এই অঞ্চল থেকে সর্বশেষ পুরুষমানুষটাও বিদায় হইছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। এই সাড়ে তিন বছর সময়টা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে; দীর্ঘ হচ্ছে প্রতীক্ষা। জয়তুন বেগমের মাঝে মাঝে নাভিতে একটা মোচড় মারে, একটা কম্পন শুরু হয় বুকে, জগৎটাই আবার পুরুষশূন্য হইয়া গেল না তো! ১৩ বছর বয়সী নাতনি দাদিরে জিগায়, ‘পুরুষ মানুষ কী কামে লাগে?’ জয়তুন বেগমের মনেও ইদানীং এ-প্রশ্ন ধরা দেয় – এই জীবনটাইবা কী কামে লাগে? তারপরও এই সমুদ্রের সাদা বালু আর নীলজলের পাশে এসে প্রতিদিন বসে থাকে দাদি আর নাতনি। কেউ একদিন আসবে পুরুষের নাহান, বয়ে আনবে বীজ, না হয় এই অঞ্চলটাই মরুভূমি হয়ে যাবে; এই ক্ষেত নিষ্ফলা হয়ে যাবে। এই বিরান তীরে আর কতদিন এই অপেক্ষা চলবে? এর উত্তর জয়তুনের জানা নেই। কেউ জানে – এই বিশ^াস নিয়ে জয়তুন এখন আর দিন গুজরায় না।
প্রতিদিন কাঁচা দুপুরে দুই মাইল পথ হেঁটে দাদি আর নাতনি এসে বসে সমুদ্রের কিনারে, চেয়ে থাকে দূরে, কোনো এক অলৌকিক জাহাজের জন্যে। ওই জাহাজে আসবে কোনো পুরুষ, কিংবা পুরুষের মতো কিছু। দাদির এই তৃষ্ণা, অপেক্ষা কিছুদিন যাবত নাতনিও কিছুটা টের পায়। দাদিকে নাতনি জিজ্ঞেস করে, ‘ওই জাহাজ কোথা থেকে আসে, আবার কোথায় চলে যায়? ওই পুরুষ কেমনে নামবে এখানে? সে কি ঝাঁপ দিবে? সে কোন ভাষায় কথা কইবো আমাগো লগে? হেয় কি আমাগো ভাষা বুঝবো?’ দাদি বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে, ‘জগতে এহন খালি একটাই ভাষা – এই মরার জীবন আর নিদারুণ প্রতীক্ষা।’ এইসব নানান প্রশ্ন জিগায় আর হাঁটুজলে নামে কিশোরী, আরো গভীরে ভিজতে ইচ্ছে হয় তার। কোমর অবধি ডুবায় নীলজলে, কেমন যেন জলের একটা স্পর্শ ঝিলিক তোলে তার শরীরে, হৃৎপিণ্ডে; দু-হাতে জড়িয়ে ধরে এ বিশাল জলধারা; মনে হয় এই জলরাশিই সেই ভিনদেশি পুরুষ।
এই ভেজা শরীরটা ইদানীং অচেনা লাগে নাতনির। ওই নীলজলের ওপর লীলা করতে করতে একটা দুষ্টু ভিনদেশি বাতাস এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কেমন যেন ঘোরে ফেলে আর আস্তে আস্তে ফুলিয়ে তোলে তার বুকের জমিন। ওই ভেজা শরীর নিয়ে বালুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরে দাদি আর নাতনি। নাতনি জিগায়, ‘দাদি আইজ-কাইল কেমন জানি পুরুষ মানুষের ঘ্রাণটা মনে হয় আমার নাকেও একটু একটু লাগে। তয় এই ঘ্রাণটা বাপজানের শরীরের মতন না – অনেকটাই অচেনা। সব পুরুষ মানুষের শরীরের ভাষা মনে হয় এক হয় না দাদি?’ দাদির মনেও একটা উদাস ভাবের উদয় হয়, কিছুক্ষণ চুপ থাকে আর বলে, ‘সময় পাল্টায় আর শরীরের ঘ্রাণও প্রকৃতির নাহান, সমুদ্রের ঢেউয়ের নাহান, ওই দূরের সূর্যটার নাহান খালি পাল্টায়। সব প্রতিমুহূর্তে পাল্টায়। মরার এই অপেক্ষার খালি কোনো বিহিত হয় না।’
এ যেন জেঁকে বসে আছে এই তীরে পাথরের মতো।
জয়তুন বেগমের মনে পড়ে তার স্বামীর মুখটা, তার শরীরের ঘ্রাণটাও এসে লাগে নাকে। এখনো কি তাজা সেই অনুভূতিগুলি! দুই যুগেরও বেশি সেই যে যুদ্ধে গেল, আর ফিরলো না। মানুষগুলান ক্যান যে যুদ্ধে যায় আর ক্যানবা যুদ্ধ বাধায়? এই প্রশ্ন কার কাছে গিয়া যে জিগাইবে তাও বুঝতে পারে না জয়তুন। মুহূর্তেই আবার মনে হয়, এই যুদ্ধটাই মনে হয় হেগো নেশা। মানুষটার ছিল ঝড়ের মতন তেজ, শক্ত বাহুর মধ্যে জয়তুনের শরীরটা যখন জাপটে ধরত মনে হইত দুমড়াইয়া-মুচড়াইয়া একেবারে দলা পাকাইয়া ফেলবে, আবার সেই মানুষটার মনটা আছিল নারিকেলের শাঁসের নাহান নরম। সেই যে একদিন শত্রুরে বিনাশ করতে গেল আর ফিরলো না। এর আগে হের বাপ, হেরও আগে হের বাপ শত্রুর সঙ্গে খালি লড়াই আর রক্তপাত করল। জয়তুন বেগমের জানা হইল না হেই শত্রুর আসল চেহারাটা কেমন? সেই শত্রু আসলে কারা?
বহুদিন পর মানুষটা ঘরে ফিরত, নানান গল্প করত। একবার হাসতে হাসতে বলেছিল, ওদের পুরুষদণ্ডে একটা চিহ্ন থাকে, জয়তুন বেগম লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারেনি এর কারণ। কিন্তু সেই তরুণীমনে জানার আকাক্সক্ষাটা ছিল তাজা। মুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে চোখে ক্রোধ জমা হয়ে গেল। সেই ক্রোধই মানুষটারে নিয়ে গেল সমুদ্রের ওপারে। সেই জয়তুনের গত দুই যুগে লাজ-লজ্জা, অনুভূতি, জিজ্ঞাসা অনেক কমে গেছে। এখন শুধু আছে তার নীলজলের পাশে নিরন্তর অপেক্ষা আর কিশোরী নাতনি। পুরুষের শরীর আর এর ঘ্রাণটা এখনো একটু একটু তার মনে পড়ে। শরীরটায় পুবের ছোট নালাটার মতো একটা শুকনা ভাব এলেও মাঝে মাঝে চিনচিনে একটা অনুভূতি দেখা দেয় ভরা পূর্ণিমায়। তপ্ত বালুর ওপর হাঁটতে হাঁটতে জয়তুনের মনে পড়ে সর্বশেষ পুরুষ মানুষের কথা; তার বুক, চোয়াল, চিবুক, শক্ত বাহু আর সেই চেনা শরীরী ভাষা। মুখটা প্রায় ভুলতে বসেছে। আজকাল ধূসর হয়ে উঠছে পুরুষের স্মৃতি।
এই এলাকাটায় কয়েকটা ঘর অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে পূর্ব প্রান্তে কোনোভাবে টিকে আছে। এই মানুষগুলি অনেক জায়গা থেকে উচ্ছেদ হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে। এই যে এখানে একটু দীর্ঘ সময় তারা টিকে রইল তার পেছনে রয়েছে পানির কুয়াটা। কুয়াটার পাশ ঘেঁষে কয়েকটা ঘর আর জয়তুনের ঘরটা আরো একটু পুবে। আশেপাশের বসতি কয়েক মাইল দূরে, ফলে জীবনের যে সাধারণ প্রবাহ তা থেকে বেশ দূরে তারা দীর্ঘদিন। জয়তুনের পৃথিবী শুধু এই কয়েক মাইল, বাকিটা তার শোনা; কিন্তু নাতনির পৃথিবী পুরোটাই কল্পনা। এই কল্পনাগুলি প্রতিদিন শুধু জাল বুনছে; আর ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের তীরে।
সূর্য অনেকটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে, ছায়ারা দীর্ঘ ও ক্লান্ত হচ্ছে। এই ক্লান্ত-শ্রান্ত জীবনকেই বয়ে নেবে জয়তুন আরো কিছুদিন। দাদি আর নাতনি অনেক ব্যর্থ দিনের মতো আরো একটা ব্যর্থ দিন শেষ করে ফিরেছে ঘরে। জয়তুনের মেয়ে আর পুত্রবধূ আরো একবার তাদের পুরুষশূন্য ঘরে ফেরা দেখল বেড়ার ফাঁক দিয়ে। দুই মধ্যবয়সী নারীর আরো দুটো দীর্ঘশ^াস ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।
এখানে সন্ধ্যা নামে তড়িঘড়ি, সূর্যের জয়তুনের মতো তর সয় না। হঠাৎ সমুদ্রের জলে ডুবে যায় আবার ওঠে জয়তুন বেগমকে সঙ্গে করে খুব সকালে। আজ দিনের শুরুতেই জয়তুনের নাকে কেমন যেন একটা ঘ্রাণ এসে লাগে, চেনা ঘ্রাণ – অনেকটা পুরুষের মতো। কচি সকালে বাসিমুখ নিয়ে জয়তুন গিয়ে দাঁড়ায় ঘরের সামনের খোলা প্রান্তরে। তাকায় দূরে, দৃষ্টি আটকে যাওয়ার মতো কোনো কিছু নেই এ ধু-ধু প্রান্তরে। শুধু সমুদ্র আর সূর্যের ভরসা আছে ওপাশে, আরো আছে নিভৃতে নিরন্তর অপেক্ষা। জয়তুন বেগমের ওপরে সূর্য, সামনে সমুদ্র আর সঙ্গে ছায়ার মতো কিশোরী নাতনি।
এই নাতনি প্রায়ই তাকে তার ঝরে যাওয়া সময়কে মনে করিয়ে দেয় সকাল-বিকেল। জয়তুন বেগম মাঝে মাঝে ভাবে, এই নাতনিটা যদি পুরুষ মানুষ হতো, তাইলে কেমন হতো! এসব ভাবনা মাথায় বেশিক্ষণ আশ্রয় দেয় না। জয়তুন বেগম শরীর আর মন জুড়ে কেমন যেন একটা পুলক বোধ করে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নরম সূর্যটার দিকে। রহস্যময় আলোটা এসে লাগে জয়তুনের গায়ে; বসন ভেদ করে স্পর্শ করে তার শরীর, শরীরের ভেতরের দেহ। চোখ বুঁজে আসে জয়তুনের। কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে, একটু পর চোখ মেলে। ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ায় নাতনির বিছানার পাশে, এক গভীর ঘুমে ডুবে আছে সে, নরম লাল সূর্যটা যেন গলে বেরিয়ে এসেছে তার শরীরের নিম্নাংশ থেকে, লেপ্টে আছে সাদা পাজামা আর খয়েরি জামার মধ্যিখানে। জয়তুনের মধ্যে ফেলে আসা একটা সময় এসে ভর করল। যুদ্ধ সে-সময়ও চলছিল। মরার যুদ্ধ আর শেষ হয় না। সেই কিশোরী জয়তুনের শরীরে আজ ভর করতে শুরু করেছে এক খসখসে অনুভূতি, ভাবেরাও অনেকটা দিশেহারা, এরপর কোনো পুরুষ মানুষ আর ফেরেনি এ-অঞ্চলে।
সর্বশেষ পুরুষ বকুও বছর কয়েক আগে, সবেমাত্র কৈশোরের আলপথ ডিঙিয়ে যৌবনে পা রাখবে, অমনি একদিন উধাও। যাওয়ার আগে সবাইকে বলেছিল, ‘পূর্বপুরুষের একটা খোঁজ নিয়েই সে ফিরবে অথবা শত্রুরে বিনাশ করবে।’ নির্বিকারভাবে জয়তুন বকুরে সে-সময় জিজ্ঞেস করেছিল, শত্রুটা কে বাবা, বকু? বকু বলেছিল, ‘আছে, ওপারে, দূরে – বহুদূরে।’ বকু আর ফেরে নাই, আর জয়তুনও শত্রুর কোনো নিশানা পায় নাই। জয়তুন মনে মনে ভাবে, যুদ্ধ কি খালি পুরুষ মানুষের কারবার? এই কারবারের মুনাফা কে নেয়?
সূর্য ওঠার পর আজ আর বেশি দেরি করে নাই। ভেতরে কেমন যেন উতলা একটা ভাব গ্রাস করছে। মেয়ে আর বউকে না জানিয়েই নাতনিরে সঙ্গে করে যাত্রা শুরু করে সমুদ্রের কিনারায়। নিত্যদিনের চেয়ে আজ ঘণ্টাদুই আগেই রওনা হয়। সঙ্গে নেয় পানি, শুকনো কিছু কাপড় আর খাবার। মাইলদুই পথ হেঁটে একটা চাপা উত্তেজনা সঙ্গী করে দুজনে পৌঁছে সমুদ্রের কিনারে। এই সময়টা ভাটা, কিছুক্ষণ পর জোয়ার আসবে। পাখিদের কোলাহল নাতনির শরীরের উত্তেজনা একটু বাড়িয়ে দেয়। তর সয় না তার, নেমে পড়ে সমুদ্রের নীল জলে; শরীরের নিম্নাংশে, কাপড়ে লেপ্টে থাকা তরল সূর্যদেব ধুয়ে ফেলে সমুদ্রের জলে। আজ জলও কেমন যেন পুরুষ হয়ে উঠছে, জড়িয়ে ধরছে তার সারা শরীর। চন্দ্র, সূর্য, সমুদ্র, প্রকৃতি সবই তাকে স্পর্শ করছে একটা নতুন অনুভবে। তার ইচ্ছে হচ্ছে জলের সঙ্গে মিশে যাবে।
জয়তুন তীরে বসে হাঁকে, বেশিদূর যাইস না, শেষ ভাটার টানে সমুদ্রের জলে ভাইসা যাবি।
এই সময় সমুদ্র কেমন যেন একটা ভাব ধরে। আজ তার ভেসে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে ওপারে, দূরে – আরো দূরে। পুরুষের একটা ঘ্রাণ এসে লাগে নাতনির শরীরে। অলৌকিক স্টিমারের গা ঘেঁষে যে বাতাস আসে, সে বাতাসের একটা পুরুষালি ধরন আছে। নাতনি এক জলরাশি ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়, দেখে শান্ত জলরাশি ও শান্ত সূর্য কেমন যেন একটা ভাব ধরেছে। তার চোখ যায় পুবের দিকটায়, সূর্যের আলোটা এসে কেমন যেন মায়াবী রূপ ধারণ করেছে। হঠাৎ চোখে ভেসে ওঠে একটা যেন কী! চিৎকার দিয়ে জল থেকে উঠে এসে দাদিকে ডাকতে থাকে, ‘দাদি, দাদি, দেখো ওটা কী!’
তন্দ্রার ভাবটা কেটে যায় জয়তুন বেগমের। উঠে দাঁড়ায় আর দেখার চেষ্টা করে আসলে ওটা কী, নাতনিকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে আগায় ওইদিকটায়। বেশি দূরে নয়, কয়েকটা পা বাড়ালেই হদিস মিলবে। দাদি আর নাতনি হাত ধরে একটু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আগায় ওই দিকে – কী যেন একটা ভেসে এসে তীরে আটকে আছে। ঢেউ এসে মৃদু আঘাত করছে ওটাকে। দেখতে অনেকটা মানুষের মতো। মনে হয় একটা পুরুষ। জয়তুন কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, নাতনি পাশে। দেখে একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ। নাতনির ভেতরটা কেমন যেন করে। নাতনি জিগায়, ‘দাদি এইটা মনে হয় পুরুষ মানুষ।’ জয়তুন বেগম কোনো উত্তর দেয় না। তাকিয়ে আছে আদম সন্তানের দিকে। আদম সন্তান নিস্তেজ পড়ে আছে, হাত দুটো বাঁধা প্লাস্টিকের খোলা কন্টেইনারের সঙ্গে। একটু এগিয়ে গিয়ে জয়তুন নাকের কাছে হাতটা নেয়, জীবনের স্পন্দনটা টের পায়। চিৎকার করে নাতনিকে বলে, ‘ধর, হাতের রশিটা খোল।’ রশিটা খুলে দাদি আর নাতনি দু-হাত ধরে টেনে ওপরে ওঠায়। শুকনো ঈষদুষ্ণ বালুর ওপর চিৎ করে শুইয়ে দেয় পুরুষ মানুষটাকে।
জয়তুন এক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, একজন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ মানুষ। এই শরীরে যেন গেঁথে আছে স্বামী, সন্তান, জামাই, নাতি অথবা হারিয়ে যাওয়া সব পুরুষ। নাতনি অদ্ভুত এক ঘ্রাণে, পুরুষের ঘ্রাণে, একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোরটা কাটে, দেখে, দাদি ওই পুরুষের বুকের ওপরে দুই হাত দিয়ে চাপ দিচ্ছে আর তাকে শ^াস নিতে সাহায্য করছে। জয়তুন নাতনিকে বলে, ‘হাতের তালুটায় একটু ঘসা দে।’ নাতনির পা আগায় না, শুধু চেয়ে থাকে পুরুষটার বুকের জমিনে। বুকটা ওঠানামা করছে। জয়তুন বেগমের সেবা আর উষ্ণতায় ঘণ্টাখানেক পর চোখ মেলে তাকায় যুবকটি। একটু পর উঠে বসে, কোনো শব্দ করে না। তাকিয়ে থাকে শুধু জয়তুন আর তার নাতনির দিকে। রোদের উষ্ণতায় চারপাশ অনেকটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। নাতনির শরীরে লেপ্টে থাকা কাপড়ও শুকিয়ে যায়। জয়তুন সঙ্গে আনা শুকনো কিছু খাবার দেয় পুরুষ মানুষটাকে। মনে হয় খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। আরো ঘণ্টাখানেক তারা বসে থাকে সমুদ্রের কিনারে। পুরুষের এই অলৌকিক উপস্থিতি সময়কে ভুলিয়ে দেয় দাদি আর নাতনির।
ঘণ্টাখানেক পরে সূর্য প্রায় মধ্য গগনে, তখন তারা রওনা দেয় বাড়ির দিকে। আজ তারা তিনজন, সঙ্গে একজন পুরুষ। বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই ঘরে দুজন নারী বারান্দা থেকে বিস্ময় নিয়ে দেখে কে যেন একজন পুরুষের মতো বা তার চেয়েও বেশি কিছু। আজ যেন তাদের উৎসব। এমন উৎসব আসেনি এ-ঘরে বহুদিন। এই দুই নারী গত এক দশকে কোনো পুরুষের শরীরের ঘ্রাণ পায়নি, মেলেনি তাদের শরীরের কোনো ওম। জয়তুনের জামাই আর পোলা সেই যে উধাও হইছে, তাও তো অনেকদিন। জয়তুন চোদ্দো পুরুষের খবর না জানলেও নিজেই দেখছে তার চাইর পুরুষ কীভাবে শত্রুরে বিনাশ করতে ওই সমুদ্রের ওপারে গিয়ে আর ফেরে নাই। নিজের মেয়ের ঘরের নাতিটা বেঁচে থাকলেও বেটা মানুষ হইয়া উঠত এতদিনে। সেও একদিন সমুদ্রের জলে ভেসে গেল সেই কিশোর বয়সেই।
এই গাঁও থেকে নানান বয়সী পুরুষ নানান সময়ে উধাও হয়েছে। আজ সব পুরুষ মানুষের ছায়া হয়ে ফিরে এসেছে এই অদ্ভুত রহস্যময় পুরুষ। ধীরস্থির, কোনো কথা কয় না, শব্দ করে না, শুধু চেয়ে থাকে এ-ঘরের চার নারীর দিকে আর উদাস হয়ে যায়। একটু দূরে যে আরো কয়েকটা ঘর তারা টের পায় নাই এ-পুরুষের আগমন। এই চার নারী আর কাউকে জানতে দিবে না এ যুবকের উপস্থিতি। একটা অজানা ভয়, যদি আবার সেও উধাও হয়; যুদ্ধের নেশা পেয়ে বসে তাকেও।
জয়তুনের এই ঘরে ছোট ছোট চারটি ঘর। এক ঘরে থাকে ছেলের বউ, এক ঘরে মেয়ে, আর বারান্দায় জয়তুন আর তার নাতনি। পাশের আর একটা ঘরে সামান্য মালামাল রাখা। এই বারান্দায় এখনো জয়তুন আর নাতনি। যেন লোকজন টের না পায় তাই মালামালের সঙ্গেই আশ্রয় হয় পুরুষ মানুষটির। এই ঘরে একটা উৎসবের আমেজ এসেছে, ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের কানায় কানায়। মনে হয়, যেন বহুদিন পর শুকনো গাঙে নয়া পানি আইছে নিভৃতে, কোনো কলকল ধ্বনি নেই। পানিতে তৃষ্ণা মিটছে না এ উর্বর শুষ্ক ভূমির। এ তৃষ্ণা ভেতরের; ওই সমুদ্রের তীর, নীলজল, তারও দূরে ওই যে পার, যার দেখা মেলে না – এরাও কখনো টের পাবে না এ-তৃষ্ণা। এ-তৃষ্ণা শুধু জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা চার নারী জানে। তাদের জমানো তৃষ্ণাগুলি, অনুভূতিগুলি পুরুষ মানুষটিও কিছুটা আঁচ করতে পারে।
পুরুষটির কদর অনেক বেড়ে যায়। চারজন নারীই যার যার মতো করে একটা সম্পর্কের গলি বানিয়ে সেবা দিতে শুরু করল তাকে। জমানো সুন্দর খাবার, কাপড়, আবেগ, ভালোবাসা যে যার মতো করে নিয়ে হাজির হয় তার ঘরে – লুকিয়ে লুকিয়ে। এক অদ্ভুত অজানা প্রতিযোগিতা শুরু হয় চার নারীর মধ্যে। পুরুষ মানুষটি কোনো কথা বলে না। মাঝে মাঝে চন্দ্রালোকিত রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, যে-পথে সে ভেসে এসেছে সেই পথটা বোঝার চেষ্টা করে আর তাকিয়ে থাকে সেই দীর্ঘ প্রান্তরে।
এভাবেই সময় পার হয়। একদিন নাতনি এসে দাদিরে কয়, ‘দাদি, মানুষটা মনে হয় কথা কইতে পারে না।’ দাদি এক রহস্যময় হাসি হেসে নাতনিরে বলে, ‘কথা না কইতে পারলে কী হইবো, পুরুষ মানুষ তো!’ জয়তুন বেগমের তলপেটে একটা মোচড় মারে, মূলাধারে চিনচিনে অনুভূতিটা নড়েচড়ে ওঠে। তার মনে পড়ে স্বামীর শরীরের ঘ্রাণটা, কিন্তু এই পুরুষটার ঘ্রাণ কেমন জানি একটু ভিন্ন – শরীরটা আর শরীরের ভাষাটাও কেমন জানি একটু ভিনদেশি, অচেনা। মেয়ে আর ছেলের বউর সঙ্গে পুরুষ মানুষটার এক লুকোচুরি সম্পর্কের ব্যাপারে জয়তুনের কোনো রাগটাক না থাকলেও নাতনিরে কেন জানি আগলে রাখতে চায়। নাতনিরে ভিড়তে দেয় না পুরুষ মানুষটার কাছে। কিন্তু পুরুষটা কেমন করে জানি তাকায় নাতনির দিকে। পুরুষ মানুষের অনেক ভাব ও ভাষা ভুলে গেলেও চোখের এই ভাষাটা জয়তুন বেগম ভালোই বোঝে। জয়তুন দুই হাতে জাপটে ধরে নাতনিরে আর মানুষটার কাছ থেকে একটু দূরে থাকতে বলে। কিন্তু নাতনির অদ্ভুত ঘোর কাটে না কোনোভাবেই।
দাদি জয়তুন বেগমের শঙ্কাটা নাতনি টের পেলেও পুরুষ মানুষের ঘ্রাণ আর শারীরিক অস্তিত্ব তার মধ্যেও এক পুলকের সৃষ্টি করে। সেও মাতে আদি উৎসবে, জয়তুনের অলক্ষে হারিয়ে যায় এক রহস্যময় পুরুষ মানুষের শরীরের কানায় কানায়। কোনো শত্রু-মিত্র খুঁজে পায় না সেখানে, কেবলই শরীর। সময়েরা যেন হঠাৎ করে দ্রুত পাল্টাচ্ছে এই সমুদ্র তীরে। এই পুরুষটি সময়ের গতি উল্টে দিয়েছে। সব যুদ্ধ মনে হয় থেমে গেছে। আর কোনো প্রতীক্ষা নেই।
এভাবেই এই রহস্যময় ভূমিতে এক রহস্যময় পুরুষ মানুষের উপস্থিতির মধ্যে লুকোচুরি করে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ কেটে যায়। শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ, সমুদ্রের বান টের পায় এই নারীদের শরীর। এরই মধ্যে লুকোচুরি, ভাব, আবেগ, আধিপত্য ও শরীর সরব হয়ে ওঠে; ডালপালা মেলে, বিস্তৃতি ঘটে অনেক কিছুর। শুধু পুরুষ মানুষটার মুখে কোনো শব্দ নেই। উর্বরতা ফিরে আসে ভূমিতে, সমুদ্রের জলে ভেসে আসা বীজের হয় বপন। নানান স্বপ্নের বপন হয় পৃথক পৃথক ভূমিতে, জীবনের সরু অলিতে-গলিতে।
আরো কয়েকটা দিন পার হয়ে যায় এ-অঞ্চলের। পৃথিবীর কোনো গাঁ থেকে কিংবা সমুদ্রের ওপার থেকে কোনো আগন্তুক আর আসে না। এই পুরুষেই ভরসা। এই বীজই সংগ্রহ করতে হবে আদি-উর্বর বীজতলায়। জয়তুনের শঙ্কা – পুরুষশূন্য হতে দেওয়া যাবে না এই অঞ্চল কোনোভাবেই। ওই তিন নারীতেও ভরসা করতে পারে না। বিরান ভূমিতে কি ফসল ফলবে? জয়তুন বিবির নাভীর ভেতরের চিনচিনে অনুভূতিটা আবার জেগে ওঠে এই পূর্ণিমার জোছনায়। এক অদ্ভুত হাওয়া লীলা করতে করতে আসে সমুদ্রের তীর থেকে কিংবা আরো দূর থেকে। জয়তুনের বসন আলগা করে দেয় সে বাতাস। জেগে ওঠে জয়তুন বিবি। পুরুষ আর জয়তুন বিবি যেন একাকার; শুধু জীবনের ভেতরের প্রবাহ। খোলা ধু-ধু বালুচর, সমুদ্র তার তীর, বহু পরম্পরার শত্রুতা, সমুদ্রের ওপার সব যেন ঢেকে গেল বিরান ভূমির অলৌকিক নাচনে, শুকনো গাঙের গোঙানিতে আর পুরুষ মানুষের শরীরে। জোছনার আলোয়, জয়তুনের শরীরের নাচনে, খসে পড়ে পুরুষ মানুষটির শেষ বসন এরপর শুধু সেই পুরুষদণ্ড। মধ্যরাতের জ্যোৎস্নার আলোর তলায় জয়তুন আঁতকে ওঠে। জয়তুন টের পায় সেই চিহ্ন, যা সে শুনেছিল তার স্বামীর কাছে। এ তো সেই শত্রু! যে শত্রু বিনাশের জন্য পুরুষশূন্য হয়ে গেছে এই ভূমি, তার চোদ্দোপুরুষ।
নীল চাঁদের আলোয় অবশ হয়ে পড়ে জয়তুন বেগম – তার শরীর, মন আর মগজ।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.