জসীমউদ্দীন

আনিসুজ্জামান

বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে জসীমউদ্দীনের আত্মপ্রকাশ, বলা যায়, ১৯২৫ সালে, কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কবর’ কবিতা দিয়ে। আমরা জানি, ১৯২৩ সালে কল্লোলের প্রতিষ্ঠা ঘটে সেইসব তরুণ লেখকের মুখপত্ররূপে, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের সর্বব্যাপী প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন এবং প্রেরণা নিয়েছিলেন সমকালীন ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে। তাঁরা নিজেদের দাবি করতেন আধুনিক বলে এবং প্রাত্যহিক জীবনের অন্ধকার বাস্তবতা ও মানবমনের গভীরে এমন তীক্ষè দৃষ্টিপাত করতেন, যা তাঁদের পূর্বসূরিরা কখনো করেননি। এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় যে নিজের কবিতা প্রকাশের জন্যে কল্লোলকেই বেছে নিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরে এক কলেজ-পড়–য়া জসীমউদ্দীন। কল্লোলের প্রধান লেখকদের মতো আধুনিক তো নিশ্চয় তিনি ছিলেন না। তাঁর জগৎ ছিল একান্তই গ্রামীণ; যেসব মানুষকে তিনি অন্তরঙ্গভাবে জানতেন, তাঁরা সবাই ছিলেন মাটির সঙ্গে বাঁধা। তাঁদের মতোই জসীমউদ্দীন ভালোবাসতেন লোকসাহিত্য ও পুথিসাহিত্যকে। পুথিসাহিত্য বলতে যা বোঝাতো, তার সূচনা হয় আঠারো শতকের মধ্যভাগে – ক্রমান্বয়ে হুগলি, কলকাতা ও ঢাকায়; এ-ধারার কবিরা ফারসি ও হিন্দুস্থানি থেকে প্রণয়গাথা ও যুদ্ধকাহিনি আরবি-ফারসিবহুল বাংলা পদ্যে অনুবাদ করে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। গ্রামীণ উৎসব, পালা-পার্বণ ও প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি জসীমউদ্দীনের আকর্ষণ ছিল। যদিও তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুরাগী ছিলেন, তবু তাঁর কবিতারচনার শুরুতেও রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। কল্লোলের দ্বিতীয় বর্ষে পরপর দু সংখ্যায় তাঁর দুটি কবিতা প্রকাশ পায়, তবে তা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু ওই পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় ‘গ্রাম্য কবিতা’ পরিচয়ে মুদ্রিত ‘কবর’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল।
কী ছিল সেই কবিতায় যাতে তা কল্লোলে স্থান পায় এবং অচিরেই  – তাঁর ছাত্রাবস্থায়ই – অন্তর্ভ্ক্তূ হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্যে পাঠ্য বাংলা সাহিত্যসংকলনে? এটি শতাধিক চরণের এক দীর্ঘ আখ্যান-কবিতা : দুঃখভারাক্রান্তহৃদয় পিতামহ তার একমাত্র বংশধরকে ছেলেটির দাদি, বাপ, মা, ফুফু ও বড় বোনের কবর দেখিয়ে স্মরণ করছেন তাদের জীবদ্দশার নানা কথা। বিষয়টা নিঃসন্দেহে শোকাবহ, তবে অসাধারণ অভিজ্ঞতার পরিচয়বাহী নয়। বরঞ্চ মৃত্যুর পৌনঃপুনিকতা এর ট্রাজিক পরিণামকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করতে পারতো। তা যে হয়নি, তার কারণ, জসীমউদ্দীনের অসাধারণ উপস্থাপনা। পৌনঃপুনিকতা সত্ত্বেও তাতে আশ্চর্যজনক সংযম আছে, সরলতা সত্ত্বেও আছে তীব্রতা। কবিতার ভাষা প্রমিত বাংলাই, তার সঙ্গে মিশেল আছে আঞ্চলিক শব্দের – কিছু, কিন্তু প্রচুর নয়।  এর ছন্দ ও অলংকারও অসাধারণ কিছু নয়, কিন্তু কবিতার আগাগোড়াই ধ্বনিত হয়     আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা, যার ফলে এর বস্তু হানা দেয় পাঠকের মর্মস্থলে। সচেতন অলংকরণের প্রয়াস থেকে নিবৃত্তি, আবেদনের প্রত্যক্ষতা এবং আঞ্চলিক স্বাদগন্ধ – গোবিন্দচন্দ্র দাসের আঞ্চলিক আবহের চেয়েও কিছু অধিক – কবিতাটিকে আলাদা করে দিয়েছিল বাংলা  কবিতার  মূল ধারা  থেকে – তা সে রাবীন্দ্রিক বা আধুনিক যা-ই হোক না কেন।
‘কবর’ এবং আরো কতকগুলি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় জসীমউদ্দীনের প্রথম কাব্য রাখালী (১৯২৭)। সেটি রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ এবং আরো অনেক সুধীজনের প্রশংসা লাভ করে, সাধারণ পাঠকের কাছেও সমাদৃত হয়। সেই থেকে ‘পল্লিকবি’ বিশেষণটি তাঁর নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়, যদিও তা সংগত হয়নি। অনেককাল পরে দুসান জবাভিতেল যেমন বলেছিলেন, জসীমউদ্দীন পল্লিকবিতা লেখেননি, পল্লিবাসী সম্পর্কে  কবিতা  লিখেছেন।  তবে সে-কথা আলোচনা করার আগে মানুষ জসীমউদ্দীনের একটু পরিচয় নেওয়া যাক।

দুই
ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জসীমউদ্দীনের জন্ম হয় – ঠিক যে কবে তা বলা শক্ত, তবে ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর জন্মতারিখ বলে গণ্য হয়ে আসছে। তাঁদের পরিবারকে কৃষিজীবীই বলা যেতে পারে। যদিও তাঁর পিতা ছিলেন স্থানীয় মধ্য ইংরেজি স্কুলের শিক্ষক। জসীমউদ্দীন প্রথমে অম্বিকা মাস্টারের পাঠশালা ও পিতার কর্মস্থল হিতৈষী মধ্য ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন, পরে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯২১ সালে। জেলা শহরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে আই এ এবং ১৯২৯ সালে বি এ পাশ করেন। গ্রাম্য কবিয়ালদের অনুসরণে অল্পবয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। বি এ পড়ার সময়েই ‘কবর’ প্রকাশিত হয় এবং নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। নজরুল যখন ফরিদপুরের একটি আসন থেকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপদ-প্রার্থী হন, তখন জসীমউদ্দীন তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সোৎসাহে অংশগ্রহণ করেন এবং কবির পরাজয়ে ব্যথিত হন। ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে যাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাস চারেক পরে ‘মুর্শিদ্যা গান’ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধ মুদ্রিত হয় কল্লোলে এবং সে-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ আরো জানার আগ্রহ বোধ করেন। জসীমউদ্দীনের অবস্থা জেনে দীনেশচন্দ্র সেন তাঁকে ৭০ টাকার মাসিক বৃত্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পল্লিগীতি-সংগ্রাহক হিসেবে নিয়োগ দেন। তাতে তাঁর ব্যয়সংকুলানের সুবিধে হয়েছিল। জসীমউদ্দীন সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথের কৌতূহলের কথা জেনে কল্লোল-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ তাঁকে নিয়ে যান ঠাকুরবাড়িতে। লোকসংস্কৃতি ও লোকপ্রিয় সাহিত্য সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথের আগ্রহ দেখে জসীমউদ্দীন খুব উৎসাহিত হয়ে ফিরে আসেন। অবনীন্দ্রনাথ একবার তাঁকে সিলেট থেকে সংগৃহীত একটি নক্শিকাঁথা দেখান, তাতেই প্রথম নক্সীকাঁথার মাঠ কাব্যের ধারণাটা তাঁর মনে আসে। ১৯২৯ সালে জসীমউদ্দীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলারস বিভাগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। তখন দীনেশচন্দ্র তাঁকে জানিয়ে দেন যে, পল্লিগীতি-সংগ্রাহক হিসেবে এতদিন যে-বৃত্তি তিনি ভোগ করছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যাওয়ায় তাঁর পক্ষে আর সেটা পাওয়া সম্ভবপর হবে না। জসীমউদ্দীনের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। তাঁর অবস্থা জেনে অবনীন্দ্রনাথ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চান্সেলর আর্কুহার্টকে এবং সিন্ডিকেটের আরো কয়েকজন সদস্যকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানান বিশেষ বিবেচনায় জসীমউদ্দীনের বৃত্তি বহাল রাখতে। কর্তৃপক্ষ সে-অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সূত্রে জসীমউদ্দীন যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং তাঁর অশেষ েস্নহ লাভ করেন। ১৯৩১ সালে তিনি এম এ পাশ করেন এবং রবীন্দ্রনাথের সুপারিশের জোরে ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামতনু লাহিড়ী গবেষকের পদে এবং ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। শিক্ষকতা ছেড়ে ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় সরকারে যোগ দেন সং পাবলিসিটি অফিসার হিসেবে এবং পরে সং পাবলিসিটি অর্গানাইজার পদে উন্নীত হন ১৯৪৭ সালে। পূর্ব  পাকিস্তান সরকারের প্রচার দপ্তরের ডেপুটি ডাইরেক্টর হয়ে তিনি অবসরগ্রহণ করেন ১৯৬২ সালে।
নানা দিক দিয়েই জসীমউদ্দীন ছিলেন সরল মানুষ, তবে অকপট ও ঋজুও। পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ঢাকায় মন্ত্রীর বাসভবনে বসেই ছোটোখাটো এই সরকারি কর্মকর্তা তাঁর মুখের উপর বলেছিলেন যে,  আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তনের যে-চেষ্টা তিনি করছেন, তা জাতির জন্যে খুব ক্ষতিকর হবে। দেশভাগের পরে লিখিত এবং অনেক পরে মাটির কান্না (১৯৫৮) বইতে সংকলিত ‘বাস্তুত্যাগী’ কবিতাটিতে তিনি যা বলেছিলেন, তাও সেদিনের সরকারকে খুশি করতে পারতো না :
দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারীরে খোঁজ করি,
মন্দিরে আজ বাজে নাকো শাঁখ সন্ধ্যা-সকাল ভরি।
তুলসীতলা সে জঙ্গলে ভরা, সোনার প্রদীপ লয়ে,
রচে না প্রণাম গাঁয়ের রূপসী মঙ্গল-কথা কয়ে।…
এই দীঘি-জলে সাঁতার খেলিতে ফিরে এসো গাঁর মেয়ে,
কলমি-লতা যে ফুটাইবে ফুল তোমারে নিকটে পেয়ে।
ঘুঘুরা কাঁদিছে উহু উহু করি, ডাহুকেরা ডাক ছাড়ি,
গুমরায় বন সবুজ শাড়িরে দীঘল নিশ্বাসে ফাড়ি।…
এ দেশ কাহারো হবে না একার, যতখানি ভালোবাসা,
যতখানি ত্যাগ যে দেবে, হেথায় পাবে ততখানি বাসা।
বেহুলার শোকে কাঁদিয়াছি মোরা, গংকিনী নদীসোঁতে,
কত কাহিনীর ভেলায় ভাসিয়া গেছি দেশে দেশ হতে।
এমাম হোসেন, সকিনার শোকে ভেসেছে হলুদপাটা,
রাধিকার পার নূপুরে মুখর আমাদের পার-ঘাটা।
অতীতে হয়ত কিছু ব্যথা দেছি পেয়ে বা কিছুটা ব্যথা,
আজকের দিনে ভুলে যাও ভাই, সেসব অতীত কথা।
এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, নূতন দৃষ্টি দিয়ে,
নূতন রাষ্ট্র গড়িব আমরা তোমাদের সাথে নিয়ে।…
জসীমউদ্দীনের অসাম্প্রদায়িক চেতনা বরাবরই প্রবল ছিল। তাঁর আত্মস্মৃতি জীবনকথা (১৯৬৪) তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সে-বছরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে হিন্দু পরিবার রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণদানকারী আমীর হোসেন চৌধুরী ও জিন্নাত আলী মাস্টারকে আর সেদিন যাঁরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা দূর করেছিলেন, তাঁদের সকলকে।
১৯৬৭ সালে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ্কে জানান যে, দেশের আদর্শের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হওয়ার কারণে বেতার ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্র-সংগীতের প্রচার ক্রমশ হ্রাস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ-খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদের যে-ঝড় ওঠে, জসীমউদ্দীন তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সালে সরকারের ইঙ্গিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বর্ণমালা ও বানান সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলে আরো অনেকের মতো জসীমউদ্দীনও তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি তখন এ-কথাও যোগ করেছিলেন যে, সীমান্তের উভয় দিকের পণ্ডিতদের মতৈক্যের ভিত্তিতেই কেবল এ-ধরনের সংস্কার করা যেতে পারে। তখনকার দিনে এমন কথা বলাছিল অসীম সাহসিকতার পরিচায়ক। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তিনিও রাজপথে নেমেছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেসব কবিতা তিনি লিখেছিলেন, তা তাঁরই যোগ্য ছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে তিনি তা পছন্দ করেননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে তিনি গভীর বেদনা বোধ করেছিলেন। তার অল্পকাল পরে ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
তিন
জসীমউদ্দীনের সমগ্র কাব্যপ্রয়াসকে দুটি মোটা দাগে ভাগ করা যায় – খণ্ড কবিতা আর কাহিনিকাব্য। তাঁর প্রথম বই রাখালী প্রথম পর্যায়ভুক্ত। তারপর এই ধারাতে প্রকাশ পায় বালুচর (১৯৩০)। তার আগে অবশ্য দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম রচনা নক্সীকাঁথার মাঠ (১৯২৯) প্রকাশিত হয়ে গেছে। রাখালী আর নক্সীকাঁথার মাঠ পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন (‘জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’)। কিন্তু বালুচর তাঁর ভালো লাগেনি (‘তোমার ‘বালুচর’ পড়তে গিয়ে বড় ঠকেছি হে। ‘বালুচর’ বলতে আমি তোমাদের দেশের সুদূর পদ্মাতীরের চরগুলির সুন্দর কবিত্বপূর্ণ বর্ণনা আশা করেছিলাম। কেমন চখাচখি উড়ে বেড়ায়, কাশফুলের গুচ্ছগুলি বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু কতকগুলি প্রেমের কবিতা দিয়ে তুমি বইখানাকে ভরে তুলেছ। পত্রে এ কথা লিখলে পাছে রূঢ় শোনায় সে জন্য এ বিষয়ে কিছু লিখিনি। মুখেই বললাম।’) মজার কথা এই যে, রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা কাব্যপরিচয় (১৯৩৮) সম্পাদনা করেন, তখন জসীমউদ্দীনের প্রতিনিধিত্ব বিবেচনা করে যে-কবিতাটি তিনি সংকলনের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন, তা বালুচর গ্রন্থভুক্ত ‘উড়ানীর চর’। কবিতাটিতে অবশ্য নিসর্গবর্ণনা মুখ্য, কিন্তু কৃষাণ-কৃষাণীর গৌণ বৃত্তান্ত তার সঙ্গে মিলেমিশে আছে। খণ্ডকাব্যের এই ধারাতেই পরে একে একে দেখা দিয়েছে ধানখেত  (১৯৩৩), রূপবতী  (১৯৪৬), মাটির কান্না  (১৯৫১), জলের লেখন (১৯৬৯), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে  (১৯৭২), মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো (১৯৭৬) ও কাফনের মিছিলে (১৯৮৮)। তাঁর খণ্ড কবিতার বিষয় মূলত প্রেম ও মাতৃøেহ, প্রকৃতি ও পল্লিজীবন এবং জনজীবনস্পর্শী সামাজিক ঘটনা ও রাজনৈতিক বিষয়। প্রেমের কবিতায় তিনি বিশেষ করে বলেছেন অচরিতার্থ ভালোবাসার কথা – সেখানে অবশ্য প্রত্যাখ্যানকারী প্রেমাস্পদের প্রতি কোনো ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নেই, বরঞ্চ আছে তার জন্যে শুভকামনা। মাতৃøেহের কবিতায় সাধারণত দেখা যায় সন্তানের জন্যে – প্রায়ই একমাত্র সন্তান বা একমাত্র জীবিত সন্তানের জন্যে পল্লিজননীর – প্রায়শই নিঃসঙ্গ বা বিধবা মায়ের – উৎকণ্ঠা বা ভালোবাসার প্রকাশ। তাঁর কবিতার অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ বাংলার শান্ত ও উজ্জ্বল নিসর্গের মনোহারিত্ব থেকে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা, গ্রাম্য উৎসব বা প্রাচীন কোনো স্মৃতিনিদর্শনের হার্দ্যকি বর্ণনা, স্বদেশপ্রেমের আবেগ থেকে হানাদার সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার আলেখ্য, মুক্তিযোদ্ধার দুঃসাহসিকতা থেকে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ। বোঝা যায়, এই কবি বিবিক্ত কোনো মানুষ ছিলেন না, বরঞ্চ যে-দেশকালে তিনি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন, সে-সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন এবং তার দাবিও তিনি অস্বীকার করেননি। এসব কবিতায় জসীমউদ্দীন ব্যবহার করেছেন প্রচলিত ছন্দ এবং প্রমিত ভাষা – তাতে অবশ্য আঞ্চলিক শব্দের কিছু মিশেল আছে।
জসীমউদ্দীনের কাব্যের অপর পর্যায় সূচিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যের দুবছর পরে প্রকাশিত কাহিনিকাব্য নক্সীকাঁথার মাঠে। দীর্ঘ বর্ণনামূলক এই রচনাকে অনেকে গাথা বলে আখ্যায়িত করেছেন। মূল গাথা সাধারণত অজ্ঞাত কবির গেয় কাব্য, তবে তার প্রেরণায় আধুনিক কালের কবিরা – যেমন স্কট, কোলরিজ বা কিট্স – সুরবিহীন গাথাও  রচনা  করেছেন।  জসীমউদ্দীনের  পক্ষে পূর্ববঙ্গ গীতিকার অন্তর্ভুক্ত গাথা থেকে প্রেরণা লাভ করা খুবই সম্ভবপর ছিল, তবে উনিশ শতকের শেষদিক থেকে বাংলাভাষায় কাহিনিকাব্যের একটি ধারাও প্রচলিত হয়েছিল – ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে কায়কোবাদ প্রমুখ কবি যে-ধারায় লিখেছিলেন – জসীমউদ্দীনের এইসব রচনা তার থেকে দূরবর্তী নয়। নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপনে এবং মা যে জননী কান্দে  (১৯৬৩) বইটির ভূমিকায় কবি এ-ধরনের রচনাকে কাহিনিকাব্য নামেই অভিহিত করেছেন।
নক্সীকাঁথার মাঠের ভূমিকায় অবনীন্দ্রনাথ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে নবীন লেখকের এই সাধারণ পল্লিজীবনের গল্প হয়তো নগরবাসী পাঠকেরা প্রত্যাখ্যান করবে, কিন্তু বস্তুত তা সমাদৃত হয়েছিল এবং ই এম মিলফোর্ড-কৃত তার ইংরেজি অনুবাদ  The Field of the Embroidered Quilt (১৯৩৯) কবির নাম ছড়িয়ে দিয়েছিল বাংলার বাইরে। এটি গ্রাম্য তরুণ-তরুণীর প্রেমের কাহিনি – মিলন  সত্ত্বেও যার ট্রাজিক পরিণাম ঘটে ঘটনাক্রমের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না বলে। সাধারণ গ্রামজীবনের আলেখ্য রচনা করতে গিয়ে সে-জীবন সম্পর্কে নাগরিক পাঠকের অজ্ঞতা সম্পর্কে কবি কটাক্ষ করতে ছাড়েননি :
মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি?
মিছেই মোদের সুখ-দুখ দিয়ে তার সুখ-দুখ খুঁজি।
আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায়,
যে লেখে বেদনা বে-বুঝ বাঁশীতে কেমনে দেখাব তায়?
অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকে,
এ দেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে;
সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান
পেতে রহি যদি কভু শোনা যায় কি কহে মাটির প্রাণ!
মোরা জানি খোঁজ বৃন্দাবনেতে ভগবান করে খেলা,
রাজা-বাদশার সুখ-দুখ দিয়ে গড়েছি কথার মেলা।
পল্লীর কোলে নির্ব্বাসিত এ ভাইবোনগুলো হায়,
যাহাদের কথা আধ বোঝা যায়, আধ নাহি বোঝা যায়।
তাহাদেরই এক বিরহিয়া বুকে কি ব্যথা দিয়েছে দোল,
কি করিয়া আমি দেখাইব তাহা, কোথা পাব সেই বোল?
– সে বন-বিহগ কাঁদিতে জানে না, বেদনার ভাষা নাই,
ব্যাধের শায়ক বুকে বিঁধিয়াছে জানে তার বেদনাই।
নক্সীকাঁথার মাঠের  পটভূমিটি  প্রথমেই  কবি স্বল্প কথায় এঁকেছেন :
এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও – মধ্যে ধূ ধূ মাঠ,
ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ।
এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ;
গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ।
ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল-কায়া,
ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় ঘরের মায়া।
এ-গাঁও চেয়ে ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে,
কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে!
এখন দেখা যাক নায়ককে :
এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মথোর চুল,
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!
কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।
জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু,
গা-খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু।
বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে গেছে তেল,
বিজলী-মেয়ে পিছ্লে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল।
কচি ধানের তুলতে চারা হয়ত কোনো চাষী,
মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি।
এবারে নায়িকা :
লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী,
ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি।
মুখখানি তার ঢলঢল, ঢলেই যেত পড়ে,
রাঙা ঠোঁটের লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে।
ফুল-ঝর-ঝর জন্তি গাছে জড়িয়ে দেবা শাড়ী,
আদর করে রেখেছে আজ চাষাদের ওই বাড়ি।
যে ফুল ফোটে শোণের খেতে, ফোটে কদম-বনে,
সবগুলো তার এক করে কে দেখ্ছে মনে মনে।
কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা,
তুলসী-তলার প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা।
গাঁদাফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি,
চাষী মেয়ের রূপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি?
রামধনুকে না দেখিলে কি-ই বা ছিল ক্ষোভ,
পাটের বনের বউ-টুবানী! নাইক দেখার লোভ।
ভাষার প্রাঞ্জলতা ও ছন্দের সরলতার সঙ্গে এখানে লক্ষ করা যায় যে, অলংকার সবই গৃহীত হয়েছে স্থানীয় প্রকৃতি ও জীবন থেকে। তার মধ্যে চিরন্তনেরও একটা স্থান আছে।
কাব্যটি যে একেবারে হাস্যরসশূন্য নয়, তা দেখা যায় দুখাই ঘটকের মুখে রূপার বংশমর্যাদার বর্ণনায় :
তার পরেতে পাড়্ল ঘটক রূপার কুলের কথা,
রূপার দাদার নাম শুনে লোক কাঁপত যথাতথা।
রূপার নানা সোয়েদ-ঘেঁষা, মিঞাই বলা যায়,-
কাজীবাড়ির প্যায়দা ছিল কাজল-তলার গাঁয়।
রূপার বাপের রাখত খাতির গাঁয়ের চৌকিদারে,
আসেন বসেন মুখের কথা – গান বজিত তারে।
রূপার চাচা অছিমদ্দি, নাম শোন নি তার?
এঁংরেজী তার বোল শুনিলে সব মানিত হার।
নক্সীকাঁথার মাঠের কাহিনিটি সরল। ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির সাক্ষাৎ হতেই তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেল। পড়শিদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল এ-নিয়ে। মেয়েটির মা ব্যবস্থা নিলেন যাতে তাদের আর দেখা না হয়। রূপা বিষাদগ্রস্ত। ঘটকের দৌত্যে তাদের বিয়ে হয়ে গেল এবং তারা সুখে দিন কাটাতে লাগল – তবে চিরকাল নয়। গাজনার চরে তাদের ধান যারা চুরি করে কেটে নিয়ে গেছে, তাদের মুখোমুখি হতে ডাক এলো রূপার। তারপর যে-সংঘর্ষ বাধল, তাতে মৃত্যু ঘটল কারো কারো। রূপা গোপনে সাজুর সঙ্গে দেখা করে নিরুদ্দেশ হয়ে  গেল। অল্পবয়সে এই কষ্টের দিনগুলিতে সাজু তার জীবনের নানা ঘটনা চিত্রিত করে এক নকশিকাঁথায়। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে মাকে বলে যায়, তার কবরের ওপরে কাঁথাটা বিছিয়ে দিতে। অনেক দিন পরে রোগপাণ্ডুর রূপা যখন ফিরে আসে, তখন   সে-ও ওই কাঁথাটি গায়ে জড়িয়ে সাজুর সমাধিতেই মৃত্যুবরণ করে।
এই কাব্যে কবি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন চরিত্রদুটির বিকাশে আর তাদের জীবনের ট্রাজিক পরিণাম ফুটিয়ে তুলতে, যে-পরিণামে একটি শাশ্বত বিষয় নিহিত রয়েছে। গ্রামসমাজের বিশ্বস্ত পরিচয় কবি দিয়েছেন, তবে ধান নিয়ে কাইজার ঘটনার বিবরণে কিংবা সাজু ও রূপার মৃত্যুর বর্ণনায় যে-বহিঃশক্তি নিয়তির ভূমিকা পালন করে, তার কথা অব্যাখ্যাতই থেকে গেছে।
সোজন বাদিয়ার ঘাটে (১৯৩৪) কিন্তু বহিঃস্থ এই শক্তির বিশদ পরিচয় দেওয়া হয়েছে। সোজন মুসলমান তরুণ, দুলী নমশূদ্র মেয়ে। মুসলমান ও নমশূদ্রেরা একই গ্রামে দীর্ঘকাল শান্তিতে বসবাস করে এসেছে এবং পরস্পরের সুখদুঃখ ভাগ করে নিয়েছে। একদিন কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মুসলমানেরা উপদ্রবের সূচনা করে। স্থানীয় জমিদারের স্বার্থে তাঁর নায়েব এখন নমশূদ্রদের উশকে দেয় তাদেরই গ্রামের মুসলমানদের ওপর তার প্রতিশোধ নিতে। নিরপরাধ প্রতিবেশীদের আক্রমণ করতে নমশূদ্রেরা প্রথমে ইতস্তত করে, কিন্তু শেষে নায়েবের কৌশলেরই জয় হয়। আর ঘটনার সূত্রপাত হয় বিয়ের রাতে দুলীর সোজনের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ায়। বহু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। দুলীকে অপহরণের দায়ে সোজনের সাত বছর কারাদণ্ড হয়। দুলী বাধ্য হয় অন্যত্র বিয়ে করতে। শেষ পর্যন্ত সকলে নায়েবের চক্রান্ত ধরতে পারে। কয়েকদিন পরে খুঁজে পাওয়া যায় নায়েবের মাটি-চাপা-দেওয়া মৃতদেহ।
কাহিনির শেষ অবশ্য এখানেই নয়। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পরে সোজন একদল বেদের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অবশেষে সে একদিন দুলীর খোঁজ পায়, কিন্তু দুলী তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তবে অন্তরের আকর্ষণে দুলী পরে ঘর ছেড়ে সোজনের সঙ্গে মিলিত হতে যায়। ততক্ষণে সোজন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, দুলীও তার অনুগামী হয়।
পরদিন ভোরে গাঁয়ের লোকেরা দেখিল বালুর চরে,
একটি যুবক একটি যুবতী আছে গলাগলি ধরে।
অঙ্গে অঙ্গে মিলিয়া অঙ্গ, প্রাণপাখি গেছে উড়ি,
মাটির ধরায় সোনার খাঁচাটি পায়ের আঘাতে ছুঁড়ি।
নায়ক-নায়িকার এই পরিণাম নক্সীকাঁথার মাঠের সমাপ্তির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে  সোজন বাদিয়ার ঘাটে ব্যক্তির এই বিপন্নতার পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং তার সাময়িক অবলোপের চিত্র সযতেœ, শিল্পিতভাবে এবং যথেষ্ট সমাজ-সচেতনতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে। তবু প্রথম কাহিনিকাব্যের সাফল্য এটি লাভ করতে পারেনি এবং বারবারা পেইনটার ও ইয়ান লাভলক-কৃত এর ইংরেজি অনুবাদ Gipsy Wharf (১৯৬৯) স্বচ্ছন্দ হয়েও পূর্ববর্তী অনুবাদের মতো সাড়া জাগায়নি।
এই ধারার অন্যদুটি  কাব্য সকিনা (১৯৫৯) ও মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩) অনেকখানি নি®প্রভ। তার প্রথমটি ভাগ্যহত সকিনার বিড়ম্বনার কাহিনি। পরেরটি কাহিনি গ্রাম ও শহরের মিলিত পটভূমিতে স্থাপিত। সন্তানের জন্যে মায়ের ভালোবাসা এবং দারিদ্র্যের দুঃসহ পীড়ন এর বিষয়। কিন্তু এ-দুটির উপস্থাপনে কবির পারদর্শিতা সীমাবদ্ধ।
হাসান হাফিজুর রহমান মনে করেন, লোকসাহিত্যের গাথার রূপটি আধুনিক সাহিত্যে পুনঃস্থাপন এবং বাংলা কবিতায় লোকজীবন ও লোক-উপকরণের সংযোজন জসীমউদ্দীনের প্রধান কৃতিত্ব। তবে এসব রচনাকে গাথা বলা যায় কি না সে-সম্পর্কে মতভেদ থাকতে পারে।
চার
জসীমউদ্দীনের অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে একটি উপন্যাস (বোবা কাহিনী, ১৯৬৪),  নাটক (বেদের মেয়ে, ১৯৫১; মধুমালা, ১৯৫১; পল্লীবধূ, ১৯৫৬; গ্রামের মায়া ১৯৫৯), গীতিসংগ্রহ (রঙিলা নায়ের মাঝি, ১৯৩৫), ভ্রমণকাহিনি (চলে মুসাফির, ১৯৫১; হলদে পরীর দেশ, ১৯৬৭; যে দেশে মানুষ বড়, ১৯৬৮, ইত্যাদি), এবং স্মৃতিকথা (যাঁদের দেখেছি, ১৯৫২; ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়, ১৯৬১; জীবনকথা, ১৯৬৪)। তাছাড়া তিনি শিশুতোষ রচনা লিখেছেন, বাঙালির হাসির গল্প ও জারিগান সম্পাদনা করেছেন। তিনি একজন সুনিপুণ  গদ্যশিল্পী। তাঁর স্মৃতিকথাগুলি  একাধিক কারণে মূল্যবান।
এখানে একটি মজার ঘটনা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ষাটের দশকের শেষার্ধে আমি তিন মাস ধরে টেলিভিশনে ‘কবিকণ্ঠ’ নামে একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতাম। তাতে এক-একজন কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হতো স্বরচিত কবিতা পড়তে, তার আগে আমি তাঁদের পরিচয় তুলে ধরতাম এবং পরে পঠিত কবিতাগুলি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করতাম। এক সন্ধ্যায় জসীমউদ্দীন ছিলেন আমন্ত্রিত কবি। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ জীবনকথা আমি সদ্য পড়েছি। কথাপ্রসঙ্গে আমি বইটির উল্লেখ করি এবং তাঁর গদ্যরীতির ভূয়সী প্রশংসা করি। মনে হলো, কবিও তাতে প্রীত হলেন। কয়েকদিন পরে জসীমউদ্দীন আমাকে বললেন, সেদিন আমার কথায় যদিও তিনি খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু পরে তাঁর মনে হয়, আমি তাঁর গদ্যের প্রশংসা করেছি তাঁর কবিতাকে খাটো করতে। আমি যতই বলি, তাঁর ধারণা ভুল, তিনি তা কিছুতেই মানতে চান না; বলতে থাকেন, আমিও সেই আধুনিকদের দলে যারা তাঁর কবিতার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে চায় না। এই ঘটনা থেকেও জসীমউদ্দীনের ব্যক্তিগত সারল্যের একটা পরিচয় পাওয়া যায়।
হুমায়ুন কবিরের মতে, দেশের গণ-মানসের অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাব্যে রূপান্তরিত করতে পারাই জসীমউদ্দীনকে কাব্যসিদ্ধি দিয়েছে; কিন্তু সে-শক্তি পশ্চাৎমুখী বলে তা নতুন নতুন রাজ্যজয়ে অগ্রসর হতে পারেনি। কথাটা ভেবে দেখার যোগ্য। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, জসীমউদ্দীন বাংলা কবিতায় নিজস্ব ও নতুন একটি পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। লোক-ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি তিনি করেননি, তিনি সে-ঐতিহ্য থেকে বস্তু ও রূপ নিয়ে তার পুনর্সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কাহিনিকাব্যকে পূর্ববঙ্গ গীতিকার প্রতিরূপ মনে করার কোনো কারণ নেই। তাঁর খণ্ড কবিতাও এমন যার ধরনের সঙ্গে আমাদের আগে কখনো পরিচয় ছিল না। পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয়কে এবং সমাজের সাধারণ স্তরের সঙ্গে তাঁর একাত্মতাকে তিনি রূপদান করেছেন বাংলা কবিতার একটি নতুন ধারায়। মাটির হৃৎস্পন্দন তিনি শুনতে পান – তাঁর এ-দাবি সত্য। এবং তাকেই তিনি কবিতায় রূপ দিয়েছেন – শিল্পিত, সুকুমার, সুন্দর কবিতায় – যা বাংলাভাষীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উপভোগ করবে।