাবিশ্ব ভ্রমণ করে কবিতার বীজ সংগ্রহ না করলে কাব্যের কল্পতরু জন্মানোর সম্ভাবনা নেই। এই উপলব্ধি মাইকেলের হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতেই। তিনি কবিতার বীজ সংগ্রহ করেছিলেন পশ্চিমা বিশ্ব থেকে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে বাংলা কবিতার গতিপথ তিনি বদলে দিয়েছিলেন। শুধু বাংলা কবিতার নয়, নাটকেরও। তিনিই সূচনা করেন প্রকৃত নাটকের ট্র্যাজেডি, কমেডি ও প্রহসন। অতুলনীয় প্রতিভার বলে সৃষ্টি করেছিলেন কবিতার নতুন ভাষা ও ছন্দ, লিখেছেন অভূতপূর্ব পত্রকাব্য, পদাবলি ও চতুর্দশপদী। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে তিনি মহাকাব্য ও অমিত্রাক্ষর সৃষ্টির পূর্বাভাস জ্ঞাপন করেছিলেন। ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য ও চতুদর্শপদ কবিতাসমূহ তাঁর অসামান্য নিরীক্ষার সফল পরিণতি। নিরীক্ষাপ্রবণতা ও সাধনার ধারাবাহিকতা তাঁকে শিল্পসাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল।

মাইকেলের শ্রেষ্ঠ কীর্তি নিঃসন্দেহে অমিত্রাক্ষর। এই ছন্দ তিনি আকস্মিকভাবে রচনা করেননি। ধাপে ধাপে তিনি অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বাংলাগ্রন্থ শর্মিষ্ঠা নাটক। বেলগাছিয়ায় মঞ্চস্থ করার জন্য রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী নাটকটি অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় মাইকেলকে। এই কাজটি করতে গিয়ে বাংলা নাটকের দুর্দশা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন – ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে/ মজে লোক রাঢ়বঙ্গে/ নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।’ তিনি শুধু তৎকালীন বাংলা নাটকের রুচিহীনতা ও স্থূলতার নিন্দা করেননি, লিখে ফেলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম  নাটক শর্মিষ্ঠা। এই নাটকের একটি সংলাপের অংশ লক্ষ করা যাক –

সুলোচনা মৃগী ভ্রমে নির্জন কাননে;

গজমুক্তা শোভে গুপ্ত মুক্তির সদনে;

হীরকের ছটা বন্ধ খনির ভিতর;

সদা ঘনাচ্ছন্ন হয় পূর্ণ শশধর;

পদ্মের মৃণাল থাকে সলিলে ডুবিয়া;

হায় বিধি, এ কুবিধি কিসের লাগিয়া?

এই পঙ্ক্তিগুলিতে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তিনি অন্ত্যমিল প্রয়োগ করেছেন। প্রাক্তন পয়ারের রীতি অনুযায়ী প্রতি পঙ্ক্তিতে আট-ছয়ের মাত্রাবিন্যাসও ঘটিয়েছেন। অন্ত্যমিল বর্জনের মাধ্যমে এই রীতি তিনি ভেঙে ফেললেন পরবর্তী নাটক পদ্মাবতীতে –

আহা! শৈলেন্দ্রের গলে শোভে যে রতন –

সে অমূল ধন কভু সহজে কি তিনি

প্রদান করেন পরে? গজরাজশিরে

ফলে যে মুকুতারাজি, যদি না বিদরে আগে

সে শিরেঃ সকলে জানে, সুরাসুর মিলি

মথিয়া কত যতনে সাগর, লভিলা

অমৃত – কত পীড়নে পীড়ি জলনিধি!

উদ্ধৃতাংশের ‘মথিয়া কত যতনে’ কিংবা, ‘অমৃত – কত পীড়নে’ অক্ষরবৃত্তের পর্বে তিন-দুই-তিন-এর অভূতপূর্ব মাত্রাবিন্যাস মাইকেলের বিদ্রোহী মনের পরিচায়ক। অমিত্রাক্ষর ছন্দের সাহসী ব্যবহার করলেন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে –

ধবল নামেতে গিরি হিমাদ্রির শিরে

অভ্রভেদী, দেব-আত্মা, ভীষণ-দর্শন;

সতত ধবলাকৃতি, অচল, অটল;

যেন ঊর্ধ্ববাহু সদা, শুভ্র-বেশধারী,

নিমগ্ন তপঃ সাগরে ব্যোমকেশ শূলী –

যোগীকুলধ্যেয় যোগী।

তখনো মাইকেলের সাধনা সমাপ্ত হয়নি। আরাধ্য ছন্দের সম্ভাবনায় সেই মুহূর্তেও তিনি চঞ্চল। কাক্সিক্ষত ছন্দের অতুলনীয় সাফল্য দেখা দিলো মেঘনাদবধ কাব্যে –

সম্মুখ সমরে পড়ি, বীরচূড়ামণি

বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে

অকালে, কহ, হে দেবী অমৃতভাষিণী,

কোন বীরবরে বরি সেনাপতি পদে

পাঠাইলা রনে পুনঃ রক্ষকুলনিধি

রাঘবারি?

বিদ্রোহী মাইকেল স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেননি। ক্ষেত্রবিশেষে কবিতায় ও বিখ্যাত দুটি প্রহসনে তিনি এই ছন্দ ব্যবহার করেছেন। একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ বাংলা সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদান। প্রথম প্রহসনে তিনি নব্যশিক্ষিত তরুণদের

উচ্ছৃঙ্খলতা ও বাবুবিলাসী ধনিকশ্রেণির অন্তঃসারশূন্যতার পরিচয় উদ্ঘাটন করেছেন। দ্বিতীয়টিতে ধর্মের লেবাসে আবৃত এক কপট সাধুর ভণ্ডামি ও লাম্পট্যের স্বরূপ অনাবৃত করেছেন। মাইকেলের পরিশীলিত আধুনিক মানস ও তীব্র রসবোধের পরিচয় মেলে প্রহসন দুটিতে। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের অসামান্য ব্যবহার দেখা যায় এখানে –

এখন কি আর নাগর, তোমার

      আমার প্রতি তেমন আছে।

নূতন পেয়ে পুরাতনে

      তোমার সে যতন গিয়েছে ॥

তখনকার ভাব থাকতো যদি,

       তোমায় পেতেম, নিরবধি

এখন, ওহে গুণনিধি

       আমার বিধি বাম হয়েছে ॥

যা হবার আমার হবে,

       তুমি তো হে সুখে রবে,

বলো দেখি শুনি তবে,

      কোন নতুনে মন মজেছো ॥১

[একেই কি বলে সভ্যতা]

বাইরে ছিল সাধুর আকার

       মনটা কিন্তু ধর্ম্ম ধোয়া।

পুণ্য খাতার জমা শূন্য,

       ভণ্ডামিতে চারটি পোয়া ॥

শিক্ষা দিলে কিলের চোটে,

      হাড় গুঁড়িয়ে খোয়ের মোয়া।

যেমন কর্ম্ম ফললো ধর্ম্ম,

     বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁয়া ॥

[বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ]

শুধু কবিতায় নয়, নাটকেও মাইকেল নবরীতির প্রবর্তক। শর্মিষ্ঠার সাফল্য তাঁকে পদ্মাবতী লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর চেতনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অসাধারণ সমন্বয় ঘটেছিল। মহাকাব্য মেঘনাদবধ লিখেছিলেন গ্রিক মহাকবি হোমারের ইলিয়ডের আদর্শে। পদ্মাবতী নাটকের প্লট নিয়েছেন গ্রিক পুরাণ থেকে, পাত্রপাত্রী নির্বাচন করেছেন ভারতীয় পুরাণ থেকে। তাঁর পরবর্তী ও শ্রেষ্ঠ নাটক কৃষ্ণকুমারী। এটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ট্র্যাজেডি। এর প্লট তিনি নিয়েছিলেন টডের অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অব রাজস্থান থেকে। এ-নাটকে তিনি গ্রিক নিয়তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ও ট্র্যাজেডির হাহাকারকে জীবন্ত করে তুলেছেন।

রেনেসাঁস-শিল্পী মাইকেলের চেতনায় পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকারদের সৃষ্টিকর্ম অন্তহীন প্রেরণা সঞ্চার করেছে। ইতালীয় রেনেসাঁসের অনুঘটক ও কবি পেত্রার্কের অনুসরণে সনেট রচনা করেছেন। দান্তের ছয়শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সনেট লিখেছেন। এটি তাঁর মননের আন্তর্জাতিকতার পরিচায়ক। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম বৈশ্বিক দৃষ্টিসম্পন্ন লেখক। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চারজন ট্র্যাজেডি রচয়িতা হলেন ইস্কিলাস, সফোক্লিস, য়ুরিপিদিস ও শেক্সপিয়র। এই চারজন লেখক তাঁদের ট্র্যাজেডিতে প্রচুর হাস্যরসের উদাহরণ দিয়েছেন। কৃষ্ণকুমারী নাটকে মাইকেলও তাই করেছেন। হাস্যরস সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ধনদাস চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন। উল্লিখিত চারজন শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি রচয়িতার মতো তিনি ট্র্যাজেডিতে কৌতুকরস সঞ্চার করেছেন।

মায়াকানন নাটকটি মাইকেলের শেষ রচনা। লক্ষণীয় যে, নাটকের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে, আবার নাটকের মধ্য দিয়েই সে-জীবনের অবসান ঘটে। মায়াকানন নাটকের কাহিনিতে গ্রিক পুরাণের প্রভাব থাকলেও এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন রাজবংশের পরিচয়। নাটকের বিভিন্ন অংশে কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তলম নাটকের প্রভাব দৃশ্যমান। মাইকেল খ্রিষ্টধর্মকে ভালোবেসে খ্রিষ্টান হননি, পাশ্চাত্য সাহিত্যকে ভালোবেসে খ্রিষ্টান হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য রীতি ও ভারতীয় ঐতিহ্যের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল তাঁর সাহিত্যে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উপাদানের সমীভবন তাঁর সাহিত্যেই প্রথম ঘটেছে।

রেনেসাঁসের চেতনাসমৃদ্ধ মাইকেলের উজ্জ্বল দুই পূর্বসূরি ছিলেন রামমোহন ও বিদ্যাসাগর। রামমোহননের কাছে যা ছিল জ্ঞানচর্চার বিষয়, বিদ্যাসাগরের কাছে সেটিই ছিল কর্মযোগ এবং একেই মাইকেল তাঁর সাহিত্যের উপজীব্যরূপে গ্রহণ করেন। নারীর প্রতি বৈষম্যহীন, মানবিক ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি রেনেসাঁসের দান। এই চেতনার বলেই সতীদাহ নামক অমানবিক প্রথা থেকে বিপন্ন নারীকে মুক্ত করেন রামমোহন রায়। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে জীবন্মৃত দশা থেকে নারীকে উদ্ধার করেন বিদ্যাসাগর। তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সাহিত্যে নারীকে যথার্থ মানুষের মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন মাইকেল। মেঘনাদবধ কাব্যের প্রমীলা বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক নারী – তেজস্বিনী ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। এই চরিত্র রূপায়ণের মধ্য দিয়ে নারীর মুক্তির স্পৃহা ঘোষিত হয়েছে। নারীর স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা প্রথমবারের মতো ফুটে উঠেছে এখানে। মেঘনাদের প্রতি তার প্রেম দুর্নিবার। এই প্রেমের আকর্ষণে সে বীরাঙ্গনা মূর্তি ধারণ করেছে এবং মৃত্যুতেও মেঘনাদকে অনুসরণ করতে চেয়েছে। এই মহাকাব্যের অপর প্রধান নারীচরিত্র সীতা। মাইকেল পৌরাণিক রাম ও  রাবণকে আমূল রূপান্তরিত করেছেন তাঁর কাব্যে। কিন্তু সীতার কোনো রূপান্তর তিনি ঘটাননি। বন্দিনী সীতা দুঃখিনী বাঙালি নারী। মাইকেল সীতাকে চিরন্তন জনমদুঃখিনী নারীরূপেই উপস্থাপন করেছেন। মাইকেলের সংবেদনশীল হৃদয়ের স্পর্শে সীতা চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধ কাব্যের প্রধান দুই নারী চরিত্র – প্রমীলা ও সীতা আধুনিকা ও শাশ্বতী নারীর অবিস্মরণীয় প্রতীক। এছাড়াও তিনি অন্য যেসব নারী চরিত্র নির্মাণ করেছেন তারা প্রত্যেকেই পৌরাণিক আবরণ ছিন্ন করে রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ হয়ে উঠেছেন। প্রেমে, বিরহে, কামে, প্রতিহিংসায়, ভয়ে প্রত্যেকেই উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে। মাইকেলের এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর প্রথাবিরোধী বিদ্রোহী মানসের পরিচায়ক।

সারস্বত সাধনার অনন্যতায় মাইকেল বিশ্বনাগরিকের মনন অর্জন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা স্মরণ করে বঙ্কিমচন্দ্র যে মূল্যায়ন করেছেন তা শিরোধার্য –

আজি বঙ্গভূমির উন্নতি সম্বন্ধে আর আমরা সংশয় করি না – এই ভূমণ্ডলে বাঙ্গালী জাতির গৌরব হইবে। কেননা বঙ্গদেশ রোদন করিতে শিখিয়াছে – অকপটে বাঙ্গালী, বাঙ্গালী কবির জন্য রোদন করিতেছে। যে দেশে একজন সুকবি জন্মে, সে দেশের সৌভাগ্য। যে দেশে সুকবি যশঃপ্রাপ্ত হয়, সে দেশের আরও সৌভাগ্য। … যে দেশের শ্রেষ্ঠ কবি যশস্বী হইয়া জীবন সমাপন করেন, সে দেশ প্রকৃত উন্নতির পথে দাঁড়াইয়াছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে যশস্বী হইয়া মরিয়াছেন, ইহাতে বোঝা যায় যে, বাঙ্গালা দেশ উন্নতির পথে দাঁড়াইয়াছে।

যদি কোনো আধুনিক ঐশ্বর্য-গর্বিত ইউরোপীয় আমাদিগের জিজ্ঞাসা করেন, তোমাদের আবার ভরসা কি? বাঙালির মধ্যে মনুষ্য জন্মিয়াছে কে? আমরা বলিব ধর্ম্মোপদেশকদের মধ্যে শ্রীচৈতন্যদেব, দার্শনিকদের মধ্যে রঘুনাথ, কবির মধ্যে শ্রীজয়দেব ও শ্রীমধুসূদন। …

ভিন্ন ভিন্ন দেশে জাতীয় উন্নতির ভিন্ন ভিন্ন সোপান। বিদ্যালোচনার কারণেই প্রাচীন ভারত উন্নত হইয়াছিল, সেই পথে আবার চল, আবার উন্নত হইবে। কালপ্রসন্ন-ইউরোপ সহায় – সুপবন বহিতেছে দেখিয়া, জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও – তা হাতে নাম লেখ ‘শ্রীমধুসূদন’।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধীর, অলস ও একমাত্রিক জীবনযাত্রার তাল-ছন্দ ভেঙে মাইকেল বৈপ্লবিক কর্ম সাধন করেন। মধ্যযুগের সতত আত্মসমর্পণমুখী যুক্তিহীন ভক্তিসর্বস্ব অন্ধকার জগৎ থেকে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন মানবাত্মাকে। মানবমনে প্রতিষ্ঠা করেছেন জীবন উপভোগের স্পৃহা। সামান্য তৃপ্ত বাঙালির হৃদয়ে তিনি অন্তহীন অনুসন্ধিৎসা জাগ্রত করেছিলেন। সাহিত্যের বাঁকবদল করে একে জীবন ও জগৎমুখী করে তুলেছিলেন।

কৈশোরে একটি ইংরেজি সনেটের মুখবন্ধে মাইকেল লিখেছিলেন, ÔI am an enemy to what men call custom.Õ

প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে দ্রোহ যে-কোনো শিল্পীর ধর্ম। মাইকেল এই দ্রোহের জ¦লন্ত প্রতীক। বিদ্রোহ করতে গিয়ে তিনি স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেননি। তিনি স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করেছিলেন। এর পেছনে ছিল তাঁর অতুলনীয় প্রতিভা ও শ্রমনিষ্ঠা। তাঁকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয়েছে, মানতে হয়েছে শিল্পের নিয়ম, ছন্দের অনুশাসন ও শব্দের শিক্ষা। ব্যক্তি মাইকেলের জীবন উচ্ছৃঙ্খল হলেও শিল্পী মাইকেল ছিলেন শৃঙ্খলা ও নিষ্ঠার অসামান্য প্রতীক। এটিই তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপ।