জলের গভীরে

অনেকদিন হলো মন্মথপুরে কোনো উত্তেজনার ছোঁয়া নেই, সব হাওয়া।

উত্তেজনা বলতে অন্য কিছু নয়,

প্রেম-ভালোবাসা তো নয়ই, এখানে উত্তেজনার অপর নাম মারামারি-কাটাকাটি। এটা সবাই জানে।

মাস ছয়েক আগেও ব্যক্তি আর গোষ্ঠী বিবাদে জর্জর হতো মন্মথপুর। যখন-তখন তুলকালাম বেধে যেত এলাকায়। রাস্তায় উষ্ণ রক্তের ভেতর গড়াগড়ি খেয়ে গোঙাত রামদার কোপ খাওয়া কিংবা টেঁটাবিদ্ধ মানুষজন, কেউ ভয়ে সেদিকে এগোত না। পুলিশ না আসা পর্যন্ত বিবাদ চলতেই থাকত। এ এক তুমুল অরাজক আর বিভীষিকাময় অবস্থা। ভাবলেও নিরীহ গ্রামবাসীর বুক দুরুদুরু করে, ক্ষণে ক্ষণে শিউরে ওঠে অন্তর।

সকালবেলার শান্তশিষ্ট গ্রাম – পাখিদের কিচিরমিচির, পুবাকাশে গড়িমসি করা লাল টুকটুকে সূর্য, ক্ষেতে-খামারে কিষানের রোজকার পদচারণা, হাটে-বাজারে সওদার পাহাড় আর সেগুলি দেখতে লোভী ফড়িয়ার দল, দূরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্দেশে বুকের সঙ্গে চেপে রাখা বই-খাতা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিশিরভেজা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যাওয়া, মোরগ-মুরগির অবিরাম কক্কক্, গরু-বাছুরের হাম্বা আর দলবদ্ধ পাতিহাঁসের প্যাঁক-প্যাঁক শব্দের ভেতর মুখ গুঁজে থাকা ধীরস্থির স্বস্তিময় চেনা এক গ্রাম, চেনা পরিবেশ, চেনা মানুষ – সবকিছু স্বাভাবিক, প্রশান্তির প্রলেপে একেবারে মাখো-মাখো।

সহসা কথা নেই, বার্তা নেই, হাটের দিনে বাজারের এক টি-স্টলে বেধে গেল ঝগড়া। প্রথমে চায়ের কাপ আগে-পরে পাওয়ার মতো তুচ্ছ কারণ নিয়ে দুজন চাখোরের ভেতর বাদাবাদি; তারপর উত্তরপাড়া আর দক্ষিণপাড়ায় চাপা ক্ষোভ আর দলাদলি, চারপাশে থমথমে পরিবেশ – কখন কী হয়, দুপুর গড়াতেই শুরু হয়ে গেল যুদ্ধের মাতম। প্রথমে হাতাহাতি, তারপর বল্লম-রামদা-টেঁটা নিয়ে হইহই-রইরই ছোটাছুটি। একদল ইট মারে তো অন্যদল টেঁটা ছুড়ে মারে তাক করে। কেউ এগিয়ে যায় রামদা হাতে, তো অন্যরা পিছু হটে ভয় পেয়ে। পুরো গ্রাম তখন যুদ্ধক্ষেত্র, উত্তেজনা ও উল্লাসে বুড়ো মানুষের হাতে ধরা চায়ের পেয়ালার মতো কাঁপতে থাকে চারপাশ। যত সময় গড়ায় তত নারকীয় হয়ে ওঠে পরিবেশ। পোষা মুরগিও তখন বাইরে বেরিয়ে কক্কক্ শব্দ করে বাড়ির সামনে মাটি থেকে শস্য খুঁটতে ভয় পায়। টিনের চালে বসে কোনো দাঁড়কাক সামান্য কা-কা করে উঠলেও বাচ্চারা কেঁপে ওঠে ভয়ে, বুড়োরা দরজা-জানালা  বন্ধ করে দিয়ে নিরাপত্তা খোঁজে ঘরের ভেতর। বউ-ঝিরা কোলের সঙ্গে লেপ্টে রাখে বাচ্চাদের। এ-সময় পরিবারের কমবয়সের নিরীহ কেউ বাইরে থাকলে অজানা শঙ্কায় মুরুব্বিদের অন্তর কাঁপে। মোবাইল ফোনে শোনা যায় তাদের নিরন্তর আর্তনাদ, তুই কই বাপ? ভালা আছোস তো, কুনসময় ঘরে আইবি? – জাতীয় প্রশ্নের পর প্রশ্ন। বলা তো যায় না কার গরদিশ কার ওপর দিয়ে যায়!

অথচ সেই উদ্দাম-উচ্ছৃঙ্খল ও উদোম মন্মথপুর এখন আর নেই। পুরো পাল্টে গেছে আগেকার চেনা চালচিত্র। ভুঁইয়া বাড়ি, খান বাড়ি, সৈয়দ বাড়ি, উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেপিলে সব এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের মতো বড়বড় শহরে, ভদ্র-সভ্য হয়ে পড়াশোনায় বা কামে-কাজে মজে রয়েছে, অকারণ রাক্ষুসে গোসা যখন-তখন আর রক্তস্রোতকে উদ্দাম করে তোলে না আগের মতো।

এর কারণ রয়েছে। বছর দশেক আগে ঘটা নিরীহ-নির্বিরোধ এলাকার জনপ্রিয় মুরুব্বি গেদু মুন্সীর মৃত্যুকে ঘিরে চোখের সামনে পরিচিত দুই বাড়ির তরতাজা দুই যুবকের ফাঁসি হওয়ার পর থেকে নিস্তেজ হয়ে গেছে সব, মুষড়ে পড়েছে গ্রামের যুদ্ধপ্রিয় লোকজন। পরিণতির কথা ভেবে এখন আর কেউ হাতে টেঁটা-বল্লম-রামদা নিতে চায় না – জমানো সব অস্ত্রশস্ত্র তাই পুকুর-ডোবার তলদেশে এখন, সাপ-ব্যাং আর মাছের আশ্রয়।

আগের তুলানায় এ যেন একটা মড়া গ্রাম। শীতকালের সাপের মতো, ঠান্ডা বরফের স্রোত সবখানে। মন্মথপুরের উত্তেজনা এখন কাটা ঘুড়ি হয়ে আটকে রয়েছে গাছের মগডালে। মাঝে মাঝে বাতাস পেলে পতপত করে শুধু নড়ে। মনে হয়, এবার বুঝি বা একটা উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে আশেপাশে। কিন্তু একটু বাদে যেই-সেই। ঘুড়িটা আরো আটকে থাকে, সুতো জড়িয়ে যায় ডালে-ডালে।

একদিন শীতের মনোরম এক ভোরবেলায় হঠাৎ করেই ঘুড়িটা ছাড়া পেয়ে গেল। বাতাসে ঢেউ তুলে ভাসতে থাকে খোলা আকাশে। সবার চোখেমুখে উত্তেজনা। কোথাকার ঘুড়ি কোথায় গিয়ে পড়ে – তা নিয়ে সবার মনে ব্যাকুলতা।

শেষ পর্যন্ত ভাসমান ঘুড়িটা গিয়ে জিন্দা মিঞার বাড়ির চালে কুমড়োর শিশিরধোয়া লতায় আটকে থাকে।

তখন জিন্দার বাড়ির উঠোন জুড়ে তুমুল হইচই, তোলপাড় আর উত্তেজনা!

নিতাই দাস যাচ্ছিল সাত সকালে শীতের শুকনো বিলে টেঁটা-জাল নিয়ে মাছ ধরতে। শীতের শুরু, খোকা-খুকু বাঁধাকপি-ফুলকপিগুলি ক্ষেতজুড়ে মাথা দোলাচ্ছে, এখনো ভরা যৌবনের ছোঁয়ায় ফুলেফেঁপে ওঠেনি। কদিন বাদে শীত যখন মাকড়সার ঘন জাল বুনবে চারপাশে তখন ঘন হয়ে শিশির জমবে লালশাক, পালং শাক আর ফুলকপি-বাধাকপির জমিতে। আলু ক্ষেতে, ফসল উঠবে মণে মণে।

নিতাইয়ের কাঁধে জাল, হাতে ধরা মাছ ধরার টেঁটা। ঘটনা জেনে সে-ও ছুটে এসেছে জিন্দার বাড়ির আঙিনায়। ঢেউটিনে ঘেরা তিনটি উঁচু ভিটার ঘর নিয়ে ওদের বাড়ি। মাঝখানে উঠোন। উঠোনের চারপাশে বিশ্বস্ত পাইক-পেয়াদার মতো আম-কাঁঠাল, নারকেল-সুপারির সারি আর বীচি কলার ঝোপ। এর ভেতর কচি একখানা নারকেল গাছের নিচে দুটো স্যাঁতসেঁতে কাঠের চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে জিন্দা মিঞার আব্বা আর আম্মা। তাদের সামনে টুলের ওপর পিতলের পানের বাটা। দুজনার মুখ পানের রসে টইটম্বুর, ঠোঁটজোড়ায় সেই রসচিহ্ন। তা সত্ত্বেও সূক্ষ্ম একটা অহংকারী প্রলেপ তাদের চেহারার পরতে পরতে। দূরে দাঁড়িয়েও নিতাই তা বুঝতে পারে ।

মানুষ উপচে পড়ছে উঠোনে। উত্তরপাড়া দক্ষিণপাড়া মিলেমিশে একাকার। বউ-ঝিরা একদিকে, যে যত লম্বা তার তত সুবিধা। ঘাড় উঁচিয়ে কোথায় কী ঘটছে সহজেই দেখতে পাচ্ছে। খোলা উঠোনে বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়ে রং দেখতে উদগ্রীব তারা। এর ভেতর কার বাচ্চা যেন কার পায়ের ওপর হেগে ফেলেছে, এই নিয়ে খানিক হই-হট্টগোল আর মন কালাকালি।

নিতাইর চোখ এখন চড়কি। এতো মানুষ চারদিকে, কিন্তু আসল মজা কই? যার কথা শুনে কাজকর্ম ফেলে ছুটে এলো, সেই জিন্দা আর তার বরফসুন্দরী বউ কই?

ওর দুই ভাই রমজান আর হেকমত কাঁচুমাঁচু হয়ে দাঁড়ানো আব্বা-আম্মার পাশে; বউদের চেহারা পাটদড়ির মতো চিমসানো। পাড়া-প্রতিবেশী সবার ভেতর মুখ ভরা হাসি আর ঠেসঠাট্টার জোয়ার লেগে থাকলেও ওরা কজন কেবল গোমড়ামুখো; নিতাই বুঝতে পারে না কেন। হয়তো জিন্দার আচানক সৌভাগ্যে ওদের সবার ভেতর হ্যাঁচকা টান লেগেছে, তাই।

এরা আদতে মাছের ব্যাপারী। নিতাইদের মতো জেলেদের কাছ থেকে কমদামে নদী-বিলের মাছ কিনে বেশিদামে বাজারে বিক্রি করে মুনাফা গোনা এদের পেশা। ইদানীং শহরে মাছ চালান দিয়েও এরা দেদার কামাচ্ছে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটা পিকআপ ভ্যান নাকি কিনবে – কদিন আগে জিন্দা ওকে গর্ব করে বলে গেল সে-কথা। হাতে ওর স্মার্ট ফোন। পরনে লাল-নীল চেক শার্ট। পানের বাটার মতো চেহারায় জৌলুস, মনে হতেই কেন যেন দমবন্ধ লাগে নিতাইর।

বর্ষার শেষ আর শীতের শুরু এখন। এসময়টায় নিতাইর বড় তাড়া থাকে। বিলের জলে শীতের টান, ঝাঁকে ঝাঁকে পাঁচমিশালি মাছ ওঠার সময় জালে। ঠিকঠাক জাল আর টেঁটা মারতে পারলেই হলো। দেরি হলে অন্যরা ভাগ বসাবে।

সে এখানে এসেছে শুধু জিন্দাকে দেখতে। ঠিক তাও নয়। নিতাই শুধু জিন্দার বিদেশি অপরূপ সুন্দরী বউটাকে একটুখানি দেখতে চায়। না দেখে যে নিস্তার নেই ওর!

ওরা একসঙ্গে বড় হয়েছে মন্মথপুরে; কদিন আগেও লুকিয়ে দুজন গাঁজা টেনেছে নৌকার পাটাতনে বসে। বিশাল তার শরীর-স্বাস্থ্য। মেজাজও সেরকম উগ্র। একটুতেই ক্ষেপে আগুন।

যখন-তখন রামদা নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়িয়ে যায়। খুনের মামলায় জড়িয়ে বেশ ক-বছর গা-ঢাকা দিয়ে থেকেছে পাশের গ্রামে। ওর মা-বাবা ভেবেছিল, বিয়ে করালে স্বভাবের উগ্রতা কিছুটা কমবে। কিন্তু যৌবনের শুরুতে জিন্দা বিয়ে করতে রাজি হলো না। বিয়ের কথা বললেই বাঁধা উত্তর, ‘অহন না। পরে।’

এজন্য ওর সমবয়সী অনেকেই মুচকি হেসে মন্তব্য ঝাড়তো, ‘হালার পো’র জিনিস নাই।’

পাশ থেকে একজন উত্তর কাটে, ‘জিনিস তো আছে। ছোডবেলায় দেখছি না?’

বিটলা কিসিমের অন্যজনের মন্তব্য, ‘তুই আবার কেমনে দেখলি?’

‘হারাদিন ল্যাংটা অইয়া কত ডুবাইছি বিলে, দেহুম না?’

‘তাইলে বিয়া করবার চায় না কেরে হারামির পো? সমস্যা কই? আমরার পোলাপান বিয়ার লায়েক অইয়া যাইতাছে আর হালা অহনও মাঞ্জা দিয়া গুইরা বেড়ায়? ’

‘কার বালে জানে? ধইরা নে মেশিন নষ্ট।’

‘আরে মেশিন ঠিকই আছে, পাওয়ার নাই। হেহেহে।’ নিতাইর বন্ধুরা আড়ালে জিন্দাকে নিয়ে এভাবেই নিয়মিত মশকরা করে বেড়ায়। সামনে বলবার সাহস নেই। মেজাজ চড়ে গেলে প্রকাশ্যে মারধর করতে পারে, এই ভয়ে।

সেই জিন্দার বিয়ের গায়ে-হলুদ আজ। প্রেমের টানে কনে তার মা-বাবাসহ উড়ে এসেছে সুদূর ইউরোপ থেকে। এমন উদ্ভট, আচমকা ঘটনা কেউ এ-গ্রামে আর কখনো শোনেনি। একটা স্মার্ট মোবাইল ফোনের এতো ক্ষমতা? সারারাত জেগে জেগে একথাটাই ভেবেছে নিতাই।

গতকাল রাত দশটার দিকে নিরিবিলি-নির্জন মন্মথপুরে হঠাৎ করেই বেজে উঠল ঢোল। কাঁথার নিচে ওম নিচ্ছিল নিতাই, শব্দ পেয়ে উদোম শরীরে বাইরে এসে দাঁড়ায়। শীত তেমন পড়েনি, বাতাসটা শরীরে একধরনের মোলায়েম পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আকাশে অর্ধাকৃতি চাঁদ, আশেপাশে বন্ধুবান্ধবের মতো অজস্র তারা, মনে হচ্ছে, বিলের ওপর থেকে নির্ণিমেষে তাকিয়ে রয়েছে, অধরা নিকষ অন্ধকারের দিকে মুখ কাত করে।

ঢোলের শব্দ উত্তরপাড়ার জিন্দাদের বাড়ির দিক থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো গ্রামে। ব্যাপারটা নিতাইর মোটেই বোধগম্য নয়। সে বোঝার চেষ্টা করতে থাকে, ঘটনাটা কী। গ্রামে এমন কি শুভযোগ ঘটল যে ওর জানা নেই?

এসময় মাটির চিকন ঢালু রাস্তা ধরে ছুটে চলতে থাকা সেলিমের মাকে চোখে পড়ে যায় ওর। সঙ্গে সঙ্গে সে জোর গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কিতা অইছে গো মাসি? কার বাইচ্চা অইছে?’

মন্মথপুরে যা কিছু ঘটে সবকিছুর লবণ-হলুদ সেলিমের মা; জামাই নেই, একটাই ছেলে, সে-ও মালয়েশিয়ায়, হাতভরা টাকা পাঠায় মাসে মাসে। সবার সব বিপদে-আনন্দে এ-গ্রামে আর কেউ থাকুক বা না থাকুক, সেলিমের মাকে পাওয়া যাবেই।

‘খাইয়া নাচুনি। তর বন্ধু জিন্দার বিয়া? তুই জানছ না?’

নিতাই আকাশ থেকে পড়ল। সত্যি সত্যি কি জিন্দার বিয়ে? সহসা মনে পড়ল, শক্তিপদ বিকালে কিছু একটা বলেছিল এ-ব্যাপারে, সে গা করেনি।

‘আমরা কিছুই জানলাম না, হুনলাম না। বিয়া ঠিক অইলো কেমতে গো মাসি?’ মুখ কাত করলেও কথাটা মিথ্যা। শক্তিপদর কাছে নিতাই বিকালেই খবরটা পেয়েছে। হয়তো শক্তির কথায় ওর বিশ^াস জন্মায়নি কিংবা পাত্তা দেয়নি।

‘বিদেশি বেডি। পিরিতের টানে অজপাড়াগাঁয় আইয়া পড়ছে বাপ-মা লইয়া। হুনছি, মাইয়ার বরফের লাহান গতরের রং। বাফের জন্মে হুনি নাই, দেহিও নাই। যাই দেহি গা।’

সারারাত ঘুম হয়নি নিতাইর। একটাই চৌকি, পাশে কঙ্কালসার চেহারার বউ সুরবালা আর পিঠাপিঠি দুই গ্যাদা বাচ্চা। ক্ষুধা, রোগ-শোক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যাদের নিত্যসঙ্গী। তাদের জীবন এরকমই, চুনোপুঁটির মতো অকিঞ্চিৎকর।

ওদের কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে নিতাই পাশ ফিরে শোয়। তারপর রাতভর জিন্দার অলৌকিক বউর কথা ভাবতে থাকে; ভেবে-ভেবে সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোররাতে উঠে নিত্যদিনের মতো কাঁধে জাল আর হাতে শোল-বোয়াল ধরার টেঁটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভোরের পাতলা অন্ধকারে চেনা রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে সহসা থমকে দাঁড়ায় সে।

জিন্দার ভাবনা কিছুতেই নিতাইকে বিলের দিকে এগোতে দিচ্ছে না। এক পা এগোলে দু-পা আটকে থাকছে। এখন মাছ ধরার ভরা মৌসুম, তাও পা নড়তে চাইছে না। মনে মনে একটা গালি দেয় জিন্দাকে, ‘দূর হ, বদমায়েশ, দূর হ।’ তবু ভুতুড়ে সেই ছায়া ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। এতো তীব্র এই ভাবাবেগ যে বুকের ভেতর বারবার করে চাবুক কষাতে থাকে। অগত্যা কাঁধের জাল আর হাতে টেঁটা নিয়েই রওনা দেয় জিন্দার বাড়ির দিকে, পরনে ধুতি আর ময়লা ফতুয়া।

দূর থেকে সে দেখতে চায় জিন্দার বিয়ে করা বউকে। সে নিজে একটা চড়ুই হলে ভালো হতো। চুপচাপ ওর বিদেশি বউকে একবার দেখেই নিরিবিলি ফিরে আসতো নিজের জায়গায়। কেউ জানতো না, বুঝতো না কিছুই। কিন্তু সবার সামনে দিয়ে জিন্দাদের বাড়ি যেতে কেন যে এতো লজ্জা লাগছে ওর, তা সে নিজেও বুঝতে পারে না।

একটা পুরনো কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করতে থাকে। এসময় চোখের সামনে জিন্দার নানা কীর্তিকলাপের কথা ভেসে ওঠে এক-এক করে। বিয়ের আগে ওর যা নারীসংসর্গ সব জিন্দার হাত ধরেই হয়। শহরের নটিবাড়ির আঙিনা সে-ই ওকে হাত ধরে চেনায়, প্রথম গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস জিন্দাই ধরায়। সোজা কথায় ওর জীবনে যা কিছু একান্ত গোপনীয় সব জিন্দার অবদান। একসময় মনে হলো, এভাবে জিন্দার পিছু ঘুরে বেড়ালে ওর আর ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকবে না। ব্যস, হুট করে দময়ন্তীকে বিয়ে করে সংসারী বনে গেল নিতাই। তখন মুখভরা হাসিতে উপচে পড়তো ওর অন্তরের সুখ। জিন্দার মুখ আমসি। একবার গোপন রোগে জীর্ণ-শীর্ণ হলো জিন্দার শরীর। শহরে গিয়ে ইনজেকশন নিয়ে সেরে উঠল ঠিকই; কিন্তু এ বাবদ নিতাইর কাছে জিন্দার ধার হলো দু-হাজার টাকা। শতবার চেয়েও সেই টাকা ফেরত পায়নি সে। একদিন টাকা চাওয়ায় জিন্দা মুখের ওপর আচমকা বলে উঠলো, ‘আমিও তর লাহান বিয়া করুম। দেহিস। তহন দিমু।’ নিতাই মনে মনে হাসে। ‘তর কাছে কোন বেডা  হের মাইয়া দিব?’ – প্রশ্নটা সে চেপে রাখে ভেতরে। ক্রমে জিন্দার বয়স বাড়ে; পকেটে কিছু টাকাকড়ি আসে শহরে মাছ চালান দিয়ে। হাতে মোবাইল আর চোখে চশমা পরে ভদ্রলোক সাজে। মাঝে মাঝে ভিনগাঁও থেকে বিয়ের আলাপও আসে; কিন্তু কিছু হওয়ার আগেই অকালে সেসব ঝরে পড়ে। পেছনে কারা যেন ফিসফাস করে কীসব বলে দেয়। তারপরই মেয়ের পিতা-পরিজন গা-ঢাকা দেয় অন্ধকারে। জিন্দা নিতাইর কাছে এসে চেঁচায়, ‘কোন শুয়োরের বাইচ্চার কাম এইডা? পাইলে জবেহ দিতাম হাটের দিন।’ মেজাজ পড়লে নিতাই বলে, ‘বাদ দে দোস্তো। সবার কপালে সব থাহে না রে।’

‘হ। ঠিকই কইছস। আমার কপালে বিয়া নাই। আগে খালি না করছি। অহন চাইয়াও পাই না। তরাই ভালা আছস। সময়ের কাম সময়ে সাইরা ফেলাইছস।’ বলে একটা বড় দীর্ঘশ^াস চাপে। নিতাইর করুণা হয় ওর প্রতি। না-পাওয়া দু-হাজারের জন্যে মোটেই ক্ষোভ জমে না ভেতরে।

সেই চিরচেনা জিন্দা বকফুলের মতন সাদা-সফেদ এক বিদেশি পরীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তুলে এনেছে এ-গ্রামে, তা কি না দেখে সে পারে? বুকটা ফেটে যাচ্ছে, চৌচির হচ্ছে দুঃখে। তবু দেখতে এসেছে সে। চুপি চুপি এক ঝলক দেখেই সে কেটে পড়বে এখান থেকে। তাই নিজেকে কাঁঠালগাছের আড়ালে রেখে সব পরখ করে নিচ্ছে সে। জিন্দার মা-বাবা, ভাই-ভাবি সবাইকে চোখে পড়ছে। পাড়া-আটির লোকজনে গিজগিজ করছে উঠোন। কিন্তু যাকে ঘিরে এ-উত্তেজনা সেই পরী কই?

পুবাকাশে লাল কার্প মাছের মতন সূর্য উঁকি মারছে। তরল কুয়াশা চারপাশে, গাছগাছালির ফাঁকফোকর ভেদ করে সেই রেশ ছড়িয়ে পড়ছে জিন্দাদের উঠোনে। নিতাই শুধু একঝলক দেখতে চায় নতুন বউকে। মনে মনে সাদা বরফের ওপর দুধের ক্ষীর ছড়িয়ে গাঁদাফুলের হলুদ পাপড়ি ছিটিয়ে দেয় সেখানে। এর ওপর ঘষা কাচের মতো দেখতে কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটু একটু করে প্রতিফলিত মিঠে-নরোম সূর্যের কিরণ এসে লুটিয়ে পড়ে। সেই দ্যুতির ভেতর ঝিকমিক করছে জিন্দার বউ, হাসছে, খেলছে আর আনন্দে হাততালি দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছে। স্বর্ণকেশী বিদেশিনীর লাল ঠোঁট, চোখ, গ্রীবা, স্তন, কোমর, জংঘা – সব যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিতাই। তৃষ্ণার্ত মন সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে কাঙালের মতো। এ দেখা যেন কখনো শেষ না হয়, ছায়াচ্ছন্ন কাঁঠালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে সে মনে মনে তা-ই কামনা করে।

সহসা নিতাইর এ-ঘোর ভেঙে দেয় সুরবালা। ওর বউ। শিকারি চোখ ঠিকই খুঁজে নেয় ওকে, একমুখ হাসি দিয়ে বলে ওঠে, ‘তুমি ইগন? কান্দে জাল আর হাতে টেঁটা লইয়া ইগন কিতা কর? বিলে যাও নাই?’

নিমেষে মুখটা তেতো হয়ে যায় ওর, মনটাও হয়ে ওঠে ঝাপসা। নিস্পৃহ গলায় জিজ্ঞাসা করে, ‘জিন্দার বউডারে দেখছস?’

‘হ। ঘরের ভিতরে বউ। এমুন সুন্দর, মনে অয় য্যান গন্ধরাজ। হিহিহি। যাও না ভিতরে? কাডলগাছের তলে লুকাইয়া কিতা কর? তুমারই তো বন্দু। দেইখ্যা আইয়ো। চল যাই। একটু পর হলুদ মাখাইবো। ফরি নাইম্যা আইছে মাডিত। জিন্দাভাইর কফাল একটা। রাজ কফাল। যাও না, দেইখ্যা আও?’ উচ্ছ্বাস ঝরায় সুরবালা।

‘আমার বালের ঠেকা পড়ছে দেহনের। আর ঘরের কামকাজ ফালাইয়া তুই ইগন কিতা করছ? বেডা দেহছ? যাহ্।’ বলে সে হনহন করে হেঁটে চলে যায় বিলের দিকে। ডাঙায় পুঁটলি করে ধুতি-ফতুয়া রেখে, উদোম শরীরে পরনে শুধু একটা নেংটি সম্বল করে, জাল আর টেঁটা হাতে নেমে যায় ঘোলা হাঁটুজলে।

অথচ বিলের ঠান্ডা জলে ডুব দিয়েও সে শান্তি পাচ্ছে না। জালে-টেঁটায় ধরা পড়া মাছগুলিকে শত্রু বলে মনে হচ্ছে ওর। ডাঙায় আছাড় মেরে মেরে ওদের প্রাণ নেওয়ার জন্যে হাত নিশপিশ করছে। উথালি-পাথালি মন এখন নিতাইর।

অনেকক্ষণ থেকে ডাঙায় বসে শক্তিপদ ওর এরকম অস্থিরতা লক্ষ করছে। বয়সে ওর চেয়ে ছোট হলেও কৈবর্ত আটির হারামি পুরুষ হিসেবে ওর দুর্নাম আছে। ঘরে বউ থাকলেও নানা সম্পর্কে যখন তখন জড়িয়ে যায় সে। শক্তিপদর প্রধান গুণ হচ্ছে সে সবার বন্ধু হতে পারে অনায়াসে।

সে ইশারায় ওকে ডেকে নেয় কাছে। তারপর জিজ্ঞাসা করে, ‘কিতা অইছে কাঁহা?’

রাগত চোখে নিতাই তাকায় ওর দিকে। অনেকক্ষণ পর সে শক্তিপদকে প্রশ্ন করে, ‘একটা ইস্মাটফোনের দাম কত রে শক্তি? দুই হাজারে কিনন যাইবো নি ভাতিজা?’

‘অ। এই লাইগা মন খারাপ? তয় এই বুইড়া বয়সে ইস্মার্ট ফোন দিয়া কিতা করবা?’ হেসে ওঠে বিটলা শক্তিপদ।

‘বাল ছিঁড়ুম।’ বলে সে কোনদিকে না তাকিয়ে ফের জাল ফেলে বিলের জলে।

জালের ভেতর ছোটমাছ খলবল করে লাফায়। মাছেদের নিষ্ফল লাফ-ঝাঁপের দিকে নিতাই চোখ তাক করে রাখে কিছুক্ষণ ।

এ-সময় জিন্দার কাছে না-পাওয়া দু-হাজার টাকার জন্যে সহসা মনটা আকুলি-বিকুলি করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে রাগ জন্মায় সেখানে; একসময় কাকে যেন গালি দিয়ে ওঠে সে, শুয়োরের বাইচ্চা!