ফাগুনের অগ্নিকণা
মনি হায়দার * বেঙ্গল পাবলিকেশন্স * ঢাকা, ২০২৪ ষ ৪৮০ টাকা
বাঙালির আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে দেশভাগ ও ভাষা-আন্দোলন অপরিহার্য অঙ্গ। এই নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। মনি হায়দারের ফাগুনের অগ্নিকণা বইটির বিশেষত্ব হলো, লেখক এই পরিপ্রেক্ষিতে মানব-সম্পর্কের টানাপড়েনের আখ্যান রচনা করেছেন।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’। আমরা দেশভাগের যন্ত্রণার ইতিহাসের সঙ্গেই বেশি পরিচিত। আখ্যানে এমন এক চরিত্রের দেখা পাই যে দেশভাগের সুযোগ নিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছে : ‘১৯৪৮ সালে আমিনউদ্দিন ছিলেন পুলিশের এসআই। কিন্তু ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে কপাল খুলে যায়। হিন্দু পুলিশরা ওই পাড়ে হিজরত করার পর পুলিশের অনেক পদ খালি হয়ে যায়। শূন্য পদ পূরণ আর নতুন সরকার চালানোর জন্য নিচের দিকে পদগুলো দ্রুত উন্নত হতে থাকে। সেই উন্নত হওয়ার সুযোগে এসআই আমিনুদ্দিন প্রমোশন পেয়ে পেয়ে, বড় বড় স্যারদের পেছনে হাত কচলে কচলে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার এসডিপিও হয়ে গেছেন।’
নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেত্রী ইলা মিত্র এপার বাংলার মানুষের স্মৃতিতে প্রায় বিলীয়মান। মনি হায়দারের আখ্যানে তাঁর সংগ্রামী জীবনের ছবি ফুটে ওঠে : ‘ইলা মিত্রের ওপর পাকিস্তান সরকারের নির্মম নির্যাতনের ঘটনা এখনো দগদগে ঘা হয়ে ছড়িয়ে আছে সারা বাংলায়। তেভাগা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানের পুলিশ গ্রেফতার, থানায় নিয়ে ধর্ষণ করেছে, পালাক্রমে। … বর্বর পাকিস্তান পুলিশের এই বর্বরযজ্ঞ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা পড়ে মানুষ স্তম্ভিত হয়েছিল। একজন নারীর যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল গরম ডিম, তাও ইলা মিত্রের মতো একজন নারীকে।’ ১৯৫০ সালে ইলা মিত্রের রাজশাহী আদালতে দেওয়া ঐতিহাসিক জবানবন্দির শেষে আমরা শুনি : ‘কোন অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি।’ এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা জরুরি যে ‘নাচোলের রানী’ ইলা মিত্রের সংগ্রামী ভূমিকার কথা স্মরণ করে সেখানে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ ও সংগ্রহশালা নির্মিত হয়েছে।
আখ্যানের প্রেক্ষাপট হিসেবে লেখক বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে পূর্ববঙ্গের মেয়েদের স্বাধীনতাহীনতার পরিচয় দিয়েছেন : ‘ঢাকা শহরে বা নারায়ণগঞ্জে নারীরা বাসার বাইরে যায় না। গেলেও রিকশা বা ঘোড়ার গাড়ির চারপাশে কালো কাপড়ের ঘের দিয়ে, ঢেকেঢুকে ইজ্জত রক্ষা করে। কোনো নারী একা বাইরে বের হলে পঞ্চায়েত বসে জরিমানা করে ধর্ম বাঁচায়।
মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দেওয়া নারীদের অসম্ভব অবিশ্বাস্য ঘটনা গোটা পাকিস্তানে। সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার জন্ম দিয়েছে কল্যাণী রায় চৌধুরী বা মমতাজ বেগম মিনু, ঢাকার উপকণ্ঠে, নারায়ণগঞ্জে।’
ফাগুনের অগ্নিকণা মূলত রাজশাহীর রঘুনাথপুরের কয়েক পুরুষের জমিদার বংশের সন্তান, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রায় বাহাদুর মহিমচন্দ্র রায়ের মেয়ে কল্যাণী রায় চৌধুরীর সঙ্গে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর কৃষক পরিবারের সন্তান আবদুল মান্নাফের প্রেম-পরিণয়ের আখ্যান। ওপার বাংলা থেকে কলকাতায় ‘আইন’ পড়তে এসেছিলেন মান্নাফ। সেখানেই পরিচয় ও প্রেম কল্যাণীর সঙ্গে। বাবা-মায়ের অমতে ১৯৪৩ সালে কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটের নাখোদা মসজিদে কলেমা পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে মান্নাফকে বিয়ে করে পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জে পাড়ি দেন কল্যাণী ওরফে মমতাজ বেগম মিনু।
নারায়ণগঞ্জের মর্গান গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মিনু জড়িয়ে পড়েন ’৫২-র ভাষা-আন্দোলনে এবং গ্রেফতার হন। তখন আবদুল মান্নাফ ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকারের খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা’। ওপরওয়ালাদের থেকে চাপ আসে। কন্যা ‘খুকু’র কথা বলে মান্নাফ মিনুকে আন্দোলন থেকে সরে আসার জন্য মিনতি করে : ‘ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়েন আবদুল মান্নাফ, সরকার থেকে আমাকে জানিয়েছে, তুমি যদি আন্দোলন বাদ দাও, চাকরি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। চাইলে তোমাকে-আমাকে বড় চাকরি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেবে। গরাদের ওপর রাখা মমতাজের হাতের ওপর হাত রাখেন আবদুল মান্নাফ, তুমি আন্দোলন থেকে ফিরে আসো। সংসারটা বাঁচাও।’ ইলা মিত্রের নির্যাতন স্মরণ করে মান্নাফ শিউরে ওঠেন। কিন্তু মমতাজ বেগম মিনুকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনা যায় না। তিনি মান্নাফকে বলেন : ‘কতগুলো মানুষ জীবন দিয়েছে, তাদের জীবনের কি কোনো মূল্য পাবে না এই দেশ? মর্যাদা পাবে না দেশের ভাষা?’ নারায়ণগঞ্জে মিনুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে প্রবল জনরোষ সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান প্রশাসন রাস্তা অবরোধের মধ্যে প্রিজন ভ্যানে তাঁকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করে। আখ্যানের শেষে পাঠক শোনেন : ‘মমতাজ বেগম মিনু প্রিজন ভ্যানের ছোট গবাক্ষপথে দৃষ্টি রাখছেন, হালকা আলোর মধ্যে পাতা ঝরার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন আর শুনতে পাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষের স্লোগান – রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা – বাংলা চাই বাংলা চাই …’
ফাগুনের অগ্নিকণা বইয়ে দুটো আখ্যান পাশাপাশি চলেছে – পঞ্চাশের দশকের পূর্ববঙ্গের রাজনীতির আখ্যান ও মান্নাফ-মিনুর সম্পর্কের আখ্যান। পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে যে, রাজনীতির আখ্যান ব্যক্তিগত সম্পর্কের আখ্যানকে কোথাও কোথাও ছাপিয়ে গেছে। তবে ফেলে আসা সময় ও সম্পর্কের টানাপড়েনের দলিল হিসেবে বইটি পঠিত হওয়া বিশেষ জরুরি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.