মুহাম্মদ সামাদ
কবি জাই ইয়ংমিং চীনের সিচুয়ান প্রদেশের চেংদুতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালে। ইউনিভার্সিটি অব ইলেকট্রনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়না থেকে স্নণাতক ডিগ্রি অর্জন করে কাজ নেন চেংদুর পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। লেখালেখি এবং কর্মসূত্রে বাস করেন চেংদু ও বেইজিংয়ে।
বিশ শতকের আশির দশকের শুরু থেকে চীনের পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। বর্তমানে চীনের একজন সুপরিচিত কবি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দশটির বেশি, গদ্যসংকলন আটটি। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, ইতালিয়ান, ওলন্দাজ, জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ প্রভৃতি ভাষায়। কাব্যক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্যে নিজ দেশে ও বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছেন।
আমার আমেরিকান-চাইনিজ কবিবন্ধু জ্যামি শ্যু কবি জাই ইয়ংমিংয়ের ইংরেজি অনুবাদক। জ্যামির আগ্রহে আর আমার ভালোলাগায় তাঁর ইংরেজি অনুবাদ থেকে জাই ইয়ংমিংয়ের সাতটি কবিতা অনূদিত হলো।
পুরাকালে
পুরাকালে, আবার তোমার সঙ্গে
কোথায় আমার দেখা হতো –
না জেনেই তোমাকে কেবল আমি
চিঠি লিখে যেতে পারতাম।
আমি এখন তারকাপুঞ্জ দিয়ে
তোমার মনিটরের ইনবক্স ভরি
সকলেই উঠে দাঁড়ায় ও দৌড়ায় তোমার দিকে
তারারা আকাশে কোথায় নোঙর করে,
আমি সত্যিই তা নিয়ে বিচলিত নই।
পুরাকালে, চুনি-পান্নার পর্বতমালা জেদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো;
সতেজ জলের ধারারা মাতাল হয়ে ঝরে পড়তো তাদের পায়ে;
আমাদের আবারো দেখা হবে জেনে –
সরে আসার ভঙ্গিতে আমরা নিছক করমর্দন করতাম।
তুমি এখন আকাশ জুড়ে এদিক-সেদিক ওড়াউড়ি করো
সমস্ত আকাশ জুড়ে তারাদের ছোটাছুটি আচমকা বুকের বিরহে
ওরা যেন নীল পরদায় ঢাকা ক্ষতের ওপর
অসংখ্য তালি-তাপ্পি সত্যি সত্যি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত নয় তারা।
পুরাকালে, শুয়েংজিং চায়ের কাপে ঝড় তুলে, বাতাস উজিয়ে,
দেয়াল গুঁড়িয়ে লাও-পাহাড়ের তাওবাদী প্রভু হতে
মানুষকে কতো কবিতা রচনা করতে হয়েছে!? প্রায়শই
যখন তোমাকে তারা ধরে ফেলতো, তখন ওপরে ওঠার বদলে গড়িয়ে
নিচে পড়তে-পড়তে তারা মস্তক ফাটিয়ে রক্তপাত ঘটিয়ে ফেলতো।
আজকাল মোবাইল থেকে তুমি ফোন করো একটি নম্বরে
এটি অবিরত সৌরভ ছড়িয়ে দেয়
এই ঘ্রাণ কারো সুবাসিত দেহে ঢুকে পড়ে; আর
যখনই এক অঙ্গ কাঁপে, তখনই সারা দুনিয়া কাঁপতে থাকে।
পুরাকালে, আমরা এসব পছন্দ করিনি
আমরা তখন মাইলের পর মাইল কেবল পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়েছি
আমার কানের দুল ঝংকৃত হয়েছে তুমি তাকিয়েছো বাঁকা হেসে
যে মুহূর্তে আমাদের মাথা নুইয়েছি চলে গেছি ততক্ষণে অনেক-অনেক দূরে…
চন্দ্রমল্লিকার মতো লণ্ঠন
রাতভর নিস্তব্ধতার ভিতরে একটা-একটা করে
চারিদিকে চন্দ্রমল্লিকা ভাসে
নদীতীরে শিশুদের নম্র স্বরের ভিতরে
চন্দ্রমল্লিকা বিবর্ণ হয় চন্দ্রমল্লিকা বিবর্ণ হয় পাখির ছায়ায়
শিশুরা ভাসতে থাকে লণ্ঠন বহন করে
শিশুদের কোমল কোরাস গানে
কোনো ভয় নেই কোনো আনন্দ নেই কোনো বেদনাও নেই
সেখানে কেবল চন্দ্রমল্লিকার মতো লণ্ঠন চন্দ্রমল্লিকারা সাদামাটা
লণ্ঠনের লাল আভা
এক যুবতী কুমারী লণ্ঠন বহন করে ভাসে
যুবতী কুমারী ও তার সহচরীর চুল ঝুঁটিবাঁধা;
তাদের চমৎকার সাজগোজে রেশমের জামা, বকলেস –
বাতাসে মাথার ফিতা দুলে;
গলায় লকেট, কানে দুল আর চুলে কাঁটা;
ঠুনঠুন ঝনঝন আওয়াজে তাহাদের পাশাপাশি হাঁটা;
কুমারী ও তার সহচরী
উভয়েই অনুভবে ঋদ্ধ –
ধীরেসুস্থে মাঝরাতে হতে চায়
জোছনার মুখোমুখি।
কুমারীরা নম্র, লণ্ঠনেরা মৃদু
তারা কেবলই ভাসে… ভাসতেই থাকে
আটপৌরে একটি সন্ধ্যাকে ওরা
অসামান্য স্বপ্নের সন্ধ্যায় রূপ দেয়।
প্রতিরাতে
চন্দ্রমল্লিকার মতো লণ্ঠনেরা ভাসে
একজন লণ্ঠনবাহক ঘুরে বেড়ায় দিগন্তে;
তার এলোমেলো পদচিহ্ন ধরে
তাল মেলানো কঠিন।
লণ্ঠনের অনুগামী হয়ে ছেলেপুলে পুষ্ট হয়।
এই গল্পটি গভীর নীল সমুদ্রের মধ্যে এক লণ্ঠনের।
আমি যদি মেঝের ওপর বসি
আমি সে-শক্তিমত্তাকে ভয় পাবো
আমি চন্দ্রমল্লিকার ছায়াদের ভয় পাবো মানুষকে আলোকিত করো
আমি ঠনঠন ঝনঝন এলোমেলো ছন্দ তুলবো
আমার ঘরে।
আমি যদি সোফায় অথবা বিছানায় বসি
আমি উপভোগ করবো নিজেকে
আমি ধীরে-ধীরে অনুভব করবো নিজেকে ঈষৎ অস্বচ্ছ
আসেত্ম-আসেত্ম রং বদলাবো
রাতভর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হবো, অতঃপর
ভূমি থেকে উঠে যাবো, আমি ঊর্ধ্বগামী।
একাকী পলায়নপর
কোনো দিকে না তাকিয়ে তোমার
সুবাস সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে তুমি যদি একা
পালাতে মনস্থ করো একজন ঘাতক এখানে পৌঁছে যাবে।
যখন তোমার দেহ হালকা ও পলায়নের বাসনা তীব্র
তখন পাখির ডানা ছেঁটে দেওয়ার দরকার নেই;
প্রয়োজন নেই ভালোবাসার মতো সত্যনিষ্ঠ হওয়ার;
প্রয়োজন নেই পুরনো বা নতুন খেলাকে প্রশ্রয় দেবার;
অবশেষে, নিকটবর্তী জায়গা থেকে তুমি অবশ্যই চলে যাবে
এটা এমন নিকটতম স্থান যা তুমি দেখতে পাও দূর থেকে;
চলে যাবার বাসনা পানির মতো তা বাষ্প হয়ে উবে যাবে
মানুষের পৃথিবীতে। একটি দেহও কয়েক মুহূর্তে
উবে যাবে বাষ্প হয়ে একা।
থেকে যায় কেবল সময়।
শিলার ভিতর দিয়ে মন্থর অবলোকন।
আর একাকিত্বের সঙ্গে কুস্তি লড়া।
এই তিনের ভিতরে এক মেঘ আর কুয়াশার ব্যূহ ভেঙে অতিক্রম করে
হাতে হাত ধরার আকাঙক্ষা নিয়ে
আত্মরক্ষার্থে একটি ঢাল হওয়ার ইচ্ছে তুমি এড়াতে পারো না।
ছদ্মবেশ
(আমি যখন জানালার কাগজের ফুটোতে লেহন করি
এই স্নানাগারটি আমার চোখ জুড়িয়ে দেয় )
আমি এমন নারীকে দেখি
যে কিছু-না-কিছু করে।
সে তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে তার কেশ নিচে লুটিয়ে পড়তে দাও
আয়নার মুখোমুখি হয়ে সমুদ্রের স্পঞ্জ দিয়ে সে তার সমস্ত দেহমাঝে
যেন পরিষ্কার করে নিজের দেহের আঁশ;
অদ্ভুত বিষয়, সে নিজের হাতে
তার মাথা নিচু করে;
এখন সে তার ভ্রূ রঞ্জিত করে;
(নিজ দেহকে বিমূর্ত ভেবে কী করে এমন
পরিহাস করতে পারে সে?
একজন মানুষের মাংসপেশি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
বিভাজন করার মতো নিজেকে কীভাবে বিভাজন করে সে?)।
স্নানাগার থেকে জল ফোঁটায় ফোঁটায়
ঘরের বাইরে বয়ে যায় ফোঁটায় ফোঁটায়
বয়ে যায় নিচের তলায় ফোঁটায় ফোঁটায় জল
গলিতে বেরিয়ে যায় অই বৃক্ষ আর ইট,
কংক্রিটের প্রান্তর
ইতিমধ্যে তারা জেনেছে – আমার ভীরু প্রেম
রূপান্তরিত হয়েছে ভয়ে;
এখন আমার দেহের ভিতর থেকে ধীরে-ধীরে ঝরে পড়ে।
আমি অবিরত ভালোবেসে যাবো
ভালোবেসে যাবো আমার ভয়কে যখন দেখবো
তার দেহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তখন খুলিতে
পাউডারের চূর্ণ ছড়িয়ে দেবো;
যেন-বা সে সাদা রং মেখে নিচ্ছে তার ত্বকে
যেহেতু সম্পূর্ণ নতুন দেখায় তাকে
সে অধিক শক্তিমতী হয় তার প্রেতাত্মা,
গরল আর প্রখরতা
বিন্দু-বিন্দু করে ফিরে আসে তার দেহে।
এভাবেই আমি নিজেকে বুঝতে পারি –
ধীরে-ধীরে আমার পৌরুষ ক্ষয় হয়
বাইরে বেরিয়ে যায় অল্প অল্প করে
নিজেকে রক্ষার কথা আমি ভাবি না
বরং অবিরত উপভোগ করি আনন্দকে।
মৃত্যু অবধি নিশ্চিত হতে পারবো না
কাকে আমি ভালোবেসেছিলাম;
সম্মোহিত হয়ে যাকে কল্পনা করেছি এমনই একজন
অথবা তুমিই – যতটুকু খুঁজে পেয়েছি বিষের পস্নাবনের পর।
আকাশের ওপারে
প্রতিটি মানুষ একেকটি শিশুর আত্মার পুনঃরূপ
শরতের পুষ্পরাজি ঝরে মরে যায় উইলো গাছের ক্যাটকিন ফুলেরা আকাশ ভরে যায়
আত্মারা আকাশে ওড়ে – এই পৃথিবীতে
কিছু-না-কিছু জায়গা প্রতীক্ষায় থাকে
আমার ভাবনা যখন আমার হৃদয়ে আসীন
তোমার ধ্যানমগ্ন মন নড়ে ওঠে
যেন আজ থেকে বহু বছর আগের আকাশের
ওপারের কেউ মুহূর্তে ঘরের ছাঁইচের নিচে পৌঁছে যায়;
শেষ প্রস্থানের দিকে যেতে যেতে
আমি কেবল একটি তলপেট ব্যবহার করি এই পৃথিবীর
তুমি বরফে রূপান্তরিত হও আর গলে জল হয়ে যাও অন্যত্র
এবং আমি স্বপ্ন দেখে কেঁপে উঠি,
উঠে বসি আর প্রার্থনায় কপালে ঠেকাই হাত।
শিশু হয়ে যাওয়ার মানে
সিভিটেলাতে ভ্রমণে গেলে আমি শিশু হয়ে যাই
চোখ বন্ধ হলে আমার মনন পঞ্চ চরিত্র ধারণ করে
একটির যাত্রা মেক্সিকোতে একটি নিউইয়র্কে
একটি ইংল্যান্ডের দিকে একটি ব্রাজিলে যায়
এবং অবশিষ্টটি ইতালিতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়
কর্ণকুহর বন্ধ হয় চারিদিকে পাখির কূজন
এই আদিম ভাষাটি আমি বুঝি
পৃথিবীতে পাঁচ হাজারের বেশি ভাষা একজন কয়টা বুঝতে পারে?
আমি পাখির মতো তাদের পেছনে ছুটি
ভাষাদের মরে যাবার দ্রম্নতগতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারি না
তাদের নিজস্ব সংকেতরীতি আছে
মানবতার উন্মেমষকালে আমাদের কথা বলার একটি মাত্র ভাষা ছিল
ক্রমবর্ধমানভাবে পৃথিবী বিসত্মৃত হচ্ছে
দুর্বলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া সাদা-কালো বাঘের মতো শহর মথিত করে
ক্রমবর্ধমানভাবে ভাষা প্রবল ক্ষুধার্ত হচ্ছে
অসম্পূর্ণ হয়েও কম্পিউটারের ভাষা আমাদের মেধা গিলে খেতে আরম্ভ করেছে
ভাষা যখন একটি ভাইরাসে রূপ নেয়
জনসমাজ সংক্রমিত হবে পৃথিবী নিজেই নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে
কেবল শিশুরা টিকে যাবে
পাঁচ হাজার ভাষার মৃত্যু হবে মাত্র একটি ছাড়া।
একজন শিশু হয়ে যাওয়ার মানে পাঁচ হাজারকে একটিতে রূপান্তর করা
পৃথিবী অনুসন্ধান করতে শিশুর হৃদয়কে কাজে লাগাচ্ছে :
হাতের কথা বলার মতোন
আলোর পুস্তক পাঠের মতোন –
যেভাবে ছায়ারা প্রকৃতি ও প্রেতাত্মার সঙ্গে কথোপকথন করে;
আকাশে ওঠার জন্যে আমি ঘাসের নিকট আমার দৃষ্টিকে নত করি
একজন শিশু হয়ে যাওয়ার মানে নিজেকে একটি ভাষায় রূপান্তরিত করা।
ফোনকলের মুখোমুখি
আমার একটা দিন চলে যায় ভয় তাড়িয়ে উঠতে
প্রতিদিন আমাকে সতর্ক করা হয় সমস্ত পৃথিবীর আকাশের নিচে
আমি কিছু জীবনকথায় রং ছিটিয়ে দিতে চাই প্রত্যেক পথনির্দেশে
ঘাস বেঁকে যায় যেহেতু বায়ুকে ভয় পায়
গুলিরা পতিত হয় যেহেতু তাদের ভয় লক্ষ্যবস্ত্তগুলো
ফোন বেজে যায় যেহেতু তাদের ঝোঁক
বাক স্বাধীনতার ওপর
বেশ, আরেকটি নাচের স্বাগতসম্ভাষণে
লাফ দিয়ে উঠবে জিহবা;
কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের পূর্বাভাস জলবায়ুর পরিবর্তন
যুদ্ধের অগ্রগতি আর অসুস্থতা
বহু লোকজন
সকলেই এক পথ অনুসরণ করে –
অন্তর্ধান অন্য অনেকেই
এক পথই অনুসরণ করে –
হামাগুড়ি দিয়ে আসে
একে বলা হতো ভয়ানক পতনের কাল
সম্পূর্ণ পতন সংঘটিত করবে
সবচেয়ে গতিশীল রূপান্তর
সব ঠিক আছে, এই যে যুবক ভালোবাসে আমাকে
এবং ভাগাভাগি করে জীবন আমার সঙ্গে
সে তো একজন অকর্মণ্য ভগ্নচিত্ত নয়
সে তো ক্ষয়ে যাওয়া বাতিল ক্ষুদ্রাংশ দিয়ে তৈরি নয়
সে এমন কেউ নয় যাকে নিয়ে আমি মোহগ্রস্ত হতে চাই
বোধ হয় আমরা প্রেমসত্তার
কাছাকাছি হচ্ছি
আমরা সেসব জীবজন্তুর মতো হবো
যারা পরস্পর গ্রাস করে একটি বৃহৎ মেঘের কিনারে
আমাদের তুলে নেবে এবং বহন করে নিয়ে যাবে দূরে
এটি এরকম ভাবনাহীন ঘটনা হওয়া উচিত;
যখনই আমি একটি ফোনকলের মুখোমুখি হই
আমি আবারো ভারাক্রান্ত হই।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.