মহীবুল আজিজ
আমরা তখন টগবগে তারুণ্যে ফুটছি। মধ্য আশির সেই উত্তাল তাপে আমরা পুড়ে যাই শুধু। যুদ্ধ তখনো আমাদের কাছে পুরনো বিষয় নয় যেহেতু যুদ্ধই ছিল আমাদের পুরাণ। তৎকালে অব্যাখ্যেয় চেতনা নামক কোনো এক আচ্ছন্নতার ঘোরে একটু-একটু করে আমরা পড়তে শুরু করেছি। চারদিকে, রাস্তায়-রাস্তায় ফুটতে থাকে ফুল – অজস্র আর রক্তময়। মুক্তিযুদ্ধ আরো তীব্রতা নিয়ে আমাদের দখল করে এবং আমরা অনুভব করি, যুদ্ধের আসলে শেষ নেই, যুদ্ধ এক চলমান অগ্রগতির নাম। যুদ্ধে-যুদ্ধে আমাদের যৌবন ক্রমে বয়স্ক হয়ে ওঠে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ মুহুর্মুহু কাঁপে – শাসকেরা তবু বোঝে না, যুদ্ধে যাদের ইতিহাস জয়ের, তাদের দমানো অসম্ভব। মৃত্যুর ছায়া দীর্ঘ ও প্রলম্বিত হয় কেবলই। সেই করাল কালে আমাদের হাতে আসে একটি উপন্যাস – অদ্ভুত এক গ্রন্থ – গদ্য-পদ্য মিলেমিশে একাকার। যেন আমাদের ভেতরটা ছুঁয়ে যেতে চায়। মোহাবিষ্টের মতো আমরা পাঠ করি –
আমরা এই কাহিনি আগেই শুনেছি,
এখন শুনছি এবং ভবিষ্যতেও শুনব
(অন্তর্গত)
সেই কাহিনি আমাদের সকলের – আমরা যারা যুদ্ধ দেখে বড় হয়েছি তাদের সামনে বেদবাক্যের মতো ধ্বনিত হয় এসব মূক শব্দ। সেই আমার প্রথম সৈয়দ শামসুল হক পাঠ। তারপর থেকে গল্প-উপন্যাস-কবিতা-কাব্যনাট্য-গদ্য হয়ে সেই পাঠ হয়ে ওঠে স্ফীতাভিজ্ঞ। কিন্তু তাঁর কোনো লেখাই মনে হয় না অকারণ, অযৌক্তিক। মনে হয় না, কারণ জীবনের সারাৎসার তাঁর মৌল প্রেরণা – সমকাল কিংবা ইতিহাস সবই তাঁর চেতনাশানিত রূপকল্প। অনেককাল পরে, তাঁর অসংখ্য রচনায় ¯œাত হওয়ার পরে, তাঁর সেই স্বরূপটিকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি তাঁরই নিজের কথায় –
আমার যাবৎ লেখাই হচ্ছে জীবনের ভোক্তা ও দর্শক এই দুজনের যুগলবন্দী রচনা। অন্যভাবে, আমার সকল লেখাই
হচ্ছে জীবনপূজা নিবেদন ও সেই পূজাগ্রহণের বিবরণ। শিল্পও আসলে তা-ই। শিল্প! শিল্পের ভেতর দিয়েই জীবনকে
আমি অনুভব করেছি; যা কিছু দেখেছি ও জেনেছি সবই আমি শিল্পে অনুবাদ করে নিয়েছি; সেখানেই শেষ নয়, আমার
পূর্ববর্তী ও সমসাময়িকদের কারো কারো অনুবাদেও আমি জীবনের স্বাদ উল্লসিত জিহ্বায় গ্রহণ করেছি।
(প্রণীত জীবন)
কতকাল পেছনে চলে যাই! অর্ধশতাব্দী তো বটেই, তারও অধিক – হয়তো প্রায় ষাট বছর। সেই ষাট বছর আগে একজন মানুষ অবাক চোখে দেখছেন, তারও বাইশ বছর আগে তাঁর নিজ হাতে পোঁতা আমগাছ উন্মত্ত বাতাসের ঝাপটায় দুলছে। একটি সাদামাটা প্রাকৃতিক চিত্রকল্পের অধিক কিছু হওয়ার কথা নয় এটির। কিন্তু তখন বাস্তবের হাওয়াও উন্মত্ত। বাস্তব তাই প্রতীকতা নিয়ে হাজির। এভাবেই একে একে আসতে থাকে ‘কবি’, ‘আনন্দের মৃত্যু’, ‘কালামাঝির চড়নদার’, ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’, ‘নেপেন দারোগার দায়ভার’, ‘নেয়ামতকে নিয়ে গল্প নয়’, ‘জলেশ্বরীর দুই সলিম’, ‘গুপ্ত জীবন, প্রকাশ্য মৃত্যু’, ‘সংসদ সদস্যের জুতো’ – একটানে এই গল্পগুলোর নাম করা গেল বটে কিন্তু এ হলো আইসবার্গের সামান্য একটুখানি আভাস। আর এসব গল্পের একটি থেকে অন্যটির মাঝখানে রয়ে যায় আনন্দ ও বেদনা, কোলাহল ও স্তব্ধতা, ক্রন্দন ও উদযাপনের অযুত উপলক্ষ। কালের সাক্ষী সৈয়দ হক কালকে সাক্ষী করে রেখে যান জীবনের এসব গল্পের মধ্যে।
কালচেতনা তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ থেকেই বর্তমান তাঁর রচনায়। ‘আনন্দের মৃত্যু’ নামক গল্পটিকে পূর্ববঙ্গের ভাষা সংস্কার উদ্যোগ, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এসবের প্রেক্ষাপটে দেখলে এর অন্তঃস্রোতে বয়ে যাওয়া ব্যঙ্গের ধারটুকু বুঝে নেওয়া যায়। ক্ষীণকায় গল্পটিতেও দুই পাকিস্তানের ঔপনিবেশিকতার সম্পর্ক এবং পুঁজি-অবস্থার ইঙ্গিত লক্ষ না করে পারা যায় না। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবসায়-পুঁজির প্রসঙ্গে এক ব্যবসায়ী আরেক ব্যবসায়ীকে বলছে – ‘দ্যাখো, এই এক চমৎকার ব্যাপার। পান জন্মাই আমরা, পান খেতে জানে ওরা। আল্লা তার বান্দার রুজির জন্যে কি তাজা ব্যবস্থাই না করে রেখেছেন।’ শাসকগোষ্ঠী যে পূর্ববাংলাকে আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের রসদ-সরবরাহকারী ভাবত তারই ছায়া এতে খানিকটা ঝলকে উঠল। আর এই ঝলকানি আরো স্পষ্ট ও প্রখর হয়ে উঠবে তাঁর ‘কবি’ গল্পে, যেখানে দরিদ্র-বিত্তহীন এক কবি আবদুর রব মুনশী সুবর্ণ ভবিতব্যের সম্ভাবনা সত্ত্বেও বিসর্জন দেন না বিবেক ও আত্মমর্যাদা – ‘যে মানুষ না তার নামে গান রচনা’ ‘কবি’কে দিয়ে রচনা করা যায় না। তাঁর এই প্রত্যাখ্যান চেতনা সেদিনকার প্রেক্ষাপটে যুগপৎ প্রতীকী ও বাস্তব। অতঃপর এই ধারাবাহিকতায় সৈয়দ শামসুল হকের নীল দংশন এবং নিষিদ্ধ লোবান পাঠ করলে এক নগণ্য বাঙালি কাজী নজরুল ইসলাম ও বিলকিস চরিত্রদুটির মর্ম আমরা উপলব্ধি করি। একা সৈয়দ শামসুল হক-ই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে রচনা করেন ছয়-সাতটি উপন্যাস। একটু আগেই বলেছি, কালচেতনা তাঁর যাত্রাবিন্দু থেকেই তাঁর পথের সঞ্চয়। সেই কালচেতনা মানে কেবল সমকালের সঙ্গে সংযুক্তি-ই নয়, ইতিহাস-সমকাল এবং ভবিতব্যের ত্রিমাত্রায় একটি পূর্ণাঙ্গ আলোকন, যাতে প্রতিফলিত হবে জীবনদর্শন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত স্মৃতিমেধ উপন্যাসটিকে তাই সম্পূর্ণ নতুন এক অর্থে গ্রহণ করতে হয়। পাঠ করে দেখুন কী আশ্চর্য বিদ্যুৎ ঠিকরে পড়ে জিনাত মহলের শব্দবোধের উৎসার থেকে – সাল ১৯৮৬-তে এককালের মুক্তিযোদ্ধার দুঃখজনক পরিণতি প্রত্যক্ষ করা এক রমণী, হয়তো সে বিলকিসেরই উত্তরসূরি, ফেটে পড়ে সগর্জে –
রাজাকারকে তোরা ক্ষমা করতে পারিস, আমি পারি না? রাজাকারকে তোরা মন্ত্রী করতে পারিস, আমি স্বামী করতে
পারি না? একাত্তরের দালালকে স্বাধীনতা পদক দিতে পারিস, একাত্তরের দালালের গলায় মালা আমি দিতে পারি
না?
আমি করলে অপরাধ? আর তোদের বেলায় সেটা উদারতা?
আমাকে তোরা মনে রাখতে বলিস, আর নিজেরা ভুলে
যাবার জন্য রক্ত ঢেকে রাখিস
মনে হতে পারে, সমকালীন পত্রপত্রিকার পাতা থেকে তুলে আনা বা মাঠেঘাটে উচ্চারিত হওয়া কোনো কথকতার অংশবিশেষ। যে-সাহস এই ডকুমেন্টেশনের জন্যে অনিবাযর্, সেকালে তা সকলের মধ্যে ছিল না কিন্তু ছিল সৈয়দ হকের এবং আশ্চর্য নয় যে, বাঙালির
জীবন-প্রেরণা নিংড়ানো উপাদানে রচিত হবে একের পর এক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এবং নূরলদীনের সারাজীবন। আমাদের চেতনায় আর সংশয় থাকে না, যে-ডাক দিয়েছিলেন একদিন নূরলদীন সে-ডাকের প্রত্যুত্তরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান –
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনেরও কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
বাংলা ভাষা বিস্ময়কর দক্ষতায় উত্থান-পতনশীল ধ্বনিময়তায় বয়ে যায় তাঁর রচনায়। কেবল শব্দ দিয়ে কাল-ইতিহাস-চরিত্র এ-সমস্ত কিছুকে মূর্ত বাস্তবে পরিণত করার সাহিত্যিক অধ্যবসায়ে রীতিমতো খননের কাজ চালিয়ে গেছেন সৈয়দ শামসুল হক। নিজের ভাষায়-উপভাষায় নিজের ইতিহাস-সমকাল এবং নিজের চেতনা¯œাত বিষয়াবলিকে প্রকাশ করার কাজটি হয়তো দুঃসাধ্য হলেও অসম্ভব নয় কিন্তু অন্যের ভাষার সঙ্গে নিজের ভাষার পরীক্ষা-পর্ব অনুষ্ঠানেও তাঁর সাফল্য উচ্চাঙ্গের। বলা যায় বাংলা ভাষার শক্তি-পরীক্ষার কঠিন কর্মেও তিনি উতরে যান সাবলীল ভঙ্গিমায়। বস্তুত এটাই সৈয়দ হকের সহজাত মেধা-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য। আমি তাঁর শেক্সপিয়র অনুবাদের কথা বলছি। পাঁচশো বছর আগেকার ভাষা ও জীবনবোধকে আজকের যুগের সঙ্গে প্রস্থাপনার মেলবন্ধন তিনি ঘটান দারুণ সৃজনশীলতায়। প্রাকৃতজনের এবং উপনিবেশিত মানুষের ভাষায় তথাকথিত রাজ-রাজড়াদের এবং ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষার অনুবাদ ঘটিয়ে দেখান, সম্পদে-ঐশ্বর্যে বাঙালিও কম নয়! একটি-দুটি নয়, শেক্সপিয়রেরই তিন-তিনটি নাটকের কথা বলা যায় যেগুলো তাঁর শিল্পসৌকর্যের নমুনা হয়ে রয়েছে – জুলিয়াস সিজার, ম্যাকবেথ এবং টেম্পেস্ট। প্রাকৃত ভাষা বাংলায় দ্যোতিত হয়ে ওঠে অ্যাংলো-স্যাক্সন আভিজাত্য –
যখন ঘুমিয়ে যাবে ডানকান,
সারাদিন পথের কষ্টের পর চোখ ভেঙ্গে ঘুম
তার আসবেই, তারপর তার দুই প্রহরীকে
এমন মাতাল করে দেব আমি সুরায় সুরায়
চেতনার প্রহরী যে স্মৃতি সেটা বাষ্প হয়ে যাবে,
বুদ্ধি লোপ পেয়ে যাবে, তারা নিষ্প্রাণ জন্তুর মতো
যখন ঘুমোবে, তখন সে অরক্ষিত ডানকান –
বলো তার কিনা করতে পারি তুমি আর আমি?
বলো, অসম্ভব কিসে, যদি মাতাল প্রহরীদের
কাঁধে এই ভীষণ হত্যার দায় কৌশলে গড়ায়?
মূল ইংরেজিকে পাশে রেখে পাঠ করলে বাঙালি কবির ভাষান্তরকে সজীব ও গতিময়ই মনে হয়। বাঙালি জাতির বাংলা ভাষা যে বিশ্বের ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেও অনন্য তার সাক্ষ্য সৈয়দ শামসুল হকের অনূদিত শেক্সপিয়র।
প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলার শক্তি ও ঐশ্বর্যকে আবিষ্কার করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। জীবনবোধ, জীবনের বিচিত্র আবেগ ও অনুভূতি, দৃশ্যমান জীবনের ও প্রকৃতির সঙ্গে তার প্রকাশের বহুমাত্রিক সম্বন্ধ – এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন
পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁর স্বাজাত্যবোধ স্বাদেশিকতা এবং ঐতিহ্যসম্পৃক্ততার বহিঃপ্রকাশ। নাথ-সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, মৈমনসিংহ গীতিকা রচয়িতাদের জীবনবোধকে তিনি উপলব্ধি ও আবিষ্কারের চেষ্টা চালান তাঁর ভাষার শক্তি, জীবনবোধের প্রগাঢ়তা আর আবেগের কাব্যময়তার সমন্বয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, কবিত্বের মেধাকে তিনি পূর্ণশক্তিতে কাজে লাগান বাঙালির লোকায়ত ও চিরন্তন জীবনবোধের উদ্ঘাটনে – ফলে অনেক শতাব্দী পরেও ‘পরাণের গহীন ভিতরে’ জেগে ওঠে শাশ্বত বাংলা ও বাঙালি। যে-প্রেরণায় জীবনানন্দ দাশ রচনা করেছিলেন তাঁর রূপসী বাংলা সেরকম এক অনুপ্রেরণায় সৈয়দ শামসুল হকের চেতনায় সৃষ্ট হয় পরাণের গহীন ভিতর। একটি অঞ্চলের ভাষায় রচিত একটি সমগ্র কাব্য কী করে গোটা দেশের কাব্য-পাঠককে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়, সেটা একটা সংগত-কৌতূহলী প্রশ্ন। এর উত্তরও কিন্তু অজানা নয়। পূর্ব-ময়মনসিংহ অঞ্চলের কাব্য যেভাবে বাঙালিকে স্পর্শ করে, তেমনি এ-কাব্যও স্পর্শ করতে পারে পাঠক-হৃদয়কে –
সে কোন বাটিতে কও দিয়াছিলা এমন চুমুক –
নীল হয়্যা গ্যাছে ঠোঁট, হাত পা ও শরীর অবশ,
অথচ চাও না তুমি এই ব্যাধি কখনো সারুক।
আমার জানতে সাধ, ছিল কোন পাতার সে রস?
সে পাতা পানের পাতা মানুষের হিয়ার আকার?
নাকি সে আমের পাতা বড় কচি ঠোঁটের মতন?
তাঁর আঞ্চলিক ভাষার জাদুময়তা তাঁর কাব্যনাটকে আমরা লক্ষ করি। তাঁর গল্প-উপন্যাসের বর্ণনা এবং সংলাপেও ভাষার বেগ ও আবেগ দুটোরই থাকে সমধর্মী সক্রিয়তা। বস্তুত এক চিরন্তন কবি সৈয়দ শামসুল হকের প্রাণচেতনার কেন্দ্রে সজাগ। কেবলই আবেগ নয়, জীবনের যাবতীয় অনুভূতিকে পরখ করার জন্যে সদা উন্মুখ এই কবিসত্তা। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা তার স্বাক্ষর। সেই ‘বুনোবৃষ্টির গান’, ‘একদা এক রাজ্যে’ কিংবা ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ থেকে শুরু করে ‘রজ্জুপথে চলেছি’, ‘বেজান শহরের জন্য কোরাস’ কিংবা ‘বুকের লবণ আর চোখের ম্যাজিক’ পর্যন্ত ছড়ানো তাঁর কবিসত্তার অজস্র প্রতিকল্প। তাঁর কবিতাসমগ্রর দুটি খ- মিলিয়ে হিসাব করি – আমার চোখের সামনে তাঁর ৫৯৯টি কবিতা। শেক্সপিয়র রচনা করেছিলেন ১৫৪টি সনেট। তাঁর প্রথম সনেট শুরু হয় সুন্দরের গোলাপের প্রসঙ্গ দিয়ে এবং শেষ চারটি সনেটে ‘প্রেম’ (‘লাভ’) শব্দটি উচ্চারিত হয় অজস্রবার। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম কবিতায় ছিল আর্দ্রতার প্রত্যাশা – বৃষ্টি এসে ভেজাবে ‘দুরাশার মাঠ’ এবং ৫৯৯-সংখ্যক কবিতায় আর্দ্রতাহীন দগ্ধতা – ‘মানুষের এখন-জীবন/ আগুন পোড়া গাছের মতো/ দগদগে আঙুল তুলে আকাশটা আঁচড়াচ্ছে।’ প্রথম কবিতায়, ছেষট্টি বছর আগে তিনি ছিলেন পরাধীন এবং শেষের কবিতায় তার বায়ান্ন বছর পরে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম। কেন তবু তাঁর দৃষ্টিতে রুক্ষতা আর দগ্ধতার চিত্রকল্প তার উত্তর তাঁর কবিতাতেই মেলে।
যদি বিষয়বস্তুর কথা তুলি, কী বিষয় নিয়ে কবিতা লেখেননি তিনি! শব্দ তাঁর চকচকে নখের আয়নায়, উপমা তাঁর চারপাশে বিরাজিত আর তিনি তো এক চেতন স্যাকরা – যা-ই হাতে নেন, হয়ে ওঠে অলংকার। সারা পৃথিবীর কাব্যজিজ্ঞাসা তাঁর চেতনা জুড়ে সক্রিয়। বিশ্ব-কবিতার অনুবাদে তাঁর সেই কৃতিত্ব হাজির – গ্রিসের ধ্রুপদী বাণী কি ফারসি হাফিজের হৃদয়োৎসার সব-ই তাঁর সহজ সৃজনানন্দের শৈলী। জীবনের নানা কর্মকা-, প্রকৃতি, স্বদেশ, প্রেম, ইতিহাস, রাজনীতি, বহির্বিশ্ব, লোকোজীবন কোনোকিছুই তাঁর মনোযোগের বাইরে ছিল না। এক সর্বগ্রাসী সৃজনান্বেষায় মশগুল তাঁর সাহিত্যকর্ম। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর – দশকের পর
দশক উজিয়ে অন্য কাব্য-সহযাত্রীদের সঙ্গে পা ফেলেন তিনি সমানতালে। বিষয়ে-প্রকাশে থাকেন নিজের নিয়মের প্রতি ধ্যানী। সংকটে-উপপ্লবে তিনিও সাড়া দেন অন্তরের সমর্থতা দিয়ে। ১৯৭১-এর মার্চে লিখেছিলেন তিনি –
দ্যাখো, অন্ধকার চাপা আলোয় যখন উঠে আসে মুয়াজ্জিন
পবিত্র, গম্ভীর
দাঁড়ায় মিনারে
ভরে তোলে ভোর তার আকুল আজানে
তখনি আকাশ তার গোল দেহ ফেটে পড়ে লাল
স্বর্গীয় ফলের মতো
ঈশ্বরের রাজপথ রক্তে ভেসে যায়। …
চারদিকে ঠক ঠক এ কোন্ কুঠার?
এ কোন্ কুঠার ওরা? কিসের উল্লাসে … ’
এর সতেরো বছর পরে ১৯৮৮-তে স্বাধীন ২৫ মার্চে আবার তাঁকে লিখতে হয় – ‘এখনো রাত এগারোটা দশে/ থেমে যায় কবির কলম,/ এখনো রাত এগারোটা দশে/ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালায় পথিক,/ এখনো রাত এগারোটা দশে/ শহরটা চষে ফেরে ট্যাংক/ এবং এখনো রাত এগারোটা দশে/ কোথাও না কোথাও প্রেমিকেরা/ শেষবার চুম্বন করে সংসার/ এবং পেরিয়ে যায় সীমান্ত।/ আর মাত্র চার ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট পরে/ আমিও থেমে যাবো,/ কিন্তু কবিতার বা দেশটির অন্তর্গত/ সবুজের স্পন্দন/ এবং তেরোশ’ নদীর পানি/ থামবে না ॥’
তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাসগুলোতে সৈয়দ শামসুল হককে খানিকটা নৈরাজ্যবাদী বলে মনে হলেও কবিতায় তিনি পূর্বাপর সংগঠিত ও আশাবাদী। একথা সত্য, যে-তিনি বাবর আলীর স্রষ্টা সে-তিনিই ‘ফিরে এসো বাংলাদেশে’রও স্রষ্টা –
জয়নুলের চিত্রে তুমি, আব্বাসের গানে,
ফিরে এসো কাদায় আটকে পড়া গো-গাড়ির চাকা ঠেলে
আবার পথের পরে তুলে দিতে,
ফিরে এসো, ফিরে এসো, বাংলাদেশ, ফিরে এসো তুমি ॥
বাঙালির বিবর্তমান জাতিগত চেতনার সমান্তরালে বিচার্য সৈয়দ শামসুল হকের রচনাবলি। আত্মতার সীমানা থেকে এমন সমগ্রতায় পৌঁছানো একজন রচয়িতা স্বভাবত পরিণত হন জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.