জীবনের সুন্দর ও ভয়াবহ রূপ

হাসনাত আবদুল হাই

শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে সকল সৃজনশীল কাজই প্রতিভার উদ্ভাস। প্রতিভা নিয়ে জন্ম নেন বলেই কেউ শিল্পী, সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং সংগীতের জগতে পরিচিতি পান। সৃজনশীলতার বাইরে মানুষের সুকৃতির যেসব বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক সেগুলির পেছনেও প্রতিভা কাজ করে, তবে সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভূমিকা থাকে প্রধান হয়ে। একজন শিল্পী অথবা গায়ক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও দৃষ্টি আকর্ষণ করার এবং কোনো-কোনো ক্ষেত্রে প্রশংসা লাভের দাবিদার হতে পারেন, এমন দৃষ্টান্ত চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ। সৃজনশীলতা মানুষের মনের এমন একটি প্রক্রিয়া যা স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে বিকশিত হয়। জন্মগত সূত্রে লব্ধ প্রতিভা এই প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে এবং উদ্দীপ্ত করে তোলে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সৃজনশীল প্রতিভার এই স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশকে বিবর্তনের পথে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। স্বভাব-কবির মতো স্বভাব-শিল্পী যে সহজ-সরলতাকে বৈশিষ্ট্য করে নিজের ভুবন তৈরি করেন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সেখানে বৈচিত্রের সৃষ্টি করে এবং পুনরাবৃত্তির ছকে আবদ্ধ না থেকে নিত্য-নতুন বাঁক ফেরার শক্তি সঞ্চারে ভূমিকা রাখে।

গুলশান হোসেনের শিল্পীজীবনের সূচনা, নিকট অতীত এবং বর্তমান পর্যালোচনা করলে ওপরের কথাগুলি প্রাসঙ্গিক মনে হবে। চিত্রশিল্পী হিসেবে গুলশান ব্যতিক্রমী এবং অনন্য। তাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজেই। শিল্পী হওয়ার জন্য তিনি প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করেননি। তাঁর উচ্চশিক্ষার বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান যার সঙ্গে শিল্পকর্মের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। সেই পর্বের ছাত্রজীবনে শিল্পী হওয়ার অভিলাষ না থাকলেও শিল্পের প্রতি অনুরাগ এবং আগ্রহ নিশ্চয়ই ছিল যথেষ্ট। এই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই প্রতিভার তাড়না এবং প্রজ্ঞার প্রেরণায়  তিনি চিত্রকলার জগতে প্রবেশ করেছেন। সখের শিল্পী হিসেবে তাঁর এই চর্চা শিল্প-ভুবনের সঙ্গে একেবারে সম্পর্করহিত ছিল না। তিনি প্রবীণ এবং সমকালীন শিল্পীদের ছবি অবশ্যই দেখেছেন আগ্রহ নিয়ে। তাঁদেরকে অনুকরণ করার কথা তাঁর মনে হয়েছে কিনা তা তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, কেননা এই লেখাটি কোনো ইন্টারভিউ নেওয়া ছাড়াই সম্পূর্ণ হয়েছে। শিল্প-সমালোচনায় শিল্পীর সঙ্গে আলোচনার যেমন সুবিধা আছে (যেমন, অনেক কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়) আবার অসুবিধাও আছে, কেননা তখন শিল্পীর বক্তব্য প্রায় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। বেশির ভাগ শিল্প-সমালোচনাই এই প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। এর জন্য যে সমালোচনার মান ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়, তা নয়। এখানে শুধু একটা সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতার কথা বলা হলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের পর সখের চিত্রশিল্পী গুলশান প্রায় পূর্ণকালীন শিল্পী হয়ে গেলেন এই অর্থে যে, সংসার দেখাশোনার বাইরে ছবি আঁকা ছাড়া অন্য কোনো বেতনভুক্ত পেশায় যোগ দিলেন না। তাঁর প্রথম দিকের ছবি ছিল অধিকাংশই বিমূর্ত, এর পেছনে দুটি কারণ কাজ করতে পারে। প্রথমটি হলো, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ড্রইংয়ের ওপর যে দক্ষতা লাভে সহায়ক হয়, সখের শিল্পী হিসেবে সেক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকে। দ্বিতীয় কারণ, রঙের সাহায্যে বিমূর্ত ফর্মের সৃষ্টি করে নিজের সৌন্দর্যবোধ প্রকাশের সহজলভ্যতা। তাঁর প্রথম পর্বের এসব বিমূর্ত ছবি রঙের ব্যবহারে প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি হুবহু অনুসরণ না করলেও সহজাত সৌন্দর্যবোধের ভিত্তিতে দৃষ্টিনন্দন হতে পেরেছিল। এই ঘরানার ছবি আঁকতে গিয়ে তাঁর হয়তো বাংলাদেশের বিমূর্ত ধারার ছবির পথপ্রদর্শক মোহাম্মদ কিবরিয়া এবং আমিনুল ইসলামের ছবির কথা মনে হয়েছে। কিন্তু তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি বলেই তাদের অনুকারক হননি, বড়জোর অনুসরণ করেছেন। এসব বিমূর্ত ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রঙের উজ্জ্বলতা এবং ফর্মের অভিনবত্ব। গুলশান বিমূর্ত ধারায় তৈলচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী করেছেন। দর্শকদের প্রশংসা লাভ করলেও আর্ট এস্টাবলিশমেন্ট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি বলে গুলশানের বিমূর্ত ধারার ছবিগুলোকে প্রথমে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করেনি। এখানে এক ধরনের রক্ষণশীলতা কাজ করেছে। হয়তো উন্নাসিকতাও। তাঁর ক্যানভাসে স্পেসের বিভাজন বা জ্যামিতিক বন্ধনের স্থানে রঙের তরল গতিময়তাকে কারো কাছে মনে হয়েছে দুর্বলতা। প্রথম থেকে বর্তমান পর্যন্ত রঙের স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তাই হয়ে গিয়েছে গুলশানের সিগনেচার স্টাইল।

গুলশান হোসেনের প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী হয় ১৯৯৪ সালে ঢাকায় বনানীর লা গ্যালারিতে। এর পরের বছর তাঁর ছবির একক প্রদর্শনী হলো ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রাঁসেসে। তাঁর সর্বশেষ একক প্রদর্শনী সংখ্যায় সপ্তদশ, যা প্রদর্শিত হয়েছে ঢাকার এথেনা গ্যালারিতে এই বছরে ১৬ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত। ১৯৯৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গুলশান হোসেনের শিল্পীজীবনে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। ২০০৬ সালে ঢাকার ইউনিভার্সিটি অফ ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ থেকে তিনি অর্জন করেছেন চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি। এরপরই তিনি চলে যান যুক্তরাজ্যে, যেখানে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন থেকে ড্রইং ও পেইন্টিংয়ে গ্রহণ করেন মাস্টার্স অফ ফাইন আর্টস ডিগ্রি। নিষ্ঠা এবং একাগ্রতার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তাঁর যে ঘাটতি ছিল তিনি তা সফলভাবে পূরণ করেন। কিন্তু এর আগেই বেশ কয়েকটি একক এবং গ্রম্নপ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে তিনি বাংলাদেশের শিল্পজগতে নিজেকে উপযুক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিদেশে প্রশিক্ষণ লাভের আগেই তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শনী ও ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছেন, যার ফলে তাঁর কাজে আন্তর্জাতিক ধারার প্রকাশ ঘটেছে।

গুলশান হোসেনের যে একক প্রদর্শনী জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি ২০১৬-তে হয়ে গেল  সেখানে তাঁর কাজে অতীতের হুবহু পুনরাবৃত্তি নেই। তবে ধারাবাহিকতা আছে। এই ধারাবাহিকতা প্রচ্ছন্ন হলেও স্পষ্ট এবং এর ভিত্তিতে তাঁর শিল্পীসত্তার ক্রমবিকাশ লক্ষ করা যায়।

গুলশান হোসেনের ছবির বিষয় প্রকৃতি ও মানুষ। এদের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাতে চেয়েছেন। প্রকৃতি এসেছে নদী, মাঠ, গাছপালার অনুষঙ্গে। নর-নারীর প্রতিকৃতি দেখা যায় কখনো ছোট স্কেলে, কখনো লাইফ সাইজে। বিভিন্ন রঙের সহাবস্থানে ও মিলনে পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর ছবির বিষয়। উজ্জ্বল রঙের সঙ্গে মিশেছে রঙের অবদমিত রূপ। রং দিয়ে বিভাজিত হয়েছে স্পেস। এই বিভাজনে স্পেস কখনো বিভক্ত হয়েছে আনুভূমিকভাবে,

কখনো উলস্নম্ব আকারে, আবার কখনো আয়তাকারে। এথেনায় প্রদর্শিত ‘স্টোরি অফ ওয়াটার লিলি-২’ (২০১৬) এবং ‘ইন সার্চ অফ লাইফ-৩’ (২০১৬) স্পেসের এই বিভাজনের দৃষ্টান্ত। প্রথমটিতে কয়েকটি ছোট শাপলা ফুল সবুজ এবং নীল রং স্পেসের মধ্যে সেতুবন্ধ হয়ে বিভাজনের মধ্যে ঐক্যের সূত্র রচনা করেছে। স্পেসের সমান্তরাল বিভাজন ফরাসি শিল্পী মনের ‘ওয়াটার লিলি’র অবিভাজ্য বিসত্মার থেকে পৃথক হয়ে স্বকীয়তার পরিচয় বহন করছে। দ্বিতীয় ছবি, ‘ইন সার্চ অফ লাইফ’ স্পেসকে আয়তাকার এবং বর্গাকারে বিভক্ত করে ফ্রেমের মতো বিচ্ছিন্ন বিষয়কে ধারণ করে কোলাজের রূপ গ্রহণ করেছে। মাঝখানের বর্গাকার খ–ত স্পেসে সবুজ ও নীল রং এ মানুষের আবক্ষমূর্তি অর্ধবির্মূততার ভেতর একটি কাহিনির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সপ্তদশ একক প্রদর্শনীতে গুলশান হোসেনের ছবি শিল্পরসিককে হয় কোনো দৃশ্যের দর্শক হতে বলে অথবা গল্প শোনায়। এই দৃশ্য এবং গল্প বাংলাদেশের প্রকৃতির এবং মানুষের। ‘হারিয়ে যাচ্ছে নদী’ (২০১৫) ছবিটি একটি সংকটদৃশ্যের বর্ণনা এবং শিল্পিত উপস্থাপন। নিচের নৌকাটি বাদ দিলে ছবিটি হয়ে যায় কেবলই বিমূর্ত দৃশ্য, যেখানে স্পেস বিভাজিত হয়েছে সমান্তরালে নদীর অনুকরণে। ‘নতুন দিনের অপেক্ষায়’ (২০১৬) ছবিটিতে গল্পের বীজ বোনা হয়েছে নিচে, ডানদিকে শ্বেতবসনা দুই নারীর দ-ায়মান অবয়ববের উপস্থিতি দেখিয়ে। এখানে স্পেসকে বিভক্ত করা হয়েছে উলস্নম্ব মোটা দাগে এবং বিভিন্ন পরিসরের আয়তাকারে। নিচের কালো রঙের আধিক্য এবং উপরিভাগে নীলের মাঝখানে অনেকটা সবুজ

যে-বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে তার মধ্যেই রয়েছে প্রতীক্ষার ইঙ্গিত, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রার বাসনা। এখানে এক ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে, যা গুলশানের যেসব ছবিতে সাধারণ নরনারীর উপস্থিতি দেখা যায় তাঁর অন্তর্নিহিত বক্তব্য।

‘কোথায় গেল দিনগুলি’ (২০১৬) ছবিতে নিচের দিকে দুজন উপবিষ্ট মানুষের পশ্চাদপটে নস্টালজিয়ার পাশাপাশি আশার সঞ্চারও করে হালকা সবুজ এবং মিশ্র নীল রঙের ব্যবহারে। যেসব ছবিতে গুলশান গল্প বলেছেন তার মতো এই ছবিটিও অর্ধবিমূর্ত। তাঁর সব অর্ধবিমূর্ত ছবিতে বাস্তবতা ফর্ম এবং রঙের ভেতর আশ্রয় নিয়ে মায়াবী আবহ সৃষ্টি করেছে। জ্যামিতিক বিভাজনে রঙের সৃষ্টি বহুতলের সাহায্যে আঁকা ‘অরণ্যকে ভালোবাসো’ (২০১৬) ছবিটি প্রায় অধরা থেকে অলৌকিক অনুভূতির জন্ম দেয়।

রঙের ব্যবহারই গুলশান হোসেনের শিল্পক্ষমতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর ছবিতে রং সৃষ্টি করে রেখা, নানা ধরনের ফর্ম। বড় স্পেসের ভেতর খ–খ- স্পেস যেখানে বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্যের আভাস দেয়। রং দিয়ে তিনি তৈরি করেন টেক্সচার, সেখানে খেলা করে আলো-ছায়া। ‘কম্পোজিশন ইন রেড’ (২০১৫) এবং ‘কম্পোজিশন ইন বস্নু অ্যান্ড গ্রিন’ (২০১৫) ছবি দুটিতে টেক্সচার রঙের উজ্জ্বলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে স্পেসের বিভাজনকে সামনে নিয়ে এসেছে। এখানে লালের মতো উজ্জ্বল রংকে আয়ত্তে এনে ফর্ম সৃষ্টির কুশলতা দেখিযেছেন গুলশান।

গুলশান প্রকৃতি ও জীবনকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে। এই প্রকৃতি গ্রামীণ ও নাগরিক, উভয়ই। উভয়ের পটভূমিতে মানুষের ফিগার বসিয়ে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের যে-বর্ণনা দিয়েছেন তা সমকালীন। রোমান্টিকতাবর্জিত হলেও এসব ছবিতে জীবনের সৌন্দর্য আবিষ্কারের ইঙ্গিত রয়েছে।

জীবনের অসুন্দর, কুৎসিৎ এবং ভয়াবহ রূপ গুলশানের দৃষ্টি এড়ায়নি। বৃক্ষ নিধন, নদী গ্রাস থেকে নারীর ওপর নির্যাতন তাঁর ছবির বিষয় হয়েছে। ‘স্টোরি অফ দেয়ার পেইন’ (২০১৫) ছবিগুলি মূর্ততায় সামাজিক অন্যয়ের বিরুদ্ধে এক-একটি বিশাল প্রতিবাদ। গুলশান রং, তুলি, ক্যানভাসকে সামাজিক শোষণ ও নিপীড়ন দূর করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সৌন্দর্যবোধ থেকে উৎসারিত সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশের এসব দৃষ্টান্ত তাঁর সমকালীন চিমত্মার প্রতিফলন।

গুলশান জীবনকে ভালোবাসেন। জীবনকে সবার জন্য সুন্দররূপে পেতে আগ্রহী। এই আগ্রহের প্রতিফলন ঘটেছে এথেনায়  অনুষ্ঠিত তাঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে।  আগামীতে প্রকৃতি পরিবেষ্টিত এবং নাগরিক জীবনের আরো ঘনিষ্ঠ প্রকাশ দেখা যাবে তাঁর কাজে, এই আশা তার অনুরাগী দর্শকদের।