আমরা একে অপরকে প্রায় আঠারোটা বছর ছেড়ে ছিলাম। সবমিলিয়ে আঠারোটা বছর। পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্য জীবনের ভেতরে আঠারোটা বছর ছেড়ে থাকা বা দূরে থাকা তো একেবারে চাট্টিখানি কথা নয়। এখন ভাবলে অবাক লাগে, যে-মানুষটিকে বিয়ের আগে থেকেই একদণ্ড ছেড়ে থাকতে পারতাম না, তাঁকে কীভাবে আমি জীবিত থাকতে আঠারোটা বছর না দেখে ছিলাম? বা থাকতে পেরেছিলাম?
এসব এখন অকল্পনীয় বলে মনে হয়।
কিন্তু মানুষের জীবন মানেই তো এই দূরত্ব। পরস্পর পরস্পরকে যতই কাছে চাই না কেন জীবনের বাস্তবতা মানুষকে টেনে নিয়ে যায় সেই সত্যে যেখানে মানুষ যেন বড় কথা নয়, মানুষের কাজই হচ্ছে বড়। তার বেঁচে থাকার অস্তিত্বের জন্য তার দরকার একটি আইডেন্টিটি, যে-আইডেন্টিটি সে তার কাজ দিয়ে গড়ে নেয়।
আমাদের জীবনও ছিল যেন তেমন।
এখন যখন তিনি অনেক দূরে, যখন কোনো বাংলাদেশ বিমান, বা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বা ইউনাইটেড এমিরেটস তাঁকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে উড়িয়ে আনতে পারবে না, তখন মনে হয়, কীভাবে এরকম বছরের পর বছর আমরা একাকী ছিলাম?
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে আমরা, আমরা ছুঁতে চেয়েছিলাম আকাশের তারা, কল্পনার রথে যেন টগবগ করে ছুটত আমাদের পরিকল্পনা; কিন্তু আমাদের হাত-পাগুলো ছিল মোটা রশি দিয়ে বাঁধা, কর্কশ পৃথিবী অনেক কিছু আমাদের কাছ থেকে আদায় করে নিত, আমরা মনে মনে ক্ষিপ্ত হলেও দাবি পূরণ করতেই হতো, তার কোনো ছাড় ছিল না, তবু আমরা কত যে সুখী ছিলাম! কত যে সরস ছিল জীবনের দিনগুলো।
আবার দুঃখ, অনুশোচনাও ছিল অনেক। অনুশোচনা শুধুই আমার ব্যক্তিগত। তাঁকে আমি কোনোদিন অনুশোচনা করতে দেখিনি। কোনোভাবেই নয়!
কী চেয়েছিলাম আমরা জীবনে? কীভাবে চেয়েছিলাম? কেমন করে চেয়েছিলাম?
সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা মনে হয়, অবান্তর মনে হয়, অসংলগ্ন মনে হয়। আমরা জীবনের কাছে সত্যিই কী চাই, কেউ কি সেটা বলতে পারে? সবকিছুই যেন ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’-এর ভেতরেই ঘুরপাক খায়। যা চাই কিছু পরে তা যেন অবান্তর বলে মনে হয়, আবার যা পাই তাকেও যেন কিছু পরে অবান্তর বলে মনে হয়! কোনো চাওয়া ও পাওয়াতেই কি মানুষের শান্তি আছে?
তিনি যখন বক্তৃতা দিতে ডায়াসে উঠে দেশভাগের পর এদেশের সাহিত্যের কথা বলতেন, বলতেন তাঁর সমসাময়িক সাহিত্যসঙ্গীদের কথা তখন অনেক কিছু আমরা তাঁর মুখ থেকে শুনতে পেতাম। বলতেন, দেশভাগের পর যখন তাঁদের সামনে ছিল না কিছুই, পেছনেও নয়, তখন সেই শূন্যের ভেতরে কীভাবে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা এদেশে সাহিত্যের ভূমি রচনা করেছিলেন। কীভাবে রুক্ষ মাটি কুপিয়ে, কেটে, সার দিয়ে, জলসেচ করে বুনে তুলেছিলেন আধুনিক সাহিত্যের বীজ, দেশের সাহিত্যকে সংযুক্ত করেছিলেন আন্তর্জাতিক সাহিত্যের পরিমণ্ডলে।
শত ঝড়ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও বুকে ধারণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল।
এসবই ছিল তাঁর গর্বের বিষয়।
আরো গর্বের বিষয় ছিল এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। যেহেতু এই স্বাধীনতা ছিল অস্ত্র দিয়ে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতা, কোনো গোলটেবিল বৈঠক করে আনা নয়।
এখন এতো বছর তিনি চলে গেছেন; কিন্তু আমার কাছে এখনো মনে হয়, তিনি যেন তরতাজা জীবন্ত। এমন একটি দিন আমার যায় না যেদিন কেউ না কেউ তাঁর কথা বলে, তাঁর নাম করে, তাঁর লেখা পড়ে, বা তাঁকে আবৃত্তি করে, বা ইউটিউবে তাঁর লেখা গান না গাওয়া হয়।
তখন তাঁকে কাজ করতে দেওয়ার সুযোগের জন্য আঠারোটা বছরের দূরত্ব সব কষ্ট ছাপিয়ে পদ্ম হয়ে ফুটে ওঠে। চোখের অশ্রু দিয়ে সেই পদ্মকে আমি ধুয়ে তুলে রাখি।
কিন্তু তারপরও কথা থাকে। অনেক অনেক কথা। আর সেসব কথা শুধু শূন্যতা দিয়ে ভরা। শূন্যতা আর শূন্যতা। এক শূন্যতার সঙ্গে আরেক শূন্যতার যেন হাজার মাইল দূরত্ব।
যখন কেমো বা রেডিওথেরাপি নিতে যেতেন হাসপাতালে, তখন তাঁর সঙ্গে থাকত শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
মাঝে মাঝে আপনমনে আবৃত্তি করতেন, চুম্বন করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে, তেমন বাসিনি ভালো ভুল হয়ে গেছে!
একবার ভুল হয়ে গেলে মানুষ কি আর তা শুধরে নিতে পারে? ভুলের মাশুল তো বাড়তেই থাকে।
এখন যখন তিনি আর নেই, ছায়াপথে গড়ে নিয়েছেন নতুন আবাস, সেখানে হয়তো শুধুই জ্বলন্ত তারাদের বসবাস; আমি নিঃশব্দে তাঁর পড়ার ঘরে বসে কাজ করি এবং তাঁর আলমারি খুলে যখন দেখি একের পর এক সাজিয়ে রাখা তাঁর বইগুলো, কত কত বই, সেসব বই, বা সেসব লেখার অধিকাংশই হয়তো আমি পড়িনি, তখন বড় অদ্ভুত মনে হয় নিজেকে।
অদ্ভুত এজন্য যে, এই যে তাঁর বই আমি পড়িনি আর তিনি পড়েননি আমার বই, কই, তাতে করে তো আমাদের ভেতরে কোনো কিছুর কমতি ছিল না? কোনো ভুল বোঝাবুঝি ছিল না? আমরা দুজনে দুজনের মতো করে কত সাহিত্যিকের বই-ই না পড়েছি, দেশ-বিদেশের সাহিত্য, আমাদের দেশের সাহিত্য; কিন্তু নিজেরা যেন একে অপরের সাহিত্য সেভাবে পড়িনি! বা সেভাবে যে পড়তে হবে বা পড়ার দরকার – এমনও কখনো মনে হয়নি!
তাহলে এই জীবনটা নিয়ে আমরা কী করলাম?
এখন যেন মনে হয়, জীবনের কর্মকাণ্ডকে আমরা একটি প্রজেক্ট হিসেবে নিয়েছিলাম। পাঁচ বছরমেয়াদি প্রজেক্ট বা দশ বছরমেয়াদি প্রজেক্ট হিসেবে নয়, এ ছিল যেন সারাজীবনের প্রজেক্ট!
এই প্রজেক্ট সফল করার জন্য আমরা যেন দেশ-বিদেশ তোলপাড় করে ফেলেছি। শুধু তাই নয়, আমাদের ভাই-বোন ও ছেলেমেয়েকেও যেন সেই প্রজেক্টের আওতার ভেতরে ফেলে দিয়েছিলাম। আমাদের ছিল কিছু কাজ, বড় নিম্নজাতীয় কাজ, বেঁচে থাকার জন্য যেসব কাজ দরকার হয়, তার বাদে বাকি সময়টা ছিল আমাদের লেখার প্রজেক্ট।
লেখা ভালো কি মন্দ, সেটি একেবারেই বিবেচ্য নয়, লেখা ছিল একটি নেশা, একটি প্যাশন, দৈনন্দিন জীবনের কাদা খোঁড়ার সান্ত্বনা মাশুল। হয়তো এটি সেভাবে বোঝানো যাবে না, এর অনেকখানিই আমার নিজের কাছেই মনে হয় কুহেলিকা।
লেখা আদতেই ছিল আমাদের একটি অবসেশন।
আর অবসেশনকে তো দমিয়ে রাখা যায় না কিছুতে।
এখন দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর চলে গেল, এভাবেই তো দিন যায়, দিনের পর দিন, তিনি এই নশ্বর পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন দীর্ঘ আশিটি বছর, তাঁর দাম্পত্য জীবন ছিল প্রায় পঞ্চাশ বছরের; কিন্তু একটি দিনের জন্যও কি আমাদের মনে হয়েছিল যে, আমরা বড় দীর্ঘদিন বেঁচে আছি? না। কখনো সেটা মনে হতো না। কারণ পৃথিবীর ধারাবাহিকতার সঙ্গেই আমরা লেপ্টে থাকি। এই পৃথিবীটাকে আমাদের এতো আপন এবং এতো বিশ্বস্ত মনে হয় যে, মনে হয়, আমি ছেড়ে দিলেও পৃথিবী তো আমাকে ছাড়বে না! আমাকে তার বুকের ভেতরে জড়িয়ে রেখে দেবে!
তিনি একের পর এক বই লেখার ছক কেটে যেতেন। কবিতার পঙ্ক্তি তাঁর করোটির ভেতরে অনর্গল আঁকিবুঁকি কেটে যেত, তিনি ছক কেটে রাখতেন নতুন সব লেখার। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি ‘ইন সার্চ অব বঙ্গবন্ধু’র ছক কেটে রেখে গেছেন, তিনি বাচ্চাদের নতুন বই কোনটা হবে সে-সম্পর্কে আমার সঙ্গে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আলোচনা করে গেছেন; কিন্তু হায়, কোনোটাই শেষ করে যেতে পারেননি। সব তাঁর করোটির ভেতরেই রয়ে গেল।
একবার হাসপাতাল থেকে কেমোথেরাপি নিয়ে আসার পরে মহাবিরক্ত হয়ে আমাকে বললেন, আমার মাথায় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি উপন্যাস ঘুরঘুর করছে, কেন বলো তো? এখন কি আমার উপন্যাস লেখার সময়?
একদিন বললেন, আমি একটু ভালো হয়ে উঠে মাইকেলের ওপরে একটি নাটক লিখব। একবারে নতুন দৃষ্টিতে। এরকম নাটক আগে লেখা হয়নি!
একবার বললেন, আমরা শরৎচন্দ্রকে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। একটু ভালো হয়ে উঠেই আমাকে কাজটা সারতে হবে!
যখন রাস্তাঘাটে, এমন কি গহিন গ্রামেও ‘জাগো বাহে কোন্ঠে সবাই’ সেøাগান তুলে মানুষ সামনে এসে দাঁড়াত, তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভীতি বা ভালোবাসা দেখতাম, তখন এসব আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই যেন গ্রহণ করতাম! আমার মনে হতো, এতো বছর ধরে লিখছেন, এরকম তো হবেই!
অজানা-অচেনা মানুষ যখন আমাকে ফোন করে তাঁর লেখার, কবিতার, নাটকের, গল্পের প্রশংসা করতেন আর তার পাশাপাশি আমার কর্মজীবনের পেশাদরিত্বের প্রশংসা করতেন, তখন কত সহজেই আমি তাদের বলতে পারতাম, আমি যদি আমার ডাক্তারি লাইনে এতো বছর কাজ করে প্রথম সারিতে আসতে পারি, তাহলে তিনিও তাঁর লেখার লাইনে প্রথম সারিতে আসবেন, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? একজন মানুষ এতোটা বছর ধরে একমনে সাহিত্য করছেন, তাঁর কি কোনো ভক্ত জুটবে না? কোনো পাঠক জুটবে না? কোনো পদবি, পুরস্কার বা সম্মাননা জুটবে না?
অবশ্যই জুটবে। এবং এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তখনো কি আমি সত্যিই জানতাম যে, তিনি কত বড় লেখক যেজন্য মানুষ তাঁর এতো প্রশংসা করে? রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে মানুষ পয়সা নেয় না, গাড়িতে গ্যাস ভরলে পেট্রোল পাম্প বিল করে না, মানুষেরা তাদের শিশুদের সমুখে এগিয়ে দেন তাঁর কবিতা মুখস্থ বলবার জন্য, কখনো তাঁর কাছে বাচ্চা এনে মাথায় হাত রাখতে অনুরোধ করেন। কখনো তাঁর গান বাজে রেডিও-টেলিভিশনে, এসব চলাচলতি, কোনো কিছুই আর যেন গুরুত্বসহকারে দেখা হয় না!
আমার গৃহ ভরে উঠেছে তাঁর প্রতি সম্মানের স্মারকে, তবু আমার মনে হয় না, এগুলোকে মূল্যায়ন করবার দরকার আছে!
আমিও মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে উঠি। জীবনসায়াহ্নে আমার মনে হয় ঘরভর্তি আমার পদক, পদবি, ক্রেস্ট, পুরস্কার, মেডেল। বাউল মন আমার যেন হিমশিম খেয়ে যায়। কীভাবে আমি এসব সামাল দেব? আমার নিজেরই তো শরীর চলে না। আমি যতই যত্ন করি না কেন, তাদের গায়ে তো ধুলো পড়তেই থাকে, আমি মরে গেলে এগুলোর কী অবস্থা হবে?
কে বা কারা আছে আমাদের দেশে যারা এগুলোর মূল্য দেবে?
যখন তিনি একেবারে চলে গেলেন আর দৈনিক খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনামে বড় করে ছাপা হলো তাঁর ছবি, ছাপা হলো তাঁর কবিতা, শোকগ্রস্ত দেশের মানুষ, আমি হতবাক। সামান্য লেখা নিয়ে এতো?
নিজের অজান্তেই যেন আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলাম, নতজানু হয়ে উঠলাম, আমার দেশের প্রতি, দেশবাসীর প্রতি, তাঁর প্রতিও, যে তিনি আমাকে গৌরবের আসনে রেখে চলে গেলেন পরপারে।
যেন আমার শোক প্রশমিত করবার চেষ্টা করে।
যখন আমি মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলতাম, তুমি ঘনঘন কলকাতায় যাও না কেন? পান খেয়ে পিক ফেলতে কলকাতায় যাও না কেন? অনেকেই তো যায়, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করো না কেন? তারাও জানুক যে, তুমি একজন ব্যতিক্রমী লেখক!
আমার কথা শুনে হাত উঠিয়ে নাকচ করে দিয়ে কতদিন বলেছেন, আরে রাখো, তোমার মাথায় শুধু দু-নম্বরি চিন্তা! বলি, নিজের দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছেই আমি পৌঁছোতে পারলাম না!
তাঁর ৭৫তম জন্মদিনে কবি মোহন রায়হান ২৬শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সালে আমাদের সময় কাগজে লিখেছিলেন, ‘বাঙালির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন – মাতৃভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরশাসনবিরোধী অব্যাহত গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, ভয়ংকর মৌলবাদী অন্ধত্বভেদী সাহসী লড়াই – সবকিছুতেই সৈয়দ হকের অপ্রতিরোধ্য মসিযুদ্ধ, চেতনাবারুদ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার অযুত প্রেরণার উৎস হয়েছে। শুধু তাই নয়, কালজয়ী এই শিল্পসত্তা বারবার জীবনবাজি রেখে তাঁর ব্যথিত, দলিত, নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ত্রাতা হয়ে। স্ববোধ, স্বচেতনা, স্বপ্রেমের প্রশ্নে আপোস করেন নি কখনো। তাঁর জনগণমন নিঃসরিত শুভ শুভ্র চেতনার জয় হয়েছে বারবার। দলমত গোষ্ঠীস্বার্থ কিলবিল, ক্লীব, ভীরু দাসানুদাস সমাজে সৈয়দ হক নিরপেক্ষ নন, অজাতশত্রু নন, ঊর্ধ্বে নন বিতর্ক কিংবা সমালোচনার, পছন্দ-অপছন্দের কিংবা অসম্মানের। কিন্তু সৈয়দ হক, সৈয়দ হকই। তাঁর সৃষ্টির বিশাল ব্যাপক আদিগন্ত বিস্তৃতি, শক্তি, ক্ষমতা ও নিপুণতার কাছে সব শত্রুতার উলঙ্গ তরবারি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় আঘাতের পূর্বেই।’
আঠারোটা বছর আমরা একাকী ছিলাম!
জীবনসায়াহ্নে একদিন তিনি বিছানায় শুয়ে গল্প করতে করতে বললেন, তুমি কি জানো, আমরা আমাদের দাম্পত্য জীবনে আঠারোটা বছর আলাদা ছিলাম? শুনে আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। এটা কি সত্যি হতে পারে? তিনি বলেছিলেন, তোমার পাসপোর্ট আর আমার পাসপোর্ট ঘাঁটলেই সব হিসাব বেরিয়ে যাবে!
তারপর বললেন, আর আমরা আলাদা হবো না!
তখন তো আর আলাদা হবার কথাই নয়। কারণ তখন তিনি ঘোরতর অসুস্থ। তাঁর বয়স তখন আশি পূর্ণ হয়েছে। আর আমার মনে পড়ল আমাদের সংগ্রামী জীবনের কথা। আমাদের সংসারজীবন মানুষের দৌরাত্ম্যে ছিন্নভিন্ন হওয়ার কথা।
কিন্তু সবকিছু পায়ে দলে আমরা পরস্পরের প্রতি অনুগত থেকেছি। এই অনুগত থাকার অর্থই হচ্ছে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো। দূরত্ব কোনো কথা নয়, ছেড়ে থাকা কোনো কথা নয়, সাধারণ ঘরের মানুষ আমরা, জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে অনেক বিষ হজম করেই পৌঁছাতে হবে। অনেক বিরূপতা, অনেক হাসিঠাট্টা, অনেক বিদ্রƒপ অগ্রাহ্য করেই হাঁটতে হবে পথ। আর তার সঙ্গে সঙ্গে জীবনকেও কুসুমিত করতে হবে। আর জীবন তো মানুষের একটাই।
আমাদের দুজনের সারাজীবনে কোনো গল্পের তো অভাব হয়নি।
কত হাজারো প্রকারের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে সুচারুভাবে সব পালন করে গেলেন। পরিবারের, তা সে যতই দূরের হোক; বন্ধুদের, তা তাঁরা যত দূরেই থাকুন – জন্মদিনের সবচেয়ে প্রথম টেলিফোনটা হতে হবে তাঁর। সবচেয়ে প্রথম টেলিফোন।
এখন যেন মনে হয় হি ওয়াজ অ্যা কমপ্লিট হিউম্যান বিয়িং।
এখন যখন তিনি নেই, আর তো কেউ কাউকে টেলিফোন দেয় না।
আমাকে ইঙ্গিত করে বলা হয়, কেন আমি তাঁদের জন্মদিন, বিবাহের দিন, স্পেশাল কোনো দিন স্মরণে রাখি না।
আমি রাখি না। কারণ আমি সৈয়দ শামসুল হক নই। আমার পক্ষে এতোসব মনে রাখা সম্ভব নয়। আমি মানুষেরই মুখ বা চেহারা মনে রাখতে পারি না, সেই ছোট্টবেলা থেকে পারি না। এটা আমার স্মৃতি-দুর্বলতা।
এরপরও কীভাবে চলে গেল আমাদের জীবনের পঞ্চাশটি বছর?
কই কখনো তো মনে হয়নি যে, আমরা একে অপরের কাছ থেকে দূরে ছিলাম?
এরকম জীবন্ত একজন মানুষের কাছ থেকে যত দূরেই যাই না কেন, সেই দূরও তো ক্রমে নিকট বলে মনে হয়! তাঁর কথা, হাসি, অবিরাম স্নেহ সমস্ত পরিবার ঘিরেই যেন বয়ে যেত অবিরাম। এমনকি বাড়ির কাজের মানুষেরাও তাঁকে ছেড়ে কোনোদিন যেতে চায়নি।
তিনি নেই। এটি বাস্তব সত্য। এটা আমি না মানলেও কিছু আসে-যায় না। তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের শারীরিক দূরত্ব হতে পারে; কিন্তু জীবনের সঙ্গে জীবনের দূরত্ব আমাদের কোনোদিন তো হয়নি। আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য, আমি যাতে একাকী বোধ না করি, সেজন্য তিনি রেখে গেছেন আলমারিভর্তি তাঁর বই। কত কত বই। কত কবিতা, কত উপন্যাস, কত গল্প, কত নাটক।
তাই আমাদের দুজনের জীবনের সঙ্গে কোনো প্রকারের দূরত্ব তো নেই।
কন্টিনেন্টের দূরত্ব তো আমাদের ধরাশায়ী করতে পারেনি।
ছায়াপথের দূরত্বও নয়।
দূরত্বের ভেতরেই তো তিনি রেখে গেছেন নৈকট্যের কৃচ্ছ্রব্রত।
গতকালই পড়ে শেষ করলাম তাঁর লেখা এক যুবকের ছায়াপথ। সেই কোন যুগে লেখা উপন্যাস, অথচ আমি পড়িনি! এখনো কী বাস্তবভাবেই না তা প্রযোজ্য। আর লেখার বিন্যাস বা দেশভাবনা কত যে আধুনিক, পড়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ইদানীং মন খারাপ লাগলেই আমি তাঁর আলমারির সামনে নত হই। সারি সারি তাঁর বইগুলোর নাম দেখি। আমি জানি, এর যে-কোনো একটি বই খুলে ধরা মাত্রই তিনি হেসে উঠবেন। তিনি প্রীত হবেন। আর আমাকে স্মিত মুখে বলবেন, কেমন, তোমায় বলেছিলাম না?
৮/৯/২১