বাংলাদেশে আলোকচিত্রচর্চার সূচনাকালে যে-কজন এই বিষয়টিতে বিশেষ ব্যুৎপত্তি দেখাতে সমর্থ হয়েছেন গোলাম মোরশেদ মোহাম্মদ এহসানুল করিম, বা সংক্ষেপে জি এম এম ই করিম (১৯২১-৯৯), তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী সদ্য গত হয়েছে। তাঁর বাবা খানবাহাদুর ফজলুল করিম ও মা আলতাফুন্নেসা খাতুন। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের ঢাকায় জন্ম নেওয়া বাঙালি আলোকচিত্রী এহসানুল করিম চল্লিশের দশকে শখের বশে ফটোগ্রাফি শুরু করলেও ভারতবর্ষের নানা জায়গায় তাঁর ভ্রমণ, নানা সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ভাষিক জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রণালি এবং সন্নিহিত অঞ্চলের পরিবেশ, প্রতিবেশ নিয়ে তাঁর ফটোগ্রাফির শুরু মধ্যচল্লিশে। সময়টি গুরুত্বপূর্ণ – ভারত থেকে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান, দুই দেশতত্ত্ব মেনে ভারতবর্ষকে রক্তাক্ত বিভক্তির দিকে ঠেলে দেওয়া – সেই ১৯৪৬-৪৭ সময়কালেও তিনি ছবি তুলেছেন। তাঁর আলোকচিত্রে প্রতিফলন ঘটেছে গত শতকের মধ্য সময়ের বাংলাদেশের নগর, পাহাড়, সমতলের গ্রামীণ জীবন যাপনের নানা ঘটনা ও বিষয়।
পাকিস্তানে ট্যুরিজম বিকাশের অন্যতম উদ্গাতা জি এম এম ই করিম। ১৯৬১ সালে ঢাকায় ট্যুরিজম পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেশে এর ভিত্তি নির্মাণ করেন তিনি। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড তহবিলের দুজন সদস্যের একজন। তিনি বাংলাদেশ বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭৩ সালে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত পরামর্শক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
ষাটের দশকে নির্মিত হলিউডি চলচ্চিত্র অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইস-এর সিলেটের শ্রীমঙ্গলের সংরক্ষিত বনে ধারণকৃত অংশটুকুর শুটিং আয়োজনে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
তরুণ বয়স থেকেই ছবি তোলার শখকে সম্বল করে ঘুরতে-ফিরতে যেখানেই গেছেন, একের পর এক ছবি তুলেছেন। কালক্রমে সেসব ছবিই এখন হয়ে উঠেছে ইতিহাসের সচিত্র অংশ! ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে ‘অবিরাম চাষাবাদ’ শিরোনামে তাঁর ভিজ্যুয়াল ডায়েরির বাছাইকৃত ছবির একটি একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখে দর্শক সেই গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাট দশকের ঢাকার স্থাপনা ও জনজীবনের চিত্রটি দেখতে পেয়েছেন। প্রদর্শনীটির কিউরেটর শামসুল আলম হেলাল।
জি এম এম ই করিমের তোলা ছবিতে ঢাউস ক্যামেরাসহ ক্যামেরাম্যান ও ছবি তুলতে আগ্রহীদের ছোট্ট একটু ভীড়। ছবিটি আমাকে একলহমায় চার দশক আগে নিয়ে গেল। এটি দেখে মনে পড়লো মুখচ্ছবি তোলার পুরনো প্রযুক্তির সেই বিশেষ কায়দার কালো কাপড়ে আবৃত ক্যামেরা ও তার পেছনের মানুষটির কথা। গত শতকের আশির দশক অবধি ঢাকার গুলিস্তানে ওই ক্যামেরায় সাদাকালো পাসপোর্ট আকৃতির ছবি তোলা যেত। জরুরি প্রয়োজনে আমিও তুলেছি। সূর্যের আলো আর ছায়ার কৌশলে লেন্সের ভেতর যে প্রতিবিম্ব ধরা পড়তো, সেটিই মুদ্রিত হতো ফটোপেপারে।
তেজগাঁও রেলস্টেশনের রমরমা যুগের ছবি তুলেছেন এহসানুল করিম। মতিঝিলের আমিন কোর্ট ভবন, ওয়াসা ভবন, জনসমাবেশের ছবিতে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের ঢাকার আন্তরিক অবয়বটা দেখতে পেলাম।
বাংলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রধান ফসল পাট। এর চাষাবাদের সেই সময়কার ছবি পাই এহসানুল করিমের ভিজ্যুয়াল ডায়েরিতে। পাটের পর চা-পাতা অন্যতম অর্থকরী ফসল। সিলেটের শ্রীমঙ্গল এলাকায় চা-বাগানের ছবিতে আমরা দেখি, নারী শ্রমিকরা চা-পাতা তুলছেন। পাহাড়ি এলাকার উঁচু-নিচু পথ, দুই পাহাড়ের সংযোগস্থলে বাঁশের সাঁকোয় গাড়ি পারাপার করার ছবিটি সেকালের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার খবর দেয় আমাদের। সেই কবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বোমাং রাজা ও রাঙামাটির রাজার ছবি তুলেছেন, পাশাপাশি পাহাড়িদের তাঁত বোনা, পাহাড়ি মেয়েদের ঝরনা থেকে পানি সংগ্রহের ছবিটিও তুলেছেন আলোকচিত্রী করিম সাহেব। এভাবে তিনি ওই অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জীবন সংগ্রামকে আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
অপরদিকে সমতল বাংলার মানুষের কাজ, তাদের পেশা, সংস্কৃতি, সেকালের পোশাক-আশাক সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু দর্শকরা ধারণা পাবেন এই প্রদর্শনীর চিত্রগুলি দেখে। একটি চিত্রে দেখা যায়, দোতরা বাদককে ঘিরে অনেক মানুষ বসে ও দাঁড়িয়ে। ভেজা শাড়িতে গ্রামীণ নারীর জলকে চলা, মাছধরার জাল নিয়ে জেলে কিংবা সাধারণ মানুষের মাছ শিকারের পূর্বপ্রস্তুতিও উঠে এসেছে তাঁর আলোকচিত্রে।
বেশ কিছু ছবিতে আমরা দেখি, ঘোড়ার গাড়ি ও গরুর গাড়ি করে যাত্রী ও মালামাল টানা, নদীপথে নৌকার চলাচল, নদীর ঘাটে অজস্র নৌকার ভিড়। যাত্রী নামিয়ে ধুলা উড়িয়ে বাসের চলে যাওয়ার ছবিতে পথঘাটের দুর্দশা বোঝা যায়। সেই আমলের বাস, ট্রেন, মানুষের আসা-যাওয়া সবই ছিল সীমিত – সেই অবস্থা আমরা উপলব্ধি করতে পারি জি এম এম ই করিমের তোলা আলোকচিত্রে।
আট মিলিমিটার ক্যামেরায় তোলা তাঁর ভিডিও সেই সময়ের অনন্য দলিল হয়ে আছে। এর প্রজেকশনও দেখা গেল চিত্রশালায়। পাশাপাশি এই ভিজ্যুয়াল ডায়েরির ধারাবাহিক প্রজেকশনের ব্যবস্থাও ছিল বেঙ্গল শিল্পালয়ে। করিম সাহেবের ব্যবহার করা ক্যামেরা, ফিল্ম, ফিল্ম রাখার পাত্র, ছবি তোলায় ব্যবহৃত সব জিনিসও প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে।
‘অবিরাম চাষাবাদ’ শিরোনামের এই ভিজ্যুয়াল ডায়েরি বা আলোকচিত্র প্রদর্শনী গত ৯ই সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১৫ই অক্টোবর, ২০২২।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.