জ্যোৎস্নার ছোঁয়ায় যে-মানুষটি প্রতিবাদ করেছিল

জাকির তালুকদার

কয়েকটা বাবলাকাঁটা আর খয়েরগাছ ছাড়া এই মাঠে থাকার মধ্যে আছে শুধু ঘাস। কথা ছিল এখানে গ্রামের গোরস্তান হবে। কিন্তু সবটুকু জমির মালিকানা না পাওয়ায় কাজটা করা হয়ে ওঠেনি। সাত শরিকের মধ্যে তিনজন জমি লিখে দিয়েছে গোরস্তানের জন্য। চারজন দেয়নি। সে-কারণে বারো বছর ধরে পড়ে আছে পুরো জমি। কেউ আসে না ফসল ফলাতে। ফলে মাটির বড় বড় চাঁইয়ের ফাঁকে-ফাঁকে বেড়ে উঠেছে ঘাসের জঙ্গল। এই মাঠে দাঁড়ালে জ্যোৎস্না বোঝা যায় খুব সুন্দর। জ্যোৎস্নারাতে মাঠের মধ্যে দাঁড়ালে মনে হয় পবিত্র মোলায়েম অপার্থিব এক আলো ঢুকে যাচ্ছে শরীরের সব লোমকূপে।
বদরে আলমকে কবি বলার কেউ নেই, তার মধ্যে কবিত্ব দেখেনি কেউ কোনোদিন, নিজেকে নিজেও কখনো কবি ভাবে না বদরে আলম। তবু জ্যোৎস্নারাত তাকে ডাকে। সে-ও সাড়া দেয় সে-জ্যোৎস্নার ডাকে।
অনেক রাত অবধি চাঁদে-পাওয়া মানুষের মতো ঘুরে বেড়ায় কিংবা বসে থাকে আষাঢ়ের বানের পানির মতো জ্যোৎস্নাবানে ডুবে থাকা মাঠে। কথায় কথায় আল্লাহর শোকর গুজারি করা তার অভ্যাস। মাঠের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে অন্তত কয়েকবার নিজেকে এই কথা সে মনে করিয়ে দেয় যে, খোদার দরবারে লাখ-লাখ শোকর জানানো তার কর্তব্য, কেননা, খোদা তাকে এত সুন্দর জ্যোৎস্না দেখার তওফিক দিয়েছে।
দিনের বেলা এই বদরে আলমকে দেখে বোঝাই যায় না, সে এত রোমান্টিক মনের অধিকারী। ছোটবেলা থেকেই দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর রমজানের রোজায় অভ্যস্ত। কৈশোরে বছর তিনেক পড়েছিল গাঁয়ের মক্তবে। পড়া বলতে অতটুকুই। কেতাবি পড়াশোনায় ছেদ ঘটলেও সমাজে থাকলে মানুষের তথ্যভাণ্ডারে কিছু-না-কিছু যোগ হয়েই যায়। তার ইসলামিজ্ঞান বাড়ে ওয়াজ-নসিহত শুনে। আশপাশে গাঁ-গঞ্জে যত ওয়াজ মাহফিল হয়, সব জায়গাতেই পারতপক্ষে তার যাওয়া চাই। আর দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে তার জ্ঞান চায়ের দোকানে খবরের কাগজপডুয়া লোকের আড্ডা থেকে। অন্য কোনো কাজ শেখা হয়নি বদরে আলমের। কৈশোর থেকেই গাঁয়ের মসজিদে আজান দেওয়া ছিল তার শখের নেশা। চিকন মেয়েলি সুরেলা গলার আজানের সুখ্যাতি তার ছিল। যতদিন যায়, সুরা-দোয়া তেলাওয়াতের দক্ষতা তার বেড়ে চলে। শেষে সেটাই তার পেশা হয়ে দাঁড়াবে এ-কথা সে নিজেও কখনো ভেবেছিল কি? এছাড়া অবশ্য তার কোনো উপায়ও ছিল না। ছোটবেলায় বাপ মরেছে। মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। জমি নেই যে চাষবাস করবে। পুঁজিপাট্টা নেই যে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল যে, মানুষের কাছ থেকে ধর্মীয় বিষয়াদিতে চাঁদাপত্র তোলায় তার সহজাত দক্ষতা রয়েছে। কোরবানির ঈদে মক্তব-মাদ্রাসার জন্য কোরবানির চামড়া চেয়ে বেড়ানো, জুমাবারে মসজিদের জন্য মুসল্লিদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা, তালেবে-এলেমদের জায়গির থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া, ওরস-মিলাদের জন্য চাঁদা তোলা ইত্যাদি কাজে তাকে সবসময় আগ বাড়িয়ে যেতে দেখা যায়। এখন সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তার পেশা। সে এখন মসজিদ-ঈদগাহ-মাদ্রাসার জন্য প্রফেশনাল চাঁদা আদায়কারী। পাটি বিছিয়ে পথের পাশে মাইক হাতে তাকে বসিয়ে দাও, সে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেশকিছু টাকা তুলে ফেলবে। যেখান থেকে অন্য লোক চাঁদা চাইতে গেলে দশ টাকার বেশি পায় না, সেখান থেকে সে বিশ-ত্রিশ এমনকি পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত তুলে নিয়ে চলে আসবে।
তার এই দক্ষতা আশপাশের দশ-বারোটা গাঁয়ে সুবিদিত। ফলে নলডাঙায় নতুন মসজিদ তৈরি হবে, তো টাকা তোলার জন্য ডাকো বদরে আলমকে। কিংবা বাসুদেবপুরে নতুন ঈদগাহ তৈরি হবে, ডাকো বদরে আলমকে। অথবা বীরকুৎসায় কওমি মাদ্রাসা বসবে, শরণাপন্ন হও বদরে আলমের।
প্রথম প্রথম সে কমিশন পেত শতকরা পঁচিশ টাকা। এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তাছাড়া নামডাকও বেড়েছে তার। এখন তার কমিশন শতকরা পঁয়ত্রিশ টাকা।
লিকলিকে শরীর তার। লম্বায় প্রায় ছয় ফুট। শুকনো হওয়ার জন্য আরো লম্বা দেখায়। নিজের উচ্চতা নিয়ে গাঁয়ে সে একটু লজ্জিতও বোধহয়। এ-কারণে সবসময় সামনের দিকে কুঁজো হয়ে থাকে। দাড়ি-গোঁফে কোনোদিন ক্ষুর ছোঁয়ায়নি সে। কিশোর বয়সেই হাদিস শুনেছিল Ñ যে-ব্যক্তি দুনিয়ায় কোনোদিন দাড়ি কামাবে না, সে বেহেস্তে ইব্রাহিম পয়গম্বরের সঙ্গী হবে। কখনো না কামানোর ফলে তার দাড়ি পাতলা। মোলায়েম ও কচি একটা ভাব ফুটে থাকে মুখমণ্ডলে। পরনে থাকে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। টুপি মাথায়। সাদা গোল টুপি। সব মিলিয়ে একেবারেই সাধারণ ছিমছাম চেহারা তার। তার বিশেষত্ব বোঝা যায় শুধু তখনই, যখন সে দোয়া-কালাম তেলাওয়াত করে ঘুরে ঘুরে টাকা তোলে। পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে অনায়াস সাবলীলতা তখন তাকে বিশিষ্ট করে তোলে। মনে হবে তার জন্ম হয়েছে এই কাজের জন্যই।
এখন সে চাঁদা তুলছে নলডাঙার বেহেস্তি নূর জামে মসজিদের জন্য। মসজিদের জন্য জমি কিনে দিয়েছে আলহাজ আবদুল মজিদ। আগে লোকটা নাকি ছিল চোরাচালানি। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ বর্ডারে ইধারকা মাল উধার আর উধারকা মাল ইধার করত। তখন তার দাপট ছিল প্রচণ্ড। থানা-পুলিশ-বিডিআর সব তার কেনা। দিনে হাজার টাকার ওপরে শুধু মদের খরচ ছিল তার। মেয়েমানুষ নিয়ে সে যেসব কাজ করেছে সেগুলো এখনো এ-তল্লাটে কিংবদন্তি হয়ে আছে। লেখাপড়া তেমন জানে না; কিন্তু তার বুদ্ধির কাছে বিএ-এমএ পাশ নস্যি। এরশাদ প্রেসিডেন্ট থাকার সময় এখানে মিটিং করতে এলে সে মঞ্চে উঠে নিজের হাতে এরশাদকে উপহার দিয়েছিল সোনার লাঙল। তো বেশ টাকাকড়ি কামিয়ে নিয়ে তারপরে সময়মতো তওবা করেছে আবদুল মজিদ। গঞ্জের সবচেয়ে বড় শাড়ি-কাপড়ের দোকান এখন তার। বেশ কয়েকটা বাস-ট্রাকেরও মালিক সে। হজ করে আসার পর থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। মদ-মাগির নেশা সে ত্যাগ করেছে। এখন তার দোকানে দিনভর বেচাকেনা চলে। সে ক্যাশে বসে বসে তসবিহ টেপে।
সে বলে যে, গরিবঘরের ছেলে হয়েও সে এত শান-শওকতের মালিক হয়েছে শুধু আল্লাহর দয়ায়। তাই সে চায়, তার এলাকায় একটা আল্লাহর ঘর হোক, যে-ঘরে মুসল্লিরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারবে, যে-ঘরের মিনার থেকে দিনে পাঁচবার দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে আল্লাহর পথে আসার ডাক। সে তাই এককথায় মসজিদের নামে দান করে দিয়েছে পুরো একবিঘা জমি।
ছয়মাস হলো এই মসজিদের জন্য চাঁদা তুলছে বদরে আলম। গঞ্জের এ-মাথা থেকে বাসে ওঠে। বয়ান করে, চাঁদা তোলে। মাইল দুয়েক দূরের পরের স্টপেজে নেমে পড়ে। সেখান থেকে ওঠে ফিরতি গাড়িতে। চাঁদা তুলতে তুলতে এসে পৌঁছায় গঞ্জে। এভাবে দিনভর বাসবদল। সারাদিন চাঁদা তোলার পরে এশার নামাজ শেষে মসজিদ কমিটির কাছে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে নিজের কমিশন বুঝে নিয়ে বাড়ির পথ ধরা। তার আগে চাল-ডাল মাছ-তরকারি কিনে নিতে হয়।

দুই
আজ মজিদ হাজির কাপড়ের দোকানে চাঁদার টাকা জমা দিতে গিয়ে শোনে, হাজি সায়েব মসজিদে গেছে। একটু অবাক হয় বদরে আলম। রাতকালে ওই আধাভাঙা মসজিদে কী করছে হাজি সায়েব!
সেখানে গিয়ে এলাকাটাকে যেন চিনতেই পারে না বদরে আলম। রাতারাতি এমন বদলে গেল কেমন করে! মসজিদপ্রাঙ্গণ আলোয় আলোময়। পল্লিবিদ্যুতের খুঁটি থেকে লাইন টেনে আলো জ্বালানো হয়েছে। সে-আলোতে প্লাস্টারবিহীন দেয়াল আরো প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। পাল্লাবিহীন দরজা দিয়ে দেখা যায় ভেতরে সারি সারি খাটিয়া পাতা। প্রত্যেক খাটিয়ার ওপর একটা করে বেডরোল। মসজিদ প্রাঙ্গণে পঞ্চাশ-ষাটজন মানুষ। গাঁয়ের মানুষ সবাই সবাইকে চেনে। আশপাশে সাত গ্রামের প্রায় সবাইকে চেনে বদরে আলম। কিন্তু এই মানুষগুলো একটাও তাদের পরিচিত নয়।
কোনো বড় তবলিগ-দল এসেছে মনে হয়, মনে মনে ভাবে বদরে আলম। কিন্তু একটু খটকাও লাগে। তবলিগের মানুষজনের কথাবার্তা, চালচলন খুব বিনয়ী হয়। কিন্তু এই দলটির সবাই দাড়ি-টুপিঅলা যুবক হলেও আচরণের মধ্যে একধরনের দম্ভ আর শক্তির প্রকাশ। একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন হাজি আবদুল মজিদ। তাকেও একটু থতমত খাওয়া চেহারাতেই দেখা যাচ্ছে। যেন বুঝতে পারছেন না কী করবেন। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় বদরে আলম। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে Ñ চাচা এই তবলিগ-সায়েবরা কই থেকে আইছে?
হাজি মজিদও নিচুস্বরে বলে Ñ এরা তবলিগ না। ইসলামি মুজাহিদ। বাংলাভাইয়ের নাম শুনিছো না? এর বাংলাভাইয়ের লোক। আইছে সর্বহারা খতম করতে।
তবলিগ না! তাহলে মজ্জিদে ঢুকল ক্যান? আপনে মজ্জিদে থাকতে দিলেন ক্যান?
আরে আমি থাকতে না দেওয়ার কে? থানার ওসি সায়েব নিজে আইছিল। এসপি সায়েব আধঘণ্টা পরপর মোবাইলে কথা কয় তার সঙ্গে। মন্ত্রী নাকি নিজে বাংলাভাইকে এখানে আসতে কইছেন। আমার ঘাড়ে কয়খান মাথা আছে কও! আমি কীভাবে মন্ত্রীর অর্ডার না শুনে পারি?
লোকজনকে বেশ সুশৃঙ্খল কর্মতৎপর দেখা যায়। দুজন শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে চুলা বানানোর জন্য। অন্যরা জিনিসপত্র গোছগাছ করছে।
বদরে আলম ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে Ñ বাংলাভাই কোন জন?
তাঁই ভিতরে আছে।
মানুষডা আসলে কী চাচা?
খুব বড় যোদ্ধা নাকি। প্যালেস্টাইনে ইয়াসির আরাফাতের বাহিনীতে আছিল। পরে নাকি আফগানিস্তানে লাদেনের সঙ্গে মিল্যাও আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ করিছে।
ইরাকে যায় নাই? সাদ্দাম হোসেনের কাছে?
কী জানি! গেছিল বোধহয়!
অনেক অস্ত্র আছে নাকি চাচা?
আমি তো দেখি নাই। তবে চার-পাঁচখান বড় বড় কাঠের সিন্দুক দেখছি। ওইগুলানে বোধহয় অস্ত্র ভরা আছে।
একজন লোক কোনো একটা কাজে তাদের পাশ দিয়ে যায়। তড়িঘড়ি তাকে সালাম ঠোকে বদরে আলম Ñ আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালেকুম আসসালাম ওয়া রহমতুল্লাহ।
লোকটা একটু দাঁড়ায়।
বদরে আলম সমীহের দৃষ্টিতে তাকায় লোকটার দিকে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে Ñ জনাবের বাড়ি কোন জেলায়?
হো-হো করে হাসে লোকটা। বলে, আমরা ইসলামের সৈনিক। যখন যেখানে যুদ্ধ সেখানেই যাই। ভুলেই গেছি নিজের বাড়িঘরের কথা।
আরেকজন এগিয়ে আসে তাদের দিকে Ñ হাজি সায়েব কেডা? আপনেরে ডাকতিছে আমাগের সিপাহসালার সায়েব।
জে?
আমাগের নেতা ডাকতিছে আপনেরে। ভিতরে যান।
পায়ে পায়ে ভেতরের দিকে এগোয় হাজি আবদুল মজিদ। তার সঙ্গে সঙ্গে চলে বদরে আলমও।
একটা টুলের ওপর বসে আছে নেতা। ওদের দেখে উঠে দাঁড়ায়। এই লোকই বাংলাভাই!
একটু হতাশই হয় বদরে আলম। বিশালদেহী একটা লোককে দেখবে বলে আশা করেছিল সে। কিন্তু লোকটা চেহারাতেই মাঝারি গড়নের। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। দাড়ি নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত। কুচকুচে কালো দাড়ি। গায়ের রং কালো। ভেবেছিল লোকটার শরীর হবে মেদহীন টানটান; কিন্তু তার বদলে পেটে বেশ বড়সড় একটা ভুঁড়ি। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়েই থমকে যায় বদরে আলম। বুঝে ফেলে লোকটার বিশেষত্ব এখানেই। চোখের মণি নড়ে না বললেই চলে। হাসি ফোটে না চোখে। মরা মানুষের চোখের মতো স্থির, ভাবলেশহীন। ওই চোখের দিকে তাকালে অশুভ একটা ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। নিজের অজান্তেই হিম হয়ে যায় বুকের ভেতরটা।
আপনাদের মসজিদের সবকিছু ঠিক আছে হাজি সাহেব। শুধু বাথরুম খারাপ। আপনি এক কাজ করুন। রাতেই দু-তিনজন মিস্ত্রি জোগাড় করুন। সিমেন্ট, বালু যা লাগে জোগাড় করে ফেলুন। রাতের মধ্যেই ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে বাথরুম-ল্যাট্রিন।
নিচু গমগমে গলা। প্রতিটি শব্দ আলাদা করে উচ্চারণ করা। মনে হয় কথাগুলো কানের মধ্যে গেঁথে যায়।
একটু গাঁইগুঁই করে হাজি মজিদ Ñ আমাগের গাঁয়ে মিস্ত্রি নাই জনাব। অন্য গেরাম থাক্যা আনাতে হবি। এত রাত্তিরে মিস্ত্রি পাবো কিনা…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাংলাভাই বলে, মিস্ত্রি পেতে হবে। আপনি লোক পাঠান। অন্য জিনিসপত্র জোগাড় করে ফেলুন।
কিন্তু!
কোনো কিন্তু নাই। যা বললাম তাই করেন। আর আপনাদের চেয়ারম্যানকে খবর পাঠানো হয়েছে? সে এখনো আসছে না কেন? আপনি তাকেও খবর দেবেন। আজ রাতেই যেন দেখা করে আমার সঙ্গে।
জি, জি!
যান। এখানে আপনার থাকার দরকার নাই। যা যা করতে বললাম, সেই কাজগুলি ঠিকঠাক করবেন। যান।
তার সামনে থেকে সরে আসতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে হাজি মজিদ আর বদরে আলম।

তিন
পরদিন ফজরের ওয়াক্তে বদরে আলম সচকিত হয়ে শোনে, নতুন একটা আজান হচ্ছে। তার বাড়ি থেকে তিনটে মসজিদের আজান শোনা যায়। আজ শোনা গেল চারটি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বদরে আলম ভেবেই পায় না চতুর্থ আজানের ধ্বনি কোন মসজিদ থেকে আসছে। সে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে আজানের শব্দ লক্ষ করে। কিছুদূর এগিয়েই সে বুঝতে পারে এই আজানটা আসছে গঞ্জের নির্মীয়মাণ মসজিদ থেকে, যার জন্য চাঁদা তোলে সে। একটু আশ্চর্য হয় সে। মসজিদে আজান দিয়ে নামাজ পড়া শুরু করা মানে মসজিদের কার্যক্রম চিরস্থায়ীভাবে শুরু করা। সেখানে যারা এই মসজিদ বানাল, এই গাঁয়ের মানুষ, তারা কিছুই জানল না! বহিরাগত একদল মানুষ নিজেরা মসজিদে ঢুকে নিজেদের ইচ্ছামতো কার্যক্রম শুরু করে দিলো! এ তো সাধারণ ভব্যতাতেও মেলানো যায় না। অভিমানে ফুলে ওঠে তার বুক। এই মসজিদের জন্য গত ছয়টা মাস যাবৎ কী পরিশ্রমই না সে করছে! অথচ মসজিদে আজ প্রথম নামাজ শুরু হতে যাচ্ছে এ-কথা কেউ তাকে জানাল না। অন্তত হাজি আবদুল মজিদের উচিত ছিল তাকে জানানো। তবু যেহেতু আজান হয়ে গেছে, সে এই মসজিদেই নামাজ পড়ার জন্য অজু করে রওনা দেয়।
মসজিদের দরজার কাছে যেতেই আবার হোঁচট। মসজিদ-চত্বর ঘিরে টহল দিচ্ছে বাংলাভাইয়ের লোকজন। তারা বাধা দেয় বদরে আলমকে Ñ না জনাব, এই মসজিদে নামাজ পড়বে শুধু মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যরাই। অন্য লোকের জন্য এই মসজিদে প্রবেশ নিষেধ।
কোনো নামাজির জন্য মসজিদে ঢোকা নিষেধ হতে পারে! তাহলে সেটা আবার খোদার ঘর হয় কী করে!
বেলা দশটার দিকে শুরু হলো বাংলাভাইয়ের দলের মিছিল। সে মিছিল দেখে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে গাঁয়ের মানুষের। মিছিলের মানুষের সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে তারা যুদ্ধে যাচ্ছে।
সবার সামনে বাংলাভাই। পায়ে বুট, পরনে কাবুলি ড্রেস, মাথায় টুপি। হাতে আকাশের দিকে মুখ করে ধরে রাখা নাঙা তলোয়ার।
মিছিলের অন্যদের কারো হাতে ছোরা, কারো হাতে বল্লম। বন্দুক-পিস্তল দেখা যাচ্ছে না। হয়তো সেগুলো সবসময় বের করা হয় না।
নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর!
আল্লাহু আকবর বলার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রগুলো উঁচু হয় আকাশের দিকে। সেগুলোর ফলায় রোদ ঠিকরে পড়ে এসে ধাঁধিয়ে দিচ্ছে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসীর চোখ। ভীতি-বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে গ্রামের মানুষ। এমনটি এর আগে কেউ কোনোদিন দেখেনি।
সব মতবাদ আজকে শেষ, বাংলাভাইয়ের বাংলাদেশ।
জেহাদ জেহাদ জেহাদ চাই, জেহাদ করে বাঁচতে চাই।
বিপ্লব বিপ্লব, ইসলামি বিপ্লব।
একটা-দুইটা কাফের ধরো, সকাল-বিকাল জবাই করো।
একটা-দুইটা বেদ্বীন ধরো, সকাল-বিকাল জবাই করো।
আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান।

পরদিন হাইস্কুল মাঠে জনসভা হয়। বাংলাভাইয়ের জনসভা।
জেলা সদর থেকে এক ভ্যান পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছিল জনসভার পাশের রাস্তায়। লোকজন ততদিনে প্রায় জেনে গেছে, রবিউল মন্ত্রীর ভাতিজা অত্যাচারী বদমাশ গামাকে যে কিছুদিন আগে মেরে ফেলেছে সর্বহারা পার্টি, তার প্রতিশোধ নিতে এলাকা থেকে সর্বহারা নির্মূল করার জন্যেই মন্ত্রী ডেকে এনেছে বাংলাভাইকে। পুলিশ এখন বাংলাভাইয়ের সাথি।
গাঁয়ের পুরুষরা প্রায় সবাই আসে জনসভায়। আসতে বাধ্য হয়। কেননা, বাড়ি বাড়ি আগেই খবর পৌঁছে গেছে যে, এখন এই এলাকায় বসবাস করতে হলে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। সেই নিয়মগুলো বলে দেওয়া হবে জনসভায়। গ্রামের সরকারি দলের লোকেরা যোগ দিয়েছে বাংলাভাইয়ের সঙ্গে। তারাই অনেক অনেক অনুরোধ করে বাংলাভাইকে এনেছে এ-এলাকায়। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে আছে। সাধারণ মানুষ তো ভয় পাবেই।
জনসভায় দাবি করা হয়, এই এলাকা সর্বহারা পার্টির ক্যাডারে ছেয়ে গেছে। সর্বহারা হচ্ছে নিকৃষ্ট শ্রেণির জীব। তারা কমিউনিস্ট। আল্লাহ-খোদা মানে না। ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন। তারা মানুষের জান-মাল কেড়ে নেয়। অতএব সর্বহারাদের খতম করতে হবে। জনসভায় মাইকে দাঁড়িয়ে বাংলাভাই বলে Ñ আমি সর্বহারা যারা আছ তাদেরকে একটা সুযোগ দিতে চাই। আগামীকাল মাগরিবের ওয়াক্ত পর্যন্ত তোমাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। এই সময়ের মধ্যে যারা আমাদের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করবে, তওবা করবে, তাদের প্রাণভিক্ষা দেওয়া হবে। আগামীকাল সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হবে সর্বহারা নির্মূল অভিযান। তখন আর কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না।
জনসভা থেকে গাঁয়ের নারী-পুরুষ, সব প্রাপ্ত বয়স্কদের নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করা হলো। নারীরা বোরখা ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। পুরুষদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। রাস্তায় বা বাহিরে বেগানা নারী-পুরুষ বাক্যালাপ করতে পারবে না।
আবার মনে করিয়ে দেওয়া হলো, কেউ যদি কোনো সর্বহারাকে কোনোভাবে সহযোগিতা করে তাহলে তার রেহাই নেই।

পরদিন সকালে কলেজ-ছাত্র রফিকের লাশ পাওয়া গেল এখান থেকে তিন মাইল দূরে উল্টাডাঙার বিলের মধ্যে। একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা। ওপরদিকে পা, মাথা নিচে। তার পরের দিন বাদশা, মানিক আর সুবলের লাশ। পরের দিন কাইয়ুমের লাশ। তার পরের দিন হাসুর লাশ। সাতদিনে লাশ পড়ে গেল উনিশটা। বাংলাভাইয়ের লোকেরা বুক ফুলিয়ে গ্রামে ঘোরে। নাস্তিক সর্বহারাদের নিশানা রাখবে না তারা।
কিন্তু দশ গ্রামের লোকে জানে, যাদের খুন করা হয়েছে, তারা কেউ সর্বহারা নয়।
কিন্তু কেউ সে-কথা উচ্চারণের সাহসটুকুও পায় না।

চার
এমন দুঃখী উপদ্রুত গ্রামেও তিথিতে-তিথিতে জ্যোৎস্না বর্ষিত হয়। এশার নামাজ শেষ করেই বেরিয়ে পড়ে বদরে আলম। দেখে পল্লিবিদ্যুতের আলোকে ম্লান বানিয়ে জ্যোৎস্না দখল করে নিয়েছে সমস্ত গ্রামের আকাশ। গ্রামের উত্তর পারের গোরস্তান-মাঠ তাকে তখন ডাকে। বদরে আলমও সাড়া দেয়। এক পা এক পা করে চলে আসে গাঁয়ের সীমানা ছাড়িয়ে। পথে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাভাই-বাহিনীর। টহলরত জঙ্গিরা তাকে চিনে নিয়েছে এতদিনে। কেউ কিছু বলেনি। সে নির্বিঘেœ চলে আসতে পারে জ্যোৎস্নাধোয়া মাঠে।
আল্লাহর কী কুদরত!
জ্যোৎস্না ঢুকে যাচ্ছে তার লোমকূপে লোমকূপে। সমস্ত দেহ-মন আলোকিত হয়ে উঠছে বদরে আলমের। তার মনে হয় জ্যোৎস্না নয়, যেন ঝরছে আল্লাহর অসীম স্নেহ। বিশ্বচরাচর ডুবে যাচ্ছে সেই øেহ-ভালোবাসার অপার্থিব আলোয়। রাতজাগা পাখি থেকে থেকে ডাকছে বাতাস চিরে। সেই কর্কশ ডাককেও আজ মনে হচ্ছে পাখিদের আনন্দ প্রকাশের অভিব্যক্তি।
চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্র“ গড়িয়ে পড়ে বদরে আলমের। এই সুন্দর ফুল, এই সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানি। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে পড়ে বদরে আলম। খোদা তুমি চোখ দিয়েছিলে, আজ এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে চোখদুটোকে সার্থক করে নিতে পারি তাই। তুমি কান দিয়েছিলে, সেই কান দিয়ে শুনতে পাই; গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ তোমারই নামগানে মশগুল।
অবশ্যপালনীয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আজকের মতো সমাধা করতে পেরেছে সে, তবু আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় বারবার মাথা নুয়ে আসছে তার। সেজদা করতে ইচ্ছা করছে আবারো। সে জ্যোৎøায় পশ্চিমমুখো হয়। হাঁটু গেড়ে বসে। তারপর চিত্তসমর্পিত সেজদায় আভূমি নত হয়। বদরে আলম সেজদায় যায়। সেজদা ছেড়ে তার আর উঠতে ইচ্ছা করে না। সে সেজদাতেই কাটিয়ে দিতে থাকে পলের পর পল।
হঠাৎ মাটি আর্তনাদ করে ওঠে Ñ বাবা রে মা রে বাঁচাও, পায়ে ধরি, আমাক জানে মারিস না!
চমকে মাথা তোলে বদরে আলম।
শুধু মাটি নয়, আর্তনাদ করছে বাতাসও।
ও বাবা রে… ও ও মরে গেছি মা! ও মা রে…
ও-ও-ও-ও…
আর্তনাদ ছাপিয়ে সপাং-সপাং শব্দ ওঠে কয়েকটা। সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদের আওয়াজ বেড়ে ওঠে কয়েক পর্দা Ñ আল্লাহ রে, মরে গেছি… মা রে… ও মা…
হঠাৎ-ই বিভ্রম কেটে যায় বদরে আলমের। মাটি আর্তনাদ করছে না। বাতাসও আর্তনাদ করছে না। আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে মসজিদ চত্বরের বাংলাভাইয়ের টর্চার ক্যাম্প থেকে। নতুন পদ্ধতি বের করেছে বাংলাভাই। টর্চার করার সময় হতভাগার মুখের সামনে রেখে দেয় মাইক। সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে তার আর্তনাদ। যতদূর এ-শব্দ ছড়ায়, ততদূর ভীতি আরো গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাভাইয়ের নামে।
বদরে আলম কানে আঙুল দেয়।
তার পরও তার মগজে আছড়ে পড়তে থাকে আর্তনাদের শব্দ।
এই জ্যোৎস্না, চরাচরব্যাপী জ্যোৎস্না, পবিত্র মোলায়েম অপার্থিব জ্যোৎস্না মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায় বদরে আলমের চোখের সামনে থেকে।
আর্তনাদের শব্দ আরো বাড়ে।
বদরে আলমের শরীর কেঁপে ওঠে। ভীতিতে।
আশ্চর্য! একটু পরেই ভীতি উধাও হয়ে যায়। তার জায়গা নেয় ক্রোধ।
কেননা, এখন সে উপলব্ধি করছে, তার পায়ের নিচের মাটি আর্তনাদ করছে, তার কানের পাশের বাতাস আর্তনাদ করছে, তার প্রতি লোমকূপ স্পর্শ করা গাঁয়ের জ্যোৎস্না আর্তনাদ করছে।

পাঁচ
আপনে এই গেরাম ছাইড়া চল্যা যান জনাব!
চায়ের কাপ ঠোঁটে তুলেছিল বাংলাভাই। বিস্ময়ে হাত থেকে চাসহ ছিটকে পড়ে কাপ। বিষম খায় সে। খুব জোর বিষম। যত বেশি বিস্ময়, তত জোরে বিষম। কাশির দমক ওঠে তার। কাশতে কাশতে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে।
অনেকক্ষণ সময় লাগে ধাতস্থ হতে। জোব্বার হাতায় চোখের পানি মুছে পিটপিট করে তাকায় সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বদরে আলমের দিকে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, এই লোকটা বলেছে কথাগুলো। নিজের অজান্তেই প্রশ্ন বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে Ñ কী বললে তুমি?
আপনে এই গেরাম ছাইড়া চল্যা যান জনাব!
স্থির-নিষ্কম্প গলায় একটু আগে বলা কথাটার হুবহু পুনরাবৃত্তি করে বদরে আলম।
ঘরের মধ্যে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে বাংলাভাইয়ের অন্তত আটজন ক্যাডার। তারা পর্যন্ত হা হয়ে গেছে বদরে আলমের কথা শুনে। বলে কি লোকটা! এমন সাহস কোথায় পেল!
নিজেকে ততক্ষণে পুরোপুরি সামলে নিয়েছে বাংলাভাই। ব্যঙ্গের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল Ñ আমাকে চলে যেতে হবে কেন?
কারণ এইডা আল্লাহর ঘর। এই ঘরে মানুষ আসবি আল্লাহর এবাদত করার জন্যে। আপনে সেই ঘর নাপাক করিছেন।
সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে হতাশার ভঙ্গি করে বাংলাভাই Ñ লোকটা নিঃসন্দেহে পাগল হয়ে গেছে।
কিন্তু কোনো বিকার নেই বদরে আলমের। সে ধীরস্থিরভাবে বলে চলে Ñ আমরা এই গেরামের সকল মানুষ Ñ সুখে থাকি, দুখে থাকি, কষ্টে থাকি, আমরা আমাদের মতো থাকি। আপনের জন্যে এই এলাকার মানুষ আর নিজেরা নিজেদের মতো কর‌্যা বাঁচতে পারে না। আপনে চল্যা যান!
রোগা-ঢ্যাঙা, নীল জোব্বা-লুঙ্গি-সাদা টুপিপরা বদরে আলমের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসে মাথা ঝাঁকায় বাংলাভাই Ñ কে পাঠিয়েছে তোমাকে?
কেউ পাঠায়নি, আমি নিজে নিজেই আইছি।
কেন এসেছ? তোমার কি মরার খুব সখ? যদি মরার খুব সখ থাকে, তাহলে যাও কোনো গাছের ডালে দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ো, না-হয় কুয়ায় ঝাঁপ দাও। যাও ভাগো!
না আমি যাব না। আপনে আগে গেরাম ছাড়েন।
উঠে দাঁড়ায় বাংলাভাই। বদরে আলমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার সাপচোখ রাখে বদরে আলমের চোখে। হিসহিস করে বলে, ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চাই না বলে তোকে এবারের মতো মাফ করে দিলাম। যা দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে।
এ-কথায় হঠাৎ করে ক্ষেপে যায় বদরে আলম। চিৎকার করে বলে, এই মজ্জিদ আমার। দিন-রাত খাটাখাটনি করি আমি এই মজ্জিদের জন্যে। টাকা তুলি। মানুষের কাছে হাত পাতি। এই মজ্জিদ আমার। তুমি একখান শয়তান, নমরুদ-ফেরাউন জোর কর‌্যা দখল নিছো এই মজ্জিদের। তুমি চল্যা যাও এক্ষুনি।
তেড়ে আসে এক ক্যাডার। দড়াম করে লাথি মারে বদরে আলমের পাঁজরে।
মাটিতে পড়েও সমানে চেঁচাতে থাকে সে Ñ এই মজ্জিদ আমার। তোমরা ছেড়ে দাও আমার মজ্জিদ।
দুজন এগিয়ে আসে। বদরে আলমকে চ্যাঙদোলা করে ছুড়ে দেয় দরজা দিয়ে বাইরে।
সেখানে কিছুক্ষণ পড়ে থাকে বদরে আলম। তারপর হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে বসে। সর্বশক্তিতে চিৎকার করে Ñ গ্রামবাসী ভাইয়েরা-মায়েরা, এই শয়তান নমরুদ-ফেরাউন বাংলাভাই আল্লাহর দুশমন। ইসলামের দুশমন। জোর কর‌্যা এই মজ্জিদ দখল কর‌্যা পাপের আখড়া বসাইছে। তোমরা আসো। এই শয়তানরে তাড়াতে হবি।
উঠে দাঁড়িয়ে উদ্বাহু চিৎকার করতে থাকে সে Ñ এই মজ্জিদ আমার। এই গাঁ আমার। এই গাঁয়ের আকাশে আর গাঁয়ের গায়ে জড়ায়া থাকা জোছনা আমার। তুমি যাও। তুমি দূর হও!

তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা হায়েনাগুলিকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনে না বদরে আলম। তার মনে একবিন্দু ভয় নেই। বরং হায়েনাগুলিকেই কিছুটা বিহ্বল দেখায়। বদরে আলমের সাহসের উৎস তারা কেউ-ই আন্দাজ করতে পারে না। তারা তো জানে না যে, বদরে আলম জ্যোৎস্না ও মাটির ডাক শুনতে পেয়েছে। কেননা, জ্যোৎস্না কিংবা মাটির ডাক ঠিক কেমন, তা তো কেবল মানুষই অনুভব করতে পারে; হায়েনারা পারে না।