জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ৭

অবন্তি আর অংশু চলে যাওয়ার পরও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইলো ঋভু। এখান থেকে রাস্তার বেশ খানিকটা দেখা যায়। ওদের গাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার পর কেমন এক শূন্যতাবোধ গ্রাস করলো ঋভুকে। নিজেকে একা আর নিরালম্ব মনে হলো। এরকম হওয়ার কথা নয়। একা থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। সত্যি বলতে কী, এরকম নিঃসঙ্গ জীবনই চেয়েছিল ঋভু। যখন রিনি ছিল তখন সে কল্পনা করতো, যদি এই বাসায় সম্পূর্ণ একা থাকা যেত! কিংবা এমন কোথাও যদি চলে যাওয়া যেত যেখানে কেউ তাকে চেনে না! অবশ্য যতটা শূন্যতা সে কল্পনা করেছিল ততটা পায়নি, চাচা-চাচি আর করিমের উপস্থিতির জন্য, যদিও তারা কেউ তার কোনো কাজকর্মে বাধা দেয় না, এমনকি আপত্তিও তোলে না, তবু উপস্থিতি মানেই একটা দায়িত্ব নেওয়া। রিনি চলে যাওয়ার পর সে তাই স্বস্তি বোধ করতো। নিজেকে মনে হতো দায়হীন। তারপর থেকে তো একা একাই কেটে গেল এতগুলো বছর। কখনো তো এমন শূন্য লাগেনি, আজকের দিনটি কি তাহলে অন্যরকম? হ্যাঁ, একটু অন্যরকম তো বটেই, সুসানই অন্যরকম করে দিয়ে গেল। আজকে দ্বিতীয়বারের মতো সুসান এলো এই বাসায়, প্রথমবার এসেছিল বন্ধুদের সঙ্গে, সেই কতকাল আগে! সেদিন আলাদা করে ওকে পাওয়া হয়নি, আজ যেমন হলো। সেরকম সম্পর্কও অবশ্য ছিল না তখন। এখনো কি আছে? কোনোকিছুরই তো মীমাংসা হয়নি। আজ তাহলে সুসান হঠাৎ অমন প্রগলভ হয়ে উঠলো কেন? আজই কেন প্রথম চুম্বনবিনিময় হলো? কুড়ি-বাইশ বছর আগে যদি হতো, তাহলে জীবন কি অন্যরকম হতো? কী হতে পারতো? বিয়ে, প্রেম, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা …। তারপর? ক্লান্তি? তার কি ভালো লাগতো সংসারের ঘেরাটোপ? সুসান কি এরকম আকর্ষণীয়ই রয়ে যেত তার কাছে? মনে হয় না। তার আসলে কখনো  কোথাও মন বসেনি। নইলে আরিয়ানার কাছেই বসতে পারতো। 

সারাদিন পর ফের আরিয়ানার কথা মনে পড়লো ঋভুর। সেই মুখর দিনগুলো, উদ্দাম দিনগুলো, অলৌকিক দিনগুলো যেন ফিরে এলো আবার, আকস্মিকভাবে, স্মৃতিতে।

মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য ঋভু নেপালে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কাঠমান্ডুতে তিন-তারা হোটেলের বিলাসবহুল আরামের ভেতরে থেকেও তার ভালো লাগছিল না। হোটেল থেকে খুব একটা বেরুতো না সে। দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার কোনো তাগিদ সে অনুভবই করছিল না। অথচ কাঠমান্ডু পর্যটকদেরই শহর। অসংখ্য পর্যটক আসছে-যাচ্ছে, হই-হুল্লোড় করছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে; আর সে বসে বসে দেখছে কেবল। দিন-কয়েক পর, সম্ভবত তার এই বিমর্ষ মুখ দেখেই একজন নিজে থেকে এগিয়ে এলো। কুশলবিনিময় করলো, কেমন লাগছে কাঠমান্ডু জানতে চাইলো, সেও দায়সারা গোছের উত্তর দিলো। সেই লোক নিজে থেকেই বললো, আমার মনে হচ্ছে এখানে আপনার ভালো লাগছে না। কাঠমান্ডু তো ভিড়ের শহর, কেউই ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারে না। আপনি দু-একদিনের জন্য পোখারা থেকে ঘুরে আসুন।

পোখারায় গেলে কি ভালো লাগবে?

আমার ধারণা লাগবে।

লোকটার নাম অমৃত, নেপালি। পেশায় একজন ট্যুরিস্ট গাইড। ঋভু জিজ্ঞেস করে জেনেছিল এবং অমৃতের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল। অমৃতই পোখারায় হোটেল ঠিক করে দিলো, বাসের টিকেট কেটে দিলো, কিন্তু নিজে গাইড হিসেবে যেতে রাজি হলো না। তার নাকি এখানে অনেক কাজ।

পোখারায় গিয়েই দেখা হলো আরিয়ানার সঙ্গে এবং অন্নপূর্ণার অলৌকিক সূর্যোদয়ের সঙ্গেও। ঋভু কিছুই জানতো না অন্নপূর্ণা সম্বন্ধে। সংগত কারণেই কোনো আগ্রহও দেখায়নি ওখানে যাওয়ার। তবে যে-হোটেলে রুম রিজার্ভ করে দিয়েছিল অমৃত, সেখানে উঠে, দরজা-জানালা খুলে, ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই তার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। এই শহরের দৃশ্যপট অন্যরকম – সারি সারি পাহাড়, রোদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা, একটা গম্ভীর অথচ মায়াময় রূপ নিয়ে শহরটা ধরা দিলো তার কাছে একেবারে প্রথম দেখাতেই। বিছানায় ধবধবে সাদা চাদর, সুন্দর একটা গন্ধ, সম্ভবত দামি কোনো এয়ার ফ্রেশনারের, ভ্রমণের ক্লান্তি মুছে গেল তার। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো সে, তারপর শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগলো রূপলাবণ্যভরা পাহাড়ি শহরের সোনাঝরা বিকেল। আলস্যটাকে পরম মধুর বলে মনে হচ্ছিল আবার মন টানছিল বিকেলের ডাকে সাড়া দিয়ে শহরটা ঘুরে দেখতে। দ্বিতীয় ইচ্ছেটাই জয়ী হলো, বেরিয়ে পড়লো সে। কিন্তু বাইরে যাওয়ার আগেই তাকে দেখে রিসেপশন থেকে এগিয়ে এলো অভ্যর্থনাকর্মী, আগ বাড়িয়ে বললো, ‘বাইরে যাচ্ছেন স্যার? সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বেশি দূর যাবেন না। কালকে তো সারাদিন পড়েই আছে, শহর দেখতে পারবেন। আজকে বরং লেকের পাড়ে যান, ভালো লাগবে।’ লেকের লোকেশনও বুঝিয়ে দিলো, ওটা যে হাঁটা দূরত্বেই তা বলতেও ভুললো না লোকটা।  পড়ন্ত বিকেল। শীত-বিকেলের নরম-কোমল আলোতে ভরে আছে চারপাশ, তার ওপর পাহাড়ি লেকের রহস্যময়তা। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়ে ফয়’স লেক দেখে তার প্রথমেই মনে হয়েছিল, এতো উঁচুতে লেকটা তৈরি হলো কীভাবে? বাবাকে জিজ্ঞেসও করেছিল সে-কথা, তিনি বলেছিলেন : প্রকৃতির এইসব কাজকর্মের ব্যাখ্যা আমি জানি নারে বাবা। ঋভুর বিস্ময় বেড়ে গিয়েছিল, কারণ, তার ধারণা ছিল, বাবা পৃথিবীর সবকিছুই জানেন! আজো, এই এতোদিন পর, বহুদূরের এক শহরে এসে সেই একইরকম বিস্ময়বোধ তৈরি হলো তার। বিশাল লেক, ওপারে পাহাড়ের সারি, এপারেও নিশ্চয়ই পাহাড় ছিল একসময়, এখন সেখানে শহরের প্রধান সড়ক। লেকপাড়ে হাঁটলো সে অনেকক্ষণ, এমনকি দশ ডিগ্রির নিচের তাপামাত্রায় যে প্রবল শীত তাও যেন ভালো লাগছিল তার। রাস্তার ওপারে সারি ধরে দোকানপাট। হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানে মিউজিকের মনকাড়া সুর শুনে ভেতরে ঢুকলো সে, জানা গেল ওটা তিব্বতিয়ান মেডিটেশনাল মিউজিক। পাশেই ছোট্ট একটা বার দেখে বসে পড়লো সে। এরকম পরিবেশে একটু পান না করলে চলে? অনেকদিন পর ভালো লাগছিল তার। মুগ্ধ এবং বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা যে এখনো হারিয়ে যায়নি, ভেবেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছিল। কাঠমান্ডুতে বসে এই পাহাড়ি দেশের রূপমাধুর্য উপভোগ করতে পারেনি ঋভু। পারবেই বা কীভাবে, হোটেল থেকে সে বাইরেই তো যেত না। অথচ এখানে এসে প্রথমদিনেই মন ভালো হয়ে গেল তার।

হোটেলে ফিরতেই সেই অভ্যর্থনাকর্মী জানতে চাইলো, কেমন লাগলো স্যার?

ভালো, খুব ভালো লাগলো।

কাল সারাঙকোট যাচ্ছেন তো?

সারাঙকোট? সেটা আবার কী?

ওটাও পাহাড়। খুব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা যায় ওখান থেকে।

না, ওখানে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।

ঘুরে আসুন স্যার। আপনার ভালো লাগবে।

এ-দেশে পর্যটন শিল্পটা কীভাবে কাজ করে আন্দাজ করতে পারছিল ঋভু। সবাই তাদের দেশটা দেখানোর জন্য উদগ্রীব। কাঠমান্ডুতে যদি অমৃত যেচে এসে পোখারার কথা না বলতো, তাহলে তার জানাই হতো না যে, এরকম একটা শহর আছে এখানে। শুধু বলেই ক্ষান্ত হয়নি, উদ্যোগী হয়ে ট্যুরিস্ট বাসের টিকিট করে দিয়েছে, হোটেলে রুম রিজার্ভ করে দিয়েছে, প্রয়োজনীয় তথ্যও দিয়েছে। এখানে, এমনকি হোটেলের রিসেপশনিস্টও কত আন্তরিকভাবে নিজের শহরটিকে দেখাতে চাইছে একজন অচেনা আগন্তুককে। শুধু কি তাই? ঋভু যখন জানতে চাইলো, কীভাবে যেতে হবে, তখন সেই লোকই সব ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিল। এমনকি ভোরবেলা ডেকে দেওয়ার দায়িত্বও। এবং ভোর সাড়ে চারটায় বেজে উঠলো রুমের টেলিফোন, ওয়েক আপ কল! ঋভু তৈরি হয়ে বেরুলো। এবং বেরিয়েই টের পেলো, তীব্র শীত এখন বাইরে। রুমের ভেতর থেকে তা বোঝা যায়নি। জানা গেল তাপমাত্রা তিন ডিগ্রিতে নেমে এসেছে। সে জীবনেও এই ধরনের শীত দেখেনি, যদিও এই ঋতুটার জন্য সে সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে।

সর্পিল পাহাড়ি পথ বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলো জিপগাড়িটা। উঠছে তো উঠছেই, ওঠার আর শেষ নেই। ভোরের আলো তখনো ফোটেনি, তবু সেই পথে আরো অনেক গাড়ি, বাস, লরি। সবাই কি ওখানেই যাচ্ছে? ঘণ্টাখানেক ধরে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ওপরে উঠে এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করলো ড্রাইভার, বললো – ‘সামনে এগিয়ে যান। আরো অনেক লোক যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে গেলেই হবে। আমি এখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করি।’

ভোরের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে, অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি, অচেনা পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঋভুর মনে হলো, এই হাঁটার শেষ কোথায়? পথের দুদিকেই তো পাহাড়, সূর্যোদয়ই বা দেখা যাবে কী করে? এই সময় একজন লোক এগিয়ে এসে বললো – ‘সূর্যোদয় দেখতে এসেছেন? চলুন আপনাকে নিয়ে যাই।’ কথাবার্তা বলে জানা গেল, এটাই সারাঙকোট, তিনি স্থানীয় মানুষ, অবসর সময়ে গাইড হিসেবে কাজ করেন। একটু পথ গিয়ে একটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন তিনি। ওটা আসলে একটা পাহাড়ি বাড়ি, দোতলা, ছাদটা ওয়াচ-টাওয়ারের মতো, সেখানে অনেক ট্যুরিস্ট জড়ো হয়ে গেছেন এর মধ্যেই। ওখানে ওঠার পরই দেখা গেল অন্নপূর্ণা পাহাড় তার অনড় গাম্ভীর্য, রূপ আর রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্নপূর্ণার চূড়া আসলে একটা নয়, একাধিক। ভোরের আলো ফুটতেই সব চূড়া দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। বরফে ঢাকা শুভ্র-সুন্দর চূড়া। একটু পর দেখা গেল, চূড়াগুলোর রং বদলাতে শুরু করেছে। ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে ওগুলো। কেন এরকম হচ্ছে? সূর্যোদয়ও তো এখনো হয়নি! একটু পরেই কারণটা বোঝা গেল। সূর্যোদয় এখনো হয়নি বটে, মানে সূর্য দেখা যাচ্ছে না, দিগন্তরেখায় আছে বলেই দেখা যাচ্ছে না, সমতল ভূমি তো নয় যে, দিগন্তে থাকতেই তাকে দেখা যাবে, অজস্র পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরুলেই সে দৃশ্যমান হবে। কিন্তু সূর্যের আলো এসে পড়ছে বরফ-ঢাকা অন্নপূর্ণার চূড়ায়, সেজন্যই ওরকম রং বদলাচ্ছে। সাদা আলো প্রিজমের ভেতর দিয়ে পার হয়ে গেলে যেমন নানান রঙে বিশ্লিষ্ট হয়, এখানেও তাই ঘটছে। এবং সব চূড়ার রং একসঙ্গে পাল্টাচ্ছে না। যেগুলো বেশি উঁচু তাদের রং পাল্টাচ্ছে আগে। এই রঙের খেলা চললো অনেকক্ষণ ধরে। লাল থেকে কমলা হলো, তারপর হলুদাভ। সূর্য যখন উঠে এলো, তখন একেবারে স্বর্ণের মতো ঝকঝক করতে লাগলো চূড়াগুলো। মনে হলো – যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ পাহাড়ের গায়ে, কিংবা ওটা আসলে স্বর্ণেরই পাহাড়। জীবনে সূর্যোদয় দেখেছে সে অসংখ্যবার, সমুদ্রে-পাহাড়ে-বনভূমিতে-সমতলে, কিন্তু এমন অলীক দৃশ্য আর কখনো-কোথাও দেখেনি।

ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কাকতালীয়। নইলে সে সারাঙকোট যাবে কেন, ওরকম অলৌকিক সূর্যোদয় দেখে অভিভূত হবে কেন; কেনই-বা তার চোখ ভিজে উঠবে এই জীবন ও জগতের জন্য ভালোবাসায়-কৃতজ্ঞতায়; আর কেনই-বা অচেনা এক বিদেশি মেয়ে আলতো করে তার হাত ধরে বলবে, তুমি কাঁদছো কেন? সে তো জানতোই না, সারাঙকোট নামে একটা জায়গা আছে। হোটেলের রিসেপশনিস্টের পীড়াপীড়িতেই সে যেতে রাজি হয়েছিল। ভোরবেলা রওনা দিতে হবে জেনেই সে পিছিয়ে গিয়েছিল, অতো ভোরে আরামের ঘুম বাদ দিয়ে কে যায় সারাঙকোট না ফারাঙকোটে? কিন্তু রিসেপশনিস্ট নাছোড়বান্দা। বারবার বলতে লাগলো, আমি আপনাকে জাগিয়ে দেবো স্যার, ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে। এরা নিজেদের দেশটাকে দেখানোর জন্য এতো উদগ্রীব কেন ভেবে সে বিরক্তও হয়েছিল। তারপর কী মনে করে রাজি হয়েছিল।

ভাগ্যিস গিয়েছিল, নইলে জানাই হতো না জগতে এমন বিস্ময়কর সূর্যোদয়ও হয়। ভোরের সূর্যের আলো এসে পড়তেই যেভাবে রং পাল্টাতে শুরু করলো বরফাচ্ছাদিত পাহাড়গুলো, বহুবর্ণিল আলোর বিস্ময়কর খেলা চললো অনেকক্ষণ ধরে – সেই দৃশ্য ঠিক বর্ণনাযোগ্য নয়। প্রচুর পর্যটকের ভিড়ে কিন্তু সে ছিল একা। এমন একটা দৃশ্য একা দেখতে নেই, প্রিয় কেউ সঙ্গে থাকতে হয়, অনুভূতিটা ভাগ করে নেওয়ার জন্য, কিন্তু উপায় নেই, কাউকে তো সে চেনেই না। আর তখনই সেই মেয়েটির স্পর্শ। আরিয়ানা। ওই সময় ঠিক কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না ঋভু। তাছাড়া মেয়েটার ওই প্রশ্নের কোনো উত্তরও হয় না, মৃদু হাসি দিয়ে সে কেবল আলতো করে ওর হাতে চাপ দিতে পেরেছিল।

তারা ফিরলো একই গাড়িতে, কারণ, টুকটাক কথা বলতে বলতেই জানা গেল, তাদের হোটেল পাশাপাশি। ফিরে আসতে আসতে আলাপ-পরিচয় হলো। আরিয়ানা এসেছে ইতালি থেকে, এটাই তার প্রথম একা বিদেশ ভ্রমণ, বললো সে। স্কুল পাশ করে যখন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হলো তখন বাবা তাকে কিছু একটা উপহার দিতে চাইলে একা ভ্রমণের অনুমতি চেয়েছিল আরিয়ানা, বাবা সেটি অনুমোদনও করেছিলেন। তারপরও দু-বছর সময় নিয়ে সে বেরিয়েছে। তার প্রথম পছন্দ ভারতীয় উপমহাদেশ, এ নিয়ে অনেক পড়াশোনাও করেছে সে, এ-অঞ্চলের সব দেশ সম্বন্ধেই কিছু না কিছু জানে, বাংলাদেশও তার অচেনা নয়। ঋভু বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো সে, অনেক কিছু জানার আগ্রহ তার, ঋভু যথাসম্ভব তার কৌতূহল মেটালো। এসব প্রাথমিক আলাপ-পরিচয়ের পর কথা আর তেমন এগোনোর আগেই পথ ফুরালো, হোটেলের সামনে এসে থামলো গাড়ি। ঋভুর খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, চলো একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করি। কিন্তু প্রথম পরিচয়ের জড়তা তখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি, তাছাড়া দুজনের হোটেল আলাদা, হোটেলে ব্রেকফাস্টটা কমপ্লিমেন্টারি, মানে ফ্রি, বাইরে কোথাও খেতে গেলে পয়সা খরচ হবে। তাতে ঋভুর অসুবিধা নেই, পর্যাপ্ত টাকা নিয়েই সে দেশ থেকে এসেছে, প্রায় কিছুই খরচ হয়নি, কিন্তু টাকাই তো শেষ কথা নয়, আরিয়ানাকে বললেই যে একসঙ্গে খেতে রাজি হবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া একেক দেশের একেক সংস্কৃতি। বাংলাদেশে যেমন বন্ধুবান্ধব মিলে একসঙ্গে খেয়ে কখনো ভাগাভাগি করে বিল দেয়, কখনো যার যার বিল তার তার, কখনো-বা কোনো একজনই খাওয়ায় সবাইকে, কোনোটাতেই সমস্যা নেই। কিন্তু স্বল্পপরিচিত কাউকে খেতে বলা মানে হচ্ছে, নিজে হোস্ট হওয়া এবং বিল দেওয়া। আরিয়ানার দেশেও কি একই ব্যবস্থা? নাহ, এসব খামোখাই ভাবছে সে। একসঙ্গে নাস্তা করার দরকার কী? কিন্তু এই শেষ? আর দেখা হবে না এই অপূর্ব মেয়েটির সঙ্গে? এইসব দ্বিধাদ্বন্দ্বে দুলছিল সে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিল না। গাড়ি থেকে নেমে দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে, কেউই নিজের হোটেলে ঢুকছে না, আরিয়ানার ঠোঁটের মৃদু হাসি আর চোখের চাউনি দেখে ঋভুর মনে হচ্ছে মেয়েটি যেন অপেক্ষা করছে কিছু একটা শোনার জন্য। কিন্তু কী বলবে সে, কী বলা যায়? কিছুক্ষণ ক্যাবলাকান্তর মতো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে যখন মুখ খুললো ঋভু, দেখলো ঠিক সেই সময়ই কিছু একটা বলে উঠলো আরিয়ানা। দুজনে একইসঙ্গে বললেও বাক্য দুটো একই ছিল না। ঋভু বলেছিল : আর দেখা হবে না আমাদের? আর আরিয়ানা বলেছিল : আবার কখন দেখা হবে আমাদের? দুজনই দুজনকে শুনলো, হেসে ফেললো দুজনেই, তারপর আরিয়ানা জিজ্ঞেস করলো : আজ তোমার প্ল্যান কী? কোথায় যাবে?

আমার কোনো প্ল্যান নেই। কোথাও যাবো না।

সে কি! বেড়াতে এসে ঘরে বসে থাকবে নাকি?

তাই তো থাকছি। তুমি কি খুব ঘুরে বেড়াচ্ছ?

হ্যাঁ, সারাক্ষণ। আর কোনোদিন আসা হবে কি না জানি না তো, যতটা পারি দেখে নিচ্ছি। আজকে তুমিও চলো না আমার সঙ্গে।

হ্যাঁ, যেতে পারি। সানন্দে রাজি।

থ্যাংক ইউ। তাহলে ব্রেকফাস্ট করে, একটু রেস্ট নিয়ে, স্নান করে সারাদিনের জন্য বেরুবো, ঠিক আছে?

আচ্ছা ঠিক আছে।

বিদায় নেওয়ার আগে দুজন হোটেলের রুম নাম্বার বিনিময় করলো যেন প্রয়োজনে ফোন করা যায়। তারপর যে-যার রুমে চলে গেল। ঘণ্টা তিনেক পর বেরুলো ফের। তারপর এলোমলো ঘুরে বেড়ানো – পুরনো বসতি, একাধিক মন্দির, নতুন শহর, লেক, শ্বেতী নদী, দেবীর জলপ্রপাত, গুপ্তেশ্বর গুহা আরো কত কী! কতটুকু কী দেখা হলো ঋভু জানে না, তার মনে পড়ে, সে ঘুরেফিরে কেবল আরিয়ানাকেই দেখছিল। এতো সুন্দর একটা মেয়ে, এত্ত সুন্দর, কোনো উপমা দিয়েই এই সৌন্দর্যকে বোঝানো যায় না। আরিয়ানা যে তাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে দারুণ খুশি তা বোঝাতে কার্পণ্য করলো না। উচ্ছল, চঞ্চল, দুরন্ত হরিণীর মতো সে বিচরণ করলো শহরজুড়ে। আর দুপুর পেরিয়ে বেলা পড়ে আসতে না আসতেই খুলে দিলো নিজের অর্গল – হাত ধরে হাঁটলো, ট্যাক্সিতে উঠে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো; পাহাড়ি রাস্তায় ওঠার সময় নিজেই হাত বাড়িয়ে বললো – আমাকে একটু ধরো না, একা একা যাচ্ছো কেন? এরকম সহজ মানুষের সঙ্গে সহজ হতে সময় লাগে না। ঋভু যে-দেশ থেকে এসেছে সেখানে ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক এতো সহজ নয়, এমনকি তারা সহজভাবে তাকাতেও পারে না পরস্পরের দিকে। কোনটা মুগ্ধতা, কোনটা ভালো-লাগা, কোনটা প্রেম, কোনটা বন্ধুতা, কোনটা কাম – আলাদা করে ভাবেই না কেউ। সমাজের কাছে ছেলেমেয়েদের সম্পর্কের একটাই মানে, যৌনতা! সে-ও বেড়ে উঠেছে নানারকম বিধিনিষেধের ভেতর দিয়ে, কাউকে ভালো লাগলেও তার দিকে পূর্ণ চোখে তাকানোর সাহস হয়নি, যদি কিছু মনে করে – এই ভেবে। সেজন্যই আরিয়ানাকে  নিয়ে শুরুতে কিছুটা দ্বিধা ছিল ঋভুর, ওর সহজ আচরণে সেটুকুও ধুয়েমুছে গেল। এমনকি গুপ্তেশ^র গুহার গা-ছমছমে আলো-আঁধারির মধ্যে আরিয়ানা যখন জড়িয়ে ধরলো তাকে, এতোটুকু অবাক হলো না সে, যেন এটাই স্বাভাবিক, এমনই হওয়ার কথা। আর, হ্যাঁ, সেখানেই তাদের প্রথম চুম্বনবিনিময় হলো।

একটা রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করলো তারা। কয়েক-ঘণ্টা ধরে এখানে-সেখানে ঘুরে ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত, খেতে বসে তাই একদম তাড়াহুড়ো করলো না। অবশ্য মেন্যু বাছাই করতেও বেশ খানিকটা সময় লাগলো। দুজনের খাদ্যাভ্যাস দুরকম। এখানকার খাবার-দাবার অনেকটা বাংলাদেশের খাবারের মতোই, ঋভুর তাই ততোটা সমস্যা হয়নি আসার পর থেকে, কিন্তু আরিয়ানার জন্য এদেশের খাবার থেকে বাছাই করা একটু কঠিনই। সে তাই ঋভুর ওপরই ছেড়ে দিয়েছিল বাছাইয়ের ভার। খাওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য প্রধান নয়, দুজনে যেন আরো খানিকটা কাছাকাছি আসার উপলক্ষ খুঁজছিল। খাওয়ার ছলে  তাই ঘণ্টা-দেড়েক কাটিয়ে দিলো রেস্টুরেন্টে বসেই।    

সেদিন বিকেলেই লেকের পাড়ে হাঁটতে গেল তারা, সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে বসলো লেকমুখী এক বারে, পান করতে করতে আড্ডা জমে উঠলো। সেই ভোর থেকে সারাদিন একসঙ্গে থাকা আর সন্ধ্যার এই মোহনীয় পানীয় তাদের বন্ধুত্ব গড়ে দিলো। কেবল কি বন্ধুত্ব? তাদের চোখের ভাষা কি ততোক্ষণে পাল্টে যায়নি? পরস্পরকে কামনা কি করেনি তারা? অন্তত ঋভু নিজের ব্যাপারে বলতে পারে, তার ভেতরে তীব্র কামনা জেগে উঠেছিল। এখানে দিনের বেলাও বেশ শীত, সারাদিন আরিয়ানা জ্যাকেট পরে ছিল, ঋভুও; শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বারে বসে পান করতে করতে শরীর উষ্ণ হয়ে উঠতেই দুজনই খুলে ফেলেছিল জ্যাকেট। আর তখনই আরিয়ানার শার্ট ভেদ করে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল ওর সুগঠিত, সুউচ্চ স্তনের আভাস। ঋভু চোখ ফেরাতে পারছিল না, আরিয়ানাও প্রশ্রয়ের হাসি হেসে দুটো বোতাম খুলে দিয়ে আরেকটু দৃশ্যমান করে তুলেছিল স্তনদুটো। কামনা না জেগে পারে?  

কামনার আগুন অবশ্য নিভলো না। দুজন ফিরে এলো নিজেদের রুমে। অবশ্য তার আগে, মানে সেদিনের মতো বিদায় নেওয়ার আগে, আরেকবার চুম্বনবিনিময় হলো তাদের, আরো দীর্ঘসময় ধরে। রুমে ফিরেও ঋভু অনুভব করলো, তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে, জেগে উঠেছে তার সমস্ত ইন্দ্রিয়, মনে হচ্ছে এক্ষুনি আরিয়ানাকে না পেলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তার শরীর। একবার মনে হলো, এই যন্ত্রণা সহ্য করার মতো নয়। নিজেকে বইয়ে দিয়ে ইন্দ্রিয়গুলো শিথিল না করতে পারলে ঘুম আসবে না সারারাত। চকিতে একবার সুসানার কথাও মনে এলো তার। সুসানও সুন্দর, ভীষণ সুন্দর, তবু আরিয়ানার মতো নয়। আচ্ছা, সুসানকে কি সে কখনো এতো তীব্রভাবে কামনা করেছে? মনে পড়লো না। সুসানের কাছে সে চেয়েছে প্রেম, আর আরিয়ানার কাছ থেকে এই মুহূর্তে চাইছে শরীর। প্রেমিক নয়, নিজেকে কামুক মনে হলো তার। আর তখন মনে হলো, সে তো প্রেমিক হতে চায়। প্রেম ছাড়া শরীর তো চায়নি সে কোনোদিন। নিজেকে শান্ত করতে সময় নিলো ঋভু, ধৈর্য ধরার সিদ্ধান্ত নিল, অন্তত কালকের দিনটা দেখা যাক। আরিয়ানাকে আরেকটু বুঝে ওঠার চেষ্টা করা যাক। যদি সেও চায় তাহলে হতে পারে শরীরবিনিময়। চায় কি না সেটা আগে বুঝতে হবে, এর বিকল্প নেই।

পরদিন সকালে দেখা হতেই আরিয়ানা জিজ্ঞেস করলো, ঘুম কেমন হলো তোমার?

ভালো না।

কেন?

সারারাত তোমার কথা ভেবেছি।

সত্যি?

হ্যাঁ।

তাহলে ডাকলে না কেন?

কোথায় ডাকবো?

তোমার কাছে!

তুমি আসতে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসতাম।

ধুর! ওভাবে রাতদুপুরে ডাকা যায় নাকি?

আরিয়ানা ঘাড় কাত করে একটা বিহঙ্গ ভঙ্গি করে বললো – তাহলে রাতগুলো কি এভাবেই কাটবে?

ভাবছি!

কী ভাবছো?

এখন বলবো না।

কখন বলবে?

আগে বলো, আজকে তোমার প্ল্যান কী?

কোনো প্ল্যান নেই। কালকের মতো সারাদিন তোমার সঙ্গে থাকবো।

তাহলে কোনো একসময় বলবো।

আরিয়ানা হঠাৎ করেই সামনে এসে দাঁড়ালো, দু-হাতে আহ্লাদী ভঙ্গিতে গলা জড়িয়ে ধরে বললো, না, এখনই বলো।

এখনই? পরে বললে হয় না?

না, এখনই …

বলতে চাইছিলাম …

হুঁ, বলো …

সারাদিন তো একসঙ্গেই কাটাচ্ছি। রাতেও একসঙ্গে থাকলে কেমন হয়?

আমি রাজি।

রাজি? সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

এতো সহজে রাজি হবে, বুঝিনি।

বুঝলে কী করতে?

বুঝলে কালকেই বলতাম।

তুমি একটা বোকা ছেলে। কিচ্ছু বোঝো না।

এখন তো বুঝলাম। চলো দেখি, ডবল-বেডের রুম খালি আছে কি না।

ও নিয়ে ভেবো না। এতো হোটেল, কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবেই।

খুঁজতে হলো না অবশ্য, হোটেলের রিসেপশনে জিজ্ঞেস করতেই পাওয়া গেল বড়ো রুম। ঋভু নিজের রুমের জিনিসপত্র নতুন রুমে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে আরিয়ানাকে নিয়ে গেল ওর হোটেলে। পাওনা চুকিয়ে লাগেজ নিয়ে ফিরলো ফের নিজের হোটেলে। তারপর বেরিয়ে পড়লো ঘুরতে। একবার অবশ্য ভেবেছিল, আরিয়ানাকে এখনই রুমে নিয়ে গিয়ে …। কিন্তু নিজেকে সামলালো ঋভু।

 সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে, সন্ধ্যায় ফের পান করে, দুজনে ফিরলো একই হোটেলে, একই রুমে। ঋভু তখন চব্বিশ বছরের তরুণ আর আরিয়ানা কুড়ি বছরের তরুণী। শরীরে শরীর মিশে যাওয়ার সেই তো উৎকৃষ্ট সময়। ঋভুর অবশ্য মনে পড়ে গিয়েছিল, এই তার প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। বছর তিনেক আগে এক অভিজ্ঞ-বিবাহিত নারী তাকে শিখিয়েছিল শরীরী ভাষার রূপ। প্রথমবার সে ভয়েই কিছু করতে পারেনি, কিন্তু ওই নারী ছিল সহযোগিতাপ্রবণ; সাহস দিয়ে, উদ্দীপনা দিয়ে তৈরি করে নিয়েছিল তাকে। হয়তো সেজন্যই পরের সঙ্গমগুলো ছিল দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ আর তৃপ্তিকর। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগলো এবারো। সম্ভবত আরিয়ানার প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল ওটা। ওর শরীরের কাঁপন, অজানা ভয়, দ্বিধা থরথর আলিঙ্গন দেখে সে-কথাই মনে হয়েছিল ঋভুর। কিন্তু প্রথমদিনের পরই সব দ্বিধা আর ভয় কেটে গেল ওর। পরের এক সপ্তাহ কী যে উদ্দাম সময় কাটলো! ঋভুর মনে হলো, দীর্ঘ অবসাদের পর এ যেন এক প্রকৃতিপ্রদত্ত উপহার। এতোদিন পরও সেই স্মৃতি মনে করে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো সে! হায়, এখন আর কেউ নেই কাছে সেই উত্তাপ শুষে নেওয়ার। (চলবে)