বরিশালের সন্তান জীবনানন্দ দাশ ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরের বছর ১৯৩০ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি কালের মধ্যে কোনো এক সময় ঢাকা শহরে এসেছিলেন বিয়ের পাত্রী দেখতে। তিনি তখন দিল্লির রামযশ কলেজের শিক্ষক। আজকে ঢাকার যে-অংশটি পুরান ঢাকা নামে পরিচিত, সেখানেই ব্রাহ্ম সমাজের তৎকালীন নেতা অমৃতলাল গুপ্তের ভাইঝি লাবণ্য গুপ্তকে দেখতে এসে পছন্দ করেন এবং তারপর পুনরায় যখন লাবণ্যকে বিয়ে করার জন্য জীবনানন্দ ঢাকায় আসেন, তখন তিনি বেকার। অর্থাৎ বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে তুলেছেন একজন ‘বেকার কবি’। ফলে আমরা দেখব এর পরবর্তী দুই যুগ (১৯৫৪ পর্যন্ত) এই দম্পতির জীবনে অশান্তি, টানাপড়েন – যার ছাপ রয়েছে। পড়েছে জীবনানন্দের ডায়েরি তো বটেই, তাঁর আত্মজীবনীনির্ভর গল্প ও উপন্যাসের পাতায় পাতায়। নামের সঙ্গে ‘আনন্দ’ থাকলেও ৫৫ বছরের জীবনে যিনি আভিধানিক অর্থে আনন্দের দেখা পাননি। তাহলে এবার তাঁর সাংসারিক অশান্তি বা টানাপড়েনের সঙ্গে সম্পর্কিত ঢাকার স্থানগুলি খুঁজে বের করা যাক। তার আগে জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী লাবণ্য সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা দরকার।
লাবণ্যের জন্ম ১৯০৯ সালে। বাবা রোহিণীকুমার গুপ্ত ছিলেন খুলনার বৈদ্যপ্রধান অঞ্চল সেনহাটির কুলীন বৈদ্য সন্তান। আর মা যশোর জেলার ইতিনা গ্রামের তারাপ্রসন্ন সেনের একমাত্র মেয়ে সরযু গুপ্ত। শৈশবে তিন মাসের ব্যবধানে বাবা-মা দুজনকেই হারান লাবণ্য। এর পর তাঁর দায়িত্ব নেন অকৃতদার জেঠামশাই অমৃতলাল গুপ্ত। তিনি তখন ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গিরিডিতে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক। সেখানে গিরিডি উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ের বোর্ডিংয়ে থাকতেন লাবণ্য। স্কুলটি তখন পাটনা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৩০ সালে লাবণ্য এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এ সময় অমৃতলাল গুপ্ত গিরিডি থেকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক হিসেবে ঢাকায় বদলি হলে লাবণ্যও তাঁর সঙ্গে ঢাকায় এসে ইডেন কলেজে আই.এ ক্লাসে ভর্তি হন। আই.এ পড়ার সময় জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। (গোপালচন্দ্র রায়, জীবনানন্দ, সুবর্ণরেখা/ ১৯৯৮, পৃ ২৯)।
ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক হওয়ায় জীবনানন্দের বাবা-মা সত্যানন্দ দাশ এবং কুসুমকুমারী দাশকে চিনতেন অমৃতলাল গুপ্ত। তিনি তাঁদের প্রভাষক ছেলের সঙ্গে তাঁর ভাইঝির বিয়ের প্রস্তাব দেন। সত্যানন্দ দাশ এবং কুসুমকুমারী দাশ এতে সম্মত হন এবং ছেলেকে দিল্লি থেকে ডেকে পাঠান।
লাবণ্য লিখেছেন : ‘পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে আমি তখন সবেমাত্র ঢাকা ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছি। হস্টেলে থাকি। হঠাৎ একদিন সকালে শুনলাম জেঠামশাই বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন। … জেঠামশাই দোতলা থেকে হাঁক দিয়ে বললেন, মা লাবণ্য, কয়েকখানা লুচি নিয়ে এস তো! দিদি লুচির পাত্রটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়েই হাসি চাপতে দূরে সরে গেল। আমিও সেটা নিয়ে দুম্দাম শব্দ করতে করতে উপরে চলে গেলাম। জেঠামশাইকে ঝাঁঝের সঙ্গে কি একটা বলতে যাব, তাকিয়ে দেখি সেখানে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়েই তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলেন। জেঠামশাই আমাকে বললেন, এই যে মা, এস আলাপ করিয়ে দি। এর নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। দিল্লী থেকে এসেছেন।’ (লাবণ্য দাশ, মানুষ জীবনানন্দ, ভাষাচিত্র/ ২০১৫, পৃ ২১)।
তার মানে জীবনানন্দ যখন লাবণ্যকে দেখতে ঢাকায় আসেন, তিনি তখনো দিল্লির রামযশ কলেজের শিক্ষক। আর যেহেতু গোপালচন্দ্র রায় জানাচ্ছেন যে, লাবণ্য ১৯৩০ সালে তাঁর জেঠার সঙ্গে ঢাকায় আসেন, তার মানে ১৯৩০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যেই কোনো এক সময়ে হয়তো জীবনানন্দ ঢাকায় এসেছিলেন লাবণ্যকে দেখতে। বিয়ে হয় তার কয়েক মাসের মধ্যেই, ওই বছরের ৯ই মে। ততদিনে জীবনানন্দের চাকরিটা নেই। কেননা বিয়ে করার জন্য দিল্লি থেকে বরিশালে গিয়ে আর সেখানে ফেরেননি। দিল্লিতে অবস্থানের বিবরণসংবলিত জীবনানন্দের ডায়েরি বিশ্লেষণ করে ভূমেন্দ্র গুহ জানাচ্ছেন, জীবনানন্দ ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরের বছর ১৯৩০ সালের মার্চ পর্যন্ত ছয়-সাত মাস রামযশ কলেজে চাকরি করেছেন। (বিষয়মুখ, জানুয়ারি-জুন ২০০১, পৃ ৮৮)।
দিল্লির এই কলেজটি নানা কারণেই জীবনানন্দের সঙ্গে মানানসই ছিল না। প্রথমত এটি বাংলার বাইরে, দ্বিতীয়ত কলেজের পরিবেশ, কাজের চাপ এবং সর্বোপরি সহকর্মীদের আচরণ – সব মিলিয়ে এই কলেজে তাঁর অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। ফলে শেষমেশ চাকরিটা যদি স্থায়ী হতোও, তাও তিনি এই পরিবেশে কতক্ষণ নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তা সত্ত্বেও বিয়ের আগ মুহূর্তে বা বিয়ের অব্যবহিত পরেই যাতে বেকারত্বের ঘানি টানতে না হয়, সেজন্য জীবিকার তাগিদে অন্তত এই চাকরিটা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তার ওপর খুব সন্তুষ্ট ছিল না। সবকিছু দেখেশুনে জীবনানন্দ নিজেও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, এখানে তাঁর চাকরিটা স্থায়ী হচ্ছে না। ফলে শেষের পনেরো দিন চাকরিটা করেছেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে। আবার এই শেষের পনেরো দিনের বেতনও পাননি। অর্থাৎ একরকম অসম্মান নিয়েই এখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে হয় প্রিয় মাতৃভূমি বরিশালে এবং ওই বেকারত্বের কালেই তিনি লাবণ্যের সঙ্গে বসে যান বিয়ের পিঁড়িতে। জীবনানন্দের বয়স তখন ৩১, আর লাবণ্যের ২১। দুজনের বয়সের ব্যবধান ১০ বছর। জীবনানন্দের মৃত্যু হয় ১৯৫৪ সালে। লাবণ্য এরপরে বেঁচেছিলেন আরো ২০ বছর। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৪ সালের ২৪শে এপ্রিল।
দিল্লির রামযশ কলেজের ইংরেজির শিক্ষক, বাবা সত্যানন্দ দাশ বরিশালের নামকরা শিক্ষক এবং ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব – এইসব পরিচয়ের কারণেই সম্ভবত লাবণ্যের পরিবার বিয়েতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু যখন জীবনানন্দ বিয়ের পিঁড়িতে বসেন, তখন তিনি বেকার। ফলে এই ঘটনাটি লাবণ্য এবং তাঁর আত্মীয়-স্বজনের মনে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল, সে-প্রশ্নের উত্তর এখন আর জানার সুযোগ নেই। লাবণ্যও এ-বিষয়ে তাঁর মানুষ জীবনানন্দ বইয়ে কিছু লেখেননি।
১৯৩০ সালের ৯ই মে শুক্রবার ২৬শে বৈশাখ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ, শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে বিয়ে হয় জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্য গুপ্তের। ব্রাহ্মমতে তাঁদের বিয়ে হয় ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। বিয়ের আচার্য ছিলেন জীবনানন্দের পিসেমশাই মনমোহন চক্রবর্তী।
যদ্দুর জানা যায়, বিয়েতে লাবণ্যকে ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় থেকে কেনা একটি গোলাপি বেনারসি শাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছিল। আর বিয়ের খাবারে ছিল কালাচাঁদ গন্ধবণিকের পরানহরা, মাওয়ার চোসি এবং জীবনানন্দের অতিপ্রিয় সিদ্ধ ডিম।
বিয়ের পরে ঢাকা থেকে নৌপথে (স্টিমারে) তাঁরা বরিশালে যান। বিয়ে হয়েছিল যে ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে, তার অদূরেই ঢাকা সদরঘাট, অর্থাৎ যেখান থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন রুটের লঞ্চ ও স্টিমার ছেড়ে যায়। বিয়ের চারদিন পর ৩১শে বৈশাখ বরিশালে জীবনানন্দের পারিবারিক বাসগৃহ সর্বানন্দ ভবনে হয় বউভাত ও বিশেষ উপাসনা।
জীবনানন্দ ও লাবণ্যের বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জীবনানন্দের ‘আবিষ্কারক’ বুদ্ধদেব বসু (৩০শে নভেম্বর ১৯০৯-১৮ই মার্চ ১৯৭৪)। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং প্রগতি পত্রিকার সম্পাদক – যে-পত্রিকায় জীবনানন্দের কবিতা ছাপা হতো। বুদ্ধদেব লিখেছেন : ‘জীবনানন্দকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ঢাকায়, তাঁর বিবাহ-সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলাম ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজে।’
কেমন ছিল ওই সময়ের ঢাকা শহর, বিশেষ করে জীবনানন্দের বিয়ে হয়েছে যে-সদরঘাট এলাকায়, তাও জানাচ্ছেন বুদ্ধদেব : ‘রায় কোম্পানির মুখোমুখি একটা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার যা খোলা থাকে নিশুতি রাত পর্যন্ত, পাশে ছদ্মবেশে পরিরা খেতে এসে ফিরে যায় – আমি তার পাশ দিয়ে কখনো ঢুকি মালীটোলায়, যদি আমার গন্তব্য হয় আর্মানিটোলায় আমার পিতার বা কোনো বন্ধুর বাড়ি; আর বেশিরভাগ দিন সোজা এগিয়ে যাই সদরঘাট পর্যন্ত – সন্ধ্যা নামে ততক্ষণে, রাস্তায় ভিড়, শুধু পুরুষের ভিড় – রমনায় ও অন্য দু-একটি বিশেষ এলাকায় ছাড়া ভদ্র মেয়েরা পায়ে হেঁটে রাস্তায় বেরোন না। পাঁচ দিক থেকে পাঁচটি রাস্তা এসে মিলেছে ওখানে, এক মিনিট দূরে বুড়িগঙ্গা, করোনেশন পার্ক – ঢাকার নাগরিক কেন্দ্র বলতে এই সদরঘাটকেই বোঝায়। সারা শহরের মধ্যে শুধু এখানেই আছে ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন। কাছাকাছি অনেকগুলো স্কুল-কলেজ
আপিস-কাচারি, এক কোণে বড়-পোস্টাপিশটির কালচে-লাল অবয়ব অস্পষ্ট দেখা যায়, ঢাকার দ্বিতীয় এবং উজ্জ্বলতর সিনেমাভবনটি খোলার পর থেকে জায়গাটার জৌলুশ আরো বেড়েছে। তিন পা হাঁটলে ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরি।’ (বুদ্ধদেব বসু, আত্মজৈবনিক, বাতিঘর/ ২০১৮, পৃ ৮৭)
১৯৫১ সালে প্রকাশিত বঙ্গবিহারী করের লেখা পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্তর বরাতে সাংবাদিক কাজী আলিম-উজ-জামান (প্রথম আলো, ২৫শে জুন ২০২১) জানাচ্ছেন, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে রামমোহন রায় লাইব্রেরি ও পাঠগৃহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অভয় চন্দ্র দাশ, ১৮৬৯ সালে। ব্রাহ্মমন্দিরের দোতলার একটি কক্ষে পাঠাগারটির সূচনা করেন তিনি। যদিও এই ভবনের গায়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সালটি লেখা রয়েছে ‘১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি’।
প্রতি রোববার এখানে প্রার্থনা হয়। খ্রিষ্টানরাও রোববার প্রার্থনা করেন। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার পেছনে খ্রিষ্টানদের যে প্রভাব ছিল, রোববারের প্রার্থনা তার প্রমাণ বলে মনে করা হয়। তবে প্রশাসনিক কারণও ছিল। সাপ্তাহিক ছুটি রোববার হওয়ায় ওইদিন জমায়েত ও প্রার্থনার দিন নির্ধারিত হয়। শুধু শিক্ষিত ও উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই যেহেতু ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হয়েছিলেন, ফলে তাঁদের সুবিধার্থে প্রার্থনার দিন ঠিক করা হয় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে।
ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরি এবং উপসনাগৃহটি এখনো আছে। এটি পুরান ঢাকায় অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে সদরঘাটে যাওয়ার পথে হাতের ডানে পাটুয়াটুলী রোডে ঢুকে একটু হাঁটলেই ডান দিকে ৩নং লয়াল স্ট্রিটে কমলা রঙের সুন্দর ভবন। সামনের খোলা জায়গায় অনেক গাছপালা। একটি পুরনো ভবনের সাইনবোর্ডে লেখা : বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজ, নিরাকার একেশ্বরবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়। প্রতিষ্ঠা ১৮৬৯।
বর্তমানে এই মন্দিরে ১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ নিবন্ধন আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী বিয়ে পড়ানোর দায়িত্বে আছেন চন্দনা দে তপাদার। তাঁর পদবি বিশেষ বিবাহ নিবন্ধক। তিনিও জানেন, এই মন্দিরেই ১৯৩০ সালে কবি জীবনানন্দ দাশের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তার কোনো প্রমাণপত্র নেই। কারণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো লাইব্রেরি ধ্বংস করা হয়েছিল। ফলে অতীতের কোনো রেকর্ড, ডকুমেন্ট বা কাগজপত্র নেই। চন্দনা জানান, এই বিশেষ আইনে এই মন্দিরে বছরে শ’দুয়েক বিয়ে হয়।
জীবনানন্দ-গবেষক গৌতম মিত্র জানান, অনেক চেষ্টা করেও তিনি জীবনানন্দ দাশের বিয়ের কার্ড সংগ্রহ করতে পারেননি। ব্রাহ্মমতে বিয়ে কীভাবে হয় তা জানার খুব কৌতূহল ছিল তাঁর। জীবনানন্দ দাশের বিয়ের ১৮ বছর আগের একটি বিয়ের কার্ড তিনি সংগ্রহ করতে পারেন। ১৯১২ সালে অনুষ্ঠিত বিয়েটা ছিল জীবনানন্দ দাশের দিদি অমিয়াবালা দাশের। জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশের দাদা হরিচরণ ও বউদি সুশীলা বালার মেয়ে এই অমিয়া। বরিশালের সর্বানন্দ ভবনে এই বিয়েটাও হয় জীবনানন্দ দাশের মতো ব্রাহ্মমতে। বিয়ের আচার্য ছিলেন জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ। আট পৃষ্ঠার এই বিয়ের কার্ডে বিস্তারিতভাবে লেখা আছে কোন মন্ত্র, কোন গান, কোন উচ্চারণ ও কোন নিয়মে এই বিয়ে সম্পন্ন হবে। আন্দাজ করা যায়, জীবনানন্দ দাশের বিয়ের কার্ডটিও এমনই ছিল। কার্ডে উল্লিখিত বিয়ের নিয়মটা এরকম : প্রথমে একটি সংগীত হবে : ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দ ধারা’। শেষে আরেকটি গান : ‘যে প্রেমের পথ গেছে অমৃত-সদনে, সে প্রেম দেখায়ে দাও পথিক দুজনে।’ এরকম চমৎকার বিয়ের আয়োজনে অভিভূত গৌতম মিত্রের প্রশ্ন, ‘১০৮ বছরে আমরা এগোলাম না পিছিয়ে পড়লাম?’
বাংলাদেশের ‘প্রধান কবি’ হিসেবে পরিচিত শামসুর রাহমান বড় হয়েছেন পুরান ঢাকার মাহুৎটুলী এলাকায়। তাঁর ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ কবিতায়ও আছে কালাচাঁদ গন্ধবণিকের মিষ্টির প্রসঙ্গ :
হঠাৎ দেখি, চক্ষু টেপে
গন্ধবণিক কালাচাঁদের, মিষ্টি মিষ্টি
হ্রস্ব পরী।
একসময় পুরান ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিল কালাচাঁদ গন্ধবণিক, মরণচাঁদ ও সীতারাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও ঢাকার স্মৃতিকথায় কালাচাঁদের মিষ্টির প্রসঙ্গ আনতে ভুল করেননি। তিনি লিখেছেন : ‘মিষ্টির প্রসিদ্ধ দুই দোকান, কালাচাঁদ গন্ধবণিক ও সীতারাম গন্ধবণিক, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে সদরঘাটে যাবার এক প্রবেশ পথের কাছে। জুতার দোকান, খাবার রেস্টুরেন্ট, রামমোহন লাইব্রেরি, নর্থব্রুক হল লাইব্রেরি – সবাই সদরঘাটের অনুরাগী; আশপাশে অবস্থান।; (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘প্রাণ ছিল ঐ সদরঘাটেই’, দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ই আগস্ট ২০২১)।
ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মোহাম্মদ আজিমের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে ২০১৮ সালের ১১ই এপ্রিল দৈনিক কালের কণ্ঠে লেখা হয়েছে : একসময় ঢাকা শহরে পয়লা বৈশাখ ছিল মূলত মুসলমান ব্যবসায়ীদের উৎসব এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। উভয় ধর্মের ব্যবসায়ীরাই হালখাতা অনুষ্ঠান করত। ব্যবসায়ীরা ছোট বাচ্চাদের ডেকে ডেকে মিষ্টি খাওয়াত। পাটুয়াটুলীর কালাচাঁদ গন্ধবণিক ও সীতারাম ভাণ্ডার, নবাবপুরের মরণচাঁদ, চকবাজারের আলাউদ্দিন সুইটমিট ও ফরাশগঞ্জের মিষ্টির দোকানগুলো নববর্ষের দু-তিন দিন আগে থেকেই রমরমা থাকত।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা এবং ঢাকার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক হাশেম সূফী জানান, কালাচাঁদ গন্ধবণিকের মিষ্টির দোকানটি তিনিও দেখেছন এবং তিনি ওই দোকানের গ্রাহক ছিলেন। এই দোকানের ‘পরানহরা’ ছিল খুবই সুস্বাদু। তাঁরা বলতেন ‘প্রাণহারা’। এছাড়া এই দোকানের মোহনভোগ ও কালোজামেরও প্রশংসা করেন তিনি, বলেছেন, ছোটবেলায় তিনি এখানে যেতেন মূলত সকালের নাশতা খাওয়ার জন্য। লুচি আর মোহনভোগ – যেটি বানানো হতো সুজি ও ঘি দিয়ে। ঢাকা শহরের মুসলমানদেরও অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই কালাচাঁদের মিষ্টির দোকান।
তিনি জানান, প্রাণহরা বা প্রাণহারা ছিল মূলত মিহি ছানা দিয়ে তৈরি গোলাকৃতির সাদা মিষ্টি – যা মুখে দিলে সঙ্গে সঙ্গে গলার ভেতরে চলে যেত। প্রাণহরা কি এখনো হয়? বললেন, অনেকে তৈরি করেন। কিন্তু শক্ত থাকে। কেননা এখন মিষ্টিতে ভেজাল। মিহি ছানার বদলে দেওয়া হয় চালের গুঁড়া ও ময়দা। ফলে শক্ত এবং আঠালো হয়ে যায়।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত – যাঁর শৈশব কেটেছে ঢাকায়, তিনি মনে করতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা রসিকতা করে বলতেন, ‘বাঙালদের সন্দেশের নাম প্রাণহারা – খেলেই অক্কা।’ তখন তিনি বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথের বাদল রাগিনী সজল নয়নে গাহিছে, পরানহরী। সে রাগিনী শুনলেই কি প্রাণহানি?’
ভবতোষ দত্ত শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে বলছেন : ‘একবার আমাদের বাড়িতে একটা ছোট অনুষ্ঠানের জন্য কাকা আমাকে আর জেঠতুতো দাদাকে পনেরো টাকার মিষ্টি আনতে বলেছিলেন। দোকানদার তো মহাখুশি। আমাদের সব মিষ্টির নমুনা খাওয়াবেই। শেষ পর্যন্ত পনেরো টাকা দিয়ে আধমণের বেশি সন্দেশ-রসগোল্লা-অমৃতি দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি বোঝাই করে বাড়ি ফিরলাম।’ (কাজল ঘোষ-সম্পাদিত স্মৃতির ঢাকা, নালন্দা/ ২০১৯, পৃ ২০২)।
প্রশ্ন হলো, কোথায় ছিল এই দোকানটি?
পাটুয়াটুলী সড়কের যে-জায়গাটিতে এখন বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ি, সেটি ছিল ঐতিহাসিক কোতোয়ালি থানা; ঢাকা শহরের প্রথম পুলিশ স্টেশন। কালাচাঁদের দোকানটি ছিল তার উল্টো দিকে। এখন সেখানে ‘শাহী বিরানী হাউজ’ এবং ‘কাশ্মীর বিরিয়ানী হাউজ’ নামে দুটি দোকান রয়েছে। প্রসঙ্গত, এই জায়গাটি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় এবং ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির থেকে হাঁটাপথ। হাশেম সূফী মনে করতে পারেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও দোকানটি ছিল। পরবর্তীতে এর মালিক ভারতে চলে যান।
ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় কি আছে?
হাশেম সূফী জানান, পাটুয়াটুলী রোডে তিনিও ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় দেখেছেন এবং একবার বড় ভাইয়ের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন মায়ের জন্য সুতির শাড়ি কিনতে। এর পাশেই আরেকটি দোকান ছিল – অমৃতা বস্ত্রালয়। দোকানটি ছিল পাটুয়াটুলীতে বেগম ক্লাব গেটের পশ্চিম দিকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও দোকানটি ছিল। তবে এখন সেখানে আধুনিক ভবন হয়ে গেছে। পাটুয়াটুলীর যে-জায়গায় ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় ছিল, সেখানে এখন ‘শ্রীশ্রী কালাচাঁদ জিউ বিগ্রহ এস্টেট’ লেখা একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। যে-দোকানে এখন দুবাই বোরকা বাজার, সেখানেই ছিল ঢাকেশ্বরী। তবে মিষ্টির দোকানি কালাচাঁদ আর এই কালাচাঁদ এক নন।
ঢাকার টিকাটুলী এলাকায় রাজধানী সুপার মার্কেটে এখন ‘আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়’ নামে যে দোকানটি আছে, তার মালিক সুকান্ত সাহা (জন্ম ১৯৬৭) জানান, পাটুয়াটুলীতে যে ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় ছিল, সেটির মালিক ছিলেন তাঁর জেঠামশাই নিতাই সাহা (মৃত্যু ১৯৭৮)। ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় ছিল এই সাহা পরিবারের পারিবারিক ব্যবসা। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পরে ১৯৬৪ সালে পাটুয়াটুলির ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং দোকানের মালিকরা কলকাতায় চলে যান। সেখানে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ‘আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়’ নামে একটি দোকান এখনো আছে। সেটি পরিচালনা করেন নিতাই সাহার নাতি সঞ্জয় কুমার সাহা। অর্থাৎ কলকাতার আদি ঢাকেশ্বরীর মালিক ঢাকার আদি ঢাকেশ্বরীর মালিকেরই আত্মীয়। সুকান্ত সাহা জানান, নারায়ণগঞ্জে একসময় ‘ঢাকেশ্বরী কটন মিল’ নামে একটি সুতার কারখানা ছিল। অনেকে সেই কারখানার মালিক ও ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের মালিক একই ব্যক্তি বলে মনে করেন। কিন্তু ঢাকেশ্বরী কটন মিল এবং ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের মালিক আলাদা।
ঢাকার ইডেন কলেজে আই.এ পড়ার সময় জীবনানন্দের সঙ্গে বিয়ে হয় লাবণ্যের। এখন ঢাকা শহরের আজিমপুর এলাকায় কলেজের যে-ক্যাম্পাস, লাবণ্যের সময়ে সেখানে ছিল না। তখন কলেজটি ছিল সদরঘাট এলাকায় পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের একটি বাণিজ্যিক ভবনে।
১৮৭৩ সালে ইডেনের যাত্রা শুরু হয়েছিল স্কুল হিসেবে। ১৯২৬ সালে কলেজ চালু হয়। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের উদ্যোগে কলেজটি আবদুল গণি রোডের একটি ভবনে স্থানান্তরিত হয়। ভবনটি পরে ‘ইডেন বিল্ডিং’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৪৭ সালে সরকার ইডেন বিল্ডিংয়ে নতুন প্রাদেশিক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলে কলেজটি কার্জন হলের একটি অংশে স্থানান্তরিত হয়। কলেজের সঙ্গে কামরুন্নেছা স্কুলকে একীভূত করার পরিকল্পনা অনুযায়ী কলেজটি আবার স্কুলচত্বরে স্থানান্তরিত হয়। অবশেষে ১৯৫৮ সালে ইডেন কলেজ ও কামরুন্নেছা স্কুলের কলেজ শাখা একীভূত হয়ে বকশিবাজারে ইডেন গার্লস কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৯৬২ সালে আজিমপুরে ইডেন কলেজের ক্যাম্পাস স্থানান্তর করা হয়। এখানেই ১৮ একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কলেজের নিজস্ব স্থাপনা। (‘ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইতিহাস ও বর্তমান’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৭শে জুন ২০১২)
ইডেন কলেজ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু তাঁর কৈশোরের স্মৃতি হাতড়ে লিখেছেন : ‘আমাদের হাঁটার জন্য একটি প্রিয় স্থান হলো ইডেন কলেজের পিছনকার রাস্তাটা – আলো কম সেখানে, লোক নেই, মহিলা-বিদ্যালয়ের উঁচু দেয়াল আর অনেক বেশি উঁচু এক সার গাছের জন্য কেমন গা-ছমছম-করা, রহস্যময় – হস্টেলের কল্পিত অধিবাসিনীদেরও মনে হয় যেন দুর্গবন্দিনী রাজকন্যা, অন্তত তখনকার মতো তা ধরে নিলে দোষ নেই।’
প্রসঙ্গত, লাবণ্য এবং বুদ্ধদেব প্রায় সমবয়সী এবং লাবণ্য যে-বছর মারা যান, বুদ্ধদেবেরও মৃত্যু হয় ওই বছরই।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.