তুঘলক

সাদিক হোসেন

Sadik-Hossain

ঠিক এই মুহূর্তে ১০০ পাওয়ারের বাল্বের নিচে শুয়ে তুঘলক বুঝতে পারে, এই হাওয়ালাতের ভেতর, এই হাওয়ালাতের ভেতর গরাদের গা থেকে বেরিয়ে আসা আলো, ও সেই আলোর পরিপ্রেক্ষিতে তার চোখের দিকে ধাবমান কালারগুলো, খৈনি ঝাড়ার শব্দ, লাঠির ঠুকঠাক, এটাসেটা সবই আসলে ওই ১০০ পাওয়ারের বাল্বের গায়ে জাপ্টে থাকা ধুলোর মতো, শ্রেণিশত্রম্নর পকেট কেটে পাওয়া মানিব্যাগসদৃশ পবিত্র তথা বিলীয়মান; অর্থাৎ সন্দেহাতীত নয়। উপরন্তু লম্বা বুটের শব্দকে অনুসরণ করলে, সে খেয়াল করবে, প্রশ্নকর্তা তার দিকেই এগিয়ে আসছে – সুতরাং, ঠিক এই মুহূর্তে শিরদাঁড়া খাড়া করে বসে থাকাটা হবে রাজনৈতিক বিচ্যুতি। তুঘলক শুয়ে পড়ে এবং যন্ত্রণাকাতর কয়েদিদের মতো পা-টাকে পেটের কাছে টেনে এনে ‘দ’ হয়ে যায়।

দ-এ দৌড়।

দ-এ দাঁড়িপাল্লাও বটে।

তুঘলকের নাম তুঘলক কেন? – এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে একটা দৌড়ের দিকে নজর দেওয়া আমাদের একান্ত কর্তব্য।

কিন্তু যেহেতু ছাপা অক্ষর বৈশিষ্ট্যগতভাবে স্থির, তাই আমাদের কল্পনা করতে হবে এই মুহূর্তে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই আসলে চলমান। শুধু চলমান কেন, এই মুহূর্তে লিখিত শব্দরা এই তো পাহাড় থেকে গড়গড়িয়ে নামছে, খনি থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠছে, ব্যর্থ পকেটমারের মতো তারা দৌড়াচ্ছে, তাদের পেছনে ছুঁচোবাজি ছেড়ে দেওয়া হয়নি তবু তারা দৌড়াচ্ছে, তাদের চামড়া থেকে বেরিয়ে আসছে রক্ত ও ক্যালসিয়াম এবং তারা এমন এক প্রান্তরের ভেতর ঢুকে পড়ছে যেখানে আদালত ও কিষান, সমকাম ও গণিত এবং ভুখহরতাল আর শব্দ ও তার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সব একত্রে, সমানতালে প্রসব করে চলেছে যে মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে – তাই তুঘলক।

সুতরাং, তুঘলক – এখানে তুঘলকই!

তবু আমাদের খেয়াল রাখা জরুরি গল্প এমন এক আর্টফর্ম যেখানে সাদা কাগজের ওপর কালো অক্ষর ছাড়া আর কোনো কিছুরই বাস্তবিক উপস্থিতি নেই। সবটাই কল্পনা। ফলে পাঠক প্রথম থেকেই লেখকের দাবিগুলোকে সন্দেহ করতে থাকে। অন্যদিকে লেখক তাঁর দাবিগুলোকে জোরদার করতে এমন ছকে গল্পকে বাঁধেন যাতে মনে হয় তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো কোনো না কোনোভাবে তাঁর ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। যেন লেখকের কল্পনা অতটাও কাল্পনিক নয়, এটাই লেখক প্রমাণ করতে চান।

পাঠক-লেখকের এই বোঝাপড়ার মাত্রার ওপরই কি গল্পের সফলতা নির্মিত হয়?

যদি তাই হয়, তবে এইক্ষণে তুঘলক সম্পর্কে দু-চার পিস হিন্ট দিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

তুঘলকের বাপের নাম ছিল খালিদ। কিন্তু তার চোখ বেড়ালের মতো ঘোলাটে হওয়ায় বিলস্নু খালিদ নামেই পরিচিত ছিল বেশি। সবজিবাজারে যতটুকু জায়গা পাওয়া গেলে সংসার চালানো যায়, ঠিক ততটুকু জায়গায় দাঁড়িপাল্লার এমন এক হিসাব সে করতে পেরেছিল যে, আপনি ৫০০ গ্রাম টমেটো চাইলে চারটি টমেটো নিয়ে তার দাঁড়িপাল্লা ততটুকুই ঝুঁকত, যতটুকু ঝুঁকলে ৫০০ গ্রামের হিসাব মেলে। বলা বাহুল্য, টমেটোর সাইজের ওপর তা সবসময় নির্ভর করত না। তা ছাড়া কথায় আছে, মানুষের চেহারা তার চরিত্রকে নির্মাণ করে। ফলে তার পাশের সবজিওয়ালারা প্রায়শই লাভ-লোকসানের হিসাব মেলাতে পারত না। সন্দেহ এসে পড়ত অবশ্যই বিলস্নু খালিদের ওপর। কিন্তু সে সবসময় এমন এক চোখে চারদিকে তাকাতে শিখেছিল যে, প্রায় দিন মনে হতো সেই দিনটাই তার এই বাজারে প্রথম দিন। সে থ্রেট পেত। কখনো-কখনো হেট স্পিচ শুনত। কিন্তু গায়ে হাত পড়ত না। একদিন সেটাও হলো। একজন বউদি টমেটো, কাঁচালংকা কিনতে এসেছিল। সে মানিব্যাগ ফেলে রেখে চলে গেল। পরে খোঁজ নিতে এলে বিলস্নু খালিদ সোজা ডিনাই করতে থাকল। তাকে চার্জ করা হলো। সার্চ করা হলো। শেষে চটের তলা থেকে মানিব্যাগটা পাওয়া গেল।

এই সময় তুঘলকের বয়স কত ছিল? বহু চেষ্টা করেও তুঘলকের এগজ্যাক্ট জন্মতিথির খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রাইমারি স্কুলে তার যে-জন্মতারিখ দেওয়া রয়েছে তা নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ ভোটার কার্ড অনুযায়ী তার বয়স আবার অন্য। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায়, যেদিন তার বাপ গায়েব হয়ে গেছিল, সেদিন সে খাতুনমহলে পিঠে চাবুকের দাগ নিয়ে নাচতে থাকা মাধুরী দীক্ষিতের এক-দো-তিন-চার দেখছিল। তেজাবের রিলিজ ডেট ১১ নভেম্বর, ১৯৮৮। সুতরাং ১৯৮৮ সাল নাগাদ তার বয়স ছিল লাগভাগ ১০-১২ বছর।

১৯৯০ সালে worldwide web এলো। সাড়ে সাতাশ বছর জেল খাটার পর সাউথ আফ্রিকা নেলসন ম্যান্ডেলাকে রেহাই দিলো। ইরাক কুয়েত আক্রমণ করল। আবার এই সময় ইন্ডিয়া শ্রীলংকা থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়েছিল, কাশ্মিরে ডাইরেক্ট রুল চাপিয়ে ছিল, মণ্ডল কমিশনের প্রস্তাবনাকে বাস্তবায়িত করেছিল। এসব ঘটনা এবং আরো অনেক কিছু তুঘলকের ওপর কী কী প্রভাব বিস্তার করেছিল?

পুলিশের লাঠির ঠকঠকানির সামনে তুঘলক যা বলে তা প্রায় ম্যাজিক রিয়্যালিজমসদৃশ।

মায়ের পেটের ভেতর থাকাকালীন সে নাকি বাপের লাথি খেয়েছিল। প্রমাণস্বরূপ নিজের বোঁচা নাকটা দেখিয়ে বলে, এই যে।

এতে বড়বাবু হেসেই কাহিল। কনস্টেবলকে ডেকে বলেন, শুনুন, আপনার তুঘলক কী বলে। এই বল, বল না।

তুঘলক আবার শুরু করতেই বড়বাবু কনস্টেবলের দিকে তাকান, কী ঘোষদা, আপনিও আজকাল লাথি দিচ্ছেন নাকি?

কনস্টেবলের ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। অফিসার কোন দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তা বুঝতে পেরে সে তুঘলকের জুলপি টেনে দু-চারটে চুল ছিঁড়ে দেয়।

– আহ্ ঘোষদা। বড়বাবু খানিক ধমক দিয়ে তুঘলকের দিকে ফেরেন, তো বাপের পা-টা তোর নাকে লেগেছিল! ওটা পা ছিল, না অন্য কিছু? তুই জানলি কী করে? তুঘলক জানায়, তার যখন বছরপাঁচেক বয়স হবে, সে তার বাপ-মায়ের সঙ্গে দীঘায় গিয়েছিল। তার এখনো মনে আছে, সন্ধেবেলা বালুর ওপর বসে তারা হাজার হাজার টিউবলাইটকে সমুদ্রের ওপর আছাড় খেয়ে ভেঙে যেতে দেখেছিল। সকালে সি-বিচে মরে যাওয়া তারামাছ দেখেছিল। সমুদ্রের ওপারে কী আছে, সে দেখতে পায়নি। তবু কোনো-কোনো রাতে তার ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখতে পেত, মা পাশে ঘুমোচ্ছে, আর বিলস্নু খালিদ বেড়ালের মতো জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যেন এখনই সে জানালা দিয় লাফ কেটে পাশের পাঁচিলে উঠে যাবে। কিন্তু সে কিছুই করত না। হয়তো একটা বিড়ি ধরিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকত খানিক।

বিলস্নু খালিদ না পারলেও লাফ দিয়েছিল তুঘলক নিজেই।

২০০০ সালে প্রিয়াংকা চোপড়া মিস ওয়ার্ল্ড হলেন, I LOVE YOU ভাইরাস পৃথিবী জুড়ে কম্পিউটারে থাবা বসাল আর তুঘলক শিবুকে সঙ্গে নিয়ে কুরলা স্টেশনে পা ফেলল। তার সারাশরীর ঝনঝন করে উঠেছিল। শিবু গান গায়, ইয়ে বোম্বাই মেরি জান। কানে-কানে বলে, ভাই টাকা-পয়সা সামলে।

তুঘলক পেছনের পকেটে হাত দিয়ে স্টেশন টার্মিনাল পার হয়েছিল।

সে বড়াপাও খেয়ে শহরে মিশে যেতে থাকে। একটা হোটেলে কাজ নেয়। রাতে আবার কুরলায় ফিরে আসে। সেখানে দৈনিক ২০ টাকা দিলে একটা গোডাউনে ১০-১২ জনের সঙ্গে ঘুমানোর বন্দোবস্ত পাকা করা যায়।

তারপর মিডনাইটে সিমেন্টভর্তি ওয়াগন ছুটে গেলে সে নিজের ভেতর কেমন টান অনুভব করে। বুড়ো-বুড়ো, খোঁড়া মানুষগুলোকে দেখলেই ভাবে বিলস্নু খালিদ? একবার ডবল ডেকারে উঠে সে যেন সারা শহরে শুধু বেড়ালের চোখ দেখতে পায়। জ্বলজ্বলে শিকারি চোখ। জুহু বিচের ওপর লাথি কষাচ্ছে। তুঘলক ঠিক করে আর নয়। এবার উলটো লাফ দেওয়ার সময় এসেছে।

সে লাফ দিয়ে যেখানে এলো, সেখানে ততদিনে বুলি সংসার পেতেছে।

– বুলি কে?

অফিসারের প্রশ্ন শুনে তুঘলক এমন চোখে তাকায় যার অর্থ বুলির অস্তিত্ব এক অনন্ত ইতিহাসের পাতায় প্রোথিত রয়েছে। অতএব তার মতো অজ্ঞ ছোকরার কাছ থেকে সেই অস্তিত্বের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে নিতান্তই নাদান পলিসি। কিন্তু তুঘলক বুঝতে ভুল করে। প্রশাসন ব্যাখ্যা চায় না, চায় ফ্যাক্ট। তাই বুলির বর একজন লক-আউট পাট কারখানার শ্রমিক, এটা জানার পরেই অফিসার চমকে ওঠেন। বুঝি কোনো বৃহৎ সত্যের সম্মুখীন হতে চলেছেন তিনি, এই ভেবে, উত্তেজনায় তুঘলককে দু-চারটে চড় কষিয়ে আবার জল খেতে দেন। তুঘলক ডিসাইড করতে পারে না জলটা কি সে গ্লাসে মুখ দিয়ে খাবে? গ্লাস এঁটো করলে আবার মার খাবে না তো? শেষে ঊর্ধ্বতনের মুখ দেখে আর রিস্ক নেয় না। গ্লাস উঁচু করে জল খায়। খানিক জিরোয়। সেই সুযোগে অফিসার চেয়ার থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে আসেন। কনস্টেবল অফিসারের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আহা, এই সময়, অফিসারের বুটের শব্দের সঙ্গে সে কি বেড়ালের পদচালনার কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিল?

সম্ভাবনা বড়ই কম। কেননা বুলির উপস্থিতি তাকে সর্বদাই কাল্পনিক করে তুলত। তার নিজেকে মনে হতো সে যেন লোকাল ট্রেনে পাশের সিটে বসে থাকা সেই লোকটা, যার সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। কিংবা এসব একেবারে ফালতু। তুঘলক সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যে যা ধারণা তৈরি করে ফেলেছি, তা যদি সত্যি হয়, তবে তুঘলকের পক্ষে এই সূক্ষ্মতায় গিয়ে কিছু ভাবা কি আদৌ সম্ভব? আসল কথা হলো, বুলির ওই রকম মোটা গড়ন, ঝুলে যাওয়া বুক, কেলেকুচ্ছিত মুখম-ল দেখে তুঘলক এতটাই মিইয়ে যেত যে, সে ভাবত তার যদি কোনো সহোদরা থাকত তবে সে হতো বুলির মতোই এবং সে তার সেই না-সহোদরাকে কল্পনা করে সমেহনে প্রবৃত্ত হতো প্রায়ই।

তবে এই সময়, যখন অফিসার তার দিকে এগিয়ে আসছেন, এসব কথার উল্লেখ ঘটনাকে লঘু করে দেয় বইকি। তাই এসব কথা আপাতত মুলতবি থাক। বরঞ্চ আমরা ইন্টারোগেশনের দিকে নজর দিই-

– বুলির বরের নাম কী?

– তপন প্রামাণিক।

– কোথাকার জুট মিলে কাজ করত?

– হাওড়া।

– কারখানার নাম কী?

– ডেলটা (পুরোপুরি ঢপ। সে বুঝে গিয়েছিল, কিছু-কিছু সিচুয়েশনে অজ্ঞতাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করা অনুচিত)।

– তুই কোনোদিন কারখানায় গিয়েছিলি?

– না।

– ঠিক করে বল।

– হ্যাঁ।

– কবে?

– অনেকদিন হলো।

– কবে?

– ছয় মাস হবে।

– কী করতে গিয়েছিলি?

– ওখানে ভুখহরতাল হচ্ছিল। আমাকে নিয়ে গেছিল।

– আর কারা ছিল?

– অনেকে।

– অনেকে কারা?

– চিনি না।

– কারা ছিল?

– ওই কারখানায় যারা কাজ করত।

– কী করে জানলি, ওরা কারখানায় কাজ করত?

– বলাবলি করছিল।

– আর কী বলাবলি করছিল?

– কারখানা কবে খুলবে – এসব।

– তুই কেন গিয়েছিলি? (তুঘলক চড় খায়)

– আমাকে নিয়ে গিছিল।

– বুলির বর কোন পার্টি করে?

– জানি না। (কানমলা খায়)

– কোন পার্টি?

– জানি না। (আবার চড়)

– কোন গোপন মিটিংয়ে গিয়েছিলি?

– তুঘলক চুপ।

– চিঠিটা কার জন্য ক্যারি করছিলি?

– চিঠিটা আমার না।

– কে তোকে রিক্রুট করেছিল?

– উত্তর নেই। (পায়ের পাতার ওপর অফিসারের বুট)

– কী লেখা আছে চিঠিটায় জানিস?

– না।

– তোর বাপের নাম কী?

– খালিদ।

– অফিসার হেসে ওঠেন। কনস্টেবলও।

– লাটুয়াগিরিতে কবার গিয়েছিলি?

– যাইনি।

– তপনের সঙ্গে তোর পরিচয় কবে থেকে?

– বছর দুই।

– তপন কোন জুট মিলে কাজ করত?

– তুঘলক আমতা-আমতা করে।

বড়বাবু কনস্টেবলকে ইশারা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। নিজের টেবিলে বসে সিগ্রেট ধরিয়ে ঘোষদাকে জিজ্ঞেস করেন, কী, সাসপিশাস মনে হচ্ছে?

– হাইলি।

অফিসার খানিকক্ষণ চুপচাপ সিগ্রেট খান। যেন নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন। তারপর কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন। ঘোষদা ভ্যাবাচ্যাকা খায়, কী হলো স্যার?

– আচ্ছা বলুন তো এত রকমের কাজকর্ম থাকতে লোকজনে তবু পকেটমারি করতে যায় কেন? ভেরি রিস্কি জব। একটু এধার-ওধার হলেই পাবলিকের কেলানি। তবু কেন?

– ওরা আর কী করবে স্যার। খেটে তো খেতে চায় না।

– তাই?

– আবার কী?

– আর পকেটমার হতে গেলে সব থেকে আগে কী দরকার লাগে?

– হাতসাফাই।

অফিসার হাসেন। যেন তার হাতে তিনটে টেক্কাই এসে গেছে। তিনি আর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে বলেন, ঘোষদা সবসময় পুরনো মডেল কি আর কাজে দেয়?

– বলছেন হাতসাফাই নয়?

– উহু। অফিসার দুদিকে মাথা নেড়ে বলেন, অ্যাসেসমেন্ট। আদারকে অ্যাসেস করতে না পারলে, কোনোদিন পকেটমারি করা যায় না। কার পকেটে কত টাকা আছে, কী সেলফোন আছে… এসব যদি সে অ্যাসেস করতে না শেখে তবে বুঝবে কীভাবে কার পকেটে কখন হাত দিতে হবে? আর আদারকে অ্যাসেস করতে চাওয়াটা একটা নেশা। না হয়তো নেশাও না। প্র্যাকটিস অব নলেজ। কিংবা নলেজের প্যাটার্নটাই হয়তো এটা।

সেসব তো হলো, ঘোষদা এবার প্রবলেমের দিকে চোখ ফেরায়, তা মালটাকে কী করবেন? একে কি পকেটমারই ভাবছেন? আর চিঠিটা? নো লিংক?

– অ্যাবসোলুটলি নো লিংক। অফিসার আড়মোড়া ভেঙে বলেন, যার পকেটে হাত দিয়েছিল চিঠিটা তারই। তারপর বাস থেকে হুড়মুড় করে নামতে গেলে তুমি ওকে ক্যাচ করো।

– মালটাকে ছেড়ে দেবেন?

– রেখে কী লাভ। মাঝখান থেকে হিউম্যান রাইটস ঢুকে গেলে আবার কেলো। তবে এমনভাবে ছাড়তে হবে যাতে ও বুঝতে না পারে ওকে ছাড়া হচ্ছে। কথামতো তুঘলককে লকআপ থেকে বার করতেই অফিসার তাকে সটান চড় কষিয়ে হুমকি দেন, তোর কাছে আর একদিন আছে। কালকের মধ্যেই এই চিঠিটা যার, তাকে এখানে তুই হাজির করাবি। আর না পারলে তুই জানিস আমরা কী করতে পারি। তুঘলক কী বলতে যাচ্ছিল, অফিসার হাত উঁচু করতেই সে থেমে যায়। কনস্টেবল তাকে টেনে থানার বাইরে বার করে দিয়ে আসে।

এতক্ষণে তুঘলককে আমরা প্রায় তার ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে একজন তুঘলক অর্থাৎ পাগলাগোছের কিছু এবং অফিসারকে ধান্ধাবাজ মায় শিক্ষিত বলে ধরে নিয়েছি। এবার ফাঁক-ফোকরের দিকে নজর দেওয়া যাক।

এই যে অফিসার প্রায় নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্তে এলেন তুঘলক একজন ব্যর্থ পকেটমার ছাড়া আর কিছু নয়; তার এই সিদ্ধান্তে আসার প্রসেসটা কি সন্দেহকে অতিক্রান্ত করতে পেরেছে? বিশেষত বোম্বে (মুম্বাই) যাওয়ার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে তুঘলক যখন প্রায় নীরব! শিবুর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী ছিল – আমরা কিন্তু এখনো তা জানি না। তা ছাড়া বুলিদের সঙ্গে তার এই ঘনিষ্ঠতা শুধুই কি গল্পকে একটি আকার দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা! তুঘলক তার মা সম্পর্কে কোনো কিছুই বলে না কেন? উপরোক্ত প্রথম প্যারাগ্রাফেই তুঘলকের বয়ানে ‘শ্রেণিশত্রম্ন’, ‘রাজনৈতিক বিচ্যুতি’ এসবের উল্লেখ ছিল। তবে কি এই শব্দগুলো প্রয়োগ করে আমি কেবলই বাক্যবিন্যাসটিকে সুন্দর করতে চেয়েছিলাম? নাকি তুঘলক সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা দিতে চেয়েছিলাম? তুঘলককে কি আমরা চিনতে পেরেছি? কতটুকু ডিটেইল লিপিবদ্ধ করতে পারলে একটি চরিত্রকে শেষমেশ মনে হয় সে কোথাও না কোথাও, কখনো না কখনো, কোনো না কোনোভাবে উপস্থিত ছিল?

আহা, ওই তো, চড়চাপড় খেয়ে তুঘলকের মুখ ফুলে গিয়েছে। এখন সে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে রাস্তা পেরোচ্ছে। তাকে দেখলে মায়া লাগে।

ঠিক এই মুহূর্তে আমরা জেনে গেছি, সিরিয়ায় সিভিল ওয়ারে ২ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে, ৯০ লাখের বেশি ঘরছাড়া, চীন দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে ফেলেছে, ২০১১ সালে সাউথ সুদান নামের আরো একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে আর এসব কিছু নিয়ে তুঘলক এখন কলকাতার রাস্তায় ভ্যা-ভ্যা করে ঘুরছে।

হাওয়ালাতের ভেতর সেই ১০০ পাওয়ারের বাল্বের গায়ে লেগে থাকা ধুলোর মতোই সে যেন ক্রমশ জেপ্টে থেকে যাচ্ছে। তার ভালো লাগছে না। তবু তাকে থাকতে হচ্ছে। পায়ে ব্যথা তবু সে হাঁটছে। সে প্রতিটা বাসের দিকে সজাগদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বাসের ভেতরকার মানুষগুলোর ভেতর, আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোর ভেতর সে খালি চিঠির মালিকটিকে খোঁজে।

এদিকে বিজ্ঞাপনের আলো, সিগন্যালের আলো, দোকানপাট দিয়ে বেরিয়ে আসা আলো তার চারদিকে যে-পবিত্রতার হুলেস্নাড় তৈরি করেছে, তাতে সে বিরক্ত হয়।

তারপর এভাবে থাকতে-থাকতে তার সব মানুষকেই একই রকম মনে হয়। মনে হয় তাদের সবার মুখ এক। মনে হয় তাদের সবার কাঁধ থেকে ব্যাগ ঝুলছে। এই তো তারা বাসে উঠছে। এই তো তারা বাস থেকে নামছে। কে একজন দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। আর একজন ফোনে কথা বলতে-বলতে বুকপকেট থেকে সিগ্রেট বার করল।

বাড়ি ফেরার গলিটা সরু। শেষ মাথায় একটা স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। সেই আলো সবদিকে সমানভাবে পড়েনি। মধ্যিখানের একটা অংশ তো প্রায় অন্ধকার।

তুঘলকের গা-টা ছমছম করে ওঠে। কেউ বুঝি তাকে ফলো করছে, এই ভেবে সে খালি পেছনে তাকায়। কেউ নেই। নেড়ি কুত্তারা ডেকে উঠল। আবার চুপ করে গেল।

দরজায় টোকা দিতেই তপন দরজা খুলল। পেছনে বুলি।

এদের দেখেই তুঘলকের চোখ দিয়ে আপনাআপনি জল নেমে এলো।

– কোথায় ছিলিস? এ কী অবস্থা তোর!

তুঘলক কোনো উত্তর করল না। তপনের গায়ে হাত দিয়ে খানিক দাঁড়াল। তপন তাকে ঘরে নিয়ে এসে চেয়ারে বসাল।

সে একবার বুলিকে দেখল। তপনের দিকে চোখ ঘোরাল। কিন্তু কাউকেই জানাতে পারল না, অবশেষে চিঠির মালিকটিকে সে চিনে ফেলেছে। 