মধ্যরাতে এরকম হয়, মধ্যরাতে জেগে ওঠে তনুজা, জেগে উঠে অন্ধকারের বিস্তারে নিজেকে হাতড়ে বেড়ায়। হাতড়াতে হাতড়াতে একসময় আর মনে করতে পারে না, আসলে সে কী খুঁজে পেতে চাইছে, এই মধ্যরাতে সেটা খুঁজে পাওয়ার দরকারই বা কী! একরাশ ক্লান্তি নিয়ে তখন থমকে বসে সে। আর জানালার পর্দাটা দুলে উঠলে অবশেষে কেন যেন মনে হয়, তৃষ্ণা – আসলে তার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। একসমুদ্র জল নাকি একআকাশ বৃষ্টি সে এখন গিলে ফেলতে পারবে অনায়াসে। অতএব তনুজা বিছানা থেকে উঠে পানি খায় ঢক ঢক করে। যদিও খুব বেশি খেতে পারে না। দেড় গ্লাস খাওয়ার পরেই পাকস্থলী কেমন ভরা-ভরা লাগে। আধবোজা চোখ নিয়ে বিছানায় ফিরে আসে সে। তারপর আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমাতে ঘুমাতে সে ভাবার চেষ্টা করে, এই ঘুমই কি চেয়েছিল সে কোনো এক শৈশবে! এই ঘুমের মোহেই কি বয়স ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে সে চিরঘুমের দিকে!
সকালে জেগে উঠে তনুজা এইসব আবারো ভাবে – শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একেবারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোনো দুশ্চিন্তা হয় না তার; আর শুধু দুশ্চিন্তা কেন, সত্যি কথা বলতে গেলে কোনো চিন্তাও জাগে না তার, কিন্তু কিছু একটা চিন্তা করতে চেয়েও না করার ব্যর্থতাটুকু অনুভব করে সে। বেশ ভালো করেই অনুভব করে। অথচ এই ব্যর্থতা নিয়েও তার তেমন কোনো চিন্তা জাগে না, দুশ্চিন্তাও জাগে না। রেকর্ডারে একটা ক্যাসেট ঢুকিয়ে বাটন অন করে সে পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্যে রওনা হয় ওয়াশরুমের দিকে। তখন সামান্য একটা কথা মনে পড়ে, ক্যাসেটের ফিতাগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ক্যাসেট আজকাল আর কেউই শোনে না। এমনকি সে নিজেও না। এখন ওই মোবাইল ফোনেই গান শোনা হয়। কিন্তু তবু সকালে এই ক্যাসেট-কাণ্ডটুকু না ঘটালে তার ভালো লাগে না, সারাদিন ভালো যায় না।
প্রাতরাশটা আগেও বাসায় করা হতো না, আর এখন তো সে উপায় একদমই নেই। তবু বাঁচোয়া, কয়েকদিন হলো মেসের কেউই বাসায় নেই।
একা-একা হিজিবিজি চিন্তা করে সময় পার করে দেওয়া যাচ্ছে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো অলসতাও নেই, কেবলই বিভোরতা এখন দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ধরে। তবে এখন তার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়া উচিত। একটু সূর্যের আলোয় হাঁটা উচিত। যদিও কোনখানে যাবে, সেটা ঠিক না করে বের হওয়াটাও বেশ বিপজ্জনক। কালকে যেমন, শিপ্রার অফিসে গিয়েছিল; কিন্তু যাওয়ার পর জানা গেল, সে নাকি সাভারে কোন কর্মশালায় গেছে। অবশ্য ক্ষীণ আশা ছিল, দুপুরের মধ্যেই তার ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও সে আর ফিরে এলো না। তা কতক্ষণ আর মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়! শেষ পর্যন্ত রিসিপশনিস্ট মেয়েটিকে সে বলতে বাধ্য হলো, ‘একবার ফোন করে দেখেন না।’
‘ম্যাডাম, আপনার মোবাইল থেকে রিং দেন না! মানে, বোঝেনই তো … সেটাই ভালো হয় না?’
তা ঠিক, না বোঝার কী আছে! কিন্তু তার আগে তো সেলফোনে টাকা ঢোকাতে হবে; ফোনে ব্যালান্স থাকলেই না সম্ভব কথা বলা! কী যে দিন এলো, এত দুঃখের মধ্যেও হাসি পায় তনুজার, ব্যালান্স নেই বললে মানুষ এখন ঠিকই বুঝে নেয়, সেলফোনে টাকা নেই, কথা বলতে পারছে না! অবশ্য পকেট ফাঁকা করার কায়দাকানুন কোম্পানিগুলি ভালো করেই জানে। ব্যালান্স না থাকলেও কথা বলিয়ে পকেট থেকে টাকা খসানোর বন্দোবস্ত করে রেখেছে তারা। কিন্তু সেটা আর কতটুকু করা যায়, কতক্ষণই বা করা যায়! যাকে বলে কোম্পানির কাছ থেকে লোন নিয়ে কথা বলা – সেই লোন নেওয়ারও উপায় নেই তনুজার হাতে এখন। আগের রাতে ওইভাবেই সে কথাবার্তা বলেছিল আহাদের সঙ্গে। এখন ফোনে টাকা ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটা হাওয়া হয়ে যাবে, নিপুণ যন্ত্রমহাজন টাকাপয়সা আদায় করে ছাড়বে সঙ্গে সঙ্গে। এমন অবস্থায় দু-চারটা ভদ্রস্থ টাকার নোট না মেলা পর্যন্ত মোবাইলে হাত দেওয়া ঠিক হবে না। আর এটাও তো ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে, ফিরে এলেও শিপ্রা এখন ব্যস্ত থাকবে ভীষণ রকম। যে-কথা বলার জন্যে তার এখানে আসা, সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে না। অতএব সে বেরিয়ে এসেছিল শিপ্রার অফিস থেকে।
বেরিয়ে আসতে আসতে নিজের ওপরেই রাগ চড়ছিল তনুজার – চাকরিটা এমন সময়ে গেল! অবশ্য এখন না গিয়ে অন্য কোনো সময়ে গেলেও তো একই রকম ভাবতে হতো তাকে! অতএব সে মন খারাপ না করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখন তাকে ভাবতে হচ্ছে, মন খারাপ করলেই বরং ভালো হতো, তখন মন খারাপ করে ফেললে মধ্যরাতে হয়তো আর এরকম হতো না, ঘুম ভেঙে যেত না, চিন্তা করতে করতে খেই হারাতে হতো না কিংবা ঢকঢক করে পানিও খেতে হতো না। তবে সেই পানি খাওয়ারই সুফল কি না কে জানে, ওয়াশরুমে পরিচ্ছন্ন হতে তেমন কসরত করতে হলো না তাকে। তাছাড়া মোবাইলের ব্যালান্স না থাকার সমস্যাটাও কেটে গিয়েছিল আগের রাতে। বাসায় ঢোকার আগে মনোহারি দোকানদার ডাক দিয়ে বলেছিল, ‘আপা সেদিন যে ৫০০ টাকা দিয়ে ভাঙতি নিতে পারলেন না, আর তো নিলেনই না।’ তাই তো, সে তো এখনো ১৬৮ টাকা পাবে! এইভাবে বেশ কয়েকটা টাকা হাতে চলে এলে সে ফোনে ৪২ টাকা ভরে ফেলেছিল। অথবা এমনও হতে পারে, মেজাজ ফুরফুরে করে দেওয়া এসব ঘটনা নয় – মাথার ওপর ঝুলে থাকা তিন-তিনটা ঝামেলাই তার মনোযোগ সরিয়ে রাখল অন্যদিকে। আর কোন ফাঁকে যে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো নিজেই বুঝতে পারল না।
তাহলে তিনটা – তিনটা,
তিন-তিনটা ঝামেলা চেপে বসে আছে মাথার ওপর! মাথার ওপর কিংবা কাঁধে। কিংবা ঘাড়ের ওপর – এরকমও বলা যায় ব্যাপারটাকে। কোথাও কোনো এক সাদা কাগজে মনে মনে সেই তিনটা ঝামেলাকে লিখে ফেলে তনুজা, যেগুলি তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সপ্তাহখানেক ধরে। প্রথম ঝামেলা, তার চাকরি চলে গেছে। অথচ তার আগের দিন সন্ধ্যায়ও তাদের বস তার কাজের প্রচুর প্রশংসা করেছেন; তাকে চনমনে করে তুলেছেন এই বলে যে, তার কাঁধে আরো কাজের দায়িত্ব চাপানো উচিত। দ্বিতীয় ঝামেলা, চাকরি চলে যাওয়ার কথাটা বলি বলি করেও আহাদকে বলা হয়নি, আর প্রথম চোটেই না বলার কারণে এখন সেটা বলার ইচ্ছে কিংবা শক্তি কোনোটাই খুঁজে পাচ্ছে না সে নিজের ভেতর। বাড়ির কাউকেও জানানো হয়নি কথাটা। তৃতীয় ঝামেলা, আগামী শুক্রবার দুপুরে তাকে লাঞ্চ করার জন্যে ‘দিবারাত্রির কাব্যে’ যেতে হবে। ছেলেটা বোধহয় একটু কবি-কবি স্বভাবের। না হলে কনে দেখার জন্যে এই নামের একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে নেবে কেন!
একটা-একটা করে সব ঝামেলাকে আবারো ভাবার চেষ্টা করে তনুজা। সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক আগে-আগে অফিসের প্রশাসন থেকে পিয়ন পাঠিয়ে তাকে চাকরিচ্যুতির চিঠিটা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে তখন টেবিলের ড্রয়ারটা লক করছে। সই দিয়ে চিঠিটা নিতে নিতে ভেবেছিল সে, হয়তো কোনো মিটিং আছে, হয়তো কোনো প্ল্যানিং এজেন্ডা নিয়ে কথা বলার অনুরোধ এসেছে। অফিস তখন বলতে গেলে ফাঁকা। চিঠিটা পড়ে সে চুপ করে বসে থাকার সুযোগও পায়নি বেশিক্ষণ, কেননা যেনবা হঠাৎ করেই একে একে আলো নিভতে শুরু করেছিল একেকটি টেবিল বরাবর সিলিংয়ে, একেকটি রুমে। সেদিনই প্রথম অনুভব করল সে, প্রতিদিন অফিসের আলো নিভে যায় এমন করে। কিন্তু সে-ই কোনোদিন তা ভালো করে চেয়ে দেখেনি।
তারপর কী আর করা, বাসায় সে চলে এসেছিল। আহাদ কল করলে তা রিসিভও করেছিল; কিন্তু বলি-বলি করেও এরকম একটা বড় ঘটনা আর আহাদকে বলা হলো না। বরং আহাদ যখন বলল, ‘তোমাকে আজ একটু আনমনা লাগছে’, তখন শশব্যস্ত হয়ে উঠেছিল নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে। হতে পারে, তখনো তার আস্থা ছিল, পরের দিন অফিসে গিয়ে বিষয়টা সামাল দিতে পারবে; হতে পারে, তখনো সে মনে করছিল, এ আর এমন কী ঘটনা – ঠিক এত ভালো অ্যাডফার্ম হয়তো পাবে না, যেটায় সন্ধ্যা ৬টার পর কোনো কাজই হয় না; কিন্তু কাজের মানুষ খুঁজছে, এরকম অ্যাডফার্মের কোনো অভাব নেই। অতএব আহাদকে ঘটনাটা বলা হলো না। এবং পরের দিনও না। আর এইভাবে আজ কয়েকদিন গড়িয়ে গেল, বলাই হলো না। অথচ আশ্চর্য, এর মধ্যে দুদিন তাদের দেখাও হয়েছে।
তাহলে সে কি আসলে একটু বিষণ্ন হয়ে পড়েছে? অথবা পলায়নপর? সমস্ত বিষণ্নতার তরঙ্গে সে এত বেশি দুলছে যে, কোনোটাই গায়ে লাগছে না!
সবচেয়ে বড় ঝামেলা হলো তৃতীয়টা। বাবা ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, ছেলের হাতে বেশি সময় নেই। মানে বিয়ে করার মতো সময় আছে, বিয়ের পর কিছুদিন থাকার মতো সময় আছে, কিন্তু পাত্রী দেখার জন্যে তেমন কোনো সময়ই নেই তার। বেশি দৌড়াদৌড়ি করাটাকেও সে নাকি ভালো মনে করছে না। অতএব একটা রেস্তোরাঁই সই। শুক্রবারের দিন বাবা-মা আসবে, তারা তনুজাকে নিয়ে ‘দিবারাত্রির কাব্যে’ যাবে, ছেলের মা আর মামা-মামিও আসবে ছেলের সঙ্গে, খেতে খেতে তারা একজন আরেকজনকে দেখে নেবে, কথাবার্তা বলবে, গল্পগুজব করবে,
খাওয়া-দাওয়া শেষে বাড়ি ফিরে যাবে, ডিনারের আগেই যে যার পছন্দ হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে পারবে। চাইলে দু-তিনদিন সময়ও নিতে পারে। বেশ পছন্দ হয়েছে তনুজার পাত্র-পাত্রী দেখার এই আয়োজন – কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই, আনুষ্ঠানিকতার ধুমধাড়াক্কা নেই, বোঝাপড়া তৈরির পিছুটান নেই; কিন্তু বাবা যে তাকে কোনো কিছু না জানিয়ে লাঞ্চের এই পরিকল্পনাটা করে ফেলেছে, সেটাই তার একদম মনে ধরছে না। ওদিকে বাবাকেও জানানো হয়নি, চাকরি চলে গেছে। জানলে অবশ্য বাবা হয়তো খুশিই হবে। কম-বেশি বেশিরভাগ পাত্রই চায়, পাত্রী বেকার থাকুক, বিয়ের পর তাহলে চাকরি ছেড়ে দেওয়ানোর ঝামেলাটা আর পোহাতে হয় না শ^শুরবাড়ির লোকজনকে; সেদিক থেকে ধরতে গেলে, চাকরি হারিয়ে পাত্রী হিসেবে তার যোগ্যতা এখন খানিকটা বেড়েছে। কিন্তু তবু বাবাকে কথাটা বলতে পারল না! তা বলতে পারুক বা না পারুক, লাঞ্চের তারিখ ঠিক করে ফেলার ব্যাপারটাও মেনে নিতে পারুক না পারুক, এখন বাবার মুখটা তো তাকে রক্ষা করতে হবে। আবার আহাদের দিকটাও তো তাকে দেখতে হবে, কোনো পাকাপোক্ত প্রতিশ্রুতির জায়গায় তারা যায়নি অবশ্য, কিন্তু যাওয়ার পথে তো আছে। প্রতিদিন বিকেলে তাদের আকাশটা সিঁদুররঙা হয়ে পড়ছে। কিন্তু বাবার কাছে সে-প্রসঙ্গ তোলার আগে আহাদের কী পরিকল্পনা, সেটা তো তাকে ভালো করে জানতে হবে। অথচ সেরকম ইঙ্গিতময় প্রসঙ্গের সূত্রপাত ঘটালেই আহাদ হাসতে হাসতে এমনসব কথা বলতে থাকে যে, পুরো প্রসঙ্গই চলে যায় অন্যদিকে। অবশ্য একদিন এরকম একটা লাঞ্চ করলে আহাদ হয়তো তেমন কিছু মনে করবে না; কিন্তু তার নিজের মনেই তো একটা শক্তপোক্ত দাগ পড়ে যাবে!
বাইরে বৃষ্টি ঝরছে এখন। কিন্তু তনুজাকে বেরুতেই হবে। আহাদের অফিস বেশ খানিকটা দূরেই বলতে হবে হাঁটা চোখে দেখতে গেলে। অন্তত পৌনে এক ঘণ্টা। কিন্তু সে হেঁটে হেঁটেই যাবে। মানে অন্য কোনো বিকল্প আপাতত যত কম ব্যবহার করা যাবে, ততই ভালো। কয়েকটা টাকা বাঁচল, একটু ক্যালোরিও খরচ হলো। অবশ্য শরীরে বাড়তি যা ক্যালোরি ছিল, সেটা এই কয়দিনে তার খরচ হয়ে যাওয়ার কথা। আজ সকালে নাস্তা করল দুটা টোস্ট আর এক কাপ চা। চাকরি যখন ছিল, তখনো অবশ্য সকালে সে এটুকুই পেটে তুলত, তবে এর সঙ্গে একটা ডিম আর শবরি কলাও যুক্ত হতো। তা কয়েকদিন ডিম-কলা না হয় রয়েসয়েই খাবে সে, চর্বি একটু
নিজে-নিজেই খরচ হতে শিখুক এই কয়েকটা দিন। আহাদের অফিসে গিয়ে সে এক কাপ চা খাবে ওর সঙ্গে, তার পর টাকা ধার চাইবে আর আহাদ যদি এরকম অফিসটাইমে সে উদয় হওয়াতে একটু অবাক হয়ে কিছু জানতে চায়, তাহলে বলবে, এখন সে পূর্ণ বেকার। ওই সুযোগে এটাও জানাবে, লাঞ্চ করার একটা আমন্ত্রণ পেয়েছে সে ক’দিন আগে বাবার কাছ থেকে, সেখানে যাওয়া তার ঠিক হবে কি না। একটা বড়সড় পরীক্ষাও হয়ে যাবে আহাদের; কেননা একদিনে এরকম তিন-তিনটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের মুখোমুখি হওয়া আর সামাল দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বেশ ভালো করেই বোঝা হয়ে যাবে তনুজার ভাবনার চৌহদ্দিতেও নেই এমন পরিস্থিতিতে আহাদের আচরণ কেমন হতে পারে। গত সাড়ে তিন বছরের একটা দিনও তনুজা একটা ফুটো পয়সা পর্যন্ত চায়নি ওর কাছে, এখনো হয়তো না চাইলে চলে, কিন্তু অফিসে হিসাব-নিকাশ করে টাকা পেতে নিশ্চয়ই বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে, আর এ-মাসের বেতনও ব্যাংকে বোধহয় ঢুকবে না। এরকম হবে জানলে সে কি আর এই গেল হপ্তায় ঝুমাকে পাঁচ হাজার টাকা কর্জ দিতে যেত! চাকরি করার সময় সে যে দু-চারজনকে ধারকর্জও দিতে পারত, সেটা ভেবে তার বেশ খানিকটা গর্বও জাগে মনে। অতএব দু-চারজনের কাছে এখন তো সে ধারকর্জ চাইতেই পারে। মুশকিল হলো, দু-চারবার তার এরকম মনে হয়েছে, ছেলেদের কাছ থেকে মেয়েদের টাকাপয়সা চাওয়ার বা নেওয়ার ঘটনায় যত অপরিহার্য পারিপাশির্র্^কতাই থাক না কেন, সেটাকে বোধহয় আহাদ খুব একটা সুবিধার বলে মনে করে না। ওর কাছে বোধহয় এটা ‘খসিয়ে নেওয়া’র মতো একটা কিছু। এটা মনে করতে করতে তনুজার গা হঠাৎ শিউরেও ওঠে – তাদের দুজনের সম্পর্কটা কি তাহলে দুমড়েমুচড়ে যাবে? লিফট দিয়ে না নেমে সিঁড়ি বেয়ে নামছিল সে, প্রতিটি সিঁড়ি-বারান্দাতেই লতানো মানিপ্ল্যাট না হয় ওরকমই একটা কিছু; কিন্তু হঠাৎ করেই সেসবকে খুব অসহ্য লাগে, নিজেকেও খুব রিক্ত লাগে। কিন্তু তারপরেই আবার কেমন যেন জ্বলে ওঠে ও, চাকরি গেছে, এবার না-হয় এই সম্পর্কটাও যাবে – কিন্তু আহাদের পরীক্ষাটা হয়ে যাক আজ। সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক – এখন কিছু টাকাপয়সা চাওয়াতে যদি ও ভাবতে পারে যে, তনুজা ওর কাছ থেকে খসাতে এসেছে, তাহলে আজ না হয় তনুজা ওকেই সারাজীবনের জন্যে খসিয়ে রেখে আসবে। এইরকম একটা ঝামেলা ঘাড়ের ওপর টেনে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না।
এই ভাবতে ভাবতে তনুজা সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে, একটা ফ্লোরে খুব একটা দামি কুকুরকেও দেখে, এটা বোধহয় সেই যে পিচ্চি ছেলেটা আছে – মুনসারাত না কী যে একটা অদ্ভুত নাম – সেই ছেলের বাপ-মায়ের আর কী। তা বেশ ছটফটে হলেও কেমন তুলতুলে কুকুরটা। তাই তাকে একটু ছোট করে টা-টাও দেয় তনুজা। যদিও মনে মনে এটা ভাবতেও ছাড়ে না, এইরকম সব বাপ-মা যারা চাকরিবাকরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের দাপটে সবসময় দৌড়ের ওপর থাকে, এতই লম্বা দৌড়ের ওপর থাকে যে, একজন আরেকজনকে আদর করারও সময় পায় না, ছেলেটাকে নিয়ে কোথাও বের হতে পারে না, আর ছেলেটাও কেমন দিনকে দিন একটা ভ্যাবলা ঠাকুর হয়ে যায় শুয়েবসে থাকতে থাকতে, তারা এত ব্যস্ততার মধ্যেও কুকুরের সঙ্গে একেবারে
ঠিক-ঠিক আদর-মহব্বত করার সময় বের করে নেয় কেমন করে! কিন্তু চিন্তাটা বেশিদূর এগোতে পারে না। তার আগেই মোবাইল ফোনটা বাজতে থাকে। আর সে একবার প্যান্টের পকেটে, আরেকবার ব্যাগের মধ্যে, ফের প্যান্টের পকেটে, এইভাবে শেষ পর্যন্ত সেটা খুঁজে পায় পকেটেই। কিন্তু ফোনটা ধরবে কি না, বুঝতে পারে না। একবার ভাবে, কী দরকার ধরার, সে তো আহাদের অফিসের দিকেই যাচ্ছে, একেবারে সেখানে গিয়েই না হয় বলবে, ‘ফোন করেছিলে, একেবারে নিজেই এসে হাজির হলাম।’ কিন্তু আরেকবার আবার মনে হয়, না জানি কী হয়েছে, এরকম যদি হয়, রাস্তার মধ্যে পড়ে আছে, কাতরাচ্ছে … ‘বালাই ষাট’, ‘বালাই ষাট’ বলতে বলতে সে এবার কলটা ধরেই ফেলে।
‘হ্যাঁ, আহাদ – ’
‘তনুজা, কথা বলা যাবে এখন?’
‘যাবে না মানে? শোনো, আমি নিজেই তো -’ বলতে গিয়েও থেমে যায় তনুজা। সে যে আহাদের অফিসের দিকে যাচ্ছিল, সেটা বলা না হয় আপাতত বাদ থাকুক। সচরাচর অফিস থেকে এরকম সময়ে ফোন করে না আহাদ। করলেও তা বিকেলের দিকে। আর তাতে এমন আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। ফোন ধরতে না ধরতেই বলে দেয় সে, ‘আমার অফিস তো আর মিনিটপাঁচেকের মধ্যে শেষ। তুমি বের হবে নাকি?’ একটু থেমে উত্তর শোনে সে, কখনো কখনো না শুনেই বলে দেয়, ‘তুমি তাইলে অফিস থেকে বের হয়ে সরোবরের ওখানে আসো।’ এখনো, কথা বলা যাবে শোনার সঙ্গে সঙ্গে আহাদ ওইরকম প্রগলভ হয়ে ওঠে, ‘বাঁচাইলা। আমি তো মনে করছিলাম, তুমি তো সেইরকম অফিসে কাজকর্ম করো, এরকম সময়ে ফোন করলেই কল ধইরা বলবা, হ্যাঁ, একটু তাড়াতাড়ি বলো, আমি একটু ব্যস্ত আছি।’ শেষের কথাগুলি আহাদ একটু মেয়েলি কণ্ঠে বলার চেষ্টা করে আর তা শুনতে শুনতে তনুজার মনে হয়, এইরকম একটা উচ্চুঙ্গা ফালতু ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক হলো কী করে! তাও ভাগ্য ভালো, এইটার সঙ্গে সে বিছানায় যায় নাই। নিজেকে সামলাতে তনুজা চুপচাপই থাকে আর আহাদও একটু দম নেয়, তার কণ্ঠ স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং সে ধীরে ধীরে বলে, ‘আসলে একটু জরুরি বলেই এ-সময়ে ফোন করলাম। হাজারবিশেক টাকা যদি ধার দিতে পারতে …’
হাজারবিশেক! তনুজার মাথা ঘুরে ওঠে, ‘ও রে চান্দু, এই টাকায় তো আমার মোটামুটি সারা মাস চলে যাবে!’ করুণ হাসি ঝরতে থাকে তার কণ্ঠস্বরে, ‘তুমি এমন সময়ে টাকা ধার চাইছ -’
‘না, না, এখনই না – আমি সন্ধ্যায় গিয়ে -’
এবার না বলে পারে না তনুজা। তার কণ্ঠস্বর ঝিকমিকিয়ে ওঠে, যেন সে এইমাত্র নতুন ভালো একটা চাকরি পেয়েছে, কিন্তু সে বলে, ‘আসলে তোমাকে বলা হয়নি, কয়দিন আগে আমার চাকরিটা চলে গেছে -’
নিচতলায় নেমে এসেছে তনুজা। আধো আলো আধো ছায়া খেলা করছে সারাটা তলা জুড়ে। কেয়ারটেকারের বাসার মধ্যে থেকে শিলনোড়ায় বাটনা বাটার শব্দ ভেসে আসছে আর গেটের একেবারে পাশে গার্ডরুমে সিকিউরিটি গার্ড ও ড্রাইভাররা কী নিয়ে যেন জটলা পাকাচ্ছে। আলাপটা ভালো করে সেরে নিতে তনুজা একেবারে কোণের দিকে রাখা গাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘কী! তোমার চাকরি চলে গেছে? বলো নাই ক্যান? তুমি আমাকে বলো নাই?’
বিস্ময় আর অবিশ^াস খেলা করছে আহাদের কণ্ঠস্বরে। তনুজা যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে বলে, ‘এরকম একটা খারাপ খবর বলতেও তো কেমন লাগে। … বলো, লাগে না?’
দৃশ্যের অন্তরালে থেকে তনুজা ঠিক অনুমান করতে পারে না আহাদের চেহারাটা এখন কেমন দেখাচ্ছে। কিন্তু ওর কথাগুলি ঠিকই শুনতে পায় সে, ‘এমন একটা খবর তুমি আমার কাছে চেপে রেখেছ! … ঠিক আছে … চিন্তা কোরো না, নতুন একটা কিছু হয়ে যাবে।’
খুব ছাড়া-ছাড়া মনে হয় আহাদকে; মনে হয়, খানিকটা উদ্বিগ্নই সে এই মুহূর্তে, তবে সেই উদ্বেগ তনুজার জন্যে নয় – একেবারেই নিজেকে ঘিরে। তাছাড়া কথা বলতে এখন বিরক্ত লাগছে তনুজারও – কোনো এক ফ্লোরের কেউ ফিরে এসেছে বাইরে থেকে, বারবার হর্ন দিচ্ছে গ্যারেজে গাড়ি ঢোকাবে বলে। তবু সেই শব্দকে এড়িয়ে সে বলার চেষ্টা করে, ‘শোনো, আমি বরং তোমার অফিসে আসি। সামনাসামনি কথা বলা যাবে।’
‘না-না – এখন আর আসার দরকার নেই। শোনো তুমি বাসাতেই একটু বিশ্রাম নাও। আমি বিকেলে আসছি হেয়ার অ্যান্ড দেয়ারে। তখন সব ভালো করে শুনব।’ একটু থামে আহাদ, তারপর আরো পরিষ্কার গলায় বলে, ‘তুমি কি টাকাটা এখনই নগদ না হয় বিকাশ করে দেবে? নাকি তখন সঙ্গে করে নিয়ে আসবে?’
খুব হতাশ হয়ে পড়ে তনুজা, ‘আমি তো তোমার অফিসে যাচ্ছিলাম তোমার কাছ থেকেই টাকা ধার করতে। বেকার হয়ে গেলাম না? আমি টাকা দেবো কোত্থেকে, বলো?’
‘কী বলো! তোমার কোনো সঞ্চয় নাই? এই যে এত বছর ধরে -’
‘এত বছর কোথায়? মাত্র তিন বছর। তার মধ্যে বছরখানেক তো আবার প্রবেশনারি ছিলাম।’
‘কিন্তু কোনো সঞ্চয় নাই তোমার? ডিপিএস-টিপিএসও নাই ভাঙানোর মতো?’
একটা ডিপিএস আছে অবশ্য, কিন্তু হঠাৎ করেই ষষ্ঠেন্দ্রিয় সতর্ক হতে বলে তনুজাকে আর সেই সতর্কতা তার চোখে-মুখকেই শুধু না, তার গলার স্বরকেও দখল করে ফেলে, ‘না। টাকা জমাবো কোত্থেকে বলো? আমাকে তুমি ছেলেটলানি পকেটখসানি মনে করো নাকি? ক্যান, তোমার সঙ্গে দেখা হলেই তো এক প্যাকেট করে বেনসন দিই, রিকশা ভাড়াও দিই – আর দেখা তো সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিনই হয়। এরপরও তোমার কী করে মনে হয় যে, আমি টাকা জমিয়ে বেড়াই?’
‘না-না -, সে কথা তো বলি নাই। বলছিলাম, এত ভালো চাকরি ছিল, একটা ডিপিএস তো করা যেত।’
ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় তনুজার, ‘করেই বা কী হতো! যেভাবে বলছ আর পরীক্ষায় নামাচ্ছ, তাতে তো মনে হচ্ছে, থাকলেও সেটা এখন তোমাকেই দিতে হতো, নাকি?’
‘আরে, তোমার মনটা আসলে খুব খারাপ হয়ে আছে দেখছি। শোনো, আমি তো এখন কাজে একেবারে আটকে আছি, তুমি সাড়ে ৫টার দিকে ক্যাফেতে অবশ্যই আসো তনু। তখন -’
‘ঠিক আছে, সাড়ে ৫টায় না হয় গেলাম ক্যাফেতে। কিন্তু তুমি মনে রাখবে, আমার হাত কিন্তু একেবারেই খালি। আমার টাকা লাগবে। আর আরেকটা ব্যাপারও আছে। সেটাও তোমার সঙ্গে শেয়ার করছি। তুমি এটা নিয়ে ভেবেচিন্তে এসো, একটা সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে।’
বলে সে পাত্রপক্ষের সঙ্গে বাবার কী কথাবার্তা হয়েছে, সেটা জানায়; তাকে যে বাবার মুখ রক্ষার জন্যে হলেও লাঞ্চ করতে যেতে হবে, সেটাও জানায়; আর আবারো জানায়, এরপর সে কী করবে, ডিনারের সময় হওয়ার আগেই কিংবা পরে পাত্রপক্ষকে কী বলা যাবে, সেসব যেন আহাদ ভেবেচিন্তে আসে।
কিন্তু এইসব কথার আহাদ কতটুকু যে বোঝে, কী দিয়ে কী বোঝে, সেটা তনুজা ধরতেই পারে না। সে শুধু শোনে, আহাদ বলছে, ‘তার মানে চাকরিটা আসলে তুমি ছেড়ে দিয়েছ? আর চাকরি চলে যাওয়ার ধানাইপানাই করে বিয়ের আগে আমার কাছ থেকে কিছু টাকাপয়সা খসায়ে নিতে চাইছো? আমাকে তুমি এতই বোকা মনে করো?’
প্রথমে ভেবেছিল, কল ড্রপ হয়েছে, কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তনুজা নিশ্চিত হয়ে যায়, ফোনটা আসলে কেটে দেওয়া হয়েছে।
তবু ঠিক সাড়ে ৫টাতেই ‘ক্যাফে হেয়ার অ্যান্ড দেয়ারে’ পৌঁছে যায় তনুজা। সে জানে, আহাদ আসবে না, তবু সে চলে যায় ঠিক সময়ে। হেমন্ত এসে গেছে, দিনগুলি ছোট হয়ে আসছে; হেমন্ত চলেও যাবে আর দিনগুলি আরো ছোট হবে। কিন্তু এইখানে বসে তা বোঝা যায় না। এইখানে শুধু মনে হয়, অনন্ত এক আলোআঁধারি ঘিরে আছে তাদের সবাইকে। জন্মমৃত্যুহীন তারা প্রত্যেকেই অলৌকিক এক জগতের ঈশ^র। একেবারে দক্ষিণের কোণের সেই প্রিয় টেবিলটা সচরাচর এ-সময় ফাঁকা পাওয়া যায় না। কিন্তু কে জানে কেন, আজ সেটা ফাঁকা। সে চুপচাপ সেখানে গিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতদিনে এখানকার লোকজন সকলেই কেমন চেনাজানা হয়ে গেছে। এইখানে সারাদিন বসে থাকলেও কেউ কিছুই বলবে না। তবে যতক্ষণ কিছু না নিয়ে বসে থাকা যাবে, ততক্ষণই শুল্কমুক্ত সে। তবে এক কাপ কফি নিলে যে দাম নেবে, তাতে এই বসে থাকার মাশুল যুক্ত হয়ে যাবে। তা হোক, তবু বসে তো থাকা যায় নিশ্চিন্তে!
কিন্তু এই যে সে এসেছে, এই যে সে বসে আছে, এই যে সে অপেক্ষা নাকি প্রতীক্ষায় আছে, তা আহাদের কোনোদিনই জানা হবে না? কোনোদিনই আহাদ টের পাবে না, এই সন্ধ্যাটা কেমন শান্ত বেশে প্রচণ্ড এক ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে চলেছিল গভীর তলদেশে? অন্তত একটা মেসেজ করার দায়িত্ব অনুভব করে সে। ‘আমি ক্যাফে এইচ অ্যান্ড টি’তে’ – মেসেজটি পাঠিয়ে আবারো চুপচাপ বসে থাকে সে। হয়তো একবার এক কাপ কফিও নিয়েছিল, ঠিক মনে করতে পারে না। মনে করতে পারে না, ঠিক কী কারণে সে বসে আছে এইখানে। সে তো জানে, আহাদ আসবে না। তাছাড়া তার নিজেরও আহাদের মুখটা আর দেখার ইচ্ছা নেই। তারপরও সে চুপচাপ বসে থাকে। দুই টেবিল দূরে তারও চেয়ে কমবয়সী এক তরুণী সিগারেট টানতে টানতে হঠাৎ প্রচণ্ড আবেগে উঠে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসা ছেলেটিকে চুমু দিয়ে বসলে তনুজা রাখঢাক না করে কফির কাপের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে মনে মনে বলে, ‘বুঝবি রে বুঝবি, দুই দিন পরে ঠিকই বুঝবি, কতটুকু চুমুতে কতটুকু বিষ’। তারপর মনে হয়, বোধহয় এই হাসিটুকু আসার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে, এখন তার চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু উঠবে, ঠিক তখনই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে, সে তাকিয়ে দেখে বাবা কল করেছেন, দেখতে দেখতে মনে হয়, রাস্তায় নামলে কত প্যারা, কত শব্দ, তার চেয়ে এখানে বসে কথা বলে যাওয়া অনেক ভালো। তাছাড়া সিদ্ধান্তও তো সে নিয়ে ফেলেছে এইখানে এসে কফির অর্ডারটা দিতে দিতে – লাঞ্চ করবে ছেলেটার সঙ্গে, যদিও এখন পর্যন্ত ওর মুখ দেখেনি, তবু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, তার পক্ষ থেকে বাবাকে ‘হ্যাঁ’ বলে দেবে। জীবনটা যে ছোট, খুবই ছোট, এ তো আর নতুন করে জানার বিষয় নয় – কিন্তু সেই জীবনে যদি অজানাতে ঝাঁপ দেওয়ার ঝুঁকিটুকুই না নিতে পারা যায়, তাহলে জীবনকে বড় মনে হবে কী করে! তনুজা রাজ্যের আলিস্যি ঝেড়ে ফেলে কলটা রিসিভ করে, ডগমগ গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, বাবা – বলো, কেমন আছো?’
‘আছি – আমরা তো ভালোই আছি। তুই কি অফিস থেকে ফিরেছিস?’
‘ক-অ-খ-ও-ও-ন …’ – সত্যের মতো সুন্দর করে মিথ্যা বলে তনুজা – ‘এখন বাসা থেকে বেরিয়ে আবার এক কাপ কফি খাচ্ছি। খেয়েই ফের ডেরায় ঢুকব। … শোনো বাবা, তোমাকে তো বলেছি, আমার কোনো সমস্যা নেই – তুমি যদি ভরসা না পাও, তাহলে আগেই ঢাকায় চলে এসো, আমাকে আগেই ধরেবেঁধে রাখো। কিন্তু তা না করে বারবার ফোন দিচ্ছো কেন?’ বলে সে মিথ্যা-মিথ্যা হাসতে থাকে।
‘না-না – সেজন্যে না রে।’- বাবাকে ভয়ানক বিব্রত মনে হয় – ‘আসলে হয়েছে কী জানিস, ওই পাত্র তো এখন বলছে, বিয়ের পর তুই এই চাকরি-বাকরি করতে পারবি না।’ তনুজা চেঁচিয়ে উঠতে চেয়েছিল, ‘চাকরি তো আমার চলেই গেছে বাবা, কোনো সমস্যা নাই।’ কিন্তু তার আগেই বাবা আবারো বলে, ‘তুই এত কষ্ট করে লেখাপড়া করলি, চাকরিটা পেলি – শুনেই আমি না করে দিয়েছি। … ভালো করি নাই?’
গলা কেমন বুঁজে আসে তনুজার, ‘খুব ভালো করেছ বাবা। … আমি তোমার সঙ্গে একটু পরে কথা বলি বাবা? বাসায় ফিরে?’
বলতে বলতে তার চোখ জলে ভরে ওঠে। কোনো কিছুই আর কানে ঢোকে না। ফোনটা টেবিলে রেখে দুই হাতে কফির মগটা জড়িয়ে আস্তে করে চুমুক দেয় তাতে আর জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে। এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভরে।’ বলে আর আবারো কফির মগে চুমুক দেয়। চুমুক দিতে দিতে ভাবে, এবার কত তাড়াতাড়ি হেমন্ত এসে গেল! আর অবসরও মিলে গেল! কিন্তু হেমন্ত এলে দিনগুলি ছোট হতে থাকে, কেবলই ছোট হতে থাকে, এখন এই এত বড় রাতভর ক্যাফেটা যদি খোলা না থাকে, না-ই থাকে, তাহলে এত যে বড় এই রাত – এই রাত তার কাটবে কেমন করে!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.