দৃশ্যকলার বাঁশিওয়ালা

অশোক কর্মকার

ইয়েলো অকার যাঁর প্রিয় রং। সোনালি আভায় উদ্ভাসিত যাঁর ক্যানভাস আর প্রচ্ছদপট। বাংলাদেশের চিত্রকলা আর ব্যবহারিক শিল্পে যাঁর তুলির আঁচড়ে আমাদের রুচির নির্মাণ। তাঁর আঁকা একটি পোস্টার প্রথম দেখি ১৯৭২ সালে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন-প্রকাশিত ‘লাখো শহিদের আত্মদানে মুক্ত স্বদেশ এসো দেশ গড়ি’, অসাধারণ এক পোস্টার – যা আজো আমার চোখে লেগে আছে। তখন আমি স্কুলের ছাত্র। সযত্নে দীর্ঘদিন বাড়িতে এ-পোস্টারটি রেখেছিলাম। স্কুলজীবনে এ-পোস্টারের স্রষ্টার নাম জানতাম না। শুধু ভালো লাগার তাগিদেই তা সংগ্রহ করেছিলাম।

ওই পোস্টারটি ছিল লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে ধ্বংসস্তূপের সামনে ছন্দায়িত একটি মানুষের অবয়ব। ওই অবয়বটি ইয়েলো অকারে আঁকা। টাইপোগ্রাফিও মানুষের ফর্মেরই পরিপূরক হয়ে দেখা দিয়েছে পোস্টারটিতে। বহু বছর পর জেনেছি, এই পোস্টারের স্রষ্টা ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ওই পোস্টার তখনকার বহু তরুণ ও কিশোরকে অনুপ্রাণিত করেছিল দেশকে ভালোবাসতে, দেশের জন্য কাজ করতে।

স্কুলজীবন শেষ করে ১৯৭৯ সালে চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা দিই। মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে স্যারকে প্রথম সচক্ষে দেখি। তারপর ছাত্রজীবনে বহুবার বহুভাবে স্যারের সান্নিধ্যে এসেছি, কাজ দেখেছি, দূর থেকে – কাছ থেকে শিখেছি।

ছাত্রজীবনেই আমি প্রচ্ছদশিল্পের কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। প্রচ্ছদ করা শুরু হয় সাহিত্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মফিদুল ভাইয়ের (মফিদুল হক) সান্নিধ্যে। তখন প্রায়ই প্রচ্ছদ তৈরি করতে গিয়ে প্রচ্ছদের মাপে ভুল করে বসতাম। কখনো কখনো একটি প্রচ্ছদ দুবার ছাপাতে হতো। কিন্তু মফিদুলভাই কখনোই এ নিয়ে রাগ করতেন না। একদিন একটি প্রচ্ছদের প্যাকেট এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটি খুলে ভালো করে দেখো। দেখো কাইয়ুমভাই কীভাবে পরিপাটি করে কাজ করেন।’ দুরু-দুরু বুকে প্যাকেটটি খুলে দেখলাম অসম্ভব যত্ন করে একটি ফোল্ড করা কাগজের ভেতরে অন্য একটি কাগজে আঁকা প্রচ্ছদ পেস্ট করা। তার ওপর একটি ট্রেসিং পেপার। ট্রেসিং পেপারের ওপর কালো কালিতে প্রচ্ছদের টাইপোগ্রাফি আর তারও ওপর আরেকটি ট্রেসিং পেপার। ওই ট্রেসিং পেপারে টাইপোগ্রাফির রঙের সাজেশন দেওয়া। প্রচ্ছদটির চতুর্দিকে কাটিং মার্ক, দুই ফোল্ডের মাঝখানে পুটের মার্ক, দুই ফোল্ডের ভাঁজের মার্ক এমনভাবে দেওয়া, যেন যে-কোনো লোকই অনায়াসে প্রচছদটি প্রসেস করতে পারেন। কোনো বেগ পেতে হবে না। কাজটি ভালো করে দেখে নিলাম এবং শিখে নিলাম প্রচ্ছদ আঁকা ও ছাপার মধ্যবর্তী টেকনিক্যাল কাজটি, যা একজন প্রচ্ছদশিল্পীর জন্য অপরিহার্য। স্যারের অসংখ্য কাজের মাধ্যমে তাঁর পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ প্রভাব ও শিক্ষা আমাদের দেশের বহু প্রচ্ছদশিল্পী ও গ্রাফিক ডিজাইনারকে সমৃদ্ধ করেছে বলেই আমার মনে হয়।

তখনো আমি ছাত্র। স্যার একদিন সন্ধানী অফিসে ডেকে পাঠালেন। সময়মতো উপস্থিত হলাম। স্যার হাতে একটি পান্ডুলিপি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইলাস্ট্রেশন করে দাও। সময় বেশি নিয়ো না।’ ওটি ছিল সন্ধানীর একটি বিশেষ সংখ্যার কাজ। আমি ভেতরে ভেতরে রোমাঞ্চিত! এত বড় একজন শিল্পী, যাঁর ইলাস্ট্রেশনের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকি, তিনি আমায় ইলাস্ট্রেশন করতে দিলেন! পান্ডুলিপি নিয়ে ফিরে আসি। সম্ভবত দুদিনের মাথায় আঁকাগুলো নিয়ে যাই। স্যার খুশিই হয়েছিলেন আমার সময়জ্ঞানের জন্য।

১৯৯৮ সালে প্রথম আলো যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর আগে পরিকল্পনাপর্বে মতিভাই (প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান) স্যারের সঙ্গে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। বৈঠকে মতিভাই স্যার ও শিশিরদার (শিশির ভট্টাচার্য্য) সঙ্গে আমাকে ও শামসুভাইকে (শামসুল হক) ধরিয়ে দিলেন এবং স্যার আমাদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন। প্রথমেই মাস্টহেড। স্যার অনেকগুলো মাস্টহেড বানালেন। তা থেকে তিনটি মাস্টহেড পরবর্তী মিটিংয়ে উপস্থাপন করা হলো। ওই তিনটি থেকে আরো পরিবর্ধন-পরিমার্জন করে একটি মাস্টহেড নির্ধারণ করে যাত্রা শুরু হলো। স্যার ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত ছিলেন একটি ভালো মানের পত্রিকার জন্ম দেওয়ার প্রত্যয়ে, যা তাঁর কথাবার্তা এবং কাজের মধ্যেই প্রকাশ পেত। মনে পড়ে, তখনো আমাদের অফিসের আসবাবপত্র তৈরি চলছে। তার মধ্যে শুধু মতিভাইয়ের জন্য নির্ধারিত রুমটির আংশিক কাজ শেষ হয়েছে। মতিভাই রুমটি ছেড়ে দিলেন আমাদের কাজের জন্য অর্থাৎ পত্রিকার লে-আউট তৈরির জন্য। স্যারের বাসায় করা ছোট ছোট কাগজের লে-আউটগুলোকে বড় ডামিতে রূপান্তর করার কাজটি স্যার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করতেন।

এভাবে পত্রিকার লে-আউট, ফিচার পাতার মাস্ট লে-আউট, পাতার লোগো, আইটেম লোগো, লেটারহেড – একটির পর একটি কাজ তিনি সম্পাদন করতেন। প্রথম আলোর মাস্টহেড ফাইনাল হওয়ার পরও বারবার তা কারেকশন করার তাগিদ আমাকে অবাক করে দিত। প্রথম আলো মাস্টহেডটি পত্রিকা প্রকাশের পরও কয়েকবার স্যার কারেকশন করেছেন, যা তাঁর কাজের অতৃপ্তিরই বহিঃপ্রকাশ। ফিচার পাতার লোগো বহুবার পরিবর্তন করেছেন। প্রতিবারই নতুন নতুন ফর্মের জন্ম দিতেন তিনি। স্যারের কাজগুলোর মধ্যে গোল্লাছুটের প্রথম মাস্টহেডটি ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার হাত ধরাধরি করে দৌড়ে চলার একটি সহজাত ফর্ম তৈরি করেছিলেন এটিতে।

সাহিত্য সাময়িকীর প্রতি এক বিশেষ পক্ষপাত তাঁর লোগোগুলোর মধ্যেই প্রকাশ পেত। অন্য ফিচার পাতার লোগোর টাইপোগ্রাফিতে জ্যামিতির ধারা থাকলেও সাময়িকীর লোগোগুলো ছিল আবহমান বাংলার দোলায়িত ছন্দের প্রতিরূপ। সাহিত্য সাময়িকীর সর্বশেষ লোগোটি তৈরি করার সময় সাদা-কালোতে লেখাটি কোনোভাবেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। ফলে অনেকেরই পছন্দ হচ্ছিল না। স্যার বললেন, আগে রংটা তো হোক। রংগুলো স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে বসাতে শুরু করলেন। প্রতিটা অক্ষরে ভিন্ন ভিন্ন রং দেওয়ার পর লোগোটি অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হলো। দেখে মতিভাই হেসে দিয়ে বললেন, ‘কাইয়ুমভাই কী না পারেন। সাময়িকীটা কাইয়ুমভাইয়ের ভালোবাসার জায়গা।’

স্যার যে-কোনো কাজ করার সময় অনেকগুলো লে-আউট করতেন এবং তা থেকে দু-তিনটি কাজ চূড়ান্ত করতেন। মাঝে মাঝেই স্যার জিজ্ঞাসা করতেন, কোনটা তোমার পছন্দ। আমি প্রথম প্রথম ভয়ে নিরুত্তর থাকতাম। আমার কাছে তো সবকটাই ভালো। কখনো কখনো স্যারের প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলতাম, স্যার সবকটাই নিয়ে যাই। মতিভাই যেটা ভালো বলেন সেটাই করব। এভাবেই স্যারের সঙ্গে কাজ করতে করতে খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। স্যার কাজ শেষ করেই ফোন দিতেন। এসো, কাজ তৈরি আছে। আমি গিয়ে বুঝে নিয়ে আসতাম এবং কম্পিউটারের প্রয়োজনীয় কারিগরি শেষে আবার তা দেখিয়ে নিয়ে আসতাম।

এভাবে যে কতবার কতদিন স্যারের সঙ্গে দেখা হতো তার হিসাব করা যাবে না। রাতে, সকালে, দুপুরে স্যারের বাসার দ্বার ছিল আমার জন্য অবারিত। শত ব্যস্ততার ভেতরেও স্যার আমার ফোন রিসিভ করতেন। কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে থাকলেও ফোন রিসিভ করে বলতেন, তোমাকে পরে ফোন করি। মিটিং শেষ করেই ফোন – অশোক, কী খবর বলো।

পত্রিকার কাজ ছাড়াও ‘প্রথমা প্রকাশন’ নিয়ে স্যারের ভীষণ আগ্রহ ছিল। প্রথমার বইয়ের সিংহভাগ কভার, গেটআপ, মেকআপ স্যারের করা। প্রতিটি কভার ছাপার পরে ওটা নিয়ে আবার ভুলত্রুটি আলোচনা করতেন। বলতেন, এ-ত্রুটিটা ভবিষ্যতে যেন না হয়।

প্রতিচিন্তা আমাদের একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা, যার এযাবৎ প্রতিটি সংখ্যার কভার স্যার এঁকেছেন। প্রতিচিন্তার অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৪ সংখ্যার কভার স্যারের আঁকা সর্বশেষ কভার। সংখ্যাটি স্যার হাতে পাওয়ার পর আমাকে ফোন করলেন, অশোক, কভারে তো ভুল হলো। আমি কেঁপে উঠলাম। বললাম, স্যার কী ভুল হয়েছে? বললেন, প্রতিচিন্তার ‘প্রতি’ লেখাটার মধ্যবর্তী অংশের লাল রংটা বাদ পড়ে গেছে। আমি স্যারকে স্যরি বললাম এবং তখনো বুঝতে পারলাম না, কোথায় ভুল হয়েছে। অফিসে গিয়ে প্রথমায় দৌড়ে গেলাম। কভারটি বের করে দেখলাম। এত সূক্ষ্ম জায়গাটাও এই বয়সে স্যারের চোখ এড়াল না। এরকম অজস্র স্মৃতি আমার মাথা নত করে রেখেছে স্যারের প্রতি।

কর্মক্ষেত্র ছাড়াও বিভিন্ন কাজে আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করতাম। সব ধরনের কাজেই আমার নতুন নতুন শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হতো। আমি দীর্ঘ ১৬ বছর প্রত্যক্ষভাবে স্যারের কাছ থেকে শিখেছি। আর তার আগে পরোক্ষভাবে। এই শেখার শেষ নেই।

টাইপোগ্রাফির মৌলিক যে গ্রামার তা স্যার কাজ করার সময় ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন। এই গ্রামারটা স্যারের সহজাত ছিল বলেই এত অসাধারণ টাইপোগ্রাফি স্যার লিখতে পারতেন। যেভাবেই লিখুন না কেন, তার নান্দনিকতায় সামান্যতমও কমতি থাকত না। স্যারের বিভিন্ন কাজের সমন্বয়ে একটি ভালো গ্রাফিক ডিজাইনের বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করার তাগিদ দিয়েছিলেন মতিভাই। সে-তাগিদ থেকেই স্যার শুরু করেছিলেন কাজগুলো একত্র করার। শেষ পর্যন্ত বইটি শেষ করে যেতে পারেননি। তবে অনেক কিছুই গুছিয়ে রেখে গেছেন। প্রায়ই আমাকে তাঁর সংগ্রহ থেকে বইপত্র এনে দিয়ে কম্পিউটারে স্ক্যান করে রাখতে বলতেন। বলতেন, প্রথম আলোয় প্রকাশিত কাজগুলো গুছিয়ে রাখতে।

স্যারের চলে যাওয়ার আগের কয়েকদিন বেশকিছু কাজ নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমার অফিসে বসে কাজ করেছিলাম। ২৫ নভেম্বর শেষ এসেছিলেন অফিসে। সেদিন স্যারের শরীর একটু খারাপ ছিল। (স্টমাক আপসেট) অফিসে কফি খেতে দিয়েছিলাম। বেশি খেলেন না। কাজ শেষে আমাকে বললেন, চলো তোমাকে নামিয়ে দিই। আমি বিনয়ী হয়ে বললাম, তার দরকার নেই, আমি পরে যাই। তবু জোর করেই নিয়ে গেলেন এবং বললেন, লাজ ফার্মায় ওষুধ কিনব, ওখানে তুমি নেমে যেও। লাজ ফার্মায় ওষুধ কিনে দুটো আইসক্রিম বক্স কিনলেন একটা অতশী ও অতনুর জন্য (শ্যালকের সন্তান) আর একটা আমার ছেলেমেয়ে অংকন ও অদ্বিতীয়ার জন্য। আমি ওখান থেকে আইসক্রিম হাতে বিদায় নিলাম।

৩০ নভেম্বর বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। ওইদিন স্যারের সঙ্গেই আমার যাওয়ার কথা ছিল উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে। স্যারের যাওয়ার আগে ফোন করে বলেছিলাম, স্যার, আমি একটু পরে যাব। রাতে চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনব, তাই শীতের কাপড় নিতে বাসায় যাব এবং এও জানাই যে, জাহিদ রেজা নূরের সঙ্গে ওখানে যাব। স্যার বলেছিলেন, তুমি আসো, আমিও চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনব। কিন্তু ওই বাঁশি আর শোনা হলো না।