তপনদা ও হাসিদিকে যেমন দেখেছি

নূরজাহান বোস

তপন রায়চৌধুরীর কথা শুনেছি বরিশালবাসীর কাছে। বিখ্যাত কীর্তিপাশা জমিদারবাড়ির সন্তান হিসেবে। আমাদের কাছে আরো বড় ছিল ওই পরিবারের অনেকের স্বাধীনতা-সংগ্রামে অংশ নিয়ে জেল খাটার খবর। তপনদাও জেলখেটেছেন। ওঁরা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে সপরিবারে ভারতে চলে যান। তপন রায়চৌধুরী উচ্চশিক্ষিত হয়ে নানা জায়গায় কর্মজীবন কাটিয়ে অক্সফোর্ডে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে থিতু হয়ে বসেছেন – ভারতীয় ইতিহাসের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি – এ পর্যন্ত আমরা জানতাম।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের দুই বছর পর আমার স্বামী স্বদেশ বোস এক বছরের জন্য শিক্ষাছুটি নিয়ে অক্সফোর্ডে যায়। ওখানে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কাছে নিয়মিত যোগাযোগ করে। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা ভালোই জমে। সকলের নাম এখন আর মনে করতে পারি না। যাদের কথা মনে আছে তারা ড. আজাদ, তার স্ত্রী কিশোয়ার। লুৎফর রহমান, তার স্ত্রী ও কন্যা। ইতিহাসে পিএইচ.ডি করছিল অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে মোজাম্মেল হক, ফকরউদ্দীন আহমেদ। আমরা একদিন লুৎফর রহমানকে বললাম তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে। লুৎফর রহমান বলল, ‘আমার কাছে আপনাদের কথা শুনে তাঁরা খুব আগ্রহ দেখালেন। শিগগিরই একদিন চা খেতে বলবেন।’ সত্যি একদিন লুৎফর রহমান ও তার স্ত্রী-কন্যাসহ, আমরা দুই মেয়ে মনিকা ও অনিতাকে নিয়ে তপন রায়চৌধুরীর বাড়িতে চা খেতে গেলাম।

দেখামাত্রই মনে হলো কতকালের চেনাজানা। বরিশালের নানা গল্প দিয়ে শুরু। স্বদেশ ও তপনদা, দুজনেই দুজনের কথা খুব ভালো করে জানেন। বন্ধুবান্ধব প্রায় সকলেই পরিচিত। মনে হলো, আমরা যেন একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরছি। প্রাণরসে ভরপুর হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে একটুও দেরি হলো না। অসামান্য সুন্দরী মিষ্টি হাসিদির হাতে বানানো অনেক রকমের মজাদার খাবারের সঙ্গে কয়েক প্রস্থ চা খেয়ে বেশ দেরি করে বাড়ি ফিরলাম। মধুর আনন্দে আমাদের মন ভরে রইল।

অক্সফোর্ডের কটা মাস তপনদা ও হাসিদির সাহচর্য খুব তাড়াতাড়ি যেন শেষ হয়ে গেল। হাসিদি দিল্লি গেলেন, তপনদা একমাত্র কন্যা খুকুকে (সুকন্যা) নিয়ে ফিরে এলেন। সুকন্যা ও তপনদাকে আমরা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে খেতে ডাকতাম। আমার কয়েকটা রান্না তপনদার ভারি পছন্দ। হাসিদির প্রায় সব রান্নাই আমার খুব ভালো লাগে। মনে আছে, দিদি একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন  – আমি কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধতে পারি কি না। সত্যি বলতে কী, আমি কোনো বিরিয়ানিই রাঁধতে জানি না তখন পর্যন্ত। দিদি একটু যেন হতাশ হলেন। অনেক বছর পরে তপনদা ও হাসিদি যখন ওয়াশিংটনে এলেন, তখন তাঁদের আমি বিরিয়ানি রান্না করে খাইয়ে খুব আনন্দ দিয়েছি। দিদিও আমাদের কত কী রেঁধে খাইয়েছেন, তার আর হিসাব নেই।

আমার ও হাসিদির মধ্যে মাঝে মাঝে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হতো। হঠাৎ করে একদিন ফোন করে তপনদা বললেন, এক বছরের জন্য তপনদা ও হাসিদি ওয়াশিংটনে আসবেন। তাঁদের কিছু বইপত্রসহ একটা ট্রাংক ভয়েস অব আমেরিকার একজনের হাতে পাঠাবেন। আমরা যেন ওই ট্রাংকটা তাদের কাছ থেকে নিয়ে আমাদের কাছে রেখে দিই। তাঁরা এসে সংগ্রহ করবেন। এ-খবরে আমাদের আনন্দের সীমা নেই। দুই বাংলার সকলকে খবরটা দিলাম। দুয়েকজন ছাড়া অন্যরা খুব একটা ওঁদের চিনতেন না।

প্রথম দিকে তাঁদের ওয়াশিংটনে এক বছরের জন্য সুস্থির হয়ে বসতে আমাদের, বিশেষ করে স্বদেশের, সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল, এবং আমরা তা আনন্দের সঙ্গে করেছি। দুই বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আমার বাড়িতেই ডিনারের ব্যবস্থা করি। এরপর তো প্রায় সকলের বাড়িতেই তাঁদের নিমন্ত্রণ এবং হাসিদির রান্নার স্বাদও সকলের জিবে অমৃততুল্য বোধ হতে বিন্দুমাত্র দেরি হলো না। হাসি, আনন্দ ও আড্ডায় এক বছর কেমন করে কাটল বুঝতেও পারলাম না।

এর মধ্যে আমার বড় মেয়ে মনিকার বিয়েতেও তপনদা-হাসিদি ছিলেন মধ্যমণি। গায়ে হলুদের দিনের একটা মজার কথা না লিখলেই নয়।

গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠান আমাদের রেড উইং রোডের বাড়ির পেছনের লনে সম্পন্ন হয়। হলুদ রঙের তাঁবু খাটিয়ে চমৎকার ব্যবস্থা। একটি স্টেজের মতো করে তার চারপাশে বাংলাদেশের কুলো, কলসি, ঘটি ও প্রদীপ জ্বালিয়ে, ফুল-লতাপাতা ঘিরে যতখানি সম্ভব বাঙালি সংস্কৃতির ছোঁয়া আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানের জন্য একটা প্রোগ্রাম করা হয়েছিল। কখন ছেলেপক্ষ আসবে, কখন তাদেরসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের জায়গামতো বসাবে, কখন মিনিকে (মনিকা) এনে স্টেজে মাইকেলের পাশে বসাবে, কখন হলুদ দেওয়া শুরু হবে এবং কখন খাবার দেবো, এর প্রতিটির জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। মোটামুটি একটা অনুমান করার জন্য। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই সবকিছু সময়মতো হচ্ছিল। লাঞ্চ দেওয়ার কথা ছিল একটার সময়ে। একটায় সবাইকে খাবারঘরে আসার জন্য অনুরোধ করা হলো। সকলে ধীরে ধীরে আসছিল। তপনদা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘নূরজাহান একদম মানে ‘Thorn to thorn’ করলে কী করে?’ যারা বুঝতে পারলেন, তারা হেসে কুটিকুটি। তপনদার হাস্যরসের ভান্ডার ছিল সদা ভরপুর। যারা তাঁর রোমন্থন : ভীমরতিপ্রাপ্তের পরচরিতচর্চা ও বাঙালনামা বইদুখানি পড়েছেন তাঁরা ভালো করেই জানেন। যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরাও জানবেন। গুরুগম্ভীর বিষয়ে বক্তৃতা করার মধ্যেও তপনদা নানা ধরনের মন্তব্যে ও ঘটনার উল্লেখ করে দর্শক-শ্রোতাদের হাসাতে পারতেন।

তপনদা ও হাসিদির স্মৃতিভরা হাসি-আনন্দ ও আড্ডার একটি বছর শেষ হতে সময় লাগল না। তাঁরা অক্সফোর্ডে ফিরে গেলেন। আমরা কেমন জানি এক নিরানন্দ পরিবেশে গতানুগতিক জীবনে ডুবে গেলাম। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছে। মাঝে মাঝে চিঠিপত্র ও ফোনে কথা হতো।

এর মধ্যে স্বদেশ চার বছর আগেই ওর বিশ্বব্যাংকের চাকরিতে অবসর নিল। এর দুবছর পর তার দুরারোগ্য পারকিনসন্স রোগ ধরা পড়ল। ধীরে ধীরে ওর শরীর ও মনে এই ব্যাধির প্রভাব পড়ায় স্বদেশ তড়িঘড়ি অবসর নিয়েছিল। চিকিৎসা চলছিল জন হপকিন্স হাসপাতালে। এই হাসপাতালটি ওয়াশিংটন থেকে ৪০-৪৫ মাইল দূরে বাল্টিমোরে। যাওয়া ছিল খুবই কষ্টকর। কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ও মেয়েরা (দুজনেই ছিল নিউইয়র্কে) নানা অসুবিধা সত্ত্বেও ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও বাল্টিমোর আসা-যাওয়া করত। খুব তাড়াতাড়ি স্বদেশের শরীর ভেঙে পড়ল। ডাক্তাররা বললেন, আর কিছু করার নেই, শুধু এই ওষুধগুলোই চালিয়ে যেতে হবে, এবং নার্সিংহোম অথবা বাড়িতে উপযুক্ত যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

ওয়াশিংটনে আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু শিগগির আমার পক্ষে এই দায়িত্বপূর্ণ কাজটি আর একা সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। ছেলে ও মেয়েদের নিয়ে আলোচনাশেষে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর পূর্বে আমার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ওর সার্বক্ষণিক যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছিলাম। যা-ই হোক, আমাদের একটা অ্যাপার্টমেন্ট ছিল ঢাকাতে। ওয়াশিংটনের প্রায় ৩০-৩২ বছরের সংসার। মেয়ে, মেয়ের বর, নাতনিদের ও অগণিত বন্ধুবান্ধব ছেড়ে চলে আসাটা সহজ ছিল না। ধীরে ধীরে ঢাকাতে আমাদের জীবন সহজ হয়ে এলো। এর কারণ, ভালো কাজের লোক এবং বিশেষ করে আমার ভাইবোন ও তাদের ছেলেমেয়েদের ও কয়েকজন দরদি বন্ধুর বিশেষ আদর-যত্ন ও সহযোগিতা। হঠাৎ করেই তপনদার ফোন পেয়ে জানলাম, তাঁরা দুজনেই হামিদা ও কামাল হোসেনের বাড়িতে অতিথি। এই আসার বিশেষ কারণ প্রায় ৫৪ বছর পরে তাঁদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের কীর্তিপাশায়  বেড়াতে যাবেন। হাসিদি এই শ্বশুরালয়ে কোনোদিন যাননি। হামিদা আমাকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করল। তপনদা ও হাসিদির বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করার জন্য এই নিমন্ত্রণ।

আমি জিজ্ঞেস করে জানলাম, তাঁদের কীর্তিপাশা যাওয়ার ব্যাপারে বরিশালের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। বললেন, কীর্তিপাশার পাশের গ্রামের মিহির সেন – যিনি অনেক আগেই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন – তিনিই নাকি সব ব্যবস্থা করেছেন। এ-ব্যবস্থাপনা আমার ভালো লাগল না। বিশেষ করে দুজন বয়স্ক মানুষ যেখানে এত বছর পরে এত দূরদেশ থেকে এসেছেন।

আমি বললাম, বরিশালে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে দেখি কী করা যায়। কিন্তু মনে হলো, আমার এ-কথাটা তাঁদের ঠিক পছন্দসই নয়। কতকাল ধরে আমি বাইরে আছি। আমার কথার কী মূল্য! আমি কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে আমার ভগ্নিপতি ফকরউদ্দীন বিশ্বাস ও নিখিলদাকে ফোন করে বললাম, বরিশালের এই স্বনামধন্য সন্তানকে যোগ্য সম্মান দেখানো উচিত। ফকরউদ্দীন স্বীকার করল, কিন্তু নিখিলদাকে রাজি করাতে পারলাম না। পরে তপনদার সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে জানালাম নিখিলদাকে। এদিকে রাণাদি ও পুষ্প চক্রবর্তীকে ফোন করলাম। তাঁরা সকলেই বামপন্থী রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত।

এঁরা দুজন বরিশাল ঘুরে এসে আমার বাড়ি এলেন কয়েক ঘণ্টার জন্য। সেদিনই চলে যাচ্ছেন কলকাতার উদ্দেশে। দুজনেই মহাখুশি এই সফরে। হাসিদি বললেন, জীবনে কখনো কোথাও এত ভালোবাসা পাইনি। তপনদা বললেন, এরা কেউ তো আমাকে দেখেনি, তবু কী আদর কী ভালোবাসা! সকলেই আনন্দাশ্রুতে ভেসেছিল। ওঁরা আরো বললেন, আমার নিখিলদা, রহমতপুরে (হেলিকপ্টার যেখানে নামে) স্বয়ং উপস্থিত থেকে এঁদের সঙ্গেই কীর্তিপাশা গেছেন। বরিশাল ফিরে এসে পুষ্পের বাড়িতে লাঞ্চ ও আড্ডায় সারাদিন কেটে গেছে। রাণাদির সঙ্গে তপনদা আত্মীয়তা খুঁজে পেয়েছেন। দুজনেই বললেন, নূরজাহানের জন্যই বরিশালে এই ভ্রমণ চিরকাল মনে থাকবে। শুনে আমিও মহাখুশি।

আমি প্রতিবছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ওয়াশিংটন যাই চেকআপ ও চিকিৎসা করাতে এবং আমার প্রতিষ্ঠান ‘সংহতি’র বার্ষিক তহবিল সংগ্রহের জন্য। ২০০৯ সালে সম্ভবত অক্টোবরে খুব ভোরে তপনদার ফোন পেলাম। বললেন, নভেম্বরের শেষে ঢাকা আসবেন একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এ-ব্যাপারে আমার সহযোগিতা দরকার। কথা দিলাম আমি নভেম্বরের প্রথম দিকেই ঢাকা আসছি এবং অত্যন্ত আনন্দসহকারে তাঁর আগমনের সব রকম প্রস্ত্ততি পর্বের সঙ্গে আমি থাকব। খুশি হয়ে, তপনদা ঢাকা আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। কোথায় থাকবেন, কার সঙ্গে কোথায় কী প্রোগ্রাম করবেন, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চালিয়ে গেলেন। ঢাকাতে যারাই তাঁর সঙ্গে কোনো প্রোগ্রাম করতে চান মানে, দেখা করা, সাক্ষাৎকার নেওয়া, ডিনার বা লাঞ্চের নিমন্ত্রণ করা সকলকেই বলেছেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এতে ভালোও হয়েছে এবং কিছু ঝামেলাও হয়েছে। সে যাক।

২১ নভেম্বর এশিয়াটিক সোসাইটির নিমন্ত্রণে সস্ত্রীক ঢাকা এলেন ‘ইশতিয়াক মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের’ বার্ষিক বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতাটির নাম ‘ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক’। এঁরা উঠবেন ঢাকা ক্লাবের অতিথিশালায়। আমি ওইদিন দেখা করি। অনেকেই দেখা করতে এসেছেন। প্রতিদিনই নানা রকম প্রোগ্রামে ঠাসা তাঁর দিন-রাত। আমাকে বলেছিলেন, তপনদার বাল্যবন্ধু বরিশালের জমিদার ইসমাইল চৌধুরীর পুত্র শাহজাহান চৌধুরীর পরিবারের খোঁজ করতে। আমি জানতাম, আমার বন্ধু লায়লা কবীরের এক পুত্রের সঙ্গে শাহজাহান চৌধুরীর এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। লায়লাকে বলায় ও তাঁদের রাতে ওর বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণ করল। একুশের সন্ধ্যা ছাড়া আর কোনো সময় খালি না থাকায় তাঁরা দুজনেই রাজি হয়ে গেলেন। সন্ধ্যায় লায়লার বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন অত্যন্ত আনন্দসহকারে। বন্ধুকন্যার সঙ্গে অনেক পুরনো দিনের কথাবার্তা বললেন।

ফেরার পথে লায়লার বাড়ির বেগুনের টকমিষ্টি পদটির খুব প্রশংসা করলেন। রেসিপি জোগাড় করতে পারব কি না জানতে চাইলেন। তপনদার এই বিশেষ গুণটির কথা অন্যত্র লিখব।

২২ নভেম্বর জাতীয় জাদুঘরের উপরের বড় হলে বক্তৃতা। হলটি টইটম্বুর। সকলেই ইংরেজিতে তপনদার পরিচয় ও অন্য অনুষঙ্গগুলো শেষ করার পর তপনদা চমৎকার বাংলায় সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। প্রশ্নের উত্তরও দিলেন। বক্তৃতার মাঝে মাঝেই তাঁর চটুল রসিকতায় দর্শক-শ্রোতারা হাসিতে হলটি ভরে তোলেন।

২৩ তারিখ সকালে আমার আপত্তি সত্ত্বেও বাল্যবন্ধু দেলোয়ার হোসেন তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ি দেলদুয়ারে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ দেখানোর জন্য নিয়ে গেলেন। তাঁদের দুজনের বয়স, নানা শারীরিক অসুস্থতা এবং ওই পথের প্রচন্ড যানজটের কথা স্মরণ করেই আমার আপত্তি। মাত্র এক সপ্তাহ আগে এদিক  থেকে তিন ঘণ্টার পথ আমরা সাত ঘণ্টায় পাড়ি দিয়েছিলাম। তাছাড়া ওইদিন সন্ধ্যায়ই ছিল ইশতিয়াক ফাউন্ডেশনের ডিনার। আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। তাঁরা অবশ্য সময়মতোই ফিরতে পেরেছিলেন।

পরদিন ২৪ নভেম্বর। ওইদিন তাঁরা আমার বাড়িতে চলে আসবেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রথম আলোর গোলটেবিলে সিনিয়র সম্পাদকমন্ডলীর সঙ্গে আলাপচারিতা এবং পরে মধ্যাহ্নভোজ। ঢাকা ক্লাব থেকে প্রথম আলোই তাঁদের তুলে নেবে। হঠাৎ করে প্রথম আলোর সাজ্জাদ শরীফ আমাকেও নিমন্ত্রণ করলেন। যেহেতু তপনদা ও হাসিদি আজ থেকে আমার অতিথি, তাই আমাকেও সৌজন্যবশত নিমন্ত্রণ।

২৫ তারিখ চ্যানেল আই আমার বাড়ি থেকে এঁদের তুলে নেবে এবং দেড়টার মধ্যে পৌঁছে দেবে। সন্ধ্যায় বরিশাল জিলা স্কুলের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ডিনার। তপনদা কাউকেই নিরাশ করবেন না, অথচ তাঁর ও হাসিদির বয়সের কথা এবং নানা ব্যাধির বিস্তৃত বিবরণ আমার জানা, তাই চিন্তা হয় বইকি!

একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁর দোতলায় ডিনারের আয়োজন দেখে আমি খুব রেগে যাই। দাদার নানা রকম হার্টের সমস্যা, হাসিদির হাঁটু ও কোমরে ইস্পাতের পার্টস বসাতে হয়েছে, কেমন করে এরা এরকম ব্যবস্থা করল। শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টে সিঁড়ি ভেঙে উঠে নির্দিষ্ট জায়গায় বসলাম। বিশাল একটি ঘরে প্রায় ৬০-৭০ জনের বসার ব্যবস্থা। ধীরে ধীরে সকলে আসতে শুরু করলো, সবচেয়ে আশ্চর্য, এরা সকলেই বক্তৃতা করতে চায়, খাওয়া-দাওয়ার কথা কেউ ভাবছে না, আমরা তিনজন বয়স্ক ব্যক্তি এই বক্তৃতার মধ্যে কতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। মনে নেই, তবে বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, সে তো যাঁরা আমাকে চেনেন তাঁরা জানেন। আমি বললাম, আপনারা বক্তৃতা দিচ্ছেন তা দিন। কিন্তু আমরা ক্ষুধার্ত, খাবারের ব্যবস্থা করুন। আমার প্রস্তাব কারো ভালো লাগেনি, তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। যাই হোক, অনেক দেরিতে বাড়ি এসে পৌঁছাই এবং তাড়াতাড়ি তপনদা ও হাসিদির শোবার ব্যবস্থা করে আমিও ঘুমাতে যাই।

হঠাৎ ফোন পেয়ে উঠে বসি, একটি মহিলার গলা, ‘তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ বললাম, এত রাতে তাঁকে জাগানো যাবে না। উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। মেয়েটি ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, এটা অত্যন্ত জরুরি। তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলতেই হবে। আমি আবারো বললাম, এত রাতে আমার বাড়িতে কখনো, কেউ ফোন করে না, তাছাড়া ওঁরা দুজনেই খুব বয়স্ক এবং ক্লান্ত, ঘুম ভাঙানোর প্রশ্নই আসে না। কী এমন জরুরি বার্তা আমাকে বলতে পারেন? উত্তর – আমি এটিএন বাংলার মুন্নী সাহা। কাল তপন রায়চৌধুরীকে ১০টার সময়ে আমাদের স্টেশনে সাক্ষাৎকারের জন্য নিয়ে যাব। আমি বললাম, সকাল ৮টায় ফোন করে তপনদার সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু সাক্ষাৎকার আমার বাড়িতেই হবে। আমি তাঁকে বাইরে যেতে দেবো না। মুন্নী সাহা এবার রেগে বলল, তা হতেই পারে না। আমার অনেক যন্ত্রপাতি ও লোকজন দরকার। আমিও বললাম, এ-বাড়িতে অমন অনেক লোকজন ও যন্ত্রপাতি নিয়ে সাক্ষাৎকার হয়েছে। বলেই আমি ফোন ছেড়ে দিলাম। সকালে তপনদাকে রাতের এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিলাম। দাদা খুশি হয়ে আমাকে বাহবা দিলেন।

ঠিক ৮টায় দাদার সঙ্গে ফোনে কথা বলে মুন্নী সাহা ১০টায় লোকজন ও যন্ত্রপাতি নিয়ে এলো। চমৎকার সাক্ষাৎকার শেষ করল। চা খেতে খেতে গল্প করছিলাম। টেবিলে তপনদার বাঙালনামা বইটি ছিল। মুন্নী হঠাৎ বইটি হাতে নিয়ে বলল, আমি এই বইটি নিলাম। আমি বললাম, সেকি ও-বইটি আমার। তুমি বাজার থেকেই বই কিনে নেবে। মুন্নী হেসে বলল, কাল আপনি আমাকে অনেক বকাবকি করেছেন। তাই এখন এই বইটি আমার পাওনা। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। তপনদা ওর হাত থেকে বইটি নিয়ে বড় বড় করে লিখলেন – ‘মুন্নী সাহা নূরজাহানের এই বইটি ডাকাতি করে নিয়ে গেল, আমি সাক্ষী থাকিলাম। তপন রায়চৌধুরী।’ এই ছিল আমাদের অতিপ্রিয় তপনদার হাস্যরসের ধরন।

ওইদিনই তপনদার কথামতো তাঁর কয়েকজন পরিচিত বন্ধুকে রাতে খেতে বলেছিলাম। আনিসুজ্জামান ভাই ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ভাই ডিনারে আসতে পারবেন না বলে দুপুরেই দেখা করে গেলেন। হামিদা ও কামাল হোসেন শহরে ছিলেন না, তাই তাঁরা আসতে পারেননি। এশিয়াটিক সোসাইটির সিরাজুল ইসলাম নিমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও আসেননি। যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে যাদের কথা মনে আছে তাঁরা হলেন – জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, তপনদার বন্ধু দেলোয়ার হোসেন ও জনকণ্ঠের স্বদেশ রায়, দিল মনোয়ারা মনুও এসেছিলেন। সরয়ার মুরশিদ অসুস্থ ছিলেন বলে পরের দিন সন্ধ্যায় আমরাই তাঁকে দেখতে গেলাম এবং তাঁর সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে এলাম।

পরদিন বনানীতে তাঁর গ্রামের এক মুসলিম পরিবারের সঙ্গে দেখা করার জন্য নিয়ে গেলাম। এই পরিবারের সকলের সঙ্গে তপনদার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আমিও অভিভূত হয়ে সব দেখছিলাম। বাড়ির কর্তাটির বয়স একশ বছরেরও বেশি। ছেলে ও বড় বড় মেয়েরা সবাই হাসিদি ও তপনদাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কান্নাকাটি করছিল। তপনদা তাঁর মানিককাকুকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহ দেখালেন। অনেকক্ষণ পরে যাঁকে হুইলচেয়ারে করে আনল, তাঁর তো কোনোদিকে লক্ষ নেই। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। স্মৃতিশক্তি বলেও কিছু নেই। চারিদিকে তাকাচ্ছেন, কিন্তু কিছুই দেখছেন না। তপনদা তাঁর সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে অতি কোমল স্বরে ডাকছেন – ‘মানিককাকু, তুমি আমাকে চিনতে পারছো না? আমি তোমার তপু। তুমি আমারে লইয়া কত মাছ ধরতে গেছো, কত কাঁচা আম আমারে তুমি পাইড়া দেছো। তুমি কি সব ভুইল্যা গেলা? ও মানিককাকু, আমার দিকে একটু চাইয়া দেখো।’ বলছেন আর তার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এই দৃশ্যে আমার ও হাসিদির চোখেও জল। উপস্থিত সকলেরই একই অবস্থা। অত বড়মাপের একজন মানুষ শিশুর মতো কাঁদছিলেন। ফেরার পথে বারবার বললেন, ‘মানিককাকু আমাকে চিনতেও পারল না!’

বাড়িতে ফিরেই দেখি, বরিশাল জিলা স্কুলের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের লোকজন অনেক উপহারসামগ্রী নিয়ে বসে আছে। সকলেই নিজের অথবা তাদের ছেলেমেয়েদের লেখা বইপত্রসহ নানারকম উপহার এনেছেন। ঢাকাই জামদানি, তপনদার জন্য দামি পাঞ্জাবি, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র ও নকশিকাঁথা। তপনদা, হাসিদি ও আমি বিস্ময়ে হতবাক। এতসব জিনিস নেবেন কী করে। ওঁরা বললেন, আমরা প্যাক করে দেবো। দুজনে সাকুল্যে নিতে পারবেন মাত্র চল্লিশ কেজি। আমি হেসে বললাম, এক কাজ করুন, একটা হেলিকপ্টার ভাড়া করে আনলেন না কেন? অনেক ভেবেচিন্তে, অনেক কষ্টেও এই উপহারের অর্ধেকও সুটকেসে ভরা গেল না। তপনদা ও হাসিদি এঁদের এই ভালোবাসা দেখে আনন্দে আত্মহারা, জীবনে কোথাও কেউ তাঁদের জন্য এরকম করে নিজেদের উজাড় করে দেয়নি। ওঁরা কিন্তু দমলেন না। অবশিষ্ট বই ও অন্যান্য সামগ্রী প্যাক করে আমার ঘরে রেখে যেতে চাইলেন, পরে যে যখন কলকাতা যাবেন, তখন অল্প অল্প করে নিয়ে যাবেন। আমি কিছুতেই এই বোঝার দায়িত্ব নিতে রাজি হলাম না। বললাম, আপনারা নিয়ে যান, আপনারা যে যখন কলকাতা যাবেন, তখন কিছু কিছু নিয়ে যাবেন। হাসিদি বললেন, তাঁর কলকাতার ফ্ল্যাটে এতসব জিনিস রাখার জায়গা নেই। সারাদিন অনেক লোকজন এলো তপনদা ও হাসিদিকে বিদায় জানাতে। আজকেই শেষ দিন। কাল ২৮ নভেম্বর সকালেই চলে যাবেন। বিকেলে আমার ভাই, বোন ও তাঁদের ছেলেমেয়েরা এমন এক দম্পতিকে তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল। আমরা সকলেই সুন্দর একটি সন্ধ্যা উপভোগ করেছিলাম।

পরদিন সকালেই হাসিদি ও তপনদা বিমানবন্দরে চলে গেলেন, আমি আর গেলাম না, স্বদেশের শরীরটা তেমন ভালো ছিল না বলে। তবে তাতে কী হয়েছে! বরিশাল জিলা স্কুলের এতগুলো দরদি আপনজন থাকতে। হাতে হাতে স্যুটকেস, আরো নানা ধরনের ছোট-বড় পোঁটলা, পুঁটলি নিয়ে দু-তিনটে গাড়ি চলল তাঁদের আগে-পিছে। আমার মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। এক সপ্তাহের আনন্দ-কোলাহল শেষ হলো। আর কোনোদিন এঁরা  এ-দেশে আসতে পারবেন কি? এসেছিলেন বইকি! তবে সে-গল্প আরো একটু পরে। তপনদা ও হাসিদির ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার মাত্র চারদিন পর ৩ ডিসেম্বর স্বদেশ সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে নীরবে চলে গেল। খবরটা আমিই দিলাম তাঁদের। সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই বললেন, ‘কদিন আমাদের কাছে ঘুরে যাও।’

আমার ছেলে, মেয়েরা ও নাতনিরা প্রায় তিন সপ্তাহ থেকে স্মরণসভা করে যার যার জায়গায় চলে যাওয়ার পরে বাড়িটা যেন গভীর এক শোকে মুহ্যমান হয়ে রইল। একটা মানুষ – যে কথা বলতে পারত না, হাঁটতেও পারত না – তার অভাবে এমন খা-খা করছে কেন? প্রায় ৫০ বছর ধরে যে ছিল সর্বক্ষণের সাথি তাঁর অভাব থাকাটাই তো স্বাভাবিক; কিন্তু চারিদিকে এমন গভীর শূন্যতা আমাকে বড় ভাবিয়ে তুলল। গ্রামের বাড়ি কাটাখালীও ঘুরে এলাম। কোথাও শান্তি পেলাম না। ঢাকা আসার পরে হাসিদি-তপনদা, বারবার ফোন করে তাঁদের কাছে যেতে বললেন। ছেলেমেয়েরাও একই কথা বলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ১৯ জানুয়ারি কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে আধঘণ্টার এই যাত্রায় ছয় ঘণ্টা বসে থাকতে হলো। আমার চিন্তা হাসিদি ও তপনদাকে নিয়ে। তাঁরা দুজনে বিমানবন্দরে আসতে চেয়েছিলেন। বারবার ফোন করে নিষেধ করছিলাম। ম্যানিলা থেকে আমার পুত্র জসিমও ওঁদের বারণ করেছিল। শেষ পর্যন্ত পরিচিত এক ট্যাক্সিওয়ালাকে পাঠিয়ে নিশ্চিত হলেন। আসলে সত্যি কতটুকু নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন তা আমি জানি না। রাত ১০টায় তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দেখলাম দাদা শংকরলাল ও ইন্দ্রানীর বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে গেছেন, দিদি আমার জন্য ঘরে অপেক্ষা করছেন। চটজলদি হাতমুখ ধুয়ে শাড়ি পালটে অপেক্ষমাণ গাড়িতে চেপে ওই বাড়ি গেলাম। ওখানে কলকাতার নামিদামি অনেক বিদগ্ধজন। পুঁটিমাছ ভাজা ও দামি সরাব পান করছিলেন। তপনদা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিশেষ করে আগুনমুখার মেয়ের লেখিকা বলে। অনেকেই বইটি ইতোমধ্যেই পড়েছেন বললেন।

বইটির কথা যখন এসেই গেল তখন একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হচ্ছে। আগের বছর ফেব্রুয়ারিতে আগুনমুখার মেয়ে নামে আমার একটি আত্মকথা প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশে। প্রকাশ হওয়া মাত্র বইটি পাঠক দ্বারা সমাদৃত হয়েছে। তপনদা সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বইটি হাতে পেয়েছিলেন। অক্টোবরের ২ তারিখে দেশ পত্রিকায় তাঁর একটা ‘রিভিউ’ ছাপা হয়। আমি কখনো ভাবিনি তপনদা আমার লেখা বই পড়বেন, রিভিউ লেখা তো দূরের কথা। সে-কারণেই হয়তো এঁরা আমার বইটি পড়েছেন। মনে মনে সত্যি খুশি হলাম এবং তপনদাকে ধন্যবাদ জানালাম।

সেদিন বাড়িতে ফিরতে আমাদের রাত একটা-দেড়টা বাজল। কুছ পরোয়া নেই। এই দম্পতির জন্য এ কিছুই না। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত এঁরা সমানে ছোটাছুটি করে যাচ্ছেন। দুপুরে শোবার ঘরে কখনো ঢোকেন না। কেমন করে এঁরা এত কাজ করেন, না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। কাউকেই এঁরা নিরাশ করেন না। পছন্দসই নানারকম বইয়ের রিভিউ করা, মোড়ক উন্মোচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ভাষণ দেওয়া এবং বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া চলছে। লাঞ্চ ও ডিনারের আমন্ত্রণ তো লেগেই আছে। তাঁদের বাড়িতেও নিমন্ত্রিত জনদের ভিড় লেগে আছে। হাসিদির রান্নার সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এ-যাত্রায় তপনদা ও হাসিদির কাছে আমি ১০ দিন ছিলাম। সর্বত্র আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। কোনোরকম আপত্তি শুনতে নারাজ। এর মধ্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মবার্ষিকীতে নৈহাটিতে ঝালকাঠির বাঙালিদের (তপনদার গ্রাম এখন ঝালকাঠির মধ্যে পড়েছে) মহামিলনোৎসবে যোগ দেওয়া। তপনদা, হাসিদি ও আমাকেও নিমন্ত্রণ করেছেন। গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাওয়া ও পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ তাঁরাই করেছেন। গিয়ে দেখি, বিশাল আয়োজন, নাচ-গান, বক্তৃতা ও খাওয়া-দাওয়ার চমৎকার ব্যবস্থা। আমাদের সকলকে ফুল ও উত্তরীয় পরিয়ে সম্মাননা দিলেন। তপনদা তাঁর ভাষণে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আগুনমুখার মেয়ে সবাইকে পড়তে বললেন। আমাকেও কিছু বলতে হলো।

খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের নিয়ে গেল সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি দেখার জন্য। সংস্কারকাজ চলছে। এখানে লাইব্রেরিতে দেখলাম আমাদের বাংলাপিডিয়া। গর্বে বুক ভরে উঠল। কলকাতা থেকে নৈহাটি যাওয়া এবং ফিরে আসা, বিশেষ করে এই বয়সে এবং নানারকম জটিল শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও চাট্টিখানি কথা নয়। বাড়িতে ফিরেই আনন্দ পাবলিশার্সের একজন কর্তাব্যক্তির বাড়িতে ডিনারে গেলাম। সুবীর ও জয়িতা মিত্রের সঙ্গে আলাপ হলো। খুব ভালো লাগল। এছাড়াও গেছি তপনদার দুই ছাত্রছাত্রী চিত্ত ও নন্দিনী পান্ডার বাড়ি। চিত্ত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর। তপনদা আমার জন্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখার এক বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু ওই যে কথায় বলে কপালে না থাকলে আঠা দিয়ে লাগালেও চটা দিয়ে উঠে যায়, ওইদিনই আমার শরীর খারাপ হলো।

পরে একদিন ওঁদের বাড়িতে ডিনার খেতে যাই। এক-একটা চিতল মাছের পেটি বড় প্লেটেও ধরছিল না। এ যাত্রায় খেয়েছি অশোক ও ইন্দ্রাণী মুখার্জির বাড়িতে। এঁরা দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। এঁদের বাড়িতে জমায়েত হয়েছিলেন অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক, কবি-সাহিত্যিকও বাদ পড়েননি। সকলেই বয়স্ক। একজন স্বদেশকে চিনলেন। দুঃখের বিষয় কারো নামই আমার মনে নেই। দেখা হয়েছিল বন্ধু নবনীতার সঙ্গে। সরস্বতী পূজার খিচুড়ি খেয়ে সারাদিন আড্ডা দিয়েছি ওর সঙ্গে। অশোকদার সঙ্গে দেখা তো হয়েছেই। তাঁর শরীরটা খুব খারাপ ছিল, একবুক দুশ্চিন্তা নিয়ে ফিরে এলাম তাঁর জন্য।

হাসিদির বাড়ি কত কী যে খেয়েছি তার হিসাব করা কঠিন, তবে কয়েকটির কথা বিশেষভাবে মনে আছে, যেমন উপমা, সুজির নরম হালুয়া। কিন্তু মিষ্টির বদলে লবণ ও শুকনো মরিচ, সর্ষে ও কারিপাতা ফোড়নের স্বাদ। একেবারেই অন্যরকম। এটা দক্ষিণ ভারতীয় রান্নার মধ্যে পড়ে। এছাড়া এঁচোড়ের (কাঁচা কাঁঠাল) ঘণ্ট ও মোচার চপ এবং মিষ্টি কুমড়োর সঙ্গে বেশ বড় বড় চিংড়ির একটা তরকারি, যার স্বাদ এখনো জিবে লেগে রয়েছে।

তপনদা ভোজনরসিক এবং হাসিদি রন্ধনপটীয়সী। আগের দিনই পরের দিনের খাদ্যতালিকা তৈরি করেন তপনদা – প্রতিটি খাবারের জন্য কী লাগবে, কেমন করে তা রান্না হবে – তার  বিস্তারিত আলোচনা হয় দুজনের মধ্যে। পরে সুভাষকে (পাচককে) ডেকে সব বুঝিয়ে দেবেন। উপকরণ যদি কিছু লাগে তা খুব সকালে তপনদা হাঁটার পথে কিনে নিয়ে আসেন। খেতে বসেও প্রতিটি পদের ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা। কারো বাড়িতে নতুন কিছু খেলে অথবা পছন্দ হলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করে রেসিপি নিয়ে আসবেন। পরদিনই ওই পদটি রান্না করা চাই।

কলকাতা বইমেলা শুরু হলো ২৭ জানুয়ারি ২০১০ সালে। ২৮ তারিখ বরিশালের বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা প্রয়াত প্রশান্তদার ছোট ছেলে নয়ন এসে আমাকে সোদপুরে ওদের বাড়ি নিয়ে যাবে কয়েকদিনের জন্য। ইচ্ছা ছিল একবার বইমেলাতে গিয়ে দেখে আসি, আমার আগুনমুখার মেয়ে বইটি ওখানে কারো দোকানে এসেছে কি-না। শুনেছিলাম পার্থশংকর বসু নয়া উদ্যোগ নামে দোকানে বাংলাদেশের বই বিক্রি করেন। বইমেলাটি আজকাল নতুন জায়গায় হচ্ছে। অনেক দূরে, জায়গাটা আমার চেনাজানা নয়। নবনীতাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ও যাবে সন্ধ্যায়। তাতে আমার কাজ হবে না। আমি যাচ্ছি তখন সোদপুর।

তপনদা শুনে বললেন, জায়গাটা আমিও চিনি না। কিন্তু তুমি বইমেলায় যাবে না তা কী করে হয়। চলো তোমাকে আমিই নিয়ে যাই। ট্যাক্সিওয়ালা নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে পারবেন। এত ব্যস্ততার মধ্যে তপনদাকে আবার ওখানে নিয়ে যেতে আমার মন চাইছিল না, কিন্তু তাঁর যেই কথা সেই কাজ, কোনোরকমে লাঞ্চ খেয়েই রওনা দিলাম। অনেক ঘুরে, অনেক বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত বইমেলার একটা গেটে এসে পৌঁছলাম। মাত্র একদিন আগে মেলার উদ্বোধন হয়েছে। খুব একটা গোছানো আশা করা যায় না। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ডানদিকে গেলে দুটো দোকানের পরেই ‘নয়া উদ্যোগ’ পাবেন। সত্যিই তাই হলো। দোকানে জিজ্ঞেস করতেই আমাদের দুজনকে নিয়ে গেল যেখানে অসংখ্য বইয়ের মাঝে আগুনমুখার মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। দাদা হাততালি দিয়ে বললেন, ‘ওই দেখ তোমার আগুনমুখার মেয়ে। চলো দেখি ওইদিকে ক্যাশিয়ারের কাছে, জিজ্ঞেস করি বইটির বিক্রি কেমন হচ্ছে।’ ভদ্রলোক বললেন, ওই বইটি নিয়ে এখানে শোরগোল পড়ে গেছে। আমরা বললাম, কেন এত শোরগোল? বললেন, আমাদের দেশের এক বিখ্যাত ব্যক্তি নাকি দেশ পত্রিকায় একটা ‘রিভিউ’ লিখেছেন, তাই হয়তো। আমি হেসে বললাম, এই সে বিখ্যাত ব্যক্তি। দাদাও আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই সেই লেখিকা নূরজাহান বোস। আমাদের চারদিকে তখন সত্যি শোরগোল পড়ে গেল। সাড়ে তিনটা বাজে, আমি জানি তপনদাকে ঠিক চারটায় টেলিভিশন স্টেশন থেকে ইন্টারভিউ করতে আসবে। তারপরও দাদা বললেন, আর একটু বেশি সময় থাকতে পারলে তোমার ভালো লাগবে নূরজাহান, চলো কোথাও একটু চা খেয়ে আসি। আমি বললাম, বাড়ি গিয়েই চা খাবো। বাড়িতে এসে দেখি সেই ভদ্রলোক হাসিদির সঙ্গে বসে চা-মিষ্টি খাচ্ছেন। অসাধারণ এই দম্পতি। এঁদের এত ভালোবাসা, আদর-যত্ন পেয়েছি যা কোনোদিনই ভুলতে পারব না। এঁদের ধন্যবাদ দেওয়ার সাহসও আমার নেই।

মন খারাপ করে তপনদা ও হাসিদির কাছে এসেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী ঘুমোবার সময় ছাড়া প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে হাসি, আনন্দ ও আড্ডায়। তপনদা ও হাসিদি একে অপরের পরিপূরক। একজন না হলে আরেকজনের এক মুহূর্ত চলে না। এমন দম্পতি বিরল।

এখানেই শেষ করতে পারতাম, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল তপনদা ও হাসিদির অক্সফোর্ডের বাড়িতে আরেকবার বেড়িয়ে আসার কথা। আমার বড় মেয়ে মিনি চার বছরের প্যারিসবাস শেষ করে ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে আরেকবার প্যারিসে গেলাম। হঠাৎ তপনদার ফোন এলো, একবার আমাদের কাছে ঘুরে যাও, আমাদের খুব ভালো লাগবে। মনে হয় তোমারও ভালো লাগবে। এমন আদরের ডাক অবহেলা করা যায় না। মিনি ট্রেনের টিকিট কিনে সবকিছু বুঝিয়ে দিলো। আমার বাদলভাই লন্ডনে ট্রেনস্টেশন থেকে অক্সফোর্ডের ট্রেনে তুলে দিলো। মাঝখানে ওর সঙ্গে দুটি ঘণ্টা অনাবিল আনন্দে কেটে গেল।

অক্সফোর্ডের ট্রেন থেকে বেরিয়ে দেখি গাড়ি নিয়ে তপনদা সহাস্যে দাঁড়িয়ে। একটু বকলাম, আমি তো ট্যাক্সি নিয়েই আসতে পারতাম।

তুমি অক্সফোর্ডে ছিলে সেই কবে, তা কি আর মনে আছে এখন – বললেন দাদা। খুব সুন্দর একটি এলাকার মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আরো সুন্দর একতলা একটা বাড়িতে এসে ঢুকলেন। বাড়ি না বলে একে লতাপাতা ও নানা ধরনের নানা রঙের ফুলে ঢাকা একটি কুঞ্জবন বললেই যথার্থ বলা হবে। আমার প্রশংসা শুনে তপনদা ভারি খুশি হলেন। ঘরে ঢুকেই দেখি হাসিদি একটি হুইল চেয়ারে বসে অধীর আগ্রহে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। আনন্দভরা কণ্ঠে বললেন, এখন কী খাবে?

কিছুই না। আগে বাড়ি ও এর চারপাশ দেখি, তাছাড়া  খাওয়ার কোনো তাড়া নেই। পথে বাদলভাই ভালো লাঞ্চ খাইয়েছে।

তপনদা আমার সঙ্গে বাগানে এসে প্রতিটি লতা ও ফুলের নাম বলে দিচ্ছেন। সঙ্গে ক্যামেরা নেই বলে খুব খারাপ লাগল।

হাসিদি ও তপনদা বসে ঠিক করলেন, আমি যে চারদিন ওঁদের সঙ্গে থাকব সে-কটাদিন আমাকে কী কী বিশেষ খাবার খাওয়াতে হবে। আমি তো হেসেই মরি। মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে অনেক রাত ধরে জমিয়ে প্যারিসের গল্প, কলকাতা ও নাতনির গল্প। পরদিন সকালে উঠেই তপনদা বললেন, এতদিন পর অক্সফোর্ড এসেছ, তোমার কী খেতে ইচ্ছে করছে। আমি চট করে চললাম, গরম গরম স্কোন্স ক্রিম ও স্ট্রবেরি জ্যামসহ একটি ব্রিটিশ রুটি, যা আর কোথাও বানাতে পারে না। তপনদা লাফ দিয়ে উঠে গাড়ির চাবি নিয়ে বললেন, এখুনি এসো। সেন্ট মাইকেল সুপার মার্কেটে কয়েকটা জিনিসও কিনতে হবে। ওখানেই আমরা ব্রেকফাস্ট খাব, হাসির জন্য নিয়ে আসব। ওদের স্কোন্স খুব ভালো। আমি তৈরিই ছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে দোকানে পৌঁছে গেলাম। অনেকদিন পরে আমার পছন্দের খাবার ও খুব ভালো কফি খেয়ে, হাসিদির জন্য এক প্যাকেট নিয়ে বাড়ি এলাম।

তপনদা খাদ্যরসিক। আগেই লিখেছি, নানা দেশের খাদ্য নিয়ে তিনি গবেষণাও করেছেন। বিশেষ করে মুঘলদের খাবার নিয়ে তাঁর গবেষণা বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশের খাবার নিয়েও তাঁর লেখা আছে। আমার কাছ থেকে বাংলাদেশের নানারকম মুখরোচক ভর্তা তিনি খেয়েছেন এবং সে-বিষয়ে অনেক পত্রিকায় লিখেছেন।

এখানে একদিন আমি চিংড়ি মাছ ভর্তা ও মুরগি ভর্তা করে খাওয়ালাম, দুজনেই মুগ্ধ হয়ে খেলেন এবং প্রশংসা করলেন। আমি একদিন ইংলিশ ফিশ এবং চিপস মানে মাছ ও আলু ভাজা খেতে চাইলাম। মহাউল্লাসে দাদা আমাদের চমৎকার জায়গায় নিয়ে গেলেন। রেস্টুরেন্টটি ফিশ অ্যান্ড চিপসের জন্যই বিখ্যাত। চেয়ার-টেবিল পেতে একটি জলাশয়ের পাশে আমরা তিনজন বসলাম। দাদা খাবারের অর্ডার দিয়ে এলেন। বড় ট্রেভর্তি গরম গরম মাছ ও আলু ভাজা, সঙ্গে ঠান্ডা বিয়ার। যে না খেয়েছে তাকে এর স্বাদ বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। ঘরে ফেরার পথে একটা আইসক্রিমের দোকানে থামলেন। তপনদার ডায়াবেটিকস, তাতে কী হয়েছে, তাই বলে আমি খাবো না, তা কী করে সম্ভব! তপনদাকে উলটো কথা বোঝানোর মতো ক্ষমতা আমার নেই।

একদিন অক্সফোর্ডের চারিদিক ড্রাইভ করে দেখালেন, ফেরার পথে আমরা যেদিকটাতে ছিলাম তা প্রায় ৪০ বছর আগের, সেদিকটাতেও নিয়ে গেলেন। দুজনেরই বয়স ৮৫-৮৬। কিন্তু তাঁদের আচরণে মনে হচ্ছে এখনো ১৬-১৭ পার হয়নি। নানা রকম অসুস্থতা দুজনেরই, কিন্তু তাই বলে ঘরে বসে থাকবেন, এটা হতে পারে না। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন উল্কার বেগে। আমার ফেরার আগের দিন Event management-এর জন্য এক মহিলা এলেন। তপনদা ও হাসিদির ৫০ বছর বিবাহবার্ষিকী সমাগত। হাসিদির ইচ্ছা এই উৎসবটি তাঁরা মনের মতো করে করবেন। তপনদা সর্বান্তঃকরণে হাসিদিকে সমর্থন করছেন। সারা পৃথিবী থেকে তাঁদের ঘনিষ্ঠ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন আসবেন। একশ অতিথি আসবেন বলে ধারণা করছেন। অনুষ্ঠানটি সবদিক থেকে সুন্দর ও সার্থক করার জন্যই একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ওই মহিলার সঙ্গে বসে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হলো। দাদা একসময়ে আমাকে বললেন, হাসির শরীর ভালো না, কখন কী হয়। আমি শুধু চাই যা-ই হোক, এই অনুষ্ঠান পর্যন্ত যেন হাসি বেঁচে থাকে। অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।

এর কিছুদিন পর তপনদা আমাকে জানালেন যে, তিনি, হাসিদি, তাঁদের একমাত্র মেয়ে সুকন্যা ও তাঁদের নাতনি লীলালক্ষ্মী শিগগির ঢাকায় আসবেন। এবারে তাঁর সফরসূচি একটু অন্যরকম। তপনদার দুই সফল ছাত্র ড. গওহর রিজভী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈদেশিক উপদেষ্টা, আর একজন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার, তাঁর স্ত্রী সুকন্যার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এবার তিনি কন্যা ও নাতনিসহ হাইকমিশনারের বাড়িতে অতিথি ছিলেন। গওহর রিজভী দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের বরিশাল ঘুরিয়ে আনলেন। এশিয়াটিক সোসাইটি এবার তপনকে আজীবন ‘ফেলোশিপ’ সম্মাননায় ভূষিত করল। এক ফাঁকে আমাকে তপনদা বললেন, নূরজাহান আমার মতো এই ক্ষুদ্র মানুষটির সব আশাই পূরণ হলো। জীবনের শেষ স্বপ্ন ছিল সুকন্যা ও লীলালক্ষ্মীকে বাংলাদেশ তথা কীর্তিপাশা ঘুরিয়ে আনা, কখনো ভাবিনি সেটা সম্ভব হবে। কেমন করে যেন সেটাও হয়ে গেল। এ আমার ভাগ্য।

তপনদা ও হাসিদির একটি অসাধারণ গুণের কথা কেমন করে যেন ভুলে গেলাম। বই পড়ার ব্যাপারে এঁরা দুজনে ছিলেন কিশোর-কিশোরীদের মতো। ভালো লাগলে তো শেষ পর্যন্ত শেষ না করে ছাড়তেন না। নানা দেশের নানা রসের বই তাঁরা এত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও পড়তেন। ফোনে মাঝে মাঝে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বলতেন, যে-বইটি তাঁরা সদ্য শেষ করেছেন, সুযোগ পেলে যেন অবশ্যই সে-বইটি আমি পড়ি। পড়ার পরে তিনজনে মিলে বইটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যাবে।

প্রাণশক্তির এমন প্রকাশ, এমন মেধা ও হাস্যরসের সমন্বয় কোনো এক ব্যক্তির মধ্যে আমি কখনো দেখিনি। নিজে যেমন আনন্দ করতে ভালোবাসতেন, আবার তেমনি সেই আনন্দ অন্যদের মধ্যেও দুহাত খুলে ভাগ করে দিতেন। শতভাগ অসাম্প্রদায়িক এমন দুজন মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তপনদা ও হাসিদির মতো এমন বড়মাপের দুজন মানুষকে কাছের মানুষ হিসেবে পেয়েছিলাম, এ আমারই ভাগ্য।