দগ্ধ চাঁদ ও অচেনা উপগ্রহের গল্প

সাতাশ বছর বয়সী সুদর্শন ও চৌকস যুবক শাকিল রাইয়ান একটি ভালো স্পন্সর পেয়ে প্যারিসের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ৩০ মিনিটের শর্টফিল্মটা নিয়ে গিয়েছিলেন অনেকটা শখের বশেই। তার মানে এই নয়, ফিল্ম নিয়ে তার কোনো উচ্চাশা ছিল না। ভারতের এক ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে দু-বছরের একটি কোর্সও করা আছে। কিন্তু এই সামান্য জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায় নির্মিত তার লাইট ফ্রম দ্য ডার্কনেস মুভিটি যে ওই প্রতিযোগিতায় বেস্ট প্রমিজিং শর্টফিল্ম-মেকারের পুরস্কার এনে দেবে, সেটা ছিল ভাবনার বাইরে। দেশে এই পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটা পত্রিকায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই ছাপা হয়েছিল। আর গোটাতিনেক টিভি চ্যানেল আলাদাভাবে পনেরো-বিশ মিনিটের সাক্ষাৎকার নেয়। এসবে বিশেষ উৎসাহবোধ করায় এবার জমানো অর্থ থেকে প্রায় পনেরো লাখ টাকা ব্যয় করে দু-তিনজন পরিচিত আর্টিস্টকে দিয়ে কাস্টিং করিয়ে বছরখানেক খেটে তিনি দ্বিতীয় ফিল্মটি বানিয়ে ফেললেন। বিষয় ছিল ঢাকাবাসী মধ্যবিত্ত নাগরিক-জীবনের মর্মযন্ত্রণা। তবে এদেশে এ-মুহূর্তে ফিল্ম নিয়ে কাজ করা যে কতটা বিড়ম্বনার বিষয় তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে। বাণিজ্যিক হলগুলো তো এসব ছবির বিষয়ে কোনো আগ্রহই দেখায় না; মফস্বলের টাউন হল, শিল্পকলা একাডেমি, পাবলিক লাইব্রেরিতেও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা সহজ হয়নি। দর্শকের আনাগোনাও বিশেষ সন্তোষজনক ছিল না। ফলে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা দেখা গেল না, উপরন্তু ছবিটা নিয়ে পত্রপত্রিকায় ‘এবার প্রতিশ্রুতিশীল পরিচালক শাকিল রাইয়ান প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন’ প্রভৃতি বলে খানিকটা নেতিবাচক খবরই ছাপা হলো।
তবে কাজের ক্ষেত্রে শাকিল রাইয়ান সহজে ভেঙে পড়ার পাত্র নন। মাসতিনেক কেবল বইপত্র পড়ে কাটিয়ে দিতে দিতে তার মনে হলো, কিছুদিন রেস্ট নেওয়ার পর সম্পূর্ণ নতুন আর চমক-জাগানো কোনো ভাবনা নিয়ে পরবর্তী সিনেমার পরিকল্পনা করতে হবে। প্রেক্ষাপট হবে প্রকৃত বাংলাদেশে – তার জন্মভূমির একেবারে পশ্চাৎপদ কোনো গ্রাম, যেসব গ্রাম সম্পর্কে আমরা বাইরে থেকে জানলেও এর গভীরে ঢুকে তার হৃৎস্পন্দনটি উপলব্ধি করতে চাই না। জন্ম জেলা শহরে হলেও গ্রাম যে তার খুব অচেনা এমন নয়। শাকিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে মা-বাবা সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার পথে এক মর্মান্তিক কার দুর্ঘটনায় মারা গেলে তিনি ভেবেছিলেন, জীবনের কী-বা আর অবশিষ্ট রইল, আর লেখাপড়া করবেন না। মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে, সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্য নিয়ে প্রথম তিন সেমিস্টারে সবার আগের স্থানটা তিনি দখলেই রেখেছিলেন। তারপর মা-বাবা এভাবে চলে যাওয়ায় তার চারপাশ শূন্য ও অর্থহীন হয়ে উঠতে থাকে, তার আকাশের কালো মেঘ সরতে চায় না, ফলে চারপাশের সবকিছুতেই তিনি কেমন নির্বিকার থাকেন। তবু জীবনস্রোতের টানে কোনোমতে ইকোনমিক্সে অনার্সটা শেষ করে ফিল্মের প্রতি বিশেষ আগ্রহবশত পুনেতে চলে যান – কিছু-একটা নিয়ে তো বাঁচতে হবে। বাবা শফিকুর রহমান ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আর মা সরকারি হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। জেলা শহরে দশ কাঠা জায়গার ওপর গাছগাছালি-ঘেরা তিনতলা একটি বড় বাড়ি, ঢাকায় দুটো ফ্ল্যাট আর ব্যাংক ব্যালেন্স যা তারা রেখে গিয়েছেন তাতে এক জীবনে অন্তত
টাকা-কড়ি নিয়ে শাকিলের কোনো ভাবনা থাকার কথা নয়। ফলে আরো দু-চারটা ফিল্ম এমন ফ্লপ হলেও তিনি দিব্যি তার ধকল সামলে নিতে পারবেন। তবে পত্রিকায় আর নেতিবাচক খবরের নায়ক হওয়ার ইচ্ছা তার নেই, এবার এমন একটা কাজ করতে হবে, যাতে দেশের লোকে তাকে নতুন করে চিনতে পারে, এমনকি বিদেশেও পৌঁছোয় তার প্রতিভার সৌরভ। সে-কাজ যে সহজসাধ্য হবে না শাকিলের তা ভালো করেই জানা আছে।
গত এপ্রিলে ব্যাংকক থেকে ঘুরে আসার পর ঢাকায় একটানা ছয়টা মাস কেটে গেল। এই শহরে জীবনটা বোরিং লাগছিল, তাই তিনি ভাবলেন এবার আর বিদেশ-টিদেশ না গিয়ে কিছুদিন পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে কাটিয়ে আসা যাক, ছোটবেলার মফস্বলবাসী বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে কিংবা চেনা-অচেনা গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে মিশে নতুন কোনো আইডিয়া চলে আসাও বিচিত্র কিছু নয়। শাকিলের পরিচিত পৈতৃক গ্রাম তার সামনে নতুন একটা বিশ্ব মেলে ধরতে পারে – রবীন্দ্রনাথ তো বলেই গিয়েছেন – দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া। তাই প্রায় পনেরো মাস পর দুশো কিলোমিটার গাড়ি ড্রাইভ করে শাকিলের আবার মুক্তানগর আসা। প্রথম দিনের অবশিষ্ট সময়টুকু আড্ডা দিয়ে আর বন্ধু ফরহাদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে কেটে গেল। পরদিন শুক্রবারটা তিনি নিজের মতো করে পরিকল্পনা করতে চাইলেন। দুপুরে পুষ্পশোভিত কবরস্থানে গিয়ে মা-বাবার কবর জিয়ারত, রাতে বাইরে কোথাও কিছু খেয়ে নিয়ে ঘরে বসে ল্যাপটপে জার্মানির ফুললেন্থ একটা বিখ্যাত মুভি দেখা। মা-বাবাকে ভেবে মনটা খুব বিষণœ হলেও রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত পরিকল্পনাটা ঠিকঠাকই ছিল। রাতে চতুর্থ তলার ফুডপার্ক রেস্টুরেন্ট থেকে যখন খাবার খেয়ে বেরোচ্ছেন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখা শুক্লপক্ষের উদীয়মান চাঁদটাই দিলো বিপত্তি ঘটিয়ে। আজকের চাঁদটা কী অদ্ভুত মায়াবী, ঢাকা শহরে বিল্ডিংয়ের জঞ্জালের ভেতর চাঁদের এই মায়া থাকে না। কেবল তাই নয়, মুক্তানগর থেকেও তো বহুবার জ্যোৎস্না দেখেছেন তিনি। কিন্তু এখন চাঁদটা দেখে এমন লাগছে কেন – কেমন নেশা-নেশা? আজ ওই মায়াবী চাঁদটার দিকে তাকিয়ে তার অন্যরকম কিছু একটা করার ইচ্ছা হলো, মন বলছে বেপরোয়া হতে, চারদিকের বাঁধন ছিঁড়তে। হেমন্তের বাতাসের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে আসতে আসতে মাথায় পরিকল্পনাটা আসে। এই জ্যোৎস্নারাতে গ্রামে চলে যাওয়া যেতে পারে – হুট করে চলে যাওয়ার মতো গ্রাম তো রয়েছেই, রওনা হতে হবে দ্রুতই। এ-শহরে ‘ছায়ানীড়’ নামক পৈতৃক বাড়ির নিচের দুটো ফ্লোরের চারটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া। আর মা-বাবার স্মৃতিবিজড়িত সব আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো থাকে তৃতীয় তলাটি। সেখানে নিজের ঘরে গিয়ে ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, চায়ের ফ্লাস্ক, গাড়ির চাবি, একটা পাতলা চাদর নিয়ে দ্রুতই নিচে নেমে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। মিনিট পনেরোর মধ্যে শহরের কোলাহল পেরিয়ে তার গাড়ি পেছনে ঝাউগাছের সারি রেখে গ্রামের পথে ছুটতে থাকে। ধান কাটা শেষ হওয়ায় রাস্তার দুপাশের বেশিরভাগ মাঠ ফাঁকা পড়ে আছে। আকাশের ঝুলন্ত বিশাল চাঁদ তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। বাতাসে বুনো ফুল, লতাপাতা, কীটপতঙ্গের বিচিত্র আরণ্যক গন্ধ। রাস্তায় তেমন কোনো মানুষজন নেই। প্রথম কিছু সময় কয়েকটি মোটরসাইকেল চোখে পড়েছিল। এখন এই নির্জনতায় শাকিলের সামান্য ভয় হয় – রাস্তায় বাঁশ বা গাছের গুঁড়ি দিয়ে যদি কেউ তার পথ আটকে দেয়, গলায় ছুরি ধরে মাত্র ছ-মাস আগে কেনা গাড়িটা যদি ছিনিয়ে নেয়! অবশ্য স্নিগ্ধ চাঁদের আলো কিছুক্ষণের মধ্যে সে ভয় ভুলিয়ে দেয়। তখন তার মনে হয়, এই গভীর রাতে চাচার বাড়িতে পৌঁছলে তারা নিশ্চয় খুব অবাক হবেন। শাকিলের বাবা উচ্চশিক্ষিত হলেও চাচা ম্যাট্রিকের গ-ি পেরোতে না পেরে গ্রামে পিতার সম্পত্তিতেই চাষবাস করেন, তাতে তার স্বাচ্ছন্দ্যেই চলে যায়। চাচার তিনটে ছেলেমেয়ে – সবাই শাকিলের বেশ ছোট। তাদের সঙ্গে
ছয়-সাত বছর দেখা নেই। রাতে কাঁচা ঘুম থেকে জাগা চাচি, চাচাতো ভাইবোনদের বিস্ময়মাখা বড় বড় চোখ তিনি যেন দেখতে পান। অনেকক্ষণ থেকে রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা – এখন ক্রমান্বয়ে তার গাড়িটি নির্জনতার গর্ভে ঢুকে পড়ছে। হঠাৎ দু-একটি শেয়াল গাড়ির আলো দেখে ভয় পেয়ে চকিতে রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। কোথাও যেন পেঁচার ডাক শোনা গেল, আরো দূরে একটা তক্ষক ডাকছে। হঠাৎ শাকিলের মনে হলো তার গাড়িটা অত্যন্ত মসৃণ গতিতে চলছে, সামান্যতম ঝাঁকুনিও নেই। এই গ্রামের রাস্তা তো অতটা মসৃণ হওয়ার কথা নয়। তার সাদা গাড়ির যেন শুভ্র দুটি ডানা গজিয়েছে, সে-ডানায় ভর করে মেঘের মতো ভেসে চলেছে বাতাসের টানে, জ্যোৎস্নাময় আকাশে সত্যি সত্যি হালকা কিছু সাদা মেঘ রয়েছে। একবার মনে হলো গাড়ির ডানপাশের গ্লাস খুলে দেখবেন নাকি যথার্থই কোনো মেঘ হাতে ধরা দেয় কি না। ঠিক তখনই মনে হয়, আজগুবি ভাবনাকে এত বেশি প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না, তাহলে সে তার বাড়-বাড়ন্ত রূপ দেখাতে শুরু করবে। তবু খানিক বাদে চারপাশ বড় বেশি এবং অস্বাভাবিক রকমের সুনসান মনে হয়। তবে তিনি কি ভুল পথে অন্য কোথাও চলে এলেন? ঘড়ির কাঁটা রাত প্রায় বারোটার ঘর স্পর্শ করতে চলেছে, তার অর্থ প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন। তার পূর্বপুরুষের ভিটে শহর থেকে কি এতটা পথ? তা তো হওয়ার কথা নয়। এ-কথা যখন ভাবছেন তখন বেশকিছু বাড়িঘর চোখে পড়ে তার। চেনা চেনা লাগে। হ্যাঁ, এটাই তো তাদের গ্রাম – এই নূরনগর গ্রামের মাটিতেই মিশে আছে তার চোদ্দো পুরুষের অস্থিমজ্জা। কিন্তু চারপাশ যে এখনো আশ্চর্যরকম নীরব; শিশুর কান্না, বৃদ্ধের কাশি কোনো আওয়াজই নেই। আকাশে গোলাকৃতি চাঁদটা আলো দিচ্ছে, অন্যথায় টিন আর খড়ে-ছাওয়া বাড়িগুলো ভীষণ অন্ধকার। শাকিল তো জানতেন, বেশ আগেই এই গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে, তবে কি দীর্ঘ লোডশেডিং নাকি কোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা? এবার পথটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে তিনি বাঁদিকে স্টিয়ারিং ঘোরালেন, ডানপাশের পরিচিত তালগাছটা দেখে ভরসা বাড়ে। ওই তো চাচার বাড়ির টিনের নতুন চাল চাঁদের আলোয় চকচক করছে। ওই তো বুড়ো লিচুগাছের নিচে খড়ো চালের সেই পুরনো চৌচালা বৈঠকখানা। তিনি ভেবেছিলেন, গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আর আওয়াজে সবাই জেগে অশেষ কৌতূহলে ছুটে আসবে। কই না, তেমন কোনোকিছুর আভাস না পেয়ে তিনি গাড়ি থেকে নেমে ‘চাচা, চাচা’ – বলে দুবার ডাক দিলেন। আশ্চর্য, কেউ জাগছে না। দরজায় নক করবেন বলে এগিয়ে গিয়ে দেখেন সবগুলো দরজা খোলা, ভেতরে কোনো মানুষজন নেই। কী কা- – এ কী করে সম্ভব? এই গভীর রাতে বাড়িঘর ফেলে রেখে সবাই কোথায় যাবে? আশপাশে কোনো বাড়ি থেকেও তো কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। শাকিল সামান্য ভয়ে ভয়ে খানিক এগিয়ে প্রতিবেশী আরো দু-তিনটি বাড়িতে গিয়ে দেখতে পান সবখানে একই অবস্থা। দরজাগুলো হাট করে খোলা, কোথাও কোনো মানুষের টুঁ-শব্দটি নেই। পুরো গাঁয়ের মানুষ এভাবে হাওয়া হয়ে গেল! এমনকি গৃহপালিত কোনো পশুপাখির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাকে দেখে এক বাড়ির দরজা দিয়ে গোটা-কতক চামচিকা বেরিয়ে এলোমেলো ওড়াউড়ি করতে লাগল। তাহলে এই গ্রাম কি বহুদিন জনশূন্য? কোনো দৈব দুর্বিপাকে পড়ে গ্রাম ছেড়ে গেলে চাচা তাকে এতদিনে জানাবেন না, তা তো হতে পারে না। না, এ-জনবিরল ভূমি তো তার পূর্বপুরুষের ঠিকানা নয়, তিনি কি কোনো ভৌতিক জগতে এসে পড়েছেন? যে-গ্রাম হুবহু তাদের নূরনগরের মতো? নাকি কোনো মায়ার ইশারায় সবকিছু বদলে গিয়েছে মুহূর্তেই? এবার তার ভয়টা বাড়তে থাকে, মনে পড়ে প্রেমিকা নাতাশার কথা। নাতাশাকে তিনি কথা দিয়েছেন আগামী বসন্তে তাদের বিয়ে হবে, হানিমুন গ্রিসে। নাতাশা বলেছে, তাদের প্রথম সন্তান হবে একটা ফুটফুটে মেয়ে – যে হবে বাবার মতো সুন্দর। শাকিলের আরো মনে পড়ে মৃত মা-বাবার ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত মুখ, পাশাপাশি রাখা একজোড়া নিস্তব্ধ খাটিয়া। তখন হঠাৎ নজর যায় পুব আকাশে চাঁদটার দিকে। চাঁদটা এতক্ষণে যতখানি ওপরে ওঠার কথা তা ওঠেনি, প্রায় একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে, এর উজ্জ্বলতা বরং কমেছে, কিছু লঘু সাদা মেঘ হাওয়ায় ভাসছে। সে-সময় শাকিলের দৃষ্টি যায় বিপরীতে পশ্চিম আকাশে, হঠাৎ তিনি চমকে ওঠেন। আরে ওইদিকে তো আর একখানা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তিনি কি ভুল দেখছেন? চোখ কচলে চশমার কাচ ভালো করে মুছে নিয়ে স্পষ্ট দ্বিতীয় চাঁদ দেখতে পান। ওই চাঁদটি আরো বৃহৎ, আরো বেশি উজ্জ্বল; এর জ্যোৎস্নার তীব্রতা অনেকটা চোখ ঝলসে দেওয়ার মতো। তিনি চকিতে আবার প্রথম ও আদি চাঁদটির দিকে তাকান। কী আশ্চর্য – এক আকাশে দুটো চাঁদ? তবে কি শাকিল অন্য কোনো গ্রহে এসে পড়েছেন, যার একাধিক উপগ্রহ রয়েছে? হঠাৎ মনে হলো পুব আকাশের চাঁদটি দৃশ্যমান গতি পেয়েছে, চাঁদটা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে। ক্রমেই গতি বাড়ছে তার। এক মুহূর্তের জন্য শাকিল দ্রুতবেগে ছুটে-আসা চাঁদটা থেকে চোখ সরাতে পারেন না। আরে, ওই চাঁদ পৃথিবীর এই অংশের দিকে মানে একেবারে এই গ্রাম বরাবরই ধাবিত হচ্ছে। একটা সোনার থালার মতো বিশাল পি-টা উল্কার গতিতে ধেয়ে আসছে। এ কীভাবে সম্ভব? তবে কি তিনি কোনো স্বপ্নের মধ্যে নিমজ্জিত আছেন? তখন নিজের হাতের তালুর উলটোদিকে চিমটি কেটে ব্যথা পেয়ে বাস্তবতার নিশ্চয়তা মেলে। সে-সময় সামান্য ঘোরের মধ্যে তার মাথায় অন্য এক ভাবনা খেলে যায়। ধাবমান চাঁদটাকে তো সোনার থালার মতো দেখাচ্ছে, ওটা যে পাবে সে নিশ্চয়ই খুব ভাগ্যবান, রাতারাতি তার সবকিছু বদলে যাবে। আচমকা একটা বড় কাঁসার প্লেটের মতো চাঁদটা টিনের চালে বাড়ি খেয়ে তার থেকে পনেরো-বিশ গজ দূরে ঘরের পেছনে সশব্দে যেন আছড়ে পড়ল। শাকিল আর কিছু ভাবতে পারেন না, চারপাশে এসব কী হচ্ছে – এ কোন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়া গেল? তবে তিনি যদি পৃথিবীতে ছুটে-আসা ক্ষুদ্র রূপ লাভ করা ওই চাঁদটাকে হাতে পান তাহলে রাতারাতি নিশ্চয় খুব ধনী আর বিখ্যাত হয়ে যাবেন। কাল সকালেই তার কাছে শত শত সাংবাদিক ছুটে আসবে। পৃথিবীর সেরা নিউজ চ্যানেলগুলো – বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা তাকে নিয়ে ব্রেকিং নিউজ দেখাতে থাকবে। এসব ভেবে শাকিলের শরীরের লোমগুলো যখন দাঁড়িয়ে গেছে তখন তিনি চাচার টিনের ঘরের পেছনে ছুটে যান চাঁদটা কুড়িয়ে নেবেন বলে। কাছে গিয়ে দেখা যায় একটা প্রমাণ সাইজের কাঁসার প্লেটের চেয়ে খানিকটা বড় থালার মতো অগ্নিকু- জ্বলছে, সেটা থেকে যে-ধোঁয়া বেরোচ্ছে তা চোখে মোটেই জ্বালা ধরায় না। শাকিল আরো দু-পা এগিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন কখন আগুন জ্বলা শেষ হয়। ততক্ষণে পশ্চিম আকাশের বিশাল ও উজ্জ্বল চাঁদটি উজ্জ্বলতর হয়ে প্রায় মাঝ আকাশে চলে এসেছে। আর তখনই খেয়াল হয়, চারদিকের বাতাসে কী আশ্চর্য এক সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে। শাকিলের মনে হয় আকাশে দ্বিতীয় চাঁদের জ্যোৎস্নাই ওই সৌরভের উৎস। চাঁদের আলোরও যে এমন সুবাস থাকে, সে-কথা কে বিশ্বাস করবে? বিজ্ঞান, ভূগোল, এমনকি মহাকাশবিদ্যার যতখানি জ্ঞান তার আছে তাতে আজকের ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। এর পরের মুহূর্তগুলোতে আর কী কী ঘটতে যাচ্ছে তা-ই বা কে জানে? চাকতিটি থেকে ধোঁয়া ওঠা শেষ হলে সেটা অন্ধকারে আর দেখা যায় না। শাকিল ওটার ওপর মোবাইল ফোন থেকে টর্চের আলো ফেলে চমকে যান। কী ব্যাপার, সোনার থালাটাকে এমন কালো দেখাচ্ছে কেন? তিনি ওটাতে হাত দিতে সামান্য উত্তাপ টের পান; কিন্তু ভয়, বেদনা ও হতাশার ব্যাপার হলো ওটার উষ্ণ তলে হাত দিয়ে একদিক ধরে তোলার চেষ্টা করতেই আধখানা ভেঙে পড়ে থাকে শুকনো ধুলোমাটির ওপর। বাকি আধখানা আলোতে নেড়েচেড়ে দেখেন এটা একখ- কয়লার অর্ধবৃত্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। কোথায় গেল তার সেই সোনার থালা – লোকে কি এই কয়লাখ- দেখে বিশ্বাস করবে তার চাঁদ আছড়ে পড়ার গল্প। বললেই তো নিছক উন্মাদ কিংবা নেশাখোর ঠাওরাবে। ততক্ষণে অচেনা চাঁদের আলোর দ্যুতিতে প্লাবন নেমেছে পৃথিবীময়। চারপাশের গাছপালা, আকাশের কতক তারা, কিছু মেঘ দেখে এটাকে স্বপ্নজগৎ ছাড়া আর কিছু বলে ভাবা যাচ্ছে না। এই অতিপ্রাকৃত ঘটনায় এতক্ষণে তো এই গ্রহজুড়ে একটা হইচই পড়ে যাওয়ার কথা। অথচ চারপাশ এখনো কী সুনসান। তার মোবাইলে একটা ফোন পর্যন্ত আসেনি। তাহলে কি তিনি ছাড়া আর কেউ টের পাচ্ছেন না যে, পৃথিবীজুড়ে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে? হঠাৎ এই পার্থিব জীবন, তার প্রেমিকা, সংসার বাঁধার স্বপ্ন, অতীত জীবন, সিনেমা বানিয়ে বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান হওয়ার বাসনা – সবকিছু অর্থহীন-অসার বলে মনে হয়। এখন সবচেয়ে বড় সত্য, হাতের ওই কয়লার চাকতি আর আকাশে অচেনা আশ্চর্য উজ্জ্বল ওই দ্বিতীয় চাঁদ। আগামীকাল রাতে ও দিনে বিশ্বপ্রকৃতি কি রকম আচরণ করবে তা তার জানা নেই। পৃথিবীর আর যে যা-ই বলুক, নিজের চোখে দেখা, উপলব্ধি করা ওই যুগ্ম চাঁদকে তিনি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবেন না। শাকিল চাঁদের পোড়া অংশগুলো প্লাস্টিকের একটা প্যাকেটে পুরে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে রাখেন। রাত বোধহয় আর খুব বেশি বাকি নেই। এখানে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। যে অদ্ভুত কা-ের মধ্যে পড়েছেন তিনি, প্রত্যুষে আবার কোন নতুন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়েন তা কে জানে। নতুন সূর্য ওঠার পরিবর্তে অন্যকিছুও ঘটে যেতে পারে। কাল আবার পৃথিবীর শেষদিন মানে কেয়ামত নয় তো? সেদিন নাকি পশ্চিমদিক থেকে সূর্য উঠবে, চাঁদের কথা তো কোথাও বলা নেই। এই যুগ্ম চাঁদের অদ্ভুত আচরণ তবে কীসের ইঙ্গিত? এখনো এই গাঁয়ে কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই, একটা রাতজাগা পাখির আওয়াজ পর্যন্ত মিলছে না। সময় থাকতে এখান থেকে সরে পড়া ভালো, এই নির্জন গাঁয়ে অবস্থান করে আর কোনো ভৌতিক অভিজ্ঞতা লাভের ইচ্ছা তার নেই। পকেট থেকে কাঁপা-কাঁপা হাতে চাবি হাতড়ে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে মনে হয় হাত-পা বেশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়ে ভাবেন এবার ঠিকঠাকমতো বাড়িতে পৌঁছতে পারলেই হয়। গাড়ি চলছে পশ্চিম বরাবর পিচঢালা চিকন পথ দিয়ে তার বাড়ির দিকে। ঘণ্টাখানেক চলার পর মনে হলো যে, প্রভাতের আলো ফোটার ইঙ্গিত মিলছে। হয়তো খানিক বাদেই সূর্য উঠতে পারে। আরো মিনিটপনেরো পার হলে তার মনের ভয় কেটে গিয়ে আশার সঞ্চার হয়, যদিও সামান্য আশঙ্কা থাকে নতুন দিন, নতুন সূর্যের আকার-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে। হালকা কুয়াশার মধ্যেও সামনের পথ, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, গাছপালা, আকাশ একটু-একটু করে দৃশ্যমান হতে থাকে। পাখির কলকাকলি শুরু হয়েছে বেশ আগেই। সে-সময় শাকিল রাইয়ান আবার নতুন এক সংকটের মধ্যে পড়েন। তার মনে হয় তিনি কোনো অবাস্তব জগৎ থেকে এতক্ষণে সত্যিকারের বাস্তবলোকে প্রবেশ করছেন, নাকি এতখানি সময় যেখানে ছিলেন সেটাই বাস্তব। এখন যেখানে যাচ্ছেন সেটা আসলে প্রকৃত জগৎ নয়, জগতের ছায়ামাত্র! হঠাৎ গাড়িটা রাস্তার পাশের একটা বাবলা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল, শাকিল দক্ষ-হাতে টাল সামলে নেন। মাথাটা যেন তার টলছে, গলাটা শুকিয়ে আসছে। সারারাত জাগলেও, ভীষণ তৃষ্ণা পেলেও একফোঁটা পানি পানের কথা পর্যন্ত এতক্ষণ মনে হয়নি। বাঁহাতে চোখ কচলে নিয়ে পাশের সিটে রাখা বোতলের পানির পুরোটাই ঢকঢক করে শেষ করেন তিনি। এই সকাল যদি সত্যি আবার বাস্তব হয়ে থাকে তাহলে তিনি কি আর কোনোদিন সিনেমা বানাতে পারবেন? আজকের রাতের ঘটনাকে কি চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব? এসব ব্যাপার সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তোলা মোটেই সহজ কাজ নয় – আর লোকে এসব বিশ্বাস করতে যাবে কেন? ফিল্মটা বানানোর পর কেউ পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন বুঝতে না পেরে আজগুবি সব মন্তব্য করতে পারে। সিনে-সাংবাদিকরা লিখতে পারেন নানা কথা, যা তার আস্থা ও বিশ্বাস শেষ করে দেবে। কিন্তু সে যা-ই হোক, এই অদ্ভুত রাতের কী জবাব আছে তার কাছে? তবে কি বিগত কয়েকটি প্রহরের ব্যাখ্যা খুঁজতে খুঁজতেই কেটে যাবে তার অবশিষ্ট জীবন – যেখানে বিচিত্র আর্টফিল্ম কেন, মানুষের গোটা পার্থিব জীবনই একটি গৌণ কিংবা তুচ্ছ বিষয়!