নন্দীপাড়া থেকে ভ্যানগাড়িটা যখন চলতে শুরু করে, আতিউরের চোখ গেছে তার হাতঘড়ির দিকে, হাতঘড়ির কাচে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত, একটা টিস্যু কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে রক্ত মুছে সে সময়টা দেখল, ৭ : ৩২। তার ধারণা হলো, কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে রাত দুটার বেশি লাগবে না। সময়টা তার জন্য ভালো, বাবা রাতের এই সময়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকেন, তাঁর দেহঘড়িতে ফজরের নামাজের ওকত্ ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত। মা-ও ঘুমান, অথবা সেরকমই মনে হয় আতিউরের। তাঁর শরীরে নানা অসুখ, সেগুলির চিকিৎসা নন্দীপাড়ায় নেই, হবিগঞ্জেও নেই। বিছানায় গেলে সেসব অসুখ নানাভাবে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়, তাঁর দুই চোখের পাতা দখলে নিয়ে নেয়। তারা অনুমতি দিলে তিনি চোখ বন্ধ করতে পারেন, না দিলে ঘরের অন্ধকারে, মশারির ভেতরের বিষণ্ন চৌখোপে চোখ মেলে রাতের অনেকটা সময় কাটিয়ে দেন।
এবং আতিউরকে নিয়ে ভাবেন। আতিউর এখন আর আতিউর নেই। যেমন তার এঁড়ে বাছুরটাও আর এঁড়ে বাছুর নেই। মেজাজ খারাপ হলে শিং উঁচিয়ে তার দিকেই মাঝেমধ্যে তেড়ে আসে। আতিউরের মেজাজ খারাপ হয় না; কিন্তু সে অসহিষ্ণু হয়, অস্থির হয়। কথা শুনতে চায় না। কখন যে তাঁর হাত গলিয়ে ছেলেটা বেরিয়ে গেল, বাইরের দুনিয়াটা তাকে দখলে নিয়ে নিল, যেমন তাঁকে নিয়ে নিল নানা অসুখ, তিনি বলতে পারেন না। ছেলেটার সন্ধ্যা হয় এখন রাত দশটায়। আজ রাতে সেই দশটাও কখন পেরিয়ে গেছে। সেকি এখন নন্দীপাড়ায়, নাকি অন্য কোথাও? হবিগঞ্জে? হবিগঞ্জে কখন সন্ধ্যা হয়?
আতিউর বসেছে ভ্যানগাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে, তার পাশে রাজিক আর দীপু, ভ্যানচালকের পেছনে গুটিসুটি মেরে বসে ঢুলছে আহাদ। আহাদ আর আতিউরদের মাঝখানে পড়ে আছে ষোলো-সতেরো বছরের একটা বাপে খেদানো ছেলে, যার নাম নোমান। না, ছেলেটা নয়, ছেলেটার লাশ। লাশটা দুই বড় গামছায় জড়িয়ে দড়ি দিয়ে পেঁচানো হয়েছে। ভ্যানগাড়িতে তাকে শুইয়ে দিয়ে তার ওপর চটের কিছু খালি বস্তা বিছিয়ে, সেগুলির ওপর মুরগির ফিডের খালি বাক্স রাখা হয়েছে। এসব বস্তা, ফিডের খালি বাক্স আর গামছার কথা মাথায় এসেছে রাজিকের, যার বুদ্ধিটা অনেকের চাইতে পাকা। একটা ভ্যানগাড়িতে রাতে কী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এ নিয়ে কেউ যেন সন্দেহ না করে – যদিও নন্দীপাড়া থেকে বাগুইভিটা পর্যন্ত যে-পথটা তারা বেছে নিয়েছে, তাতে ট্রাক-বাস-অটো চলে না, যে দুই-এক হাটবাজার পথে পড়বে, সেগুলিতেও রাতে তেমন মানুষ থাকে না। তারপরও, রাজিকের বুদ্ধি বলেছে, সাবধান থাকাটা জরুরি। তার আগে, বাগুইভিটাই বা কেন যাবে, তারও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে রাজিক। আকিলকে সে বলেছে, ‘পুয়াটারে মারছে, ধরইন মহিউদ্দি, মাইরা, ইটভরা বস্তার লগে বান্ধি, ধরইন মিঠাখালর পানিত ডুবাই দিছে। তে পুলিশ যখন আইব, দেখব, লাশর লগো মহিউদ্দির গামছা, মহিউদ্দির দড়ি-দড়াও। তে তারা কারে সন্দেহ করব, কউকখ্যা? কারে ধরব?’
আকিল রাজিকের বুদ্ধির তারিফ করল। বলল। আইডিয়াটা ভালো। কিন্তু মহিউদ্দির বাড়ি তিন-চার মাইল। এত দূর থেকে চটজলদি চটের বস্তা আর গামছা কিভাবে আসবে? কে আনবে? তার থেকে বড় কথা, তার বাড়ির কোথায় এসব থাকে, কেউ কি জানে?
রাজিক হাসলো। মহিউদ্দির আড়তে গামছা থাকে, সে বলল, বস্তাও থাকে প্রচুর। দিনের গরম বাড়লে সে সুতাং-এ নেমে গোসল করে। এক গামছায় গা মোছে, আরেক গামছায় গতর ঢেকে ভেজা লুঙ্গিতে আড়তে ফেরে।
আকিলের মনে পড়ল, মহিউদ্দিকে সেও গামছা গায়ে দেখেছে। গামছাগুলি মস্ত বড়, চাদরের মতো। কোথায় পেয়েছে, কে জানে। আড়ত থেকে এগুলো কীভাবে জোগাড় হবে, তা একটা ভাবনার বিষয়, কিন্তু তা নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চায় না। ভাবনাটা রাজিকের আর আতিউরের। তার ভাবনা বরং নোমানের মারা যাওয়া, তার লাশটা বাগুইভিটা পর্যন্ত চালান দেওয়া, এসব তার বাবা হাশিম আলি যেন কোনোক্রমে জানতে না পারেন, তার সব উপায় বের করা নিয়ে। সে তার বাবাকে চেনে। তিনি জেনে গেলে কী হতে পারে, তার কিছু সে অনুমান করতে পারে। জীবনে ওপরে ওঠার মইয়ে সে মাত্র পা রেখেছে, সেই পা’টা টলে যাক, সে তা চায় না।
তবে নোমানকে এত তাড়াতাড়ি নিশানা করবে আহাদ, আকিল তা বুঝতে পারেনি। নন্দীপাড়া বাজারে তার বাবা তখনও ছিলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যে এমন একটা আগুনমুখা হাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে, বাজারের কেউ তা ভাবতেও পারেনি। আড়তে বসে হাশিম আলি দিনের হিসাব মেলাচ্ছিলেন। আজ দুই চালান সিমেন্ট এসেছে, সেগুলি গুদামে তোলা হয়েছে। গুদামের পেছনে করাত কল, সেখানে একটা ট্রাকে মোটা করে কাটা তক্তা তোলা হচ্ছে। এগুলি যাবে লাখাই। নোমান আঙুলে গুনে তক্তাগুলির হিসাব নিচ্ছে। ট্রাকের ড্রাইভার নোমানের চটপট ভাবটা পছন্দ করেছে। তার হেলপারের দরকার, এরকম একটা ছেলে পাওয়া গেলে বেশ হয়। এজন্য নোমানের সঙ্গে সে গল্প জমিয়েছে। একটু দূর থেকে আহাদ দেখেছে। সে এগিয়ে এসে নোমানকে বলেছে, হাশিম চাচা মতি মিয়ার দোকান থেকে চা আনতে বলেছেন। পকেট থেকে দশ টাকা বের করে তাকে দিয়ে বলেছে, এখনই যাও। ট্রাক ড্রাইভারের বিষয়টা পছন্দ হয়নি। সে রেগে বলেছে, ‘আমার মাততো শেষ অইছে না।’ আহাদের মেজাজটা সবসময় গরম, বুদ্ধিটা মোটা সেজন্য কি না, রাজিকের মতো চিকন নয়, শরীরে অসুরের শক্তি। সে লাল চোখে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলেছে, ‘আমি কইছি মাত শেষ, তে মাত শেষ।’ তারপর নোমানের দিকে তাকিয়ে বলেছে, ‘যা। অকখন যা।’
ট্রাক ড্রাইভারের রাগটা চড়ল। সে একটা কটুকথা বলল। আহাদ কথার চাইতে হাতের ব্যবহারটা বেশি পছন্দ করে। ফলে যা হবার তাই হলো। একসময় যে হট্টগোল শুরু হলো, তার কারণ জানার জন্য আকিলকে বেরিয়ে আসতে হলো। সে দেখল, আহাদের সঙ্গে ট্রাক ড্রাইভারের হাতাহাতি হচ্ছে, তাতে যোগ দিয়েছে দীপু আর আতিউর, আর বাজারের কিছু লোক। দেখতে দেখতে হাতের ব্যবহার কাঠের দিকে গেল। করাত কলে চেলাকাঠ থাকে, নানান আকৃতির, সেগুলির সদ্ব্যবহার হলো। একসময় আকিলের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আর্কিমিডিসের মতো সে চেঁচিয়ে উঠল, পেয়েছি!
কী পেয়েছে আকিল?
শুনুন তাহলে।
নন্দীপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। নির্বাচনে নাম লেখানোর শেষ দিনও সপ্তা দুয়েকের মধ্যেই। হাশিম আলির একটা সখ এবার তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন, এবং নন্দীপাড়ার উন্নয়ন যতটা সম্ভব, করবেন। আকিলও চায় বাবা তা-ই করুন। তারও কেন জানি মনে হচ্ছে, বাবা জিতলে তার ভাগ্য বদলাবে। ভাগ্য মানে, অন্তত এক ডজন নির্মাণকাজের ঠিকাদারি অথবা কন্ট্রাক্টরি, যার মধ্যে
নন্দীপাড়া-লাখাই রাস্তার কাজটাই সবচেয়ে লোভনীয়। তবে সমস্যা একটাই – এবার মহিউদ্দিও ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনে নামছেন। লোকটাকে নিয়ে নন্দীপাড়ার মানুষের নানা প্রশ্ন থাকলেও তিনি যে টাকা ছড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে ভোট পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। হাশিম আলি বিষয়টা জানেন। ভোট কেনা বিষয়টা তিনি ঘৃণা করেন! তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যদি তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে দাঁড়ান, খরচ যতটা কম করা যায়, করবেন। আকিল বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে। সে জানে, টাকা না ছড়ালে নির্বাচনে জেতা যায় না। এজন্য সে কিছু বিকল্প নিয়ে ভেবেছে। ভাবতে ভাবতে মহিউদ্দিকে পরাস্ত করার একটা বিশেষ কৌশল ঠিক করে ফেলেছে। তার বুদ্ধিটা তার মনের মতোই বাঁকা, তাতে সোজাপথ ছেড়ে ঘোরাপথে, চোরাপথে চলার ইচ্ছাটাই প্রবল। বাবা চেয়ারম্যান হওয়া মানে আকিলেরই চেয়ারম্যান হওয়া। তাহলে একবারেই মইটার মাঝ বরাবর পৌঁছানো যাবে।
আহাদ ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে মহিউদ্দির লোকজনের মারামারি বেঁধে যাওয়ার পেছনে তার অবশ্য কোনো ভূমিকা ছিল না। কিন্তু নন্দীপাড়ায় মানুষজন মহিউদ্দির লোকজনকে চেনে, যেমন চেনে আকিলের ঘনিষ্ঠ চার-পাঁচ বান্দাকে। সেজন্য বাজারের লোকজন একটু দূর থেকে হাঙ্গামা দেখতে থাকল। আকিল প্রথম সুযোগেই বাবাকে রাজি করিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।
টাকা-পয়সা এক পোঁটলায় বেঁধে তিনি বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।
আকিল আতিউরকে ডেকে বলল, বিরাট সুযোগ। মারামারিটা বড় করো। আগুনমুখা করো। যেভাবেই হোক একটা লাশ পড়ার ব্যবস্থা করো।
লাশ বলতে প্রথমেই আসে নোমানের নাম। আগের রাতের ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার আলোয় যার এদিক-সেদিক হওয়ার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয় লাশটা হতে পারে মহিউদ্দির কলেজ পড়ুয়া ভাগনা মুকিত, যে একটা মোটরসাইকেলের মালিক হয়ে আকিলের বুকে ঈর্ষার আগুন জে¦লে দিয়েছে। যদি এরপরও কোনো লাশ পড়ে যায়, সে হাততালি দেবে।
আতিউর দেখল হাঙ্গামা বাড়তে থাকলে একসময় হাঙ্গামার ব্যাকরণ মেনে এখনো যারা নিষ্ক্রিয় আছে, তারা সক্রিয় হবে। একসময় সারা বাজারে তা ছড়িয়ে পড়বে। তাতে কিছু লোক ভালোই জখম হবে, দু-এক লোক ফৌতও হয়ে যেতে পারে। হাঙ্গামা বাড়ানোর উপায় মোটাবুদ্ধির কিন্তু বদমেজাজের মানুষজনকে উত্তেজিত করা, তাদের বলা তোমাদের স্ত্রীদের অথবা বোনদের ওরা তুলে নিয়ে গেছে। অথবা, মহিউদ্দির আত্মা বাঁধা আছে ইবলিসের কাছে। তাকে না ঠেকালে তোমাদের টেনে সে দোজখে নামাবে।
তাতে বেশ কাজ হলো। মাথামোটা ইন্দ্র তার দা দিয়ে মহিউদ্দির বামহাত বলে পরিচিত হারুন ঘরামির ঘাড় বরাবর একটা কোপ দিয়ে দিলো। হারুনকে বাঁচাতে মহিউদ্দির ডানহাত ফজল এগিয়ে এলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আহাদ। তাতে ফজলের রক্ত ঝরলো। ফজলকে আগলে রাখতে দৌড়ে এলো মুহিবুল আর প্রণয়। বেশ একটা তুলকালামের ভাব তৈরি হলো। একসময় আহাদের কানে কানে নোমানের কথাটা বলল আকিল। নোমান ছিল মতি মিয়ার দোকানে। মতি মিয়া চা বানাবেন কী, হাঙ্গামার গন্ধ পেয়ে চুলা নিবিয়ে দোকানের ঝাঁপ ফেলার জন্য তৈরি হচ্ছেন, আর নোমানকে বলছেন ঝাঁপ ফেলা দোকানের ভেতর বসে থাকতে। কিন্তু আতিউর হাশিম মিয়ার জন্য চা নিয়ে যাবেই। তার পীড়াপীড়িতে মতি মিয়া তাকে চা বানিয়ে দিলেন, যদিও তিনি জানেন, চা যথেষ্ট গরম না হলে হাশিম আলি খান না।
নোমানকে খুঁজে পেতে তাই আহাদের দেরি হলো না। সে তাকে বলল, হাশিম আলি বাড়ি চলে গেছেন। নোমানের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে এক চুমুকে খেয়ে নিয়ে কাপটা সে রাস্তার পাশে ফেলে নোমানকে টেনে গোসাইবাবুর ভুসিমালের দোকানের পেছনের খালি জমিতে নিয়ে গেল। একটা হাত দিয়ে সে নোমানের মুখ চেপে রাখল, অন্য হাত দিয়ে লুঙ্গির সঙ্গে আটকানো ছোট একটা দা বের করে তাকে দু-এক কোপ দিলো। তারপর তাকে মাটিতে ফেলে বেরিয়ে এলো। বিকেল যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। এখানে কেউ আসার সম্ভাবনা নেই।
আকিলকে গিয়ে খুনের কথাটা বলতে প্রথমে সে কিছুটা ভড়কে গেল। সে ভেবেছে, আহাদ কাজটা করবে চিকনবুদ্ধির রাজিককে নিয়ে এবং যাতে তাদের কেউ কোনোভাবে না দেখে, তা নিশ্চিত করে। কিন্তু মোটাবুদ্ধির আহাম্মকটা কাজটা করেছে একা, তার গেঞ্জিতে আবার রক্তের দাগ। সেটা কেউ যে দেখেনি তার নিশ্চয়তা কোথায়? বিরাট একটা ভুল হয়ে গেল। আহাদকে বলল চুপচাপ আড়তে গিয়ে গেঞ্জি বদল করে নিতে।
হাঙ্গামা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করাতকলের তিন-চার কামলাকে পয়সা দিয়ে আকিল বলেছে কিছু মানুষ জোগাড় করে আনতে। পয়সা যত লাগে সে দেবে। তাদের গুদামে, করাতকলে মহিউদ্দির লোকজন আগুন লাগাতে পারে। কামলাগুলি সে-কথা শুনে কাজে নেমেছে, কিছুটা নগদ পয়সার জন্য, কিছুটা করাতকল এবং তাদের চাকরি বাঁচানোর জন্য। তারা তিন-চার মানুষ নিয়ে ফিরলে সকলকে নিয়ে আকিল মহিউদ্দির আড়তের দিকে গেছে। দূর থেকে আড়তটা দেখিয়ে বলেছে, পেছন থেকে গিয়ে হামলা শুরু কর। যত ড্যামেজ হবে, তত ভালো। আকিল নিশ্চিত, হামলা শুরু হলে মহিউদ্দি বেরিয়ে আসবেন।
কিন্তু সে-পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হলো না। মহিউদ্দি খবর পেয়েছেন তার দুই হাত গুরুতর জখম হয়েছে। তিনি দৌড়ে এসে দেখলেন, হারুন ঘরামি মাটিতে শুয়ে আছে। তার মাথার পাশে বসে আছে ফজল। সে হারুনের জখম ধুয়ে গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু তাতে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। ফজলের মাথাতেও গামছার পট্টি। তারও গায়ের গেঞ্জি রক্তে লাল। মহিউদ্দি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। ফজল তাকে আহাদ আর আতিউরের কথা বললে তার উত্তেজনা আরো বাড়ল। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘আমার হারুনর কিচ্ছু অইলে কুত্তার বাচ্চা আহাদরে জাহান্নামো পাঠাইমু।’ বাজারের হোমিওপ্যাথ অমিয়বাবু তাকে বললেন, ছেলেটাকে হাসপাতালে না পাঠালে রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হবে। মৃত্যু হবে কথাটা মহিউদ্দিকে একটা চাবুক মারল। তিনি দ্রুত একটা ভ্যানগাড়ি ডাকিয়ে এনে তাতে হারুনকে তুলে ফজল আর আড়তের এক কর্মচারীর জিম্মায় তাকে দিয়ে বললেন,
‘অটো-উটো যেতা পাও ভাড়া করি লাখাই যাও। আল্লা আল্লা করো।’
কিন্তু নিজে তিনি হুংকার দিতে শুরু করলেন। তাঁর এক লোক তাঁকে বলেছে, হাঙ্গামা শুরু হলে হাশিম আলি সাব হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘হাশিম মিয়া আইজ বাগোর লেঙ্গুরো পাড়া দিছইন। অখন বুঝবা।’
এই ক্রোধটা তাঁর আরো তীব্র হলো যখন শুনলেন তাঁর আড়তে হামলা হয়েছে। দ্রুত তিনি আড়তে ফিরতে ফিরতে আবার হুংকার ছাড়লেন। হাশিম, তুমি টের পাবে, বাঘের ঝাপ্টা কি জিনিস, হাড়ে হাড়ে বুঝবে।
তাঁর হুংকারের সাক্ষী হয়ে রইলেন অমিয়বাবু এবং বাজারের বেশ কিছু লোক, যারা তাঁর মুখে জাহান্নাম কথাটা শুনে আতঙ্কিত হয়েছে। তিনি আড়তে ফিরতে ফিরতে আতিউর পেছনের ভাঙা দরজা দিয়ে ঢুকে মহিউদ্দির দুই গামছা তুলে নিল। দরজার বাইরে পাহারায় থাকা দীপু হাতিয়ে নিল দু-তিনটি চটের বস্তা, যাতে ঢাকার এক ফিড কোম্পানির নাম লেখা। ক্রোধে প্রায় জ্ঞানশূন্য মহিউদ্দির এখন যাই হোক গামছা আর বস্তার হিসাব নেওয়ার কথা নয়।
২.
বিকেলের দিকে হাঙ্গামা আগুন ছড়ালো। সেই আগুনে ঝলসে গেল দুই পক্ষের অনেক লোক। দোকানপাট ভাঙল, রক্ত ঝরল, চিৎকার-গোঙানিতে বাজারের আকাশ কাঁপলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, খবর পেয়ে লাখাই থেকে একটা পিকআপে চড়ে কিছু পুলিশকে নন্দীপাড়ায় আসতে হলো। পিকআপ থেকে নেমেই পুলিশ তাদের লাঠি চালাতে শুরু করল। পুলিশ দেখে আহাদ বাহিনী তফাতে গেল। করাতকলের কামলা আর ভাড়ায় আনা লোকজন হাওয়া হয়ে গেল। আকিল তার গুদামে তালা মেরে সাইকেলে উঠল। অবাক কাণ্ড, পুলিশের লাঠি যাদের ওপর পড়ল, তারা কেউ মহিউদ্দি অথবা হাশিম আলির লোকজন না, তাদের কেউ জানেও না ঘটনা কীভাবে এবং কেন এতদূর গড়ালো। এদের কয়েকজনকে পুলিশ মতি মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে কঠিন কিছু প্রশ্ন করল। পুলিশের গলা এমনিতেই চড়ায় থাকে, আজ লোকগুলির মনে হলো, গলা তো নয় যেন বাজের আওয়াজ। তারা বুঝল, তারা যা দেখেছে, শুনেছে সব খুলে বলতে হবে, কিছুই লুকানো যাবে না। আর লুকাবেই বা কেন, মহিউদ্দি অথবা হাশিম আলির কাছে তাদের কিসের ঠেকা? ফলে প্রথম যাকে পুলিশ প্রশ্ন করল, বাজারের ছাতিম গাছটার নিচে একটা সেলাই কল ফেলে যে দর্জিগিরি করে, অর্থাৎ ছমির খলিফা, সে স্পষ্ট করেই বলল, ইন্দ্র হারুন ঘরামিকে মেরেছিল, ফজলকেও; আহাদ আর আতিউরও ছিল তাদের সঙ্গে এবং ঘাড়ে বুকে জখম নিয়ে হারুন মাটিতে পড়ে থাকলে তাকে দেখে মহিউদ্দি চিৎকার করে হুমকি দিয়েছিলেন, সবগুলোকে তিনি জাহান্নামে পাঠাবেন। দ্বিতীয়জন ছমিরের কথায় কিছুটা রং চড়ালো। মহিউদ্দি তার দুই লোক হারুন আর ফজলকে পাঠিয়েছিলেন আহাদ আর আতিউরকে পেটাতে। তারা পেটাবে কি, নিজেরাই সারা শরীরে জখম নিয়ে মাটিতে পড়েছে। পুলিশ জানতে চাইল হারুন আর ফজল কোথায়? কবিরাজ অমিয় বললেন, লাখাইতে, হাসপাতালে। সময়মতো সেখানে পৌঁছাতে না পারলে হারুন ফৌত হয়ে যেতে পারে। হয়ে গেছে কি না কে জানে। ঈশ^র ছেলেটাকে যেন কৃপা করেন।
পুলিশের মনে অবশ্য কৃপার ভাব নেই, তারা এসেছে ঘটনার আগুনে পানি ঢালতে, তদন্ত করতে, এবং অপরাধীদের ধরে থানায় চালান করতে। তারা হিসাব করে দেখেছে, পিকআপে বড়জোর তিনজনকে ওঠানো যাবে। মানুষজনকে জেরা করে তারা মোটামুটি ছয়-সাত অপরাধীর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। দুই পুলিশকে পাঠানো হলো আহাদ, আতিউর আর দীপুর তল্লাশে; মাথামোটা ইন্দ্রকে পেতে দেরি হলো না, সে মতি মিয়ার চায়ের দোকানের ভেতরেই ছিল। কিন্তু অন্যদের পাওয়া গেল না। অবাক ব্যাপার, পুলিশের কাছে আকিলের নামটা শুধুু একজনই বলল। হয়তো এ-কারণে যে তাকে হাঙ্গামা করতে কেউ দেখেনি। পুলিশ তার ব্যাপারে মেন্টাল নোট নিল। তারা ফিড ব্যবসায়ী মহিউদ্দির ব্যাপারে আগ্রহী হলে তাকে ডেকে পাঠানোর একটা উদ্যোগ নিল। কিন্তু তার আগেই তিনি হাজির হলেন। পুলিশকে দেখে তিনি প্রথমেই দাবি তুললেন হাশিম আলিকে গ্রেফতারের জন্য। পুলিশদের নেতা এএসআই সাইফুলকে তিনি বললেন, ‘স্যার, হাশিম আলি আর তার গুন্ডা পুয়া আমার মানুষজনরে খুন করছে, আমার গদিত আগুন দিছে, টেকা-পয়সা লুট করছে …’
তাকে থামিয়ে সাইফুল জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? তুমি সম্বোধন শুনে মহিউদ্দির রাগ হলো, কিন্তু তিনি জানেন, রাগেই বিনাশ। তিনি তাঁর নাম-পরিচয় জানালেন এবং প্রতি তিন শব্দের পর স্যার কথাটি জুড়ে দিলেন। ব্যবসায়ী শুনে সাইফুল কিছুটা নমনীয় হলেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যে খুনের কথা বললে, টাকা লুটের কথা বললে, কারা? মহিউদ্দির উত্তেজনা বাড়ল। তিনি বললেন, কে আর, হাশিম আলি আর আকিল।
এএসআই সাইফুল চিকন চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো, তোমার গদিতে চলো।
গদিতে পৌঁছে প্রথমেই মহিউদ্দি তার ভাঙা ক্যাশবাক্স দেখালেন। পুলিশ তা দেখল না। পুলিশের চোখ গেল গাদাগাদি কিছু চটের বস্তার ফাঁকে একটা কাঠের বাদামি বাক্সের পিঠের কিছু অংশের দিকে। সাইফুল নিজে গিয়ে বাক্সটা তুলে নিয়ে এলেন। বাক্সের তালা ভাঙার একটা চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সফল হয়নি। তিনি মহিউদ্দিকে বললেন, খোল।
কাঁপা হাতে লুঙ্গিতে বাঁধা চাবির গোছা বের করে বাক্স খুলতে খুলতে মহিউদ্দি প্রায় কেঁদেই ফেললেন। বাক্সটা নিজের হাতে বস্তার নিচে চাপা দিয়ে গেছেন তিনি। কে ওটা বের করে খুলল? তাঁর যেন হঠাৎ চেতনা ফিরল। কে আবার, ভাগনা মুকিত! তাকেই তো গদিতে বসিয়ে তিনি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন।
বাক্স খুললে পাঁচশো-একশ টাকার তিন-চারটি বান্ডিল দেখা গেল। সাইফুল বললেন মহিউদ্দিকে, ভালো নাটক সাজিয়েছেন, তারপর বাক্সসমেত তিনি তাঁকে পিকআপে তুললেন।
৩.
বাজারে সন্ধ্যা নামল। দোকানপাট সব বন্ধ, আলো নেই। রাতের মতো সব যেন বিশ্রামে গেল।
কিন্তু সবাই গেল না। যেমন আকিল আর আহাদ, এবং তাদের দলের অন্যরা। আকিল একটা ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করেছে, চালাবে করাতকলের এক কামলা। ভ্যানগাড়িটা একটু পরেই চলে এলো, কোনো টুংটাং না তুলে নিঃশব্দে এসে গোসাইবাবুর ভুসিমালের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। আহাদ আর রাজিক গেল নোমানের লাশটা তুলে আনতে। লাশটা আগের জায়গাতেই আছে, আহাদ একাই সেটি বয়ে নিয়ে এলো। দোকানের একদিকে কিছু ঝোপঝাড়, আর একটা ন্যাড়া পেয়ারা গাছ, অন্ধকারে পেয়ারা গাছের ডালকে সাদা মনে হচ্ছে। সেই গাছের নিচে নোমানকে শোয়ানো হলো। রক্ত জমে আছে তার শরীরের নানা জায়গায়। চোখ দুটি বন্ধ, কিন্তু একটু ভালো করে দেখে আতিউরের মনে হলো, মুখ জুড়ে ক্লান্তির একটা ভাব থাকলেও কোথায় যেন হাসির একটা আভাস। ঠোঁটের কোণে, নাকি ভুরুতে। তার হঠাৎ কেমন একটা ভয় হলো। আহাদ বলেছে, লাশটা শক্ত হয়ে যাচ্ছে। দেরি করা যাবে না। রাজিক গামছা আর দড়ি বের করলো। আতিউর আর দীপু সারা গায়ে গামছা জড়ালো। জড়াতে গিয়ে আতিউরের একটা হাত পড়ল বড় একটা জখমে। জখম থেকে এখনো নিশ্চয় রক্ত বেরুচ্ছে, কারণ বেশ কিছু রক্ত লাগলো তার হাতে। একটা লাফ দিয়ে দোকানের সামনে ফেলা কাটা ড্রামে জমে থাকা পানিতে হাত ধুয়ে নিল।
রক্ত বলে কথা।
আকিল নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে সব দেখল। লাশ ভ্যানে তোলা হলে সে আতিউরের হাতে একটা টাকার বান্ডিল গছিয়ে দিলো। কাজটা ঠিকঠাক শেষ হলে সবাইকে পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। আর ভ্যানগাড়ি চালক ছেলেটাকে ভালো একটা বখশিস। ছেলেটাকে সে বলল, পরদিন সকালেই যেন অন্তত সপ্তা দুয়েকের জন্য ফুটে যায়।
ছেলেটার সেই সাহস নেই যা দিয়ে পুলিশের জেরা মোকাবিলা করতে হয়। পিঠে লাঠির দু-এক বাড়ি পড়লে মনের কোণের গোপন কথাগুলিও সে উগড়ে দিতে পারে।
৪.
বাগুইভিটা থেকে যে-পথে মহিউদ্দি প্রতিদিন নন্দীপাড়া আসেন, তা খুব বেশি হলে সাড়ে তিন মাইল, কিন্তু আজ রাতে ভ্যানগাড়িটা যে-পথ বেছে নিয়েছে, তাতে দূরত্ব দাঁড়াবে চার-পাঁচ মাইলে। রাস্তাটাও উঁচু-নিচু, মাঝেমধ্যে যথেষ্ট সরু। ভ্যানচালককে দু-একবার নামতে হয়েছে, হাতে টেনে ভ্যানটা এগিয়ে নিতে। আতিউর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা সমাধান বের করেছে। ভ্যানগাড়ি কোথাও আটকে পড়লে, অথবা সরু পথে বিপাকে পড়লে তিনজন নেমে পড়ে সেটি ঠেলবে। তাতে সময় বাঁচবে। তার কেন জানি ক্লান্তি লাগছে। যেন নোমানের ক্লান্তি এখন তার ওপর এসে ভর করেছে। মরা মানুষের ক্লান্তি নিয়ে সমস্যা নেই, এটি জিন্দা মানুষের মাথাব্যথা!
ভ্যানগাড়ির চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। মাঝে মধ্যে হীরার দ্যুতির মতো আলো জ¦ালিয়ে নিভিয়ে উড়তে থাকা জোনাক পোকারা সামনে পড়ে। কিছু জোনাক অনেকক্ষণ ভ্যানগাড়ির ওপরেই তাদের আলোর কারুকাজ চালালো। তাদের দেখতে দেখতে আতিউরের মনে হলো, এরা কি লাশটার খোঁজ পেয়েছে, নাকি লাশটার মুখে জমা হাসিটা তাদেরও ভাবাচ্ছে, এবং এর একটা অর্থ তারা করতে চাইছে। এমনও তার মনে হলো, হয়তো জোনাকগুলি তাদের আলো জে¦লে তাকে কিছু দেখাতে চাইছে। যে ভয়টা হঠাৎ তাকে স্পৃষ্ট করেছিল, তা থেকেই কি জোনাক পোকাদের নিয়ে এমন ভাবনা? জোনাকদের নিয়ে আগে কখনো কি সে কিছু ভেবেছে?
জোনাকের দল হঠাৎ চলেও গেল। তাদের জ¦লা-নেভা মিলিয়ে গেলে আতিউরের মনে পড়ল, নোমান নামের ছেলেটা একসময় নন্দীপাড়া বাজারের নৃপেনের চায়ের দোকানে কাজ করত। কিন্তু ছাপড়া দোকানটা একদিন পুড়ে গেল। আগুনে এমনকি অ্যালুমিনিয়ামের কেতলিটাও কেমন করে জানি পুড়ল, একটা ছিদ্র দেখা দিলো। ফলে নৃপেণ বেকার হলো, নোমানও। এরপর দুজনই নন্দীপাড়া ছেড়ে কোথাও যেন চলে গেল। তাদের সবাই ভুলেও গেল, কিন্তু এই কদিন আগে ছেলেটা আবার ফিরে এলো, এবং হাশিম আলির আড়তে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। বলল, একটা চাকরি পেলে সে বেঁচে যায়। হাশিম আলি এভাবে কাউকে চাকরি দেন না, কিন্তু ছেলেটাকে দেখে তাঁর কেমন জানি মায়া হলো। তিনি চুপ করে তাকিয়ে থাকলে নোমান তার গল্পটা শোনালো। তার একটা মা আছে, যাকে তার বাবা চেলাকাঠ দিয়ে মাঝে মধ্যে পেটায়। মাকে সে যতটা পেরেছে আগলে রেখেছে। কিন্তু ভেতর থেকে নিঃস্ব হয়ে তিনি বেঁচে
থাকার ইচ্ছাটা হারালেন। এক রাতে তার কোলে মাথা রেখে তিনি চলে গেলেন। তার কিছুদিন পর বাবা আরেকটা বিয়ে করল, বউ নিয়ে বাড়িতে এলো, এবং এক সপ্তাও গেল না, চেলাকাঠটা দিয়ে বউকে একদিন মারল। তাতে নোমানের রাগ এমনই চড়ল যে, চেলাকাঠটা বাবার হাত থেকে নিয়ে তাকে বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলো। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সে শুনল, বাবা তাকে বলছে, তাকে সে ত্যাজ্য করছে। তাকে বলেছে, জন্মের মতো দূর হ।
বাবাকে পেটানোর বিষয়টা হাশিম আলির পছন্দ হয়নি। কিন্তু তাতে সমস্যা হলো না। নোমান কাজ পেল, একটা থাকার জায়গাও হলো। আড়তের যেখানে সিমেন্ট রাখা হয়, তার পাশে একটুখানি ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে চিকন একটা চৌকিও পাতা। বাজারটা যখন এত বড় ছিল না, তখন একটা লোক ঠিক করা ছিল রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য। এখন তার আর দরকার হয় না। বাজার কমিটিই পাহারাদার রেখেছে। চৌকিটাকে এখন নোমান তার ঠিকানা বানাতে পারে।
ওই চৌকির জন্যই ছেলেটা লাশ হলো, নিজেকে অবাক করে একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে আতিউর ভাবল।
একটা চৌকির জন্য?
শুনুন তাহলে।
আকিলের মাথায় যখন থেকে বাবাকে ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে জিতিয়ে কিছু টাকা-পয়সা কামাইয়ের চিন্তা এসেছে, এবং যখন বুঝতে পেরেছে মহিউদ্দি টাকা ফেলে জিতে যেতে পারে, তাকে থামানোর পথগুলি খতিয়ে দেখেছে। একটা পথ তার মনে ধরেছে। মহিউদ্দির ছোট মেয়ে শামসুন নাহার, যে কি না ঘোষণা দিয়েছে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, এবং মন দিয়ে পড়াশোনা করে একটার পর একটা পরীক্ষায় সবাইকে টপকে যাচ্ছে, সপ্তায় দু-তিন দিন টিউশনিতে যায়। ক্লাস এইটের পরীক্ষা সামনে, সে সব বিষয়ে একশতে একশ পেতে চায়। টিউশনিটা বাড়ি থেকে কিছু দূরে এক স্যারের বাড়িতে এবং আরেক স্যারের স্কুলে। একাই সে যায়, কারণ আশেপাশের তার কোনো বন্ধুর টিউশনি করার পয়সা নেই। টিউশনি শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কোনো কোনোদিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। তাকে যদি বাড়ি ফেরার পথে একদিন মুখে রুমাল ঢুকিয়ে চোখ বেঁধে ফের স্কুলে ঢুকিয়ে সালোয়ার কামিজ খুলে ছবিটবি তুলে আবার কাপড়-চোপড় পরিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া যায়, এবং তারা অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায়, তাহলে একদিন ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপ মহিউদ্দির ফোনে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? মহিউদ্দির একটা স্মার্ট ফোন আছে, আকিল জানে, এই ফোনের বড়াই তিনি সবখানেই করেন। আকিল এও জানে, বাংলাদেশের যে-কোনো জায়গা থেকে যে-কোনো ফোনে ছবি পাঠানো হলে পুলিশ তার খবর পাবে। সেজন্য ভিডিওটা সে পাঠাবে শারজাহতে তার মামাতো ভাইয়ের কাছে। তারপর ভিডিওটা সে মুছে ফেলবে। মামাতো ভাই ছবি পাঠাবে মহিউদ্দির ফোনে।
গত রাতে আড়তে বসে কথাগুলি সে বলছিল আতিউর আর রাজিককে। আকিল কোনো কোনো সন্ধ্যায় আড়তে বসে। ফেনসিডিল বা ডাইল পেলে খায়, না পেলে ফ্লাস্কে রাখা চা খায়। আড্ডা জমায়। আড্ডা ভাঙতে নয়টা-দশটা বাজে। গত রাতে কোথা থেকে দুই বোতল ডাইল জোগাড় করেছিল আকিল। খুব আয়েশ করে, সিগারেট সহযোগে সে ডাইল খেয়েছে, সেজন্য গলাটা তার চড়ায় উঠেছে। সন্ধ্যাবেলা নোমান করাতকলের পেছনে একটা চুপচাপ জায়গায় চুলা জে¦লে ভাত ফুটিয়েছে, আলু-ডাল রেঁধেছে। দু-তিন কাঁচামরিচ দিয়ে সেগুলি খেয়ে বাসন-পাতিল পরিষ্কার করে তার চৌকিতে এসে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। তার চৌকির ওপর বা পাশে কোনো আলো জ¦লে না, কেউ এদিকে আসেও না। মশার উৎপাত আছে, কিন্তু সারা গায়ে কাঁথা জড়ানো থাকলে মশারাও একসময় বিরক্ত হয়ে উৎপাত থামায়।
আকিলের উঁচু গলা নোমানকে ঘুম থেকে জাগালো। সে শুনল – শামসুন নাহারকে আকিল স্কুলের ঘরে বস্ত্রহীন করবে। একটা দিন সে ঠিকও করে ফেলেছে। তার মনে হলো, আকিল যেন এরই মধ্যে সে কাজটি করে ফেলেছে, কারণ তার গলায় উত্তেজনা, হিস হিস কাঁপন। নোমান নিজেও একবার বস্ত্রহীন শামসুন নাহারকে দেখল, কিন্তু তার উত্তেজনা হওয়ার বদলে কষ্ট হলো। অনেক আগে এক রাতে মাকে সে বাবার হাতে বস্ত্রহীন হতে দেখেছে। মা কিছু না পেয়ে মশারি দিয়ে লজ্জা ঢেকেছেন। ভাগ্য ভালো, ঘরে আলো ছিল না, কিন্তু পূর্ণিমাটা মেঘে ঢাকা না পড়লে যেমন আলো ছড়ায়, তার কিছু ফাঁক-ফোকর গলিয়ে ওই ঘরে ঢুকে পড়েছিল।
মাকে এত অসহায় কোনোদিন সে দেখেনি। অবাক, মার খেয়েও যে-মানুষটি সহজে কাঁদতেন না, গায়ে মশারি জড়িয়ে তিনি কাঁদতে থাকলেন। বাবাকে সেই কান্না বিরক্তির চূড়ায় তুলল। কিন্তু চালে কিছু একটা পড়ল – কেউ যেন ঢিল ছুড়ল, অথবা সুপারি গাছকটা সুপারি খসিয়ে দিলো, আর বাবা তদন্ত করতে বারান্দায় বেরোলেন।
নোমান কিছুতেই বুঝতে পারল না, একজন লোক কিভাবে একটি মেয়ের সর্বনাশের ছক এমন নির্লিপ্তভাবে তৈরি করতে পারে, তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে পারে, তার শরীরের একটুখানি জায়গাও তার হাতের ছোঁয়ার বাইরে রাখতে পারে না। সে বুঝল, আকিল আর বাকিরা চলে গেলেও রাতটা তার নির্ঘুম কাটাতে হবে।
কিন্তু সেই কষ্টে যাওয়ার আগে একটা সমস্যা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে শুনল, আকিলকে কেউ কিছু একটা বলল, এবং আকিল সঙ্গে সঙ্গে গলা নামিয়ে বলল, কোথায়? একজন বলল, চৌকিতে। এই গলাটা রাজিকের। এরপর একটা খসখস শব্দ সে শুনল, যে শব্দ সিমেন্টের মেঝেতে চপ্পলে পা ঢোকাতে গিয়ে কেউ করে। এবার চপ্পলের শব্দটা মেঝেতে বাজল। শব্দটা তাকে শুনতে হলো। চপ্পল জোড়া আকিলের। নোমানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আকিল বলল, ‘নোমান, এই নোমান।’
নোমান কাঁথা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘জি, আকিলভাই?’
‘তুই ঘুমাইছস না নি?’ আকিলের কঠিন প্রশ্ন।
নোমান বিপদটা বুঝল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে বলল, আপনি ডেকেছেন বলে জাগলাম।
আকিল কথাটা বিশ^াস করল না। কিন্তু নোমানকে সে সন্দেহ করছে সেরকম কোনো ঈঙ্গিত দেওয়া যাবে না। আচ্ছা, সে বলল। এখন তাহলে ঘুমিয়ে পড়, আমরা গেলাম।
আকিল ও তার দল চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ নোমান জেগে থাকল। সে আকিলের শীতল এবং ধারালো ইস্পাতের মতো গলায় বলা কথাগুলির অর্থ বুঝেছে। জীবনের ঘাটে ঘাটে ঠোকাঠুকি খেতে খেতে সে পৃথিবীর বাস্তবটা বোঝে, মানুষের মনও পড়তে পারে। সে আকিলের মন পড়ল। তার গাঁয়ে কাঁটা দিলো। কেন জানি তার মায়ের কথা মনে পড়ল, তার কোলে মাথা রেখে আস্তে করে তার চলে যাওয়ার কথা। একসময় তিনি একটু পানি খেতে চেয়েছিলেন। নোমান পানি এনে দিলে মা খেলেন, তারপর চোখে একটুখানি হাসি ফুটিয়ে বললেন, এই রাতটা আমার পার হবে না, না হোক, তাতে আমার খেদ নেই। তুই শুধু আমার একটা হাত ধরে রাখ।
চৌকিতে শুয়ে নোমানের মনে হলো – কেন, সে বলতে পারবে না – এই রাতটা তার পার নাও হতে পারে, যদি হয় তা হবে শুধু তার মায়ের জন্য। সে কাঁথার বাইরে একটা হাত বের করে রাখল, মাকে বলল, আমার হাতটা ধরে রাখো, মা।
৫.
রাস্তাটা দরদরিয়াতে এসে বাঁদিকে বেঁকে গেল। একটুখানি গেলে মিঠাখাল। মিঠাখালের এই জায়গাতে একটা পুল। সেটি পার হয়ে একশ গজের মতো গেলে মহিউদ্দির বাড়ি। আতিউর তার ঘড়ি দেখল, রাত ৯ : ৪৮। যা যা তাদের করার, তা করতে হবে নিঃশব্দে, সময় হয়তো এতে একটু বেশি লাগবে। আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে, কিন্তু চাঁদটা ঢাকা পড়েছে ঘোলাটে মেঘের আড়ালে যার রংটা মরা মানুষের চোখের মতো। এই ঘোলাটে আলোয় কাজ একটু ধীরে হবে, তারপরও বারোটার মধ্যে সব শেষ হওয়ার কথা, তারপর বাড়ি যেতে ঘণ্টা-দুই। সময়ের হিসাব মিলে যাওয়াটা আনন্দের, কিন্তু আতিউরের মনে আনন্দ নেই। আছে কেমন এক অস্থির করা বিপন্নতা। যে-লাশটা শুয়ে আছে তার পিঠের দিকে পা মেলে, বিপন্নতার উৎপত্তি তো সেই লাশটা। একটা জিন্দা ছেলে হঠাৎ একজনের পথের কাঁটা হয়ে গেল, রাতের একটা প্রহরও ঠিকমতো গেল না, জিন্দা মানুষটাকে লাশ বানানোর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। গত রাত যখন দশটার কাছাকাছি, আতিউরের কাছে ব্যাপারটা মোটেও তেমন মনে হয়নি। সে-ই তো আকিলের কথায় সায় দিয়েছে, তাকে সেই তো প্রথম বলেছে, চৌকিতে শোয়া নোমান মাত্র তিন হাত দূরত্বে, ফিসফিস করে কথা বললেই তো শুনে ফেলতে পারে। কাল যখন সে বাড়ি ফেরে বারোটারও আগে, মা খুব খুশি হয়েছিলেন। দরজা খুলে তাকে ধরে আদর করেছিলেন। আর ঠিক তখনই একটা বিপন্নতার বোধ তার মধ্যে তৈরি হয়েছিল। আজ রাতে যা ফণা তুলেছে।
রাজিক নিচু স্বরে বলল, ‘আইচ্ছি’, অর্থাৎ এখন মিঠাখালের পুল।
ভ্যানগাড়িটা মিঠাখালের পুলে উঠল। কিন্তু হঠাৎ আটকেও গেল। যেন চাক্কা জ্যাম। যেন তার চেইন পড়ে গেছে, বা চাকা দুটি কোনো গর্তে সেঁধিয়ে গেছে। ভ্যানচালক জোরে প্যাডেল মারছে, কিন্তু ভ্যানটা নড়ছে না, ব্যাপারটা অবাক করার মতো। রাজিক আর আতিউর চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। নাহ্, সবই তো ঠিক। তাহলে? ভ্যানচালকও নেমেছে। সে অবাক বিস্ময়ে প্যাডেল দেখছে, কোথাও তো কোনো সমস্যা নেই। চাকা দুটির নিচে পুলের সিমেন্টের পাটাতন মজবুত এবং সমান। তাহলে?
আহাদ আড়মোড়া ভেঙে জাগল। বোঝাই যাচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন ভ্যানগাড়ি থেকে নেমে সে সমাধান দিলো, ঠেললেই তো হয়। প্রথমে সে ঠেলল। কিন্তু ভ্যানগাড়ি একটা চুলও সামনে এগোলো না। এবার আহাদের সঙ্গে হাত মেলালো বাকি তিনজন, ভ্যানের চালক টানতে থাকল সামনে থেকে। না। ভ্যানগাড়িতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তার চাকা যেন পাথরের তৈরি, বিরাশি মণ যার ওজন। আহাদের চোখ বিস্ময়ে ফেটে পড়ছে। ‘কিতা অইল বা?’ সে ভ্যানচালককে জিজ্ঞেস করল। ভ্যানচালক কী উত্তর দেবে। তার চোখেও তো আহাদ থেকে বেশি বিস্ময়। এতক্ষণ যে গাড়ি চলল, এবড়ো-খেবড়ো জমিতে, কাদাপানিতে, হঠাৎ সে গাড়ি এরকম থেমে যাবে, এমন শক্ত হয়ে পুলের সঙ্গে গেঁথে যাবে, যেন এটা পুলের একটা অংশ! আহাদ রেগে গেল, তার পেটানো দুই হাত ভাঁজ করে সে বলল আতিউরকে ‘খবিছর বাইচ্চারে তুলি’ – দুই হাতে এরপর সে গাড়িটাকে একটু উঁচুতে তুলে ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলল। কিন্তু কিসের কী!
আহাদের হাতও পরাজয় মানল। একটা চুলও গাড়িটা এগোলো না, পেছালো না।
আধা ঘণ্টা ধরে তারা চেষ্টা করে গেল। আতিউরের ঘড়িতে ১০ : ২৬।
ক্লান্ত, বিরক্ত আহাদ এবার প্রস্তাব করল, ভ্যানগাড়িতে যখন একটা ঝামেলা হয়েছে, এবং ঝামেলাটা গায়েবি, এবং এর কোনো সমাধান কোনো ভ্যানমিস্ত্রি দিতে পারবে না, লাশটা বরং তুলে নিয়ে মিঠাখালে ফেলে দিলেই হবে। দীপু বলল, গায়েবি বিষয়টা ভ্যানগাড়ির নাও হতে পারে, বিষয়টা হতে পারে লাশের। আল্লার দুনিয়ায় কত কিছুই তো হতে পারে। আহাদ বিষয়টা স্বীকার করল, এমনকি চিকনবুদ্ধির রাজিকও। শুধু আতিউর চুপ করে রইল। তার বিপন্নতার পারদ উঁচুতে উঠছে। কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে একটা ভয়ও কাজ করছে। দীপু গলায় আতঙ্ক নিয়ে বলেছে, যতই পাড়াগাঁ হোক জায়গাটা, যতই এই রাতে লোকজন পথে বের না হোক, অন্তত একজন মানুষ তো থেমেছে, প্রশ্ন করেছে, কী সমস্যা জানতে চেয়েছে। আহাদ তাকে হাত নেড়ে চলে যেতে বললে সে গেছে বটে, কিন্তু গ্রামে গিয়ে আরো দু-তিন মানুষকে সে যে বিষয়টা বলবে না, সে নিশ্চিতি কোথায়? ফলে সবাই হাত চালালো। ফিডের বাক্স পুলে রেখে চটের বস্তা সরালো। তারা চারজন জানে, কাকে কী করতে হবে।
গামছায় জড়ানো লাশটার মুখ ঢাকা হয়নি, অথবা একটা কিছু দিয়ে হয়েছিল, কিন্তু সরে গেছে। মুখে রাতের ঘোলাটে আলো পড়েছে। তাতে একটা বিষণ্ন হাসি ফুটেছে, যে-হাসিটা মেলানোর আগে অনেকক্ষণ রেশ রেখে যায়। আতিউর চোখ ফিরিয়ে নিল। তার ভেতরটায় কাঁপন শুরু হয়েছে। কিন্তু আহাদের সাহস আছে, নির্বুদ্ধি বলে সাহসটাই তার সঞ্চয়। সে লাশটা কাছে টেনে পাঁজাকোলা করে কাঁধে তুলতে চাইছে। কাজটা সহজ। একটা গরিব, বাপে খোদানো, ষোলো বছরের ছেলের কতই বা আর ওজন। সিমেন্টের বস্তা কাঁধে তুলতেও আহাদের তেমন সমস্যা হয় না।
কিন্তু লাশের গায়ে হাত দিয়ে তার মনে হলো, হাতটা যেন পিছলে গেল। যেন লাশটা বলছে, হাতটা তফাতে রাখো। তাতে তার রাগ হলো। সে লাশটাকে টেনে কাঁধে তুলতে মনোযোগী হলো।
রাজিক বলল, ‘কিতাবা, কিতা অইল তুমার?’
না, আহাদের কিছু হয়নি। হয়েছে লাশটার। যতই সে টানুক, লাশটার কোনো নড়ন-চড়ন নেই। সে অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকালো, যেন আকাশ থেকে একটা উত্তর সে আশা করে। একসময় ভ্যানগাড়িতে উঠে বসে লাশের পিঠের নিচে দুই হাত ঢুকিয়ে তাকে তুলতে চেষ্টা করল। এবার মনে হলো কাজ হলো, যেহেতু লাশটা কিছুটা তোলা গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রেখেও দিতে হলো। কী ভারি! এত ভারি কী করে হয়? ভ্যানের পাটাতনে লাশটা রেখে সে কিছুক্ষণ দম নিল। আবার তোলার চেষ্টা করল। এবার ব্যাপারটা আরো কঠিন মনে হলো তার কাছে। একসময় রাজিক প্রস্তাব দিলো, তারা সকলে মিলে লাশটা তুলবে। একটা বড় চটে ইট ভরে ভ্যানে তোলা হয়েছিল। সেটিতে ভরে পুল থেকেই মিঠাখালে ফেলে দেবে। মহিউদ্দির বাড়ির সামনা পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। কথাটা আতিউরের মনঃপুত হলো। কারণ ঘড়িতে এখন ১১:১১। সবাই হাতও লাগালো। চার জোড়া হাত লাশটার শরীর পেঁচিয়ে তাকে তোলার চেষ্টা করল। এবার একটুখানি উঁচুতে তোলা গেল, তবে বেশি না, বিঘতখানেকও নয়। সবাই দেখল, লাশ তো না, যেন এক বিশাল পাথর, যে পাথরের ওজন মাপবে তেমন দাঁড়িপাল্লাও কোথাও নেই। মিনিটখানেকও সেই ভারী পাথর তারা ধরে রাখতে পারল না। আবার শুইয়ে দিতে হলো। এবার আতিউরের হাত রক্তে ভিজল। রক্ত? সে অবাক হয়ে তাকালো। কোমরে তো রক্ত থাকার কথা না!
রাতের ঘোলাটে আলোয় রক্তের রংটা লাল মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে ঘোর কালো। যেমন কালো সাদা দেয়ালে কয়লা ঘষলে হয়। আতিউর ভয় পেল। তার মনে হলো, কালোটা কোনোদিন মুছবে না, এখনি যদি না ধোয়া যায়। পুল থেকে মিঠাখালে নেমে সে ঘষে ঘষে হাত ধুতে থাকল। একসময় মনে হলো, হাতটা পরিষ্কার হয়েছে, ততক্ষণে রাজিক নেমে তার কানের কাছে মুখ এনে রেগে বলছে, এখন হাত ধোয়ার সময় হলো? এত সময় ধরে?
আতিউরের চোখ গেল তার ঘড়ির দিকে ১১:৪৬।
পুলে উঠলেও কোনো সমাধানের আশা দেখতে পেল না আতিউর। অনেকবার তারা লাশটা তুলতে চেষ্টা করেছে, প্রতিবারই যেন আরো বেশি ভারি মনে হয়েছে তাকে। দীপু বলল, ভালো হয় যদি ভ্যানগাড়ি সমেত লাশটা খালে ফেলে দেওয়া যায়।
গামছাসহ ফিডের দোকানের বস্তায় না ভরলে এই ফেলে দেওয়ায় কোনো লাভ কি হবে? দীপুকে প্রশ্ন করল রাজিক। দীপু উত্তর না দিলে রাজিক বলল, বস্তায় ভরবে কী, লাশ কি তুলতে পারছ? ভ্যানগাড়ি টলানো যাবে?
টলাতে আবার একটা চেষ্টা করা গেল। লাভ হলো না, এখন ভ্যানগাড়িটাও এক প্রকাণ্ড পাথর।
আতিউর দেখল, তার ঘড়িতে রাত বারোটা বেজেছে। সে জানে, একটু পর সাড়ে বারোটা বাজবে, তারপর
একটা-দেড়টা হয়ে দুটা। সময়টা বাড়ি ফেরার জন্য সবচেয়ে ভালো।
সেই খবর কেউ পেয়েছে কি না, কে জানে, আতিউর দেখল, যেন তাকে বাড়ি নিতেই কিছু দূর থেকে কিছু মানুষ আসছে। তাদের একজনের হাতে টর্চ। দীপু বলল, পালাও, সবাই পালাও।
আতিউর বলল, তোমরা যাও। আমি যাব না।
সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালে আতিউর বলল, লোকগুলি আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। রাত দুটায় বাবা ঘুমায়, মাও। কিন্তু আজ রাতে মা আমার জন্য জেগে আছেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.