হালিমার হাঁকাপাকি দেখে রাগ হয়। খুলবে তো রে বাবা, টাইম হলেই খুলবে। তোর জন্য কি আগে খুলবে গেট? সবাই তো আসেওনি এখনো। সারিফার স্কুলে আজ ফের পরীক্ষা আছে, ও-ও তো আসেনি। তোর কিসের হাঁকাপাকি? আর বিএসএফগুলানও তো তোর কথা শুনতে বসে নাই, ওদের ডিউটি আছে। টাইম হলে ঠিকই গেট খুলবে! ওইটাও তো ওদের ডিউটি। এখন যতই চিল্লাও ওদের নড়াচড়া নাই।
– ‘খুলো না জি, ইস্কুলের দেরি হয়ে য্যেছে’, আবার হালিমার গলা, ‘নুরি, তুই একবার বল না!’ নুরির বয়েই গেছে বলতে। সেদিন রাতে ফুফুর পেটে ব্যথা উঠলো, আব্বু-চাচারা কত করে বললো, তাতেও কি খুলেছিল গেট! সেই তো সকাল পর্যন্ত থাকতে হলো সবাইকে গেটের কাছে, টাইম হলে খুললো, তারপর ফুফুকে নিয়ে টাউনের হাসপাতাল। এর মধ্যে ফুফুর কিছু হয়ে গেলে কি হতো! নুরি ভাবতেও পারে না। আম্মি এই গেটের কাছেই ভ্যানের ওপর শোয়ানো ফুফুর পেটে তেল মালিশ করছিল। দোয়া পড়ছিল বিড়বিড় করে। চাচা যে কত গাল দিলো বিএসএফদের। ভাগ্যিস ওরা শুনতে পায়নি। নুরি জানে, ভাষা বুঝুক আর না-ই বুঝুক, গাল ঠিক বুঝে নেয় ওরা। আর তারপরেই শুরু হয় ওদের তাঁহিজ। ভারী ভারী বুটগুলি দিয়ে লাথ মারে, বিড়ি বাঁধার কুলা উল্টে দেয়। আব্বু তো বলেছে, মাঝে মাঝে ওরা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা চকচকে বন্দুক থেকে গুলিও করে। টাউনের হাসপাতাল থেকে ফুফু অবশ্য আর ওদের বাড়িতে আসেনি। নুরি একদিন দেখতে গেছিল হাসপাতালে, শুনেছিল বড়রা বলাবলি করছে, পাথর আছে পেটে, কাটতে হবে। শুধু মনে হচ্ছিল, এই কয়দিন যে রাত্রে ফুফুর সঙ্গে ঘুমাতো, নরম পেটটা জড়িয়ে ধরে, কই ও তো বোঝেনি পাথর আছে! রোজ হাসপাতালে আব্বু যেত, চাচা যেত, রাতে চলে আসতে হতো। ওরা তো আর রাতে থাকতে পারে না। ওদের কাছেই খবর পেত, ফুফুর পেট কাটা হয়েছে, ওর ব্যারাম সেরে গেছে, আর তারপর ফুফা নিয়ে চলে গেছে বাড়িতে। হয়তো ওদের বাড়িতে পাঠিয়েছিল বলেই পাথর হয়েছে পেটে এমন বলেছিল ফুফা, নুরি জানে না। ফুফু আর আসেনি। স্কুল থেকে নুরিও আর যায়নি ফুফুর বাড়িতে। বারণ ছিল।
আর এখন হালিমা বলছে গেট খুলতে। তাই খোলে কখনো? ওদের টাইম হলেই খুলবে।
অর্জুনপুরের মানুষগুলির জীবনে বিএসএফ যেন একেবারে লেপ্টে থাকে। বিএসএফ আর ওই লোহার গেট। আব্বুর কাছে শুনেছে, এই গেট আগে ছিল না।
এপার-ওপার চলাফেরা করত মানুষ, বিএসএফ ছিল ঠিকই, তবে ওদের নিয়ে এত ডর ছিল না। কত জওয়ানকে তো দাওয়ায় বসিয়ে পানিও দিয়েছে বাড়ির মেয়েরা। মাঝে মাঝে নাকি বাচ্চাদের চকলেট-বিস্কুট দিত বিএসএফ। ওদের গ্রামের পূর্বদিকে যে জমিগুলিতে গ্রামের লোকেরা কাজ করে, ধান-কলাই লাগায়, সেখানে আব্বুরা রাতে পাহারা বসায়। ওখানে নাকি মাঝে মাঝে ডাকাত পড়ে। ওপার থেকে এসে কেটে নিয়ে যায় ফসল। ওপার মানে? মানে ওই যে, বড় খালটার পুবদিকে ওদেশের বিএসএফ যেখানে পায়চারি করে, ওখান থেকেই নাকি আসে। নুরি বড় হয়ে জেনেছে, ওদেরকে বিএসএফ বলে না, বিজিবি না কী যেন বলে। দেশটাও আলাদা। বাংলাদেশ। দূর থেকে দেখে অবশ্য একইরকম লাগে। আব্বু বলেছে, গাঁয়ের লোকেরা ফসল পাহারা দেয় ঠিকই, কিন্তু আসল ভরসা ছিল বিএসএফই। অভিযোগ করতো জওয়ানদের কাছে, মাঝে মাঝে বড় সাহেবরা আসতেন, জামায় অনেকগুলি তারা, কথা বলতেন গাঁয়ের লোকের সঙ্গে। অনেকে বাংলা বলতে পারেন। সব নাকি পালটে গেল এই বেড়াটাতেই। মোটা তারকাঁটা জড়ানো লোহার শক্ত বেড়া, চকচক করছে। ঘাস জমি আর আগাছার সংসারে একেবারে বেমানান। কিছুদূর পরপর আরো মোটা লোহার খাম্বা। ধূসর অর্জুনপুরের দিকে যেন কড়া চোখে তাকিয়ে থাকে। দেখেই ডর লাগে। এই বেড়াটাই অর্জুনপুরকে বের করে দিলো রহতপুর থেকে, মালদা টাউন থেকে, স্বাধীন চলাফেরা থেকে। ভূগোল বইয়ে পড়ে ভারত দেশের কথা, সেখানেই থাকে ওরা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর নাম মুখস্থ করে, একটু বেশি বেশিই করে। তবু বাকিদের চোখ থেকে অন্যরকম তাকানোটা মুছতে পারে না। পঞ্চায়েতে গেলে আব্বুরা পায় ওই দৃষ্টি, নুরিরা স্কুলে। রহতপুর যেতে হলে তাকিয়ে থাকতে হয় ওই বেড়ার মাঝে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গেটটার দিকে। রং মিলিয়ে ওটাও কালো, ওটাও লোহার। সাদা রঙে শুধু লেখা আছে খোলার টাইম, সকালে ৭টা থেকে ৮টা, দুপুরে …।
তারকাঁটা বেড়ার ওপরে বসে আছে ল্যাংড়া শালিকটা। ওকে চেনে নুরি। একটা পা ভাঙা। ওই জন্যই আলাদা করে নজর কাড়ে। গাছের ডালে বসে থাকলে বা উড়লে বোঝা যায় না। মাটিতে নেমে, ঘাসের মাঝে খাবার খুঁজলে চোখে পড়ে। এখন ওপর থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছে অধৈর্য হয়ে পড়া হালিমাকে, যেন গেট খুললেই ছিটকে বেরিয়ে যাবে।
– ইতনা শোর মাচাতে কিঁউ, অফিসার আ রাহা হ্যায় – গেটের পাহারায় থাকা জওয়ান ধমক দেয়।
– অফিসার আসছ্যে তো কি হয়্যাছে? হামাদের ইস্কুল নাই? হালিমা মুখে মুখে তর্ক জুড়ে দেয়। এটা ঠিক,
আব্বু-আম্মির মতো বিএসএফকে দেখে এত ডর লাগে না ওদের। আসলে জওয়ানরা ওদের খানিক প্রশ্রয়ও দেয়। অনেকদিন ধরে যারা এই বর্ডারে আছে, তাদের সঙ্গে ভাবও হয়ে গেছে নুরি-হালিমাদের। তবে এটা জানা আছে, টাইম না হলে গেট খুলবে না, যতই ভাব-ভালোবাসা থাক। আর রেগে গেলে ওরাই কাউকে চেনে না।
ধীরে ধীরে সবাই চলে আসে। জড়ো হয় গেটের কাছে। সবার পিঠে স্কুলের ব্যাগ, ব্যাগের ভেতরে কার্ড। রোজ রোজ দ্যাখে, তবু দেখাতে হবে কার্ড। ঢোকার সময়, বেরোনোর সময়। এই গ্রামের মানুষের পাছায় কাপড় না থাক, কার্ড থাকবেই।
সাদা-কালোতে নিজের মুখের ভূতের মতো ছবি, সব চেহারা একইরকম। তবু আলাদা করতে পারে বিএসএফ, আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেটে। এখন আবার নতুন কার্ডও হয়েছে, হাতের ছাপ নিয়ে। ওগুলি রঙিন। সবাই পায়নি। নুরিদের স্কুল থেকে যে কার্ডটা দিয়েছিল, সেটাকেও যত্ন করে রাখে ওরা। অর্জুনপুরের মানুষ জানে কার্ডের গুরুত্ব।
গেটের ওপারে রহতপুর। সেটা একদম অন্যরকম। বাজার বসে রোজ। সপ্তাহে একদিন হাট। অর্জুনপুর থেকেও কতজন এসে বসে শাক, কলাই নিয়ে। এখানে মসজিদের পাকা বাড়ি। টোটো আছে, অটো আছে, টাউনে যাওয়া যায় গাড়ি ধরে। নুরিদের গাঁয়ের মতো অযত্নে ছড়ানো কাঁটাঝোপ, ধুলা-কাদা দরমার বেড়া আর ভ্যানগাড়ির চাকা নেই। সবচেয়ে বড় কথা – ওদের গেট নাই, টাইম দেখতে হয় না বাড়ি ফেরার। ইচ্ছেমতো যখন খুশি যেতে-আসতে পারে সবাই। নুরিদের বন্ধুরা স্কুল ছুটির পরেও থাকতে পারে যতক্ষণ খুশি, ফুচকা কাকুর সঙ্গে দরদাম করতে পারে, গাঁয়ে মীনাবাজার এলে যেতে পারে সন্ধ্যায়, চুড়ি কেনে। নুরিদের সে-সুযোগ নেই। গেট বন্ধ হওয়ার আগে ঢুকতে হবে। নইলে রাত কাটাতে হবে ফুফুর বাড়ি। ঘুপচি ঘরে, ঠাসাঠাসি করে। অপেক্ষা করতে হবে আবার গেট খোলার।
‘আব্বু, আমরা রহতপুরে বাড়ি করে চলে যাই না কেন?’ নুরি জিজ্ঞেস করেছিল। হয়তো হালিমাও। ওদের মতো সবাই যে একবার বাবা-মায়েদের এ-কথা জিজ্ঞেস করেছিল সেটা হলফ করেই বলা যায়। আর উত্তর কী পেয়েছিল তাও সবার জানা। এপারে ভিটে, জমি, ছেলেবেলা, বাপ-মায়ের গোর – সব কিছু। কী করে সেসব ফেলে যাই? অবশ্য এর বাইরে আর একটা কথাও ছিল মনের ভেতরে, যা ছেলেমেয়েদের সামনে বলা যায় না – টাকা-পয়সার তেমন জোর থাকলে ঠিকই যেতাম! গেছেও তো অনেকে, বাড়িঘর ছেড়েই গেছে। যাওয়ার পর প্রথমদিকে টাইমে টাইমে আসতো জমি দেখতে, তারপর সেসবও বেচে দিলো অর্জুনপুরের মানুষের কাছেই। বেড়ার ভেতরে আর ঢুকতে চায় না ওরা। আব্বুর বন্ধু ছিল রব্বুল চাচা, রহতপুরে যাওয়ার সময় আব্বুকেও বলেছিল। নিয়ে যেতে চেয়েছিল বন্ধুকে। আব্বু যায়নি। এসব কথা বড় হয়ে জেনেছে নুরি। কেন? জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়নি।
গাঁয়ে অবশ্য ওদের অনেক কিছুই আছে। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে দাড়িয়াবান্ধা আছে, চাচির সঙ্গে বিড়ি বাঁধায় হাত লাগানো আছে, ওদের আম্মির বয়ামে লুকিয়ে রাখা আচার আছে। আম্মি এখন মাঝে মাঝে নুরিকে ভাত নামাতে বলে, ওর খুব আনন্দ হয়। স্কুল না থাকলে আব্বুর ভাতের ডাব্বা জমিতে নিয়ে যায় ও আর হালিমা একসঙ্গে। গিয়ে সাবমার্সিবলের পানিতে ইচ্ছামতো ভিজে ভেজা জামা-কাপড়ে বাড়ি ফেরে। গাল খায় আম্মির কাছে, খিলখিল হাসে দুজনে। ওদের গাঁয়ে কুয়া আছে, টিউবওয়েল আছে। কিন্তু গরমের সময় প্রায়ই খারাপ হয়ে যায়। তাই এই মাঠের পানির জন্য টান।
– টাউনে জানিস পানির জন্য টাইম কল আছে? টাইমে টাইমে পানি আসে। – এমন আজব কলের কথা শুনে অবাক হয় নুরি। হালিমা যোগ করে, ‘আমাদের যেমন টাইমে গেট খোলে।’ খিলখিল হাসির তোড়ে শেষ কথাগুলি হারিয়ে যায়।
গাঁয়ের এবড়ো-খেবড়ো জমিতেই ছেলেরা ভলিবলের কোর্ট করেছে। হাসান চাচার ব্যাটারা খেলে। খুব লাফঝাঁপ দেয়, আর গলা দিয়ে আওয়াজও করে কিরকম। নুরি লুকিয়ে দেখে, লম্বা চেহারা গেঞ্জি-হাফপ্যান্টের বাইরে বেরিয়ে থাকা ঘেমো শরীরগুলি চকচক করে। ওরা নুরিদের দেখে না বোধহয়। মাঝে মাঝে বিএসএফগুলানও ওদের সঙ্গে ভলিবল খেলতে আসে। বাপরে ওদের হাতের জোর, কত্ত উঁচুতে পাঠিয়ে দেয় বল, আর চাপ মারলে কেউ আটকাতেই পারে না।
– ‘চল চল চল, গেট খুল্যাছে’, হালিমার আজকে যে কিসের এত তাড়া? নুরি জানে, এই গেট থেকে বেরিয়ে ওদের ‘রহতপুর আদর্শ বিদ্যামন্দির’-এর গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে দশ মিনিটও লাগে না। মসজিদের বাঁদিকে গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েকটা ছেলে। কয়েকজনের চুলে রং করা। সিটি মারে, হিন্দি গানের সুর করে, সাইকেল নিয়ে অকারণ ওদের সামনে দিয়ে যায়, জোরে জোরে নিজেদের মধ্যে কথা বলে – সবকিছুই অর্জুনপুরের মেয়েদের দেখানোর জন্য। আসলে একসঙ্গে এতো মেয়ে অন্য দলে নেই। প্রথম প্রথম নুরিদের দিনের আলোতেও ডর লাগতো, জোরে জোরে পা চালাতো। এখন ডর কেটে গেছে। বরং ভালোই লাগে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু না শুনলেই খারাপ লাগে।
এই ছেলেদের স্কুল নাই। ওদের ক্লাসে পড়ে নিলোফা, ওর দাদাটাও থাকে ওই ছেলেদের দলে। এখন নাই। নুরিকে বলেছে, দাদা বিদেশ গেছে। বিদেশ মানে গুজরাট, কেরালা, দিল্লি – এইসব। ভূগোল বইয়ে পড়া। এ-অঞ্চলের ছেলেরা ওইসব জায়গাতেই যায়। টাওয়ার বসাতে, রাস্তা করতে, আরো কী কী সব করে ওরা ওখানে মাসের পর মাস থেকে। আর বাড়ি ফিরলে বাইক কেনে, চুলে রং করে, ঘুরে বেড়ায় মেয়েদের দেখিয়ে। আর মোবাইলে জোরে জোরে গান শোনে। নুরির আব্বু যায় না, তবে চাচা যায় কয়েক মাস পরপর। ফেরার পর কয়েকদিন ঘরের দরজা বন্ধ থাকে অনেকক্ষণ, চাচিও অনেক বেলা পর্যন্ত বেরোয় না ঘর থেকে। চাচার কাছে শুনেছে, ট্রেনগাড়িতে যায়, বড় গাড়িতে যায় সবাই। তারপর তাঁবুতে থাকে। ওই দেশে অনেক মানুষ, উঁচু উঁচু বিল্ডিং, সব পাকা। রাস্তায় লাইট জ্বলে। তবে কোথাও ওদের গ্রামের মতো গেট নাই। টাইম-বেটাইম যখন খুশি যাওয়া যায় এদিক-সেদিক।
স্কুলে যাওয়ার সময় আজ যেন হালিমারই বেশি তাড়া। বর্ডার রোড পার হওয়ার সময় সবার আগে। তারপর ডানদিকে ঘুরেই সেই ছেলেদের দল। ওই দেখো, ওই লাল চুলের ছোড়াটা আজ বাইক নিয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে হালিমার পাশে আসে। চালাচ্ছে কিন্তু খুবই আস্তে। তারপর দুজনে কথা বলছে ফিসফিস করে। নুরিরা সবাই পেছনে। সবাই যেন জেনে গেছে, এখন পিছিয়ে আসতে হয়। সামনে ওরা দুজন। দেখা যাচ্ছে, হালিমার মুখ লাল হয়ে গেল, মাথা নিচু করছে ও। – হায় আল্লাহ, এর জন্যেই এত তাড়া? ছোড়াটাকে আগেও দেখেছে, ওদের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলানের মধ্যে থাকে। তবে হালিমার সঙ্গে যে এর মধ্যে আলাদা আশনাই হয়েছে, তা তো বোঝা যায়নি!
পেছন থেকে হালিমাদের দেখে মনে হচ্ছে হিন্দি বইয়ের নায়ক-নায়িকা। মাথা নিচু করে আলিয়া ভাট যাচ্ছে, এখনই ওকে নিজের বাইকে তুলে নেবে রনবীর। তারপর ভোঁ করে চলে যাবে শব্দ করে, অনেক দূরে, হাওয়ায় উড়বে আলিয়ার চুল। গান হবে। ওদের গ্রামে আলিয়া-রনবীর-সালমান সবাই আছে। তবে ছোট ছোট। ভিডিওতে যতটা দেখা যায়। চাচার কাছে শুনেছে, বিদেশে ওদের গ্রামের মতো ভিডিও না, ওখানে নাকি সিনেমা হল আছে, মালদা টাউনের মতো, ওর থেকেও বড়। সালমান খানকে দেখা যায় পুরো দেয়ালজুড়ে। নুরির খুব ইচ্ছা একবার ওই বড় হলে গিয়ে দেখবে সালমানকে, রনবীরকে। নাহ্, এসব কথা এখন ভাবার সময় নয়। মুহূর্তে সম্বিৎ ফেরে। হালিমা শালি ঠিক করছে না, কেউ যদি গ্রামে খবর দিয়ে দেয়? ওর আব্বু যা রাগী! কেটেই ফেলবে বেটিকে! নাহ্, ধরতে হবে হালিমাকে। স্কুলের গেট পর্যন্ত এলো ছোড়াটা, তারপর বাইকে স্পিড বাড়িয়ে চলে গেল।
স্কুলে পৌঁছে প্রার্থনার লাইনে দাঁড়াতে হয়। ‘জনগণমন’তে গলা মেলায় সবাই। নুরি দেখেছে, অর্জুনপুরের মেয়েরা বেশি বেশি চিৎকার করে এই গানটা গাওয়ার সময়। যেন কেউ ওদের ভিনদেশি না ভাবে। থাকলোই বা বর্ডারের ওপারে। ওখানেও তো একই পতাকা।
কিন্তু আজকে হালিমার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ছুড়ির কি একটুও ডর নাই? এখন তো ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। হালিমাদের ক্লাসেও মাস্টার ঢুকবে। টিফিনের টাইমে ধরবো। খিচুড়ির টাইমে তো গ্রামের সবাই একসঙ্গেই খায়।
এমনিতে পেছনের বেঞ্চে বসে, মাস্টার-ম্যাডামরা খুব একটা খেয়াল করে না। নাম প্রেজেন্টের টাইমে ‘ইয়েস স্যার’ বলেই তেমন কোনো কথা বলতে হয় না মাস্টারের সঙ্গে। বোর্ডে চক-ডাস্টার নিয়ে অঙ্ক করছেন মাস্টার, নুরিরা টুকছে। তাড়াতাড়ি মুছে ফেলছেন মাস্টার, সবটা টোকা হয় না, তবু কিছু বলতে চায় না ওরা। সামনের দু-একজনের খাতা দেখছেন স্যার, আর মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়ছেন, ‘অ্যাই কথা বলবে না।’ জোরে কথা বলে না ওরা, ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যেই গল্প করে, তাতেও ঠিক কানে চলে যায় স্যারের। খাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। শুধু আজকে ঘুরেফিরেই স্কুলে আসার দৃশ্যটা মনে পড়ে যাচ্ছে। রনবীর আর আলিয়া, মোটরসাইকেল …।
– অ্যাই ছুড়ি, কবে থেকে চলছ্যে রে এইসব?
– কী চলছ্যে?
– শালি, বুঝিস না? ওই ছোড়্যাটার কথা বলছি। অর সাথে অত কী আছে?
হালিমা চুপ করে থাকে। এখন থালা নিয়ে সবাই ওরা মিড ডে মিলের ঘরে। লাইন দিয়ে বসে আছে। এই হলঘরটায় সব সময় কাঁইকিচির। তার ওপর আজকে ডিম আছে। মেয়েদের সংখ্যাও বেশি। যারা এখনো পায়নি, চিৎকার তারাই বেশি করে। মাসিরা শান্ত করতে পারেন না। নুরিকে তাই গলা তুলতে হয়, ‘তোর আব্বু জানে?’ হালিমা রা করে না। উত্তরটা জানাই আছে নুরির।
মাসিরা ওদের লাইনে চলে এসেছেন। ডাব্বুতে করে একজন থালার ওপর দেয় ভাত, আরেকজনের বালতিতে লাল রঙের ঝোল, একটা ডিম গড়িয়ে যায় থালার একপাশে। ডিম ভালোবাসে নুরি, ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চায় ডিমটা – যতক্ষণ পারে।
ছুটির ঘণ্টা পড়লেই একটা হইহই শব্দ হয় চত্বর জুড়ে। বাড়ি ফেরার সময় আবার অর্জুনপুরের ওরা সবাই একসঙ্গে। কয়েকজনের সাইকেল আছে, নুরিরা হেঁটেই। হালিমা ওর সঙ্গেই আছে। মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরতেই দেখতে পেল ছেলেগুলিকে। তবে সকালে যতজন ছিল, ততজন নয়, অনেক কম। কিন্তু ওই ছেলেটা আছে, লাল চুল। সকালের বাইকটা নেই, একটা সাইকেল। তাহলে বাইকটা নিজের নয়, কারো কাছ থেকে চেয়ে-মেঙে নিয়ে এসেছিল। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, পাশ ফিরে দেখে হালিমা পিছিয়ে পড়েছে ইচ্ছে করেই। আর ছেলেটাও সুড়সুড় করে ওর পাশে চলে এসেছে। ফিসফিস কথা। রাগ হয়ে যায় নুরির। ইচ্ছে করে আরো জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে যায়, সামনে গিয়ে ফিরে তাকায় পেছনে, সবটা রাগ জড়ো হয় গলায়, ‘হালিমা গেট কিন্তু বন্ধ হয়ে যাব্যে, কহ্যে দিনু।’ ওরা শুনলো কি না বোঝা যায় না, রনবীর-আলিয়ার কোনো তাড়া নাই। দেখে কে বলবে, স্কুলে আসার সময় কেমন হাঁকাপাকি করছিল ছুড়ি!
নাহ্ গেট বন্ধ হয়নি, ওরাও জানে টাইম হয়নি। ঢুকে গেল কার্ড নিয়ে। এখন আবার একসঙ্গে। হালিমা এখন পাশে পাশেই হাঁটছে। ‘কী রে কহ্যলি না, ছোড়্যাটা কে?’ – এখন বিকেলের সূর্যের তাপ অনেক কম। তারকাঁটার বেড়ার ছায়াটা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে অর্জুনপুরের ভেতরে।
– ‘তুই কাউকে কহব্যি না, আমার কিড়া, কহ্যে দিনু’, হালিমার গলাতেও যেন বিকেলের কমলা সূর্যের তাপ। ও জানে কিড়া না কাটলেও নুরি বলবে না। আর সেই জানা থেকেই আগল খোলে। নুরি জানতে পারে, ছেলেটা রুবেল। রহতপুরেই বাড়ি। বিদেশে যায় টাওয়ারের কাজে, আবার যাবে কয়েকদিন পরেই। আর যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে হালিমাকে।
– ‘কবে?’ শেষ কথাটায় আঁতকে ওঠে নুরি। হালিমা তারিখ বলতে পারে না, তবে খুব তাড়াতাড়ি। বলে চলে, ‘ওখানে বাড়ি নেবে, দুজনার। সন্ধ্যায় কামের পরে ফিরে আসবে। তারপর যখন খুশি ঢোকা যায়, বেরোনো যায় …’, হালিমার চোখ বেড়ার ওপারে অনেকদূর দেখতে পায়।
ও বাড়ি ঢুকে যাওয়ার পরে নুরি এখন একা। ওদের বাড়িও কাছেই। দাওয়াতে ভাবি বসে আছে বিড়ির কুলা নিয়ে। মাথার ওপরে ওই পা-ভাঙা শালিকটা উড়ে গেল বুঝি। ওরও তো বাড়ি ফেরার সময়। কোন গাছে থাকে ও? এপারের, না ওপারের?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.