জীবনের সমান চুমুক খোন্দকার আশরাফ হোসেন

মন্ময় জাফর

খোন্দকার আশরাফ হোসেন (১৯৫০-২০১৩) একজন সুদক্ষ কবি ছিলেন। তাঁর তিন রমণীর ক্বাসিদা, পার্থ তোমার তীব্র তীর কিংবা জীবনের সমান চুমুক যাঁরা পড়েছেন, আমার এ-মূল্যায়নের সঙ্গে তাঁরা একমত হবেন। দীর্ঘকাল সম্পাদনা করেছেন একবিংশ –  যার পতাকাতলে নির্ভয়ে পিতার মতো আশ্রয় দিয়েছিলেন বহু নবীন কবিকে যাঁরা খুঁজে ফিরছিলেন কবিতা প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্ম। আশরাফ হোসেনের পৌরোহিত্যে ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করা একবিংশ অচিরেই হয়ে ওঠে  বাংলাদেশের কবিতার স্বনির্ভর মুখপত্র। প্রতিভার ক্ষেত্রে না হলেও, কর্মযজ্ঞের বিবেচনায় ওঁর সঙ্গে তুলনা চলে বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-৭৪), যিনি আশরাফ হোসেনের মতোই ছিলেন একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক, কবি এবং কবিতা পত্রিকার সম্পাদক। আশরাফের সঙ্গে আরো একদিকে সাদৃশ্য রয়েছে বুদ্ধদেবের। কর্মচঞ্চল জীবনের এক পর্যায়ে বড় অকালেই থেমে গিয়েছিল তাঁদের দুজনের গাড়ি। যেন গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই শেকল টেনে কোনো অজানা ইস্টিশনে ট্রেন থামিয়ে দিয়েছে এক নিষ্ঠুর সহযাত্রী।

তবে অধ্যাপক, কবি, সম্পাদক, অনুবাদক – সব পরিচয় ছাপিয়ে আমার কাছে আশরাফ হোসেনের যে-পরিচয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হলো শিক্ষক হিসেবে ওঁকে পাওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শ্রেণিকক্ষে ওঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। কবি হিসেবে আশরাফ হোসেন তখন সুপরিচিত। শিক্ষক হিসেবে মুনশিয়ানার পরিচয় পেলাম কবি আশরাফ যখন অধ্যাপক আশরাফ হিসেবে ইংরেজ রোমান্টিক কবি কোলরিজ (১৭১৮-৮১) পড়াতে এলেন। আফিম-আসক্ত অথচ অসাধারণ কবি কোলরিজের কুবলা খান, সুপ্রাচীন নাবিকের উপাখ্যান এবং বিষণ্ণতা-বিষয়ক কবিতাগুলো একে একে পড়ালেন অধ্যাপক আশরাফ। দৈবক্রমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিও বর্তমানে কোলরিজের এই কবিতাগুলোই পড়াচ্ছি। শিক্ষকের থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের সঙ্গে আমার জ্ঞানলব্ধ বিশ্লেষণ এ-প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সফলতার সঙ্গেই দিতে পারছি বলে আমার বিশ্বাস। অধ্যাপক আশরাফের মতো একজন শিক্ষক এভাবেই বেঁচে থাকবেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্রদের মারফত।

অধ্যাপক আশরাফ যে কবি ছিলেন তার প্রমাণ মিলেছিল ওঁর পাঠদানের ভঙ্গিতে, বিশ্লেষণের দাপটে এবং কবিতার মর্মমূলে প্রবেশ করে নতুন কিছু বলবার ক্ষমতায়। দক্ষ ডুবুরির মতো কবিতাসমুদ্র সিঞ্চন করে কুড়িয়ে এনেছেন মূল্যবান মাণিক্য। পড়াতে গিয়ে মর্ত্য ছেড়ে আকাশবাসীও হয়েছেন কখনো কখনো। এতকিছু সত্ত্বেও শিক্ষক হিসেবে ওঁর শেকড় ভূমিতেই ছিল অনেকখানি প্রোথিত। ক্লাসে নিয়মিত আসতেন। কবিতা পড়তে এবং পড়াতে ভালোবাসতেন এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অনেক সময়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতেন। ঈশ্বরে তেমন বিশ্বাস তাঁর ছিল না; বিশ্বাস ছিল ইহলৌকিকতায়। ধর্মাক্রান্ত বহু ইংরেজি কবিতায় তিনি অবিশ্বাসের চিড় ধরিয়েছিলেন অবলীলায়। তবে মাঝে মাঝে তাঁর মধ্যে পিতৃসুলভ রক্ষণশীলতার প্রকাশ পেতাম। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের (১৯৪৭-২০০৪) ক্লাসে দেখেছি, নির্দ্বিধায় নানাবিধ ট্যাবু বিষয় আলোচনা করে চলেছেন আজাদ। তাঁর মুক্ত আলোচনায় ছাত্রছাত্রীকুলের কে যে কোথায় মূর্ছা গেল, তার প্রতি অধ্যাপক আজাদের বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। অন্যদিকে অধ্যাপক আশরাফ তখনই পিতা আশরাফ হয়ে উঠতেন যখন দেখতাম নারীদেহের বর্ণনাসমৃদ্ধ কবিতা-বিশ্লেষণের আগে ক্লাসে কারো অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, তার একটি আগাম ঘোষণা তিনি দিয়ে রাখতেন। এতকিছুর পরেও কবি আশরাফের কাছে কবিতার পাঠ একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। সাহিত্যের অনেক অধ্যাপকই আমাদের কবিতা পড়িয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউ কবি ছিলেন না। আশরাফ কবি ছিলেন এবং এজন্যেই বিশ্লেষণধর্মী বিরস আলোচনার অনেক ঊর্ধ্বে তিনি উঠতে পেরেছিলেন।

বাংলা কবিতায় পশ্চিমের প্রভাব-সম্পর্কিত গবেষণায় মাত্র তিন বছরে (২০০৬-০৮) পিএইচ.ডি সমাপ্ত করেছিলেন অধ্যাপক আশরাফ। ব্যাপারটি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু এ-বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন তিনি সারা জীবন ধরে। করোটির ভেতরে পিএইচ.ডি তাঁর বহু আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল কেবল কাগজে স্থানান্তর। এসব কিছুর ফাঁকে ফাঁকে গ্রিক কবি সফোক্লিসের ঈদিপাস অনুবাদ করেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য, যে-অনুবাদের স্থায়িত্ব অনেকদিন হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

অপরের সুন্দরী স্ত্রী-সন্দর্শনে অধ্যাপক আশরাফের মধ্যে অনেক সময়ে ঈর্ষার ঝলক দেখেছি। যেসব বাঙালি ইংরেজিতে কবিতা চর্চা করেন, তাঁদের প্রতি তাঁর সুদৃষ্টি ছিল না। ‘এসব কথা বাংলা কবিতায় বহু আগেই লেখা হয়েছে’ – এমনটি প্রায়শই বলতেন তিনি। আমার পেশাগত জীবনে যেসব ন্যায়সংগত প্রাপ্যতা ছিল সেসব বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা আমি পাইনি। হয়তো অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল, যা তিনি অতিক্রম করতে চাননি। এসব সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক দেনা-পাওনার নয়, সবকিছুর ঊর্ধ্বে অধ্যাপক আশরাফ একজন সংবেদনশীল কবি এবং ছাত্রপ্রাণ শিক্ষক হিসেবেই আমার কাছে বেঁচে থাকবেন।

শেষবারের মতো অধ্যাপক আশরাফের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এ-বছরের বাংলা একাডেমীর বইমেলায়। একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার ওঁর কপালে জোটেনি বলে প্রকৃতার্থেই বিস্মিত হয়েছিলাম। বাংলা একাডেমীর অর্ঘ্য অনেকের স্কন্ধে অর্পিত হয়েছে যাঁদের কোনো লেখা পড়বার আগ্রহ কোনোদিন বোধ করিনি। কিছুটা হতাশা এবং ব্যঙ্গের সুরেই অধ্যাপক আশরাফ বলেছিলেন, পুরস্কারপ্রাপ্তির আগেই হয়তোবা ওঁর দেহত্যাগ হবে। সে-উচ্চারণ যে এত সহসা সত্য হবে, সেদিন বুঝিনি।