ডুবুরি

রেজাউর রহমান

রাজীবের এমনটাই হয় বরাবর। কোনো সুখ-সংবাদ – দুঃখের উৎস, কাজের নতুন উদ্যোগ – উদ্যোগের অগ্রগতি কিংবা হতাশার ইশারা অথবা এমনি এমনি মন কেমন করা, নয়তো অনির্দিষ্ট কোনো বিপন্নবোধ তাঁর পিছু নিলে স্থানীয় সরকারি মাৎস্য বিভাগে বছর ধরে থাকা বাংলোর দক্ষিণ-পশ্চিম কোনার ঘর থেকে সাগরমুখী দরজা খুলে তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ান।

বাইরে তখন সাগরের জোয়ার-ভাটার ক্ষ্যাপা উত্তাল জলরাশির ছোঁয়া ঠান্ডা বাতাস। রাজীবের প্রায় উদাম দেহে সেই শিরশিরে বাতাস এসে লাগে। কিন্তু তাকে তা অন্যদিনের মতো আন্দোলিত অশান্ত করে না। সেইসব অনুভূতিতে তাঁর খেয়াল নেই আজ।

তাঁর সামনে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লাগানো জলোচ্ছ্বাসরোধক ঝাউবনের সারি। এর ফাঁকে ফাঁকে কিছু স্থানীয় দিনমজুরের ছাপরা-ডেরা উঠে গিয়েছিল। কিছুদিন আগের তেমন জোড়ালো নয়, হালকা গোছের এক জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটায় সেসব ধুয়ে-মুছে গেছে। শুধু এদিক-সেদিক দাঁড়িয়ে আছে কিছু জীর্ণশীর্ণ বাঁশের খুঁটি। একটু দূরে সৈকতের ফেনিল লোনা জলের অাঁকাবাঁকা রেখা স্পষ্টই চোখে পড়ে। আরেকটু গভীরে মাছধরা জেলে              সাম্পান-ট্রলারের লণ্ঠনবাতির অসমান সারি। উপরের আকাশে           শেষ জ্যোৎস্নার আলো। চাঁদের বলয়রেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। জ্বলছে দু-একটি তারা। রাজীবের হালকা চোখে পড়ে চরাচরের বালিও।

 

গতকাল সাত-সকালে বাণীর সঙ্গে রাজীবের দেখা। আকস্মিক, তাও অদ্ভুত এক জায়গায়। কক্সবাজারের ফিশারিজ ঘাটে। আবছায়া অন্ধকার থাকতে এখানে জমতে থাকে সারারাতের টহল দিয়ে মাছধরার ডিঙি-সাম্পান-ম্যাকানো বোট। সিরিয়াল ধরে। মাছ পাইকারি ক্রেতারা আসে আরো পরে।

দিনের আলো ফুটে উঠতে থাকলে জেলেদের মধ্যে তালাতালির খিড়িক লেগে যায়, কার আগে কে মাছ এনে ফেলবে পাইকারি মাছ বিক্রির চত্বরে। তখন রাজীব হাসানের সন্ধানী বাজ-চিলের চোখ, খুঁজে ফিরে তাঁর প্রয়োজনীয় স্পেসিম্যান, কালেকশন-স্যাম্পলস।

রাজীব মাছের স্তূপের পাশে বসে পড়ে, দুটো মাছ, মাত্র তাঁর সঙ্গে থাকা ছেলেটির ব্যাগে ঢুকিয়েছেন, তখনই বাণী এসে তাঁর পাশে দাঁড়ান।

‘কে? আমাদের প্রবাল দ্বীপের ফুল যে! এখানে কী করছ?’

রাজীব মাছ সংগ্রহের ধান্দায় আচ্ছন্ন অবস্থা থেকে আধুনিক ধাঁচের সেলোয়ার-কামিজ পরা, সারা পিঠ ছাড়ানো ঘন চুলে আবৃত সুশ্রী মহিলার এমনি ধারার স্বচ্ছ হাসির বক্র আচরণে বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়ান।

‘আপনি… আপনাকে ঠিক…!’

‘চিনবে, উপরে উঠে এসো। এমন পচা মাছের দুর্গন্ধের মধ্যে কী বলবো?’

রাজীব ভদ্রমহিলাকে অনুসরণ করেন। তাঁরা মেছোবাজার থেকে একটু দূরে, প্রায় সব পাতা গাঢ় লাল হয়ে আসা এক কাঠবাদাম গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়।

বাণী হাসে।

‘পরে প্রবাল দ্বীপের ফুল… আছো কেমন?

‘প্রবাল দ্বীপের ফুল মানে?’ সহজ হতে পারে না রাজীব।

‘আপনি কী বলছেন… আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘প্রথমত, আপনি কথাটা উঠিয়ে তুমি বলো। আমরা একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন ফিশারিজ বিভাগে পড়েছি চার বছর… মনে পড়ছে?’

‘হ্যাঁ, এবার মনে পড়ছে… তাই তো… আই এম সরি… কতদিন আগেকার কথা!’

‘খুব বেশিদিনের কথা নয়। সাত-আট বছর হবে।’

‘তাই-ই-বা কম কী? কিন্তু প্রবাল দ্বীপের ফুল – এমন অদ্ভুত একটা সম্বোধন…!

হাসেন বাণী।

‘আমরা সাত-আটটা মেয়ে এক ক্লাসে পড়তাম। তাও আবার চার বছর। ক্লাসের অন্য ছেলেরা তো আমাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো, কোনো উছিলায় কথা বলার জন্য। কোনো সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য। শুধু তুমি ছাড়া… তুমি কী যে এক আপন ভুবনে বিচরণ করতে, আমরা একেবারেই তা আন্দাজ করতে পারতাম না। তাই না আমরা মেয়েরা তোমার এই নাম দিয়েছিলাম। ঊর্বশী খান তো তোমার জন্য একেবারে পাগল ছিল।’

‘কে, ওই যে খুব বড়লোকের মেয়েটা… গাড়িতে আসতো?

‘হ্যাঁ। তোমার মনে আছে দেখছি।’

‘একেবারেই মনে থাকবে না, তা কেমন করে হয়।’

‘তাহলে নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে হয়তো, বার্ষিক বিজ্ঞানমেলা প্রতিযোগিতায় তোমার-আমার যৌথ প্রজেক্ট                ‘সি-অ্যাকুয়ারিয়াম’ বেস্ট প্রজেক্টের ট্রফি পেয়েছিল। প্রজেক্ট পরিকল্পনাটা ছিল তোমার। তুমি আমাকে কো-ওয়ার্কার করে নিয়েছিলে। এই নিয়ে ঊর্বশীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। আমি তার হয়ে তোমাকে সুপারিশও করেছিলাম তাকে নিতে। তুমি রাজি হওনি… কারণ, সে মনোযোগী ছাত্রী ছিল না। সুতরাং তুমি ছিলে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরের জগতের এক মানুষ। তাই আমরা আমাদের মধ্যে তোমার নাম দিয়েছিলাম, প্রবাল দ্বীপের ফুল! যা ছিল আমাদের জন্য দুর্লভ।’ রাজীব হাসে।

‘আশ্চর্য… এটা কেমন করে হয়! আসলে আমার অবস্থা তখন অনেকটা তেমনই ছিল। ডিপ ওয়াটার ডাইভার – ডিপ ওয়াটার ফটোগ্রাফার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম সব সময়।’

‘এখন এখানে কী করছো?’

‘তাই করছি। মেলবোর্ন মেরিন সায়েন্স অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং নিয়েছি। ডুবুরি সেজে চষে বেড়িয়েছি সাগরের গভীর তলদেশ। কী যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সেসবের! না দেখলে…। বাকি… তোমার পুরো নামটা হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল।’

‘বলো তো দেখি?’

‘বাণী মমতাজ।’

উৎফুল্ল হয়ে বাণী রাজীবের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে চমকে উঠে।

‘একি… তোমার হাতে ওটা কী?’

‘ওহ্হো।’ হেসে ফেলে রাজীব।

‘মাছের স্তূপে দুটো বেবি হেমার হেড সার্ক পেয়েছিলাম। এগুলো দিন দিন কমছে। এভাবে এই শিশু মাছগুলো নির্বিচারে মারতে থাকলে এগুলো অচিরেই বিপন্ন প্রাণীর লিস্টে চলে যাবে।… পরে বিলুপ্ত প্রানীর তালিকায় যেতেও তেমন সময় লাগবে না।

বাণী কৌতূহলী হয়।

‘তাহলে তুমি সেই প্রবাল দ্বীপেই আছ।’

‘অনেকটা তাই বলতে পারো। একটা মাৎস্য জাদুঘর গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। একটু দূরে বালতি-ব্যাগ-হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আলীকে ডাকেন রাজীব। ‘নে… তুই কালেকশনটা দেখ। ও আমার হেলপার। অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব মেরিন সায়েন্সের প্রজেক্ট ওয়ার্ক করছি। গত দুবছর থেকে। স্থানীয় মেরিন ফিশারিজ অ্যাকাডেমি আমাকে সহায়তা দিচ্ছে।’

চাপকলে হাত-মুখ ধূয়ে লজ্জিত হয় রাজীব।

‘কী যে অভদ্র আমি। অনেক কিছুই ভুলে যাই। এতদিন পরে দেখা… তোমাকে গাছতলায় দাঁড় করিয়ে বলে যাচ্ছি আমার কথা। একটানা…। তোমার কিছুই তো জানা হলো না।’

‘আমার কথা আর কী শুনবে? আমি তো গবেষক নই।’

‘সবাইকে গবেষক হতে হবে? নাস্তা খেয়েছ?’

‘কোথায় খাবে? এখানকার পচা মাছ আর শুঁটকির সুগন্ধির মধ্যে…।’

‘নাহ্… ওই যে দেখছ টিনের ছাপরা… সামনে সাইনবোর্ড – হোটেল নোনতা, আমি প্রায় সময় ওখানে খাই।’

‘চলো, তুমি যখন খাও…’

‘নোনতা হোটেলের খাস্তা পরোটা আর লাবড়া ভালো লাগবে। সঙ্গে ডিম মমলেট। সকাল সকাল নাস্তা খেয়ে নিতে পারলে সারাদিন আর আমার খেতে হয় না। নিশ্চিন্তে কাজ করে যাই।’

‘সারাদিন খাও না? খেতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হয়। আমার অবস্থাটা তোমার একেবারে উল্টো।’

‘কী রকম?’

‘এই ধরো, সারাদিন কোনো কাজ নেই। না ঢাকায়, না এখানে। সুতরাং সবরকমের হোটেল চষে বেড়াই। নিত্যনতুন খাবার খুঁজি। শাড়ি-গহনার দোকানে ঘুরি। দিন কাটে না।’

‘তোমরা দুজনই বুঝি ভোজনরসিক?’

‘তা ঠিক নয়।’

ততক্ষণে তারা হোটেল নোনতার সামনে এসে গেছে। তেজি সূর্য দাপিয়ে উঠছে। জেলে, মাছ-বিক্রেতা-পাইকারদের নিলাম, মাছ বিক্রির হাঁকাহাঁকি-হইহট্টগোলে সরগরম হয়ে উঠেছে ফিশারিজ ঘাট।

হোটেলের বয়-বেয়ারা রাজীব-বাণীকে দেখামাত্র তৎপর হয়ে ওঠে। লোক উঠিয়ে ভালো টেবিল সাজিয়ে, প্লেট-গ্লাস-চামচ গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ঝটপট গোছগাছ করে দিতে না দিতে তাদের কাছে জনাদুই বয়-বেয়ারা দাঁড়িয়ে যায়।

‘আইয়েন স্যার… আইয়েন…।’

‘দেখো, আজ নতুন মেহমান এনেছি। ঢাকার অতিথি। বেয়ারা বিনম্র হয়ে সালাম জানায় বাণীকে। বাণী হাসে।’

‘ফিশারিজ ঘাট দেখছি তোমার দখলে।’

‘অনেকটা তাই। প্রতিদিন আসি কিনা…।’

‘আচ্ছা ভালো কথা, তোমার আসল কথাই তো জানা হলো না।’

‘আসল আর নকল কথাটা কী আবার?’

‘আসল কথা হলো, ঘর-সংসার – তোমার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে কোথায় কেমন? জানাবে না আমাকে?’

হো-হো করে হাসে রাজীব।

‘তাই বলো… সেই আসল কাজটা যে করা হয়নি। সময় পাইনি। এর সুবিধা হলো, প্রজেক্টের কাজে যখন যেখানে যেতে হয়, পিঠে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে চলে যাই।’

একটু থেমে আবার বলেন রাজীব।

‘অবশ্য সুযোগ হলেই দেশে যাই। মাকে দেখে আসি। বাবা তো গেছেন অনেক আগে।’

 

গরম গরম মচমচে পরোটায় কামড় দিয়ে বাণী উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

‘সত্যিই তো বলেছ রাজীব। সো টেস্টফুল।’ আর তখনই পাজেরোতে বাণীর স্বামী খায়রুল এসে হাজির। তিনি বাণীকে এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে খুঁজতে থাকেন। বাণী, পরোটা-মমলেট খেতে খেতে হাসেন।

‘খুঁজুক না কিছুক্ষণ।’

‘কে?’ কৌতূহলী হন রাজীব।

বাণী গম্ভীর হয়ে থাকেন খানিকক্ষণ।

‘খায়রুল… আমার হাজব্যান্ড।’

‘ওহ্হো… আমি ডেকে নিয়ে আসি।’

আঙুলের ইশারায় খয়রুলকে দেখিয়ে দেয় বাণী।

রাজীব হাসতে হাসতে খয়রুলকে টেনে নিয়ে আসেন।

‘বাণী হারিয়ে যাননি… তিনি বহালতবিয়তে সুস্বাদু পরোটা খাচ্ছেন।’ বাণীর পাশের চেয়ারে বসতে বসতে খয়রুল বিতৃষ্ণ হন।

‘কিন্তু জায়গাটা যে বড় নোংরা… এখানে বসে বাণী তুমি কেমন করে খাচ্ছ। বাতাসে শুধু অাঁশটে কাঁচা মাছ আর শুঁটকির গন্ধ!’

বাণী খায়রুলের মন্তব্যে পাত্তা না দিয়ে চপ… চপ শব্দে মচমচে পরোটা চিবুতে চিবুতে তাঁকে বলেন,

‘একটু টেস্ট করবে?’

রাজীব বেয়ারাকে ডাকে।

‘আরো পরোটা দাও। গরম গরম।’

এর প্রতি কোনো উৎসাহ না দেখিয়ে খায়রুল বরং অনীহা প্রকাশ করেন।

‘থ্যাংকস… আমি এইমাত্র বন্ধুসহ হোটেল প্যারাডাইস থেকে ব্রেকফাস্ট করে এসেছি।’

রাজীব পুরো পরিস্থিতি খুব সহজভাবে নেয়।

‘হোটেল প্যারাডাইসটা জানি কোথায়?’

‘আপনি কতদিন ধরে কক্সবাজারে আছেন।’

‘প্রায় দুবছরের ওপর।’

সশব্দে হেসে ওঠেন খায়রুল।

‘এতদিন থেকে এখানে আছেন… কলাতলী যাননি?’

‘গেছি।’

‘এখানকার একমাত্র ফাইভস্টার হোটেল প্যারাডাইস তো সেখানেই। আপনি দেখেননি?’

‘হ্যাঁ দেখেছি। এখন মনে পড়ছে। গতবার ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন মেরিন ফিশারিজ অ্যান্ড ফিশারি প্রোডাক্টসের আয়োজন করেছিলাম সেখানে।’

তখন শান্তভাবে বাণী রাজীবকে খায়রুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

‘জানো, খায়রুল… রাজীব হাসান – আমরা একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। খুউব মেধাবী ছাত্র ছিল সে। অনেকদিন পর তার সঙ্গে দেখা। সে বিদেশ থেকে মেরিন-বায়োলজিতে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে এসেছে। এছাড়া ডিপওয়াটার ডাইভিংয়ের ওপর তার বিশেষ ট্রেনিং।’

বাণীর কথায় খায়রুল বিরক্তি প্রকাশ করেন।

‘ডিপওয়াটার ডাইভিং দিয়ে এখানে কী হবে?’

রাজীব কিছুটা অপ্রস্ত্তত হন।

‘মেরিন ফিশারিজের সন্ধানী জাহাজ যখন গভীর সাগরে যায়… আমিও যাই। সাগরের তলদেশে আমাদের যে কত সম্পদ, কত বৈচিত্র্য আছে তা দেখি ও সম্ভব হলে সংগ্রহ করি। ডিপ সি ফটোগ্রাফি করি।’

রাজীবের কথায় খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে খায়রুল উঠে দাঁড়ান।

‘আমি উঠি বাণী। আমার তিন নম্বর কন্সট্রাকশন সাইটে ঢাকা থেকে আর্কিটেক্ট আসবেন। প্লেন বোধকরি এসে গেছে।’

খায়রুল উঠে পা বাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ান।

‘ঘণ্টাখানেক পর গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। বাণী তোমার বন্ধুকে নিয়ে এসো। হোটেল প্যারাডাইসে লাঞ্চ খাওয়া যাবে।’

রাজীব কোনো ভনিতার আশ্রয় না নিয়ে সহজভাবে জানান,

‘দেখুন, কিছু মনে করবেন না, আমি যেসব সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করছি, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ফরমালিন-অ্যালকোহলে প্রিজার্ভ করতে প্রতিদিন আমার বিকেল হয়ে যায়। আমার আজ সময় হবে না। আর একদিন না হয়…। নিমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ।’

‘আচ্ছা দেখুন…।’

খায়রুল চলে গেলে বাণী আস্তেধীরে নাস্তা শেষ করে বেয়ারাকে ডাকেন।

‘ভালো করে দু-কাপ চা নিয়ে আসো।’

‘ম্যাম, পটে দেবো। আমাদের টি-সেটও আছে।’

‘দরকার হবে না। প্রতিদিন যেভাবে দাও…।’

বাণী চুপচাপ। অনেকটা সময় নিয়ে চা খান। তাঁর কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল না, তবুও বলতে হয় বলা।

খায়রুলের আচরণে তোমার মন খারাপ হয়নি তো।

‘খায়রুলকে কেমন মনে হলো তোমার?’

‘ভালোই। ধন-মান-বিত্ত-প্রতাপ – এসব জীবনে লাগেই তো।’

রাজীবের নির্মোহ বহিঃপ্রকাশে কিছুটা হতাশা হয়ে বাণী তাঁর চোখ বরাবর চেয়ে থেকে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন। ওড়নায় চোখ লোকান বাণী। কিছুটা সময় পার করে মুখ খোলেন বাণী।

‘বিয়েটা আমার হয়েছিল তাড়াহুড়োর মধ্যে। বাবা-মা দেখলেন, বিত্ত-বৈভব প্রতিষ্ঠা। সুখের সূত্র আমার কাছেও তখন তেমন জানা ছিল না। অাঁচলে চোখ মুছে বাণী বলে যান।

‘খায়রুল ঢাকার প্রতিষ্ঠিত বিল্ডার্স-ডেভেলপারের ছেলে। বাবা দূরদর্শী ব্যবসায়ী। ছেলেকে দিয়ে শাখা ব্যবসার সূত্রপাত করেন কক্সবাজারের সৈকত ভূমিতেও। তাঁদের তিন বন্ধুর ব্যবসার দুটো প্রজেক্ট বিক্রি হয়ে গেছে। এখন তৃতীয়টি চলছে। টাকা রাখার জায়গা নেই তাদের। খায়রুল আমাকে দিয়ে রেখেছিল অঢেল টাকা। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল, জীবনে টাকারও প্রয়োজন আছে। এখন মনে হয় অন্যরকম।’

রাজীব নীরব হয়ে বাণীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। কিছুটা চিন্তিত হয়ে। বাণী বলে যান,

সন্ধ্যা হলে বড় বড় হোটেল-বারে তাঁদের আড্ডা-আসর বসে। কখনো-কখনো বাড়িঘরেও। এসবে আমি সবসময় না পারলেও সঙ্গ দিতে হয়। রাত-কাবারে স্বামী-স্ত্রীর যান্ত্রিক রুটিনের অভ্যাসের অবসান হলে সে নাক-ডাকিয়ে ঘুমায়। সময় সময় নিজের পুরুষের কাছে ভালোবাসা অনুসন্ধান করতাম। তখন বুঝতে পারলাম, যেখানে যে-জিনিসের অস্তিতব একেবারে নেই, সেই জিনিস খোঁজার অর্থও নেই।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বাণী আরো বলে যান,

‘ছোট জায়গায় টাকার প্রভাব আর ভোগ্যবস্ত্তর সমাগম আরো বেশি। খায়রুলদের নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে সুন্দরী স্বাস্থ্যোজ্জ্বল মগ-মেয়েদের জোগানের ব্যবস্থা হয়। সেটা আমার চোখে পড়লেও না দেখার ভান করি। মদ্যপানের আসরগুলো ভাড়াটে মগ-মেয়েরা আলোকিত করে রাখে। তখন আমার অস্তিত্ব আমি নিজেই খুঁজে পাই না।’

খায়রুলের পাজেরো গাড়ি চলে আসে। বাণী চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়েন। রাজীবের চোখের ওপর চোখ রেখে বাণী ক্ষানিকক্ষণ চেয়ে থেকে নিদারুণ কষ্ট চেপে বাণী বলেন,

‘একটা কথা বলবো, রাখবে?’

‘বলো।’

‘তোমার এই অনুসন্ধানী গবেষণা-কাজের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে নাও। আমি তোমার মতো যদি কাজে একাত্ম হয়ে যেতে পারতাম?’

‘পারবে? আমি তো অসুবিধার কিছু দেখি না। যখন কক্সবাজার আসবে, আমার খোঁজ করবে। আমারও সাহায্য হবে।’

‘এলে নয়… কক্সবাজারেই থাকবো আমি।’

‘তোমার সংসার?’

আমি সংসার ছেড়েই আসবো।… তোমার কাছে।’

এটুকু বলতে পেরে বাণী দুহাতে চোখ চেপে হু-হু করে কেঁদে ফেলেন আবার। এক সময় চোখ মুছে ধীরপায়ে গাড়িতে গিয়ে বসেন বাণী।

 

রাত গভীর হতে থাকে। রাজীবের চোখে ঘুম নেই। তিনি ফিশারিজ বাংলোর সাগরমুখী বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আজ তিনি স্মৃতিকাতর, যন্ত্রণাকাতর। বাণীর জন্য তার কষ্ট হতে থাকে। হঠাৎ করে রাজীব দেখেন, সৈকত-বালুতে শেষ জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আলোর আভায় একটা নারীমূর্তি দৌড়ে সাগরজলের দিকে ছুটে চলেছে। তার শাড়ি আলগা হয়ে হয়ে পেছনে লুটাচ্ছে।

রাজীব দৌড় দিয়ে ঘর থেকে শক্তিশালী বায়নোকুলার এনে দেখেন, এই নারীমূর্তি বাণী ছাড়া আর কেউ নয়। দেরি নয়, এক দৌড়ে রাজীব তাঁর ডুবুরির জ্যাকেটটা গায়ে চড়াতে চড়াতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেন। আর গলা ফাটিয়ে বলতে থাকেন ‘বাণী থামো… আর এগুয়ো না।… সাগরজলে ভাটির টান।’

ছুটতে ছুটতে রাজীব সাগরজলের ভাটির টানের মধ্যে গিয়ে বাণীর হাত ধরে ফেলছিলেন প্রায়। সামান্যের জন্য তাঁর হাতটা ফসকে তলিয়ে গেলো। এক পলকে।