জ্যোৎস্না, বৃষ্টি আর অন্ধকারের গল্প

পূরবী বসু
‘স্মৃতি সে সুখের-ই হোক আর বেদনার-ই হোক, সব সময়েই করুণ।’
হুমায়ূন আহমেদ (নন্দিত নরকে, ১৩৭৯, পৃ ৭১)
প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে এবং থাকতে হুমায়ূন আহমেদের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। তাই নানান রকম গাছগাছালি, ফুলপাতা যেমন পছন্দ ছিল তার, তেমনি ভীষণভাবে তার পছন্দের ছিল জ্যোৎøা আর বৃষ্টি।
গত জানুয়ারিতে দেশে যাওয়ার সময়, হুমায়ূন বিশেষভাবে বলে দিয়েছিল আমাদের, তার নুহাশপল্লী আর সেন্টমার্টিনে সমুদ্রের পাড়ে তৈরি রিসোর্টে অবশ্যই যেন বেড়িয়ে আসি। সেন্টমার্টিন যাওয়া আর হয়নি, মূলত সময়-স্বল্পতার কারণেই। কিন্তু নুহাশপল্লীতে গিয়েছিলাম একদিন সকালে প্রায় সারাদিনের জন্যেই। হুমায়ূনের পরিকল্পনামতো, অন্যপ্রকাশের অন্যতম স্বত্বাধিকারী কমল ও তাঁর পরিবার নিয়ে গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে করে। নুহাশে গিয়ে দেখে এসেছি হুমায়ূনের সেই অভিনব নিরিবিলি স্বপ্নের রাজ্য Ñ প্রকৃতির কোলে। দেখেছি তার দু®প্রাপ্য সব গাছের সংগ্রহ। চায়ের বাগান থেকে শুরু করে নানারকম ঔষধিসহ কতরকম চেনা-অচেনা ফুল-ফলের গাছ, অথবা শুধুই বৃক্ষ, যারা তাদের ফল দিয়ে পরিচিত নয়। এসব অনেক গাছই নিজের উদ্যোগে সংগ্রহ করেছে হুমায়ূন বিভিন্ন জায়গা থেকে। নুহাশে গাছ ছাড়াও রয়েছে পুকুর, মাছ, পায়েচলা পথ, বাঁধাই-করা ঘাট, নৌকা, সুইমিং পুল, দোলনা, ফোয়ারা। আরো আছে মাঝে মাঝেই সুন্দর করে কাটা ঘাসের লন, আর লনের ওপর চেয়ার-টেবিল দিয়ে সাজানো মনোরম বসার আর আড্ডা দেবার জায়গা। শুটিংয়ের জন্যে তৈরি করা রয়েছে ছই আর বেড়া দিয়ে মাটির ঘর, উঠান, মাটির উনুন, ঢেঁকি, কুয়া। একপাশে রয়েছে বিশাল ইনডোর স্টুডিও। এছাড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গরু, কুকুর, ছাগল, হাঁস, রাজহাঁস ও বিভিন্ন ধরনের পাখি। নানান রকম সাপও নাকি আছে, তবে ভাগ্যিস, আমরা তাদের কারোর দেখা পাইনি সেদিন। সাপকে আমার আবার ভীষণ ভয়। এছাড়া ঢুকতে ডানদিকের প্রান্ত ঘেঁষে এবং পল্লীর শেষমাথায় পুকুরের পাড়ে ব্রিজের কাছে রয়েছে শহুরে মানুষের থাকার জন্যে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সকল উপকরণসহ আধুনিক স্টাইলের ছোট ছোট বাঁধানো বাংলো।
শহর থেকে বেশ দূরে এই øিগ্ধ, শান্ত, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে, তার অতি প্রিয় নুহাশপল্লীতে Ñ প্রচুর গাছগাছালি- আচ্ছাদিত প্রকৃতির কোলে, মৃদু হাওয়ায় তির-তির করে কাঁপতে-থাকা ঘন ঝাঁকড়ানো পাতার লিচুবাগানের প্রশান্তিতে, হুমায়ূনের দেহাবশেষ ঘুমিয়ে থাকবে চিরকাল। জ্যোৎøার প্লাবনে যখন ভেসে যাবে চরাচর, শ্রাবণের বারিধারায় যখন সিক্ত হয়ে উঠবে ভূমি আর কদমফুল, তখন ছাউনির নিচে সবাই গোল করে বসে হুমায়ূনের কথা বলবে। বলবে -এমন দিনে কত উচ্ছলই না হয়ে উঠতো সে। কিন্তু তারপরেও আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠবে না হুমায়ূন, জ্যোৎøার ঔজ্জ্বল্য আর বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ উপভোগ করার জন্যে, যা এতো বেশি প্রিয় ছিল তার।
নিউইয়র্ক শহরে বিশাল বিশাল গগনছোঁয়া সব দালান, কর্মব্যস্ত কোটি জনতা আর লক্ষ লক্ষ গাড়ির কানফাটা আওয়াজের মধ্যে বসেও গভীর রাতে পূর্ণিমার øিগ্ধ সৌন্দর্য আবিষ্কার করা বা তা উপভোগ করা হয়তো কেবল হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব। সম্ভব এজন্যে যে, আগেই বলেছি, হুমায়ূনের অত্যধিক এক দুর্বলতা ছিল জ্যোৎøার প্রতি। কিন্তু সেই জোছনা সম্পূর্ণ নিখাদ ও প্রাকৃতিক হতে হবে। ফকফকে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ জ্যোৎøা থেকে শুরু করে মাঝারি রকমের জ্যোৎøা, এমনকি ম্লান হালকা জ্যোৎøা, সবরকম জ্যোৎøাই সে উপভোগ করতো। ভালোবাসতো। পছন্দ করতো জ্যোৎøাভরা রাতকে। তাই চাঁদকে তার খুঁজে বের করতেই হতো এই শহরে, তা সে যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন। শত কোলাহলের ভেতরেও, প্রয়োজনে ছাদে বা ব্যালকনিতে যেতে হতো তাকে চাঁদ খুঁজে বের করতে। চারদিকের হাজারো দূষণে তৈরি গভীর স্মগের smoke আর fog মিলিয়ে কী সুন্দর একটা শব্দ, স্মগ – বের করেছে এরা) আস্তরণের আড়ালে চাঁদ যদি লুকিয়েও থাকে, তাহলেও। পুত্র নিষাদ যে বলেছে হুমায়ূনকে, ঢাকা থেকে চুপিচুপি চাঁদটা নাকি তাদের প্লেনের পিছু পিছু নিউইয়র্ক পর্যন্ত ঠিক চলে এসেছে। ওকে এখন হারালে চলবে কেন? তাই ঘরে থাকলে প্রায় প্রতি রাতেই দুষ্টু চাঁদটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে পিতাপুত্র।
জ্যোৎস্না নিয়ে বিলাসিতা করা আমেরিকায় এই প্রথম নয় হুমায়ূনের।
ঘটনাটি ঘটে যখন অনেক বছর আগে প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন ও কন্যাদের নিয়ে সে নর্থ ডেকোটার ফার্গো শহরে থাকে এবং ডক্টরেটের জন্যে পড়াশোনা করে। সেই সময়েই একবার নিজ পরিবার ও দুজন বন্ধু মিলে দূরপাল্লায় গাড়ি ড্রাইভ করে সিয়াটল, ওয়াশিংটন (আমেরিকার একেবারে উত্তর-পশ্চিম কোণের স্টেটটি) যাচ্ছিল তারা এক রাতে।  সন্ধ্যায় ফার্গো থেকে রওনা হয়ে মধ্যরাতে মন্টানার গভীর বনের ভেতর দিয়ে (নিশ্চয় ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের গা-ঘেঁষে উত্তর দিক দিয়ে যাচ্ছিল ওরা) গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ হুয়ামূন চন্দ্রাহত (moon-stuck) হয়ে পড়ে। তখন হাইওয়ের পাশে গাড়িটা কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে হেডলাইট বন্ধ করে চুপচাপ এই গভীর জঙ্গলের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে শুরু করে।  জ্যোৎøা জ্বলে ওঠে চারদিকে। হুমায়ূন হঠাৎ যেন শৈশবে ফিরে যায়। অবাক হয়ে শোনে পেঁচা ডাকছে। হুত্তুম হুট। হুত্তুম হুট। হুমায়ূনের বড় মেয়ে নোভা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল। হুমায়ূন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে মা?  ভয় লাগছে?’
‘হুঁ। ভূতের ডাক শুনেছি।’
‘মাগো! ভূতের ডাক নয়। পেঁচা ডাকছে।’ (পায়ের তলায় খড়ম, শেষ পৃষ্ঠা – পৃ ৯৬)
হুমায়ূনের মনে পড়ে গেল ছোটবেলা বাবা ও পরিবারের আর সকলের সঙ্গে মহিষের গাড়িতে করে জগদ্দল থেকে পঞ্চগড়ে যাচ্ছিলেন এক রাতে। রাতের বেলায় যাতে দিনের রোদে ও গরমে কষ্ট না হয়। হুমায়ূনের ভাষায়, ‘মহিষের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙলো গভীর রাতে। আমরা ঘন জঙ্গলের ভেতর। গাড়ি চলছে না। আমি অবাক হয়ে দেখি, প্রবল জ্যোৎস্নায় বনভূমি প্লাবিত। জঙ্গলে গাছপালার ভেতর দিয়ে জোছনার কী যে রহস্য! আমি মুগ্ধ হয়ে জোছনা দেখছি ও ডাক শুনছি। অদ্ভুত এবং খানিকটা ভয় জাগানিয়া শব্দ। – হুত্তুম হুট। হুত্তুম হুট। অদ্ভুত শব্দ, জোছনা, বনভূমি – সবমিলিয়ে আমার মধ্যে প্রবল ঘোর তৈরি হলো। আমি শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। বাবা অন্য গাড়িতে ছিলেন, কান্নার শব্দে ছুটে এলেন।  আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘বাবা! কী হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘ভয় পেয়েছি। কিসের শব্দ ওটা?’
‘হুতুম পেঁচার শব্দ।’
‘গাড়ি থেমে আছে কেন বাবা?’
‘আমি থামিয়েছি। জোছনা দেখার জন্যে থামিয়েছি।’
জোছনার প্রতি অনুরাগ হয়তো জিন্স বেয়ে নেমে আসে পরবর্তী প্রজন্মে। তা নইলে আইনপ্রয়োগকারী পুলিশ কর্মকর্তা হুমায়ূনের পিতার কাছে গভীর রাতে গহিন বনের ভেতর মহিষের গাড়ি থামিয়ে জোছনা উপভোগ করার মতো রোমান্টিক চিন্তা বা শখ চেপে ওঠা তো সচরাচর দেখা বা শোনা যায় না।  আর হুমায়ূনের ভাষায়, প্রকৃতি বা ঈশ্বর সর্বদাই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে। তার ছোটবেলার এই জ্যোৎস্নারাতে বনের ভেতরের অভিজ্ঞতা পরিণত বয়সে আরেকবার অবলোকনের সুযোগ এসেছিল।
এই ঘটনার ঠিক বত্রিশ বছর পরে, হুমায়ূন লিখেছে, ‘প্রকৃতি ঠিক করল, বনভূমিতে আমার জোছনা দেখা ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে।’ হুমায়ূনের কথা শুনে মনে হয় জীবদ্দশায় কোনো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন থাকে অবধারিত – অনিবার্য। আর ঠিক তাই কেমন করে যেন ঘটে প্রায় হুবহু একই রকম ঘটনা, ছেলেবেলার অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি পরের প্রজন্মের মধ্য দিয়ে নতুন করে অনুভব করা। তবে সেটা উত্তরবঙ্গে নয়।  মন্টানার কঠিন বনভূমিতে।
এর অন্তত দু’যুগ পরের কথা আবার। শাশুড়ি, শালি, স্ত্রী শাওন ও  শিশু পুত্রদ্বয় নিয়ে হুমায়ূন পরিবারকে রকি মাউনটেইন দেখাতে নিয়ে গেছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ডিসেম্বরের এক কনকনে শীতের এক দিনে। সঙ্গে আমিও ছিলাম সেদিন। একই বড় ভ্যানের ভেতর আমরা সকলেই একত্রে বসে আছি।  মানে এক গাড়িতেই সকলে।  ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো রকি মাউনটেইনে। চারদিকে বরফে-ঢাকা সুউচ্চ রকি মাউনটেনের সেই সৌন্দর্য হুমায়ূন বর্ণনা করেছে এভাবে, ‘সন্ধ্যাবেলা আকাশে প্রকাণ্ড চাঁদ ঊঠল। চাঁদের আলো বরফে পড়ে বরফ হয়ে গেল হীরকখণ্ড। আলো বিকিরণ করা শুরু করল। চাঁদের আলো এমনিতেই ঠান্ডা। বরফ থেকে প্রতিফলিত হয়ে তা হয়ে গেল আরো কোমল। অলৌকিক এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। যে-দৃশ্যের সঙ্গে সচরাচর দেখা পৃথিবীর কোনো সাদৃশ্য নেই।  বলতে ইচ্ছা হলো :
এমন চাঁদের আলো
মরি যদি তাও ভালো।
সে মরণ স্বর্গসম।
জ্যোৎস্না রাতের রহস্য যে হুমায়ূনকে ছেলেবেলা থেকে শুরু করে সারাজীবনই  কতটা আন্দোলিত ও উত্তেজিত করেছে, জীবনসীমান্তে এসে রকি মাউনটেইনের ওপর জোছনার আলো প্রত্যক্ষ করার এই বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতাটি তার একটি আলামত মাত্র। বরফে ঢাকা রকি মাউনটেইনের চারদিকে আবার দেখে হুমায়ূন সেই পরিচিত ‘ফিনিক ফোটা জোছনা’। (পায়ের তলায় খড়ম, পৃ  ৯৫-৯৬)।
জুনের ১৯ তারিখে, সফল অস্ত্রোপচারের এক সপ্তাহ পর, যেদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ঘরে ফিরল হুমায়ূন, সেদিন রাতে না ছিল জ্যোৎস্না, না ছিল বৃষ্টি। চারদিকে তাকিয়ে কোথাও চাঁদটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আসলে সে-রাতে ছিল অমাবস্যা। কিন্তু ঘরে ফেরার আনন্দে হুমায়ূন এতোটাই মগ্ন ছিল যে সেদিন সন্ধ্যার পর সে আকাশের দিকে তাকাতেও ভুলে গেছিল। নিষাদ আর নিনিত, তার অতি প্রিয় দুই ফুটফুটে সন্তানই চাঁদের টুকরো হয়ে তার চোখের সামনে বসে একমনে খেলা করছিল সে-রাতে। মুগ্ধ বিস্ময়ে, এক সপ্তাহ পরে ঘরে এসে, ওদের ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল হুমায়ূন।
সেদিন, ১৯ জুন, অতি ভোরেই অপ্রত্যাশিতভাবে সে জেনেছিল সেই সকালেই তাকে বাড়িতে চলে যাবার ছাড়পত্র দিচ্ছে হাসপাতাল। মাত্র পরশু রাতেই ICU থেকে সাধারণ ওয়ার্ডে আনা হয়েছে তাকে। এদেশে সার্জারি বা অসুখে হাসপাতালে ভর্তি হলে, প্রয়োজনের বেশি একটি দিনও আর সেখানে রাখা হয় না। এটা আমরা জানতাম বলেই খুব ভোরে মাজহারের ফোনে সংবাদটা পেয়ে (যে সেদিনই হুমায়ূনকে ছেড়ে দেওয়া হবে) খুব বিস্মিত হইনি। গেল বছরে জ্যোতির বাম পায়ের সম্পূর্ণ হাঁটু (চামড়া ও মাংস বাদে হাঁটুর জোড়ার কাছে সকল হাড়গোড় ও চাকতি) ফেলে দিয়ে সেখানে স্টেইনলেস স্টিল ও প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি কৃত্রিম হাঁটু বসানো হয়েছিল (total knee replacement surgery)। অতিপ্রচলিত হলেও এটিকে এখনো একটি মেজর সার্জারি বলেই গণ্য করা হয় এদেশে। তারপরেও ওকে সার্জারি হবার ঠিক তিনদিনের মাথায় বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সার্জারির পরদিন সকাল থেকেই হাঁটিয়েছিল ওকে, শিখিয়েছিল সিঁড়ি ভাঙতে হাসপাতালে থাকতেই। আর যন্ত্রের মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি তো শুরু হয়েছিল রিকোভারি রুমে জ্ঞান ফিরে আসার আগে থেকেই। হুমায়ূনের বেলাতেও সার্জারির পর সপ্তাহখানেক লাগবে হাসপাতালে থাকতে, আগে থেকেই বলেছিলেন ডাক্তার। গেল মঙ্গলবার ১২ তারিখে সার্জারি হয়েছে। পরের মঙ্গলবার ১৯ তারিখে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে তাকে। আর সে কী খুশি তখন হুমায়ূন! মনে হচ্ছে বহুদিন কারাভোগ করা কয়েদি এইমাত্র জেলখানা থেকে মুক্তির পরোয়ানা পেয়েছে যেন। আমরা সকলেই জানি হাসপাতালে থাকতে কী পরিমাণ অপছন্দ করে সে। আর নিজের ঘরে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সময় কাটাতে কী সাংঘাতিক পছন্দই না করে হুমায়ূন! ব্যক্তিগত জীবনে সে বড়ই ঘরোয়া ও নিভৃতচারী।
১৯ জুন থেকে ১৯ জুলাই। সময়ের হিসাবে মাত্র একটি মাস, কানায় কানায়। অথচ মাত্র এই একটি মাসে সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। সম্পূর্ণ দৃশ্যপট বদলে গেল রাতারাতি। ১৯ জুন ঘরে ফিরে গেল হুমায়ূন সফল অস্ত্রোপচার শেষে। আর ১৯ জুলাই – ঠিক এক মাস পরে মারা গেল সে। ক্যান্সারে নয়, অপারেশন-পরবর্তী জটিলতায়, যা এদেশে এরকম সার্জারিতে ঘটে মাত্র শতকরা পাঁচেরও কম রোগীর বেলায়। জুলাই ১৮তে হুমায়ূনের প্রধান সার্জন আমায় টেক্সট মেসেজে জানিয়েছিলেন, আগের দিনের তুলনায় হুমায়ূন আজ একটু ভালো আছে। তাঁর বিবেচনায় হুমায়ূন বেশ কিছুটা ‘stable’। এই stable শব্দটার অনুরণন কমেনি, সুসংবাদটা শাওন ও জাফর ইকবালকে জানাবার পরেও। তাকে যে ঘুম পাড়িয়ে রাখার ওষুধ দেওয়া হতো, তাও তুলে নেওয়া হয়েছে আজ (জুলাই ১৮)। হুমায়ূনের জেগে ওঠার আশায় আমরা প্রতীক্ষা করতে থাকি। কিন্তু প্রায় ২৪ ঘণ্টার ভেতরও যখন তার জ্ঞান ফিরে এলো না, তখনো আমরা মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছি, এই কিছুক্ষণের ভেতরেই নিশ্চয় জেগে উঠবে সে। কেননা ডাক্তার গতকাল সকালেই বলেছিলেন, এরকম অবস্থায় রোগীর জেগে উঠতে একটু সময় লাগতে পারে। আমার আশঙ্কাকে নির্মূল করতে, ডাক্তার আবার সঙ্গে সঙ্গেই আশ্বাস দিয়েছিলেন, হুমায়ূনের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতায় কোনোরকম অসুবিধে বা ক্ষতি হয়নি। স্বাস্থ্যগত কারণে মাঝে মাঝে ভাইটাল সাইন কিছুটা ওঠানামার ভেতর দিয়ে গেলেও তার রক্ত চলাচলের গতি বা রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কখনো তেমন পর্যায়ে নামেনি যে মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি হতে পারে। আমি তখন ডাক্তারকে সেই একই কথা আজ আবার নতুন করে বললাম। ফোনে। হুমায়ূনের ছোট ভাই জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমীন দেশ থেকে এসেছে তাকে দেখতে। হুমায়ূন এখন পর্যন্ত হয়তো সেটা জানতেও পারেনি। কেননা, জেগে থাকলেই যেহেতু শরীরে টিউব, তার, নল ইত্যাদি লাগানো থাকার কারণে সে বিরক্ত ও উত্তেজিত হয়ে সবকিছু খুলে ফেলার চেষ্টা করে। সেই কবে থেকে হুমায়ূনকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু আমার অধৈর্য লাগছে এখন। কত তাড়াতাড়ি জেগে উঠে হুমায়ূন জানতে পারবে, দেশ থেকে জাফর ও ইয়াসমীন এসেছে তাকে দেখতে! কতই না খুশি হবে সে শয্যাপাশে অনুজকে দেখতে পেলে। যখন অতি আগ্রহের সঙ্গে আমরা সকলে অপেক্ষা করছি কখন হুমায়ূন চোখ খুলে তাকাবে, তখন আমাদের অজ্ঞাতে তার শারীরিক অবস্থা ঠিক উলটো দিকে মোড় নিতে শুরু করে, যা আমরা জানতাম না। রাত শেষে ভোর হয়। আসে সেই ভয়ংকর দিন – ১৯ জুলাই। ১৯ জুনের ঠিক বিপরীত দিন ১৯ জুলাই।
গেল মাসে, মানে জুনের ১৯ তারিখে ভোরে যে-সময়টায় সেই সুখবরটা পেয়েছিলাম, সফল অস্ত্রোপচারের পরে হুমায়ূন ঘরে ফিরে যাচ্ছে আজ, সেই প্রায় একই সময় ঠিক এক মাস পরে জুলাই ১৯ তারিখে ডাক্তারের কাছে খবর পেলাম তার অবস্থা মোটেও ভালো নয়, সম্ভাব্য উঁচু ডোজের ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও ব্লাড প্রেশার যথেষ্ট উঁচুতে ধরে রাখা যাচ্ছে না। তবু আশা করে থাকি এর আগে যেমন হয়েছে, এবারও তার শরীরের অবস্থা আবার পালটাবে, – ভালোর দিকে যাবে আবার। কিন্তু আরো ঘণ্টা দুয়েক পরে ডাক্তার মিলারের টেক্সট মেসেজে জানতে পাই, হুমায়ূনের অবস্থা খুবই খারাপ। শাওনসহ ওখানকার সকল আত্মীয়স্বজন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারের শেষ বাক্য ছিল, তিনি খুবই দুঃখিত। আমি জানতে চাই, ‘এই কি তাহলে শেষ?’ উত্তরে ডাক্তার মিলার লেখেন, ‘সম্ভবত। তবে আমরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ হুমায়ূনের হাসপাতালের কক্ষটা চোখে ভাসে। সকলের সজাগ দৃষ্টির সামনে আস্তে আস্তে হুমায়ূনের ব্লাড প্রেশার, হার্টবিট কমতে শুরু করে। কারো ফোন থেকে আমার ফোনে একটি কল এলে হুমায়ূনের রুম থেকে কান্নার আওয়াজ পাই – পেছনে মৃদু কোলাহল। কান্নাঝরা কণ্ঠে টেলিফোনে ইয়াসমীন বলে, ‘পূরবীদি সবকিছু নিচে নেমে যাচ্ছে। ব্লাড প্রেশার চল্লিশ থেকে এখন তিরিশ…’
না, সেদিনও, মানে ১৯ জুলাই রাতেও, পূর্ণিমা ছিল না। বৃষ্টিও হয়নি সে-রাতে। তবে সে-রাত ছিল নিকষ কালো অন্ধকারের রাত। কী আশ্চর্য, হুমায়ূনের অনন্তযাত্রার রাতটিতেও ছিল পূর্ণ অমাবস্যা। জ্যোৎস্নাপাগল-বৃষ্টিপ্রেমিক হুমায়ূনের মহাপ্রয়াণে যদি চাঁদ লজ্জায় মুখ ঢেকে আত্মগোপন না করে, করবে আর কোনদিন? আকাশে চাঁদ নেই। ঘোর অন্ধকারে হুমায়ূন শুয়ে আছে এক অপরিচিত বাড়িতে। নিজের চেনা শোবার ঘরে স্ত্রী-পুত্রদের পাশে নিয়ে বিশাল বড় খাটে নয়। অথচ যেখানে আজ রাতে শুয়ে আছে, সে-জায়গাটা তার বাসা থেকে খুব দূরে নয়। কিন্তু একা, অপরিচিত এক বাড়িতে লম্বা বাক্সের মতো এক বিছানায় শুয়ে আছে হুমায়ূন। চিকিৎসার জন্যে এইবার নিউইয়র্ক আসার পরে হাসপাতাল ছাড়া এই বোধহয় প্রথমবারের মতো এই শহরে নিজের বাসার বাইরে রাত কাটালো হুমায়ূন। তাও এক অপরিচিত স্থানে – ফিউনারেল হোমের ঠান্ডা-নিস্পৃহ-অচেনা এক ঘরে। ম্লান জ্যোৎস্না নয়, বৃষ্টি নয়, কেবল গুচ্ছগুচ্ছ অন্ধকার সাক্ষী হয়ে রইল সেই মহাপ্রয়াণের। মনে পড়ে মৃত্যুকে নিয়ে – নিজের মৃত্যুকে নিয়েও – কতরকম তামাশা, রসিকতা করতো হুমায়ূন। আমরা সকলে মিলেই হাসতাম তখন। একসঙ্গে, জোরে জোরে। সবচেয়ে বেশি হাসতো হুমায়ূন নিজে। যেন কী মজার একটা কথা বলে ফেলেছে সে। ফোনে যখনই তাকে জিজ্ঞেস করতাম,  ‘কেন আছেন হুমায়ূন?’ হয় বলতো, ‘এখনো বেঁচে আছি’ অথবা ‘এখনো মরিনি’। কেমোথেরাপির কষ্ট প্রায় অসহনীয়, বলতো, কখনো-সখনো। হাত-পায়ের চামড়া উঠে যাচ্ছে, আঙুলে ব্যথা, লিখতে কষ্ট হয়, কলম ধরে রাখা শক্ত, মুখমণ্ডলে চোখের পাশে কালো কালো দাগ, মুখে-জিহ্বায় ঘায়ের মতো, গোটার মতো, কী উঠেছে, কোনো খাবারে রুচি নেই। তাই কি বেঁচে থাকা আর ‘মরে যাওয়া’ মাঝে মাঝে সমার্থক হয়ে যেত তার কাছে? কিন্তু সে তো মুহূর্তের জন্যে। যতক্ষণ দেহে শক্তি ছিল তার, হুমায়ূন তার জীবন এবং বেঁচে থাকার ব্যাপারে কোনো কিছুতেই ছাড় দিতে রাজি ছিল না। সমস্ত শক্তি একত্রিত করে দুই কেমোর মাঝখানে পুরো পরিবার নিয়ে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তো সে এখানে-ওখানে -দূর-দূরান্তে – নানা জায়গায়। প্লেনে করে গেছে কলোরাডো, সেখান থেকে অনেক উঁচু পর্বত রকি মাউনটেইন ন্যাশনাল পার্কে গাড়ি করে। এছাড়া, সপরিবারে একাধিকবার বেড়াতে গিয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি, বাল্টিমোর, আটলান্টিক সিটিতে। কেমোর কোর্স শেষ হওয়ার পরে গেছিল ঢাকায়, তার প্রাণপ্রিয় নুহাশপল্লীতে। তবে সবচেয়ে বড় যে-কারণে সে দেশে গিয়েছিল এবার, সেটা হলো, মায়ের সঙ্গে দেখা করা। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেশে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছিল হুমায়ূন। গত জানুয়ারি মাসে আমি যখন দেশে যাই তখনো তার মায়ের সঙ্গে যেন অবশ্যই দেখা করে আসি, বলেছিল হুমায়ূন। ঢাকায় গিয়ে খালাম্মাকে অবশ্য খুঁজে বের করতে হয়নি আমায়। পুত্রের খোঁজে নিজেই চলে এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে আলমগীরের বাসায়, দখিন হাওয়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলের কথা অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলেন জননী। হাতব্যাগে পাসপোর্ট নিয়েই ঘুরছিলেন তিনি তখন। আলমগীর বলছিল, আমার সঙ্গেই নাকি ছেলেকে দেখতে আমেরিকায় যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর। সেটা অবশ্য সম্ভব হয়নি প্রধানত তাঁর স্বাস্থ্যগত কারণেই। এছাড়া শুনেছি পাসপোর্টেও সম্ভবত কী তথ্যগত ভুল ছিল সামান্য। তবে তিনি বারবার তাঁর বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যেটা শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি।
গত কয়েক মাসের ভেতর শেষ পূর্ণিমা দেখেছিলাম ৩রা জুলাই, যেদিন নিউইয়র্ক থেকে ডেনভার ফিরে আসি। হুমায়ূন তখনো হাসপাতালে – ICU-তে। অনেকদিন আগে থেকেই কথা, পরের দিন অর্থাৎ জুলাই ৪ (আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস) আমাদের বাসায় এক পুরনো বন্ধু-দম্পতি বেড়াতে আসবেন আটলান্টা থেকে। ফলে আমাদের নিউইয়র্ক ছেড়ে ৩ জুলাই ডেনভার ফিরে আসাটা আর পেছানো সম্ভব ছিল না। গ্রীষ্মে দিন অনেক বড় হয় এখানে। সমুদ্রের উপরের স্তর থেকে এক মাইল উঁচুতে অবস্থান ডেনভার শহরের, যার জন্যে ডেনভার mile high city বলে পরিচিত। অনেক উঁচুতে বলে আর গাছপালা কম থাকায় (বিশেষ করে লম্বা গাছ প্রায় নেই বললেই চলে) ডেনভারের দিগন্তটা সবসময়েই বিশাল বড় ও উন্মুক্ত মনে হয় আমার কাছে। রোদটাও খুব বেশি। একেবারে গায়ে বেঁধে যেন। সূর্য ডুবে গেলে ধপ করে তাপমাত্রা কমে যায় এখানে। দিনে ও রাতের তাপের পার্থক্য ৩০ ডিগ্রিরও বেশি। সেদিন রাতে রান্নাশেষে আমাদের বাড়ির ভেতরের দিকে খোলা ডেকে পেতে রাখা চেয়ারগুলোর একটাতে গিয়ে বসেছিলাম কিছুক্ষণের জন্যে। তখনই দেখেছিলাম আকাশে পূর্ণ চাঁদ। আমি জানি এ-চাঁদ হুমায়ূন সে-রাতে দেখতে পায়নি। বেলভিউর ICU রুমের যেখানে তার বিছানা, সেখান থেকে আকাশ দেখা যায় বলে আমার মনে হয় না।
১৯ জুন, ১৯ জুলাই – দু’রাতের এক রাতেও পূর্ণিমা ছিল না, তাই জ্যোৎস্না নয়। পূর্ণচাঁদের জ্যোৎস্নায় ভেসে যায়নি যান্ত্রিক শহর নিউইয়র্ক। কী আশ্চর্য, পূর্ণিমা দূরে থাক, সেই দুই রাতেই ছিল ভরা অমাবস্যা। জুলাই ১৯, বৃহস্পতিবার রাত। সেই রাতে তরল জ্যোৎøায় চারিদিক প্লাবিত না হলেও, রিমঝিম বৃষ্টিতে আমেরিকার বৃহত্তর শহরটি অবগাহিত না হলেও, কান্না বুঝি জমেছিল ভাঙা কলসির মতো আকাশের কোনো এক কোণে।
আর তাই ঠিক পাঁচদিন পরে ২৪ জুলাই, আবার এলো সেই মঙ্গলবার, (মঙ্গলবারেই হুমায়ূনের অস্ত্রোপচার হয়, মঙ্গলবারেই অপারেশনের পরে ঘরে ফেরে সে) শ্রাবণের ৮ তারিখ। অজস্র ধারায় গলে পড়ল আকাশ। চারদিক অন্ধকার করে তুমুল বৃষ্টি নামল। শ্রাবণের বৃষ্টি – একটানা ঝরে পড়তে শুরু করল ১০ হাজার মাইল দূরে বাংলার মাটিতে। স্বজন, বান্ধব, ভক্ত, সাধারণ মানুষ সকলের মিলিত কান্নার সঙ্গে আকাশও শরিক হয়েছিল সেদিন। চারদিকে আলোর অপ্রতুলতা। দিনের বেলা গভীর অন্ধকার করে আসছে বর্ষা। বৃষ্টি সেদিন সত্যি নেমেছিল অঝরে, নুহাশপল্লীতেও, যেদিন হুমায়ূন তার অতি সাধের লিচুবাগানের মাটির নিচে স্থায়ী বাসস্থান করে নিয়েছিল। তার প্রাণপ্রিয় শ্রাবণ মেঘের ধারা অনবরত ভিজিয়ে দিচ্ছিল সদ্য খোঁড়া কবরের ঝুরঝুরে মাটিকে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ বহু গ্রন্থের রচয়িতা। কিন্তু তাঁর প্রথম উপন্যাস, মাত্র ৭৭ পৃষ্ঠার, (আজকের যুগে কম্পিউটার টাইপে কম্পোজ করলে পৃষ্ঠা সংখ্যা আরো কম হবে) চটি গ্রন্থ নন্দিত নরকে লিখেই প্রথম সকলের দৃষ্ট আকর্ষণ করেছিল হুমায়ূন। হিমাংশু দত্তের সুরে গাওয়া গানের কথাগুলোর মতোই হুমায়ূনকেও বারবার আলোড়িত করেছে বাংলার বৃষ্টি, জ্যোৎস্না, অন্ধকার, চাঁদ, গাছ, পাখি, নদী, ফুল। এসব প্রাকৃতিক উপাদান যে বড় কাছে থেকে নিবিড়ভাবে সে দেখেছে, আপন করে গেঁথে নিয়েছে বুকে, তা তার প্রথম গ্রন্থ নন্দিত নরকের পরতে পরতে ধরা পড়ে। নন্দিত নরকেও এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত। বাবামাভাইবোন আর পাশাপাশি মাত্র কয়েকটি চরিত্র। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সহজ-সরল ভালোবাসা, দুঃখ, সুখ, আর্থিক অনটন, মানবিক দুর্বলতা, আবেগ, স্খলন, ক্রোধ, খুন, মৃত্যু – এক কথায় সংক্ষেপে এবং নির্মোহভাবে পরিবেশিত এক পূর্ণ মানবজীবনগাথা, যার সমাপ্তি ঘটে একাধিক অস্বাভাবিক করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। নন্দিত নরকের ভেতর ঘুরেফিরেই আসে বৃষ্টির কথা, বৃষ্টির রাতের কথা, বৃষ্টির রাতে ‘ভূতের গল্প’ শোনার কথা, আসে জ্যোস্নার কথা, আসে অন্ধকার, আর অন্ধকারে সেই দুঃসময়ের প্রতীক ঝাঁকে ঝাঁকে কালো পাখি ওড়বার কথা। হুমায়ূন লেখে, ‘গাছের নীচে ঘন অন্ধকার। কী গাছ এটা? বেশ ঝাঁকড়া! অসংখ্য পাখি বাসা বেঁধেছে। তাদের সাড়াশব্দ পাচ্ছি। পেছনের বিস্তীর্ণ মাঠে ম্লান জ্যোৎস্নার আলো। কিছুক্ষণের ভিতরেই চাঁদ ডুবে যাবে।’ (পৃ ৭৬)
বৃষ্টি-পাগল হুমায়ূন আরেক জায়গায় লেখে, ‘সারারাত ধরে বৃষ্টি হলো। আষাঢ়ের আগমনী বৃষ্টি। বৃষ্টিতে সব যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। রুনু বলল, মনে আছে দাদা, এক রাতে এমনি বৃষ্টি হয়েছিল, তুমি একটা ভূতের গল্প বলেছিলে!’ (পৃ ৭১)
নন্দিত নরকের শেষ দৃশ্যে উত্তমপুরুষে লেখা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গভীর রাতে তার বাবার পা ঘেঁষে বসে আছে জেলখানার বাইরে, ছোট ভাই মন্টুর ফাঁসি দেওয়া মৃত দেহখানা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। হুমায়ূনের ভাষায় : ‘বাইরে ম্লান জ্যোৎস্না হয়েছে। কিছুক্ষণের ভিতর চাঁদ ডুবে যাবে। আমি আর বাবা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছি সিমেন্টের ঠান্ডা বেঞ্চিতে। মাথার উপর ঝাঁকড়া অন্ধকার গাছ।’ (পৃ ৭৬)
অবশেষে ঝাঁকড়া গাছ থেকে ভোররাতে কা-কা ডাকে কালো পাখিরা উড়ে যেতে থাকে, যে-অমাঙ্গলিক দৃশ্য থেকে পাঠকের আর বুঝতে বাকি থাকে না, জেলের ভেতরে মন্টুর ফাঁসি এতোক্ষণে কার্যকর হলো। সবশেষে হুমায়ূন লেখে, ‘ভোর হয়ে আসছে। দেখলাম চাঁদ ডুবে গেছে। বিস্তীর্ণ মাঠের উপরে চাদরের মতো পড়ে থাকা ম্লান জ্যোৎস্নাটা আর নেই।’ (পৃ ৭৭)
হুমায়ূন নিজেও আর নেই। তার এই অসময়োচিত অন্তর্ধানে বাঙালির সার্বিক অবস্থা হুমায়ূনের ভাষাতেই অতি সংক্ষেপে বলা চলে, ‘তিমিরময়ী দুঃখ। প্রগাঢ় বেদনার অন্ধকার আমাদের গ্রাস করছে।’ (নন্দিত নরকে, পৃ ৭১)