তাঁর চলে যাবার পর

সৈয়দ শামসুল হক
একজন তাঁর বিভামন্ডিত সৃজন-জগৎটি আমাদের জন্যে রেখে সদ্যই যখন চলে যান – সৃজনের পাশাপাশি নিভৃতিও যাঁর সাধনা ছিল জীবনভর, তবুও যে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি কী কাজে কী ব্যক্তিসংস্পর্শে – তাঁকে নিয়ে লেখার মুহূর্তে কাজ নয়, কীর্তি নয়, তাঁর মুখখানাই চোখে ভাসে। এখনো আমার চোখ থেকে অপসৃত হয়ে যায়নি, হবারও নয়, তাঁর সেই দীর্ঘ দেহটি, সুঠাম ও সন্নত, সেই দীঘল মুখ, চোখের সেই চাপা দ্যুতি, যেনবা ঈষৎ কৌতুকচ্ছটা সেখানে; হেঁটে যাচ্ছেন স্বামীবাগের গলি ধরে বড় সড়কের দিকে, রোদের তাপে মুখখানা লাল প্রায়; দেখা হতেই উদ্ভাসিত হচ্ছেন নীরব হাসিতে, মোহন সেই হাসিটি, মৃদুস্বরে উচ্চারণ করছেন – প্রায় অস্ফুট – এই যে আপনি! হাতখানা বাড়িয়েও ফিরে নিচ্ছেন, যেন ওতেই করমর্দনটি পেল সম্পূর্ণতা; তারপর আমরা পাশাপাশি হাঁটছি; তিনি চলেছেন চারুকলা বিদ্যাপীঠে, আমি হয়তো কাছেই কোনো ছাপাখানায়। এরকম বহুদিন গেছে যখন হঠাৎ তাঁর সঙ্গে পথে হয় দেখা; খুব তো দূরে নয়, তিনি স্বামীবাগে, আমি লক্ষ্মীবাজারে; নারিন্দা দিয়ে হেঁটে গেলেই হয়!
তারপর একদিন সেই যে তিনি স্বামীবাগ ছেড়ে ধানমন্ডিতে উঠে এলেন, সেই ঠাঁইবদলটা আমার মন যেন গ্রহণই করতে পারেনি; তিনিও বোধহয় পারেননি; বারবারই তাঁর সেই গলিপথটির কথা বলতেন, সেই পুরনো বাড়িটি যেন তার দরোজা-জানালা নিয়ে তাঁর মনের মধ্যে স্মৃতির হাওয়ায় থেকে থেকেই ঝাপটাতো। তাঁকে ঘিরে আমি যেন তখন পেয়ে উঠতাম সেই ঢাকার নিজস্ব একটি-ঘ্রাণ – হ্যাঁ, প্রাচীন যে-কোনো জনপদের আছে স্বাক্ষরপ্রতিম ঘ্রাণ, এবং তার কোলাহলের নিজস্ব কোরাস, ছায়া-রৌদ্রেরও বিশেষ আলিম্পন। এ সবই নিয়ে এখন আমার মনে পড়ছে তাঁকে; আর যদিবা এখন মনে পড়ছে তাঁর অাঁকা ছবির কথা, অবাক হচ্ছি ভেবে – নদীতীরের মানুষ হয়েও তাঁর ভেতরে কী করে অবিরাম চ্ছলচ্ছল করত নদী, বিশেষ কোনো নদী নয়, শুধু তার জল, জলও বিশেষ করে নয় – মাছ, মাছ ধরবার জাল। তাঁর ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে, অথবা আমারই ছবি দেখার চোখ মনে রেখেছে তাঁর ওইসকল কাজ – ছবির পর ছবিতে নদীর সজলতা, মাছের উত্তল পিঠ, জালের বয়ন-বঙ্কিমতা। সৃষ্টির আদি উৎস – জল; তাই কি জলের দিকে তাঁর টান? আর, মাছ তো বহুপ্রজননের প্রতীক; ওই বহুপ্রজননতাকে তিনি কি লোকসংস্কৃতির মন্ডল থেকে উদ্ধার করে আমাদের প্রত্যেকেরই অন্তর্গত এক থেকে বহু হয়ে উঠবার অভিলাষটির কল্পরূপ বলে মনে করতেন? এও এখানে স্মরণ করি, ঈশ্বরও এক থেকে বহু হবার ইচ্ছা ধরেই প্রাণী ও উদ্ভিদের এই জগৎ একদিন সৃজন করেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বর তো ঈশ্বরই, সৃজন করেন তিনি কেবল ইচ্ছার একটি বাক্য দিয়ে, তন্মুহূর্তেই; আর আমাদের জন্যে দীর্ঘদিনের শ্রমে একটু একটু করে।
ধরে ধরে ছবি করতেন তিনি, তাঁর একেকটি ছবির ছবি হয়ে উঠতে সময় লাগত প্রচুর। অনেকদিন তাঁর স্বামীবাগের স্টুডিওতে গেছি, নিবিড় নিবিষ্ট হয়ে অাঁকছেন তিনি; মাসাবধি পরেও এসে দেখেছি, যে-কাজ কবে দেখে গেছি তিনি করছেন – সেটা তখনো শেষ হয়নি। একটি কল্পিত ছবিকে ছবি করে তুলতে এমতো দীর্ঘ কাল দিতে আমি আর কাউকে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। তাঁকে জিগ্যেস করেছি, একটা ছবি কখন শেষ হয়ে যায়? কখন তুলিটির টান বা তক্ষণ-শলাকাটির খোঁচ শেষ বিরাম পায়। হেসে তিনি পালটা বলতেন, আপনিই বলুন। তখন হয়তো পিকাসোর বরাতে বলেছি – পিকাসো বলতেন, অাঁকতে অাঁকতে একটা সময় আসে আমি তখন হাত তুলে নিয়ে বলি, ব্যস এই! এই পর্যন্তই! শুনে তিনি স্মিতমুখে জায়মান ছবিটির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করতেন, আমারও ওই!
আমার নিজের মাধ্যম ভাষা, তাঁর রং ও রেখা। তিনি একটা তুলনা বয়ান করতেন। বলতেন, গল্পের একটা নির্দিষ্ট পরিণতি আছে, কবিতারও তাই; গল্পের বেলায় ঘটনার ছক বলে দেয়, কোথায় থামতে হবে; কবিতারও তাই – যদি সনেট, তো চোদ্দ পঙ্ক্তিতে তার থামা; কিন্তু ছবির বেলায়? – ছবির ভেতরে রয়েছে সর্বাংশেই আমাদের দৃষ্টির প্রেক্ষণ, আর এটি এমনই যে, দেখার শেষ নেই; দৃষ্টি এক চিরতৃষিত ইন্দ্রিয়। তিনি বলতেন, ওই দৃষ্টিবোধ চাই চিত্রকরের, ওখানেই একটা জাদু, জাদুও ঠিক নয়, চলতি কথায় হাত আন্দাজই যেন, হাতই বলে দেয় কখন থামতে হবে। তিনি বলতেন, দীর্ঘ সময় তাঁর লাগে হাতের ওই পরামর্শটি পেয়ে উঠতে।
আমার কৌতূহল হতো; তখন জানতে চাইতাম, এই যে আপনি এত দীর্ঘসময় ধরে একটি কাজ করেন – প্রেরণা বলে একটা ব্যাপার আছে তো! – আদি প্রেরণাটিকে আপনি এত দীর্ঘকাল ধরে রাখেন কী করে? – হারিয়ে যায় না? বলতেন, প্রেরণা তো মুহূর্তের, তক্ষুনি ছবিটা মনের মধ্যে এসে যায় তার সবটা নিয়ে, বাকিটা কারিগরের কাজ – ফুটিয়ে তোলা।
অসামান্য এক কারিগর ছিলেন তিনি – নিপুণ, নিবিষ্ট; এবং এই নিবিষ্টতা ছিল তাঁর দিনরাত্রির, সপ্তাহের, মাসের, কোনো কোনো ছবির জন্যে বৎসরব্যাপী। অনেকটা ভবন গড়ার মতোই ছিল ছবি অাঁকা তাঁর কাছে – দিনের পর দিন ইটের পর ইট যেন গেঁথে তোলা।
আর কত বিচিত্র মাধ্যমেই তিনি এই কাজটি করেছেন। সেই প্রথম তাঁর বিখ্যাত ছবি – সাঁওতাল রমণী যুগল, কাঠ খোদাই; ওই খোদাই তো একবেলায় হয়ে ওঠার নয়; সেখান থেকেই শুরু; আর সেই খোদাই বা তক্ষণের কাজটি তিনি কাঠ ছেড়ে ধাতবপাতেও করে গেছেন, শুধু তক্ষণেই নয়, রংও তাতে চড়িয়েছেন বা রঙে তাকে চারু করে তুলেছেন। তক্ষণের তিনি এক অনতিক্রম্য শিল্পী, এখন পর্যন্ত এবং সমুখেও তাঁর মতো কাউকে দেখি না বা অচিরে কাউকে দেখবো বলে এখনো আমি বার্তা পাই না।
এই যে এত দীর্ঘ সময় নিয়ে তাঁর অাঁকার স্বভাব, অাঁকার কাজগুলো দেখাতেও তাঁর সে কীই না কুণ্ঠা – হ্যাঁ, কুণ্ঠাই একে বলবো; যখন আর-সবাই নিত্যই করছেন তাঁদের ছবির একক প্রদর্শনী, তিনিও ডাক পাচ্ছেন, কিন্তু না বলছেন, বলেই গেছেন; আমরা হতাশ হয়েছি; আমরা এমনকি একে তাঁর ঈষৎ বাড়াবাড়ি বলেই মনে করেছি; এখন তাঁর চলে যাবার পরেই কেবল আমরা তাঁর ছবির বিতানে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছি। তিনি বলতেন, প্রদর্শনী? হবে! আরো কিছুদিন যাক! আরো কিছু কাজ করি! ছোট ছোট বাক্য, প্রায় অস্ফুট, উচ্চারণে কিশোরসুলভ লাজুকতা; কিন্তু ভেতরের ভাবটা ঠিকই টের পাওয়া যেত – নিজের কাজ নিয়ে তাঁর অতৃপ্তি; যেন ঠিক যেরকমটি চাইছেন এখনো তেমনটি তাঁর হাতে হয়ে ওঠেনি। এই অতৃপ্তিটুকুও তাঁকে বড়র জায়গায় নিয়ে গেছে।
বড় তিনি। সত্যিকার ও সব অর্থেই বড়। এ-যুগে – সম্ভবত বাঙালির সর্বকালেই – আমাদের এ এক ভয়াবহ মানস-খর্বতা যে আমরা বড়কে বড় বলে শনাক্ত করতে পারি না; কিংবা, পারলেও, স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাপর, বা এমনও – তাঁকে নামিয়ে এনে আমাদেরই খর্বতার ভেতরে বসাতে চাই। এ-কাজটি আমরা তাঁকে নিয়ে করিনি কি? নিরন্তর তাঁর কাজ করে যাওয়া, অাঁকা নিয়ে তাঁর বিরতিহীন অভিযাত্রার বিপরীতে, আমরা তাঁকে প্রায় বিস্মৃতির পর্যায়েও হয়তো নিয়ে গেছি। যেহেতু তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, তাঁর কণ্ঠ আমরা শুনিনি। যেহেতু তিনি ছিলেন প্রদর্শনীবিমুখ, তাঁর কাজকে আমরা গণনা করিনি। যেহেতু তিনি প্রচার-পারঙ্গমতাকে মনে করতেন শিল্পীর জন্যে এক ব্যাধি, আমরা তাঁকে দূরশ্রুত একজন বলেই বিশ্বাস করেছি। কিন্তু এইসব বিরল মানুষই সেই স্তরের যাঁরা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের বায়ুর মতো বটে; গ্রহণ করছি বটে প্রাণধারণের প্রয়োজনে, কিন্তু সচেতন থাকছি না সে সম্পর্কে।
বাঙালির ইতিহাসে আমার চোখে পড়ে যে, কারো মৃত্যুর পরেই কেবল আমরা তাঁর মূল্যায়নে হয়ে উঠি তৎপর ও চিৎকৃত। তারপর কিছুকাল পেরোলে কোলাহলটা থেমে যায়, কিন্তু দুঃখিত হবার কিছু নেই, প্রকৃত যিনি জন – সেই বাঙালিই তাঁকে স্মরণ করে ওঠে তাঁর সকল কীর্তি ও গরিমা নিয়ে। আমাদের ভাগ্য যে, সফিউদ্দীন আহমদের মতো এতবড় একজন শিল্পী আমাদের মধ্যে ছিলেন এবং যত দিন যাবে ততই তাঁকে আমরা পাবো, পেতেই থাকবো। তাঁর কাজ ও শিল্পজীবন আমাদের জন্যে অক্ষয় এক নন্দন-উৎস হয়ে থাকবে। 